স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ - আবুল মাল আবদুল মুহিত
স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ - আবুল মাল আবদুল মুহিত
ভূমিকা
আমি আমার স্মৃতিকথার দ্বিতীয় খণ্ড ‘স্মৃতিময় কর্মজীবন’ সমাপ্ত করেছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একটি দিনপঞ্জি দিয়ে। তখন আমার বয়স ৩৭ বছর। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ কোনাে বছর আর ছিল না। বিংশ শতাব্দীতে আমরাই একমাত্র দেশ, যেখানে দেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র, রক্তক্ষয়ী ও ব্যাপকভাবে বিধ্বংসী একটি যুদ্ধ করতে হয়। অথচ এটি কোনাে গৃহযুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি লুটেরা, শঠ, নির্মম জনগােষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিপ্রিয়, নির্বিরােধী, নিয়মতান্ত্রিক জনগােষ্ঠীর জীবন-মরণ যুদ্ধ। সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য আমরা মােটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তনে রাতারাতি হয়ে গেলাম দৃঢ়সংকল্প ও দুঃসাহসী এক বীর জাতি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ভূখণ্ড শত্রুমুক্ত হলাে ঠিকই কিন্তু শত্রুরা রেখে গেল ধ্বংসপ্রাপ্ত বিধ্বস্ত একটি দেশ। তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেলাম আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ । আমাদের লক্ষ লক্ষ মা-বােনের ইজ্জত একটি বর্বর দস্যু দলের মতাে হরণ করে বিদায় হলাে তারা। এরপর আমাদের প্রধান কাজ হলাে অর্থনীতির পুনর্বাসন এবং উৎপাদনে দ্রুতগতিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। জনগণের পুনর্বাসনে তেমন অসুবিধা হলাে না, কারণ তারা নিজেরাই সে দায়িত্ব পালন করল।
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যে জর্জরিত; ৬৫ শতাংশ নিরক্ষর। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ফলে আমাদের জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত হলে আমাদের আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল স্বাধীন দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ এবং নতুন উদ্যোগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অন্তর্ভুক্তি।
আমার স্মৃতিকথার এই তৃতীয় খণ্ডে আমি শুধু একাত্তরের কাহিনিই লিখতে বসেছি। তবে তাতে ১৯৭২ সালের স্মৃতিও স্থান পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালে আমি ছিলাম সুদূর আমেরিকায় পাকিস্তান দূতাবাসে ওয়াশিংটনে পদায়িত অর্থনৈতিক কাউন্সেলর। ৩০ জুন সেখানে পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করে আমি
চূড়ান্তভাবে সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে ব্ৰত হই। সে যুদ্ধ কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ ছিল না। সে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল করার জন্য বিশ্ব জনমত সৃষ্টির প্রয়াস এবং পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য সে দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক ঘৃণা ও অসহযােগিতা উদ্রেক করা। সেই উদ্যোগে সহযােগী হন প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালি জনগণ, বন্ধু দেশ ভারতের ডায়াসপােরা এবং সংবেদনশীল মার্কিন জনগণ। সংবাদ মাধ্যম, বুদ্ধিজীবীবৃন্দ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যুবক, কিশাের ও শিক্ষকবৃন্দ এবং অসংখ্য বিবেকতাড়িত মানবতাবাদী সাধারণ মানুষ এতে মূল্যবান ভূমিকা রাখেন।
এ বই এবং স্মৃতিকথার অন্যান্য খণ্ড সম্পাদনা করতে গিয়ে আমি লক্ষ করি। যে অনেক বিষয়ে আমার স্মৃতিনির্ভর বিবরণ যথাযথ হয়নি এবং বেশ কিছু বিষয়ের উল্লেখ বাদ পড়েছে। কালানুক্রমও সঠিকভাবে রক্ষিত হয়নি। স্মৃতি অম্লান : ১৯৭১ বইয়ের এই নতুন সংস্করণে এগুলাে সংশােধিত যথাসাধ্য হলাে।
এ বইয়ের ১৯৯৬ সালের ভূমিকায় আমি বলেছিলাম তদানীন্তন ভােরের কাগজ-এর সম্পাদক মতিউর রহমান বইটি লিখতে আমাকে প্ররােচিত করেন। তাঁরই উদ্যোগে মাত্র চার মাসে অন্যান্য কাজের ফাঁকে আমি বইটি রচনা করি । এবার সে বইয়ের সংশােধিত ও পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণটিও প্রকাশ করছে মতিউর রহমানের প্রথমা প্রকাশন।
১০ অধ্যায়ের গ্রন্থটি এবার বর্ধিত আকারে ১৩ অধ্যায়ের একটি গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। পুরােনাে বইটির আদলই বদলে গেছে। পরিশিষ্ট থেকে চারটি অংশ নতুন একটি অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে। একেবারেই দুটি নতুন অধ্যায় হিসেবে সংযােজিত হয়েছে ১৯৭২ সালের কাহিনি।
প্রায় নতুন এ বই পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি বিশেষ আনন্দবােধ করছি। এটি আমাদের বিজয়ের গাথা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল সময়ের কাহিনি।
আবুল মাল আবদুল মুহিত
ঢাকা
জুলাই ২০১৭
<p style="text-align: justify;"> প্রথম অধ্যায়
অমীমাংসিত দাবি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ যুগে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি, তখনই এই তত্ত্ব ও দাবির সঙ্গে পরিচয় হয়। স্কুলে সে যুগে কোনাে সমাজবিজ্ঞান পড়ানাে হতাে না, তবে নবম-দশম শ্রেণিতে জনপ্রশাসন বলে একটি বিষয় ছিল। বিষয়টি মােটামুটিভাবে সমাজবিজ্ঞানেরই তালিম দিত। কিন্তু রাজনীতি-সচেতন সব ছেলেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে ভাসা-ভাসাভাবে ওয়াকিবহাল ছিল। তখন অবশ্য আরেকটি ব্যাপার ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা ছিলেন অনেক দূরে এবং সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন। কিন্তু প্রাদেশিক মন্ত্রীরা স্কুলে এসেও পুরস্কার বিতরণ করতেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার মােহাম্মদ সাদুল্লার কাছ থেকে একটি পুরস্কার পাবার ঘটনা আমার খুব মনে আছে। মােটের ওপর বােঝা যেত যে স্বায়ত্তশাসনে কাছের লােক ক্ষমতা প্রয়ােগ করবে, তাতে অভিমতের কদর থাকবে এবং এতে যে একটি সমজাতিক গােষ্ঠী ক্ষমতাসীন থাকবে, তাতে কোনাে সংশয়ের অবকাশ ছিল না ।
১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হলাে, আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র—একটি রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে এবং নিজেও বেশ সক্রিয়। আমরা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবী । আমাদের শহরে সরকারবিরােধী অসহযােগ আন্দোলনে ২৪ এপ্রিল তারিখে আলকাস শহীদ হয়েছে। পাকিস্তান নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন। উদারতা, ন্যায়নীতি, স্বাধীনতা আর শ্রীবৃদ্ধি দিয়ে আমরা ভারতকে তাক লাগিয়ে দেব। আমরা খুব সংহত ও ঐক্যবদ্ধ এবং আমাদের নেতা শৃঙ্খলা ও দৃঢ়চিত্ততার প্রতিভূবিশেষ। কিন্তু সেই স্বপ্ন ছিল খুব স্বল্পস্থায়ী ।
১১
বছর যেতে না যেতে নানা বিষয়ে দেশের দুই ভাগের মধ্যে বনিবনায় ফাটল দেখা দিল। আমরা ভেবেছিলাম, আমরা একটি আদর্শ দেশ হব, আমাদের ভৌগােলিক দূরত্ব সত্ত্বেও আমরা শক্তিশালী দেশ হব। আমরা হব অনন্য। কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা এল, প্রতিনিধিত্ব ও ভাষা নিয়ে। তারপর আরও কত কিছু।
সিলেটে শুরু থেকেই আমরা ভাষা নিয়ে ছিলাম বিশেষ তৎপর। এর কারণ বােধ হয় ছিল কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের দশাের্ধ্ব বছরের সাধনা। ১৯৩৬ সালে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন কতিপয় দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল যুবকগণ।
এই প্রতিষ্ঠান একটি প্রগতিশীল, আত্মসচেতন, উন্নতমনা মুসলমান তরুণসমাজ গঠনে ব্রতী হয়। কৈশােরে আমি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হই এবং তরুণ বয়সেই ১৯৫০ সালে এর আজীবন সদস্য হই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার। অব্যবহিত পরই এই প্রতিষ্ঠান দাবি করে বসল যে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে। ১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলাে। স্মরণ থাকে যেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কিন্তু শুরু হয় অনেক পরে, ১৯৪৮-এর জানুয়ারি মাসে। সাহিত্য সংসদ ১৯৪৭-এর ৯ নভেম্বরে একটি আসর ডাকে, যেখানে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুসলিম চৌধুরী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এরপর এ বিষয়ে আরেকটি বড় আলােচনা সভা হয় নভেম্বরের ৩০ তারিখে, যেখানে প্রবন্ধ পাঠ করেন তরুণ সংসদকর্মী হােসেন আহমদ। আর এদিন বিশেষ বক্তব্য দেন। সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও সাহিত্যিক ড. সৈয়দ মুজতবা আলী। এ দুই সভায় সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক মতিন উদ্দিন আহমদ। তার পরও ৮ ডিসেম্বরে আরেক সভা হয় সংসদের সভাপতি শিক্ষাবিদ নজমুল হােসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে । তাতে প্রবন্ধ পাঠ করেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মােহাম্মদ আজরফ । এসব আলােচনা সভার প্রথম দিকে আমাদের বয়সী অনেক তরুণ উপস্থিত ছিল কিন্তু দ্বিতীয় সভায় শহরের সুধীসমাজ ভেঙে পড়ে। তাই বিতর্কে আমাদের উৎসাহ আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪৮-এর প্রদেশব্যাপী ভাষা আন্দোলন তাই আমাদের একটু বেশি করেই দোলা দেয়।
১৯৪৭-এর আগে আমাদের আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের জন্য। ১৯৪৮-এ আন্দোলন শুরু হলাে অন্য বিষয় নিয়ে, অন্য মাত্রায়, অন্য রকমের। ভাষা আন্দোলন ছাড়া আরও অনেক বিষয় হয়ে উঠল গুরুত্বপূর্ণ। দেশরক্ষার জন্য বিরাট খরচ হয় কিন্তু পূর্ব বাংলা তাতে অংশীদার নয়। দেশরক্ষা যদি গুরুত্বপূর্ণই হবে, তবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্যই তাে তা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের খরচ জোগানাের জন্য রাজস্ব চাই কিন্তু প্রাদেশিক যে দু-একটি সূত্রে রাজস্ব আদায় হয়, সেগুলাের ওপর এত চাপ কেন? ব্রিটিশ আমলে প্রাদেশিক একটি
১২
উল্লেখযােগ্য রাজস্ব সূত্র ছিল বিক্রয় কর। পাকিস্তানের শুরুতেই কেন্দ্রীয় সরকার এই সূত্রটিকে প্রদেশের হাত থেকে কেন্দ্রে নিয়ে গেল । শিল্পোন্নয়ন হবে মানুষের সুখের জন্য, সে দায়িত্ব তাে প্রাদেশিক সরকারের। সেটা প্রদেশের হাত থেকে কেন কেন্দ্র নিয়ে যাবে? কেন্দ্র তাে আমাদের অনেক দূরে, সেখানে আমাদের প্রতিনিধিও কম। মন্ত্রী তাে প্রায় নেই। শিক্ষার মাধ্যম তাে আমাদের ব্যাপার, ভাষার স্বীকৃতি আমাদের অধিকার। এসব বিষয়ে প্রথমে যৎসামান্য এবং কালক্রমে জোরালাে সমালােচনায় সুধীমহল মুখর হয়ে উঠল। তারই ফলে এবার স্বায়ত্তশাসন আলােচনার মঞ্চ থেকে আন্দোলনের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। বিষয়টি গুরুতর আকার ধারণ করল যখন সংবিধান প্রণয়নের জন্য মূলনীতি কমিটি তাদের সুপারিশ পেশ করল।
১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নভেম্বর ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে সরকারবিরােধী সব গােষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণসমাজ, মূলনীতি কমিটির সুপারিশের ওপর এক মহাসম্মেলনের আয়ােজন করে। আমি তখন সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজের ছাত্র। আমরা প্রাদেশিক নানা ছাত্রসংগঠনের ওপর বীতশ্রদ্ধ, কোনােটাই পছন্দের নয়। তাই ১৯৫০ সালে দাঙ্গার পর, বােধ হয় ফেব্রুয়ারি কি মার্চে, একটি নির্দলীয় প্রগতিশীল শিক্ষা সমিতি সংগঠন করি। যেকোনাে সমস্যার মােকাবিলা করতে আমরা এগিয়ে যেতাম কিন্তু আমাদের মতামত ছিল আমাদের নিজস্ব কোনাে কেন্দ্রীয় সংগঠনের নির্দেশের আমরা তােয়াক্কা করতাম না। এই সমিতির আহ্বায়ক হিসেবে আমি ঢাকার মহাসম্মেলনে যাই সিলেটের প্রতিনিধি হিসেবে। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান, পরবর্তী সময়ে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে এরশাদের আমলে কিছুদিন প্রধানমন্ত্রী। এই মহাসম্মেলনের প্রধান সুপারিশ হয় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ফেডারেল সরকার হবে সীমিত ক্ষমতার, তার রাজস্ব আদায় হবে পূর্বনির্ধারিত খাতে আর তার দায়িত্ব হবে মাত্র দুটি বিষয়ে, যথা পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা (সেখানেও আঞ্চলিক স্বয়ম্ভরতা গড়ে তুলতে হবে)।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে সরকারবিরােধীরা বানাল যুক্তফ্রন্ট আর ঘােষণা করল একুশ দফার নির্বাচনী কর্মসূচি। এই কর্মসূচির ১৯ ধারায় দাবি করা হলাে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। ফেডারেল কর্তৃত্ব হবে তিনটি বিষয়ে—পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও মুদ্রা। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে সংবিধান রচনাকালে স্বায়ত্তশাসন নিয়ে চলে জোরালাে বিতর্ক। এই তিন বিষয়ের বাইরে ফেডারেল কর্তৃত্ব হয় প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর, ভারী শিল্পের ওপর, আর্থিক খাতের ওপর এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর। পূর্ব বাংলার ৪০ জনের মধ্যে ২৩ জন গণপরিষদ সদস্য এই সংবিধানের পক্ষে ভােটদানে
১৩
বিরত থাকেন। তাঁদের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল যথাযথ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব । এ ছাড়া আরও আপত্তি ছিল, যেমন যুক্ত নির্বাচন সম্বন্ধে সিদ্ধান্তহীনতা, পশ্চিমে এক ইউনিট স্থাপন এবং রাষ্ট্রপতির অত্যধিক স্ববিবেচনার ক্ষমতা। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যে সংবিধান পাস হলাে, তাতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কিছুটা খর্ব হলেও ফেডারেল সরকার ছিল সীমিত ক্ষমতার । এ নিয়ে ছাত্র মহলে দুই রকম চিন্তাধারা ছিল । নয় বছরে সংবিধান রচিত হয়েছে এবং সত্যিকার অর্থে প্রথম জাতীয় পরিষদ গঠিত হতে যাচ্ছে। বলে অনেকেই খুশি হন। নির্বাচনের প্রস্তুতি তখন চলছে এবং ১৯৫৭-তে তা অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘােষণা দেওয়া হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রভাবে ছাত্রলীগ এই সংবিধান গ্রহণ করল না। তখন সলিমুল্লাহ হল ইউনিয়নে ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব বহাল ছিল । সহসভাপতি ছিলেন ইব্রাহিম তাহা এবং সাধারণ সম্পাদক এ টি এম শামসুল হক। দুজনই ছাত্রলীগের প্রতিনিধি। ২৩ মার্চে সংবিধান। দিবস পালনে তাঁদের সায় নেই কিন্তু ছাত্রসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ উৎসব উদ্যাপন করতে চায়। তাই একটি বিশেষ কমিটির হাতে এই উৎসব উদ্যাপনের ভার দিল হল ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ। সেই বিশেষ কমিটির আহ্বায়ক হই আমি। সলিমুল্লাহ হলে আমরা চমৎকার আলােকসজ্জার ব্যবস্থা করি । একটি আতশবাজি জ্বালাতে গিয়ে আমার বাঁ হাতের খানিকটা পুড়ে যায় বলে উৎসবটির কথা বিশেষ করে মনে আছে।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন বহাল হলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে যবনিকা পড়ল। আইয়ুব খান ‘ফেডারেল সরকারের নাম পরিবর্তন করে তার নাম দেন ‘কেন্দ্রীয় সরকার। তারপর তিনি রাজকীয় কায়দায় একটি সংবিধান দিলেন, যেখানে সারা দেশে প্রতিষ্ঠা করা হলাে ‘শাসনতান্ত্রিক একনায়কত্ব। এতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন শিকেয় উঠল। প্রদেশের সমুদয় ক্ষমতা ন্যস্ত হলাে রাষ্ট্রপতির একান্ত অনুগত তারই নিযুক্ত প্রদেশপালের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকারের সব ক্ষমতার উৎস হলেন পরােক্ষ নির্বাচনে পার পেয়ে যাওয়া রাষ্ট্রপতি আর মন্ত্রিসভা অথবা জাতীয় পরিষদ হলাে তার বশংবদ। এই ব্যবস্থার প্রতিবাদে আবার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন জোরদার হলাে। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগের ১১ দফা মূলতই ছিল স্বায়ত্তশাসনের সনদ, অবশ্য তখন সামরিক শাসনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক সরকারব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণ ছিল মুখ্য বিষয়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে শাসনতান্ত্রিক একনায়ক লিপ্ত হলেন ১৭ দিনের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে। এ যুদ্ধই আইয়ুব খানকে শেষ করল এবং খলনায়ক ভুট্টোকে রঙ্গমঞ্চে নিয়ে এল। তবে এ যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে আরও জোরালাে করল। মনে রাখা ভালাে যে ব্রিটিশ
১৪
শাসনের অবসানে আমাদের দেশের নাম হয় পূর্ববাংলা। তবে পাকিস্তানের। শাসনতন্ত্র ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চে এই নাম পরিবর্তন করে রাখল পূর্ব পাকিস্তান। যুদ্ধকালে আমাদের বিচ্ছিন্ন ও অসহায় অবস্থান সবার কাছে ধরা পড়ে। যুদ্ধ শেষে লাহােরে এক সম্মেলনে বসলেন আইয়ুববিরােধী নেতারা। তাঁদের আলােচনার বিষয় ছিল কাশ্মীর সমস্যা এবং যুদ্ধোত্তর রাজনীতি। কিন্তু এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সমস্যার দিকে নজর দিতে কেউ রাজি হলেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আবির্ভাব হয় আমাদের বাঁচবার সনদ ছয় দফা কার্যক্রম।
ছয় দফার পাঁচটি দফাই ছিল স্বায়ত্তশাসন নিয়ে। প্রথম দফায় ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি। প্রত্যক্ষ ভােটে ফেডারেল সংসদীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল এক নম্বর দফা। এক ব্যক্তি এক ভােটের ব্যবস্থা করে সমতার নামে যে ধোকাবাজি চলছিল, তাকে বিসর্জন দিতে হবে। দুই নম্বর দফায় সেই পুরােনাে দাবি, ফেডারেল সরকারের কর্তৃত্ব হবে পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা বিষয়ে, সামনে আসলাে। তিন নম্বর দফায় ছিল প্রদেশের রাজস্ব ক্ষমতা। ফেডারেল সরকারের খরচ প্রদেশগুলাে জোগাবে কিন্তু সমুদয় রাজস্ব সূত্র হবে প্রাদেশিক সরকারের। চার নম্বর দফায় ছিল বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব থাকবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য হবে আঞ্চলিক সরকারের দায়িত্ব। ছয় নম্বরে ছিল পুরােনাে দাবি, অর্থাৎ আঞ্চলিক দেশরক্ষার ক্ষমতা গড়ে তােলা এবং এ জন্য আঞ্চলিক বাহিনী গঠন। ছয় দফার প্রথম দফা নিয়ে ঝগড়া বেশি দিন স্থায়ী হলাে না কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের দফাগুলাে অমীমাংসিত থেকে গেল এবং এরই মীমাংসা পাওয়া গেল মুক্তিযুদ্ধে।
১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহােরে এক সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফার প্রথম ঘােষণা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের পরবর্তী কাউন্সিল সভায় ১৯ মার্চ এই কার্যক্রম গৃহীত হয় এবং শেখ মুজিব হন দলের সভাপতি। কিন্তু কদিনের মধ্যেই ৫ মে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং বন্দী অবস্থায়ই ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারিতে হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি। এই মামলা খারিজ হয় ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যান রাওয়ালপিন্ডির গােলটেবিল বৈঠকে আগামী দিনের সংবিধানের রূপরেখা নির্ধারণ করতে। গােলটেবিল বৈঠক শেষ হলাে ১৪ মার্চে কিন্তু সংবিধানের রূপরেখা ঠিক হলাে না। সেই ছাত্রাবস্থায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন করেছি। এবারে ১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করি একজন সরকারি আমলা হিসেবে।
১৫
আমি তখন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভা বিভাগের উপসচিব। সে সময় সরকারের কলেবর অনেক ছােট ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীর সংখ্যা ১২-১৪ জনের বেশি ছিল না। মন্ত্রিসভা বিভাগে ছিলেন একজন সচিব এবং গােটা ১০ জন শাখাপ্রধানসহ (বর্তমানের সহকারী সচিব) দুজন উপসচিব। ১৯৬৮ সালের শেষে ওয়াশিংটনে দূতাবাসে পরবর্তী চাকরিতে যাব বলে আমি মন্ত্রিসভা বিভাগে পাততাড়ি গুটাচ্ছি। অন্তত তিন বছরের জন্য ওয়াশিংটন যাচ্ছি, সুতরাং তার আগে লম্বা ছুটি দেশে কাটাব বলে আগেভাগেই তৈরি হচ্ছি। কিন্তু গােলটেবিল বৈঠকের সম্ভাবনা আমার ছুটি নাকচ করে দিল। যথাসময়ে আমার ওপর হুকুম হলাে যে আমাকে পিন্ডি প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং বৈঠকের সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের দেখভাল করতে হবে। ফিরে গিয়ে আমাকে আমারই পুরােনাে বাড়িতে যেতে হলাে। তবে এবার বন্ধুবর গােলাম মােস্তফার অতিথি হিসেবে। সে আমার উত্তরসূরি হিসেবে মনােনীত হয়েছে বলে আমি বাড়ি ছেড়ে দিই এবং তারা ততক্ষণে সেখানে পুরােদস্তুর বহাল হয়ে গেছে। পরবর্তী পাচ মাসের মতাে ওই বাড়িতে আমি আমার বন্ধু ও উত্তরসূরির অতিথি কামরায়। আস্তানা গাড়ি।
গােলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা পিন্ডির পূর্ব পাকিস্তান হাউস ও পশ্চিম পাকিস্তান হাউসে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে রােজই দেখা হতাে, আলাপ হতাে। সরকারি দলের বেশির ভাগ প্রতিনিধিও নানা কাজে ডাকতেন বলে তাঁদের সঙ্গেও আলাপ-আলােচনা হতাে। গণতন্ত্রায়ণের বিধান নিয়ে কোনাে সমস্যা ছিল না, তবে স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে অনেক বাধাবিপত্তি। আমার নিজের ধারণা হয় যে প্রতিরক্ষা ও রাজস্ব বিষয়ে ফেডারেল সরকারকে আরও ক্ষমতা দিলে বাকি বিষয়ে ছয় দফার ভিত্তিতে একটি সমঝােতা হতে পারে। কিন্তু গােলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলাে সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষের জন্য। তারা ক্ষমতা ছাড়তে মােটেই রাজি ছিল না। আইয়ুব যেতে পারেন কিন্তু সামরিক শক্তি দখলদারি ছাড়বে না, আর তাঁদের মদদ দেন। কতিপয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ—পশ্চিমের জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পূর্বের মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আর আমলাতন্ত্র প্রায় সম্পূর্ণভাবে ছিল সামরিক শক্তির দোসর। জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আসীন হলেন, ওপর স্তরে সব তছনছ হয়ে গেল কিন্তু আমাদের স্তরে সবার ছুটিছাটা বা বদলি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেল। অবশেষে মাসখানেক ছুটি নিয়ে আগস্টের মাঝামাঝি আমি আমেরিকায় পাড়ি দিলাম—ওয়াশিংটনে দূতাবাসে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর হিসেবে। পাকিস্তান সরকারের আমলা হিসেবে এই ছিল আমার শেষ পদ।
আমি পাকিস্তান ছাড়ার প্রাক্কালে ইয়াহিয়া রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সুপারিশ আহ্বান করেন এবং একই সময়ে একটি বেসামরিক মন্ত্রিসভা গঠন
১৬
করেন। হামিদুল হক চৌধুরী তখন প্রায়ই ওয়াশিংটনে যেতেন, সেখানে তাঁর মেয়ে এবং অসুস্থ জামাতা ছিলেন। তিনি গেলে সব সময়ই তাঁর সঙ্গে আলাপআলােচনা হতাে। তার মুখেই প্রথম জেনারেল ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য উদ্যোগের কথা শুনলাম। তিনি যথার্থই ইয়াহিয়ার বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। চৌধুরী বললেন যে রাজনীতিবিদদের সময় বেঁধে দিয়ে সংলাপে বসিয়ে দিলে সমাধান একটি বেরিয়ে আসবেই, ১২০ দিনে জাতীয় পরিষদ একটি সংবিধান রচনা করতে সক্ষম হবে। এর কিছুদিন পরই ইয়াহিয়া ২৮ নভেম্বরের ঘােষণায় জানালেন যে ১. এক ইউনিট ভেঙে দেওয়া হবে, ২. প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং সংবিধান প্রণয়নের ব্যবস্থা হবে। ১৯৭০-এর ৩০ মার্চ জারি হলাে দুটো আদেশনামা। প্রথম আদেশে এক ইউনিট ভেঙে চার প্রদেশ ও এক ফেডারেল এলাকা হলাে পশ্চিম পাকিস্তানে। দ্বিতীয় আদেশে ১৬৯ জন পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যসহ ৩১৩ সদস্যের এক জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ দেওয়া হলাে ৫ অক্টোবর। একই সঙ্গে প্রাদেশিক পরিষদগুলােরও নির্বাচনের ব্যবস্থা নেওয়া হলাে। জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে বসে ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করবে আর প্রেসিডেন্ট তা অনুমােদন করবেন। স্বায়ত্তশাসন। সম্বন্ধে কোনাে স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা এতে ছিল না। আরও মজার ব্যাপার হলাে যে পশ্চিমের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি ছয় দফা সম্বন্ধে কোনাে বক্তব্যই দিল না। পশ্চিমের সবাই-রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী মায় সাংবাদিক গােষ্ঠী—মােটামুটিভাবে ছয় দফাকে অবহেলা করে গেল, যেন স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি মােটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা প্রায় চার বছর ধরে লােকমুখে, মাঠেঘাটে সর্বত্র। এই হিসাবে ছয় দফা বাঙালিদের ম্যাগনাকার্টার আসন নিয়েছে।
১৯৬৯-৭০ সালে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কাজে অথবা ভ্রমণে আসেন এবং তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনার খানিকটা সুযােগ আমার হয়। প্রথমেই এলেন অর্থমন্ত্রী নবাব মােজাফফর আলী কিজিলবাস। একবার এলেন তথ্য বা প্রচারমন্ত্রী জেনারেল শের আলী। আবার এলেন প্রখ্যাত আমলা পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্টের সভাপতি আজিজ আহমদ। আর একবার এলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার আবদুর রশিদ। জাতিসংঘের ২৫তম অধিবেশনে যােগ দিতে এলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি ওয়াশিংটনেও এলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনার জন্য।
পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্ক নিয়ে জেনারেল শের আলীর কোনাে মাথাব্যথাই ছিল না। তাঁর মতে, সমস্যা ছিল বিবদমান রাজনীতিবিদদের নিয়ে, তাঁরা দেশ শাসনে অপরিপক্ক। সদিচ্ছা থাকলেও যােগ্যতা নেই এবং বিশেষ করে শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ
১৭
নেই। কিন্তু তাঁদের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। কারণ, তারা জনগণের কাছের লােক আর তাদের প্রতিনিধি। তবে সামরিক বাহিনী তাদের প্রতি কড়া নজর রাখবে। তিনি একটি চমৎকার উপমা ব্যবহার করে তাঁর ধারণাটি বিশ্লেষণ করেন। একধরনের প্রেটোরিয়ান গার্ডদের ভূমিকা ছিল তাঁর আদর্শ। বন্যায় নদীর পাড় যাতে না ভাঙে, সে জন্য বাঁধ দেওয়া হয় এবং চাপ বেশি হলে বাধকে মজবুত করা হয়। বাঁধ মজবুত করা মানে পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। রাজনীতিবিদেরা দেশ পরিচালনা করতে পারেন, তবে বাধ গড়ে দেবে সামরিক বাহিনী এবং প্রয়ােজনে সময়ে সময়ে তারা তা মজবুত করে দেবে। শের আলী বস্তুতই সামরিক বাহিনীর দেশ শাসনের ঐশী ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন বলে আমার মনে হয়। জেনারেল শের আলীকে আমি তত চিনতাম না। কারণ, তিনি বহুদিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিদেশে অবস্থান করেন। লাহােরে আমি যখন সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণে, তখন তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তখনাে তিনি কোনাে দেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তবে তার একটি ঘােড়া ছিল আমাদের একাডেমির আস্তাবলে । ঘােড়াটি ছিল বয়স্ক ও বেয়াড়া, কামড় দিত, কিন্তু আবার খুব তেজি এবং পলাে খেলায় অভ্যস্ত ছিল। এই ঘােড়াটিকে অনেকেই এড়িয়ে যেত কিন্তু এটি ছিল আমার প্রিয় এবং ঘােড়াটির সঙ্গে আমার একধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। এই ঘােড়ার সহিসের বদৌলতে জেনারেল শের আলীর সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হবার সুযােগ হয়। রাজনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ প্রথম ও শেষবারের মতাে হয় ওয়াশিংটনে। শের আলী কিছুদিন পরই পদত্যাগ করেন। তিনি নাকি অবাধ নির্বাচনের ঘাের বিরােধী ছিলেন বলেই মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নেন।
আজিজ আহমদ যখন ওয়াশিংটনে আসেন, তখন তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ওয়াশিংটন তাঁর অতিপরিচিত জায়গা। তিনি ওখানে রাষ্ট্রদূত ছিলেন একসময়। তারপর পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে ওয়াশিংটনে তার জানাশােনা ছিল বিস্তর। তিনি অবিভক্ত বাংলায় তার চাকরিজীবন শুরু করেন এবং মহকুমা ও জেলা হাকিম হিসেবে খুবই দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি ওই সময়ে ঋণ সালিসের পরীক্ষামূলক নানা উদ্যোগ নেন। জনশ্রুতি ছিল যে শেরেবাংলার ঋণ সালিস বাের্ডের আইন তাঁরই পরীক্ষামূলক উদ্যোগ থেকে উদ্ভূত। পূর্ব বাংলায় তিনি হন প্রথম মুখ্য সচিব, তখন তার অভিজ্ঞতা মাত্র ১৭ বছরের এবং জ্যেষ্ঠতায় তিনি সর্বোচ্চ ছিলেন না (টি আই এম নুরুন্নবী চৌধুরী ছিলেন তার চেয়ে জ্যেষ্ঠ)। তাঁর সম্বন্ধে জানা যায় যে তিনি প্রাদেশিক মন্ত্রীদের কার্যাবলি সম্বন্ধে গােপন প্রতিবেদন। কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতেন। তিনি পাকিস্তান মন্ত্রিসভা বিভাগের একজন সুযােগ্য সচিব ছিলেন। প্রথম যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়, তখন একমাত্র
১৮
বেসামরিক অফিসার হিসেবে তিনি হন উপপ্রধান সামরিক প্রশাসকদের একজন। তিনি যখন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস সমিতির সভাপতি (বােধ হয় ১৯৬৬ সালে। কিছুদিন), তখন আমি ছিলাম এই সমিতির সম্পাদক। পূর্ব বাংলায় অনেক পাকিস্তানি, যারা তার সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁরা মনে করতেন যে প্রাদেশিকতার বিষবৃক্ষ রােপণে তাঁর অবদান ছিল মুখ্য। বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ ব্যবহারের প্রতিভূ হিসেবে অনেকেই তাকে দোষারােপ করতেন।
তাঁকে প্রথম দেখি ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে, যেদিন সলিমুল্লাহ হলে ঢাকা সিটির পুলিশ সুপার খুনি মাসুদ মামুন প্রবেশ করে অনেক কামরার দরজা-জানালা ভেঙে প্রায় ২৭ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। যখন মাসুদ মামুন তার ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তখন হলের অবস্থা দেখতে তার পেছনে পেছনে আসেন মুখ্য সচিব আজিজ আহমদ, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার নিয়াজ মােহাম্মদ খান এবং আরও অনেক উচ্চপদস্থ পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা। আমি ছিলাম হলের মিলনায়তনে, তাঁদের আগমন দেখেই দৌড়ে বেরুতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম তবে চালাকি করে তাঁদের পেছনে লাইন লাগালাম।
তারা মিলনায়তনে একধরনের সচিবালয়ের নিদর্শন পেলেন। মিলনায়তনে কয়েকটি টেবিল সাজানাে ছিল এবং টেবিলে যেন দপ্তরের নাম লেখা ছিল। যেমন এক টেবিলে ছিল জনসংযােগ’ । সেখান থেকে ঢাকার ছাত্রাবাস ও মহল্লার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা হতাে। মহল্লার সর্দাররা তখন ছাত্রদের জোর সমর্থক। তাই তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা ছিল খুবই জরুরি।
একটি টেবিলে লেখা ছিল ‘ইশতেহার, ঘােষণা ও প্রচারপত্র, পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশনা’। সেখান থেকে যতসব ঘােষণা ও প্রচারপত্র লেখা হতাে ও ছাপানাে হতাে। ছাপা হতাে অবশ্য কাছের একটি প্রেসে। এক টেবিলে লেখা ছিল প্রচার দফতর। সেখান থেকে ঢাকায় মাইকিং করা, প্রচারপত্র বিলি করা—এসব কাজ হতাে। একটি টেবিল ছিল কেন্দ্র হিসেবে স্থাপিত আর সেখানে আমাদের হল ইউনিয়নের খেলাধুলা বিভাগের মহাসচিব এমএসসির ছাত্র ইকরামুল আমিন ছিলেন মুখ্য সচিব। তিনি আমাদের মতাে কর্মীদের ব্যস্ত রাখতেন।
সেদিন জনাব আজিজ আহমদের সহযােগীদের দেখলাম এই সচিবালয় নিয়ে হাসি-মশকরা করছেন। পুরােনাে দিনের কথা ভেবে গর্ববােধ হয় যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুলিবর্ষণের পর সপ্তাহখানেক ঢাকা বস্তুত ছাত্রদের দখলে ছিল। তাদের হুকুমে সরকারি অফিস প্রায় বন্ধ থাকে। বড় বড় কর্তারা অবশ্য কাজ করে গেছেন কিন্তু বেশির ভাগ কেরানিকুল অফিসমুখাে ছিল না।
রাওয়ালপিন্ডিতে আমি যখন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারে উপসচিব ছিলাম (জুলাই ১৯৬৬ সাল থকে জুলাই ১৯৬৯ সাল), তখন আজিজ আহমদ সাহেবকে
১৯
ভালােই চিনতাম। তিনি ছিলেন একজন সুপুরুষ এবং কাপড়চোপড়ে খুব দুরস্ত । তবে কেমন যেন দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। এমনকি সামাজিক পরিবেশেও সে দূরত্ব বজায় থাকত। তবে বাঙালিদের সঙ্গে একটু যেচেই সদ্ব্যবহার করতেন। মনে হতাে বাংলাদেশে তিনি যে সংকীর্ণতার পরিচয় দেন তারই যেন। খেসারত দিচ্ছেন।
ওয়াশিংটনে আলাপ-আলােচনায় মনে হলাে যে তিনি দেশের আসন্ন সংকট নিয়ে বেশ চিন্তিত । তিনি বললেন যে বাঙালিদের ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত হয়েছে এবং অন্যায় সহ্য করেছে। তবে অনেকেই এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং যথেষ্ট সদিচ্ছা বর্তমান। পশ্চিম পাকিস্তানকে অনেক দিতে হবে, সদিচ্ছা নিয়ে অনেক এগােতে হবে। কিন্তু তিনি জানেন না যে সরকার যারা পরিচালনা করছেন, তারা এ বিষয়ে তত গুরুত্ব দেন কি না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি উপদেশও দিলেন যে শেখ সাহেবকে নমনীয় হতে হবে, দেশ ভাঙা উচিত হবে না। আজিজ আহমদ যখন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী (তিনি অনেক দিন স্টেটমন্ত্রী ছিলেন আর ভুট্টো নিজে ছিলেন মন্ত্রী), তখন দুবার তার সঙ্গে আলােচনা। হয়। প্রথমবার যখন ১৯৭৪ সালের জুন মাসে তিনি ভুট্টোর সঙ্গে ঢাকায় আসেন। এবং আবার ১৯৭৫ সালে বােধ হয় জুলাইতে জেদ্দায় ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে। কিন্তু এই দুবারই তাঁর মধ্যে কোনাে নমনীয়তার নিদর্শন পাইনি।
চালচলন ও মনমানসিকতায় নবাব কিজিলবাস ছিলেন ব্রিটিশ যুগের সরকারি দলের রাজনীতিবিদ। কাপড়চোপড়ে ধােপদুরস্ত, কথাবার্তায় খুব চালু, বক্তৃতায়। দক্ষ, বিনােদনে (রেস-পার্টি এগুলােতে অভ্যস্ত এবং মেহমানদারিতে অনবদ্য। তিনি বৈদেশিক দেনা ও লেনদেনের ভারসাম্য নিয়ে কিছু কথা বললেন। বিষয়টি ১৯৭০-এ বেশ গুরুতর আকার ধারণ করে এবং হেমন্তে একটি কার্যক্রম মােটামুটিভাবে গৃহীত হয়। অবশ্য ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কারণে এই কার্যক্রমের আর বাস্তবায়ন হয়নি। দেশের জটিল সাংবিধানিক সমস্যা নিয়ে—পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্ক নিয়ে—তার কোনাে চিন্তাভাবনা আছে বলে আমার মনে হলাে না। অবশ্য তার সঙ্গে কোনাে পূর্বপরিচয় না থাকায় সে রকম আলাপ হয়তাে জমে ওঠেনি।
সরদার আবদুর রশিদ আসলে একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিনি উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পুলিশবাহিনীর ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন। তাঁকে বোেধ হয় রাজনীতিতে নিয়ে আসেন ডা. খান সাহেব । জেনারেল ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে আমাকে করনিংয়ে যেতে হয়। করনিংওয়্যার কোম্পানি তখন করাচিতে বিনিয়ােগের চিন্তা করছিল। তারা সরদার রশিদকে কারখানা ভ্রমণে আমন্ত্রণ করে এবং তাদের একটি বার্ষিক নৈশভােজে প্রধান। অতিথি বানায়। নিউইয়র্কের কাছে হাকেনসাক বিমানবন্দর থেকে আমরা একটি
২০
এক্সিকিউটিভ জেটে করনিংয়ে যাই। সরদার রশিদ ওয়াশিংটনে এসেও আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। সরদার রশিদ স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি ভালাে বুঝতেন। তিনি মনে করতেন যে ছয় দফা পাকিস্তানকে খুবই দুর্বল করে দেবে এবং এতে দেশরক্ষা একটি নাজুক অবস্থায় পর্যবসিত হবে। তবে ছয় দফা পুরােপুরি গৃহীত কখনাে হবে না এবং শেখ সাহেবকে কিছু ছাড় দিতে হবে । তিনি বলেন যে তাঁর গােয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরাে ও সামরিক গােয়েন্দা সংস্থার হিসাবে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি আসনে নির্বাচিত হবে। পূর্ব পাকিস্তানি বাকি সাংসদদের সঙ্গে পশ্চিমের সাংসদেরা হাত মিলিয়ে এমন একটি সাংবিধানিক সমাধান দিতে পারেন, যাতে দেশরক্ষা বিষয়ে আপস না করেও পূর্ব পাকিস্তানকে আর্থিক বিষয়ে যথােপযুক্ত স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যেতে পারে।
১৯৭০ সালে আমেরিকায় পাকিস্তান থেকে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য আগন্তুক ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের রজতজয়ন্তী অধিবেশনে বক্তৃতা দেন, মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কাশ্মীর নিয়ে দেনদরবার ইত্যাদি করেন। ব্যবসায়ীদের এক সভায় তিনি বক্তৃতা দেবেন বলে আমি একটি খসড়া দিই। তবে জ্যেষ্ঠতর অনেক আমলা এ ব্যাপারে তৎপর ছিলেন বলে আমার ভূমিকা সামান্যই ছিল। এই সভা এবং প্রেসিডেন্ট প্রদত্ত একটি অভ্যর্থনা ভােজে যােগদানের জন্য আমি নিউইয়র্কে যাই। জেনারেল ইয়াহিয়ার মদে আসক্তি সর্বজনবিদিত। তবে প্রকৃতিস্থ অবস্থায় তিনি খুব আসর জমাতে পারতেন। সামরিক বিষয় ছাড়া অন্য যেকোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল বলে মনে হতাে না এবং গুরুত্বের বিষয়ে তাকে মনে হতাে চপল। এদিকে তিনি তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের একেবারে উল্টো ছিলেন। আইয়ুব ছিলেন রাশভারী লােক, যেকোনাে বিষয়ে চিন্তা না করে মন্তব্য করতে বিরত। প্রতিটি সমস্যা তিনি গভীরভাবে বিবেচনা করতেন এবং তা নিয়ে পড়াশােনা করা ছিল তার অভ্যাস।
ওয়াশিংটনে জেনারেল ইয়াহিয়ার কর্মসূচি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম রাতে রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের গণ্যমান্য সব পাকিস্তানির একটি ভােজসভায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মিলিত হবার ব্যবস্থা করেন। এই আসরে তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদ ব্যক্ত করেন। যথাসময়ে নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে তিনি জানান। ইতিমধ্যে অবশ্য নির্বাচনের তারিখ ৫ অক্টোবরের পরিবর্তে ৭ ডিসেম্বরে নির্ধারিত হয়েছে। ভােজসভায় তিনি ছিলেন খুব নিরুদ্বেগ এবং অনেক হাস্যরসের সৃষ্টি করেন। উপস্থিত সবাইকে যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলাে, তখন তিনি নানা রকম কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য সমানে করতে থাকেন। আমাকে দেখে
২১
বললেন, এই লােকটা আমার জন্য কাজ করত, তবে গােলযােগ করত (troublesome) বলে তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারপর যােগ করলেন, ‘তার এখানে নিযুক্তি আগেই হয়েছিল, তাই আমি তাকে ছেড়ে দিই।’
পরদিন সকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে তার বৈঠক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাষ্ট্রদূত হিলালি এবং পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মােহাম্মদ খান। সম্ভবত অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মির্জা মােজাফফর (এম এম) আহমদ ছিলেন না। বৈঠক শেষে দুপুরে রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে মধ্যাহ্নভােজে হােমরাচোমরারা থাকবেন। সেক্রেটারি অব স্টেট বিল রজার্স, দেশরক্ষা সেক্রেটারি মেলভিন লেয়ার্ড, নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার, সহকারী সেক্রেটারি অব স্টেট জো সিসকো, মার্কিন এআইডি প্রশাসক জন হানা, আইএমএফের নির্বাহী পরিচালক পিয়ার সােয়াইটজার, বিশ্ব ব্যাংকের পিটার কারগিল, কজন কংগ্রেস সদস্য এবং আরও কজন। আমি লাঞ্চে নিমন্ত্রিত নই কিন্তু ঠিক লাঞ্চের প্রাক্কালে আমার ডাক পড়ল। রাষ্ট্রদূতের বাড়ি দূতাবাস থেকে মিনিট তিনেকের পথ। ওখানে পৌছাতেই রাষ্ট্রদূত নিচে নেমে এসে বললেন যে প্রেসিডেন্টের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়ের যে ব্রিফ ছিল, তার মােদ্দাকথা তাঁকে বুঝিয়ে বলতে হবে। ব্যাপারটি নিয়ে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এবং তার সুরাহা লাঞ্চের আগেই করতে হবে।
পাকিস্তানে তখন ঘােরতর অর্থনৈতিক সংকট, বৈদেশিক ঋণের বােঝা খুব বেশি এবং লেনদেনে ভারসাম্য মােটেই নেই। এই সংকট সমাধানের জন্য একটি প্রস্তাব আলােচিত হচ্ছিল। তার প্রধান বিষয় ছিল নিম্নরূপ :
১. পাকিস্তান মুদ্রামান হ্রাস করবে।
২. দাতাগােষ্ঠী পাকিস্তানকে মােটা হাতে অপ্রকল্প সাহায্য দেবে। পাকিস্তান তখন বছরে সাহায্য পেত প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। অপ্রকল্প সাহায্য ছিল প্রায় ১০০ মিলিয়ন এবং খাদ্য সাহায্য প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার। তখন বৈদেশিক সাহায্য ছিল তিন রকমের। প্রকল্প সাহায্য ছিল সবচেয়ে বেশি। অপ্রকল্প সাহায্য ছিল পণ্যদ্রব্য বা রসদ কেনার জন্য যেমন সার, ইস্পাত, সিমেন্ট, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। তৃতীয় সাহায্য ছিল খাদ্যশস্য বা ভােজ্যতেলের জন্য।
৩. আইএমএফ স্ট্যান্ডবাই সুযােগের অধীনে ঋণ দেবে। ৪. পাকিস্তান বৈদেশিক দেনা মেটানাের জন্য কয়েক বছরের অবকাশ পাবে। সেই যুগে গরিব উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঋণ স্বস্তির ব্যবস্থা কনসাের্টিয়ামেই হতাে। ষাটের দশকে ঋণের পুনর্বিন্যাস (মওকুফ বা স্বস্তি) নিয়ে অন্তত আরও চারটি দাতা ক্লাব (কনসাের্টিয়াম) সিদ্ধান্ত নেয়; যথা : ঘানা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক। পরবর্তীকালে হর্তাকর্তা প্যারিস বা লন্ডন ক্লাব তখন সক্রিয় ছিল না, কালেভদ্রে তারা বাণিজ্যিক ঋণের বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত নিত।
২২
সংকট সমাধানের এই প্রস্তাবে সমস্যা ছিল দুটো বিষয়ে। প্রথমত, মুদ্রামান হ্রাস কখন হবে আর তাতে রপ্তানি বােনাসের হার কীভাবে প্রভাবিত হর্বে । পাকিস্তানে রপ্তানি বােনাস পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় ১৯৫৯ সালে। এতে রপ্তানিকারকেরা অতিরিক্ত আয় করত, যদিও আমদানি দাম থাকত কম । বস্তুতপক্ষে রপ্তানিকারকদের জন্য মুদ্রামান ছিল হ্রাসকৃত। দ্বিতীয় অমীমাংসিত বিষয় ছিল অপ্রকল্প সাহায্যের কলেবর। মার্কিন খাদ্য সাহায্য প্রায় ২০ মিলিয়ন বাড়বে বলে জানা ছিল। পাকিস্তান অপ্রকল্প সাহায্য বাবদ আমেরিকার কাছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন চাচ্ছিল, কিন্তু মার্কিন ধারণা ছিল যে ১২০-১৪০ মিলিয়নই যথেষ্ট। কারণ, বিশ্ব ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ২৫ মিলিয়ন এবং আইএমএফ থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মিলে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে।
দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটি একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যাতে একমাত্র অন্য ব্যক্তি ছিলেন কিসিঞ্জার, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আর কেউ ছিলেন না। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে নিক্সন ২০০ মিলিয়নে রাজি হয়েছেন কিন্তু ডা. হানা বলেন যে তা হতে পারে না, ভুল-বােঝাবুঝি হয়েছে। রাষ্ট্রদূত আমাকে প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে গেলেন, ডা. হানাও সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট আমাকে বললেন, “তােমাদের ব্রিফমতাে কথা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছেন যে ২০০ মিলিয়ন সাহায্য পাব। তারপর ড. হানাকে বললেন, আপনারা আলােচনা করে সংশয় নিরসন করুন। আর হেনরি এলে তার কাছেই শুনতে পাবেন।’ হেনরি কিসিঞ্জার কিছুক্ষণ পর এলেন, তাঁকে রাষ্ট্রদূত হিলালি এবং ড. হানা যৌথভাবে বিষয়টি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। হেনরি ড. হানার ব্যাখ্যাকে সমর্থন করলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তখন বােঝালেন যে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের সাহায্য মিলে মােট ২০০ বা তার বেশি বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান হবে। আমার মনে পড়ে, মার্কিন এইডের পণ্য সাহায্য ১৭০ মিলিয়নে রফা হয়। তবে এ বিষয়ে পরবর্তী দেড় বছরে কোনাে চুক্তি স্বাক্ষরের সুযােগ হয়নি। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ‘পাকিস্তানের দিকে ঝোঁক’ নীতি সত্ত্বেও ১৯৭১-এ এই পণ্য সাহায্য বা অন্য কোনাে রকম সাহায্য তিনি পাকিস্তানকে দিতে পারেননি। শুধু ত্রাণ সাহায্য অব্যাহত থাকে, যদিও নানা কারণে বিস্তৃত কোনাে ত্রাণ কার্যক্রমও গ্রহণ করা যায়নি।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দুটি বিষয়ে সাফল্য লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের কারণে প্রেসিডেন্ট জনসন ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই সামরিক সাহায্য বা সমরাস্ত্র বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবার এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে শক্ত যুক্তি দেখান এবং এ বিষয়ে একটি বিশেষ এককালীন
২৩
অব্যাহতি লাভে সক্ষম হন। কিছু নির্দিষ্ট সমরাস্ত্র এবং স্পেয়ার্স দান ও বিক্রয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়। দ্বিতীয় সাফল্যের বিষয়টি বহুদিন ছিল অত্যন্ত গােপনীয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন জেনারেল ইয়াহিয়াকে তাঁর তরফ থেকে গণচীনের সঙ্গে দূতিয়ালিতে নিয়ােগ করেন এবং ইয়াহিয়ার উদ্যোগের ফলে সরাসরি চীনমার্কিন সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৭১ সালে। মাতাল হলেও ইয়াহিয়া তাঁর স্বার্থ ভালােভাবে সংরক্ষণ করতে জানতেন। এ দুটি বিষয়ে সাফল্য আর বিশেষ করে চীন-মার্কিন সম্পর্ক সম্বন্ধে শক্ত গােপনীয়তা বজায় রাখা অবশ্য কৃতিত্বের বিষয়। ইয়াহিয়া যখন সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন, তখন তাকে একবার দেখেছি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং দৃঢ়ভাবে তার আবেদন তুলে ধরতে। মন্ত্রিসভার দেশরক্ষা কমিটির সভায় ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করেন। আমি পদাধিকারবলে এই কমিটির সচিব ছিলাম। তিনি যুক্তি দেখালেন যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রয়ােজন সহজে মিটেছে কিন্তু সেনাবাহিনী অবহেলিত হয়েছে। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রয়ােজন আধুনিক দামি ও জটিল যন্ত্রপাতি এবং সেগুলাে সামরিক সাহায্য বা ঋণে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু সেনাবাহিনীর দামি ও জটিল সমরাস্ত্র ছাড়াও অনেক সাধারণ রসদের প্রয়ােজন এবং এগুলাে বৈদেশিক সাহায্য বা ঋণে পাওয়া যায় না। অথচ দেশি উৎপাদনক্ষমতাও পর্যাপ্ত নয়। এর ফলে সেনাবাহিনীর দক্ষতা যথােপযুক্ত নয় এবং সেনাবাহিনীর জন্য নিজস্ব সম্পদ থেকে বরাদ্দ বাড়ানাে প্রয়ােজন। এ বিষয়ে আরও আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল যে সভার পর তিনি কয়েকবারই এ সম্বন্ধে তাগিদ দেন ও তদবির করেন। রসদের জন্য দাবিদাওয়া গােটা সামরিক খাতেই সর্বত্র খুব বেশি। কারণ, জাতীয় সম্পদের এমন অপচয় এবং এসব লেনদেনে কালােটাকা কামানাের এমন সুযােগ আর কোথাও ছিল না। গােপনীয়তার আড়ালে, জরুরি প্রয়ােজনের ধুয়াতে এবং একটি সীমিত গােষ্ঠীর মনােপলিতে এ রকম বড় কলেবরের লেনদেন অন্যত্র কোনাে বিষয়ে হয় না।
ইয়াহিয়া দেশে ফিরে গিয়েই চীন ভ্রমণে যান; দূতিয়ালির কাজটি ছিল বড় প্রয়ােজনীয়। ইয়াহিয়া যখন চীনে, তখনই ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের। কালরাতে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকা এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছাসের কবলে পড়ে। ইয়াহিয়া ১৪ নভেম্বর বেইজিং থেকে ফেরার। পথে ঢাকায় থামেন। উড়ােজাহাজে তিনি দুর্গত এলাকা দেখে এলেন। কোনাে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করার প্রয়ােজনীয়তা দেখলেন না এবং দ্বিতীয় রাজধানীতে কিছুদিন অবস্থানের কথাও বিবেচনা করলেন না। সারা পৃথিবী যখন এই দুর্যোগে হতভম্ব এবং সাহায্য ও ত্রাণকাজে উদ্যোগী, তখন পাকিস্তানের শাসকেরা ছিলেন ঘুমিয়ে। ব্রিটিশ ও মার্কিন নৌবাহিনী এসে মানুষকে দাফন করল, ঢাল
২৪
তলােয়ারহীন প্রাদেশিক সরকার পানি ও ত্রাণসামগ্রী পৌছাতে নিতান্তই হিমশিম খাচ্ছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তাদের হেলিকপ্টার, সি ১৩০ পরিবহন বিমান, নৌযান এলসিটি ইত্যাদি নিয়ে বসে রইল। ২১ নভেম্বরে দুর্যোগের ১০ দিন পর বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে বদনাম কুড়িয়ে, দেশের মানুষের উন্মা আহরণ করে তাদের টনক নড়ল। অনেকের মনেই প্রশ্ন দোলা দিল, পশ্চিমে কি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এতটুকু দরদ বা চিন্তাভাবনা আছে; না এই এলাকা শুধুই এক দুগ্ধবতী গাভি, শােষণের জন্য এক উপনিবেশ? স্বায়ত্তশাসনের আশু প্রয়ােজনীয়তা সজোরে ঘােষণা করল ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়।
আমেরিকায় সে সময় বাঙালি গােষ্ঠী ছিল খুব ছােট। নিউইয়র্কে ছিল সবচেয়ে বড় সমাবেশ। ওখানে পাকিস্তান লীগ—মােটামুটি তাদেরই সমিতি ছিল। মূলত সিলেটি রেস্তোরার মালিক আর কর্মীরাই এই সমিতি চালাতেন। তাদের নেতা তখন কাজী শামসুদ্দিন আহমদ ‘আ বিট অব বেঙ্গল’ নামক একটি রেস্তোরার মালিক। কাজী সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম মােলাকাত ১৯৬৩ সালে, আমার প্রথম নিউইয়র্ক ভ্রমণকালে। তার বড় ভাই কাজী বদরুদ্দিন হায়দরকে ছাত্রাবস্থায় আমরা খুব সমীহ করতাম। ১৯৪৭ সালে সাহিত্য সংসদের রাষ্ট্রভাষা আলােচনায় তিনি বাংলার পক্ষে বক্তব্য দিয়ে আমাদের প্রিয়পাত্র হন। তখন তিনি ছিলেন জেলা জনশিক্ষা কর্মকর্তা। শামসুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে অনেক দিন যােগাযােগ নেই। তবে পরবর্তীকালে তিনি হবিগঞ্জ জেলায় তাঁর গ্রামে বসবাস করেন। পাকিস্তান লীগের সদস্যরা ঠিক করলেন যে তাঁরা তাঁদের সমিতিকে চাঙা করবেন পূর্ব পাকিস্তান লীগ নামে এবং পূর্ব পাকিস্তানের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবেন। তাদের সহকর্মী ও বুদ্ধিদাতা হিসেবে তারা পেলেন ডা. খন্দকার আলমগীর (যিনি পঞ্চাশের দশকে মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতিতে প্রগতিশীল গােষ্ঠীর একজন নেতা ছিলেন), সৈয়দ আনােয়ারুল করিম (যিনি তখন জাতিসংঘে পাকিস্তান স্থায়ী মিশনের উপপ্রধান) এবং আবুল হাসান মাহমুদ আলী (যিনি তখন নিউইয়র্কে পাকিস্তান কনস্যুলেট জেনারেলের ভাইস কনসাল)।
নতুনভাবে উজ্জীবিত পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগের মােকাবিলায় পাকিস্তান সরকারের ব্যর্থতার তীব্র সমালােচনা করল। তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও জাতিসংঘের মহাসচিবকে আহ্বান জানাল এই সংকট নিরসনের খাতিরে পূর্ব পাকিস্তানে আশু স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের বক্তব্য ছিল যে বাঙালিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যাহত হচ্ছে। তারা দাবি করল যে ১৯৪০-এর লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ভিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দরকার। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাফল্যে তারা বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানাল
২৫
এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আবেদন জানাল। ছাত্র ও জ্ঞানী সমাজের পক্ষ থেকে লীগের সংস্কৃতি ও সমাজসেবা সম্পাদক রফিক আহমদ স্বায়ত্তশাসন পেরিয়ে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করলেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল আশাতীত। ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও পাকিস্তান দূতাবাসের আমরা কজন এ বিষয়ে বাজি রেখেছিলাম। আওয়ামী লীগ ১৪০টি আসন পেতে পারে বলে ছিল সর্বোচ্চ আশাবাদ। কিন্তু ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি যখন ছয় দফার সমর্থনে গেল, তখন হলাে দুই রকমের কথাবার্তা। আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের বন্ধুরা বলতে থাকলেন, ছয় দফা তাে একটি সংলাপের ব্যাপার, রাজস্ব ক্ষমতাবিহীন কেন্দ্রীয় সরকার তাে হতে পারে না। আবার কেউ কেউ বললেন যে ভুট্টো পশ্চিমের নেতা আর শেখ সাহেব পূর্বের নেতা, তাঁরা এককভাবে তাে কেউ ফেডারেল সরকার বানাতে পারবেন না । আমাদের রাষ্ট্রদূত তাে বলেই বসলেন যে ভুট্টো হবেন উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র দপ্তর তিনিই পরিচালনা করবেন। তাঁর অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করলেন তাঁর বাঙালি সহকারী এনায়েত করিম কিন্তু হিলালি অভিমতটিকে পাত্তাই দিলেন না।
আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় কিন্তু আমাদের অনেকটা বেপরােয়া করে তুলল। পাকিস্তানের ৬৮টি বৈদেশিক মিশন, যার মাত্র ১৪টিতে বাঙালি রাষ্ট্রদূত ছিলেন, সেগুলােকে কেমন করে ঢেলে সাজাতে হবে, সে বিষয়ে আমরা নসিহত দিতে শুরু করলাম। বৈদেশিক মিশন একটিই হবে, কিন্তু দুই অঞ্চলের জন্য থাকবে দুই স্বতন্ত্র দপ্তর। বাংলাদেশের ভাগ্য বাঙালিরাই নির্ধারণ করবে। একটি বড় প্রশ্ন হলাে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক হবে ঘনিষ্ঠ । আর সেই ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ হলাে চীন ও ব্রিটেনের সম্পর্কের অনুকরণ । রাজনীতিতে ভিন্নমতাবলম্বী হয়েও বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে যাতে নিজের স্বার্থসিদ্ধি হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। মােটামুটিভাবে ছয় দফার ব্যবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিমের সহাবস্থান সহজসাধ্য বলেই ছিল সাধারণ ধারণা। আমরা অনেকেই ভাবতাম যে পাকিস্তানের শ্বেতহস্তী সামরিক বাহিনীর জন্য না হয়। আমরা খানিকটা বেশি খরচই জোগালাম, তবু তাে অন্যান্য বিষয়ে নিজের ভাগ্য নিজেই ঠিক করতে পারব।
ভবিষ্যৎ নিয়ে এ রকম আশাবাদের পরিবেশে আমি তাে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একটি রচনাই লিখতে শুরু করে দিলাম। এত দিন আমরা দুই অর্থনীতির কথা বলেছি। এবার তাে নিজেদের অর্থনীতির জন্য পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম স্বতন্ত্রভাবে বানাতে হবে। স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা শুধু স্লোগানই নয়,
২৬
এর জন্য প্রস্তুতি প্রয়ােজন, নতুন ব্যবস্থাপনা গড়ে তােলা প্রয়ােজন। ১৯৭১-এর বর্ষশুরুতে তাই আমরা ছিলাম খুবই আশাবাদী এবং একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে খুবই নিবেদিত । এত বছরের অমীমাংসিত স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি এবার পার পাবে। দেশের দুই ভাগের সম্পর্কে উত্তেজনার নিরসন হবে। নিজের ভাগ্য | নিজে নিয়ন্ত্রণ করার ফলে বৈষম্য ও বঞ্চনা নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ বন্ধ হবে।
মানুষ ভাবে এক কিন্তু বিধি হয় বাম। ব্যালটের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বাঙালিরা পেল বুলেটের মুখে মৃত্যু। স্বায়ত্তশাসনের সুন্দর স্বপ্নকে বানচাল করে দিল সামরিক বর্বরতা। গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিল পাকিস্তানি সমরতন্ত্র। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপরীতে দাঁড়াল পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ। ১৯৭১-এর শুরুতে যে আশায় আমরা উদ্বেলিত হয়েছিলাম, তাকে গুঁড়িয়ে-মুড়িয়ে। দিল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর চক্রান্ত এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অপরিণামদর্শিতা। বাংলাদেশের বুকে নেমে এল অমানিশার অন্ধকার, গণহত্যার কালরাত্রি এবং প্রতিফল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের দুর্জয় প্রত্যয়।
২৭
<p style="text-align: justify;"> দ্বিতীয় অধ্যায়
স্বায়ত্তশাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধ
ছয় দফা বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে একটি কনফেডারেশনের পরিকল্পনা বলে বিবেচিত হতে পারে। যারা এই কার্যক্রম প্রণয়ন করেন, তাঁরা অবিভক্ত ভারতে যেসব সাংবিধানিক কাঠামাের চিন্তা করা হয়, সেগুলােকে ভালোঁ করে যাচাই করেন এবং বিশেষ করে ১৯৪৬ সালে প্রদত্ত ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুসরণ করেন। ১৯৩৯ সালে অন্তত তিনটি প্রস্তাব ছিল, রহমত আলীর প্রস্তাবে ছিল তিন বিষয়ের কনফেডারেশন—দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং অভিন্ন উৎস থেকে প্রবাহিত পানিসম্পদ। স্যার সিকান্দর হায়াত খানের কনফেডারেশনে ছিল। পাঁচটি বিষয়, যথা : পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা, যােগাযােগ, বাণিজ্য শুল্ক ও মুদ্রা। মাওলানা মওদুদীর কনফেডারেশনের ছিল তিনটি বিষয়—দেশরক্ষা, যােগাযােগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য। ১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাবে তাে দুটি স্বতন্ত্র মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন ১৬ মে যে। প্রস্তাব দেয়, তাতে কনফেডারেশনের দায়িত্ব ছিল চারটি—দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি, যােগাযােগ এবং এ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়ােজনীয় রাজস্ব ক্ষমতা। এসব চিন্তাধারার সঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সামনে আসে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা। এর সুদূরপ্রসারী ফসল হতে পারত একটি উপমহাদেশীয় কমনওয়েলথ। মহামতি গােপালকৃষ্ণ গােখলের কথার যথার্থতাই বােধ হয় প্রমাণ করতে চেয়েছিল ছয় দফা কার্যক্রম। বাংলা আজ যা ভাবে, সারা ভারত তা-ই ভাবে কালকে’—এমন সুন্দর সম্ভাবনাকে কিন্তু পাকিস্তানের জবরদখলকারী সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিল।
১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বেরােতে না বেরােতেই শুরু হয়ে গেল স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র । ভুট্টোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতালােলুপতার যােগসাজশ হলাে। ১৯৭১-এর ১৭ ফেব্রুয়ারিতে লারকানার
২৮
শিকার সম্মেলনেই ভুট্টো এবং সামরিক নেতাদের ঘৃণ্য আঁতাত প্রতিষ্ঠা হয় : ইয়াহিয়া হয়তাে তাতে নির্বোধ দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তারপর ঘােষণা, চ্যালেঞ্জ, নির্ঘণ্ট আলােচনা—সবই ছিল শঠতার আশ্রয় নিয়ে সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। এই খেলা অনেকের চোখেই ধরা পড়ে, তবে কেউ আশা ছাড়তে প্রস্তুত বা রাজি ছিলেন না। নিউইয়র্কের পাকিস্তান লীগ তত দিনে পূর্ব পাকিস্তান। লীগে রূপান্তরিত হয়েছে। ১২ মার্চ তারা জাতিসংঘের সামনে শােভাযাত্রা করল। এবং জাতিসংঘের ও মার্কিন নেতা-নেত্রীদের কাছে বাঙালিদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সাহায্যের আবেদন করল। এই আবেদনের শেষ পরিচ্ছদটি তুলে ধরছি :
আমাদের যদি সাহায্য করতে অসুবিধা হয়, আমরা অনুনয় করছি, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীকে সাহায্য করতে বিরত থাকুন। তাদের জালিম ঔপনিবেশিক শাসনকে আর চলতে দেবেন না।
১৯৭০-এর নির্বাচনে ছয় দফার আশাতীত সাফল্য বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্ববােধ ও আত্মবিশ্বাস খুব করে বাড়িয়ে দেয়। এত দিনে যেন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গভীর প্রত্যয়ের পরিচয় দিল। একটি জাতির রাজনৈতিক বিকাশে সুযােগ, কৌশল, সংগঠন এবং নেতৃত্ব অত্যন্ত বিনিশ্চায়ক ভূমিকা পালন করে। আমি নিজে দেখেছি কেমন করে বাঙালি আমলারা সুযােগের সদ্ব্যবহার করেন এবং নেতৃত্বের সৎসাহসের বলে ষাটের দশকের শুরুতে আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে থাকেন। সে সময় তাদের নেতৃত্বে ছিলেন দুজন অবাঙালি নিবেদিত শুভানুধ্যায়ী। জেনারেল আজম খান তখন পূর্ব পাকিস্তানের লাট সাহেব এবং ডেভিড খালেদ পাওয়ার প্রদেশের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব। তাঁরা বাঙালি উচ্চপদস্থ আমলাদের ভিন্নমত পােষণের সাহস ও স্বাধীনতা দেন। আইয়ুব খান তখন তাঁর একনায়কত্বের বৈধতা আহরণে ব্যস্ত। দেশের দুই ভাগের সম্পর্কে খানিকটা সমতা সৃষ্টির একটি প্রয়াস তাঁকে নিতে হয়। নানা বিষয়ে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে, তাঁকে অনেক কমিশন-কমিটি বানাতে হয় এবং এদের সুপারিশ বিবেচনা করতে হয়। এসব কমিশন-কমিটিতে অবশ্য বাঙালি সদস্য নিতে হয়। বাঙালি সদস্যরা এই প্রথমবারের মতাে ভিন্নমত প্রকাশ করতে থাকেন। সাধারণত ভিন্নমত আলােচিত হলেও প্রতিবেদন পাকাপাকি করার সময় সমঝােতার ফয়সালা দেওয়াই ছিল চিরাচরিত রীতি। এই রীতির ব্যতিক্রম কদাচিৎ হতাে।
১৯৫৮ সালে রেলওয়ের প্রাদেশিকীকরণ এবং ১৯৫৯ সালে রাজধানীর স্থান নির্ধারণের জন্য যে দুটি কমিশন প্রতিবেদন পেশ করে, সেখানে একজন বাঙালিই দুবার ভিন্নমত দিয়ে তাঁর স্বতন্ত্র অভিমত ব্যক্ত করেন এবং এর জন্য তিনি সরকারের খাতায় একজন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হন। এই ব্যক্তি
২৯
ছিলেন চুয়াডাঙ্গার ব্রিটিশ ভারতীয় কেন্দ্রীয় প্রকৌশলী সার্ভিসের সদস্য চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান মালিক আবদুল বারী। আমি শুনেছি যে তাঁর ভাই ডা. আবদুল মােত্তালেব মালিক যখন দখলীকৃত বাংলাদেশের লাট সাহেব হন, তখন আবদুল বারী তাতে ঘাের আপত্তি তােলেন এবং তাঁর এই দাসবৃত্তিতে ক্ষুব্ধ হয়ে দেশ ত্যাগ করেন। বিদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁরই ইচ্ছায় তাঁর দাফন বিলেতে সম্পন্ন হয়। তিনি পাকিস্তানের দখলীকৃত উপনিবেশে সমাহিত হতে আপত্তি করেন। বহু যুগ আগে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা খেলাফত আন্দোলনের মনমাতানাে বাগ্মী মাওলানা মােহাম্মদ আলীও ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে সমাহিত হতে আপত্তি করেন। তাঁরও সমাধি বিলেতের চিরমুক্ত মাটিতে হয়।
যে কথাটি বলতে চাচ্ছিলাম, তা হলাে জেনারেল আজমের নেতৃত্বে বাঙালি আমলারা নির্ভয়ে ও সজোরে তাদের ভিন্নমত ব্যক্ত করার সাহস সঞ্চয় করেন। প্রায় প্রতিটি কমিশন-কমিটিতে তারা স্বতন্ত্র প্রতিবেদন পেশ করতে থাকেন। ভিন্নমতের প্রতিবেদনের (note of deissent) যে কী ক্ষমতা, আমরা এর আগে তা কখনাে টের পাইনি। তখনকার দিনের সুপ্রসিদ্ধ ফাইন্যান্স কমিশন রিপাের্ট এই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা যায়। পাঁচজন বাঙালি সদস্য ডেভিড খালেদ পাওয়ারের নেতৃত্বে এবং লাট সাহেবের সমর্থন পেয়ে তাদের নিজস্ব মতামতে অটুট থেকে তদনুযায়ী তাদের ভিন্নমত ব্যক্ত করেন। পাঁচজন পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য, বিশেষ করে সভাপতি এতে খুব বিপদে পড়ে গেলেন। তাই শেষ পর্যন্ত তিনটি মতামত প্রকাশিত হলাে। পাঁচ বাঙালি সদস্যের এক প্রতিবেদন, চার পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যের এক প্রতিবেদন এবং সভাপতি হাফেজ মজিদের (তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থসচিব) এক স্বতন্ত্র প্রতিবেদন। কেন্দ্র ও প্রদেশের আর্থিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে অনুকূল সুপারিশ—যদিও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ১৯৭০ সালে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ধাপে ধাপে ছয় দফাকে জাতীয় সনদে রূপান্তর করে এবং সাংগঠনিক শক্তি বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ, নির্ভীক নেতৃত্বে বাঙালি জাতির চরিত্রকে একেবারে বদলে দেয়। ভিক্ষুক বাঙালি, ভীরু বাঙালি, নমনীয় বাঙালি। ও ‘সাইল’ বাঙালি, সাহসিকতা, আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধিকার চেতনায় মহীয়ান হয়ে ওঠে। আমাদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারে এই নতুন বাঙালি পরিচয় ছিল পরিস্ফুট।
এ অবস্থায় মার্চের প্রথম দিনে ইয়াহিয়ার ধোকাবাজি বারুদের স্কুপে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গরূপে দেখা দিল। অসহযােগ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সফল হতাে বলে আমার মনে হয় না। অসহযােগ আন্দোলনের ক্রমবিকাশ এবং অভূতপূর্ব সাফল্য প্রবাসে আমাদের যে ভরসা দেয়, এত দিন
৩০
পর মনে হয়, তা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়ার মনােবৃত্তি গড়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে তখন পাকিস্তানের রাষ্টদূত ছিলেন আগা হিলালি । তাঁর ভাই আগা শাহি তখন ছিলেন জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি এবং পরবর্তী সময়ে তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তাঁদের পূর্বপুরুষ (বােধ হয় পিতা) ইরান থেকে দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর স্টেটে অভিবাসন করেন। তারা দুই ভাই মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং দুজনই ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন। আগা হিলালি ১৯৩৬ সালে চাকরি শুরু করেন এবং তিনি বাংলা প্রেসিডেন্সির আমলা ছিলেন। বিভাগােত্তরকালে কিছুদিনের জন্য তিনি ঢাকায় সচিবালয়ে ছিলেন। তারপর পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যােগ দেন। ওয়াশিংটনে ছিল তাঁর সর্বশেষ নিযুক্তি। এর আগে তিনি ভারত, সােভিয়েত রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম মােলাকাত রাওয়ালপিন্ডিতে, আমার ওয়াশিংটন যাবার কয়েক মাস আগে। হিলালি রাওয়ালপিন্ডিতে আসার জন্য কয়েকবারই প্রচেষ্টা নেন কিন্তু তদানীন্তন পররাষ্ট্রসচিব এস এম ইউসুফ তাতে রাজি না হওয়ায় তাঁর সে সুযােগ হয়নি।
অবশেষে তিনি এলেন কিছু সরকারি ও কিছু পারিবারিক কাজে। সাংকেতিক যত বাণী (সাইফার মেসেজ) কেন্দ্রীয় সরকারে প্রেরিত হতাে বা কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পাঠানাে হতাে, তার জিম্মাদার হিসেবে আমি সেগুলাে পড়তে পারতাম। সেই সূত্রেই হিলালির বিভিন্ন উদ্যোগ আমার জানা ছিল । তখন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে মাত্র একটি সচিবের পদ ছিল। যার ফলে অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কোনাে দিন সচিবের মর্যাদা পেতেন না এবং যুগ্ম সচিব হিসেবেই অনেকে অবসর নিতেন। যেমন এস কে দেহলভি একসময় সচিব ছিলেন, কিন্তু মেয়াদপূর্তির পর তিনি ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হয়ে যান এবং সেখান থেকেই বােধ হয় যুগ্ম সচিবের মর্যাদায় ও বেতনে অবসর গ্রহণ করেন। পররাষ্ট্র দপ্তর তাই একটি প্রস্তাব করে যে আরও কিছু সচিবের পদ সৃষ্টি করা হােক এবং শুধু অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতকে সেই মর্যাদা দেওয়া হবে (বাংলাদেশে এই অবস্থা নেই, আমাদের ফরেন সার্ভিসে সম্ভবত ১১ জন সচিবের পদ আছে)। প্রস্তাব করা হয় যে ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত রাশিয়ার অন্তত তিন কি চারটিতে যিনি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁকে সচিবের মর্যাদা দেওয়া। যেতে পারে। আগা হিলালির স্বাভাবিকভাবেই এই প্রস্তাবে ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল এবং একটি দ্রুত সিদ্ধান্ত তাঁর জন্য খুবই উপকারী হতাে। তিনি এ বিষয়ে আমাকে খোঁজখবর নিতে অনুরােধ করেন। অবশ্য তা ছাড়া তাঁর রাজত্বে যে নতুন কর্মচারী অচিরে হাজির হবে, তাকে পরখ করে নেবারও বােধ হয় তাঁর একটি ইচ্ছা ছিল।
৩১
প্রস্তাবটির মধ্যে যুক্তি ছিল বলে আমার মনে হয় এবং যথাযথ মহলে আমি সেই অভিমতও ব্যক্ত করি। কিন্তু পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের আপত্তিতে প্রস্তাবটি অন্তত ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। পরবর্তী খবর আমার জানার কথা নয়। কারণ, আমি ওই সময়ই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে এবং ওই দেশটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক চুকিয়ে দিই। আগা হিলালি একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাঁর একটি অভ্যাস বা কৌশল ছিল খুব চমৎকার। তখনকার দিনে বিদেশে যারা চাকরি করতেন, তারা সহজে দেশের মধ্যে যে অনবরত পরিবর্তন বা উন্নয়ন হচ্ছে, সে সম্বন্ধে মােটেই ওয়াকিবহাল থাকতেন না। এখন আনাগােনা অনেক বেশি, তথ্য বিনিময়ে হয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, টেলি ও টিভি সংযােগ হয়েছে যুগান্তকারী এবং ভ্রমণও অনেক বেড়েছে। তার ফলে বাইরে থাকলেও প্রবাসীদের বিচ্ছিন্নতা অনেক কমেছে। হিলালি নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখবার জন্য খুব চেষ্টা করতেন। দেশ থেকে সরকারি বা বেসরকারি যারাই ওয়াশিংটনে যেতেন, তাঁদের সঙ্গে যােগাযােগ করে তিনি খবর আদায় করতেন। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব, যারা তখন ওয়াশিংটনে গিয়েছেন, তাঁরা এর সাক্ষী। লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী জিয়াউল হক টুলু ১৯৭০ সালে এক পাট ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে যান। একসময়ের সচিব সালাউদ্দিন আহমদ বিশ্ব। ব্যাংকের সঙ্গে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প ঋণের বিষয়ে চুক্তি আলােচনা করতেও যান। ওই বছরই। হিলালি তাঁদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেশের খবর আদায় করতেন। তাঁরা দুজনই এখন ইহজগতে নেই। তার একটি বাঁধা ব্যবস্থা ছিল এসব অভ্যাগতকে আপ্যায়ন করা এবং এই সুযােগে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা।
হিলালি যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং একই সঙ্গে মেক্সিকোতেও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। বছরে বােধ হয় একবার তিনি মেক্সিকো যেতেন। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিমার্চে তিনি মেক্সিকোতে যান। এর কিছুদিন আগে তিনি পাকিস্তান ঘুরে গিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি। ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গেও। তিনি অচিরেই অবসর গ্রহণ করবেন, তারই প্রস্তুতি হিসেবে ছিল পাকিস্তান সফর। পূর্ব পাকিস্তানে তিনি যখন যান, তখন ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন, এ দুটি বিষয়ে তিনি বিশেষ করে অবহিত হতে প্রয়াস পান। দেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি আমাদের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা বিবৃত করেন। ওই আলােচনাকালেই তিনি বলেছিলেন যে ভুট্টোকে ছাড়া কোনাে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা হতে পারে না আর এতেই এনায়েত করিম প্রতিবাদ করে বলেছিলেন যে কোয়ালিশন সরকার হলেও ভুট্টো যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন, তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই, প্রধানমন্ত্রী নিজেই হয়তাে সেই দায়িত্ব নিতে পারেন । ২ মার্চে ফ্লোরিডা থেকে হিলালি আমাকে টেলিফোন করেন, সম্ভবত রাতের
৩২
বেলা। তিনি তখন মেক্সিকোর পথে। ততক্ষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘােষণার ফলে ঢাকা ফেটে পড়েছে এবং উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। তিনি এ বিষয়েই কথা বললেন। দপ্তরে সারা দিন এ নিয়েই আলােচনা হয়েছে। আমার দপ্তর যে তলায় ছিল সেখানে আমরা তিনজন কর্মকর্তা ছিলাম। আমার মিনিস্টার এ আর বশির (আরেকজন সিএসপি কর্মকর্তা) ও প্রচার অ্যাটাশে এস এন কুতুব। প্রায়ই আমার দুজন সহকারী, যারা অন্য দালানে কাজ করতেন—সার অ্যাটাশে কর্নেল হক নওয়াজ এবং খাদ্য অ্যাটাশে ইকরামুল্লা খান—তারা আমাদের। আলােচনায় শামিল হতেন। মাঝেমধ্যে নৌবাহিনী অ্যাটাশে কমান্ডার (ঠিক মনে নেই) শামসি এতে যােগ দিতেন। একতরফা পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা। ইয়াহিয়াকে দোষারােপ করেছি এবং আমি বলেছি যে ইয়াহিয়া নিজে ঢাকায় গিয়ে এর সুরাহা না করলে দেশ ভাগ হয়ে যাবে ।
আমি হিলালিকে আমার মতামত জানালাম আমাদের দপ্তরে আলােচনার জের টেনে। হিলালির উপদেশ ছিল যথাযথ, তােমরা মাথা গরম কোরাে না, বিদেশে উত্তেজনা প্রকাশ করা সমীচীন হবে না। তবে তিনি একটি মন্তব্য যােগ করেন, যা এখনাে অবিকল আমার স্মরণ রয়েছে। How can he accept a centre with only two and half subjects?’ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ভুট্টো কী করে আড়াই বিষয়ে দায়িত্বশীল একটি কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেবেন? বিপদটি এখানেই, গণতন্ত্র মেনে নিলে কায়েমি স্বার্থ তাে ব্যাহত হয়। যদিও নির্বাচনী প্রচারে ভুট্টো ছয় দফা নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। শুধু রুটি, কাপড় ও মাকান’-এর (বাড়ি) অঙ্গীকার করেছেন; স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে তাঁর তথা গােটা পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ঘাের আপত্তি। অগ্রসর এলাকার যারা দেশ শাসনের সর্বস্তরে অন্যায়ভাবে ক্ষমতাশালী ছিলেন, স্বায়ত্তশাসন ছিল তাদের দুচোখের শূল। অনগ্রসর এলাকাকে বঞ্চিত করার এবং শােষণ করার সব সুযােগকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন একেবারে বিতাড়ন করে দেবে। তাই ছয় দফাকে যেকোনােভাবে বানচাল করতে হবে।
আগা হিলালি দ্বিতীয় দফা টেলিফোন করেন ৮ মার্চে, হয়তাে মেক্সিকো থেকে অথবা আমেরিকায় ফিরে ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তনের আগে। সেই একই নসিহত-উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করাে। মনে হলাে যে বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চে যে। একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণা দেননি, তাতে তিনি বেশ আশ্বস্ত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে দেখা হয় কয়েক দিন পর (২৬ মার্চের আগে) এনায়েত করিমের বাড়িতে এক পার্টিতে। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের উপসহকারী সচিব ক্রিস ভান হােলেন (অবসর শেষে ১৯৮০ সালে তিনি এশিয়ান সার্ভেতে নিক্সন-কিসিঞ্জার ঝোঁক নীতির ওপর একটি উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লেখেন) এবং
৩৩
বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষ প্রকল্প বিভাগের পরিচালক রবার্ট সেডােভ। তখন বােধ হয় ঢাকায় সংলাপ শুরু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। সুতরাং সবাই খুব আশাবাদী। এরপর পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করা পর্যন্ত আগা হিলালির সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। কথাবার্তা হয়েছে অন্যজনের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হিলালি অবসর নেন এবং বর্তমানে পাকিস্তানের করাচিতে বসবাস করেন।
হিলালি রাষ্ট্রদূত হিসেবে খুব সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন আসরে তিনি বক্তৃতা দিতেন, পাকিস্তানের অর্থনীতি, বিনিয়ােগের সুযােগ ও বাণিজ্যের সুবিধা নিয়ে কথা বলতেন। এসব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই আলাপ-আলােচনা হতাে এবং আমাদের মধ্যে খানিকটা ঘনিষ্ঠতা ছিল। বেগম হিলালির আতিথেয়তার সুনাম ছিল । তিনি ছিলেন একজন সুন্দরীশ্রেষ্ঠ এবং উচ্চমার্গের মেজবান। রান্নাবান্না ও মহিলা সমিতি সংগঠন নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ভালােই সম্পর্ক ছিল। মাঝেমধ্যে তাঁর অতিথিদের জন্য বিশেষ কোনাে রান্নার অনুরােধ আমার স্ত্রীকে রাখতে হতাে। ১৯৭১-এর মার্চের পর আগা হিলালির সঙ্গে দেখা হয় বিশ্ব ব্যাংকের লবিতে ১৯৮৭ সালে, একটু সময়ের জন্য। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলের শেষে হিলালি দম্পতির সঙ্গে দেখা করাচির সিন্দ ক্লাবে। অতিথিপরায়ণ বেগম হিলালি আগের মতােই আছেন, সুন্দরী, পরিশীলিত এবং সহজ মাধুর্যময় । ১ মের সারাটি দিন তাদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভােজে একটি চমৎকার সময় কাটাই। ঘটনাচক্রে তাদের পাচক ছিলেন একজন বাঙালি। অনেক কথা হলাে অবিভক্ত বাংলার প্রশাসন নিয়ে এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের গুণাবলি নিয়ে। সামরিক শাসন থেকে মুক্তির কথা ছিল আমার গর্বের বিষয়। ১৯৭১-এর তিক্ত অভিজ্ঞতা খুব সাবধানে হিলালি দম্পতি এড়িয়ে গেলেন। যুদ্ধের রণনিনাদ নিতান্ত ভদ্রলােককেও কেমন যেন উন্মত্ত এবং যুক্তিহীন বানিয়ে দেয়।
ফ্লুতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছি শনিবার ৬ মার্চ। বিল ম্যাকুলক বিশ্ব ব্যাংকে পাকিস্তান বিভাগে কাজ করে। সেই সূত্রে পরিচয়। জার্মানিতে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যখন মােতায়েন ছিল, তখন একজন চিত্রশিল্পে অনুরাগী মেয়ে ব্রিজিটের সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয়। তারা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । বিলের একটি মােটরবােট আছে, গ্রীষ্মে আমরা পটোমাক মােহনা আর চিঝাপিক উপসাগরে এই নৌযান নিয়ে বেড়াতে যাই। চিঝাপিক উপসাগরের কাঁকড়া খুবই প্রসিদ্ধ, বিশেষ করে নরম শেলের কাঁকড়া, যা অত্যন্ত সুস্বাদু। বিল একজন করিতকর্মা মার্কিন যুবক, কংগ্রেসের আনাচকানাচে, সাংবাদিক মহলে, শিক্ষক মহলে সর্বত্র তার পরিচিত লােক আছেন। মার্কিন মুলুকে বাধ্যতামূলক সামরিক সার্ভিস এ ধরনের বিস্তৃত পরিচিত গােষ্ঠীর উন্মেষে অবদান রাখত। বিল বাংলাদেশের বন্ধু, কার্যোপলক্ষেই সে বৈষম্যের ও বঞ্চনার কাহিনি অনেকটা জানে। বাংলাদেশের
৩৪
ঘটনাবলি নিয়ে সে-ও চিন্তিত ও উৎসুক। বিল টেলিফোন করল যে তার এক পরিচিত ব্যক্তি ওয়াশিংটন পােস্ট কাগজের একজন সম্পাদক, তার বিভাগ হলাে জাতীয় বিষয়াবলি (national affairs)। সে বাংলাদেশের ওপর একটি কাহিনি লিখেছে এবং আরও লিখবে। তার সঙ্গে আমি গােপনীয়তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। আমি রাজি হলে তার বন্ধু রন কোভেন আমাকে টেলিফোন করবে। রােনাল্ড কোভেনের ওই দিনের কাহিনিটি আমার ভালাে লেগেছে, আমি এককথায় রাজি হয়ে গেলাম।
দু-এক দিনের মধ্যে একটি বিশ্লেষণধর্মী কাহিনি প্রকাশ করবে বলে রন আমার সাহায্য চাইল। আগামী দিন কী হতে পারে, তা নিয়ে সে খুব চিন্তিত এবং বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে বিস্তৃত আলােচনা করতে চায়। আমি শয্যাশায়ী বলে সে কয়েকটি প্রশ্নের ওপরই জোর দিল । একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার সম্ভাবনা নিয়ে আমরা অনেকক্ষণ আলাপ করলাম। শেখ সাহেব নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিত্ব, যুদ্ধবাজ বিপ্লবী নন। তার চারপাশে উত্তপ্ত যুবকেরা রয়েছে। সত্যি কিন্তু তার নেতৃত্ব ছাড়া তারা এগােতে পারবে না। আমার অভিমত আমারই মনের মাধুরী দিয়ে রচিত, রনকে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলাে। টিক্কা খান সম্বন্ধে রনের আরেক প্রশ্ন । টিক্কা খানের বেলুচিস্তানের কসাই বলে যে পরিচিতি ছিল, তার বিস্তৃত বর্ণনা এবং তার রক্তলােলুপতা আমি ভালাে জানতাম। রনকে সেই বিবরণ শুনতে হলাে। ৮ মার্চ রনের কাহিনি বেরােল ‘East Pakistan Leader stops short of Declaring Independence’ (পূর্ব পাকিস্তানের নেতা স্বাধীনতা ঘােষণায় বিরত থাকেন)। সেই কাহিনিতে রন এক জায়গায় লেখে, ‘Tikka was described by one qualified source as’ ‘blood thirsty’ (এক ওয়াকিবহাল সূত্র টিক্কাকে রক্তলােলুপ বলে বর্ণনা দেয়)।
রনের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তার কয়েক দিন পর দুপুরে শে কাম্যি (ল) নামের এক ফরাসি রােস্তারায়। রন দম্পতি আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়। আশির দশকে রন দম্পতির মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয় এবং রন প্যারিসে চলে যায়। তারপর আর আমাদের যােগাযােগ নেই। রনের মা বােধ হয় ছিলেন ফরাসি এবং রন ফরাসি রান্না খুব পছন্দ করত। রনের মাধ্যমে পাচক কামি (ল) আমার বন্ধু বনে যায়। একবার ব্রিন মরের ছাত্রী আমার মেয়েকে দিনে বেশ দেরিতে আমি কাম্যির (ল) রেস্তোরায় নিয়ে যাই। খানা তখন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কাম্যি ঝটপট করে অত্যন্ত উপাদেয় খাবার তৈরি করে আমার মেয়েকে তাক লাগিয়ে দেয়। কাম্যি (ল) রেস্তোরা অনেক দিন হলাে বন্ধ হয়ে গেছে । ওয়াশিংটনে অনেক রেস্তোরাই এভাবে বিলীন হয়ে যায়, অনেকে আবার হাতবদল হলেও নাম রেখে দেয়।
৩৫
৪ আগস্টে ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কের অবশিষ্ট সব বাঙালি কূটনীতিবিদ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেন। এই উপলক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনের প্রয়ােজন পড়ে। আমার অনুরােধে রন কোভেনই তখন জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। সম্মেলনটি আমিই ডাকি বলে বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতিনিধি বা নেতা হিসেবে আমাকে কোনাে কোনাে সংবাদ মাধ্যম দলনেতা বলে পরিচয় দেয়। আসলে পাকিস্তান মিশন দুটি থেকে পদত্যাগকারী দলের নেতা ছিলেন জাতিসংঘে ডেপুটি স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আনওয়ারুল করিম। অবশ্য তিনি বােধ হয় সব সময় পেছনের সিটে বসতে স্বস্তি বােধ করতেন।
মার্চ মাসে ঢাকায় বিদেশি সংবাদদাতারা ভিড় করেন। ২৭ মার্চ পাকিস্তান সরকার তাদের ৩৫ জনকে শুধু ঢাকা থেকে নয়, বরং পাকিস্তান থেকেই বিতাড়ন করে। ঢাকায় তাদের উপস্থিতি বিদেশে আমাদের বাংলাদেশের খবর পেতে খুবই সাহায্য করে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সিডনি শেনবার্গ ও টিলমান ডুরডিন, ওয়াশিংটনের ইভনিং স্টার-এর হেনরি ব্রেডশার, বাল্টিমাের সা-এর জন উডরাফ, ওয়াশিংটন পােস্ট-এর সেলিগ হ্যারিসন, অ্যাসােসিয়েটেড প্রেসের আরনল্ড জেইটলিন-তারা প্রায় প্রতিদিন খবর দিতে থাকেন। ৯ মার্চ ইয়াহিয়া যখন ঢাকায় যাবেন বলে ঘােষণা দিলেন, তখন শুরু হলাে প্রতীক্ষার লুকোচুরি খেলা। অবশেষে ১৬ তারিখ সংলাপ শুরু হলে যেন রােজনামচা বেরােতে থাকল। ইতিমধ্যে শুধু জাতীয় দৈনিক নয়, মফস্বলের কাগজেও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হতে থাকল। নিউইয়র্ক টাইমস ও বাল্টিমাের সান ৩ তারিখে আর বােস্টনের ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর ৪ তারিখেই সম্পাদকীয় লিখল। এদের কথা ছিল একটাই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযােগ যেন বুলেটের আঘাতে বিধ্বস্ত না হয়। ২২ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত খবরে আশা ও ব্যর্থতার দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটন পােস্ট-এ বাংলাদেশের খবরে যেসব শিরােনাম কদিন ব্যবহৃত হয়, সেগুলাে ছিল নিম্নোক্ত :
২২ তারিখ : Pakistan : Accord Hopes Rise পাকিস্তান : সমঝােতার উজ্জ্বল সম্ভাবনা
২৩ তারিখ : Pakistan Leaders confer, Agree to Delay Assembly পাকিস্তান নেতাদের আলােচনা, পরিষদ বৈঠকের দেরিতে সম্মতি
২৪ তারিখ : Pakistan talks Hit Deadlock; 35 killed as violence flares পাকিস্তানি সংলাপে অচলাবস্থা : সহিংসতায় ৩৫ জন নিহত
২৫ তারিখ : Pakistanis Agreement Reported : Complete Agreement Reported in Pakistan Political Discussion
৩৬
পাকিস্তানি মতৈক্যের সংবাদ : পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংলাপে সম্পূর্ণ সমঝােতার খবর।
২৫ তারিখে সামরিক আক্রমণের পর মার্চ মাসে যে খবর বেরােয়, তাতে ছিল পাকিস্তানিদের ধ্বংসলীলা ও হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ বিবরণ। বহিষ্কৃত সাংবাদিকেরা যেসব বিবরণ দিতে শুরু করলেন, তা ছিল যেমন হৃদয়বিদারক, তেমনি উত্তেজনাকর। হেনরি ব্রেডশার ২৭ তারিখে লিখলেন, ‘Army shells, burns | rebel Dacca (সামরিক বাহিনী বিদ্রোহী ঢাকায় কামান দাগে এবং জ্বালিয়ে। দেয়।)। পরের দিন লিখলেন, Dacca is burning.’ (ঢাকা জ্বলছে)। তিনি এর । সঙ্গে দিলেন ঢাকার ধ্বংসলীলার একটি নির্ঘণ্ট । ২৯ তারিখ সিডনি শেনবার্গ লিখলেন, ‘Sticks and Spears against Tanks. (ট্যাংকের মােকাবিলায় লাঠি আর বল্লম)। একই দিনে হেনরি ব্রেডশার আবার লিখলেন, ‘Pakistan in agony after the storm. (ঘূর্ণিঝড়ের পর পাকিস্তানের আবার যাতনা)। মার্চ মাসে বাল্টিমাের সান-এ চারটি, নিউইয়র্ক টাইমস ও ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর তিনটি করে এবং ওয়াশিংটনের ইভনিং স্টার ও ডেইলি নিউজ-এ দুটো করে সম্পাদকীয় লেখা হয়। মার্কিন সংবাদপত্রে শীতল যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদেশি একটি কাহিনি এ রকম গুরুত্ব, এর আগে কোনাে দিন পায়নি এবং পরেও বিগত ৪৫ বছরে আর পেয়েছে বলে আমার জানা নেই।
প্রতি মুহূর্তে ঢাকার খবর পাওয়া সত্ত্বেও আমাদের উৎকণ্ঠার সীমা ছিল না। যেকোনাে আসরে এবং কূটনৈতিক পার্টিতে ঢাকার সংলাপ, অসহযােগ আন্দোলন ও পাকিস্তান বিভাগ আলাপ-আলােচনার মুখ্য বিষয়। মার্কিন মুলুকে ছড়িয়ে পড়া বাঙালিরাও তখন অনবরত টেলিফোন করছেন আর জটলা পাকাচ্ছেন। ইতিমধ্যে হারুন রশীদের এক সহকর্মী উলফ ডুয়েস ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের মিশন সমাপ্ত করে ওয়াশিংটনে ফিরেছেন। ওয়াশিংটনে আমার অনুজসম হারুন অর রশীদ তখন বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি করতে আসেন। তার পিতা ছিলেন ঢাকায় আমার সচিব আবদুর রশীদ সিএসপি। হারুন করাচিতে আমার সহকর্মী ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনে ডেপুটি চিফ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা খুবই ঘনিষ্ট ছিলাম । হারুন রশীদ আমাদের হয়ে মুজিবনগরেও গিয়েছিলেন এপ্রিল মাসেই।
উলফ ডুয়েস বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের জ্বালাময়ী বক্তৃতা টেপে ধারণ করে নিয়ে এসেছেন। এই টেপের কদর সর্বত্র, সবাই শুনতে চায় অথবা কপি চায় । ২১ মার্চ ছিল রােববার। হারুন রশীদ আর আমি চললাম নিউইয়র্কে; ওখানে বাঙালিরা অনেক সংগঠিত এবং দলে ভারী। তাদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন ছিল আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেদিন পূর্ব পাকিস্তান লীগের একটা সভা ছিল। ডিসেম্বরেই পাকিস্তান লীগের নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান লীগ করা হয় এবং মার্চের শেষে
৩৭
আরেক দফা নাম বদলে এই সংগঠনই হয় বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা। নিউইয়র্কের বন্ধুবর্গ সংলাপ নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন না, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়াই সমীচীন মনে করেন। তারা সারা আমেরিকার বাঙালিদের সংগঠনের বিষয় আলােচনা করেন এবং ওয়াশিংটনকে একটি নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে আহ্বান জানান। এ সভায় খন্দকার আলমগীর ছিলেন একজন প্রধান উদ্যোক্তা এবং বাঙালি কূটনীতিবিদেরাও উপস্থিত ছিলেন বলে আমার মনে হয়। কাজী শামসুদ্দিনের চিঠিপত্র লেখায় আমার মনে হলাে যে এস এ করিম ছিলেন তার বুদ্ধিদাতা। ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী ছিলেন যেন এই সংগঠনেরই একজন সক্রিয় কর্মী।
আমরা ফিরে এসেই ঠিক করলাম যে ওয়াশিংটনে আমাদের একটি সংগঠন গড়ে তােলা দরকার। ওয়াশিংটনে তখন বেশ কজন বাঙালি ছিলেন। দূতাবাসে আমাদের সংখ্যা ছিল খুব ভালাে। উপমিশন-প্রধান ছিলেন মিনিস্টার এনায়েত করিম, রাজনৈতিক কাউন্সেলর ছিলেন শাহ আবু মােহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া, শিক্ষা কাউন্সেলর ছিলেন আবু রুশদ মতিন উদ্দিন, হিসাবরক্ষক (দ্বিতীয় সচিব) ছিলেন মােহাম্মদ আতাউর রহমান চৌধুরী, তৃতীয় সচিব ছিলেন সৈয়দ মােয়াজ্জেম আলী (তার প্রথম নিযুক্তি)। তিনজন স্থানীয় অফিসার ছিলেন—শিক্ষা বিভাগের আবদুর রাজ্জাক খান, প্রশাসনে এ এম শরফুল আলম এবং প্রচারে শেখ রুস্তম আলী। এ ছাড়া আরও অনেক কর্মচারী ছিলেন, যাদের কিছু ছিলেন স্থানীয় অধিবাসী। বিশ্ব ব্যাংকে ছিলেন তিনজন কর্মকর্তা—পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের হারুন রশীদ, ড. আবদুন নুর এবং ড. মনােয়ার হােসেন। এ ছাড়া কিছু পেশাজীবী বা ছাত্রও ছিলেন যেমন এনায়েতুর রহিম, ড. শামসুল হক, এম এ বাতেন, মাহবুব আলী, ড. এম আবদুল আজিজ এবং ভয়েস অব আমেরিকার ইশতিয়াক আহমদ, ইকবাল আহমদ ও মােহাম্মদ কাফী। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু ছাত্র বা প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন (যেমন মহসিন রেজা সিদ্দিকী, ফরহাদ ফয়সল, নাসিম রহমান, রফিকুল হুদা চৌধুরী, ডা. মুশফেকুর রহমান), যাঁদের সঙ্গে তখন আমাদের যােগাযােগ ছিল না। ২৩ মার্চ আমরা সবাই এনায়েত করিমের বাড়িতে সমবেত হলাম। এদিন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা এবং একটি কেক বানিয়ে নিয়ে এলেন মিসেস আসমা কিবরিয়া। এই আসরে নৈশভােজ হলাে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জাতীয় সংগীত হলাে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা পরিচালনার জন্য একটি সমিতি গঠন করা হলাে। এই সমিতি গঠন নিয়ে খানিকটা ইতস্তত ভাব ছিল এবং সভাপতি নির্বাচন নিয়ে কিছুটা ঠেলাঠেলি হয় । এক-আধজন প্রস্তাব করলেন যে আমাকে দায়িত্বটি নিতে হবে। তবে আমরা সবাই জোর করলাম যে আমাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতায় সর্বোচ্চ এনায়েত করিম হবেন
৩৮
আমাদের নেতা। সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হলাে হারুন রশীদকে। ওই দিন রাতে আমাদের আশা ছিল যে একটি সমঝােতা হবে, তবে নতুন দেশটি হবে অন্য রকমের, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একটি কনফেডারেশন। এ ধরনের আশাবাদ তখন ওয়াশিংটনের ওয়াকিবহাল মহলে সর্বত্র বিরাজ করছিল। ২৪ মার্চ ইন্দোনেশীয় কূটনীতিবিদ ইব্রাহিমের বাড়িতে আমাদের দাওয়াত ছিল, সেখানেও সব আলােচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশের সমঝােতা। ইন্দোনেশীয় এই পার্টিতে ছিলেন কাপড়শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লােকজন। যুগােস্লাভিয়া, তুরস্ক ও ভারতের কজন কূটনীতিবিদ এবং স্টেট ও কমার্স ডিপার্টমেন্টের কজন কর্মকর্তা। ইন্দোনেশিয়া তখন কাপড় ও পােশাকশিল্প গড়ে তুলবার জন্য পাকিস্তানের সাহায্যপ্রার্থী। যুগােস্লাভিয়া পােশাক রপ্তানির জন্য আমেরিকার সঙ্গে কোটা নিয়ে আলােচনা করছে। পাকিস্তান ১৯৭০ সালে একটি সুবিধাজনক কোটা চুক্তি সম্পন্ন। করছে। এই কোটা চুক্তি সম্পন্ন করতে পাকিস্তান দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্যসচিব আবদুর রব। মার্কিন দলপতি ছিলেন জুলিয়ান কাটজ, স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহকারী সচিব। এই কোটা নিয়ে প্রস্তুতিপর্বে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের সহকারী উপসচিব স্টেনলি নেমার এবং আমি খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করি । কোটা চুক্তির আলােচনার শেষ পর্যায়ে জটিলতার সমাধানও হয় আমার বাড়িতে একটি নৈশভােজে। এ কারণে যুগােস্লাভিয়া, তুরস্ক ও ইন্দোনেশীয় দূতাবাসে আমার কদর খানিকটা বেড়ে যায়। যা হােক, সব আশার গুড়ে বালি দিয়ে এল ২৫ মার্চের কালরাত্রি। ২৫ তারিখের কাগজপত্রে যা বেরিয়েছিল, তাতে এই ভয়ংকর পরিণতির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
ওয়াশিংটন গ্রিনউইচের পশ্চিমে । ওখানকার ঘড়ি গ্রিনিচের ছয় ঘণ্টা পেছনে আর পাকিস্তানের ঘড়ি ঠিক ছয় ঘণ্টা এগিয়ে। তাই ঢাকায় যখন হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, তখন ওয়াশিংটনে ২৫ মার্চের দুপুরবেলা। কিন্তু এ খবর প্রায় ১২ ঘণ্টা অনুক্ত ছিল । ইয়াহিয়া করাচিতে পৌছে ২৬ তারিখে তাঁর বর্বরতার প্রথম ঘােষণা দেন। ২৫ মার্চের শেষ রাতে, অর্থাৎ ছাব্বিশের ভােরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের পাকিস্তান ডেস্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রেইগ ব্যাক্সটার টেলিফোন করে বললেন, “তােমাদের দেশ সম্বন্ধে জরুরি খবর আছে, এক্ষুনি রেডিও শােনাে।’ টেলিভিশনের যুগে রেডিও নিয়ে কে মাথা ঘামায়, আমার বাড়িতে কোনাে রেডিও নেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী খুবই বিচলিত। তখন মনে হলাে, গ্যারেজে গাড়িতে একটি রেডিও আছে। ত্রস্তে শীতের কাপড় গায়ে দিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। খবরে শুনলাম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘােষণা। টিক্কা খানকে বাংলাদেশে রক্তের বন্যা বহানাের হুকুম দিয়ে তিনি ঢাকা থেকে পালিয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বস্তুতই বাংলার জনগণকে আক্রমণ করেছে। কামান দাগিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে তারা শুরু
৩৯
করেছে এক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যালীলা, স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে এভাবেই গুঁড়িয়েমুড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার। এতেই রচিত হলাে সংযুক্ত পাকিস্তানের কবর এবং শুরু হলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের জন্য নিতান্তই অপ্রস্তুত জনগােষ্ঠীকে বাঁচবার জন্য তুলে নিতে হলাে হাতিয়ার। শুরুতে সেই হাতিয়ার ছিল শিকারের বন্দুক, লাঠি, তির, বল্লম আর জনস্রোত । কিন্তু পঁচিশের রাতে যে ট্যাংক, কামান ও সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলাে, তার বিরুদ্ধে মান্ধাতার আমলের প্রতিরােধ টিকল না। মফস্বলে সংখ্যার জোরে বাঙালিদের সাফল্যের মােকাবিলায় মােতায়েন হলাে বিমানবাহিনী এবং সংগঠিত বাহিনীর অভিযান। ঢাকাকে নিমেষে ঠান্ডা করে দিল ইয়াহিয়ার রক্তলােলুপ সামরিক শক্তি। প্রতিরােধ গড়ে উঠল ঢাকার বাইরে, চট্টগ্রামের বন্দরে, মফস্বল শহরে ও বাজারে।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারিত হলাে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে । যেখানে সব সমস্যার সমাধান ছিল একটি কনফেডারেশনে, সেখানে শুরু হলাে। এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সংগঠিত সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরােধ প্রথম ধাক্কায় খুব মার খেল । শহরের পর শহরে পাকিস্তানি দস্যুবাহিনী দখল বসাল । কিন্তু মানুষের মতের বিপরীতে এই দখল হলাে সাময়িক। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সূচনার খবর শুনলাম ভাের রাতে একটি গাড়ি-রেডিওতে। ২৩ বছর যাদের সঙ্গে থেকেছি, তাদের এই ব্যবহার আমাদের ব্যথিত করল না, করল ক্ষুব্ধ। ওয়াশিংটন যাবার প্রাক্কালে আমরা প্রায় পাঁচ বছর পশ্চিম পাকিস্তানে থেকেছি, তখনাে আমাদের বাক্সপেটরা ওখানে রয়েছে। এমন হিংস্রতার সঙ্গে এরা যে ছােবল দিতে পারে, তা ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে। মিলেমিশে না থাকতে পারলে ভদ্রভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া যেত । এ রকম সামরিক পদক্ষেপের তাে প্রয়ােজন ছিল না। ব্যাপারটি ছিল একেবারে অভাবনীয়। সমঝােতার খবরই বেশি করে ফলাও হচ্ছিল। সমঝােতা না হলে এ রকম আন্দোলনে ধরপাকড় করে উত্তেজনা হ্রাসের প্রচেষ্টা হয়, তারপর সুষ্ঠু পরিবেশে সংলাপ আবার চলে। আমার বিবেচনা এই রকম ছিল বলে খবরটি আমাকে বিমূঢ় করে দেয়। ধীরে ধীরে সংবিৎ ফিরে পেলাম, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত মহল নিয়ে হলাে পরবর্তী চিন্তা। কে কোথায় আছে, কার সর্বনাশ হচ্ছে, তাই নিয়ে আমরা ভাবিত হলাম। ধাতস্থ হতে বেশ সময় লাগল। বেশি দেরি করে দূতাবাসে গেলাম, সেদিন শুক্রবার। এমন একটি বর্বর কাণ্ড হয়েছে যে কারও মুখে কথা নেই। আমাদের তিনতলার আড্ডা সেদিন বসল না। সবাই গম্ভীর ও ম্রিয়মাণ, কেউ দুঃখিত, কেউ হয়তাে আহ্লাদিত আর আমি ক্ষুব্ধ। আলােচনার কোনাে অবকাশ সেদিন ছিল না। বাঙালিরা ঠিক করল যে তারা পরদিন বিকেলে আমার বাড়িতে সমবেত হবে।
৪০
২৭ মার্চ বিকেলে ওয়াশিংটনের বাঙালি সমাজ আমার বাসায় হাজির। যে খবর পেয়েছে, সে-ই এসেছে। আমার মনে হলাে, পরিবার-পরিজন নিয়ে আমাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই হাজির, পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ করতে হবে এবং একে প্রতিহত করার কথা ভাবতে হবে। ঢাকার হত্যাযজ্ঞ এবং দেশব্যাপী ধ্বংসলীলা পাকিস্তানের কবর রচনা করেছে, এখন বিবেচনার বিষয় একটি। কী করে কত দ্রুততার সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে উৎপাটন করা যাবে। উদ্যোক্তা হিসেবে আমাকেই বলতে হলাে, আমরা এখন আর পাকিস্তানি নই এবং পাকিস্তানি হায়েনাদের শায়েস্তা করা আমাদের কর্তব্য। প্রবাসে আমরা জনমত গড়ে তুলতে পারি। আমাদের দেশে ত্রাণকার্য ও যুদ্ধ-উদ্যোগে সাহায্য করতে পারি এবং পাকিস্তানকে সর্বতােভাবে অপদস্থ করতে পারি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলাে যে মার্কিন ও আন্তর্জাতিক নেতাদের কাছে বার্তা পাঠাতে হবে। আরও ঠিক হলাে যে সােমবারে শােভাযাত্রা হবে—কংগ্রেসের সিঁড়িতে, বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সামনে আর স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে। পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে কি না, সে বিষয়েও আলাপ-আলােচনা হলাে, তবে তাতে গুরুত্ব দেওয়া হলাে না। যাদের স্বীকারই করছি না, তাদের কাছে ফরিয়াদ করে কী লাভ।
বাঙালিদের আসরে বিতর্ক স্বাভাবিক, এদিনও অনেক বিতর্ক হলাে। বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য আরও খবরের অপেক্ষায় থাকা সমীচীন কি না, দূতাবাসে কর্মরত বাঙালিরা কি দূতাবাস পরিত্যাগ করবেন? এই আসরে একজন বাঙালির পাকিস্তানি স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি এসব আলােচনায় খুব স্বস্তি বােধ করছিলেন না । পরবর্তী সময়ে আমরা জানলাম যে তিনি সভার বিবরণী এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার পুরাে কথা সযত্নে দূতাবাসে পৌছে দেন। তিনি এর পরও মাঝেমধ্যে আমাদের আসরে আসতেন এবং আমরা কখনাে তাঁকে বিতাড়ন করার ব্যবস্থা নিইনি। আমেরিকার মুক্ত মাটিতে এসব গােয়েন্দাগিরির কোনােই মূল্য ছিল না । গােপনীয়তা ও গােয়েন্দাগিরিতে আমরা এতই অভ্যস্ত ছিলাম যে আমাদের অনেকেই টেলিফোনে কথা বলতে দ্বিধা বােধ করতেন। আমাকে অনেকেই উপদেশ দেন যে আমি যেন সাবধানে চলাফেরা করি। কারণ, টিকটিকিরা আমার পেছনে লেগেছে। আমার কাছে বিষয়টি হাস্যকরই মনে হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য টেলিফোনে আড়ি পেতে শােনার কোনাে ব্যবস্থা অথবা কারও পেছনে টিকটিকি লাগানাের ধারণাটিই ছিল উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত। আমার টেলিফোন নিয়ে এক কাহিনি তখন বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। জুলাই মাসে মুজিবনগর থেকে মাহবুব আলম চাষীর এক চিঠিতে এই খ্যাতির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমি শুধু মার্কিন মুলুকে নয়, যত্রতত্র যেসব বাঙালিকে চিনতাম, তাদের সঙ্গে আলাপ
৪১
করতাম। মার্চ মাসে দেখি টেলিফোনের বিল হঠাৎ প্রায় ১০-১৫ ডলার থেকে ৬৬ ডলারে উপনীত হয়েছে। এপ্রিলের বিল হলাে ৩৪১ ডলার। তারপর কিন্তু শেষােক্ত ডলারের নিচে আর নামেনি। কতিপয় ব্যক্তি প্রতিদিন একবার টেলিফোন না করে থাকতে পারতেন না। টরন্টো থেকে প্রতি সকালে আসমত আলী একবার যােগাযােগ করতেনই ।
২৯ তারিখের বিক্ষোভের জন্য কাজ ভাগ করে নেওয়া হলাে। প্রথম কর্তব্য ছিল আমেরিকায় সর্বত্র খবর পৌছানাে। ঠিক হলাে যে যার যেখানে যােগাযােগ আছে, তিনিই সেখানে খবর দেবেন এবং দলেবলে র্যালিতে যােগ দিতে আহ্বান জানাবেন । উদ্যোক্তা ব্যক্তিরা তক্ষুনি টেলিফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন এবং ফজলুল বারী এতে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। বাইরে থেকে যারা আসবেন, তাঁরা উদ্যোক্তা যেকোনাে ব্যক্তির বাসায় রাত্রি যাপন করতে পারবেন। তাই তাদের বিভিন্ন ঠিকানা বলে দেওয়া হলাে। র্যালির জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুমােদন নিতে হবে। এ দায়িত্ব নিলেন ফজলুল বারী ও মাহবুব আলী। ফজলুল বারী সুনামগঞ্জের অধিবাসী। পড়তে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন । ভিসার সুবিধার জন্য তখন দূতাবাসে তিনি একটি ছােটখাটো চাকরি করেন। মার্কিন কৃষি বিভাগে একটি ছােট দপ্তর ছিল আন্তর্জাতিক তুলা কমিটির সচিবালয়। মাহবুব আলী সেখানে চাকরি করতেন। তিনিও সিলেটের অধিবাসী। তারা দুজনই ছিলেন অনেকটা বেপরােয়া। তৃতীয় কর্তব্য ছিল স্লোগান, ফেস্টুন, পােস্টার ইত্যাদি লিখতে হবে। এ দায়িত্ব নিলেন এনায়েত রহিম। এনায়েত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চতর শিক্ষায় ওয়াশিংটনে আছেন। তারা সবাই বর্তমানে ওয়াশিংটনের বাসিন্দা এবং নানা ধরনের পেশায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। এনায়েত রহিম দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারে প্রথম। অধ্যাপক নিযুক্ত হন। আমাদের আরেকটি কাজ ছিল দাবিনামা বা আপিল প্রস্তুত করা। এ দায়িত্ব নিলাম হারুন রশীদ আর আমি। পরের দিন নিউইয়র্ক থেকে এস এ করিম এসে আমাদের ভার অনেকটা লাঘব করলেন।
২৮ মার্চ আমার প্রথম কাজ হলাে কয়েকটি তারবার্তা পাঠানাে। তারবার্তা বাংলাদেশ নাগরিকদের তরফ থেকে গেল প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সেক্রেটারি রজার্স, নিরাপত্তা সহকারী কিসিঞ্জার এবং সিনেটে বৈদেশিক বিষয়ের চেয়ারম্যান সিনেটর ফুলব্রাইটের কাছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্ট এবং নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে আবেদন পাঠানাে হলাে। দুপুরে এনায়েত করিমের বাড়িতে দেখা হলাে কজন উৎসাহী কর্মীর সঙ্গে, যাঁরা ইতিমধ্যে ওয়াশিংটনে হাজির হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন টেনেসির ন্যাশিভিল থেকে মুহাম্মদ ইউনূস ও হাবিবুর রহমান, শিকাগাে থেকে শামসুল বারী এবং ওহাইও
৪২
থেকে ডা. এস হাসান। শামসুল বারীকে ফজলুল বারী নিয়ে গেলেন পুলিশের অনুমােদনপত্র নিতে। মুহাম্মদ ইউনূস দেখি জোরেশােরে পােস্টার লিখতে লেগে গেছেন। আমাদের আপিলের খসড়া তৈরি হলে হারুন এর কপি বানাতে চলে গেলেন। সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে কিছু লােক জড়াে হলেন। একটি সিদ্ধান্ত হলাে যে দূতাবাসের কর্মচারীরা র্যালিতে যােগ দেবেন না। গউসুদ্দিন এই সিদ্ধান্ত মানতে রাজি ছিল না, সে ঠিক করল যে সে র্যালিতে যােগ দেবে। রাতেই লােকজন বাইরে থেকে আসতে লাগল । ডেট্রোয়েট থেকে এক গােষ্ঠী বােধ হয় রাত তিন-চারটায় এসে হাজির হলাে আমার দুয়ারে। আমার বাড়িতে বড় বড় দুটো কামরা ছিল, একটি বসবার ঘর এবং একটি বেসমেন্ট বৈঠকখানা। শীতের রাতে কোনাে রকম মাথা গুঁজতে অসুবিধা ছিল না। কত লােক সে রাতে এই বাড়িতে ছিলেন, ঠিক গুনিনি, তবে দুই ডজনের কম যে নয় তাতে সন্দেহ নেই।
র্যালি প্রথমে জমল ক্যাপিটল হিলের প্রশস্ত সিঁড়িতে। সকাল নয়টা থেকে সমাবেশ শুরু হলাে এবং দুপুরের পর তা একটি বড় র্যালিতে রূপ নিল। বাঙালি ছাড়াও ভারতীয় ও মার্কিন গুটিকয়েক শুভানুধ্যায়ীও তাতে যােগ দেন। দূতাবাসের কর্মচারীরা এতে অংশগ্রহণ না করলেও অনেক সরকারি চাকুরে এতে শরিক হন। হারুন রশীদ তাে ছিলেনই (তিনি ওই দিনই পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেন), এ ছাড়া অনেক প্রশিক্ষণার্থী কর্মকর্তা এতে ছিলেন, যথা বােস্টন থেকে আসা খােরশেদ আলম (একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, তখন হার্ভার্ডে ফেলােশিপ নিয়ে ছিলেন), ওয়াশিংটনে প্রশিক্ষণরত দুজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা আবদুর রহিম (মরহুম, সচিব) এবং এ বি এস সফদার (সাবেক সচিব)। গউসুদ্দিন এই র্যালিতে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে যােগ দেয়। সে পাকিস্তানের পতাকায় আগুন লাগালে এক সংকটের সৃষ্টি হয়। পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া তত দোষণীয় ছিল না কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত আগুন জ্বালানােই ছিল আপত্তির কারণ। পুলিশের উপদেশে আগুন নির্বাপণ বাহিনী আগমনের আগেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়। জাতীয় ও স্থানীয় টেলিভিশন সংস্থা র্যালির খবর পেয়ে এসে হাজির হলাে। তাদের কাছে অনেকেই বক্তব্য দেন অথবা প্রশ্নোত্তর প্রদান করেন। শামসুল বারী ও এনায়েত রহিমই মুখপাত্রের মতাে বক্তব্য দেন এবং অন্যরা বিশেষ মন্তব্য করেন। এই দ্বিতীয় দলের মধ্যে শুধু খােরশেদ আলম এবং এ বি এস সফদারের চেহারাটাই মনে আসছে।
প্রায় দুশাে লােকের র্যালি। কংগ্রেসের অনেক জনপ্রতিনিধির দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাঁদের স্টাফ অনেকেই বাঙালিদের কথা ও আবেদন মন দিয়ে শােনেন। বিক্ষোভকারীরা পরে হােয়াইট হাউসের সামনে দিয়ে এসে প্রথমে বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের দপ্তরে এবং পরে স্টেট ডিপার্টমেন্টে তাঁদের আপিল পেশ
৪৩
করেন। দূতাবাস কর্মচারী ফজলুল বারী চুপিসারে (অর্থাৎ মাঝেমধ্যে দেখা দিয়ে অথবা খানিকটা দূরত্ব রেখে) প্রায় সারা দিনই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। আমি আমার গাড়িতে করে এক-দুবার ক্যাপিটল হিলে এবং আবার শােভাযাত্রাকালে তাঁদের সঙ্গ দিই এবং কয়েকজনকে লিফটও দিই। দিনের শেষে যারা অনেক দূর থেকে এসেছেন, তারা অতিরিক্ত কালক্ষেপণ না করেই বাড়ির পথ ধরলেন, যাতে মঙ্গলবারে কাজে যেতে পারেন। বাকি শ খানেক লােক, বিশেষত শিক্ষার্থীরা আমার বাড়িতে সমবেত হলেন। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ও কৌশল নিয়ে সেখানে আলােচনা হয়।
প্রথম সিদ্ধান্ত হলাে যে যেখানে সম্ভব, সেখানে বাংলাদেশ লিগ গড়ে তুলবেন এবং নিউইয়র্ক লিগ হবে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। তবে প্রয়ােজনমতাে বিভিন্ন সংস্থা মিলে যথাসময়ে একটি নতুন সমন্বয় কমিটি গঠন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, তহবিল গড়ে তুলতে হবে। এর প্রয়ােজন হবে স্থানীয় সাংগঠনিক খরচ মেটাতে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে। তখনাে শরণার্থী সমস্যা দেখা দেয়নি। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের সঙ্গে আশু যােগাযােগ স্থাপন করতে হবে। স্বাধীনতা ঘােষণার কথা আমরা ২৭ মার্চেই খবরের কাগজে দেখেছি। দূতাবাসের কর্মচারীদের র্যালিতে যােগ না দেওয়া নিয়ে একটি বিতর্কের সূচনা হয়। র্যালির আয়ােজন মূলত দূতাবাসের কর্মচারীরাই করেন কিন্তু প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামার সময়টি উপযুক্ত কি না এ নিয়ে ছিল মতদ্বৈধতা। এক দলের অভিমত ছিল যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকাঠামাে তখনাে তৈরি হয়নি বিধায় সরকারি চকুরেদের অপশন তেমন ছিল না। আরেক দলের অভিমত ছিল যে আন্দোলনের প্রতিষ্ঠালগ্নে সরকারি চাকুরেদের সমর্থন একে শক্তিশালী করবে। এই বিতর্কে প্রধান অংশগ্রহণকারী ছিলেন খােরশেদ আলম, আলমগীর মুহিউদ্দিন, এনায়েত করিম, শামসুল কিবরিয়া, ফজলুল বারী ও ড. আবদুন নুর। উত্তপ্ত বিতর্ক ঝিমিয়ে আসে মুহাম্মদ ইউনূস ও শামসুল বারীর সমন্বয় প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এবং খানিকটা বােধ হয় খিদের তাড়নায়। স্থির হলাে যে এ বিষয়ে কূটনীতিবিদেরা অতিসত্বর একটি স্বচ্ছ সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন।
৪৪
<p style="text-align: justify;"> তৃতীয় অধ্যায়
আমেরিকায় জনসংযােগে হাতেখড়ি
পাকিস্তানের হিসাব ছিল যে ৭২ ঘণ্টায় বাঙালিদের ঠান্ডা করে দেওয়া যাবে। সামরিকতন্ত্র স্বভাবতই অস্ত্রের ঝনঝনানিতে বিশ্বাসী ছিল। বাঙালিদের সামরিক সামর্থ্য সম্বন্ধে পাকিস্তানিদের সব সময়ই একটি অবজ্ঞার ভাব ছিল। ব্রিটিশ আমলের সামরিক কৌশলও এই বিশ্বাসে অবদান রাখে। ১৮৫৭ সালে ভারতে যখন প্রথম ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়, তখন ব্রিটিশ সরকারের একমাত্র অনুগত গােষ্ঠী ছিল শিখ, পাঠান ও পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হিসাবে ওই স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল একটি সিপাহি বিদ্রোহ এবং এতে প্রধান ভূমিকা পালন করে বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও দাক্ষিণাত্যের সেনাবাহিনী। এ যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ব্রিটিশ কৌশল হলাে ভারতীয়দের একটি বিশেষ গােষ্ঠীকে সামরিক জাতি’ (Martial race) হিসেবে চিহ্নিত করা। এই তথাকথিত জাতির মধ্যে বাঙালি অথবা উত্তর প্রদেশের অধিবাসীরা ছিল না; ছিল পাঞ্জাবি, শিখ ও পাঠানগােষ্ঠী। তাই পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালিদের শায়েস্তা করার জন্য একটি অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর মূল কৌশল ছিল শঠতা, মিথ্যাচার ও আচমকা আক্রমণ। এর উদ্দেশ্য ছিল সব রকমের প্রতিরােধ বলপ্রয়ােগে নিঃশেষ করা। এর বিশেষ টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকজন এবং বাঙালি সশস্ত্র গােষ্ঠী (সামরিক বাহিনী, সীমান্ত বাহিনী এবং পুলিশ বা আনসারের বাঙালি সদস্যবৃন্দ)।
এই পরিকল্পনায় একই সময়ে সারা দেশে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে সব শহরে পাকিস্তানি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে চিরতরে মুছে দেওয়া ছিল ইয়াহিয়ার হুকুম । এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সব প্রস্তুতি আগেই নেওয়া হয়েছিল। শুধু অপেক্ষা ইয়াহিয়ার মােক্ষম সময় নির্ধারণ। ২৫ মার্চের দুপুর রাতে নির্ধারিত হয় সেই সময়। এই পরিকল্পনার কথা পাকিস্তানিরা সব
৪৫
সময়ই অস্বীকার করে যায় এবং পরিবর্তে বাঙালি বিদ্রোহের এক উদ্ভট নীলনকশা প্রচার করে। তবে ১৯৭৭ সালে সিদ্দিক সালেক নামের একজন সামরিক জনসংযােগ অফিসার তাঁর বই Witness to Surrender (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) প্রকাশ করলে এই তথ্য পাওয়া যায়। পরিকল্পনাটি ছিল একটি শক্রদেশ দখল করার জন্য সর্বোচ্চ বলপ্রয়ােগের একটি নীলনকশা এবং গণহত্যা ও ব্যাপক ধরপাকড় ছিল এর লক্ষ্য। এই পরিকল্পনার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় জেনারেল খাদেম হােসেন রাজার ২০১২ সালে প্রকাশিত বই A Stranger in My Own Country : East Pakistan, 1969-71-এ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস)। এর জন্য অশিক্ষিত পাঠান ও পাঞ্জাবি সেনাদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সযত্নে সৃষ্টি করা হয়। হিন্দু নিধন ও ইসলাম রক্ষা হয় এর স্লোগান ।
কিন্তু বাহাত্তর ঘণ্টায় ব্যাপারটি সম্পন্ন হলাে না। ঢাকাকে সহজেই মৃতের শহর বানানাে গেল । কিন্তু অন্যত্র তেমনটি হলাে না। বন্দর শহর চট্টগ্রাম দখল করতে চলে এল ৬ এপ্রিল। রংপুর আর নােয়াখালীতে প্রাথমিক প্রতিরােধ ব্যর্থ হলাে ২৬ এপ্রিল। এসব প্রতিরােধ ঘটে মানুষের রক্তে, লাঠি-বল্লমের আঘাতে এবং মান্ধাতার আমলের বন্দুক-রাইফেলের গুলিতে। সীমান্ত বাহিনীর কিছু দল এবং কয়েকটি রেজিমেন্টের সামান্য অংশ শেষ মুহুর্তে পাকিস্তানিদের শঠতা ধরতে পেরে বিদ্রোহ করে বা পালিয়ে কিছু উপযুক্ত প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। প্রাথমিক এই প্রতিরােধ নির্মূলে কালক্ষেপণ বিদেশে আমাদের জন্য একধরনের সুযােগ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানিরা তখনাে ঠিক ভেবে উঠতে পারেনি যে তারা আমাদের পরাজিত বিবেচনা করবে, না কিছু খাতির করে চলবে। এই সুযােগে মার্কিন মুলুকে জনসংযােগে আমার হয় হাতেখড়ি। বস্তুতপক্ষে সারা এপ্রিলে ছিল আমার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।
৩০ মার্চ ওয়াশিংটনের হিল্টন হােটেলে ছিল পূর্বনির্ধারিত সাউথ এশিয়া স্টাডি কনফারেন্স। মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় আগ্রহী রাজনীতি শিক্ষকদের সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশ নিতে আসেন অধ্যাপক খালেদ বিন সাইদ, রশিদুজ্জামান ও সাজ্জাদ ইউসুফ। তাঁরা সবাই কোনাে না কোনাে সময় ঢাকায় শিক্ষকতা করেছেন এবং পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। ওই দিনই ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকায় বেরিয়েছে লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের লােমহর্ষক কাহিনি। সাইমন ড্রিংকে পাকিস্তানি দস্যুরা ২৫ মার্চ রাতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে বন্দী করতে পারেনি। ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে ওই হােটেলে আটকে রেখে দুদিন পর করাচিতে পাঠানাে হয়। তবে সাইমন ড্রিং এবং আরও একজন খুব চতুরতার সঙ্গে এই ফাঁদে আটকা পড়েননি। তারা কারফিউর ৪৮ ঘণ্টা শহরে পালিয়ে বেড়ান এবং কারফিউতে বিরতি হলে বিধ্বস্ত
৪৬
ও নিহত ঢাকাকে কিছুটা ঘুরে দেখতে সক্ষম হন। ২৮ তারিখ ড্রিং বাংলাদেশ ছাড়েন ব্যাংকক হয়ে। তার প্রতিবেদন শুরু হয় এই বলে, আল্লাহ এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের নামে ঢাকা আজ পদদলিত এবং ভীত শহর।’ গণহত্যা, বস্তির পর বস্তি ধ্বংস, এলােপাতাড়ি কামান ও বন্দুক ছােড়া, ব্যাপক এলাকায় অগ্নিসংযােগ এবং অসংখ্য গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়ার দস্যুদল ঢাকায় নিয়ে আসে গােরস্থানের নিস্তব্ধতা, মৃতদেহের স্থূপ এবং বসতির ধ্বংসাবশেষ। সাইমন ড্রিং অভিমত প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে শেষ করে দিয়েছে। সম্মেলনে প্রশ্ন ওঠে, এই রকম ভয়াবহ নিপীড়ন কি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে সত্যি সত্যি বাঁচাতে পারবে? একই সঙ্গে চিন্তা জাগে যে শান্তিপ্রিয়, অস্ত্রে অনভ্যস্ত ও স্লোগানে পারদর্শী বাঙালি কি সত্যি সত্যি একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চালাতে পারবে? শেখ সাহেব যখন জেনেশুনেই পালিয়ে না গিয়ে ধরা দিলেন, তখন কেউ ভাবলেন যে নিশ্চয়ই একটি সমঝােতা হবেই। বাঙালি বিশেষজ্ঞরা তথ্যের অপর্যাপ্ততার দোহাই তুলে কঠিন প্রশ্নের সরাসরি মােকাবিলা করলেন না, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ফাটকাবাজিতে নামলেন না। তবে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবার মনেই জাগল সন্দেহ, অমীমাংসিত প্রশ্ন হলাে, কত দিনে এই বিচ্ছেদটি হবে।
পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিচ্ছেদের সমতুল্য অভিজ্ঞতা বেশি মজুত ছিল না। ১৯৬৭ সালে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বিচ্ছেদ ছিল সবচেয়ে নিকটবর্তী ঘটনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া উদ্ধত ও পশ্চাৎপদ সিঙ্গাপুরকে বিদায় করে বরং খুশিই হয়। আলজেরিয়া আর ফ্রান্সের বিচ্ছেদ ছিল বেশ অন্য ধরনের। আলজেরিয়াকে ফ্রান্সের অঙ্গ বিবেচনা করলেও সম্পর্কটি ছিল মূলত ঔপনিবেশিক। বায়াফ্রা ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘােষণা করে কিন্তু ৩২ মাস পর এই আন্দোলন পুরােপুরি ব্যর্থ হয়। নরওয়ে ও সুইডেন ১৮১৫ সালে এক শাসনের অধীনে আসে, যদিও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল খুব জোরদার । তবে ১৮৯২ সাল থেকে তাদের মধ্যে মন-কষাকষি শুরু হয় এবং ১৯০৫ সালে নরওয়ে একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণা করে বসে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আলােচনার মাধ্যমে তাদের ছেদনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘােষণা করে এবং এ নিয়ে যুদ্ধ চলে বহুকাল । যদিও মার্কিন মুলুকে স্বাধীনতা বহাল হয় ১৭৭৯ সালে, তবে ব্রিটেনের তা স্বীকার করতে লাগে আরও পাঁচ বছর (১৭৮৩)। তারপর আবার ১৮১২ সালে দুই দেশ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের ছেদনপ্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে স্বভাবতই সন্দেহের এবং অনিশ্চয়তার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। রশিদুজ্জামান ও সাজ্জাদ ইউসুফের সঙ্গে আলােচনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি অভিমত দিলাম যে
৪৭
পাকিস্তানের কবর রচিত হয়ে গিয়েছে আর বাংলাদেশ থেকে তাদের বিতাড়ন শুধু সময়ের ব্যাপার। আমেরিকা পেয়েছিল ফ্রান্সের সাহায্য, আমাদের পেতে হবে ভারতের সহায়তা।
খালেদ বিন সাইদের সঙ্গে ৩১ তারিখ দুপুরে লাঞ্চ। আলােচনার বিষয়। একটি—বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের বঞ্চনা ও অবহেলার কাহিনি তাঁর ভালাে করেই জানা। পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ, সেনাপতি আর আমলারা কীভাবে বাঙালিদের অবজ্ঞা ও অবহেলা করেন এবং তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করেন, খালেদ বিন সাইদ সে সম্বন্ধে অনেক লিখেছেন। মুখ্য সচিব আজিজ আহমদ যে পূর্ব বাংলার মন্ত্রীদের সম্বন্ধে কেন্দ্রে গােপনীয় প্রতিবেদন পাঠাতেন, সে কাহিনি খালেদই প্রথম ফাস করেন। খালেদ মাদ্রাজের লােক, পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছেন, তারপর বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাই পাকিস্তান অবশ্যই তার খুব প্রিয়। পাকিস্তানের এই অবশ্যম্ভাবী ভাঙন তাকে খুবই ব্যথিত করেছে বলে মনে হলাে। আমাদের আলােচনায় আরব্ধ এই ছেদনপ্রক্রিয়া রােধের কোনাে রাস্তা আমরা খুঁজে পেলাম না। শুধু দুঃখ রইল, কেন ভদ্রভাবে সংলাপের মাধ্যমে বিচ্ছেদটা সম্পন্ন করা গেল না। খালেদ বিন সাইদ কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হন, কিংস্টনে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করতেন।
১ এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংক আমার কাছে এক সমস্যা উত্থাপন করল। বেশ কজন বাঙালি ছাত্র আইডিএ ঋণের খরচে বিদেশে প্রশিক্ষণে ছিল । তারা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের খরচে আমেরিকা, জাপান এবং সম্ভবত সুইডেনে শিক্ষারত ছিল। অসহযােগের এক মাসে বাংলাদেশ থেকে তাদের মাসােহারা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়নি । টাকাটা বিশ্ব ব্যাংকের কাছে আছে, তবে খরচ করার হুকুম আসবে ঢাকা থেকে। এ ব্যাপারে একটি বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে আলােচনার প্রয়ােজন। দুপুরে তাই বিশ্ব ব্যাংকে গেলাম। স্থির হলাে যে আমি বাংলাদেশের নির্দেশ চাইব, তবে সাময়িকভাবে মাসােহারা প্রদানের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের কাছে সুপারিশ করব। ২৬ এপ্রিল এ ব্যাপারে দ্বিতীয় সভায় আমার সুপারিশ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে। আমার মনে হয়, এই সুপারিশের ভিত্তিতেই সারা বছর এই শিক্ষার্থীরা তাদের মাসােহারা পায়। কারণ, বাংলাদেশ থেকে তখন এসব নগণ্য বিষয় তদারকের সুযােগ ছিল না। বিশ্ব ব্যাংকের পাকিস্তান ডেস্কের প্রধান তখন মাইকেল উইহেন এবং উপপ্রধান আলফানসাে শিবুসাওয়া। অত্যন্ত উদ্যোক্তা একজন অফিসার ছিলেন উইলিয়াম ম্যাকুলক এবং অর্থনীতিবিদ ছিলেন ভানডার হাইডেন। এ ছাড়া আরও অনেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁদের ওপরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন ক্রিস্টোফার মেলমথ, উপপরিচালক গ্রেগরি ভােটা এবং পরিচালক পিটার কারগিল । পিটার কারগিল ছিলেন বিচিত্র এক ব্যক্তিত্ব।
৪৮
বিরাটকায় ইংরেজ এই ব্যক্তির জন্ম হয় ব্রিটিশ ভারতে, যেখানে তাঁর পিতা ছিলেন ভারতীয় রেল বিভাগের একজন কর্তাব্যক্তি। নেহরু পরিবারের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ছিল এবং ইন্দিরা গান্ধী যখন অক্সফোর্ডে পড়েন, তখন পিটার ছিলেন তাঁর খানিকটা জ্যেষ্ঠ। পিটার ১৯৩৮ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন। পাকিস্তানের মির্জা মােজাফফর আহমদ ছিলেন তাঁর সহকর্মী। দেশ বিভাগের পর পিটার পাকিস্তানে চাকরি করেন এবং সিন্ধু প্রদেশের অর্থসচিব থাকাকালে বিশ্ব ব্যাংকে যােগ দেন। তিনি পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ব্যাংকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সহসভাপতি হন এবং সবশেষে সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে অবসর নেন, তখন তিনি ছিলেন অর্থ বিভাগের দায়িত্বে। বিশ্ব ব্যাংকে আড়ালে তাঁকে বলা হতাে সম্রাট কারগিল। উপমহাদেশে তাঁর জানাশােনা ও প্রতিপত্তি ছিল বিস্তৃত। তিনি উপমহাদেশীয় খাবার পছন্দ করতেন এবং ভাত ও ডাল না হলে তাঁর মতে উপমহাদেশীয় খাবারই মাটি হয়ে যেত। ব্রিটিশ রানি তাঁকে নাইটের মর্যাদায় ভূষিত করেন। আশির শেষভাগে তিনি পরলােকগত হন।
বিশ্ব ব্যাংক পাকিস্তানে পানিসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা নেয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকা চুক্তি সম্পাদনে (১৯৬০) বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা ছিল। বস্তুতপক্ষে ব্যাংকের সভাপতি ইউজিন ব্ল্যাক সে ব্যাপারে একধরনের মধ্যস্থতা করেন। ১৯৬৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের খেয়াল হলাে যে বাংলাদেশের পানি সমস্যা নিয়ে তারা তেমন উদ্যোগ নেয়নি। তাই খেসারত হিসেবে একটি বিশেষ প্রকল্প বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর দায়িত্ব দেওয়া হয় রবার্ট সেডােভকে। রবার্ট একটি উদ্যোগী গােষ্ঠীকে তার বিভাগে নিয়ােগ করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রিস্টো হার্মা, রবার্ট এলিসন, উলফ ড্রয়েস, আমাদের হারুন রশীদ এবং আরও অনেকে। বাংলাদেশের বহু বছরের বাসিন্দা টম হেক্সনার এই বিভাগে প্রায়ই উপদেষ্টার কাজ করতেন। এই বিভাগের সব কর্মকর্তা ছিলেন বাংলাদেশের বন্ধু। তাঁরা মনে করতেন যে বাংলাদেশ বৈষম্যমূলক ব্যবহারের শিকার এবং এখানে বিনিয়ােগে অত্যধিক জোর না দিলে চলবে না। বাংলাদেশের ওপর বিশ্ব ব্যাংক একটি ব্যাপক প্রতিবেদন প্রণয়ন করে ১৯৭২ সালে। নয় খণ্ডে প্রকাশিত জমি ও পানিবিষয়ক প্রতিবেদনটি এই বিভাগের উদ্যোগেই প্রস্তুত হয়। এখনাে কৃষি ও পানির অনেক মৌলিক বিষয়ে এই প্রতিবেদন একটি প্রামাণ্য দীপিকা।
পাকিস্তান ডেস্ক ও বিশেষ প্রকল্প বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসব্যাপী ছিল আমার দ্বিতীয় দপ্তর। তাদের সমর্থন ও সহমর্মিতা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তাদের কাছে সব সময়ই ভরসা পেয়েছি। বিল ম্যাকুলকের কথা আগেই বলেছি। ১ এপ্রিলে বিল খবর দিল যে সিনেটর কেনেডি সেদিন বাংলাদেশের ওপর কংগ্রেসে
৪৯
বক্তব্য দেবেন। দিনের শেষে আমি সিনেটরের দপ্তরে হাজির হলাম । বৃহস্পতিবার বিকেলে অনেক স্টাফ তখন বাড়ি ফিরছেন। একজন বক্তৃতার একটি নকল আমাকে দিলেন এবং বললেন যে সিনেটর হ্যারিসও একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। সিনেটর হ্যারিসের দপ্তরে তাঁর সহকারী উইলিয়াম মেইনের সঙ্গে দেখা হলাে। তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন কদিন পর সময় করে তার সঙ্গে দেখা করতে । তিনি আরও জানালেন যে তাঁর সিনেটর এ বিষয়ে আরও জানতে আগ্রহী এবং আরও উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত। বিল মেইন মার্কিন ফরেন সার্ভিসের সদস্য। হিসেবে ভিয়েতনামে একসময় চাকরি করেন। তিনি প্রগতিশীল মনােভাবের লােক ছিলেন এবং সিনেটর হ্যারিস যখন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হন, তখন তার একনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। সিনেটর হ্যারিসের নির্বাচনী অভিযান বেশি দূর এগােয়নি এবং তিনি আর সিনেটর পদপ্রার্থীও হননি। বিল মেইন কার্টার প্রশাসনে (১৯৭৭-৮০) স্টেট ডিপার্টমেন্টে আন্তর্জাতিক বিষয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৭১ সালের পর তার সঙ্গে পরিচয় ঝালিয়ে নেবার সুযােগ হয় ১৯৭৮-৭৯-তে। একসময় তিনি ওয়াশিংটনের কার্নেগি শান্তি ফাউন্ডেশনের কর্ণধার এবং প্রসিদ্ধ ত্রৈমাসিক ফরেন পলিসির সম্পাদক ছিলেন।
বিল মেইনের সঙ্গে ৬ এপ্রিল আমার লম্বা বৈঠক হয় এবং সেদিনই সিনেটর হ্যারিসের সঙ্গে আলাপ হয়। বিল আমাকে সিনেটর কেসের সহকারী জন মার্ক্সের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সিনেটর কেসের দপ্তরে অনেকবার গিয়েছি কিন্তু তার সঙ্গে প্রথম মােলাকাত হয় ১৯৭২ সালে এক বিশেষ উপলক্ষে। যেসব বন্ধু ১৯৭১ সালে আমাদের সমর্থন দিয়েছেন বা ভরসা জুগিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ কজনকে আমরা আমাদের বিজয়ের পর স্মরণ করি। এই ফর্দে ছিলেন মােট ৪০ জন মার্কিন—১১ জন জনপ্রতিনিধি (৬ জন সিনেটর ও ৫ জন প্রতিনিধিসভার সদস্য), ৮ জন জনপ্রতিনিধির সহকারী এবং আরও ২১ জন কর্মী (শিক্ষাবিদ, লবিস্ট, বুদ্ধিজীবী)। আমরা এই উপলক্ষে এসব ব্যক্তিকে একটি ছােট স্মরণিকা এবং স্বীকৃতি সনদ প্রদান করি। এই ফর্দ পরিশিষ্ট ১-এ দেওয়া হলাে। সিনেটর কেইসকে এই স্বীকৃতি সনদ দিতে গেলে তার সঙ্গে দেখা হয়। সিনেটর কেইস বায়াফ্রা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের কড়া সমর্থক ছিলেন। আর সেই সময় বায়াফ্রা আন্দোলনকারীদের অবাধ গতি ছিল তাঁর কাছে। বায়াফ্রা আন্দোলন ব্যর্থ হলে তিনি খুব অপদস্থ হন। এ কারণে ১৯৭১ সালে তিনি যদিও আমাদের সমর্থন করেন কিন্তু আমাদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করতে রাজি ছিলেন না।
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসে আমাদের সমস্যা নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দেন দুজন সিনেটর। আমি তাতে এত ভরসা পাই এবং উল্লসিত হই যে এস্তে সিনেটরদের দপ্তরে হাজির হই। তখন একমাত্র ভারত ছাড়া অন্যত্র কোথাও
৫০
আমরা সামান্যতম সমবেদনার প্রকাশ দেখতে পাইনি। তখন মানবাধিকারের জন্য পৃথিবী সােচ্চার ছিল না। শীতল যুদ্ধে দ্বিখণ্ডিত পৃথিবীতে আমাদের সমস্যা ছিল যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল শীতল যুদ্ধের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন। তাই আমাদের দুঃখে সমবেদনা জানানাের বা আমাদের ওপর অত্যাচারের নিন্দা প্রকাশের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। এই অসহায় অবস্থায় এ দুই সিনেটরের বক্তৃতা আমাকে খুব আন্দোলিত করে। এখন যখন ওই দুটি বক্তৃতা পড়ি, তখন। মনে হয় এগুলাে ছিল নিতান্ত সাদামাটা বা মামুলি মন্তব্য। কিন্তু ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ও তখনকার মানসিকতার মানদণ্ডে বক্তৃতা দুটি ছিল বীরােচিত ও হৃদয়স্পর্শী। সিনেটর কেনেডি প্রশ্ন করেন যে মার্কিন সরকার কি হত্যাকাণ্ডের জন্য নিন্দা প্রকাশ করবে না, নিরীহ জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে এবং সহিংসতা রােধে প্রচেষ্টা নেবে না? সিনেটর হ্যারিস কিন্তু সেই শুরুতেই অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের আবেদন জানান।
আগেই বলেছি, গউসুদ্দিন আহমদ ২৭ মার্চেই সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি সােমবারের র্যালিতে যােগ দেবেন। তিনি ভালাে করে জানতেন যে পাকিস্তান দূতাবাস এর জন্য তাকে শাস্তি দেবে। তিনি দেশের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন, তাকে বরখাস্ত করা হবে। তখন দূতাবাসে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি বাঙালি, তাঁকেই গউসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রদূত নির্দেশ দিলেন। গউস হত্যাযজ্ঞের খবরে বিচলিত হয়ে হুজুগের বশে র্যালিতে অংশ নিয়েছেন এবং এর জন্য অনুতপ্ত—এ রকম ধরনের ব্যাখ্যা দিলে তাকে সাবধান করে মাফ করে দেওয়া হবে—এমনই একটি ধারণা তাকে দেওয়া হয়। গউস বুঝেশুনে র্যালিতে যােগ দেন এবং এ ধরনের ব্যাখ্যা দিতে মােটেও প্রস্তুত ছিলেন না। আমাকে তিনি জানালেন যে অ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরির জন্য তিনি মােটেই চিন্তিত নন এবং তিনি ক্ষমা চাইতেও রাজি নন। গউস অতি শান্তশিষ্ট যুবক, এখনাে ওয়াশিংটনে আছেন নিজের ব্যবসা নিয়ে। সিলেটের ছেলে, ওখান থেকে কলেজ পাস করে ভাগ্যান্বেষণে আমেরিকা যাত্রা এবং সেখানে দূতাবাসে সামান্য চাকরিলাভ। দেশমাতৃকার ওপর পাকিস্তানি বর্বর আক্রমণ তাঁর সহ্যসীমা অতিক্রম করে। তাই একসময়ের আদরের ও সমীহের পতাকা তিনি কংগ্রেসের সিঁড়িতে জ্বালিয়ে দেন। গউস কোনাে অপকর্ম করেছেন বলে কোনাে আরজি দিতে অস্বীকার করলেন । ১ এপ্রিলে গউসুদ্দিন আহমদকে দূতাবাসের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলাে। বাংলাদেশ মুক্ত হলে গউস তার জন্য জয়ােল্লাস করেন। কিন্তু আবার চাকরির জন্য ধরনা দিতে বিরত থাকেন। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনে আমি একাত্তরের কর্মীদের সমবেত করবার এক প্রয়াস নিই। সে সময় গউস আবার সাড়া দেন।
৫১
এখন দেশের সঙ্গে তার যােগাযােগ অনেক কম কিন্তু মনের গহনে রয়েছে গভীর দেশপ্রেম এবং দেশবাসীর জন্য শুভাকাঙ্ক্ষা। আমেরিকায় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি আক্রমণের প্রথম শিকার হন গউসুদ্দিন আহমদ, একজন অপরিচিত নীরব দেশপ্রেমিক।
৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনের শহরতলি এলাকায় জর্জ মেসন কলেজে পাকিস্তানের ওপর আলােচনা করবার আমার একটি পূর্বনির্ধারিত প্রােগ্রাম ছিল। আমার মানসিক অবস্থা একটি জ্ঞানজাগতিক বক্তৃতা দেবার জন্য উপযুক্ত ছিল না বিধায় আমি প্রােগ্রামটি বাতিল করব ভাবছিলাম। আমার স্ত্রী বললেন যে আমি কলেজের মঞ্চে বর্তমান বিপর্যয় সম্বন্ধে বক্তব্য দিতে পারি। ওখানকার শিক্ষার্থীরা তাকেও বােধ হয় দাওয়াত করেছিল। শেষ পর্যন্ত আমি প্রােগ্রাম বহাল রাখতে মনস্থ করি । সেখানে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ লেগেছে, সে বিষয়ে প্রায় এক ঘণ্টা আমি বক্তব্য দিই। পাকিস্তানি আক্রমণের বর্ণনায় মােটামুটিভাবে মার্কিন পত্রপত্রিকায় যা বিবৃত হয়েছে, তারই সারমর্ম তুলে ধরি। আমার বক্তৃতা শেষ হলে দেখলাম, অনেক কোমলমতি তরুণ-তরুণীর চোখ ছলছল করছে। প্রশ্নোত্তরের নির্ধারিত সময় ছিল আধঘণ্টা কিন্তু আমাদের আসর কোনাে সময়সীমা ছাড়াই চলল। সকাল ১০টায় আমার আলােচনা সভা শুরু হয় এবং দুপুর গড়িয়ে তা শেষ হয়। আসর শেষে অনেকে এসে ভিড় করল দুটি প্রশ্ন নিয়ে । প্রথমত, আমি কি আমার আত্মীয়স্বজনের কোনাে খবর জানি আর দ্বিতীয়ত, তারা কি কোনাে উপায়ে দুস্থদের জন্য অর্থ সাহায্য দিতে পারে? দুটি প্রশ্নেই আমার উত্তর ছিল নেতিবাচক। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের যােগাযােগ বন্ধ হয় ২৫ মার্চে এবং সেই অচলাবস্থা বস্তুতপক্ষে বহাল থাকে মাসাধিককাল। তখনাে কোনাে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং পাকিস্তানে বাঙালিদের জন্য সাহায্য প্রেরণে আমার কোনাে গরজ ছিল না।
জর্জ মেসন কলেজের সহমর্মিতা দিয়ে শুরু হয় আমার দিনটি এবং সারাটি দিন ছিল পরিপূর্ণ। ওখান থেকে আমি যাই বিশ্ব ব্যাংকে। সেখানে গিয়ে পেলাম এক শক্তিশালী বাংলাদেশ সমর্থক গােষ্ঠী। হার্ভার্ড থেকে করিতকর্মা মহীউদ্দীন আলমগীর এসেছেন অনেক কাগজপত্র নিয়ে। তার সঙ্গে তরুণ অধ্যাপক স্টিফেন মার্গলিন ও ডা. রিচার্ড টেবর্স। হার্ভার্ডের তিন বিশিষ্ট অধ্যাপক ডিন রবার্ট মেসন, রবার্ট ডর্ফম্যান আর স্টিফেন মার্গলিন একখানি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন পূর্ব পাকিস্তান সংকটের ওপর প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে। তাঁরা পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য নিয়ে আলােচনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেন যে দুই অংশের বিচ্ছেদ অপরিহার্য এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সবার জন্য মঙ্গলজনক। তাঁরা বলেন, ‘অবশেষে একটি
৫২
স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব অপরিহার্য। প্রশ্ন হচ্ছে, এর জন্য কত রক্তক্ষরণ হবে। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী হবে যদি আমাদের অদূরদর্শী নীতি পূর্ব পাকিস্তানকে আর একটি শক্তি—রাশিয়া অথবা চীনের—কোলে ঠেলে দেয়। মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহার যত-না বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিলম্বিত করবে, ততই মার্কিন ভাবমূর্তি সংগত কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে মার্কিন জনমত গঠনে বিশেষ অবদান রাখে। এ রকম আরও দু-চারটি প্রতিবেদন এপ্রিল মাসেই প্রস্তুত হয়। রিপাবলিকান পার্টির চিন্তাকোষ রিপন সােসাইটি একটি প্রতিবেদন বানায়। শিকাগােতে শামসুল বারীর উদ্যোগে অধ্যাপক রােনাল্ড ইনডেন ও এডওয়ার্ড ডিমক আরেকটি প্রতিবেদনে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে আলােচনা করে বাংলাদেশের অপরিহার্যতার বিষয়ে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। বােস্টন থেকে বাংলাদেশ সম্বন্ধে খুবই সচেতন অধ্যাপক গুস্তাভ পাপানেক ও জন টমাস একটি ছােট প্রবন্ধে জানিয়ে দেন যে বাংলাদেশ আর বায়াফ্রা এক নয় । বাংলাদেশের অভ্যুদয় অবশ্যম্ভাবী। হার্ভার্ডের এই দল গেল কংগ্রেসে তাদের কথা বলতে এবং তাদের গবেষণার প্রতিপাদ্য বিষয় জনপ্রতিনিধিদের জানাতে। পরদিন ৭ তারিখে নিউইয়র্কের রিপাবলিকান প্রতিনিধি সেমুর হেলপার্ন এই প্রতিবেদন কংগ্রেশনাল রেকর্ডে নিবিষ্ট করেন।
এই অধ্যাপকদের অনেকেই পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা গােটা উপমহাদেশ সম্বন্ধে গভীরভাবে পরিচিত ছিলেন। ডিন মেসন সেই ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকাজে সাহায্য করতে আসেন। সুপ্রসিদ্ধ হার্ভার্ড উপদেষ্টাগােষ্ঠীকে তিনিই নির্বাচিত করেন। হার্ভার্ডে উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন প্রশাসকদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবস্থা তিনিই শুরু করেন ১৯৫৬ সালে, এই কার্যক্রম এখন মেসন কার্যক্রম নামে পরিচিত। রবার্ট ডর্ফম্যান বাংলাদেশের কৃষি ও পানিব্যবস্থার ওপর অনেক মূল্যবান কাজ করেন, সুপ্রসিদ্ধ কৃষি ও পানি প্রতিবেদন (১৯৭২) প্রণয়নে তাঁর অবদান ছিল বিস্তর। গুস্তাভ পাপানেক সারা দক্ষিণ এশিয়ায় কাজ করেছেন, তাঁর স্ত্রী হান্নাও অনেক গবেষণা চালিয়েছেন, পাপানেকের অসংখ্য ছাত্র প্রশাসন ও গবেষণায় এ দেশে নিযুক্ত। জন টমাস অল্প বয়সে এ দেশে কেয়ার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর পিএইচডি গবেষণা ছিল কুমিল্লা পূর্তকর্ম নিয়ে। তিনিও এ দেশে অনেক কাজ করেছেন। স্টিফেন মার্গলিন এ দেশে এসে কাজ না করলেও তার অনেক গবেষণা এ দেশকে নিয়ে এবং তাঁরও প্রচুর ছাত্র এই এলাকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তি। রােনাল্ড ইলডেন এই এলাকায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, অনেক থেকেছেন ও পড়েছেন। তিনি বাংলায় অধ্যাপনা করতেন এবং ধ্যানধারণায় বাঙালি র্যাডিক্যালদের সমগােত্রীয় ছিলেন ।
৫৩
তাঁরা তাঁদের এই দেশ সম্বন্ধে ধারণা এবং অনুভূতি বিচার করে এবং তাঁদের গবেষণা ও জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্ত সমর্থক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
অপরাহে হারুন, বিল ম্যাকুলক এবং আমি গেলাম সিনেটর কেনেডির দপ্তরে । বিল আমাদের কেনেডির দুজন সহকারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। জেরি টিংকার পরবর্তী সময়ে সিনেটের শরণার্থী সাব-কমিটির স্টাফ ডাইরেক্টর হন। তাঁর পুরাে জীবনটিই সিনেটর কেনেডির সহকারী হিসেবে কাটে। ১৯৯৪ সালে হঠাৎ জেরি ইহধাম ত্যাগ করেন, তখন তার বয়স মাত্র ৫৫ বছর। জেরি একজন রুচিসম্পন্ন জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন এবং উপমহাদেশীয় রাজনীতি ও সমাজ সম্বন্ধে তার বিস্তর পড়াশােনা ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে সিনেটর কেনেডির সঙ্গে আগস্ট মাসে তিনি শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে ভারতে আসেন এবং বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সিনেটরের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। জেরি সারা জীবন বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন। ১৯৮৭ সালে আমি যখন মার্কিন কংগ্রেসে এরশাদবিরােধী মতবাদ সৃষ্টিতে প্রয়াসী হই, জেরিই তখন। প্রথম ঢিলটি মারতে সাহায্য করেন। ১৯৮৭ সালের ১৬ অক্টোবর জেরি সিনেট ও হাউসের পররাষ্ট্র এবং তহবিল বরাদ্দবিষয়ক কমিটির স্টাফদের সঙ্গে আমার মধ্যাহ্নভােজের ব্যবস্থা করেন।
এই আলােচনার ফলেই ১৯৮৮ সালে সােলার্জ সংশােধনী ও শুনানি প্রাধান্য লাভ করে। জেরি নানাভাবে অনেক বঙ্গসন্তানকে সাহায্য করেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে আমরা এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হারিয়েছি। জেরির স্ত্রী অ্যান বিশ্ব ব্যাংকে কাজ করেন এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিষয়ে তার উৎসাহ আছে। সিনেটর কেনেডির অন্য সহকারী, যার সঙ্গে আমাদের সেদিন পরিচয় হয়, তিনি হলেন ডেল ডিহান। বর্তমানে বােধ হয় কোনাে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ডেল শরণার্থী কমিটির ডাইরেক্টর হিসেবে জেরির পূর্বসূরি ছিলেন। তিনিও সিনেটরের সঙ্গে ১৯৭১ সালে শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রে এবং ১৯৭২ সালে ঢাকায় আসেন। ডেল সত্তরের দশকের শেষ দিকে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার উপহাইকমিশনার হিসেবে কাজ করেন। ডেলও বাংলাদেশের বন্ধু এবং তাঁর পৃষ্ঠপােষকতায় বেশ কজন বাঙালি জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনে পেশাজীবী হিসেবে কাজ করেন। তাঁদের দপ্তরে এই যে আমরা গেলাম, তারপর তা হয়ে উঠল পুরােনাে সিনেট প্রাসাদে আমাদের অন্যতম আখড়া। সিনেটর কেনেডির দপ্তর পরবর্তীকালে অন্য প্রাসাদে স্থানান্তরিত হয়েছে, যার নাম রাসেল প্রাসাদ।
এই দিন থেকে পরবর্তী আট মাস ক্যাপিটল হিল হয় আমার প্রধান কর্মস্থল। পাকিস্তান দূতাবাসে যখন ছিলাম, তখন মাত্র দুবার ওখানে গিয়েছিলাম রাষ্ট্রদূত
৫৪
হিলালির সঙ্গে। একবার বােধ হয় কংগ্রেসম্যান সাইকসের সঙ্গে দেখা করতে আর অন্যবার ওটো পাসম্যানের সঙ্গে মােলাকাতে। একবার উদ্দেশ্য ছিল চালের জন্য দরবার করা, পিএল ৪৮০-এর অধীনে পাকিস্তানকে চাল বরাদ্দ করার জন্য। আর অন্যবার একটি আইনকে একটু শিথিল করার জন্য। বৈদেশিক সাহায্য আইনের একটি বিধান ছিল যে কমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে যেসব দেশ ব্যবসা করে, তারা মার্কিন সাহায্য পাবে না এবং যাদের জাহাজ ওই সব দেশে মাল নিয়ে যায়, তারাও এভাবে বঞ্চিত হবে। বিধানের দ্বিতীয় ভাগের প্রয়ােগকে শিথিল করার জন্য আমরা দরবার করি। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারটি ছিল মূলত কূটনৈতিক বিভাগের কাজ। তাই অর্থনৈতিক বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হতাে না। মুক্তিযুদ্ধের আট মাস আমি মােটামুটিভাবে একজন কংগ্রেশনাল লবিস্ট ছিলাম এবং অনেক পরিচয় ও বন্ধুত্ব, যা ওই সময়ে হয়, তা বহুদিন অটুট থাকে।
১৯৮৭ সালে দেখলাম যে ১৯৭১-এর বহু খেলােয়াড় চলে গেলেও কংগ্রেসে প্রভাব বিস্তারের ধারা একই রকম রয়েছে এবং ফ্যাক্সের বদৌলতে সশরীরে। উপস্থিতির প্রয়ােজনীয়তা অনেক কমে গেছে। হারুন রশীদ ও বিল ম্যাকুলক সিনেটর কেনেডির দপ্তর থেকেই বিদায় নিলেন। তারপর শুরু হলাে অন্যান্য দপ্তরে আমার বিচরণ। প্রথমে গেলাম বিল মেইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত বিস্তৃত আলােচনার জন্য। খানিকটা আলােচনার পর বিল আমাকে নিয়ে গেলেন সিনেটর হ্যারিসের কামরায়। সিনেটর প্রথমেই বললেন যে তিনি আমাদের আত্মীয়, মাতৃকুলে তাঁর মার্কিন ইন্ডিয়ানদের রক্ত রয়েছে তাই। তিনি ওকলাহােমা রাজ্যের সিনেটর ছিলেন। সিনেটর এবং তাঁর সহকারী দুজনই যথার্থ কিছু করার জন্য ছিলেন উদগ্রীব। সিনেটর বললেন যে সমুদয় সমস্যা নিয়ে একটি ব্যাপক সমাধানের প্রস্তাব তিনি বিবেচনা করছেন। এতে পাকিস্তানে অস্ত্র সাহায্য শুধু বন্ধ হবে না, অর্থনৈতিক সাহায্যও বন্ধ রাখা হবে। সব বরাদ্দ এবং আরও অতিরিক্ত সাহায্য দিয়ে একটি তহবিল গঠন করা হবে বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানের পুনর্বাসনের জন্য। আর বিবাদ মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে কে এ রকম মধ্যস্থতায় ভূমিকা নিতে পারেন। আমি ইরানের শাহের নাম প্রস্তাব করলাম। এই প্রস্তাব করার একটি বিশেষ কারণ ছিল। ইরানের শাহ ভারত ও পাকিস্তানের বন্ধু ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রস্তাব দেন।
একদিন এক মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনােভাবের কথা আলােচনাকালে বলেন যে ইরানের শাহ এই বিষয়ে বেশ সচেতন। তার ধারণা ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং কাশ্মীরের
৫৫
স্বায়ত্তশাসন নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝােতা হতে পারত। এই আলােচনা ১৯৬৮ কি ১৯৬৯ সালে হয়। আমার ধারণা হয় যে শাহ নেহরুর মৃত্যুপূর্বকালীন উপমহাদেশীয় শান্তি পরিকল্পনার কথাই বিবেচনা করছিলেন। এই পরিকল্পনায় কাশ্মীর হতাে ভারতের একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য আর পূর্ব পাকিস্তান হতাে পাকিস্তানের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবসা, বিনিয়ােগ ও ভ্রমণের সুযােগ হতাে অবারিত। এই প্রেক্ষিত মনে রেখে আমি ইরানের শাহকে মধ্যস্থ বানাতে সুপারিশ করি। সিনেটর হ্যারিস তার প্রস্তাব পেশ করেন ১৯ এপ্রিল কিন্তু ইতিমধ্যে আমার এই সুপারিশ নিয়ে আমি পস্তাতে শুরু করি। সেই দুঃখের কাহিনি একটু পরে বলছি।
বিল মেইন বললেন যে এই প্রস্তাবের জন্য আরও সমর্থক দরকার এবং অন্য প্রতিনিধিদের কাছে এ বিষয় নিয়ে তিনি আমাকে আলােচনা করতে বললেন। তাঁর কাছে জানলাম যে নিউজার্সির রিপাবলিকান সিনেটর কেইস এবং মিনেসােটার ডেমােক্রেটিক সিনেটর মন্ডেইল যৌথভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছেন সব সামরিক সাহায্য বা বিক্রয় বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। আমি বিল মেইনের দপ্তর থেকে গেলাম জন মার্ক্সের দপ্তরে। জন ছিলেন সিনেটর কেসের সহকারী । জন মার্ক্স বিপ্লবী ধরনের ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর একটি আকর্ষণীয় গোঁফ ছিল। পরবর্তীকালে তিনি একটি বইয়ের যৌথ লেখক হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। এ বই প্রকাশে বেশ অসুবিধা পােহাতে হয়। কারণ, এটা ছিল সিআইএর অভ্যন্তর নিয়ে লেখা। জন আমাকে কেস মন্ডেইল প্রস্তাবের নকল দিয়ে বললেন যে আপাতত তারা সিনেটর হ্যারিসের ব্যাপক প্রস্তাবটি ঠেকিয়ে রাখতে চান। এই প্রস্তাবে ছিল সব সামরিক সাহায্য বা সমরাস্ত্র বিক্রয়ে বিরতি। ১৫ এপ্রিল এই প্রস্তাব পেশ করা হয় এবং ১৩ মে সিনেট পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটিতে তা পাস হয়।
সিনেটর মন্ডেইল ছিলেন উদারপন্থী অভিজাত গােছের নেতা। তিনি প্রেসিডেন্ট কার্টারের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হন। তাঁর সহকারী ছিলেন রােজার মরিস, একসময় বােধ হয় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা উপদেষ্টার দপ্তরে কাজ করেন। প্রেসিডেন্ট জনসনের আমলে তিনি পাকিস্তানও ভ্রমণ করেন। আমার মনে হলাে, তিনি খুব নীরব কর্মী এবং তার অনুভূতিকে খুব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তার সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানি সাংবাদিক কুতুবুদ্দিন আজিজ তাঁকে পাকিস্তানের বন্ধু বলে মনে করেন। আমার সে রকম কোনাে ধারণা হয়নি এবং সিনেটর মন্ডেইল বাংলাদেশ সংকট নিয়ে যে চারবার বক্তব্য দেন, তাতে পাকিস্তানের জন্য কোনাে সমর্থনের নিদর্শন পাওয়া যায় না। বস্তুতপক্ষে একজন মানবতাবাদী উদারপন্থী নেতা বা
৫৬
কর্মীর পক্ষে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কার্যকলাপের প্রতি কোনাে রকম নমনীয়তা প্রদর্শনের কোনাে অবকাশ ছিল না। নেহাত অন্ধ, অজ্ঞ অথবা উন্মাদের পক্ষেই তা ছিল সম্ভব।
এপ্রিলের শুরুতেই যেসব মার্কিন বিজ্ঞানী বা ডাক্তার ঢাকায় কলেরা গবেষণা ল্যাবরেটরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমার যােগাযােগ হয়। যােগাযােগ হয় দুটি সূত্রে। বাল্টিমােরে উইলিয়াম গ্রিনাে আমার খবর পান পাকিস্তানি জাহাজের কিছু বাঙালি নাবিকের কাছ থেকে। বােস্টনে ডেভিড ন্যালিন সম্ভবত খবর পান মহীউদ্দীন আলমগীর এবং রিচার্ড টেইলরের কাছ থেকে। ঢাকায় এই সিআরএল গােষ্ঠীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযােগ বড় ছিল না। ১৯৬০ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয় একটি SEATO (দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় চুক্তি সংস্থার) প্রকল্প হিসেবে। এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। প্রাদেশিক রাজধানীতে আমার প্রথম চাকরি ছিল স্বরাষ্ট্র বিভাগে, ১৯৬০ সালে । আমার মূল দায়িত্ব ছিল প্রটোকল । তখন প্রদেশে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের কোনাে প্রতিনিধি ছিলেন না। তাই কৃটনীতিবিদদের যৎসামান্য দেখভাল করা এবং রাষ্ট্রীয় অতিথি ও বড় কর্তাদের সফরের দেখাশােনার দায়িত্ব ছিল স্বরাষ্ট্র বিভাগের প্রটোকল দপ্তরের। সেই সুযােগে কলেরা ল্যাবরেটরির উদ্বোধনে সংশ্লিষ্ট হবার সুযােগ আমার হয়। প্রায় ১৮ বছর পর এই প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিকীকরণে আবার বিশেষ ভূমিকা রাখার আমার সুযােগ হয় বাংলাদেশ সরকারের বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব হিসেবে।
আইসিডিডিআরবি (উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র) ছিল এ দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৩ সাল থেকে বাংলাদেশের বাইরে থাকার ফলে সিআরএল গােষ্ঠীর সঙ্গে একাত্তরে আমার কোনাে পূর্বপরিচয় ছিল না। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি হামলা শুরু হয়, তখন বাল্টিমােরে দু-তিনটি পাকিস্তানি জাহাজ নােঙরে ছিল। এদের একটি জাহাজে আমার এক ভাইপাে ফখরুজ্জামান চৌধুরী (সাদ) কাজ করত। সে এই পরিস্থিতিতে কী করবে, সেই ব্যাপারে আমার পরামর্শ চায় এবং আমি তাকে জাহাজ ছাড়তে বুদ্ধি দিই। তার বন্ধুরা সেই কারণে আমার পরিচয় পায়, যদিও তাদের কারও সঙ্গে তখন আমার আলাপ হয়নি। আমার ভাইপাে শেষ পর্যন্ত জাহাজ ছাড়ল না কিন্তু আরও কয়েকজন তরুণ অফিসার ৮ এপ্রিল জাহাজ ছাড়ল। তাদের সহায়তা করেন। উইলিয়াম গ্রিনাে। তিনি তখন জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান ফ্যাকাল্টিতে অধ্যাপক। বাংলাদেশ তার পরিচিত এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন বাঙালি । বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার নামে ওয়াশিংটনে যে শক্তিশালী লবি দপ্তর গড়ে ওঠে, এই ডা. গ্রিনাে তার নেতা ছিলেন। পরবর্তীকালে উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র
৫৭
যখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হয়, তখন তিনি হন এর প্রথম পরিচালক।
আবদুল আউয়াল মিন্টুর নেতৃত্বে ছয়জন নাবিক ৮ এপ্রিল ময়নামতি ও শালিমার জাহাজ পরিত্যাগ করেন। বাল্টিমাের সান পত্রিকায় তাঁদের দুজনের নাম প্রকাশিত হয়, আবদুল আউয়াল ও তাহেরুল ইসলাম। আমার মনে হয়, আরও দুজন—আনােয়ার ও কাশেমকে নিয়ে ডা. গ্রিনাে একটি স্টেশন ওয়াগনে চড়ে আমার বাসায় আসেন পরবর্তী রােববার ১১ এপ্রিল। ইতিমধ্যে তাদের আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে একজন উকিলের সঙ্গে যােগাযােগ হয়েছে, ওখানকার বাঙালি ছাত্র কজনের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। ডা. গ্রিননা তাদের আমার এখানে নিয়ে আসেন ভরসা দিতে। তারা সবাই মাত্র জুলদি একাডেমি থেকে পাস করে। জাহাজে যােগ দিয়েছে এবং খুবই কম বয়সী—বিশের মতাে বয়স হবে। ডা. গ্রিনের সঙ্গে আগে টেলিফোনে আলাপ হয়েছে, এই প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় । দুর্দিনে গড়ে ওঠা সেই সখ্য আজও অটুট। মিন্টু এখন এ দেশে একজন বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও শিল্পপতি। আনােয়ার নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কাশেম বােধ হয় ফিলাডেলফিয়া এলাকায় স্থায়ী বসবাস করেন, ১৯৮৫ সালে সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। ফিলাডেলফিয়ায় আরও অনেক নাবিক স্থায়ী বাসিন্দা, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে ফিলাডেলফিয়া, বাল্টিমাের বা নিউজার্সি থেকে পাকিস্তানি জাহাজ পরিত্যাগ করেন। তাঁদের এই দৃপ্ত পদক্ষেপ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা। এসব তরুণ এক হিসেবে জ্যেষ্ঠদের উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেন।
ডেভিড ন্যালিন ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে ওয়েস্ট পয়েন্টের মার্ক ফার্মাসিউটিক্যালের একজন উঁচুদরের গবেষণা পরিচালক ছিলেন। ন্যালিন উপমহাদেশীয় পুরাকীর্তির সংগ্রাহক। বাংলার অনেক পুরাকীর্তির নিদর্শন তিনি নুয়ার্ক জাদুঘরে দান করেছেন। ডেভিড বেশ ভালাে বাংলা বলতে পারেন। একদিন তিনি আমাকে টেলিফোন করে বাংলায় কথা বলতে থাকেন। তিনি দেশের খবর এবং দূতাবাসে আমাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি তার পরিচয় চাইলে তিনি বললেন, আমাকে নলিনী বাবু মনে করতে পারেন। আমি একটু সাবধান হয়ে গেলাম এবং নেহাত লৌকিকভাবে তাঁর অনুসন্ধিৎসা নিবৃত্তির প্রয়াস পেলাম। তিনি তখন ফোনটি দিলেন আনা ব্রাউন টেইলরকে এবং আনা আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। জানা গেল যে আনা আমার শ্যালিকা সিনারা বেগম এবং তাঁর স্বামী আবদুল মান্নান আহমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । আনার স্বামী ডা. জেমস টেইলরও একসময় সিআরএলে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আর যােগাযােগ নেই। আনা জার্মান নাৎসি শিবিরে বন্দী ছিলেন এবং কোনাে রকম সহিংসতা বা জুলুম তাঁর সহ্য হতাে না। কোনাে রকম মিথ্যাচার তার
৫৮
কাছে ছিল কবিরা গুনাহ। আনা বস্তুতই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হয়ে যান। ডেভিড ও আনা দেশের যে খবর দিলেন, তা নিতান্তই ভয়াবহ। যেসব বিদেশিকে ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে অপসারণ করা হয়, তাঁদের সঙ্গে তাঁদের যােগাযােগ হয়েছে এবং তাঁদের কাছ থেকেই তারা বাংলাদেশে সামরিক হামলার টাটকা খবর পেয়েছেন। তাঁরা আমাদের আত্মীয়স্বজনের খবর দিতে পারলেন না এবং তাদের পরিচিত লােকজনের খবর জানতে চাইলেন। আমাদের কাছে তখন। কোনাে খবর ছিল না।
বাংলাদেশের সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগ পাকিস্তানি হানাদাররা একেবারে বন্ধ করে রেখেছিল। ভারতীয় সূত্রে কিছু খবর পাওয়া যাচ্ছিল, তাতে অত্যুক্তি ছিল খুব বেশি। ইউএসএইড দপ্তরে আমার বন্ধু টাউনসেন্ড সােয়েজি রােজই তাদের সরকারি সূত্রে পাওয়া বিশ্বস্ত খবর সরবরাহ করত। এই সােয়েজি একরকম প্রতিবাদ করেই কিছুদিন পর ইউএসএইডের চাকরি পরিত্যাগ করে। একসময় সে বিশ্ব ব্যাংকে কাজ করত। তার স্ত্রী ফেলিসিটি কাজ করত একটি প্রকাশনা সংস্থায়। সােয়েজি দম্পতি উপমহাদেশের বিষয়ে সব সময়ই আগ্রহী ছিল। তারা একটি ছেলে ও একটি মেয়ে দত্তক গ্রহণ করে যাদের নাম রাখে ইন্ডিয়া ও পিটার।
ঢাকায় ১৯৭০-৭১ সালে মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড বাংলাদেশের সঙ্গে ভালােভাবে পরিচিত ছিলেন। সম্ভবত দশক খানেক আগে তিনি ঢাকায়। কনসাল হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এবং আমাদের পরিচয় সেই সময় থেকে। ১৯৬১ সালে আমার বিয়েতে সামান্য যে কজন বিদেশি উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্লাড দম্পতি। একজন দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল এবং অল্প বয়সেই তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কুলীন গােষ্ঠী এফএসও ওয়ান শ্রেণিতে প্রবিষ্ট হন। তিনি বাংলাদেশের ঘটনাবলির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং তাঁর মতে পাকিস্তানিরা পাশবিক তাণ্ডবে মত্ত হয়। তিনি এবং তাঁর সহযােগী আরও ১৯ জন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সংকটে মার্কিন নমনীয় নীতির প্রতিবাদ করে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে এ ধরনের ভিন্নমত প্রকাশের একটি বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। সেই ডিসেন্ট চ্যানেলের সুযােগ নিয়েই ৬ এপ্রিল আর্চার ও তাঁর সহকর্মীরা তাঁদের বার্তা প্রেরণ করেন।
এই খবর ওই সময়ই সােয়েজির মাধ্যমে আমি জানতে পারি এবং অতিসত্বর এ খবর রাষ্ট্র হয়ে পড়ে। আর্চার ব্লাডকে এ জন্য অনেক ঝামেলা পােহাতে হয়। অল্প বয়সে যে কর্মকর্তা অনেক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি বােধ হয় শেষ পর্যন্ত একটি ভালাে রাষ্ট্রদূতের পদও পাননি। তিনি কূটনৈতিক চাকরিতে বেশ কিছুদিন কোনঠাসা ছিলেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট গহিনকে
৫৯
প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন ভারতে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন। রাষ্ট্রদূত গহিন আর্চার ব্লাডকে ভারতে তাঁর ডেপুটি হিসেবে নেন। তারপর আর্চার আফগানিস্তানে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন কিন্তু আফগানিস্তানে অস্থিতিশীল অবস্থায় তাঁর আর সেখানে যাওয়া হলাে না। তখন তিনি কূটনৈতিক দপ্তর থেকে অবসর নিয়ে পেনসিলভানিয়া রাজ্যে কলগেট কলেজে অধ্যাপনা করেন। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তাদের লাইব্রেরিটি তাঁর নামে আর্চার ব্লাড মেমােরিয়াল সেন্টার’ রেখেছে। আর্চার বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা যান। দেশের সত্যিকার খবর তাই আমরা কিছু কিছু পেতাম কিন্তু আত্মীয়স্বজনের খবর বহুদিন সম্পূর্ণরূপেই অজ্ঞাত ছিল ।
আনা ও ডেভিড বস্তুতই ছিলেন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযােদ্ধা। তারা বিবৃতি দিয়ে, চিঠি লিখে এবং নানা খবর ও মন্তব্যের সংকলন বানিয়ে মার্কিন জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও প্রচারমাধ্যমকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। আনা ও জেমস টেইলর এর মধ্যে একদিন আমাদের বাসায় এসে হাজির। তাঁরা সমবেদনা প্রকাশ করলেন, আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করলেন। তাঁদের পরিচিত লােকজন নিয়ে স্মৃতিচারণা ও আলাপ-আলােচনা করলেন। আনা মে মাসে একটি একক বিক্ষোভ শুরু করলেন এবং ৯ মে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের সন্নিকটে শেরিডন সার্কেলের সবুজে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন। শনিবার সকাল ১০টায় তাঁকে তাঁর ব্রত পালনে উৎসাহ জোগাতে আসেন প্রায় ৩০ জন বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। আমাদের সেখানে যেতে খানিকটা দেরি হয়ে যায়। ওই দিন অপরাহে পাকিস্তানের বিশেষ দূত মির্জা মােজাফফর আহমদ ওয়াশিংটনে পৌছেই আনার বিক্ষোভের খবর পেলেন। আনা। সপ্তাহখানেকের জন্য জেঁকে বসবেন ঠিক করেছিলেন কিন্তু সােমবারই পুলিশ তাঁকে ওখান থেকে উঠে যেতে বলল। স্থানটি পাকিস্তান দূতাবাসের কাছে বলে তারা এতে আপত্তি জানাল । আনা কিন্তু নাছােড়বান্দা। নতুন করে অনুমতি নিয়ে তিনি হােয়াইট হাউসের সামনে লাফায়েত পার্কে তার বিক্ষোভ আবার শুরু করলেন ১৪ মে। এবার আরও তিন দিনব্যাপী ছিল তাঁর অনশন ধর্মঘট। এবার তাঁর সঙ্গে যােগ দেন আরও অনেকে। ডেভিড ন্যালিন তাে বটেই। তা ছাড়া ওয়াশিংটনে উচ্চশিক্ষায় লিপ্ত প্রকৌশলী মহসিন সিদ্দিক, কোলের এক বাচ্চাসহ মেগি আইজেনস্টাইন এবং জোন ডাইন ও তাঁর হাঁটি হাঁটি পা পা কন্যা এমি। আনার ক্ষোভ ছিল দুই কারণে। প্রথমত, বাংলাদেশে সামরিক বর্বরতা। দ্বিতীয়ত, মার্কিন নেতৃত্বের মিথ্যাচার ও পক্ষপাতিত্ব । প্রথমে ১০ তারিখ এবং পরে ১৫ তারিখে ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকায় আনার বিক্ষোভের ছবি বেরােল।
৬০
এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় ভাগ থেকে মে মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ছিল ভিয়েতনাম র্যালি, সভা ও অনেক শােভাযাত্রা। সেই তুলনায় আনার বিক্ষোভ ছিল অত্যন্ত শালীন ও নীরব, অত্যন্ত গভীর অথচ সুসভ্য।
লাফায়েত পার্কে বাংলাদেশের জন্য বিক্ষোভ কিন্তু সেখানেই শেষ হলাে না। অক্টোবরে ওই পার্কে দশ দিনব্যাপী একটা বড় বিক্ষোভ আয়ােজিত হয়। ষাটের দশকের শেষ দিকে সল্টলেকে কলকাতার একটি উপশহর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। উপশহর নির্মাণের জন্য অনেক মালমসলাও ওখানে জড়াে করা হয়। ১৯৭১ সালের বাঙালি শরণার্থীরা ওখানে আশ্রয় নেয় এবং পানি ও পয়ােনিষ্কাশনের জন্য সংগৃহীত অনেক বড় বড় কংক্রিট পাইপেই তারা ঘর বাঁধে। পাইপ দিয়ে গড়ে ওঠা এই শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রের অনুকরণে লাফায়েত পার্কে স্থাপন করা হয় সিউয়ার সিটি শরণার্থী কেন্দ্র। এই পাইপের নকল শহরে অনেক মার্কিন নাগরিক এবং যৎসামান্য বাঙালি সঙ্গী শরণার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরা শরণার্থীদের মতাে শাড়ি, লুঙ্গি ও গেঞ্জি গায়ে দিতেন আর লঙ্গরখানার ডালভাত খেতেন। শরণার্থীদের দুরবস্থার চিত্রটি তুলে ধরার এটি ছিল একটি সার্থক প্রচেষ্টা। এই উদ্যোগটি নেয় ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল সমিতি এবং ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার। বাংলাদেশের জন্য সাহায্য ও সমর্থন আদায়ের এটি ছিল একটি নাটকীয় পন্থা। এখানে বাংলাদেশ এবং শরণার্থীদের জন্য প্রার্থনাসভার অনুষ্ঠান হয়। এসব শরণার্থী কেন্দ্রে আসেন। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি। যেমন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১৪ অক্টোবর এই বিক্ষোভ শুরু হয় ওয়াশিংটনে। ১ নভেম্বর অনুরূপ একটি বিক্ষোভ শুরু হয় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সামনে দাগ হ্যামারশােল্ড প্লাজায়। সাত দিনব্যাপী এই বিক্ষোভেও নিউইয়র্কের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা হাজিরা দেন। কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ সেপ্টেম্বরে ভারতে গিয়ে শরণার্থী কেন্দ্র এবং মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মকাণ্ড দেখে আসেন। তিনি এই বিক্ষোভে যােগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে কবিতার আসর করেন। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তিনি যশােরের পথে’ নামে একটি কবিতাও প্রকাশ করেন।
মার্কিন মুলুকের বাঙালিরা ২৯ মার্চেই বাঙালি কূটনীতিবিদদের কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তারা সবাই পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে বাংলাদেশের কাজে নেমে পড়বেন। বাংলাদেশের জন্য যে আমাদের কাজ করতে হবে, সে ব্যাপারে কোনাে দ্বিমত ছিল না, তবে কীভাবে তা করা যাবে, সে সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে। যে খবর আমরা পাচ্ছিলাম, তাতে দেখা যাচ্ছিল যে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরােধের জন্য স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে কিন্তু তাঁদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং কেন্দ্রীয় কোনাে
৬১
পরিচালনা নেই। একখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা, অন্যত্র প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, আবার অন্যত্র কোনাে বাহিনীর সেনাপতি। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছি একটি সরকার ঘােষণার জন্য। আমাদের কমিটির এক সভায় ঠিক হলাে যে ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করতে হবে। এই উদ্যোগের জন্য উৎসাহী স্বেচ্ছাসেবকও পাওয়া গেল।
হারুন রশীদ আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন, প্রতিরােধের শক্তি ও গুরুত্ব উপলব্ধি। করবেন এবং আমাদের করণীয় সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে আসবেন। সবাই চাঁদা দিয়ে তাঁর প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করবেন। চাঁদা তােলা কিন্তু তত সহজ হলাে না। আমার বন্ধু আতাউর রহমান চৌধুরী বললেন যে আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে চাঁদা। তুলবার দায়িত্ব নিই, তবে তিনি প্রয়ােজনীয় ডলার অগ্রিম দিতে রাজি আছেন। চৌধুরীর খরচে টিকিট কেনা হলাে, মনে হয় তেরাে শ ডলার লেগেছিল। হারুন ১৩ এপ্রিল দিল্লির পথে ওয়াশিংটন ত্যাগ করলেন। ওই দিনই খবর পাওয়া গেল যে একটি সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছে এবং তারাই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবে। মধ্যরাতে (তখন লন্ডনে ১৪ তারিখ সকাল) জাকারিয়া খান চৌধুরীর সঙ্গে কথা হলাে। জাকারিয়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু । বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে লন্ডনে যান ব্যারিস্টার হতে আর সেখানেই থেকে যান। বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে লন্ডনে নানা আন্দোলনে জাকারিয়া সব সময় সক্রিয় ছিলেন। বােধ হয় ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। পরবর্তীকালে জাকারিয়া জেনারেল জিয়ার উপদেষ্টা, অর্থাৎ মন্ত্রী হন এবং সক্রিয় রাজনীতি করেন। জাকারিয়া ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে লন্ডনে পৌছান এবং বিদেশে বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তুতি সম্বন্ধে তিনিই প্রথম বক্তব্য দেন।
জাকারিয়া আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধবের খবর দিলেন এবং জানালেন যে বাংলাদেশ সরকার ওই দিন কুষ্টিয়ায় শপথ গ্রহণ করবে। তবে জ্যাক (আমরা এই নামেই তাঁকে ডাকি) আরও বললেন যে মুক্তিযুদ্ধ খুব শিগগির সমাপ্ত হবে না এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে উচ্ছেদ করা যাবে না। যা হােক, ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা হলাে না। পাকিস্তান বিমানবাহিনী খুব জোরেশােরে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা আক্রমণ করে এবং মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে হয়। ছুটিতে অবস্থানরত মেজর ওসমান, মহকুমা প্রশাসক তৌফিক ইলাহী চৌধুরী এবং মহকুমা পুলিশ সাহেব মাহবুবুদ্দিন আহমদ তখন ওই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অবশেষে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের অভিষেক হলাে। জায়গাটির নাম এখন মুজিবনগর। তবে ১৯৭১ সালে মুজিবনগর ছিল সেখানে,
৬২
যেখানে বাংলাদেশ সরকার সমষ্টিগতভাবে কাজ করত। তাই অনেক দিন কলকাতার থিয়েটার রােডে ছিল মুজিবনগর। নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারকে বলত মুজিবনগর সরকার। আসলে এটি ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার। রাষ্ট্রপতি ছিলেন অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
গােপনীয়তার বেড়া অতিক্রম করে হারুন যখন কলকাতায় পৌছালেন, তখন মুজিবনগর সরকারের অভিষেক নিয়ে তােড়জোড় চলছে। ১৭ তারিখ সরকারের অভিষেক হলাে আর পরদিন কলকাতার পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের সমুদয় বাঙালি কর্মচারী পাকিস্তানের বাঙালি ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলীর নেতৃত্বে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে তাঁদের দপ্তরে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করলেন। হারুন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি মিশনপ্রধান হােসেন আলীর সঙ্গেও দেখা করেন। ২০ এপ্রিল হারুন আমাকে এক তারবার্তা পাঠালেন। ‘৯ সার্কাস অ্যাভিনিউতে বাংলাদেশ মিশনে বাংলাদেশের। প্রতি আনুগত্যের ঘােষণা পাঠান। তারপর নিযুক্তির হুকুম যাবে। অন্যখানে। যেসব বাঙালি কূটনীতিবিদ আছেন, তাঁদের সঙ্গেও যােগাযােগ করুন। হারুন। ওয়াশিংটন ছাড়ার আগে আমরা আরেকটি কাজ করি। একটি বেনামি সার্কুলার তৈরি করা হয় ৫ এপ্রিলে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে বাঙালিদের ঠিকানা জোগাড় করে সেটি পাঠানাে হয়। এই সার্কুলারে বাঙালিদের কর্তব্য কী হতে পারে, সে সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া হয়। প্রথমত, সর্বত্র বাংলাদেশ লিগ গঠন করতে হবে এবং পারতপক্ষে এসব সমিতির সভাপতি হবেন বাঙালি মার্কিন নাগরিক। তাঁদের প্রধান কাজ হবে জনমত গঠন করা এবং বাংলাদেশ সম্বন্ধে সঠিক খবর দেওয়া। সমিতির কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হবে নিউইয়র্ক লিগ, যারা পূর্ব পাকিস্তান নামটিকে বাংলাদেশ লিগ নামে পরিবর্তনের জন্য ব্যবস্থা ইতিমধ্যে নিয়েছে। এক জায়গায় বলা হয়, বােঝাতে হবে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বৃহত্তর গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। একটি বৈধ নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানকে একনায়কের নেতৃত্বে পরিচালিত সেনাবাহিনী যে ধ্বংস করতে বসেছে, এই বিষয়টির ওপর সবিশেষ জোর দিতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য চাঁদা আদায়ের কথাও বলা হয়। আমেরিকার সব নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার বা কংগ্রেসের নেতাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত, বার্মা ও শ্রীলঙ্কার ওপর চাপ রাখতে হবে এবং ওই দেশীয় লােকজনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের কিছু বিবরণ এতে দেওয়া হয়। সার্কুলারে যােগাযােগ করবার জন্য একটি ঠিকানা দেওয়া হয় ৩১১৭, ৭ নম্বর স্ট্রিট, নর্থ ইস্ট, ওয়াশিংটন।
৬৩
ডিসি ২০২১৭। ঠিকানা যে কার ছিল, এখন মনে পড়ে না। তবে টেলিফোন নম্বর ছিল হারুনের ৭০৩-৩৫৬-০২৭৭। সৈয়দ মােয়াজ্জেম আলী আর আমার স্ত্রী সার্কুলারগুলাে পাঠাবার ভার নেন। তাঁরা এই জন্য ৯০ জনের একটি ফর্দ বানান ।
হারুন ফিরে এলেন সম্ভবত ২৪-২৫ এপ্রিল, অধীর আগ্রহে সবাই মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতে চান। বাঙালি ছাড়াও বিদেশি বন্ধুরাও উদ্গ্রীব। ২৬ তারিখ বােধ হয় আমরা সমবেত হলাম আমার বাড়িতে। হারুনের মন্তব্য থেকে প্রতীয়মান হলাে যে বাংলাদেশ সরকার খুবই অগােছালাে। মুক্তিযুদ্ধের জন্য কোনাে পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। ভারতীয় সাহায্য খুবই সীমিত, হিসাব করে রাইফেল ও গুলি দেওয়া হয়। ভারত সরকার বাংলাদেশ নেতৃবর্গের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই পেরেশান। সবার জন্য একেকটি ছদ্মনাম আছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন হলেন মােহাম্মদ আলী, তার সার্বক্ষণিক সহচর আমীর-উল ইসলাম হলেন রহমত আলী, হারুন রশীদের নাম ছিল মুরাদ আহমদ। তবে সবচেয়ে আশার খবর হলাে নির্বাসিত বাঙালিদের দেশ স্বাধীন করার জন্য সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আবালবৃদ্ধবনিতা অনির্দিষ্টকালের জন্য যুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রোশ ও ঘৃণা ছিল সীমাহীন। হারুনের বরাতে আরও জানা গেল যে আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতৃত্ব, ছাত্রদের নেতৃবর্গ এবং বুদ্ধিকোষের সক্রিয় ব্যক্তিরা সবাই যথাসময়ে সাবধান হবার সুযােগ নিয়ে কোনাে না কোনাে রকমে সীমানা পেরিয়ে ভারতে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের কর্তব্যের ধারা সম্বন্ধে কোনাে সন্দেহের অবকাশ থাকল না। সর্বতােভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করে তুলতে হবে। তাদের অর্থসাহায্য দিতে হবে, সর্বোপরি যােগাযােগ ও সম্প্রচারের জন্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য সমর্থন গড়ে তুলতে হবে, পাকিস্তানকে একঘরে করতে হবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল কূটনীতিবিদদের আনুগত্য ঘােষণা নিয়ে। হারুনের তারবার্তাটিকে মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ বলে গ্রহণ করতে আপত্তি উঠল। পাকিস্তান সরকার আঘাত হানলে তখন না হয় আনুগত্য পরিবর্তন করা যাবে। এই সিদ্ধান্ত কিন্তু বাঙালি বেসরকারি মহলে মােটেই গৃহীত হলাে না। ওয়াশিংটনের বাঙালি সমাজ কূটনীতিবিদদের বাদ দিয়েই ১০ এপ্রিল তাদের একটি সমিতি গঠন করে এবং হারুনের প্রত্যাবর্তনের আগেই সেটা নিবন্ধিত হয়। তখন থেকেই এ দুই গােষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা হয় যে দূতাবাসে যেসব বাঙালি কাজ করতেন, তাঁদের মধ্যেও দুটি দল হয়ে যায়, মােটেই খােলাখুলি নয় কিন্তু মনের গভীরে। সাধারণ কর্মচারীরা মনে করেন যে কূটনৈতিক মর্যাদার কর্মকর্তারা সঠিকভাবে তাদের সমর্থন করবেন না। তাই সবাই যেন নিজের রাস্তা দেখতে শুরু করেন।
৬৪
এর মধ্যে অন্যান্য বাঙালি প্রায় ধমক দিয়ে অথবা কড়া শাসন করে সব কূটনীতিবিদের কাছে চিরকুট পাঠাতে শুরু করেন। আমার সংগ্রহে এখনাে এ রকম দুটো বার্তা ও আলটিমেটাম রয়েছে।
এদিকে ২৬ তারিখেই নিউইয়র্কের ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী পাকিস্তান কনস্যুলেট জেনারেল ছেড়ে বাংলাদেশের আনুগত্য ঘােষণা করেন। মাহমুদ আলী নিউইয়র্কে নিযুক্তি পেয়েই সাহসী ভূমিকা পালন করতে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ লিগের ছিলেন প্রধান বুদ্ধিদাতা। একুশে ফেব্রুয়ারি তারই উদ্যোগে কনস্যুলেট জেনারেলের দপ্তরে শহীদ দিবস উদ্যাপন করা হয়। পাকিস্তান সরকার তাঁকে শাস্তি দিতে নিউইয়র্ক থেকে দেশে ডেকে পাঠায়। ভারতের বাইরে আবুল হাসান মাহমুদ আলী ছিলেন প্রথম বাঙালি কূটনীতিবিদ, যিনি বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। পরবর্তীকালে তিনি পূর্ব জার্মানিতে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে ১৯৯৬ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ এইচ মাহমুদ আলী হলেন আমেরিকায় মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রতিনিধি। মাহমুদ আলীর বীরােচিত পদক্ষেপ নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হয়। ক্যাথলিন টেলটস তাঁর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করেন। আমার দোষ হলাে যে আমি বাঙালি এবং আমার স্বদেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে আমি পারিনি। আমরা দূতাবাসে কাজ করতে পারি না, আমরা হয়ে আছি জিম্মি। যে সরকার আমার জাতভাইদের হত্যা করছে, আমি তাদের চাকরি করব না। তাঁর স্ত্রী শাহীন বলেন, ‘আমার খুব খুব খারাপ লাগছে, আমি নিজে অস্ত্র তুলে নিতে চাই।’ মাহমুদ আলীর এই পদক্ষেপের পর ওয়াশিংটনে আমাদের অবস্থান নিতান্তই নাজুক হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা ইতিমধ্যে আমেরিকায় বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যস্ত। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশে বাঙালি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে যােগাযােগ করছি। মার্চেই লন্ডনে সেলিমুজ্জামান ও রেজাউল করিমের সঙ্গে এবং প্যারিসে মনজুর হােসেন চৌধুরীর সঙ্গে আমার কথা হলাে। সেলিমুজ্জামান ধীরেসুস্থে চিন্তা করতে বললেন। কিন্তু রেজা আর মনজুর দ্রুত পদক্ষেপ নিতে খুবই উৎসাহী ছিলেন। মনজুর তাে নালিশই করলেন যে আমরা এতজন ওয়াশিংটনে বসে কেন চুপ করে আছি। এপ্রিলে যােগাযােগ হলাে সুদানে রাষ্ট্রদূত আতাউর রহমানের সঙ্গে আর টোকিওতে। কায়সার মুরশেদের সঙ্গে। কায়সারকে দপ্তরে টেলিফোন করেছিলাম, তিনি বেশি কথা না বলে পরে একটি পাবলিক কল অফিস থেকে কথা বলেন। তাঁর বাঙালি রাষ্ট্রদূত মােতাহার হােসেন মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেন না বলে তিনি জানালেন। প্রাথমিক এই উৎসাহ কিন্তু আস্তে আস্তে চলে গেল। শুধু রেজাউল করিম ৭।
৬৫
অক্টোবর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। সেলিমুজ্জামান ও মােতাহার হােসেন বাংলাদেশ মুক্ত হলেও পাকিস্তানে থেকে যান। কায়সার। মুরশেদ যুদ্ধ শেষে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের পক্ষে আসেন। আতাউর রহমান কোনাে এক সময় আলােচনার্থে পাকিস্তান গেলে পরে তাকে আর ফেরত যেতে দেওয়া হলাে না। বােধ হয় ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে তিনি পালিয়ে। বাংলাদেশে আসেন। মনজুর চৌধুরী ১৯৭২ সালে পাকিস্তান দূতাবাস ছাড়লেও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করেন অনেক পরে। বাংলাদেশ সরকার কূটনীতিবিদদের আনুগত্য আশা করে এবং তার মূল্যও দেয়। তবে সরকারিভাবে তাঁদের ভার নিতে তাদের প্রথম দিকে অসুবিধা ছিল। কিন্তু জুন মাসে তারা ঠিক করে যে বিদেশে কতগুলাে মিশন স্থাপন করবে এবং সব কূটনীতিবিদকে আনুগত্য ঘােষণার আহ্বান জানাবে।
জনসংযােগের দৃষ্টিকোণ থেকে এ রকম আনুগত্য ঘােষণা ছিল নানাভাবে মূল্যবান। প্রথমত, এতে মুক্তিযুদ্ধে সমস্ত বাঙালি গােষ্ঠীর ব্যাপক সমর্থন প্রকাশ পেত। দ্বিতীয়ত, তারা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জনমত গঠনে এবং প্রচারণায় উত্তম ভূমিকা রাখতে পারতেন। তৃতীয়ত, এতে রণাঙ্গনে যােদ্ধারা ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নিষ্পেষিত জনগণ ভরসা পেত ও উদ্বুদ্ধ হতাে। ৫ জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় সব কূটনীতিবিদকে আনুগত্য ঘােষণার আহ্বান। জানান এবং তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করেন। এই আহ্বানে একটি সমগ্র দল হিসেবে সাড়া দেন ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে আমাদের সব কূটনীতিবিদ। মােট ১৪ জন কর্মচারী ৪ আগস্ট ওয়াশিংটন প্রেসক্লাবে এই ঘােষণা দিয়ে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। শুধু কলকাতায় ১৮ এপ্রিল এভাবে পাকিস্তান মিশনে চাকরিরত সব বাঙালি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
৬৬
<p style="text-align: justify;"> চতুর্থ অধ্যায়
দুটি উদ্যোগ
পাকিস্তানের ঘনায়মান অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয় প্রথম পর্বেই আলােচনা। করেছি। আজিজ আলী মােহাম্মদ একসময় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কাজ করতেন। পরে তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে যােগ দেন। ১৯৭০ সালে তাকে পাকিস্তান সরকার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত করে। তিনি ইসলামাবাদে গেলেও তাঁর পরিবার ওয়াশিংটনেই থেকে যায় এবং তাদের। সঙ্গে আমাদের বেশ সখ্য ছিল। জানতে পেলাম যে আজিজ আলী ওয়াশিংটনে আসছেন ঋণ পরিশােধ ও অর্থ সাহায্যের বিষয়ে আলােচনার জন্য। ৮ এপ্রিল আমি ওয়াশিংটন ইভনিং স্টার-এর জর্জ শারমানের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম, তিনি অর্থনৈতিক বিষয়ে রিপাের্ট করেন। মধ্যাহ্নভােজের ফাঁকে ফাঁকে তাকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করলাম । জর্জকে মার্কিন সূত্র জানায় যে তারা পাকিস্তানকে একটি সমঝােতা করার জন্য চাপ দিচ্ছে এবং সাময়িকভাবে নতুন কোনাে সাহায্য দিচ্ছে না।
ধারণা ছিল অন্য রকম, মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সাহায্য দিতে ছিল উদ্গ্রীব। তবে বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে বিষয়টি ফয়সালা করতে বলছিল। যা-ই হােক, জর্জ পরের দিনই পাকিস্তান সংকটের একটি বিশদ বিবরণ প্রকাশ করেন এবং আজিজ আলীর মিশনের কথাও উল্লেখ করেন। তবে তাঁর প্রতিবেদনের শিরােনাম ছিল মার্কিন সরকারকে খুশি করার জন্য। Us Trying to Force Pakistan Accord. (পাকিস্তানে সমঝােতার জন্য মার্কিন চাপ)। ওয়াশিংটন পােস্ট-এর রন কোভেন এবং নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেন ওয়েলস দুজনই আমাকে সংকটটি সম্বন্ধে কিছু লিখিত বক্তব্য দিতে অনুরােধ করেন। তাঁদের এই অনুরােধ আমি সাগ্রহে গ্রহণ করি। এরপর যেখানেই বাংলাদেশের কথা বলতে যাই—সাংবাদিক মহলে, কোনাে সমীক্ষা বা চিন্তাকোষ কেন্দ্রে বা
৬৭
কংগ্রেস—সবখানেই দেখি লিখিত বক্তব্যের চাহিদা খুব বেশি এবং তার প্রতিক্রিয়াও খুব ভালাে। রন কোভেন ১০ তারিখে লিখলেন ‘Pakistan Seeks US Aid to Avoid bankruptey’ (পাকিস্তান দেউলিয়াপনা এড়ানাের জন্য মার্কিন সাহায্য চায়)। বেন ওয়েলস তার এক বিস্তৃত প্রতিবেদনে এই সংকট সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ওই দিনই প্রকাশ করলেন। আমি তাঁদের জন্য একটি প্রতিবেদন বানাই, ‘পাকিস্তানের দেউলিয়াপনা।
আমার মনে হলাে, আমার সময়ের খুব অভাব। সকাল নয়টা থেকে প্রায় ছয়টা-সাড়ে ছয়টা কেটে যায় দপ্তরে খানিকক্ষণ হাজিরা দিতে আর বাইরে নানাজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে। তারপর পড়ার বা লিখবার সময় খুব কম। এ সময় বেশ কদিন অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এর পরিণাম হলাে আমার পরবর্তী জীবনের এক মূল্যবান অভ্যাস। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে আমি দেখলাম যে দিনে চার ঘণ্টা ঘুমালেই যথেষ্ট, ঘুম ভালাে হয় তাই অসুবিধা লাগে না অথচ অনেক সময় হাতে হাতে ফল পাওয়া যায়। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ঘুমের এই রুটিন পালনে আমার কোনাে অসুবিধা হয়নি অথবা খুব বেশি ব্যতিক্রমও হয়নি। এখনাে কাজের চাপ থাকলে এই রুটিনে প্রত্যাবর্তন করতে খুব অসুবিধা হয় না। ঘুমটা তাই নিতান্তই অভ্যাসের ব্যাপার। সাধারণত ছয় বা সাত ঘণ্টা ঘুমে অভ্যস্ত ছিলাম কিন্তু তাকে চার ঘণ্টায় নামিয়ে নিতে শুধু একটু কঠিন ইচ্ছাশক্তির প্রয়ােজন হয়। এপ্রিল মাসে এ ধরনের আরও কয়েকটি প্রতিবেদন আমাকে প্রস্তুত করতে হয়; কোনাে কোনােটা ছিল নিতান্ত সাময়িক বিষয় নিয়ে, আবার কোনােটা ছিল দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বের বিষয় নিয়ে। সামরিক বাহিনীর উন্মত্ত কর্মকাণ্ড, বাংলাদেশ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দর্শন ও আচরণ—এ ধরনের বিষয় নিয়ে আমাকে বেশ কটি ছােটবড় প্রতিবেদন বানাতে হয়।
এপ্রিলে দুটি সম্মেলনের কথা না বললেই নয়। ইন্টেলসাট’ বিশ্ব সম্মেলন। শুরু হয় বােধ হয় ১৯৬৯ সালে। এটি ছিল আসন্ন স্যাটেলাইট টেলিযােগাযােগ বিপ্লবের নিয়মকানুন নির্ধারণের জন্য। প্রথম সম্মেলনে পাকিস্তান দলের নেতৃত্ব। দেন সম্ভবত পােস্টমাস্টার জেনারেল ওবায়েদ মােহাম্মদ। তিনি উর্দুভাষী বাঙালি ছিলেন এবং অনেক দিন পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি করেন। তাঁর সঙ্গে ঢাকায় থাকতে প্রথম পরিচয় হয় এবং পরে করাচি ও পিন্ডিতে একসঙ্গে চাকরি করি। তার খাতিরে আমাকে এই সম্মেলনে অংশ নিতে হয়। পরবর্তী প্রায় প্রতিটি অধিবেশনে তিনি আমাকে দলের নেতা মনােনীত করেন। পাকিস্তান থেকে মাঝেমধ্যে গােলাম আব্বাস নামে একজন কর্মকর্তা আমাকে সহযােগিতা করতেন। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন মার্কিন প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ওয়াশবার্ন। ১৪ এপ্রিল শুরু হয় একটি
৬৮
অধিবেশন। অধিবেশনে তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার খানিকটা উত্তপ্ত আলােচনা হয়। তুর্কি পাকিস্তানের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ। ওই দেশে তারা পাকিস্তানিদের বলে ভাই বা কারদেশ আর মার্কিনদের বলে বন্ধু বা অর্কেন্দাশ। ভ্রাতৃত্বের সুযােগ নিয়ে আমি তাকে পাকিস্তানের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য অনুরােধ করি। আমি বলে ফেলি যে বাঙালিরা শুনেছে যে তুর্কি পাকিস্তানকে সেনা ও রসদ সরবরাহের জন্য উড়ােজাহাজ দিয়েছে। আমি আরও বলি যে এটি ভ্রাতৃসুলভ কাজ হয়নি। কারণ, এই সাহায্য পেয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের খুন করছে।
১৯ এপ্রিল তারিখে আমার মিনিস্টার বশির আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে শুধালেন যে তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার কি কোনাে বচসা হয়েছে? অত্যন্ত অপ্রিয় একটি নির্দেশ তিনি ভদ্রভাবে দেবার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন যে তুর্কি রাষ্ট্রদূত হিলালি সাহেবের কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছেন। তিনি বলেছেন যে আমি খুব আবেগপ্রবণ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে খুবই বিচলিত। হিলালি হুকুম দিয়েছেন যে আমি যেন সম্মেলনে আর না যাই এবং দূতাবাসে যেন থাকি। আমি বললাম, আমার তাে এইড, কমার্স এবং বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলে অনেক কাজ থাকে, তাই দূতাবাসে তাে আমি সব সময় থাকতে পারব না। বশির সুন্দর সমাধান বের করলেন। লাঞ্চ পর্যন্ত আমি দূতাবাসে থাকব। লাঞ্চে বেরিয়ে চারটা পর্যন্ত অন্যান্য কাজ সারব আর পাঁচটার পর যা খুশি তা করতে পারব। এই রুটিন বেশ কিছুদিন আমাকে মেনে চলতে হয়। আমি এর জন্য মধ্যাহ্নভােজের সময় বাড়িয়ে দিলাম। আর রােজই একজন-আধজন মেহমান ডাকতে শুরু করলাম। ২২-এ স্টেট ডিপার্টমেন্টে লাঞ্চ, ২৬-এ বিশ্ব ব্যাংকে, ২৭-এ মুদ্রা তহবিলে জেরাকিস, ২৯-এ বাংলাদেশে কর্মরত এক উপদেষ্টা রিচার্ড কিম্বল। ইন্টেলস্যাটে আর কোনাে অধিবেশনে আমি যােগ। দিইনি। ১৯৭২ সালে আমি যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধি (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স), তখন রাষ্ট্রদূত ওয়ার্শবান আমার সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশকে ইন্টেলস্যাট কনভেনশনে দস্তখত করতে আহ্বান জানান।
এই সম্মেলনে অন্য রকমের অভিজ্ঞতা হয় ইরানি দূতাবাসের এক মিনিস্টারের সঙ্গে আলাপ করে। তাকে ১৬ এপ্রিল আমি সিনেটর হ্যারিসের প্রস্তাব সম্বন্ধে অবহিত করি। সিনেটর ১৯ এপ্রিল তাঁর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। আমি তাঁকে বলি যে ইরানের শাহ একাধারে পাকিস্তানের বন্ধু, অন্যদিকে ভারতেরও খুব ঘনিষ্ঠ । বাংলাদেশে আমরা তাঁকে সম্মান করি। আমার কলেজজীবনে ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে তিনি যখন বাঘ শিকারে সিলেটে যান, তখন থেকে তিনি আমাদের প্রিয়পাত্র। তাকে তখন যে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়, পরবর্তীকালেও তিনি সেই রকম সংবর্ধনা পান। তিনি পাকিস্তানকে সংযমী হতে উপদেশ দিতে পারেন । তিনি
৬৯
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমঝােতার জন্য মধ্যস্থতা করতে পারেন। ওয়াশিংটনে তখন ইরানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, একসময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদের্শির জাহেদি। আমার উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে একটি ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু এটিই ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ। পাকিস্তানি বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ এমন স্তরে পৌছায় যে কোনাে রকম মধ্যস্থতার সুযােগ ছিল না। মার্কিন অনেক মহলে নভেম্বর মাসেও ধারণা ছিল যে স্বায়ত্তশাসনে রাজি হলে সম্মিলিত পাকিস্তান রক্ষা করা যেত। জুনের ২৮ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়ার ঘােষণার পর সমঝােতার একমাত্র রাস্তা ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্পর্ক ছেদ, কনফেডারেশনের কোনাে সুযােগ ছিল না। শেষ পর্যায়ে ইরানও এই সংকটে নিরপেক্ষ থাকেনি, পাকিস্তানের বিমানপােত ইরানে সংরক্ষিত হয়। ইরানের মাধ্যমে অস্ত্র পাচারের। চিন্তাভাবনা কিসিঞ্জারের মাথায় আসে।
২৯ এপ্রিল আমেরিকান সােসাইটি ফর ইন্টারন্যাশনাল ল-এর বার্ষিক সম্মেলন হয় স্টেটলার হিল্টন হােটেলে। ডেল ডিহান আমাকে এই সম্মেলনে যেতে আহ্বান করেন। ডেল সেখানে অধ্যাপক গিডন গটলিয়েবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। গটলিব নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি এই সম্মেলনে বক্তৃতা দেবেন মানবাধিকার সম্বন্ধে। তিনি বাংলাদেশের বিশদ খবর চেয়ে বসলেন। তার ধারণা, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে এবং পাকিস্তান সেখানে। জেনােসাইড কনভেনশনের হিসাবে আসামি। প্রশ্নোত্তরে গটলিব বলে ফেললেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং প্রয়ােজনে নির্বহন জায়েজ। সেখানেই ডেল জানালেন, কংগ্রেসম্যান গালাগার বাংলাদেশের ওপর শুনানি নির্ধারণ করেছেন। সিনেটর কেনেডি সেখানে প্রধান সাক্ষী আর অধ্যাপক গটলিবকে সাক্ষ্য দেবার জন্য আহ্বান জানানাে হতে পারে। গালাগার শুনানির প্রথম অধিবেশন হয় ১১ মে।
২৭ এপ্রিল আর না পেরে বিশ্ব ব্যাংকের সভাপতি ম্যাকনামারা সাহেবকে টেলিফোন করে বসলাম। তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা হয়েছে। প্রথমবার নবাব কিজিলবাসের দলের সদস্য হিসেবে আর দ্বিতীয়বার জেনারেল ইয়াহিয়ার জন্য রাষ্ট্রদূত হিলালির লাঞ্চে। রবার্ট স্ট্রেঞ্জ ম্যাকনামারা একজন বিতর্কিত মহামানব। অতি অল্প বয়সে শুধু মেধার জোরে তিনি দ্বিতীয় হেনরি ফোর্ডের নজরে আসেন। ৪৪ বছর বয়সে তিনি ফোর্ড কোম্পানির প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। বুদ্ধি ব্যবহার করে যারা সবকিছু করে, সেই গােষ্ঠীর একজন হিসেবে ‘হুইজ কিড’ (Whiz Kid) শব্দটি তাঁর সুবাদে অভিধানে একটি বিশেষ স্থান করে নেয়। প্রেসিডেন্ট কেনেডি তাঁকে আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বানান এবং প্রেসিডেন্ট জনসনের মন্ত্রী হিসেবে ভিয়েতনামের ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ সময় ১৯৬৮
৭০
সালে তিনি বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, বিশ্ব ব্যাংকে তিনি সুদীর্ঘতম সময়ের জন্য (মােট ১৪ বছর) কর্ণধার ছিলেন এবং ম্যাকনামারার বিশ্ব ব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন উদ্যোগে শুধু অর্থসংস্থানই করেনি, বরং উন্নয়ন-দর্শন ও উন্নয়নকৌশলে দিশারির ভূমিকা পালন করে।
বিশ্ব ব্যাংক ছাড়ার পরও নিরস্ত্রীকরণ ও আণবিক সমরাস্ত্র নিশ্চিহ্নকরণ, জনসংখ্যা পরিকল্পনা, দারিদ্র্য বিমােচন এবং আফ্রিকার উন্নয়ন আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আমার অভিজ্ঞতায় এমন দক্ষ বিশ্ব ব্যাংক সভাপতি আমি আর দেখিনি। বলা হয় যে কম্পিউটার জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগে। থেকেই ম্যাকনামারার মন ছিল কম্পিউটারের মতাে দ্রুতগতি, স্মৃতিধর ও বৃহৎ পরিসরের। ১৯৬৮ সালে বিশ্ব ব্যাংক বছরে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিত । ১৯৮০-তে এই কলেবর ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার । ম্যাকনামারার একটি দুর্বল দিক হলাে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ১৯৬৫-এর শুরু থেকে যুদ্ধে মার্কিন ভূমিকা বেড়ে চলল। এবং ধ্বংস ও মৃত্যুহার উঁচুতে উঠল । ১৯৬৭-এর মাঝামাঝি ম্যাকনামারা এই নীতির বিরােধিতা করতে শুরু করেন কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেননি। এ ব্যাপারে সুদীর্ঘ ৩০ বছর নীরবতা বজায় রেখে ১৯৯৫ সালে তিনি মার্কিন-ভিয়েতনাম নীতির ভ্রান্তি স্বীকার করে আরও বিতর্কিত হন। তাঁর বই In Retrospect কিন্তু একটি অবশ্যপাঠ্য। ব্যক্তিগতভাবে মানুষের মঙ্গল, বিশ্বশান্তি এবং গরিব ও বঞ্চিতের প্রতি তার অঙ্গীকার আমাকে মুগ্ধ করে। ১৯৭২ সাল থেকে তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে জানবার সুযােগকে আমি সৌভাগ্য বলে বিবেচনা করি।
ম্যাকনামারার স্টাফ অফিসার জুলিয়ান ক্রিস্টোফারসেন আমার কথা শুনলেন। আমাকে বললেন, তিনি ম্যাকনামারার সঙ্গে আলাপ করে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করবেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন এল যে ম্যাকনামারা আমার সঙ্গে দেখা করবেন না, তবে তিনি সহানুভূতিশীল । আমি যেন সর্বক্ষণ দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক গ্রেগরি ভােটার সঙ্গে যােগাযােগ রাখি। গ্রেগ এই ব্যাপারে ম্যাকনামারার বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। গ্রেগ তক্ষুনি আমাকে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে ডাকলেন। গ্রেগ দম্পতির সঙ্গে আমাদের এমনিতেই ভালাে সম্পর্ক ছিল, আমরা একসঙ্গে একবার পিকনিকও করি। গ্রেগ ভােটার সঙ্গে বিশ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বিস্তর আলােচনা হলাে কিন্তু আমাদের সংকটের আশু সমাধানের কোনাে রাস্তার সন্ধান মিলল না। গ্রেগের কথা হলাে, জাপানকে আমাদের বিষয়ে আগ্রহী করতে পারলে মার্কিন দুষ্ট প্রভাব থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। গ্রেগ আরও জানালেন যে আজিজ আলী মােহাম্মদের সফরটি ছিল পূর্বনির্ধারিত। তাই সামরিক হামলার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কোনাে বিশ্লেষণ তিনি করতে পারেননি। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিটি হয়ে গেছে মুখ্য বিবেচনার বিষয়, অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি এখন
৭১
ঢেলে সাজাতে হবে। পাকিস্তানকে নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে তারা সেই প্রস্তাব পাবার আশা রাখেন। এই প্রস্তাব বিবেচনা করে বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিল তাদের পরবর্তী কৌশল সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেবে।
ওই দিনই (২৭ এপ্রিল) আমার বন্ধু সােয়েজি ইউএসএইডে আমার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সভার আয়ােজন করেন। সহকারী প্রশাসক ডােনাল্ড ম্যাকডােনাল্ডের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার। ডন পাকিস্তানে এইডের পরিচালক ছিলেন, যখন আমি করাচিতে পরিকল্পনা কমিশনে চাকরি করি। কার্যোপলক্ষে আমরা পরস্পরের কাছে পরিচিত ছিলাম, যদিও তাঁর সঙ্গে আমার কোনাে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। ডন পাকিস্তান থেকে ভিয়েতনামে যান, তারপর ওয়াশিংটনে সদর দপ্তরে এশিয়া অঞ্চলের বড় কর্তা হন। ওয়াশিংটনে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাঁর সহযােগী অনেকের মধ্যে ছিলেন হারবার্ট রিস ও টাউনসেন্ড সােয়েজি। ডন ম্যাকডােনাল্ড খুব জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। বিশেষ করে ওয়াশিংটনে কূটনৈতিক পার্টিতে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তাঁকে দেখতে লাগত নামকরা চলচ্চিত্র নায়ক ক্যারি গ্রান্টের মতাে। এ বিষয় নিয়ে তার স্ত্রীও ঠাট্টা-মশকরা করতেন। তাঁর কাছে আমার বক্তব্য ছিল দুটি। প্রথমত, পূর্ব পাকিস্তানে তখন প্রচুর গম আর সার সরবরাহ হতাে মার্কিন সাহায্যের অধীন। আমার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দূতাবাস নির্বিবাদে মাল খরিদ ও তা জাহাজজাত করছিল। প্রায়ই জাহাজকে মাঝপথে গন্তব্যস্থল পরিবর্তন করে করাচিতে পাঠিয়ে দেওয়া হতাে। আমার কাছে মনে হতাে, বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা পাকিস্তানে এভাবে স্থানান্তর করা হচ্ছিল। তাই আমি সব সরবরাহ বন্ধ করতে আবেদন করলাম।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে উর্ধ্বতন মহল থেকে চাপ থাকলেও খুব বেশি ত্রাণসামগ্রী পূর্ব পাকিস্তানে সরবরাহ করা হয়নি। সিনেটর কেনেডির উদ্যোগে মার্কিন কম্পট্রোলার জেনারেল এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখেন, যদিও প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য ঘােষণা করা হয়, তার অর্ধেকও বাস্তবে প্রদান করা হয়নি এবং ২৫ মিলিয়ন ডলারের এক খাদ্য অনুদানের কাগজপত্রই সম্পাদন করা হয়নি। ডন অবশ্য আমাকে কোনাে সরাসরি উত্তর দেননি। আমার দ্বিতীয় আবেদন ছিল, এইডের খরচে যেসব বাঙালি আমেরিকায় প্রশিক্ষণে ছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে । ইতিমধ্যে সােয়েজি অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রলম্বিত করে শিক্ষার্থীদের থেকে যাবার ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত, যাতে প্রতিটি কেস এককভাবে বিবেচনা না করতে হয়। ডন এই প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে তিন মাসের জন্য প্রায় সব প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়ানাের ব্যবস্থা করেন।
হারুন রশীদের প্রত্যাবর্তনের পর আমরা আমাদের সার্কুলারের দ্বিতীয় সংখ্যা বিতরণ করি ২৬ এপ্রিল। এতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের খবর
৭২
দেওয়া হয়, কলকাতা থেকে প্রাপ্ত টাটকা খবরাখবর পরিবেশন করা হয় এবং চাঁদা আদায়ের প্রতি জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের হুকুমমতাে প্রয়ােজন মেটানাের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে হাতে রাখতে বলা হয়। এই সার্কুলারের। একাংশ উদ্ধৃত করছি : বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে অবস্থিত। মুজিবনগর কিন্তু একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নয়। বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা যেখানে সমবেত হয়, সেখানেই হয় তখনকার মুজিবনগর। এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী মুজিবনগরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে না দিতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত না বিমান হামলা প্রতিহত করার ক্ষমতা হয়, তত দিন ভ্রাম্যমাণ মুজিবনগরই হলাে সরকারের সদর দপ্তর।
১ জুন আমাদের সর্বশেষ সার্কুলার প্রচারিত হয়। ইতিমধ্যে খবর সরবরাহ ও যােগাযােগ অব্যাহত রাখার দায়িত্ব নিউইয়র্ক ও শিকাগাে লিগ নিয়ে নিয়েছে। ১ জুনের সার্কুলারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের অনেক খবর দেওয়া হয় আর এর। প্রধান সূত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পাক্ষিক গােপনীয় প্রতিবেদন। মােহাম্মদ সােলায়মান যত দিন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের দপ্তরে কাজ করেন, তত দিন নিয়মিতভাবে এই প্রতিবেদনের নকল তিনি আমাকে দিতেন। এই প্রতিবেদনে বস্তুতই সত্য কথা লিপিবদ্ধ হতাে এবং পরে শুনেছি যে এর জন্য কৃতিত্ব ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রসচিব মনসুর কাজিমের। মনসুর কাজিমের মূল বাড়ি বােধ হয় মাদ্রাজে ছিল, তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন ১৯৫৫ সালে এবং জীবনের প্রথম কয় বছর পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি করেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ কর্মকর্তা, মিথ্যাচার তার ধাতে ছিল না।
এপ্রিলের ৬ তারিখ ঢাকা থেকে মার্কিন অধিবাসীদের বৃহদংশকে অপসারণ করা হয়, তারা কিছুদিনের মধ্যেই তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তারা প্রায় সবাই বাংলাদেশের দূত হিসেবে ভূমিকা নেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেন সিআরএলের জন ও কর্নেলিয়া (ক্যান্ডি) রােডি । ওহাইওর সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি ছিলেন ক্যান্ডির প্রতিনিধি। এ ছাড়া সিনেটরের ছেলে ছিলেন জনের সহপাঠী । জন সিনেটরকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন এবং পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন নমনীয়তায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সিনেটর ২৯ এপ্রিল। এ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন এবং জনের চিঠি কংগ্রেশনাল রেকর্ডে নিবিষ্ট করেন। সিনেটর স্যাক্সবি সারা বছর ছিলেন আমাদের একান্ত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। অধ্যাপক রেহমান সােবহান যখন ওয়াশিংটনে পৌছান, সিনেটর স্যাক্সবি তাকে সিনেটরদের কাছে বাংলাদেশের কথা তুলে ধরার সুযােগ করে। দেন। পরবর্তীকালে তিনিই সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চের সঙ্গে একযােগে পাকিস্তানে মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের জন্য ফরেন এইড বিলের
৭৩
সংশােধনী উত্থাপন করেন। স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী বিল উত্থাপিত হয় ৮ জুন এবং পাস হয় ১০ নভেম্বর। কর্নেলিয়া রােডি এপ্রিলেই ওয়াশিংটনে এসে বাসা বাঁধেন। বেথেসডায় তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে তাঁর স্বামীর এক সতীর্থ গবেষক ডাক্তারের বাড়িতে আস্তানা গাড়েন এবং ইতিমধ্যে আন্দোলিত সিআরএল গােষ্ঠীকে সংগঠিত করেন।
বােস্টনে ডেভিড ন্যালিন আর আনার সঙ্গে যােগ দেন লিনকন আর মার্টি চেন। সিআরএল গােষ্ঠী ছিল প্রভাবশালী দল এবং বাংলাদেশের জন্য তারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁরাই ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন করেন। জন ও কর্নেলিয়া রােডি ১৯৭১ সালে স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী পেশ হওয়ার পর ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে কাজ করেন, তাঁরা দুজনই জনহিতে নিবেদিত কর্মী। জনস্বাস্থ্য রক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন আর কর্নেলিয়া শিক্ষা, বিশেষ করে শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করেন। অনুন্নত দেশই তাদের কর্তব্যস্থল। তাঁরা হাইতি ও ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করে প্রায় আট বছর ভারতে ছিলেন। জন হাইতিতে ১৯৯৬ সালে ইউনিসেফের প্রতিনিধি ছিলেন। কর্নেলিয়া শিক্ষাবিষয়ক নানা কাজে লিপ্ত থাকেন এবং আমাদের ব্র্যাকের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে উপদেষ্টার কাজ করেন সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বেশ কয়েক মাস।
অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যানের কথা প্রথম অধ্যায়ে বলেছি। সম্ভবত মহীউদ্দীন আলমগীরের প্ররােচনায় তিনি আরেকটি বিশেষ উদ্যোগ নেন এপ্রিল মাসের সূচনায়। ২৯ জন বুদ্ধিজীবী ১২ ও ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটন পােস্ট-এ একটি বড় বিজ্ঞাপন ছাপান। এটি ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে একটি আবেদন। সংক্ষিপ্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে ব্যক্ত এই আপিলে তারা রক্তপাত ও ধ্বংসের পথ পরিহার করে সমঝােতা করার আহ্বান জানান। এসব বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানকে ভালাে জানতেন এবং পাকিস্তানের উন্নয়ন সব সময়ই কামনা করতেন। তাদের আপিলের একটি কথা ছিল, আমরা বিশ্বাস করি, যেকোনাে সরকার শুধু অস্ত্রের জোরে তাদের ইচ্ছা জনগণের ওপর চাপাতে পারে না। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনতা যখন একবাক্যে তাদের আশা ব্যক্ত করেছে এবং তাদের আশা অত্যন্ত যুক্তিসম্পন্ন। এই ২৯ জন দস্তখতকারীর মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক এডওয়ার্ড মেসন, জন মেলর, গুস্তাভ ও হান্না পাপানেক, পিটার রােজার, এডওয়ার্ড ডিমক জুনিয়র, ওয়াল্টার ফালকন, রিচার্ড গেবল, ফ্র্যাঙ্ক চাইল্ড, জন টমাস, ওয়েন উইলকক্স, স্টিফেন লুইস জুনিয়র, পল ক্লার্ক, এডউইন ক্লার্ক (দ্বিতীয়), লেডি জ্যাকসন (বারবারা ওয়ার্ড) ও অন্যরা। রবার্ট ডর্ফম্যান সারা বছর ধরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে যান। তিনি গালাগার শুনানিতে বক্তব্য দেন, খবরের কাগজে চিঠি লেখেন। আবার শেষের দিকে আলমগীর মুহিউদ্দিনের দেড়সালা পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নেও একজন খুঁটি হিসেবে
৭৪
কাজ করেন। একই সঙ্গে অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকের কৃষি ও পানিবিষয়ক গবেষণায়ও তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত নয় খণ্ডের এই প্রতিবেদন সম্বন্ধে তৃতীয় অধ্যায়ে আরও বলেছি। এই গবেষণায় বাংলাদেশের কতিপয় সরকারি কর্মচারী ও গবেষকও নিয়ােজিত ছিলেন। যথা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম, প্রকৌশলী এম আর ভূঁইয়া ও অর্থনীতিবিদ মতিলাল পাল। তাঁরা সবাই অধ্যাপক ডর্ফম্যানের ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করতেন।
কথাটি যখন এসে গেল, তখন এই দেড়সালা পুনর্গঠন কার্যক্রমের কাহিনি এখানেই বিবৃত করি। সেপ্টেম্বর মাসে মুজিবনগর সরকার একটি পরিকল্পনা বাের্ড গঠন করে। এর সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী আর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক মােশররফ হােসেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং ড. স্বদেশ রঞ্জন বােস। এই বাের্ড গঠনের। প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমেরিকায় ড. নূরুল ইসলাম ও হারুন। রশীদকে (তাঁদের ছদ্মনাম ছিল নির্মল সেন ও মুরাদ) এই পরিকল্পনা বাের্ডে যােগ দিতে আহ্বান জানান। হারুনকে বােধ হয় বাের্ডের সদস্যসচিব বানানাের প্রস্তাব ছিল। তখন একটি ধারণা ছিল যে একটি পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নের জন্য যেসব তথ্যের প্রয়ােজন, তা সম্ভবত সবচেয়ে সহজে আমেরিকায়ই পাওয়া যাবে। বিশ্ব ব্যাংক ও ইউএসএআইডিতে যত খবর পাওয়া যাবে, কলকাতায় বা বাংলাদেশের বাইরে কোনােখানে ততটা পাওয়া যাবে না। এই বিবেচনায় মনে করা হয় যে পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নের কাজ আমেরিকায় সম্পাদন করাই ভালাে। মুজিবনগর সরকার অবশ্য এই মত পােষণ করত না, তবে আমেরিকায় এ রকম একটি উদ্যোগে তাদের কোনাে আপত্তি ছিল না।
সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগেও একটি পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়ন করা হয় (Special Programme for the Economic Rehabilitation of East Pakistan, September 13, 1971)। আলমগীর মুহিউদ্দিন এই পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নের কাজ হাতে নেন। ড. নূরুল ইসলাম, হারুন রশীদ ও আমি তাতে উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করি। আমি ফেব্রুয়ারিমার্চেই ‘Economy of Bengal’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করি। তাতে আমাদের অবস্থান এবং একটি সার্বভৌম অর্থনীতির সমস্যা ও কৌশল নিয়ে আলােচনা করি। কিন্তু যুদ্ধের ধ্বংসলীলা সেই অবস্থানকে মারাত্মকভাবে বদলে দেয় এবং পুনর্গঠন কার্যক্রমে বিষয়টি বিবেচনা করার প্রয়ােজন পড়ে। ধ্বংসলীলার বিবরণের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও ইউএসএআইডি ছিল একমাত্র নির্ভরযােগ্য সূত্র। বিশ্ব ব্যাংকের জুন মাসের মিশন একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। ইউএসএইড নানা বিষয়ে অনবরত নানা প্রতিবেদন প্রস্তুত করতেই থাকে।
৭৫
পাকিস্তানের সরকারি কার্যক্রমেও ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্গঠনের এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের কৃষি ও পানিবিষয়ক গবেষণার জন্য অনেক কাজ প্রায় দুই বছর ধরে চলছিল। পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নের কাজে এসব বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাকে সমন্বিত করার দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ডর্ফম্যান। তাঁরই দপ্তরে, জনসংখ্যা সমীক্ষা কেন্দ্রে, আলমগীর ও অন্য বাঙালিরা এই কাজ করেন।
বিশ্ব ব্যাংক আর ইউএসএইড থেকে তথ্য ও প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়। বিশ্ব ব্যাংকের রবার্ট সেডােভের বিশেষ প্রকল্প বিভাগের লােকজন এ কাজে সাহায্য করেন। এ কাজ পরিকল্পনা পর্যায়ে ছিল কয়েক মাস, তবে কার্যক্রম প্রণয়নের প্রকৃত কাজ বােধ হয় সম্পন্ন হয় নভেম্বর ও ডিসেম্বরে। ১৭ ডিসেম্বর যুদ্ধ বিজয়ের পর আমি হার্ভার্ডে যাই আলমগীরের আহ্বানে। সেদিন রাতে কার্যক্রম চূড়ান্ত করে। আমরা কয়েকজন (বােধ হয় মতিলাল, ভূঁইয়া, আলমগীর ও আমি) নিউ হেভেনের পথে রওনা হই। ফজরের আগে। সেখানে ড. নূরুল ইসলামের কাছে কার্যক্রমের কয়েকটি খসড়া দিয়ে আমাদের পুনর্গঠন পরিকল্পনা উদ্যোগের সমাপ্তি হয়। ড. ইসলামকে আমরা ১৮ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের পথে বিদায় জানাই। এই কার্যক্রম ছিল একটি জরুরি কার্যক্রম আর এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক পুনর্বাসন এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের প্রয়ােজন সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার হিসাব করা হয়। ড. ইসলাম ডিসেম্বরে ঢাকায় যান অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য, ফিরে গিয়ে তিনি বিশ্ব ব্যাংকে একজন পরিচালক (Director Policy Study) হিসেবে যােগ দেবেন। তবে বাস্তবে তিনি ঢাকায় থেকে যান এবং পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে তার ডেপুটি চেয়ারম্যান হন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি যখন এই পুনর্গঠন কার্যক্রমের খবর নিলাম, তখন শুনলাম যে বাংলাদেশের প্রয়ােজন পাঁচসালা পরিকল্পনার, সেখানে পুনর্গঠন কার্যক্রমের স্থান হলাে আবর্জনার স্তুপে। বিভিন্ন অবস্থানে থাকলে অগ্রাধিকারের বিচার এভাবে ভিন্ন মাত্রায় হয়ে থাকে। নমনীয়তা ও খাপ খাইয়ে নেওয়া নিশ্চয়ই মহৎ, তবে কখন তা সুবিধাবাদিতার চরিত্র গ্রহণ করে—সে বিষয়ে সজাগ থাকা বাঞ্ছনীয়।
এপ্রিলের ১৬ তারিখ ওয়াশিংটনে মার্কিন পদার্থবিদ্যা সমিতির কোনাে সভা ছিল। এই উপলক্ষে দুজন বাঙালি বন্ধু ওয়াশিংটনে আসেন। ফজলে বারী মালিক তখন ব্লুমিংটনে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ এবং মাহবুব আলম বােস্টনে সম্ভবত রেথিয়ন করপােরেশনে গবেষণা বিভাগে কাজ করেন। তাঁরা দুজনই আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু । ফজলে বারী আমার সহপাঠী এবং যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু দুই বছর এমএসসি পড়াশােনা করেন, তবু খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। তিনি জার্মানিতে গিয়ে পিএইচডি করেন, তারপর।
৭৬
কিছুদিন পাকিস্তান আণবিক কমিশনে চাকরি করে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেন। সেখানে তিনি খুব নামকরা অধ্যাপক হন। সেই সময় কার্বনডেলে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। আমেরিকায় আমার প্রায় দেড় বছরে তাঁর সঙ্গে বিশেষ যােগাযােগ হয়নি এবং ব্লুমিংটনে যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। মাহবুব আলম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমসাময়িক, অনেক দিন ধরে বােস্টনে আছেন। পড়াশােনা শেষ করে ওখানেই তিনি থেকে যান। ১৯৬৩ সালে আমরা যখন হার্ভার্ডে, তখন। তার সঙ্গে আবার যােগাযােগ হয়। সে সময় তিনি অতি উত্তম পাচক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন এবং বােস্টনের সীমিত বাঙালি মহলে তিনি সবার ‘মুশকিল আসান। তার পুরােনাে একটি প্লিমাউথ গাড়ি দিয়ে তিনি সবাইকে লিফট দেন, বিপদে-আপদে দেখাশােনা করেন, ঘরবাড়ি খুঁজে পেতে সাহায্য করেন। সবাই তাকে বড় ভাই’ ডাকে, এমনকি তার বয়ােজ্যেষ্ঠরাও তাকে এই নামে ডাকেন। তার সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ হয়েছে, এর বেশি দেখাসাক্ষাৎ আর হয়নি। তবে ২৯ তারিখ র্যালিতে সম্ভবত তিনি এসেছিলেন।
ড. আলম পরবর্তী সময়ে আর্থার ডি লিটল কোম্পানিতে যােগ দেন এবং হঠাৎ অকালে দেহত্যাগ করেন। তারা দুজন ওয়াশিংটনে কনফারেন্স করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য প্রচারকার্যে ব্রতী হন। তারা কংগ্রেসে লবি করতে যান, ওয়াশিংটনের বাঙালিদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেন, ফজলে বারী তাঁর সম্মেলন শেষে কদিন আমার সঙ্গে থাকেন এবং কংগ্রেসে জোর তদবির করেন। কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গালাগারের দপ্তরে তাঁর প্রধান উপদেষ্টা চার্লস উইটারের সঙ্গে ফজলে বারীর বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। সে সময় কংগ্রেসে পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য বন্ধের জন্য কেস মন্ডেইল প্রস্তাব পেশ হয়েছে। কংগ্রেসের লবিতে ঘুরে ফজলে বারীর মনে হলাে যে এই প্রস্তাবে কাজ হবে না। সত্যি সত্যি মার্কিন সাহায্য বন্ধ করতে হলে ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইনের সংশােধনী দরকার । ফজলে বারী ও মাহবুব পরে অনেকবার ওয়াশিংটনে আসেন কংগ্রেসে তদবির করার জন্য। জুন মাসে কংগ্রেসের দুই পরিষদে পাকিস্তানে সব রকম সাহায্য বন্ধের জন্য সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করা হয়। এর পক্ষে লবি একেবারে নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
তাঁরা দুজনই বাঙালিদের সংগঠনে মূল্যবান অবদান রাখেন। মাহবুব মুজিবনগরে যােগাযােগ যন্ত্রপাতি প্রেরণে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন (এই । অধ্যায়েই বিবৃত)। বােস্টনের সক্রিয় বাংলাদেশ সমিতিতেও তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ফজলে বারী মিডওয়েস্ট বাংলাদেশ সমিতি গঠনে উদ্যোগ নেন। ইন্ডিয়ানায় অধ্যয়নরত অনেক বাঙালিকে সংগঠিত করেন এবং তাঁদের ভাতা পাকিস্তান বন্ধ করে দিলে বা তাদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাদের সাহায্য করেন। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফজলে বারী একটি বিশেষ সাহায্য
৭৭
করেন। তাঁর উকিল বন্ধু বার্নার্ড বিয়ারম্যানের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। যে ব্যক্তি বিনা খরচে আমেরিকায় আমার রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। বার্নির বুদ্ধি ও প্রশিক্ষণ পরবর্তীকালে আমাকে আমার এবং সহকর্মীদের আশ্রয় প্রার্থনার উপদেষ্টায় রূপান্তরিত করে।
১ এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট বাংলাদেশে ত্রাণকাজে সহায়তার হাত প্রসারিত করেন। তিনি ২২ এপ্রিল এক চিঠিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে এ কথা স্মরণ করান এবং তাঁকে মানবিক কারণে এদিকে মনােনিবেশ করতে আহ্বান। জানান। জেনারেল ইয়াহিয়া এই আবেদনে কোনাে সাড়া দিলেন না, বরং জানালেন যে আপাতত বাইরের সাহায্যের প্রয়ােজন নেই; অবস্থা বিবেচনা করে পরবর্তী সময়ে কার্যক্রম স্থির করা হবে। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাকিস্তানপ্রীতি তখন চারদিক থেকে আক্রান্ত হতে থাকল এবং সংবাদমাধ্যম পাকিস্তানি বর্বরতার চেহারা উদ্ঘাটন করতে থাকলে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিতে চাপ দিতে থাকে। জেনারেল ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মির্জা মােজাফফর আহমদ যখন মে মাসে ওয়াশিংটনে এলেন, তখন এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও সেক্রেটারি রজার্স তাঁকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে বলেন। আহমদ দেশে প্রত্যাবর্তনের আগে উথান্টের সঙ্গেও দেখা করেন। অবশেষে ২২ মে পাকিস্তান জাতিসংঘকে ত্রাণকাজ হাতে নিতে বলল।
জুন মাসেই জাতিসংঘের মিশন স্থাপিত হলাে এবং ১৬ জুন মহাসচিব সাহায্যের জন্য আবেদন করলেন। পাকিস্তান সাহায্যের জন্য যে ফর্দ তৈরি করে, তাতে তাদের কুমতলব প্রকাশ পায়। এই ফর্দটি দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়, রাষ্ট্রদূত হিলালির স্টাফ আবু সােলায়মান এর একটি কপি আমাকে সরবরাহ করেন। খাদ্য, জাহাজ, ট্রাক ও টেলিযােগাযােগ যন্ত্র—এই ছিল সে ফর্দে। কোনাে ওষুধ, কাপড়, আশ্রয়ের জন্য তাঁবু বা নির্মাণসামগ্রীর যেন প্রয়ােজন নেই। তবে কয়েদির গাড়িও চাওয়া হয়। যেসব জিনিস সামরিক ব্যবহারের উপযুক্ত, শুধু তাই চাওয়া হয়েছে। পাকিস্তান কখনাে চায়নি যে বাঙালিদের দুর্দশা লাঘব হােক। বস্তুতপক্ষে যুদ্ধের নয় মাসে ত্রাণকার্য কখনাে জোরেশােরে চলেনি। ত্রাণদ্রব্য সরবরাহ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল জাতিসংঘের । তার জন্য জাতিসংঘের তরফ থেকে মনিটরদের পাঠানাের ব্যবস্থা হয়, কিন্তু এ বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর হয় মাত্র ১৬ নভেম্বর আর তা-ও মার্কিন চাপে। মার্কিন সাহায্যে পূর্তকর্ম হাতে নেওয়া হয় কিন্তু দেখা যায় যে পূর্তকর্মের নামে সামরিক বাংকার অথবা যুদ্ধবহরের জন্য রাস্তা মজবুত করা হচ্ছে। পরিশেষে ইউএসএইড এই সাহায্যও বন্ধ করে দেয়। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এ ধরনের বর্বরদের সঙ্গে আমরা ২৩ বছর ঘর করেছি।
৭৮
সম্ভবত এপ্রিল মাসেই বােস্টন থেকে টেলিফোন করল রেজাউল হাসান ফিরােজ। প্রথমে পরিচয়পর্ব সেরে বলল যে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য তার একটি প্রস্তাব বিবেচনা করতে হবে। তবে বিষয়টি খুবই গােপনীয়। মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ লেগে গেছে, তার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি ছিল বলে মনে হয় না। যুদ্ধে টেলিযােগাযােগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মনে হয় মুক্তিবাহিনীর উপযুক্ত সরঞ্জাম নেই। এ ব্যাপারে সে সাহায্য করতে পারবে। সে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনােলজির ছাত্র (তখন বােধ হয় গবেষক ও টিউটর) এবং ইলেকট্রনিকস তার বিচরণভূমি। সে সহজেই মালপত্র জোগাড় করতে পারবে। এগুলাে মুজিবনগরে পাঠানাের ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। দু-এক দিনের মধ্যে ওয়াশিংটনে এসে এ বিষয়ে সে বিশদ আলােচনা করবে এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য নির্ঘণ্ট বেঁধে দেবে। এ কাজে দেরি করা চলবে না।
ফিরােজ বর্তমানে দেশে সম্ভবত ইলেকট্রনিকস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তবে লক্ষ্মী তার প্রতি সুপ্রসন্ন হয়নি বলেই মনে হয়। একসময়ের ঢাকার বিখ্যাত কোর্ট ইন্সপেক্টর কাজী জহুরুল হকের পুত্র ফিরােজ। কুমিল্লায় ১৯৫৭ সালে আমি যখন শিক্ষানবিশ হাকিম ছিলাম, তখন হক সাহেব সেখানে পুলিশ দপ্তরে কাজ করতেন। তবে তাঁর সুখ্যাতি হয় ঢাকায়, যেখানে তিনি এর আগে ও পরে অনেক দিন নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৬৩ সালে আমরা যখন হার্ভার্ডে, তখন তার এক ছেলে জাহেদ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তুকলায় পড়াশােনা করতে যায়। জাহেদ আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল এবং হার্ভার্ড থেকে আমরা ফিরলে পুনরায় জহুরুল হকের সঙ্গে যােগাযােগ হয় (জাহেদ বর্তমানে কাজী ফার্মের মালিক এবং বাংলাদেশ পােলট্রিশিল্পের একজন দিকপাল)। ফিরােজের সঙ্গে পরিচয়ও তখনই। ফিরােজ যে আমেরিকায় গেছে, তা জানতাম না। কথাবার্তায় মনে হলাে, ফিরােজ কী করতে চায় এবং কী করতে পারবে, তা খুব ভালােভাবেই জানে এবং তার পরিকল্পনায় ফাঁকিজুকি নেই।
ওয়াশিংটনে ফিরােজ বােধ হয় মে মাসের শুরুতে এল তার পরিকল্পনা নিয়ে আলােচনা করতে। ইতিমধ্যে হারুন রশীদ মুজিবনগর থেকে ফিরে এসেছেন। তার কাছে শুনেছি যে যুদ্ধক্ষেত্রে সমন্বয়ের বড় অভাব। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রসম্ভার বা অন্যান্য রসদ নিতান্তই অপর্যাপ্ত। তাদের টেলিযােগাযােগের আশু প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। বরং এর জন্য তাদের চাহিদা খুবই জরুরি। ফিরােজের প্রথম কথা হলাে, বিষয়টি অত্যন্ত গােপনীয় এবং বাঙালি সমাজের কাছেও তা গােপন রাখতে হবে। বিশেষ করে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনাে আলাপ চলবে না। বােস্টনে তার সহযােগী খুব নির্দিষ্ট, শুধু তৈয়ব মাহতাব আর ড. মাহবুব আলম। তৈয়ব মাহতাব বহুদিন ধরে বােস্টনের অধিবাসী। ১৯৫৮
৭৯
সালে তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যােগ দেন। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর পরই চাকরি ছেড়ে দেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় লাহােরে, যেখানে তিনি সম্ভবত ফোরমান ক্রিশ্চিয়ান কলেজে একজন তুখােড় ছাত্র ছিলেন। পরে ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে পদায়িত থাকাকালে তার সঙ্গে আমার যােগাযােগ হয়। সেখানে কাজ নিয়েও তার মনে খেদ ছিল যে তাতে কোনাে চ্যালেঞ্জ নেই।
তিনি পরবর্তীকালে ক্যালিফোর্নিয়ায় সানডিয়াগােতে ছােটখাটো ব্যবসা করেন। মাহবুবের কথা আগে বলেছি। ফিরােজ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করবে তার শিক্ষক অধ্যাপক রবার্ট রাইনের সৌজন্যে। ড. রাইন পেন্টাগনের জন্য মাঝেমধ্যে কাজ করেন। তাঁদের উদ্বৃত্ত মালের গুদাম থেকে পানির দরে তিনি প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি জোগাড় করবেন। সেগুলােকে দুরস্ত করে বাক্সবন্দী করে ফিরােজ আমার হাতে সঁপে দেবে। ওয়াশিংটনে এসব যন্ত্রপাতি আমাকে গ্রহণ করতে হবে এবং এগুলােকে কূটনৈতিক চ্যানেলে পার করতে হবে। সাধারণত এসব মালপত্র রপ্তানি করতে সরকারি নিকাশপত্র লাগে। কিন্তু এগুলােকে সাইক্লোন-সংকেত যন্ত্রপাতি হিসেবে বিনা নিকাশপত্রে মুজিবনগরে পাঠাতে হবে। সে ব্যবস্থা সম্ভব শুধু ভারতীয় সরবরাহ মিশনের সহায়তায় এবং আমাকে সে জন্য সব ব্যবস্থা করতে হবে। ফিরােজের তৃতীয় প্রস্তাব ছিল যে এগুলাের জন্য কিছু পয়সা লাগবে, যা সে চাদা হিসেবে মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠিত বাঙালির কাছ থেকে আদায় করবে। তার জন্য সে একটি ফর্দও বানিয়েছে। আমাকে এ ব্যাপারে তিনটি কাজ করতে হবে। সে শিকাগাের বিখ্যাত বাস্তুকলাবিদ ফজলুর রহমান খানের সঙ্গে যােগাযােগ করবে। তবে আমাকে এ মর্মে তাঁকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে এতে কোনাে জালিয়াতি নেই।
ফজলুর রহমান খান ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আবদুর রহমান খানের পুত্র এবং স্কিডমাের, ওয়িংস ও মেরিল কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার ছিলেন। উঁচু দালান নির্মাণের কৌশল আবিষ্কার করে তিনি বিশ্ববিখ্যাত হন এবং ছয় বছর আমেরিকায় বছরের সেরা বাস্তুকলাবিদ হিসেবে স্বীকৃতি পান। অতি অল্প বয়সে ১৯৮২ সালে এই প্রতিভাবান প্রকৌশলী ইহধাম ত্যাগ করেন। ফজলুর রহমান খান শুধু ফিরােজের উদ্যোগেই সাহায্য করেননি, তিনি ১৯৭১ সালে বাঙালি ও আমেরিকানদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করতে মূল্যবান অবদান রাখেন। জুন মাসে তিনি আমেরিকায় বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগ স্থাপন করেন এবং যুদ্ধবিজয়ের পর বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। নিউ মেক্সিকো না অ্যারিজোনায় আরেকজন বাঙালি ইরতেজা হােসেনের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয় আমার দ্বিতীয় কাজ। ইরতেজা হােসেন আমাদের উদ্যোগের ব্যাপারে কোনাে উৎসাহ প্রকাশ করলেন না। আমার তৃতীয় কাজ হয় গােপনীয়তা ভেঙে বাঙালি সমিতিগুলাের দু-একটির কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ।
৮০
লস অ্যাঞ্জেলেসের শামসুদ্দোহা এবং মিড ওয়েস্টের ফজলে বারী মালিকের কাছে চেয়ে আমি এ দুই সমিতি থেকে কিছু সাহায্য আদায় করতে সক্ষম হই। ফিরােজ অবশ্য বােস্টনের ডা. রেজাউর রহমান, মানিটোবা সমিতি, নিউ ইংল্যান্ড সমিতি ও নিউইয়র্ক সমিতি থেকে সাহায্য সংগ্রহ করে। ফিরােজের পরিকল্পনার চতুর্থ ও শেষ বিষয় ছিল মুজিবনগরে এই যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তৈয়ব মাহতাব সারা জুন মাস ডা. লিওনার্ড কাটজের ল্যাবরেটরিতে এগুলাের ব্যবহার শেখেন এবং জুলাইয়ে মুজিবনগরে হাজির হন। সেখানে তিনিই হন প্রশিক্ষক। পরবর্তী সময়ে আগস্টে ওহাইওর অধ্যাপক আমিনুল ইসলামও ফিরােজের চাপে নিজে কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে মুজিবনগরে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দেন। অধ্যাপক ইসলাম ঢাকায় আমার সমসাময়িক ছাত্র ছিলেন এবং বহুদিন ধরে আমেরিকায় ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি কংগ্রেসে তদবির করার জন্য। কয়েকবার ওয়াশিংটনে আসেন। ওহাইওর ডেটনে তিনি বাংলাদেশ লিগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার সভাপতি ছিলেন।
ফিরােজ ১০০টি ওয়াকিটকি, ৮টি শর্টওয়েভ রেডিও ট্রান্সমিটার ও রিসিভার এবং প্রয়ােজনীয় ব্যাটারি জোগাড় করে। আমি হিসাব করে দেখেছি যে এগুলাের দাম ছিল লাখখানেক ডলার, তবে ফিরােজ এর জন্য মাত্র ২০ হাজার ডলারের মতাে ব্যয় করে। এগুলােকে ২৫টি বাক্সে বন্দী করে ফিরােজ বিমানে আমার । কাছে ওয়াশিংটনে পাঠায় তিন দিনে (১১, ১৩ ও ১৮ জুন)। আমরা তিনজন—হারুন, রাজ্জাক খান (তার সম্বন্ধে পরে বলেছি) এবং আমি একটি। মার্সিডিস, একটি বুইক ও একটি ভক্সওয়াগনে করে এগুলােকে ভারতীয় সরবরাহ মিশনে রাতের অন্ধকারে পৌছে দিই। এই মিশনের ভারপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ—সাপ্লাই মিনিস্টার সুশীতল ব্যানার্জির সৌজন্যে এই চার টন যন্ত্রপাতি মুজিবনগরে পৌছায়। জুলাইয়ের ২ তারিখেই বােধ হয় তৈয়ব মাহতাব। মুজিবনগরে প্রশিক্ষণ দিতে হাজির হন। এ কাজ করে আমাদের খুব তৃপ্তি হয়। এতে আমার মনে হলাে যেন আমরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম। অনেক ভেবেচিন্তেও কিন্তু আর কোনাে যন্ত্রপাতি আমরা মুজিবনগরে পাঠাতে সক্ষম হইনি । নিউইয়র্ক থেকে একসময় একটি শক্তিশালী রেডিও ট্রান্সমিটার পাঠায়। নানা জায়গা থেকে কাপড়, তাঁবু ইত্যাদি পাঠানাে হয়। জেনারেল ওসমানী একবার অনেক সমরাস্ত্রের একটি ফর্দ পাঠান কিন্তু সেগুলাে কখনাে সংগ্রহ করা যায়নি, পাঠানাে তাে দূরের কথা। অনেক অস্ত্র ব্যবসায়ী অনেক প্রস্তাব নিয়ে এসেছে কিন্তু কিছুই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
৮১
পঞ্চম অধ্যায়
মনােযাতনার এক মাস : মে ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম মাস কী রকম এক ব্যস্ততা, উত্তেজনা ও ক্ষোভের মধ্যে পেরিয়ে গেল। অনিশ্চয়তা থাকলেও তা নিয়ে হাহুতাশ করার সুযােগ ছিল না। আশঙ্কার প্রথম ইঙ্গিত জ্যাকের (লন্ডনবাসী জাকারিয়া খান চৌধুরী) সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে মিলল। একটি সংগঠিত ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে বর্শা-বল্লমলাঠিসোটা নিয়ে প্রতিহত করা যে কত দুরূহ, তা প্রমাণ হতে মাসখানেক অতিবাহিত হয়ে গেল। এপ্রিল মাসের শেষে আস্তে আস্তে সারা বাংলাদেশের শহরাঞ্চল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে চলে গেল। রংপুর আর নােয়াখালীতে প্রায় শেষ হলাে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম রাউন্ড। শুধু কয়েকটি সীমান্ত এলাকা ছাড়া সারা বাংলাদেশ প্রায় পাকিস্তানিদের কর্তৃত্বে চলে গেল । রূঢ় বাস্তব আমাদের মাসখানেকের একধরনের ‘ট্রান্স’-এ যবনিকা টানল। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমেও বাংলাদেশের খবর বেশ কমে এল। মার্চ থেকেই অন্তত মার্কিন মহাদেশে সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর যত খবর বেরােত, সংগ্রহের কাজ আমি শুরু করি।
এখন যখন এই সংগ্রহের আলমারি খুলি, তখন অতি সহজে যা ধরা পড়ে, তা হলাে যে মে মাসের সংগ্রহ সবচেয়ে ক্ষীণকায়। ২১ এপ্রিল ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় সাংবাদিক পিটার কান মেহেরপুর থেকে খবর পাঠালেন, বহু বছর ধরে যদিও এ রকম একটি যুদ্ধের আশঙ্কা তারা বিবেচনা করেছেন, বাঙালিরা আশ্চর্যজনকভাবে এ যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলেন। তাঁর প্রতিবেদনের শিরােনাম ছিল একটি টিমটিমে আন্দোলন’ (A Flickering Cause)। তিনি প্রশ্ন করেন যে বাংলাদেশে বােধ হয় অত্যন্ত বেশিসংখ্যক প্যাট্রিক হেনরি রয়েছেন। প্যাট্রিক হেনরি ছিলেন মার্কিন স্বাধীনতা আন্দোলনে ভার্জিনিয়ার সুপ্রসিদ্ধ আইনবিদ ও জননেতা। প্যাট্রিক হেনরি ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্ট্যাম্প
৮২
আইনের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন করে নাম করেন এবং ১৭৭৬ সালে মার্কিন স্বাধীনতা ঘােষণার একজন প্রধান হােতা ছিলেন। পিটার কান আরও লেখেন যে বাকপটু বাঙালি রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা অথবা পেশাজীবী—সবাই আমরণ যুদ্ধের কথা বলেন, কিন্তু বস্তুতপক্ষে তারা তা করেন না। তাই তিনি এক হিসেবে সিদ্ধান্তই দিয়ে দেন যে বাঙালিরা একটি অতি দুর্বল স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করে কিন্তু ইতিহাসে এটি বােধ হয় সবচেয়ে স্বল্প সময়ের বৈপ্লবিক যুদ্ধ। আমাদের ক্ষোভ শুধু বাড়তেই থাকে। এত বড় হত্যাযজ্ঞের পর কী করে আমরা ব্যর্থ হতে পারি!
প্রবাসী পাকিস্তানিদের ব্যবহারেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এত দিন তারা তাদের সামরিক বাহিনীর বর্বরতা নিয়ে কাঁচুমাচু করত, আমাদের সরাসরি আক্রমণ করতে ইতস্তত করত। এখন সে ভাব চলে গেল—অনেক হয়েছে, এখন ব্যস! পাকিস্তানি বন্ধুমহল এখন আর সহানুভূতি প্রদর্শনে এগিয়ে আসে না, বরং বিশ্বাসঘাতক, জাতির শত্রু ও দেশদ্রোহীদের চিহ্নিত করতে ব্যস্ত থাকে। পাকিস্তানে সামরিক জান্তা এতই নিশ্চিত হয় যে তারা ৬ মে বিদেশি। সাংবাদিকদের সরেজমিনে বাংলাদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আহ্বান করে বসল । একই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যােগাযােগও পুনঃস্থাপন করা। হলাে। আমার আব্বা ২৫ মার্চে আমাকে একখানি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সেটা এসে। পৌছাল ১৭ মে। তারপর দেশ-বিদেশ থেকে পাঠানাে চিঠি আসতে শুরু করল। পাকিস্তানি বর্বরতার লােমহর্ষক সব কাহিনি বিবৃত করে। যুদ্ধকালে মানুষের দুর্গতি ও দুর্দশার হৃদয়বিদারক কাহিনি পৌছাতে লাগল। আমি এ রকম দুটো ব্যক্তিগত চিঠি পাই। আমার বােন ডা. শাহলা খাতুন ছুটি নিয়ে গিয়েছিল সিলেটে তার দুটি সদ্য পিতৃহারা বাচ্চাকে নিয়ে। তারা কেমন করে বাড়িভরা মানুষজনসহ কামান আর বােমাবর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেল; কী কষ্ট করে শহর থেকে পালিয়ে গ্রামে আশ্রয় নিল; আমার বয়স্ক মা-বাবা কেমন করে হেঁটে পালাতে শুরু করলেন ইত্যাদি। মাসখানেক সবাই মিলে গ্রামে থাকলেন। তারপর বাড়ি এসে। পেলেন অর্ধবিধ্বস্ত ও লুণ্ঠিত সংসার। তাঁর সন্তানগুলাে কী কষ্টে বেঁচে আছে, আমার আব্বা কীভাবে শারীরিক ও মানসিক যাতনায় আছেন, এসব কাহিনির সঙ্গে প্রকাশ পেল আর্থিক সংকটের কথাও।
বাঙালিরা আমাদের বাড়িতে ক্যাম্প করে প্রথমে যুদ্ধ করেছে। তারপর পাকিস্তান বিমানবাহিনী বাড়ির চাল উড়িয়ে দিয়েছে, দেয়াল বিধ্বস্ত করেছে। সবশেষে মানুষ খানিকটা লুট করেছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ, রােজগারের রাস্তা নেই অথচ খরচের বহর বেড়ে গেছে। যুদ্ধের এই স্বাভাবিক প্রতিফল আমি সরাসরি টের পাইনি, শুধু চিঠিতেই উপলব্ধি করলাম । পরবর্তীকালে এ রকম আরেক চিঠি লিখেছিলেন বিচারপতি মাহমুদুর রহমান
৮৩
চৌধুরী তাঁর ভাই নুরুল আমিন চৌধুরীর কাছে। সেই চিঠি অন্য একজন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত থেকে ডাকে দেন বলে খানিকটা আগেই এসে পৌঁছায়। নুরুল আমিন চৌধুরী আমাদের কাছে তাঁর ডাকনাম হুমায়ুন নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন নিউইয়র্কের অধিবাসী। মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তাদের পিতা আবদুল গফুর সাহেব ছিলেন আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ গুরুজন। তিনি আমার আব্বার ছেলেবেলায় তার শিক্ষক ছিলেন এবং প্রায় আট বছর তার অভিভাবক ছিলেন। পুরাে পরিবারই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
হুমায়ুন টেলিফোনে আমাকে চিঠির কাহিনি শােনালেন এবং পরে চিঠির কপি পাঠিয়ে দিলেন। তাতেও পালানাের কাহিনি, আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানাে, বয়স্ক লােকদের কষ্টের কথা, বাচ্চাদের দুর্দশা আর অবুঝ আকুতি এবং সবশেষে অর্থনৈতিক দুরবস্থার বিবরণ । এ ধরনের খবরে অসাধারণ কিছু ছিল না, প্রতিটি পরিবারেই তখন এ রকম দুর্দশা দেখা দিয়েছে। দুই মাস পর পাকিস্তানের প্রচারবিদ হামিদুল হক চৌধুরীর একটি মন্তব্য এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, এমন কোনাে পরিবার নেই, যারা দুর্দশায় নিপতিত হয়নি। খুব কম পরিবারই সামরিক অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে এবং নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু প্রায় সব পরিবারেই হয়েছে। অবশ্য তবু তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তির অবতারণা করেন এবং বাংলাদেশের বিরােধিতায় অটুট থাকেন (হামিদুল হক চৌধুরীর বিষয়ে পরে বিস্তৃত আলােচনা করব)।
এপ্রিল মাসে দুটো দুঃসংবাদ পেলাম। একটি ভুল প্রমাণিত হলাে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম প্রচার করল যে আমার আব্বা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। খবরে সঠিকভাবেই তার পেশা ও পরিচিতি দিয়েছে। উকিল এবং একসময় মুসলিম লীগের নেতা। সিলেট পাকিস্তানে যােগ দেয় গণভােটের মাধ্যমে, শুধু সংসদ সদস্যদের সিদ্ধান্তে নয় । এই গণভােট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই। এই গণভােটের সময় মুসলিম লীগ নেতা হিসেবে আমার আব্বার ছিল বিরাট অবদান। মুসলিম লীগ গণভােট বাের্ডের তিনি ছিলেন সচিব এবং সভাপতি ছিলেন আবদুল মতিন চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে তিনি সিলেটের তরফ থেকে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত সীমান্ত কমিশনের শুনানিতে হাজিরা দেন। বিভাগােত্তরকালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় ১৯৫২ সালে তিনি মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে অন্য কোনাে রাজনৈতিক দলে আর যােগ দেননি। আমি খবরটি যথাসময়ে পাইনি বা দেখিনি। একদিন হঠাৎ অন্য একজনের মুখে শুনতে পাই। একই সময়ে মাহমুদ আলীর (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের ফেডারেল মন্ত্রী) বরাতে
৮৪
রাষ্ট্রদূত হিলালির কাছে খবর আসে যে সংবাদটি সঠিক নয় এবং আমার ভাই সুজন (আবু সালেহ আবদুল মুইজ) সিলেটে গিয়ে ঠিক খবর নিয়ে এসেছে যে। আমার আব্বা জীবিত আছেন।
পরে জানা গেল, হাফিজ নামের অন্য একজন উকিল সত্যি সত্যিই নিহত হন। পরে আমার মা-বাবার এপ্রিল মাসের অডিসির কাহিনিও জানলাম। আরও জানলাম যে তাঁরা যে গ্রামে (ফুলবাড়ীতে) আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে আমার আরেক ভাই আবুল কালাম আবদুল মােমেনকে (পরবর্তীকালে বােস্টনে শিক্ষক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০০৯ সালের সরকারের আমলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের আট বছরব্যাপী স্থায়ী প্রতিনিধি) পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে এবং শেষ মুহূর্তে কোনাে সদয় কর্মকর্তার হুকুমে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়। মােমেনকে অবশ্য সরকারি চাকরির ব্যাপারে কালাে ফর্দ বা নিষিদ্ধের লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আরও জানলাম যে আমার এক মামা সৈয়দ শাহ জামালকে (তখন তিনি উচ্চশিক্ষারত এবং জামায়াতের রাজনীতি করেন) সেনাবাহিনী ২৫ তারিখেই ধরে নিয়ে যায়। আর কোনাে দিন ফেরত দেয়নি। প্রথম আঘাতে জামায়াতের লােকজনও এই বর্বর বাহিনীর হাতে রেহাই পায়নি।
এপ্রিল মাসে আরেকটি দুঃসংবাদ এল ইসলামাবাদ থেকে। বন্ধুবর ফারুক আহমদ চৌধুরী (পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্রসচিব ও লেখক) খবর পাঠালেন। যে দুর্ঘটনা তাঁদের পরিবারকে দ্বিতীয়বারের মতাে আঘাত করেছে। তাঁর ছােট বােন নাসিমের স্বামী কর্নেল সৈয়দ আবদুল হাই যশাের সেনাছাউনিতে নিহত হয়েছেন (নাসিম এখন লন্ডনে বসবাস করে)। বার্তাটি সংক্ষিপ্ত, তবে বুঝতে অসুবিধা হলাে না যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শিকার। খবরটি ফারুকের অন্য ভগ্নিপতি ফখরুদ্দীন আহমদকে পৌছে দিতে হবে। ফখরুদ্দীন তখন ম্যাসাচুসেটসের উইলিয়ামস কলেজে উচ্চশিক্ষারত। ড. ফখরুদ্দীন পরবর্তীকালে ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি করেন। আগে সিভিল সার্ভিসে ছিলেন এবং বহিঃসম্পদ বিভাগে (বর্তমানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) আমার একজন সুযােগ্য সহযােগী ছিলেন। ড. ফখরুদ্দীন ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন এবং তাঁরই দৃঢ়তার ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ফখরুদ্দীনের কাছে তিন-চার মাসের ব্যবধানে আমাকে দ্বিতীয়বার দুঃসংবাদ দিতে হলাে। সম্ভবত জানুয়ারির শেষে ফারুকই ইসলামাবাদ থেকে খবর পাঠান যে তাঁর সর্বকনিষ্ঠ বােন নীনা এবং তার স্বামী ফখরুদ্দীনকে জানাতে হবে যে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর পিতা গিয়াসুদ্দিন আহমদ (ঢাকার জনপ্রিয় কমিশনার হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ এবং রাজস্ব বাের্ডের সদস্য হিসেবে অবসর নেন) ইন্তেকাল
৮৫
করেছেন; তাঁর ভাই ইনাম আহমদ চৌধুরী (তখন যশােরে জেলা প্রশাসক, পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ও একসময় ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট) আহত হয়েছেন। ইনাম আহমদ চৌধুরী বর্তমানে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ফারুক আরও বলেন যে তাঁর বােন, যে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে বাপের খুব আহ্লাদী ছিল, তাকে ঢাকায় পাঠানাের ব্যবস্থা করতে হবে। নীনারা ওয়াশিংটনে এল, যে কদিন আমাদের সঙ্গে ছিল, শুধুই কেঁদে সারা হলাে আর তার দুরন্ত ছেলে নাভিদ তাতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল । নীনা নাভিদকে নিয়ে সেই যে ঢাকায় গিয়েছিল, ফিরল বােধ হয় মে মাসে। সে যখন ফিরল, তখন সে খুব গম্ভীর এবং প্রায় নির্বাক এবং তার দুরন্ত ছেলেটিও কেমন শান্ত হয়ে গেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা এবং বাংলাদেশ তাদের মধ্যে নিয়ে। আসে দারুণ পরিবর্তন। নাভিদ কালে এক চমৎকার যুবক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। নাভিদের মৃত্যু ফখরুদ্দীন দম্পতির সুখী জীবনে এক গভীর কালাে মেঘের ছায়া ফেলে এবং তাঁদের হাসি মিলিয়ে দেয়। বিধাতার ইচ্ছা অনুধাবন করা বড় কঠিন।
ভারত-পাকিস্তান প্রতিবেশী দেশ। হাজার হাজার বছর ধরে একই রাজত্বের অংশ। তাদের ইতিহাস ও উত্তরাধিকার একই। দিল্লির লালকেল্লা আর লাহোের দুর্গ একই ছাঁচে গড়া। উপমহাদেশীয় রান্না প্রায় একই রকমের, অবশ্য বৈচিত্র্য অনেক। মহেঞ্জোদারাে-তক্ষশীলা-নালন্দা-হরপ্পার ঐতিহ্য সবাই দাবি করে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের শেষ অধ্যায়ে দেশ শুধু ভাগই হলাে না, বরং দেশের দুই প্রধান ধর্মাবলম্বী হিন্দু আর মুসলমান হয়ে গেল পরম শত্রু। ধারণা ছিল যে ক্ষমতার ভাগাভাগি এই মনােমালিন্যের অবসান ঘটাবে। কিন্তু তা আর হলাে না। হায়দরাবাদ, জুনাগড় আর কাশ্মীর নিয়ে শুরুতেই লাগল বিরােধ আর তার সুরাহা বাস্তবে এখনাে হয়নি। ধর্মোন্মাদনা বড় জটিল এবং সব সময়ই ধর্মের চেয়ে অন্য স্বার্থ এই জটিলতা বাড়ায়। খ্রিষ্টানমুসলমানে ক্রুসেড চলে প্রায় হাজার বছর । ক্যাথলিক আর প্রটেস্টান্টদের ঝগড়া ৬০০ বছর ধরে, এই সেদিন পর্যন্ত চলেছে আয়ারল্যান্ডে। তবে উপমহাদেশে ধর্মোন্মাদনার সঙ্গে পরাশক্তির শত্রুতার যৌথ ফসল হচ্ছে একধরনের চিরস্থায়ী মনােমালিন্য। যদি পরাশক্তির প্রতিযােগিতা ভারত ও পাকিস্তানকে দুই শিবিরে না ঠেলত, তাদের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযােগিতা না শুরু করত, তবে নিশ্চয় তারা সহাবস্থানের রাস্তা খুঁজে পেত। এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে শীতল যুদ্ধের মানসিকতা বানচাল করে দিল । যার ফলে ভারত
৮৬
পাকিস্তানের সম্পর্ক এমন তিক্ত হলাে যে বিদেশে কূটনৈতিক মহলেও এ দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে মেলামেশা ছিল ন্যূনতম ।
সরকারি কার্যোপলক্ষে ঢাকায় ষাটের দশকের শুরুতে কতিপয় ভারতীয় কূটনীতিবিদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে থাকাকালীন কালেভদ্রে যদি কোনাে ভারতীয় কূটনীতিবিদের সঙ্গে দেখা হয়ে থাকে, তা স্মরণ নেই। ওয়াশিংটনেও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত রইল। আমরা অন্যান্য দেশের কূটনীতিবিদের সঙ্গে ওঠাবসা করি কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে নয়। বছরের পর বছর এই অভ্যাস বজায় রাখলে স্বভাবতই একে অন্যকে চিরশত্রু ভাবতে থাকে এবং শত্রুতার কারণ আর খুঁজতে বা বিশ্লেষণ করতে চায় না।
ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসে তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত ঝা। তিনি ১৯৩৬ সালের আইসিএস কর্মকর্তা ছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সচিব ছিলেন। অত্যন্ত দক্ষ কর্মকর্তা। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরও ছিলেন। শেষ বয়সে তিনি কাশ্মীরের প্রদেশপাল হন, ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টাও। তিনি উত্তর ভারতের লােক, তবে সুন্দর বাংলা বলতেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন জোড়াসাঁকোর। ঠাকুর পরিবারের একজন। ব্রিটিশ কমনওয়েলথ কূটনীতিবিদদের স্ত্রীদের একটি সক্রিয় সমিতি ছিল ওয়াশিংটনে, সেখানে আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয় শ্রীমতী ঝার। সেই সুযােগে কূটনৈতিক পার্টিতে কালেভদ্রে রাষ্ট্রদূত ঝার সঙ্গে কথা হয়েছে। মিশনের দ্বিতীয় ব্যক্তি মহারাজ কৃষ্ণন রাসগােত্রা। পরবর্তী সময়ে লন্ডনে। হাইকমিশনার এবং পররাষ্ট্রসচিব। তাঁর সঙ্গে দেড় বছরে কোনাে দিন দেখাও হয়নি। সরবরাহ মিশনের কর্তা সুশীতল ব্যানার্জি, ১৯৪৮ সালের আইএএস, অত্যন্ত ঝানু কর্মকর্তা। আমরা জানতাম যে খাদ্যশস্য, সার ইত্যাদি সংগ্রহে তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কাশ্মীরে মুখ্য সচিব এবং সবশেষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব হন। কম বয়সে তিনি পরলােকগমন করেন। তিনি উত্তর প্রদেশের বাঙালি এবং তাঁর স্ত্রী রানু ব্যানার্জি ছিলেন অনবদ্য মেজবান ও রাধুনে (এবং অত্যন্ত সুন্দরী)। তাঁর সঙ্গেও কখনাে দেখা হয়নি।
বিশ্ব ব্যাংকে ভারতের নির্বাহী পরিচালক হয়ে আসেন ড. সমর রঞ্জন সেন । তিনি মুন্সিগঞ্জের মানুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। তার মা শ্ৰীমতী আশালতা সেন কবি ছিলেন এবং পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। গেন্ডারিয়া মহিলা। সমিতিতে তিনি খুবই সক্রিয় ছিলেন এবং তাঁর বাড়ি তিনি ওখানকার একটি মহিলা বিদ্যালয়কে দান করে যান। ড. সেন বিভাগােত্তরকালে ভারতে গিয়ে। ইউনিয়ন সরকারের চাকরি নেন এবং সেচ ও পরিকল্পনাসচিব হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশের তরফ থেকে বিশ্ব ব্যাংকে প্রথম নির্বাহী পরিচালকের।
৮৭
দায়িত্ব পালন করেন (আমি হই তাঁর প্রথম বাংলাদেশি বিকল্প পরিচালক)। ওয়াশিংটনে তার সঙ্গেও যােগাযােগ আমরা সযত্নে পরিহার করতাম।
এপ্রিলের শুরুতে হারুন ও আমি ঠিক করলাম যে এবার বেড়া অতিক্রম করতে হবে, ভারতীয়দের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে হবে। একদিন আমরা রাতে গিয়ে ড. সেনের বাড়িতে হাজির হলাম। তিনি ছিলেন ভারতীয় মিশনের সঙ্গে আমাদের যােগসূত্র । হারুনের কলকাতায় যাওয়া যখন ঠিক হলাে, তিনি তখন ভারতে তাঁর জন্য অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেন এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন যুগ্ম সচিব এ কে রায়ের কাছে একটি চিরকুট লিখে দেন। ভারতীয়দের সঙ্গে যােগাযােগ না থাকার কারণে প্রথম যেদিন ড. সেনের বাড়ি গেলাম, তখন কেমন জানি অস্বস্তি লাগে। কিছুদিন পর তেমনই যখন ভারতীয় সরবরাহ মিশনে গেলাম, তখনাে খুঁতখুঁতে ভাব বজায় ছিল। তবে আগস্টে যখন প্রথম রাষ্ট্রদূত ঝার দপ্তরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন সেই ভাব আর ছিল না। ড. সেন ঢাকায় এনায়েত করিমের শিক্ষক ছিলেন, সেই সূত্রে তিনি আমাদের সবার গুরুজনে পরিণত হন। তিনিই আমাদের সঙ্গে সুশীতল ব্যানার্জির যােগাযােগ করিয়ে দেন। টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি মুজিবনগরে পাঠানাের জন্য মে মাসের শেষে আমরা তার কাছে ধরনা দিই এবং তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমাদের বাধিত করেন।
একটি কাকতালীয় বিষয় ছিল সমর রঞ্জন সেন নামের মানুষের সঙ্গে ১৯৭১ সালে আমাদের যােগাযােগ। ওয়াশিংটনে ড. সেন ছিলেন আমাদের বন্ধু । নিউইয়র্কে সে সময় ভারতীয় স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন সমর রঞ্জন সেন। তিনি ছিলেন মাহমুদ আলীর একধরনের অভিভাবক এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কে এলে তিনি তাঁর খুব খাতিরযত্ন করেন। পরবর্তী সময়ে এই নামের আরেক ব্যক্তি ছিলেন বাংলাদেশে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত এবং তিনি সেখানে সন্ত্রাসের শিকার হয়ে খানিকটা আহত হন, সময়টা ছিল পঁচাত্তরের নভেম্বর।
মে মাসে দুজন আগন্তুক সংবাদমাধ্যমে খানিকটা আলােড়ন সৃষ্টি করেন। পাকিস্তানের সুনাম প্রতিষ্ঠার জন্য আসেন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মির্জা মােজাফফর আহমদ। তিনি ৯ মে আসেন এবং তাঁর ছিল ব্যস্ত সময়সূচি । প্রায় একই সময় আসেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি অধ্যাপক রেহমান সােবহান এবং তিনি রাতারাতি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এম এম আহমদের সঙ্গে আসেন আমার বন্ধু এবং একসময়ের সহকর্মী সারতাজ আজিজ। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মন্ত্রিসভায় একজন সিনিয়র মন্ত্রী। আমরা পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে ১৯৬৪-৬৬ সালে সহকর্মী ছিলাম। একই সময়ে আসেন আরেক পাকিস্তানি বন্ধু
৮৮
তারেক সিদ্দিকী। তারেক পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে সহকর্মী ছিলেন এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানে অনেক দিন চাকরি করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তারেক পাকিস্তানে ফিরে যান ১৯৭১ সালে এবং বাংলাদেশ মুক্ত হলে পাকিস্তানে বন্দী বাঙালি সরকারি কর্মচারীদের নানাভাবে সাহায্য করেন। তিনি সরকারি চাকরি অনেক দিন হলাে ছেড়ে দিয়েছেন, তবে তাঁর সঙ্গে আমার যােগাযােগ সেই উত্তাল ‘৭১-এ খতম হয়ে যায়। এম এম। আহমদ ১০ তারিখে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে দেখা করেন। সেক্রেটারি রজার্স, বিশ্ব ব্যাংকে ম্যাকনামারা এবং কারগিল, মুদ্রা তহবিলে সােয়াইটজার—সবার। কাছে তিনি তদবির করেন। কংগ্রেসে সিনেটর সাইমিংটনের এক চা-চক্রে তিনি মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য দেন। প্রেস ব্রিফিং, দেখাসাক্ষাৎ এসবও অনেক হয়।
তিনি একটি সংবাদ সম্মেলনেরও চিন্তা করেন কিন্তু সেটা আর শেষ পর্যন্ত করা হলাে না। পাকিস্তানের ভাবমূর্তি সুশ্রী করবার তার প্রচেষ্টা যে খুব ফলপ্রসূ হয়েছে, তা মনে হলাে না। তিনি অনেক উপদেশ এবং মৃদু ভর্ৎসনার সম্মুখীন। হন। তাঁকে বলা হয় যে অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য তাদের আরও সচেষ্ট হতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার জন্য তাঁকে বলা হয়। অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের প্রকল্প গ্রহণের জন্য তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থ সাহায্য বা ঋণ মওকুফের বিষয়ে সরেজমিনে তদন্তের জন্য বিশ্ব ব্যাংক পাকিস্তানে মিশন পাঠাতে চায়। এম এম আহমদ নিউইয়র্কে গিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গেও যােগাযােগ করেন। ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি মােটামুটিভাবে জাতিসংঘ ত্রাণ উদ্যোগে সায় দেন এবং বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের যৌথ মিশনকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান। তিনি সম্ভবত সপ্তাহখানেক পরই ফেরত যান। জেনারেল ইয়াহিয়া ২২ মে জাতিসংঘকে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণকাজে নিয়ােজিত হতে আহ্বান জানান এবং ব্যাংক মিশন ৩১ মে ঢাকার পথে ওয়াশিংটন ছাড়ে।
এম এম আহমদের কর্মঠ ও ভালাে কর্মকর্তা হিসেবে সুনাম ছিল। তিনি পাকিস্তানের অর্থসচিব ছিলেন এবং আমি পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে যাওয়ার। প্রাক্কালে তিনি সেখানে ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন (১৯৬৬ সাল)। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি কাদিয়ানি মতবাদে বিশ্বাস করতেন বলে তাঁকে আশির দশকে পাকিস্তান ছাড়তে হয় এবং তখন তিনি ওয়াশিংটনে আশ্রয় নেন। জীবনের বাকি দিনগুলাে তিনি সেখানেই পার করেন। ১০ তারিখ রাতে তিনি আমাকে একান্ত আলােচনায় আহ্বান করেন, রাষ্ট্রদূত হিলালি বােধ হয় তাঁকে এই পরামর্শ দেন। আমিও তার সঙ্গে খােলামেলা আলাপ করতে চেয়েছিলাম। তিনি
৮৯
ঢাকায় সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন, তিনি সব সময়ই বুদ্ধিদীপ্ত, তাঁর কাছে হয়তাে একটি ভালাে বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে, আর ব্যক্তিগতভাবে তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন না । রাষ্ট্রদূতের বাসায় তাঁর সঙ্গে আমার একান্ত বৈঠক হলাে, তাঁর সহযােগীরা এবং রাষ্ট্রদূত আমাদের রেখে অন্যত্র চলে গেলেন।
প্রথমেই এম এম আহমেদ বললেন, ‘অনেকেরই ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি খুব গভীর । তােমার উত্তেজনা ও ক্ষোভ সংগত। তবে অবস্থা এত খারাপ না, যতটা বিশ্ব সংবাদমাধ্যম বলতে শুরু করেছে। আমরা একটি মিশন বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলাম, তাতে তােমারই বন্ধুবান্ধব ছিলেন। তাঁদের প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির কথা আছে, তবে তা শুধরে নেওয়া যাবে। তােমার বিদেশে খারাপ লাগলে তুমি যেকোনাে সময় দেশে ফিরতে পারাে। পূর্ব পাকিস্তানে বা কেন্দ্রীয় সরকারে তােমার পদোন্নতি হয়েই আছে, যেকোনােখানে যােগ দিতে পারাে। আমি তাঁকে সংলাপে ব্যর্থতার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তার জবাব হলাে যে তাঁকে সংলাপে ডাকা হয়েছিল আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক প্রস্তাব পরীক্ষা করার জন্য। তাঁর আপত্তি ছিল দুই মুদ্রাব্যবস্থায়। তিনি মনে করেন যে বৈদেশিক মুদ্রা ও সাহায্যের হিসাব আলাদা করা যায়, তবে তার জন্য যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি সময়ের দরকার। তার প্রস্তাব ছিল, বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে আলােচনা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ভিন্নভাবে না করে একসঙ্গে করা উচিত। ফেডারেল সরকারের কিছু বিষয়ে তিনি অধিকতর ক্ষমতা চান, যেমন প্রতিরক্ষা, শিল্প ও কেন্দ্রীয় কর্মকমিশন সংশ্লিষ্ট কতিপয় বিষয়ে। আর রাজস্ব আদায় প্রদেশ করলেও কেন্দ্রীয় একটি রাজস্ব বাের্ড থাকতে হবে। তিনি এ-ও বললেন যে তাঁর ধারণা ছিল তার মতামত আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছে। তিনি ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ করে বােঝেন যে ভুট্টো অর্থনৈতিক ক্ষমতা বণ্টনে মােটেই আগ্রহী নন এবং তার সমস্ত মনােযােগ নিবদ্ধ ছিল রাজনৈতিক সমঝােতায়। তার এই বক্তব্য রেহমান সােবহানকে জানালে রেহমান মােটামুটি সায় দেন।
এম এম আহমদকে আমি আরও জিজ্ঞাসা করলাম, বাঙালিরা যে মনে করে সংলাপ শুধুই ধোকাবাজি ছিল, সে সম্বন্ধে তিনি কি কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন? তার জবাব ছিল যে তার কাজ শেষ হয়ে গেলে তিনি ঢাকা পরিত্যাগ করেন এবং আলােচনার গতি সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল না, বরং সমঝােতা হয়ে যাচ্ছে বলেই তার তখন মনে হয়। তিনি যে কথাটি খুব জোর দিয়ে বললেন তা হলাে, জেনারেল ইয়াহিয়া বিষয়টির সুরাহা করতে বদ্ধপরিকর। এবং ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তিনি আলােচনা শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে তিনি একটি নামই উল্লেখ করেন আর তা হলাে মােহাম্মদ জহিরুদ্দীন, যার নাম ইতিমধ্যে পাকিস্তানি খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা।
৯০
হয় । আমার শেষ প্রশ্ন ছিল ইয়াহিয়ার সমাধান নিয়ে, তিনি কী দিয়ে বাঙালিদের সন্তুষ্ট করবেন—ছয় দফার তাে বিকল্প নেই। এম এম আহমদের জবাব ছিল যে এক রকমের ছয় দফা তাে গৃহীত হয়েছিল, তবে কনফেডারেশনের ধারণা নিয়ে ছিল আপত্তি । তিনি কিন্তু একটি বিষয়ে অত্যন্ত সত্যবাদী ছিলেন। তিনি বলেন যে। ইয়াহিয়া সম্ভবত একা আর কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না এবং তার জান্তা নমনীয় হবে কি না, সে সম্বন্ধে তিনি ওয়াকিবহাল নন।
এম এম আহমদ এক ফাঁকে খবর দিলেন যে ড. নূরুল ইসলাম আমেরিকায় আছেন। এখানে পৌছে তিনি খবর পাঠিয়েছেন, তাঁর ছুটি আগেই মঞ্জুর করা ছিল, তিনি শুধু আগেভাগেই ছুটি উপভােগ করতে শুরু করেছেন। ড. ইসলাম তখন ঢাকায় পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন আর আহমদ ছিলেন তার সভাপতি । আমার সঙ্গে যােগাযােগ হয়নি শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন, আমার মনে হলাে তিনি আমাকে বিশ্বাস করলেন না। দুদিন পর ড. ইসলামের সঙ্গে ওয়াশিংটনে আমার দেখা হয়। তিনি ইয়েলে আগেই পৌছেছিলেন, ১২ মে ওয়াশিংটনে আসেন। | আহমদের সফরসঙ্গী সারতাজ আজিজের সঙ্গে একদিন মধ্যাহ্নভােজে দীর্ঘ আচ্ছা হলাে। সারতাজ আজিজ পাকিস্তানে আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন, ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আমরা পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে একসঙ্গে কাজ করেছি। এ ছাড়া ‘৬৯ ও ‘৭১ সালে তিনি কিছুদিন ওয়াশিংটনে ছিলেন এবং সেখানেও আমরা ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তারেক সিদ্দিকীও আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি করতেন ও বাংলা ভাষা রপ্ত করেছিলেন। প্রদেশের বৈষম্য নিয়ে তিনি সােচ্চার ছিলেন। সারতাজের কথাবার্তা ছিল অন্য জগতের—খুবই জ্ঞানজাগতিক বা একাডেমিক। তিনি বাংলাদেশের সব সুযােগ বিবেচনা করে অভিমত দিলেন যে ওই মুহূর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। এত দিন পর যখন পশ্চিম থেকে পূর্বে সম্পদ প্রতিপ্রবাহ শুরু হয়েছে, তখন বাংলাদেশের এই সুযােগ কোনােমতেই ছাড়া উচিত হবে না। হত্যাযজ্ঞ তাঁর মতে তেমন হয়নি এবং দুই দিকেই খুনােখুনি ঘটেছে। সেনাবাহিনী বাঙালি মেরেছে, বাঙালিরা বিহারি মেরেছে। এটি একটি গভীর ক্ষত, কিন্তু একে সারিয়ে নিতে হবে।
তিনি আরও বললেন যে বাংলাদেশের যাবার জায়গা নেই। ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার ফলে আমেরিকা আর বাংলাদেশে জড়াতে চাইবে না। তিনি ভারতকে আমলেই আনতে চাইলেন না, বরং বললেন যে ভারত যুক্তিবাদী হলে তাে দেশ বিভাগই হতাে না। হিন্দু-ভারতকে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণ কখনাে গ্রহণ করবে না। আর শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু এবং মুষ্টিমেয় কট্টর আওয়ামী লীগারের
৯১
জন্য ভারতও খুব আগ্রহী হবে না। এই লাইনে কথা বলা তখন সব পাকিস্তানির সহজাত অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। তারেক সিদ্দিকী ওয়াশিংটনে পৌছেই আমাকে। বাড়িতে টেলিফোন করে সমবেদনা জানান এবং পরিবার-পরিজনের ‘খায়রিয়ত জানতে চান। তারপরই বললেন যে আমাদের কথা বলতে হবে, দেশের বিরাট সমস্যা নিয়ে একাধিক মস্তিষ্ক খাটাতে হবে। তাঁর সঙ্গে আলােচনায় তার সহানুভূতি প্রকাশ পায় কিন্তু তাঁরও শেষ সিদ্ধান্ত ছিল ঠিক সারতাজের মতােই। ভারতের ছত্রচ্ছায়ায় বাংলাদেশ হবে না এবং হলেও তা গৃহীত হবে না। তারেকের বুদ্ধিজীবী হিসেবে সুনাম ছিল। সুতরাং তার সঙ্গে আলােচনায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি।
সারতাজের সঙ্গে আলােচনা কিন্তু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সারতাজ শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, “আমরা ঘাস খেয়ে হলেও তােমাদের ভারতের সহায়তায় স্বাধীন। হওয়া ঠেকাব। এই পর্যায়ে আমাদের আলােচনায় ইতি ঘটে। তারেকের ব্যবহারে দোষ নেওয়ার কিছু ছিল না কিন্তু অনেক দিন পর একটি ঘটনা শুনে মনে কষ্ট পাই। সিনেটর চার্চের সহকারী টমাস ডাইন একদিন বললেন যে এখনাে কিছু বাঙালি পাকিস্তানের সমর্থক। এই কথাবার্তা সম্ভবত হয় আগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের প্রথমে। আমি খুব জোরে আপত্তি করলাম। তখন তিনি বললেন যে পাকিস্তান দূতাবাসের আকরম জাকির সঙ্গে একজন বাঙালি সিনেটরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। নাম খুঁজে পাওয়া গেল তারেক সিদ্দিকীর, বােধ হয় দেশে প্রত্যাবর্তনের আগে তিনি ওয়াশিংটনে এসেছিলেন। আমি টমকে জানালাম যে উনি বাঙালি নন, তবে বাংলাদেশকে ভালাে জানেন। আকরম জাকি খুব চালাক লােক ছিলেন। তিনি পরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরে সাধারণ সচিব হন। তিনি হয়তাে বলে থাকবেন যে বাংলাদেশে তেমন কিছু ঘটেনি এবং বাঙালিরা ভারতকে পছন্দ করে না এবং হয়তাে বলেছেন যে আমার সতীর্থ তাে ওই দেশ চেনেন, তারও অভিমত এ রকম। এ ধরনের আলাপ হয়ে থাকতে পারে বলে টমেরও সন্দেহ হয়।
রেহমান সােবহান কোন তারিখে ওয়াশিংটনে পৌছান, কোনােমতেই তা মনে করতে পারছি না। আর কোথাও তা লেখাও নেই । তবে নানা হিসাব করে দেখেছি যে তিনি ৮ অক্টোবরে ওয়াশিংটনে আসেন। তার ওয়াশিংটনে আসার খবর আগেই পেয়েছি; সম্ভবত তসনু ভাইয়ের কাছে। লন্ডনে তসন্দুক আহমদ বহুদিন থেকেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানবিশেষ। আমাদের ছেলেবেলার নেতা, পথপ্রদর্শক ও চিন্তানায়ক তসনু ভাই। তাঁর ছােট ভাই শফাত আহমদ চৌধুরী (ডেল্টা লাইফ-খ্যাত) এবং হেদায়েত আহমদ (অবসরপ্রাপ্ত সচিব) আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তারা দুজনই ইতিমধ্যে পরলােকগত হয়েছেন। তসনু ভাই সেই চল্লিশের দশকেই ছিলেন প্রগতিশীল ছাত্রনেতা এবং বামপন্থী। ১৯৫২
৯২
সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি দেশ ত্যাগ করেন আর লন্ডনেই থেকে যান। ষাটের দশকে তিনি লন্ডনে ‘গেঞ্জেস’ নামে একটি সুন্দর রেস্তোরা প্রতিষ্ঠা করেন। এই গেঞ্জেস ১৯৭১ সালে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাঙালিদের একটি আড্ডাস্থল, বিশেষ করে র্যাডিক্যাল গােষ্ঠীর মিলনকেন্দ্র।
পরবর্তীকালে তসনু ভাই ব্রিটেনের রানি কর্তৃক অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ খেতাবে ভূষিত হন। রেহমান ওয়াশিংটনে হারুন রশীদের বাড়িতে থাকবেন, আমি তাঁকে নিয়ে আসতে গেলাম বিমানবন্দরে। এতটুকু খেয়াল আছে যে তিনি আর এম এম আহমদ প্রায় একই সময়ে এসে পৌছান। প্রথম দিনেই তিনি আমার বাড়িতে দূতাবাসের সব বাঙালির সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। তিনি যেমন এখানকার অবস্থা সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী ছিলেন, আমরাও তেমনি বাংলাদেশের ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি তাঁর কাছ থেকে জানতে উদগ্রীব ছিলাম । মাসখানেক তিনি আমেরিকায় ছিলেন। তাঁর প্রধান আখড়া ছিল ওয়াশিংটন এলাকায় হারুনুর রশীদের বাড়ি। তবে বােস্টন, শিকাগাে ও নিউইয়র্কেও ছিল তার যাতায়াত। ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ লিগও তাঁকে লুফে নেয়। মিশনের দুজন কর্মচারী রাজ্জাক ও ফজলুল বারী হয় তাঁর সব সময়ের সহচর। রাজ্জাক ১৭ মে দূতাবাস থেকে বরখাস্ত হবার পর রেহমানের সার্বক্ষণিক সহকারীর ভূমিকা গ্রহণ করে।
সংবাদমাধ্যমে রেহমান সহজেই গৃহীত হন। তারা এই প্রথম মুজিবনগর সরকারের একজন প্রতিনিধিকে পেল। পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস সে যুগে ওয়াশিংটনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রচার করত, যার নাম। ছিল ওয়াশিংটন নিউজ কনফারেন্স। সেখানে বিভিন্ন সাংবাদিক সংবাদ পড়তেন। এবং বিশেষ বিশেষ সংবাদ নিয়ে আলােচনা করতেন। এসব সংবাদের জন্য আবার অতিথিদের ডেকে আনা হতাে অথবা সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করা হতাে। একজন সাংবাদিক ওয়ারেন উনা রেহমানকে এই প্রােগ্রামে হাজির করালেন। রেহমানের সংবাদ পরিবেশনা ছিল দৃঢ়বিশ্বাসে দীপ্ত এবং ব্যাখ্যায় পরিস্ফুট । রেহমান তার মাসখানেকের অবস্থিতিতে সম্ভবত চারটি টেলিভিশন সংবাদ পর্যালােচনায় অংশগ্রহণ করেন। ১২ মে রেহমান একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। এবং এতে বেশ লােকসমাগম হয়। পাকিস্তানি দুজন সাংবাদিককে পাকিস্তান। সরকার তখন ওয়াশিংটনে পাঠায়, ডন-এর নাসিম আহমদ এবং ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর-এর কুতুবুদ্দিন আজিজ। তারা কিছুদিনের জন্য দূতাবাসের জনসংযােগ কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। অবশ্য প্রকাশ্যে তারা স্বাধীন সাংবাদিক হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিতেন। তাঁরা রেহমানের সংবাদ সম্মেলনে বাধা সৃষ্টির জন্য হাজির হন কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে খানিকক্ষণ থেকে বিদায় নেন।
৯৩
স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে তারা সব সময় যেতেন এবং খুব তত্ত্বকথা শােনাতেন। বলা যায়, একধরনের উঁচু মার্গে অবস্থান নেবার চেষ্টা করতেন তাঁরা। রাজ্জাক একদিন তাদের খুব অপদস্থ করেন। তাঁর উপস্থিতি নিয়ে বােধ হয় নাসিম প্রশ্ন তােলেন। রাজ্জাক কম গেলেন না, তিনি বললেন যে নাসিম তাে ওই আসরে সাংবাদিক হিসেবে ভুয়া পরিচয়ে হাজির হয়েছেন, তিনি পাকিস্তান দূতাবাসের বেতনভুক্ত কর্মচারী। সুতরাং তারই বরং এই আসরে হাজিরা দেবার অধিকার নেই। নাসিম কিছুদিন পর পাকিস্তানে ফেরত যান, তবে কুতুবুদ্দিন বহুদিন পর্যন্ত জনসংযােগ কর্মকর্তা এবং কংগ্রেসে লবিস্ট হিসেবে ওয়াশিংটনে থেকে যান। তাঁরা দুজন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে তথ্য দপ্তরে উচ্চ পদে আসীন হন।
এম এম আহমদ কংগ্রেসে সিনেটর সাইমিংটন কর্তৃক আপ্যায়িত হন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর ফুলব্রাইটকে এম এম আহমদের সঙ্গে বৈঠক করতে অনুরােধ করেন। কিন্তু ফুলব্রাইট তাতে রাজি না হওয়ায় সাইমিংটন তার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করেন। সাইমিংটন পাকিস্তানের কোনাে শক্ত সমর্থক ছিলেন না, তবে শত্রুও ছিলেন না। তিনি বাংলাদেশ সমস্যার ওপর সিনেটে পাঁচবার বক্তব্য দেন। প্রথমে ২৪ জুন, তারপর ১৫, ২৩ ও ৩০ জুলাই এবং সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বরে । তাঁর সব কটি বক্তৃতাতেই ছিল মার্কিন নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে অভিযােগ—তাদের মিথ্যাচার, পক্ষপাতিত্ব ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা। তিনি বলেন যে নিক্সন সরকার বন্ধুকে কী করে ধ্বংস করতে হয় এবং বন্ধুত্বের জায়গায় নিজেদের মিথ্যাচার ও গােপনীয়তার আবরণ সৃষ্টি করতে হয়, সে কৌশলে অত্যন্ত দক্ষ। টমাস ডাইন, জেরি টিংকার, মাইক গার্টনার—আমাদের এসব বন্ধু ঠিক করলেন যে এর প্রত্যুত্তরের জন্য সিনেটরদের সঙ্গে রেহমানের আলাপের ব্যবস্থা করতে হবে। বিষয়টি যাতে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ও ডেমােক্রেটিক কংগ্রেসের দ্বন্দ্বে রূপ না নেয় তার জন্য স্থির হলাে যে সিনেটর স্যাক্সবি (রিপাবলিকান) রেহমানের জন্য মধ্যাহ্নভােজের ব্যবস্থা করবেন।
রেহমান ভালাে বক্তা এবং বিষয়টি ছিল তার নখদর্পণে, তাই তাঁর বক্তব্য সবাইকে প্রভাবিত করে। রেহমানের কথা শুনতে হাজির হন সিনেটর ফুলব্রাইট এবং রিপাবলিকান দলের নেতা সিনেটর হিউ স্কট। সংবাদমাধ্যমে রেহমানের প্রচারণা ইতিমধ্যে তাঁকে করে তােলে আকর্ষণীয়। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বস্তরে আলাপ-আলােচনার সুযােগ হলাে অতি সহজে, বিশেষ প্রকল্প বিভাগ, পাকিস্তান ডেস্ক, পিটার কারগিল—সবাই রেহমানের কথা শুনলেন। খােদ ম্যাকনামারাও দেখা করলেন। রেহমান কিন্তু মার্কিন নির্বাহী বিভাগে তদবির করার বিশেষ
৯৪
সুযােগ পেলেন না। তাঁর পক্ষে পররাষ্ট্র দপ্তর, এইড কর্তৃপক্ষ বা হােয়াইট হাউসে পৌছা খুব কষ্টকর হলাে। স্টেট ডিপার্টমেন্টে শুধু ক্রেইগ ব্যাক্সটারের সঙ্গে কথা হলাে। এইডে অবশ্য ডেপুটি প্রশাসক মরিস উইলিয়ামস তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। হােয়াইট হাউসে পৌছার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলাে। অন্যান্য সূত্রেও হােয়াইট হাউসে যােগাযােগের সব প্রচেষ্টা সারা একাত্তরে ফলপ্রসূ হয়নি। রেহমান হার্ভার্ডের মাধ্যমেও কিসিঞ্জারের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করে ব্যর্থ। হলেন। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের পর প্যাট নিক্সন একটি ত্রাণ তহবিল গঠন করেন। এই তহবিলের কো-চেয়ার ছিলেন একজন আইনবিদ, যার পুরাে নাম এখন মনে পড়ছে না। তবে মিস্টার সাউয়ারের সঙ্গে আমার বেশ পরিচয় ছিল।
প্যাট নিক্সনের তহবিলের ব্যাপারে আমাকে যােগাযােগ রাখতে হতাে। তহবিলের জন্য চিঠিপত্র লেখা, হিসাব রাখা—এসব কাজে আমাদের মহিলারা স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতেন। আইনবিদ সাউয়ারের কাছে রেহমানকে নিয়ে একদিন বিকেলে হাজির হলাম। সেখানে আমাদের দালানে ঢুকবার জন্য একটি রেজিস্টারে নাম লিখতে হয়। আমি আমার নামেই মােলাকাত ঠিক করেছি, সেই নামই লিখে দিলাম। রেহমান তার নাম লিখলেন ‘মােহনলাল। তিনি বললেন যে ছদ্মনামের একটি কালচার মুজিবনগরে চালু হয়েছে এবং আমি যে তা রপ্ত করিনি, তাতে আমার অসুবিধা হতে পারে। মার্কিন মুলুকে এ রকম- অসুবিধা আমি কখনাে চিন্তা করিনি এবং বাস্তবে তা কখনাে হয়নি। জুলাই কি সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক আনিসুর রহমানও ওয়াশিংটনে আসেন এবং কংগ্রেসে তদবির করেন। তিনিও সব সময় ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। তার আবার বাতিক ছিল যে তিনি সব সময় ‘আ’ এবং ‘র’ অক্ষরের নাম নিতেন, যেমন আবদুর রাজ্জাক, অনিল রায় ইত্যাদি। রেহমান দ্বিতীয়বার যখন ওয়াশিংটনে আসেন, তখন আর ছদ্মনাম ব্যবহার করেননি। সাউয়ার আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক অনুমানের খেলা খেললেন। কিন্তু নিক্সনের কাছে এ ব্যাপারে কোনাে তদবিরের সুযােগ বের করতে পারলেন না। আমাদের ফজলে বারীও একবার নিক্সনের কাছে পৌছাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনাে ফল হলাে না।
কিসিঞ্জারের সহকারী হ্যারল্ড সন্ডার্স এনায়েত করিমের পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনিও বাংলাদেশের ব্যাপারে কিসিঞ্জারের সঙ্গে কোনাে রকমের ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। সে সময় হােয়াইট হাউস এ ব্যাপারে কানে দেয় তালা আর চোখে দেয় তুলা।
আমি অনবরত প্রতিবেদন ও প্রচারপত্র তৈরি করেই চলেছি। ২ মে অ্যান্টনি মাসকারেনহাসের বরাতে বিহারি হত্যা নিয়ে একটি বড় কাহিনি বিশ্ব
৯৫
সংবাদমাধ্যমে বেরােল। হারুনের সঙ্গে মিলে আমি লিখলাম কে কাকে খুন করছে। রেহমান এসে এতে এক নতুন মাত্রা যােগ করলেন। তিনিও দু-একটি সাপ্তাহিকীতে লিখলেন। আরও সব প্রতিবেদন বানালেন, যেমন অবস্থান এবং বিকল্প নীতি’। তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ১৭ এপ্রিলের একটি মূল্যবান বক্তৃতার খসড়া এনে তার বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। ১২ মে রাতে ড. নূরুল ইসলাম এলেন ওয়াশিংটনে। রেহমান, হারুন আর আমি গেলাম রজার স্মিথ। হােটেলে। সেদিন আমাদের একটি লম্বা এবং খােলামেলা আড্ডা হলাে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা দুটি ভিন্ন বিশ্লেষণ শুনলাম।
রেহমানের অভিমত ছিল যে অতিসত্বর বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি দখলদারেরা বিদায় নেবে। বাঙালি যুবসম্প্রদায়কে দেখে এবং তাদের ত্যাগ ও যুদ্ধস্পৃহা বিশ্লেষণ করে তার ধারণা হয় যে এরা দেশকে স্বাধীন করেই ছাড়বে। ভারত সরকার তাদের দরাজ হাতে সাহায্য না করলে নিজেই বিপদে পড়বে এবং কোনােমতেই আমাদের পিছু টেনে রাখতে পারবে না। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেশ মুক্ত হবে। ড. ইসলাম এতটা আশাবাদী ছিলেন না। তাঁর প্রাথমিক অভিমত ছিল যে মুজিবনগর সরকার ক্রমে তিব্বতের দালাই লামা বনে যাবে। পাকিস্তানিরা বিতাড়িত হবে, তবে সে অনেক দিনের ব্যাপার। তারা দুজনই একমত ছিলেন যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব হবে অন্য রকমের, অন্য মাত্রার। নেতারা হবেন যৌবনদীপ্ত, বিপ্লবী, প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী। ড. ইসলাম হাস্যোচ্ছলে আমাকে উপদেশ দিলেন আমার যেকোনাে আন্তর্জাতিক বা মার্কিন সংস্থায় চাকরির জন্য চেষ্টা করা উচিত। মজার ব্যাপার হলাে যে দুই মাস পর একই রকম ব্যক্তিগত উপদেশ আমাকে আবার দেন পাকিস্তানি মাহমুদ আলী। সময়ের ব্যবধানে মে মাসে আমি ছিলাম পাকিস্তান দূতাবাসের ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী কূটনীতিবিদ এবং জুলাইয়ে পাকিস্তান পরিত্যাগী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত লবিস্ট।
রেহমান ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কের বাঙালি কূটনীতিবিদদের নিয়ে একটি বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের পরিকল্পনা রচনায় ব্রতী হন। প্রাথমিক হিসাবে ঠিক হলাে যে মাসিক ১৫-২০ হাজার ডলারে একটি মিশন স্থাপন করা যায়। সেখানে সব বাঙালি কূটনীতিবিদ যােগ দেবেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন বাঙালি সমিতিও খুব আগ্রহী ছিল। কিন্তু অর্থের নিয়মিত ব্যবস্থা করাটা তত সহজ ছিল না। নিউইয়র্কে মিশনের জন্য মাহমুদ আলীর দুই হাজার ডলার আদায়ের প্রতিশ্রুতি কোনাে সময়ই পালন করা যায়নি। শিকাগাের ফজলুর রহমান খানও এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা নিয়ে সফল হননি। দু-একজনের জন্য দূতাবাস ছেড়ে কোনাে রকমে জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা করা কঠিন ছিল না, কিন্তু সবাইকে নিয়ে ১০-১৫ জনের মিশন স্থাপন করা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার ।
৯৬
১১ মে কংগ্রেসে বাংলাদেশের ওপর গালাগার শুনানি হলাে। নিউজার্সির প্রতিনিধি ডেমােক্র্যাট কর্নেলিয়াস গালাগার ছিলেন হাউসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা সাব-কমিটির চেয়ারম্যান। তিনিই কংগ্রেসে বাংলাদেশের ওপর প্রথম শুনানির ব্যবস্থা করেন। (এ বিষয়ে বিস্তৃত আলােচনা দ্রষ্টব্য)। এতে প্রথম দিন সাক্ষ্য দেন সিনেটর কেনেডি। দ্বিতীয় অধিবেশন হয় ২৫ মে এবং তাতে সাক্ষ্য দেন অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যান ও অধ্যাপক গিডন গটলিয়েব। আবদুর রাজ্জাক খান এই শুনানিতে হাজির হন। তিনি ওই দিনের জন্য দূতাবাস থেকে ছুটি নেন এবং দর্শক গ্যালারিতে উপস্থিত হন। দূতাবাস তাঁকে এর জন্য শাস্তি দিল । ১৭ তারিখে তাকে বরখাস্ত করা হলাে। আমরা দূতাবাসের বাঙালি কর্মচারীরা একসময় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমাদের কাউকে যদি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়, তাহলে আমরা সবাই একযােগে তার প্রতিবাদ করব আর সেটি হবে আমাদের আনুগত্য পরিবর্তনের সময়।
সেদিন বিকেলে আমরা অধ্যাপক আবু রুশদের বাড়িতে সম্মিলিত হলাম। সেখানে প্রথম আমাদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিল। কারও মত ছিল যে রাজ্জাক আক্রান্ত হওয়ায় আমাদের পূর্বেকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবারই দূতাবাস পরিত্যাগ করা উচিত। ভিন্নমত হলাে যে রাজ্জাক স্থানীয় কর্মচারী, পুরােপুরি কূটনীতিবিদ নন। সুতরাং কূটনীতিবিদদের ওপর আক্রমণ এখনাে হয়নি এবং আমাদের কোনাে পদক্ষেপ নেবার সময় আসেনি। এই যুক্তির বিপদ ছিল যে এটি বাঙালি মহলে সমাদৃত হবে না এবং বৈষম্যমূলক বলে গণ্য হবে। যা-ই হােক, সিদ্ধান্ত হলাে যে সম্মিলিতভাবে আমরা কোনাে প্রতিবাদ করব না, তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি প্রতিবাদ করে কোনাে পদক্ষেপ নেন, তাতে কোনাে আপত্তি থাকবে না। এককথায় এবার আমাদের ঐক্যে ভাঙন এল। এই সিদ্ধান্ত কিন্তু কাউকেই শান্তিতে থাকতে দিল না এবং এ নিয়ে কদিন ধরে কানাঘুষা চলল। দূতাবাসের কয়েকজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী কিন্তু খুব ক্ষুন্ন হলেন। তাঁদের তিনজন ফজলুল বারী, মুহিদ চৌধুরী ও মােশতাক আহমদ আমার কাছে এলেন বুদ্ধি নিতে। তারা চাকরির তােয়াক্কা করেন না, কিন্তু প্রতিবাদ তাদের করতেই হবে। অবশেষে তাঁদের নিয়ে একটি প্রতিবাদলিপি তৈরি করলাম এবং ১৯ মে তাঁরা সেটি রাষ্ট্রদূতের কাছে দিলেন। ২৬ মে প্রথমে ফজলুল বারী বরখাস্ত হলেন। তার কদিন পর ৯ জুন মুহিদ বরখাস্ত হলেন। মােশতাককে বরখাস্তের সুযােগ আর হলাে না। ৪ আগস্ট তিনি নিজেই বিদায় নিলেন। হিউবার্ট মিচেল বলে একজন উকিল বারী ও মুহিদকে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে এবং জীবিকার রাস্তা খুঁজে পেতে খুব সাহায্য করেন।
৯৭
কিছুদিন পর আমার বাড়িতে দূতাবাসের কর্মচারীদের আরেকটি সভা বসল। সেদিন আমি আমার সহকর্মীদের জানালাম যে আমি মাস শেষে দূতাবাস পরিত্যাগ করছি এবং আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছি। কিন্তু তার আগে হারুন রশীদের প্লেনের ভাড়ার চাঁদাটা আদায় করতে হবে। সবার প্রশ্ন হলাে দুটি, প্রথমত আমার চলবে কী করে, আমি কি কোনাে ব্যবস্থা নিয়েছি? দ্বিতীয়ত, আমার এই পদক্ষেপে আন্দোলনের কী লাভ হবে, আমি কী করব? আমি কোনাে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা ঠিক করিনি, তবে দু-চারটি বক্তৃতা দেবার প্রােগ্রাম করেছিলাম আর বিশ্বাস ছিল যে কিছু একটা জুটিয়ে নিতে পারব। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ছিল সহজ। কারণ, ইতিমধ্যে একটি মিশন বা কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা শুধু বাঙালিদের মধ্যে নয়, মার্কিন শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যেও আলােচিত হচ্ছিল।
মে মাসে বাংলাদেশের খবর তত আশাব্যঞ্জক ছিল না। ওয়াশিংটনে কর্মচারীদের বরখাস্তের ঘটনাটি মনঃকষ্টের কারণ ছিল। পাকিস্তানিরা বেশ মাথা। উঁচু করে কথা বলছিল । রাষ্ট্রদূত কতগুলাে প্রচারপত্র ও পুস্তিকা বিতরণ করে বেড়াচ্ছিলেন। এর মধ্যে পাকিস্তান একটি সংবাদ বিজ্ঞাপন বের করল। তাতে ‘আমরা মৃত বলে ঘােষিত হয়েছিলাম’–এই শিরােনামে ঢাকার কয়েকজন। শিক্ষক জানান যে ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ হয়নি এবং তারা বেঁচে আছেন। এম এম আহমদ পাকিস্তানের জন্য শক্ত তদবির করে গেলেন। লাভের খাতায় ছিল রেহমানের সফল সফর, আনার দুটি বিক্ষোভ, গালাগার শুনানি এবং কেস মন্ডেইল প্রস্তাব পাস।
মে মাসের শুরুতে দুজন বাঙালি এসে সামরিক বর্বরতার বিস্তৃত কাহিনি শােনালেন। প্রথমে এলেন জিল্লুর রহমান খান এবং তাঁর স্ত্রী, পরে এলেন মাসুদা আলম (শরফুল আলমের স্ত্রী দেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন, প্রত্যাবর্তন করলেন ১০ মে)। জিল্লুর রহমান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, লালমাটিয়ায় থাকতেন। তাঁর স্ত্রী মার্কিন, তাই ৬ এপ্রিল তিনি মার্কিন নাগরিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অপসারিত হন। জিল্লুর কিছুদিনের মধ্যে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসকস ক্যাম্পাসে অধ্যাপক হন। প্রসিদ্ধ ফজলুর রহমান খানের তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতা । মাসুদা ঢাকা থেকে পালিয়ে টাঙ্গাইল এলাকায় ঘুরে বেড়ান। করটিয়ায় শত্রুপক্ষের গােলাগুলিতে তাঁর কয়েকজন আত্মীয় নিহত হন এবং তিনিও বুলেটবিদ্ধ হন। তিনি সামরিক বর্বরতার লােমহর্ষক বিবরণ দিলেন। তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করলেন যে বাংলাদেশে এসব বর্বর দখলকারীর দিন খুবই নির্দিষ্ট । জিল্লুর মার্কিন শিক্ষক মহলে একটি লিখিত বিবৃতি দেন, যেখানে তিনি সামরিক বাহিনীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আক্রোশের বিশদ বিবরণ দেন। তিনি দেশব্যাপী প্রতিরােধেরও একটি চিত্র আঁকেন।
৯৮
তাঁর এই বক্তব্য পণ্ডিত মহলকে খুবই বিচলিত করে এবং এর ওপর ভিত্তি করে তারা কড়া বক্তৃতা ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেন। জিল্লুর আমাদের বাড়িতে কয়েক দিন ছিলেন। তাঁর স্ত্রী সামরিক আক্রমণের অনেক বিবরণ দেন। একদিন এফ আর খান এলেন আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে এবং জিল্লুরকে দেখতে। এই স্বনামধন্য ব্যক্তির সঙ্গে সেদিন আমার প্রথম মােলাকাত। তিনি ওয়াশিংটনে একটি বাংলাদেশ মিশনের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। জিল্লুরের জন্য কী করতে পারেন, তা আলােচনা করলেন। বাংলাদেশ সমিতিগুলাের জন্য একটি সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা বললেন এবং ফিরােজের প্রকল্পের বিষয়ে খোজ নিলেন। তিনি ১২ ১৪ মে আমার বাড়িতে আসেন।
এদিকে আরেকটি সুখবর হলাে কর্নেলিয়া রােডির উদ্যোগ। কর্নেলিয়া কংগ্রেসের লবিতে ঘােরাফেরা করছিলেন। সিআরএলের আরও লােকজন এখানে-সেখানে তদবির করছিলেন। ওয়াশিংটনের বাঙালি সমিতির উদ্যোগে জোর আসে রেহমানের আগমনে ও তৎপরতায়। আমি প্রায় রােজই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ১৪ মে ডানহাম প্রস্তাবের খসড়া দপ্তরে দপ্তরে বিতরিত হলাে। কর্নেলিয়ার আলাপ-আলােচনার ওপর ভিত্তি করে এবং আমার একটি প্রতিবেদনের সাহায্য নিয়ে নিউইয়র্কের এক অত্যুৎসাহী যুবক ডেল ডানহাম (বােধ হয় সিআরএল গােষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং ফরিদা বুইর বন্ধু) প্রস্তাবটি রচনা। করেন। এই প্রস্তাবে পাকিস্তানে সব রকম মার্কিন সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়। কথা হলাে যে জন রােডি এলে পরে ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টের সংশােধনী নিয়ে সিনেটরদের কজন আলােচনায় বসবেন। রােডির আসার তারিখ ছিল ২২ মে।
পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মাস শেষে খুব তৎপরতা দেখাতে লাগলেন। তিনি অনেক প্রচারপত্র বিলি করলেন। জনপ্রতিনিধিদের অনবরত তারবার্তা পাঠিয়ে আর চিঠি লিখে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। বাঙালি কর্মচারীদের বিশ্বাস করা যায় না বলে তিনি দূতাবাসে দুজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা আমদানি করলেন। আকরম জাকি ছিলেন কানাডায় কাউন্সেলর, তাঁকে নিয়ে এলেন। জহিরুদ্দীন ফারুকী ছিলেন এনায়েত করিমের পূর্বসূরি, মিশনের উপপ্রধান। তিনি সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রদূত হয়ে বদলি হয়েছিলেন। তাঁকে আবার নিয়ে আসা হলাে। কুতুবুদ্দিন আজিজ আর নাসিম আহমদও দূতাবাসের কর্মচারী হিসেবে কাজ করছিলেন। তারা কংগ্রেসে খুব ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করলেন, সংবাদমাধ্যমে জোর তদবির চালালেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের মিশন পাঠানাের তােড়জোড় চলছে। ২৭ মে মাইকেল উইহেন ও ভানডার হাইডেন আমাকে মধ্যাহ্নভােজে ডাকলেন। তাঁদের পাকিস্তানি মিশন নিয়ে হবে আমাদের আলােচনা। কোথায় গেলে, কার সঙ্গে
৯৯
আলাপ করলে সঠিক খবর পাওয়া যাবে, কী কী বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার (যেমন চা-বাগান, পাটের পরিবহন, বিদ্যুৎ স্টেশনের নিরাপত্তা, যানবাহনের অবস্থা, গৃহায়ণ ও ধ্বংসলীলা)। অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে আমার অভিমতও তারা শুনলেন। কী ধরনের সাহায্য দিলে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হবে অথবা কীভাবে তাদের কাছে সাহায্য পৌছানাে যাবে, এমন ধরনের খােলামেলা আলােচনায় প্রায় দপ্তরের সময় শেষ হয়ে এল। উইহেন মােটামুটিভাবে দলনেতার কাজ করবেন, তবে শেষের দিকে খােদ পিটার। কারগিল যাবেন এবং তিনিই হবেন লৌকিক দলাধিপতি। আমার কোনাে ব্যক্তিগত খবর থাকলে তা-ও তারা পৌছে দেবার অঙ্গীকার করেন। তবে তারা। তখনাে নিশ্চিত ছিলেন না যে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও খুলনা ছাড়া আর কোনাে জায়গায় তারা যেতে পারবেন কি না।
সারা দেশ শান্ত—পাকিস্তানিদের এই দাবির ব্যাপারে তাঁরা মােটেই আস্থাশীল ছিলেন না। যােগাযােগের ব্যবস্থা সম্বন্ধেও তাঁদের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। আমার সৌভাগ্য যে আমার সরকারি মধ্যাহ্নভােজ ছিল এত বিশদ ও দীর্ঘ। সেদিন অপরাহ্রে রাষ্ট্রদূত দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন, যার অন্যতম। উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল ইয়াহিয়ার ২৪ তারিখের বক্তব্যের ব্যাখ্যা ও প্রচার। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল দুরভিসন্ধিমূলক। এ এইচ মাহমুদ আলীর আনুগত্য। পরিবর্তন, রাজ্জাকের বরখাস্ত, বাঙালি কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ—এগুলাে। নিয়ে স্থানীয় পত্রিকাগুলাে কয়েক দিন অনেক মন্তব্য করে এবং ধারণা দেয় যে দূতাবাসেই একধরনের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। হিলালি এই প্রচার বন্ধ করতে দৃঢ়মনস্ক ছিলেন। তার সংবাদ সম্মেলনে তিনি এক পাশে বসালেন এনায়েত করিমকে আর। অন্য পাশে শামসুল কিবরিয়াকে। আমাকেও খুঁজেছিলেন, তবে আমার সৌভাগ্য যে আমি কার্যোপলক্ষে দপ্তরে ছিলাম না। সংবাদ সম্মেলনে দূতাবাসে বাঙালিপাকিস্তানি মন-কষাকষি নিয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন। হিলালি এর জবাবে তার দুপাশে বসা বাঙালিদের দেখিয়ে ঘােষণা করেন যে সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার আর বাংলাদেশেও এ রকম সম্পর্ক বিরাজ করছে। শুধু গুটিকয়েক দুষ্কৃতকারী ভারতীয় উসকানিতে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তিনি শরণার্থীদের দেশত্যাগের বিষয়ে তাঁর কর্তাদের কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন যে, ও তেমন কিছু নয়, শুধু ভারতীয় প্রচারণা। এই সংবাদ সম্মেলনের খবর কাগজে বেরােল, তবে বাঙালি-পাকিস্তানি সম্পর্কের বিষয়ে কেউই কোনাে মন্তব্য করলেন না। দুই মাস পর অবশ্য হিলালির সে মধুর সম্পর্কের দাবিটি নিতান্তই অসার প্রমাণিত হলাে। ৪ আগস্ট হিলালির দূতাবাসে কোনাে বাঙালি, এমনকি একজন পিয়নও অবশিষ্ট থাকল না।
এদিকে মে মাসের শেষ, সম্ভবত ২৪ তারিখের দিকে বিচারপতি আবু সাঈদ
১০০
চৌধুরী নিউইয়র্কে আগমন করলেন। এ এইচ মাহমুদ আলী সেখানে তাঁর দেখাশােনা করেন, এস এ করিমও তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ রাখেন। বাংলাদেশ লিগ তাঁকে নিয়ে অনেক হইচই করল। নিউইয়র্ক টাইমস-এ ৩০ তারিখ একটি সুন্দর প্রতিবেদন ছাপলেন কেথলিন টেল্টস। পাকিস্তানিরা তাকে মানবাধিকার কমিশন। থেকে বিতাড়নের তােড়জোড় চালাচ্ছে আর তিনিও ধীরস্থিরভাবে পাকিস্তানের গণহত্যার প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। ২৯ মে হারুন আর আমি গেলাম নিউইয়র্কে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে। এবার আমাদের বাসে করে যেতে হলাে। কারণ, প্লেনের ভাড়া অনেক বেশি। ওখানে এফ আর খান ও রেহমানও গেছেন তাঁর সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্য। সবাই চান, ওয়াশিংটনে একটি মিশন স্থাপন করা হােক। বিচারপতির সঙ্গে একান্ত আলাপে আমি জানালাম যে জুনের ১৫ তারিখ আমি দূতাবাস ছাড়ব এবং মিশনের ভার নেব। পাকিস্তানের চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত আমার চূড়ান্ত এবং আমার সহযােগীরা তা জানেন।
বিচারপতি আমাকে দুটো উপদেশ দিলেন—প্রথমত, আমার পদত্যাগ করা উচিত নয়, সরকারটি অবৈধ, সুতরাং আমি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেব এবং যথাসময়ে আমার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব। তিনি বললেন যে তিনি তখনাে বাংলাদেশের বিচারপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। শুধু সাময়িকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। দখলদারদের উচ্ছেদ করে নিজের জায়গায় আবার ফিরে যাবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বললেন যে এই সিদ্ধান্ত নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং প্রত্যেকেরই উচিত নিজের বিচার-বিবেচনা ধীরেসুস্থে প্রয়ােগ করা। তবে তার বিশ্বাস আমি কোনাে দিনই আমার সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ পাব না, অনুশােচনা করব না বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগব না। আমার ব্যক্তিগত অঙ্গীকার কিন্তু আমি যথাসময়ে রাখতে পারিনি এবং এর জন্য বিচারপতির ক্ষোভ এফ আর খান আমার কাছে প্রকাশ করেন। পরে একসময় তা ব্যাখ্যা করার সুযােগ আমার হয়। তখন তিনি বলেন যে যথাসময়ে তা আমি তাকে জানালে ভালাে হতাে। আমি ১৫ তারিখের পরিবর্তে ৩০ তারিখে দূতাবাস ছাড়ি। ৭ জুন জানলাম যে পাকিস্তান সরকার দয়াপরবশ হয়ে জুনের শেষে আমার পদটি বিলুপ্ত করে দেবে। তাই আমি আরও ১৫ দিন পাকিস্তানের ভাত সাবাড় করতে স্থির করি। তারা অবশ্য আরও দয়া প্রদর্শন করে আমাকে পিন্ডিতে শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে নিযুক্তি দেয়। তবে পিন্ডি থেকে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি ডেভিড গর্ডন বার্তা পাঠালেন যে আমি যেন পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনে বিলম্ব করি, অবশ্য বার্তাটি ছিল একান্ত ব্যক্তিগত ।
১০১
<p style="text-align: justify;"> ষষ্ঠ অধ্যায়
মুক্তিযুদ্ধ দৃঢ়করণের সময় : জুন-জুলাই ১৯৭১
যাতনার মাসের পর আসে দৃঢ়করণের সময়। জুন-জুলাই ছিল আমেরিকায়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দৃঢ়করণের সময় । জুন মাসে কংগ্রেসে পাকিস্তানকে সব। রকম সাহায্য বন্ধের জন্য সংশােধনী প্রস্তাব পেশ হলাে। বাংলাদেশের সমর্থনে দুটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, ফিলাডেলফিয়ায় ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার আত্মপ্রকাশ করল । নিউইয়র্কে বাঙালি সমিতিগুলাের বড় কনভেনশন হলাে। শিকাগােতে বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগও গঠিত হলাে। পাকিস্তান এইড কনসাের্টিয়ামের সভায় পাকিস্তানকে কোনাে সাহায্য বা ঋণ রেয়াতি দেওয়া বন্ধ হলাে। পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য প্রদানে মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তিকর সংবাদ প্রকাশিত হলাে জুনের শেষে। আর জুলাইয়ের প্রথমে বেরােল পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্বন্ধে বিশ্ব ব্যাংকের মারাত্মক এক প্রতিবেদন।।
তখন মার্কিন কংগ্রেস ছিল বস্তুতই জনপ্রতিনিধিদের কর্মস্থল । এত সহজে কোনাে আইন পরিষদে প্রবেশ করা এবং সরাসরি প্রতিনিধির কাছে নিজের দাবি বা দুঃখ বলা অন্য কোনাে আইন পরিষদে সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা। নিরাপত্তার বেড়া অথবা অন্য রকম লৌকিকতার সীমানা পেরিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টে যাওয়া, ভারতীয় লােকসভায় পৌছা অথবা আমাদের জাতীয় পরিষদে হাজিরা দেওয়া অনেক দুরূহ। মার্কিন কংগ্রেসে এখন নাকি কিছু নিরাপত্তার কড়াকড়ি হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও ওকলাহােমার বােমা হামলার পর কড়াকড়ি নাকি বেড়েছে। কিন্তু ১৯৯০ সালেও আমি ইচ্ছেমতাে সিনেটর অথবা কংগ্রেসম্যানদের দপ্তরে হাজির হয়েছি আর তাঁদের সঙ্গে দেখা না হলেও তাঁদের সহকারীদের কাছে আমার বক্তব্য বলেছি। জনপ্রতিনিধিদের দুয়ার জনগণের জন্য সব সময় উন্মুক্ত আর বিশেষ করে তাদের জন্য যারা তার নির্বাচনী এলাকার
১০২
লােক । আর একটি রীতি হলাে কোনাে রকম চিঠি, বার্তা বা টেলিফোন এলে তার জবাব তাঁরা দেবেনই দেবেন। জনপ্রতিনিধিরা নানা বিষয়ে, বিশেষ করে মানুষের অভিযােগ নিয়ে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য ও ব্যাখ্যা চান, বিশ্লেষণ চেয়ে পাঠান। নির্বাহী বিভাগ এসব অনুসন্ধানের জবাব দিতে বাধ্য এবং দেরি করলে বা ভুল খবর দিলে বিপদে পড়ে।
কংগ্রেসের দুই পরিষদেই অসংখ্য কমিটি রয়েছে। দেশের প্রতিটি বিষয়—পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, বিচারব্যবস্থা, শরণার্থী সমস্যা, ইন্ডিয়ান বিষয়, পরিবেশ, বাজেট নিয়েই কমিটি ও সাব-কমিটি রয়েছে। সমস্ত আইন নিয়ে তারা মাথা ঘামায় এবং নির্বাহী বিভাগের কার্যকলাপ নিয়ে অনুসন্ধান চালায় বা তথ্য সংগ্রহ করে। নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি হয় এসব কমিটিতে । কমিটির চেয়ারম্যান হন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের একজন প্রতিনিধি এবং এর সদস্যরা সব দল থেকেই আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হন। কে কোন কমিটিতে যাবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেয় দলাধিপতিদের গােষ্ঠী এবং তাতে প্রতিনিধি হিসেবে জ্যেষ্ঠতা একটি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। এভাবে প্রতিনিধিরা সাধারণত বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে যান এবং সেই ক্ষেত্রেই অবস্থান করতে ভালােবাসেন । যেমন সিনেটর কেনেডি ছিলেন তিনটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, যথা : শরণার্থী, প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য। সিনেটর ফুলব্রাইট ছিলেন পররাষ্ট্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। প্রতিনিধিদের কাজকর্মে দক্ষতার পেছনে রয়েছে তাদের স্টাফরা। তাঁরা দুই ধরনের স্টাফ ব্যবহার করেন। একটি হলাে অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সাধারণত পড়াশােনায় ভালাে, জনসংযােগে পারদর্শী এবং খুব চলতাফেরতা। অন্যটি হলাে অনভিজ্ঞ কিন্তু খুব সপ্রতিভ ও মেধাবী সাময়িক স্টাফ, যাদের একধরনের শিক্ষানবিশ বলা চলে। তাদের মধ্যে অনেকেই কালে নিয়মিত স্টাফ হিসেবে যােগ দেন। প্রত্যেক প্রতিনিধির নিজস্ব স্টাফ থাকে আর তাঁদের নিয়েই হলাে তাঁর দপ্তর। এই দপ্তরে যত কাজ হয়, পরিষদের মেঝেতে বা গ্যালারিতে তার তুলনায় অতি সামান্যই হয়। সেখানে হয় বক্তৃতা, যার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দপ্তরে এবং ভােট প্রদান, যার জন্য সব তদবির হয় দপ্তরে।
মাত্র একটি সুরম্য প্রাসাদে হলাে পরিষদের দুই কক্ষ। কিন্তু দপ্তরগুলাে ছড়িয়ে আছে আরও পাঁচটি প্রাসাদে। ১০০ জন সিনেটর এবং ৪৩৫ জন প্রতিনিধির দপ্তর এই বিরাট কমপ্লেক্সে । তারা সারা বছর এখানে কাজ করেন, গ্রীষ্মে কদিন ছুটি আর আছে ছােট ছােট বিরতি। তারা সবাই নিয়মিত বেতন পান, মন্ত্রীদের চেয়ে। সামান্য কম তাদের বেতন। প্রতিনিধিদের নিজস্ব স্টাফ ছাড়াও কমিটিগুলাের স্টাফও রয়েছে। যখন চেয়ারম্যানের পরিবর্তন হয়, বিশেষ করে একদল থেকে আরেক দলে, তখন স্টাফেরও পরিবর্তন হয় কিছুটা।
১০৩
সাধারণত প্রতিনিধিরা যত গুণী, তাঁদের স্টাফও তত মেধাবী ও সপ্রতিভ। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলাে সিনেটর ও প্রতিনিধিদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য। সিনেটররা প্রায়ই অনেক বেশি শিক্ষিত এবং তাদের চিন্তার পরিধি অনেক বিস্তৃত। ১৯৭১ সালে কয়েকজন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানকে আমার ঘনিষ্ঠভাবে চেনার সুযােগ হয়। সিনেটর স্যাক্সবি, হ্যারিস, কেইস ও মন্ডেইলের কথা আগেই বলেছি। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তাঁর পরিবারের নামেই সমধিক পরিচিত। অতি অল্প বয়সে তাঁর ভাই প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির শূন্য আসনে তিনি সিনেটর নির্বাচিত হন ১৯৬২ সালে। তবে সিনেটে বস্তুতই কঠিন শ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি নিজস্ব উচ্চাসন প্রতিষ্ঠা করেন। জনস্বাস্থ্য, প্রবাসন ও শরণার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মানবাধিকার—এসব বিষয়ে তাঁর বিশেষ অবস্থান ও বক্তব্য সর্বত্র সমাদৃত। একসময় অত্যধিক মদ্যপান ও মেয়েমানুষে আসক্তি নিয়ে তার বদনাম ছিল । কিন্তু সিনেটের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলিতে তাঁর ভূমিকা তার শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারত না। ১৯৮০ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে স্বদলীয় প্রেসিডেন্ট কার্টারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন, তবে তারপর আর কোনাে প্রচেষ্টা চালাননি। ১৯৮৮ সালে সিনেটে তাঁর রজতজয়ন্তী উদ্যাপিত হয়। সেই উপলক্ষে বােস্টনে এক বিশেষ উৎসবের আয়ােজন হয়, সেখানে এক নৈশভােজে তাঁর গুণমুগ্ধ খ্যাতনামা এবং অনেক অচেনা মানুষ তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে। এই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হবার এবং হাজিরা দেবার সুযােগ আমার হয়েছিল ।
সিনেটর কেনেডি একজন সুবক্তা। ১৯৭২ সালে ডেমােক্রেটিক কনভেনশনে। তিনি দলীয় প্রার্থী সিনেটর ম্যাকগভার্নকে পরিচয় করিয়ে দেন। এমন সুন্দর বক্তৃতা, যেমন বক্তব্যে, তেমন পরিবেশনায়, আমি খুব কম শুনেছি। আমাদের দেশে সুন্দর বক্তৃতা দেবার একটি রেওয়াজ ছিল এবং অনেক বক্তা এ ব্যাপারে কঠোর অনুশীলন করতেন। আমাদের ছাত্রবেলায় এ ধরনের সুন্দর বক্তৃতা দিতেন শেরেবাংলা ফজলুল হক, উপাচার্য ওয়াল্টার জেনকিনস, অধ্যাপক খালেদ বিন সাইদ, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মুরশেদ। সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ ছিলেন বাংলাদেশের আরেক বন্ধু । আইডাহাে আলু উৎপাদনে প্রসিদ্ধ, সিনেটর এ রাজ্যের প্রতিনিধি ছিলেন এবং তাঁর মনােগ্রামে সম্ভবত আলুর ছবি পরিস্ফুটিত হতাে। চার্চকে অনেকে বলতেন সিনেটের কুলীন সদস্য—ব্রাহ্মণ । তিনি ভারতের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। রক্ষণশীল একটি রাজ্যের তিনি ছিলেন অতি প্রগতিশীল প্রতিনিধি। মুক্তচিন্তা, পরিচ্ছন্ন রাজনীতি এবং যুক্তিবাদী অবস্থান ছিল তার শক্তির উৎস। তিনি একসময় একটি বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান হন। এই কমিটির কাজ ছিল আমেরিকার সমুদয় বিশেষ ও জরুরি আইনের হিসাব নেওয়া এবং তাদের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে এর জঙ্গল সাফ করা ।
১০৪
একদিন তিনি বললেন যে এমন সব জরুরি আইনের তথ্য তিনি পেয়েছেন, যা গৃহযুদ্ধের সময় (১৮৬১-৬৫) বা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৮) সাময়িকভাবে জারি করা হয়েছিল কিন্তু তখনাে বহাল রয়ে গেছে। মানবাধিকারের রক্ষাকবচ হলাে সতর্কতা এবং নিজের অধিকার সম্বন্ধে সদা সজাগ থাকা। জরুরি আইন মূলতই মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং তা এস্টাবলিশমেন্টের পছন্দ। সুতরাং সজাগ না থাকলে এগুলাে বহাল থাকে এবং ক্রমে নিয়মিত জীবনের অঙ্গ হয়ে যায়। মার্কিন মুলুকে যেখানে গণতন্ত্র শক্তিশালী, সরকারি বিধিনিষেধ তত কঠোর নয়, জনগণ শিক্ষিত ও স্বাতন্ত্রবাদী এবং সুশীল সমাজের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান কাজ করে, সেখানে জরুরি আইনের বাড়াবাড়ির যে চিত্র সিনেটর চার্চ আবিষ্কার করেন, তা ছিল বস্তুতই ভাবনার বিষয়। সিনেটর ফুলব্রাইট অবসর নিলে তার জায়গায় সিনেটর চার্চ সিনেট পররাষ্ট্র কমিটির চেয়ারম্যান হন। তবে ১৯৮৫ সালে তিনি ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেন।
সিনেটর চার্চের সহযােগী ছিলেন তরুণ টমাস ডাইন। টমাস ডাইন অল্প বয়সে ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেস্টার বাউলসের স্টাফ ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সিনেটর কেনেডির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অভিযানের স্টাফ হন এবং তারও পরে মার্কিন বিভিন্ন ইহুদি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হন। এরপর তিনি হন ক্লিনটন প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা, ইউএসএইডের সহকারী প্রশাসকদের একজন। টম ও তার স্ত্রী জোন ছিলেন বাংলাদেশ সংগ্রামের নিবেদিত মুক্তিযােদ্ধা। আরও দুজন সিনেটর ছিলেন আমার খুব শ্রদ্ধেয়, জর্জ ম্যাকগভার্ন ও চার্লস পার্সি। দক্ষিণ ডাকোটার সিনেটর জর্জ ম্যাকগভার্ন ছিলেন একজন। নীতিমান জননেতা। একজন ধর্মপ্রচারকের ছেলে, তার মধ্যে ছিল পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। তার সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনবরত কথা বলা যেত এবং তাঁকে মনে হতাে শিশুর মতাে সরল এক ব্যক্তি।
তিনি ১৯৭২ সালে ডেমােক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন লাভ করেন, তবে নিক্সনের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। ইলিনয় রাজ্যের সিনেটর চার্লস পার্সি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী একজন রাজনীতিবিদ। অল্প বয়সে তিনি ব্যবসায় যশ লাভ ও আর্থিক উন্নতির শিখরে পৌছান, সম্ভবত ইলেকট্রনিকসের হিউলেট পাকার্ভ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পরিচালক হন। তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রগতিশীল গােষ্ঠীতে অবস্থান নেন। একসময় প্রেসিডেন্ট পদের জন্যও বিবেচিত হন। তাঁর। সহকারী স্কট কোহেন আমাদের বন্ধু ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনিও বােধ হয় প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ ছাড়া আরও ডজনখানেক সিনেটর এবং তাঁদের সহকারী আমাদের শুভানুধ্যায়ী ও বন্ধুর ভূমিকা গ্রহণ করেন। আমি নিজে তত কংগ্রেসম্যান চিনতাম না। শুধু কর্নেলিয়াস গালাগারের
১০৫
সঙ্গে খুব সখ্য গড়ে ওঠে এবং ১৯৭৪ সালে তাঁর নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বে আমি তার অভিযানের একজন প্রধান সদস্য ছিলাম। গালাগার নানা মােকদ্দমায় জড়িয়ে পড়লে আর নির্বাচন করতে পারেননি এবং কিছুদিন বােধ হয় কারাবাসও করেন। তাঁর সহকারী চার্লস উইটার ছিলেন আমাদের ফজলে বারীর বন্ধু এবং বাংলাদেশ সংগ্রামের নিবেদিত একজন মুক্তিযােদ্ধা। চার্লস তােতলা ছিলেন কিন্তু তাঁর অনন্ত কর্মক্ষমতা ও চৌকশ বুদ্ধি তাঁর এই দুর্বলতাকে সহজেই ঢেকে রাখত। বছরের শেষের দিকে কংগ্রেসম্যান জেমস কোরমান (ক্যালিফোর্নিয়া ডেমােক্র্যাট), পল ম্যাকলেস্কি (ক্যালিফোর্নিয়া রিপাবলিকান) এবং হেনরি হেলস্টোস্কির (নিউজার্সি ডেমােক্র্যাট) সঙ্গে আমার বেশ পরিচয় হয়। জিম কোরমান ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন। পল ম্যাকলােস্কি ও হেনরি হেলস্টোস্কি বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন স্বীকৃতিদানের পক্ষে ডিসেম্বরেই দাবি তােলেন। ম্যাকলােস্কি পরে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতেও প্রয়াস পান।
কংগ্রেসের কমিটিগুলাে খুবই ক্ষমতাশালী। নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়াও যেকোনাে আইন প্রণয়নে তাদের ক্ষমতা অসীম। প্রেসিডেন্ট বাজেট বিল প্রণয়ন করেন কিন্তু কংগ্রেসের কমিটি (সিনেটে ও হাউসে) যেভাবে বাজেট কাটছাট করে, পরিবর্তন বা সংশােধন করে, সেটাই শেষ পর্যন্ত পরিষদে বিবেচিত হয়। দুই পরিষদের অভিমত ভিন্ন হলে আবার দুই কমিটি কনফারেন্সে বসে তার সমাধান করে। যেকোনাে বিষয় বিবেচনা উপলক্ষে এসব কমিটি শুনানির ব্যবস্থা করে। শুনানিতে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দেন এবং কমিটি অন্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য শােনে। সদস্যরা মন্তব্য করেন, নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে তথ্য আদায় করেন, তারপর তাদের প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পরিষদে বিবেচনার জন্য পাঠান। সাধারণত এসব শুনানি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, তবে মাঝেমধ্যে গােপন অধিবেশন হয়। এক্সিকিউটিভ অধিবেশনের আলােচনা গােপনীয় থাকে। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে অনেক শুনানি হয়। সিনেট পররাষ্ট্র কমিটি, শরণার্থী সাব-কমিটি, হাউস পররাষ্ট্র কমিটি (এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সাব-কমিটি) এসব শুনানির আয়ােজন করে। প্রথম শুনানি হয়। হাউস সাব-কমিটিতে, যার চেয়ারম্যান ছিলেন কর্নেলিয়াস গালাগার এবং সর্বশেষ শুনানি হয় সিনেট পররাষ্ট্র কমিটিতে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে।
১১ মে গালাগার সাব-কমিটির শুনানি শুরু হয়। প্রথম দিন তাতে বক্তব্য দেন। চেয়ারম্যান গালাগার ও সিনেটর কেনেডি। বাংলাদেশের অবস্থা এবং বিশেষ করে শরণার্থী ও ত্রাণসমস্যার ওপর ছিল এই শুনানি। শুনানিতে অনেকের মধ্যে দূতাবাসের কর্মচারী আবদুর রাজ্জাক খান উপস্থিত ছিলেন। রাজ্জাক পঞ্চাশের দশকের শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লন্ডনে যান ব্যারিস্টার হবার
১০৬
উদ্দেশ্যে। পরে তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং পড়াশােনা ছেড়ে দিয়ে দূতাবাসে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার চাকরি নেন। তাঁর সঙ্গে আমেরিকার পাকিস্তানি ছাত্রগােষ্ঠীর যােগাযােগ ছিল ঘনিষ্ঠ। ১১ মে রাজ্জাক দূতাবাস থেকে ছুটি নিয়ে গালাগার শুনানিতে যান। কিন্তু পাকিস্তান তখন একেবারে মারমুখাে । তাই রাজ্জাককে দূতাবাস ১৭ তারিখে বরখাস্ত করে। রাজ্জাক বাংলাদেশ লিগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চাকরিমুক্ত হয়ে তিনি সিআরএল গ্রুপের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, রেহমানের সহকারী হিসেবে কাজ করেন, বাংলাদেশ ইনফরমেশন। সেন্টারের প্রতিষ্ঠাকালে তিনি এতে কাজ করেন।
আগস্ট মাসে বাংলাদেশ মিশন স্থাপিত হলে তিনি সেখানে যােগ দেন এবং বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরে পরে আত্তীকৃত হন । কিছুদিন নিউইয়র্কে স্থায়ী মিশনে কাজ করার পর তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যােগ দেন। অবশেষে সেখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে নিউইয়র্কে স্কার্সডেলে বসবাস করছেন। তাঁর স্ত্রী জাকিয়া আমেরিকায় পড়াশােনাকালে কলেজ-রানি হিসেবে নাম করেন। তিনি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করে অবসরে গেছেন। কখনো কখনাে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ পরিবেশন বা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। গালাগার শুনানির দ্বিতীয় অধিবেশন হয় ২৫ মে এবং সেখানে সাক্ষ্য দেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক গিডন গটলিয়েব এবং হার্ভার্ডের অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যান। গালাগার জুনের শুরুতে ভারতে যান এবং বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ঘুরে বেড়ান। তিনি শরণার্থীদের দেশত্যাগ ও দুর্দশার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন। ১০ জুন তিনি কংগ্রেসে এ বিষয়ে বিস্তৃত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আমার ১২ বছর পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির অভিজ্ঞতায় এমন দুরবস্থা আমি আর কখনাে দেখিনি । পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার সমাধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একার ক্ষমতায় নেই। তবে এটি পাকিস্তানের একার কোনাে অভ্যন্তরীণ বিষয়ও নয়। এটি উপমহাদেশের শান্তি বিপর্যস্ত করেছে। সেখানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। মানুষের মানবিক অনুভূতির প্রতি শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এবং মানবজাতির সামনে একটি ভয়ংকর ও দুরূহ নৈতিক প্রশ্ন তুলে ধরেছে।
জুন মাসের শুরুতেই ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইনের সংশােধনী নিয়ে আলােচনা শুরু হলাে। টমাস ডাইন আর মাইক গার্টনার সিআরএল গােষ্ঠীর সঙ্গে বসে কৌশল নির্ধারণে ব্রতী হলেন। জেরি টিংকার, ডেল ডিহান ও আর্ট কুল তাতে যােগ দিলেন। আর্থার কুল, যাকে আর্ট কুল বলে ডাকা হতাে, ছিলেন সিনেট পররাষ্ট্র কমিটির ডাইরেক্টর এবং সিনেটর ফুলব্রাইটের উপদেষ্টা।
১০৭
সিনেটে চার্চ ও স্যাক্সবি হবেন এই সংশােধনীর উদ্যোক্তা। জন রােডি ও কর্নেলিয়া দুজনের কাছেই তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলেছেন। হাউসেও একটি সংশােধনীর প্রয়ােজন। ফজলে বারী গালাগারের দপ্তরে আগেই তদবির করে গেছেন। গালাগার ভারত থেকে ফিরে এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে রাজি হলেন। তবে তাঁর সহযােগীদের মধ্যে আরও উদ্যোক্তা বের করতে হবে। বাংলাদেশ লিগ ও তাদের সমর্থক এবং সিআরএল গােষ্ঠী এই উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি পরিষদে জোরেশােরে লবি করতে শুরু করল। অবশেষে সিনেট পররাষ্ট্র কমিটি এ বিষয়ে শুনানির ব্যবস্থা করল এবং স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী পেশ হলাে ১০ জুন। ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টের ওপর কমিটি শুনানি গ্রহণ করে ১০, ১১ ও ১৪ জুন। জন রােডি এই শুনানিতে সাক্ষ্য দেন এবং সংশােধনীতে বলা হয় যে পাকিস্তানে সব রকমের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত রাখা হবে। তা পুনরারম্ভের শর্ত হবে, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছে এবং ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা ফিরে আসতে এবং তাদের জমিজমা ও সম্পত্তি ফিরে পেতে সক্ষম হচ্ছে। অবশ্য ত্রাণকাজের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানে প্রদত্ত সাহায্য বহাল থাকবে।
১৭ জুন হাউসে কর্নেলিয়াস গালাগার অনুরূপ আরেকটি সংশােধনী উত্থাপন করলেন। অবশ্য এটি একটু নমনীয় ছিল, এতে সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে তত কড়াকড়ি ছিল না। অর্থাৎ সামরিক ঋণের খাতে বিক্রয় বা সরবরাহ এবং সার্ভিস প্রদান স্থগিত রাখা হয়নি। এই সংশােধনী পাস করবার জন্য শুরু হলাে তদবির এবং এর জন্য লবি করা হলাে পরবর্তী পাঁচ মাসে বাঙালি ও তাদের মার্কিন সমর্থকদের প্রধান কর্তব্য। এ কাজেই ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারের সৃষ্টি হয় এবং এ কাজেই আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশ মিশন বিশেষভাবে ব্যস্ত থাকে। এই সংশােধনী নিয়ে আমরা নানা ব্রিফিং নােট, প্রতিবেদন, যুক্তিজাল ইত্যাদি প্রস্তুত করি। সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের এবং তাদের সহকারীদের সম্বন্ধে অভিমত লিপিবদ্ধ করে কার্ড বানাই। তাঁদের কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, তার জন্য কৌশল রচনা করি। এ কাজে প্রধান উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার এবং সিনেটে আমাদের বন্ধুস্থানীয় কতিপয় সিনেটরের সহকারীরা। সিআরএল গােষ্ঠীর কথা তৃতীয় অধ্যায়ে কিছুটা আলােচনা করেছি। কর্নেলিয়া রােডি ওয়াশিংটনে আসার। পর রীতিমতাে একটি লবিস্ট এজেন্সি সংগঠনের চিন্তাভাবনা চলে। বােস্টন থেকে আনা টেইলর ও ডেভিড ন্যালিন এবং শিকাগাে থেকে রন ইন্ডেন ওয়াশিংটনে। এসে এই উদ্যোগে শামিল হন। বাংলাদেশ লিগের বিবেচনায়ও এ রকম একটি
১০৮
সংগঠনের গুরুত্ব প্রাধান্য পায়। এ বিষয়ে নেতৃত্ব দেন উইলিয়াম গ্রিনাে। ১১ জুন এই উদ্যোগ একটি নির্দিষ্ট সংগঠনের রূপ নেয়।
গ্রিনাে ও রােডি দম্পতি ওই তারিখে একটি নিউজ লেটার প্রচার করেন। এই চিঠিটি ডা. গ্রিনের বাড়ির ঠিকানা ১২০৩ পপলার হিল রােড, বাল্টিমাের থেকে প্রচারিত হয়। এতে বলা হয় যে কংগ্রেসে বাংলাদেশ সমস্যা যথেষ্ট সহানুভূতি উদ্রেক করতে সক্ষম হয়েছে এবং তার জন্য সংবাদ সরবরাহ ও তদবির অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু হােয়াইট হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে কোনােমতেই কূলকিনারা মিলছে না। এতে সংবাদ সরবরাহ ও তদবির বজায় রাখার জন্য অর্থসাহায্য চাওয়া হয় এবং বলা হয় যে ওয়াশিংটনে এ জন্য অচিরেই একটি কেন্দ্রীয় দপ্তর স্থাপন করা হবে। সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা যখন বাংলাদেশ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন, তখন সহজেই বােঝা যায় যে বাংলাদেশ ও তার সমস্যা সম্বন্ধে কংগ্রেস ও অন্যান্য মহলকে আরও ওয়াকিবহাল করতে হবে এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাবলির খবরাখবর সরবরাহ করতে হবে। এক হিসাবে খবরই সত্যিকার ক্ষমতা। তাই এর বিস্তারই হয় সিআরএল গােষ্ঠীর লক্ষ্য। এই চিঠিতে কংগ্রেসে সংশােধনী উদ্যোগের কথা বলা হয় এবং এ বিষয়ে প্রতিনিধিদের সঙ্গে তদবির করার জন্য তাঁদের একটি ফর্দও সরবরাহ করা হয়। কিছুদিনের মধ্যে ওয়াশিংটনে যে একটি শক্তিশালী লবিং প্রচেষ্টা পরিচালনা করা হয়, এভাবেই হলাে তার সূচনা।
পরবর্তী নিউজলেটার প্রচারিত হলাে ২৩ জুন এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার খবর এতে দেওয়া হলাে। একই সঙ্গে সূচনালগ্ন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত এই উদ্যোগের জন্য প্রাপ্ত চাঁদা ও ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হয়। মােট প্রাপ্তি ছিল ১০৫২ ডলার আর ব্যয় ছিল ৮৩৩ ডলার ১০ সেন্ট। ২৪ জুলাই সেন্টারের তরফ থেকে প্রথম নিউজলেটার প্রচারিত হলাে। এটা প্রচার করেন ৪১৮ সিওয়ার্ড স্কয়ার (অ্যাপার্টমেন্ট ৪), ওয়াশিংটনে প্রতিষ্ঠিত সেন্টারের তরফ থেকে আনা টেইলর, উইলিয়াম গ্রিনাে, ডেভিড ন্যালিন ও মহসিন সিদ্দিক। এতে বলা হয় যে সেন্টারটি হবে একটি ক্লিয়ারিং হাউস এবং সমুদয় লবিং কাজের সমন্বয়কেন্দ্র। এটি হবে সব বাংলাদেশ সমিতি ও সমর্থক গােষ্ঠীর সম্মিলিত কেন্দ্রীয় দপ্তর। স্বেচ্ছাসেবীদের সেন্টারের জন্য কাজ করতে আহ্বান জানানাে হয়। প্রথম স্বেচ্ছাসেবী দলে ছিলেন আনা টেইলর (সার্বক্ষণিক), ডেভিড ন্যালিন (খণ্ডকালীন) এবং অনিয়মিতভাবে ডা. গ্রিনাে, মহসিন সিদ্দিক, মুহাম্মদ ইউনূস ও ফরহাদ ফয়সল। বাংলাদেশের খবর, কংগ্রেসে উদ্যোগ, বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকাণ্ড—সবকিছু নিয়ে এই নিউজলেটার প্রস্তুত করা হয়। পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই
১০৯
চিঠিতে বিভিন্ন মার্কিন সমুদ্রবন্দর থেকে যেসব জাহাজ সমরাস্ত্র নিয়ে যেতে পারে, তার একটি নির্ঘণ্ট প্রকাশ করা হয় এবং এগুলােকে পিকেট করার আহ্বান। জানানাে হয়।
একই সময়ে ফিলাডেলফিয়ায় বাঙালি এবং তাঁদের মার্কিন বন্ধুরা মিলে ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল নামে একটি সংগঠন স্থাপন করেন। তাঁদেরও উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সম্বন্ধে প্রচার, বাংলাদেশের জন্য জনসমর্থন আদায় এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য প্রদান। এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন নিউজার্সির মজহারুল হক ও ফরিদা হক, অধ্যাপক চার্লস কান, ক্লাউস ক্রিপেনডর্ফ এবং সুলতানা আলম, মােনায়েম চৌধুরী ও রওশন আরা চৌধুরী । মজহারুল হক (টুনু হক নামে সমধিক পরিচিত) বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দুই ক্লাস ওপরে পড়তেন, ফরিদা দুই ক্লাস নিচে। তাঁরা সেই পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি আমেরিকায় পাড়ি জমান। এখন ওয়াশিংটনের শহরতলিতে থাকেন। প্রাক-বাংলাদেশ যুগে যত মধ্য ও উচ্চবিত্ত বাঙালি আমেরিকায় গেছেন, নিউজার্সিতে হক দম্পতির বাড়ি হয়েছে তাদের একটি আড্ডাখানা। তিনি ১৯৭১ সালে বৃহত্তর ডেলাওয়ার উপত্যকার বাংলাদেশ লিগের সভাপতি হন। চার্লস কান ছিলেন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক। তিনি হন ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গলের সভাপতি। ক্লাউস ক্রিপেনডর্ফ ছিলেন আরেকজন অধ্যাপক এবং তখন তাঁর স্ত্রী ছিলেন। সুলতানা আলম। ক্লাউস বােধ হয় এখনাে ফিলাডেলফিয়ায় আছেন। মােনায়েম চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা, তখন পেনসিলভানিয়ায় উচ্চশিক্ষায় রত । তিনিও এখন পেনসিলভানিয়ার অধিবাসী। বােধ হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এ ছাড়া আরও বাঙালি অনেকেই ছিলেন, গােটা তিরিশেক পরিবার।
মার্কিন মহলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছাড়া একটি বড় সমর্থক গােষ্ঠী ছিল কোয়েকার ধর্মীয় গােষ্ঠী, যাদের নেতা ছিলেন উইলিয়াম টেইলর। তাঁরা এপ্রিলেই সংগঠিত হতে থাকেন, যদিও সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ২৪ জুন। তারা নিউইয়র্কে ও ওয়াশিংটনের সব উদ্যোগে অংশ নিতেন, নিজেরা নিউজলেটার প্রকাশ করতেন, আলােচনা সভা ডাকতেন। তাঁদের অন্যতম অবদান ছিল পাকিস্তানে সমরাস্ত্র জাহাজীকরণের প্রতিবাদ এবং এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। মার্কিন লংশােরম্যানরা কোনাে জাহাজে পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র ওঠাবেন না বলে একটি সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল ফিলাডেলফিয়ার জোর তদবির; তাঁদের হয়ে সুলতানা মায়ামিতে লংশােরম্যানদের বার্ষিক সম্মেলনে হাজির হয়ে বক্তব্য দেন। ১২ জুন তাঁরা নিউইয়র্কের বিক্ষোভে যােগ দেন। ওখানে ভারতের সর্বোদ নেতা জয় প্রকাশ
১১০
নারায়ণ বক্তব্য দেন। ১১ জুলাই তাঁরা বাল্টিমােরে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মার লােডিং বন্ধ রাখেন এবং ২৯ জুলাই ফিলাডেলফিয়ায় অহিংস ফ্লোটিলা অভিযান চালান। ছােট ছােট ডিঙির শােভাযাত্রা পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র লােডিং বন্ধ করে দেয়। আগেই বলেছি যে সিউয়ার সিটি বিক্ষোভে তারা বিশেষ অবদান রাখেন। এ দুটি সংগঠন সারা বছর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। অবশ্য এরা ছাড়াও অনেক শহরে আরও অনেক সমর্থক গােষ্ঠী নানা রকম অবদান রাখে। ফিলাডেলফিয়ায় প্রায়ই তহবিল আদায় বা প্রচারসভার জন্য নানা রকম অনুষ্ঠান আয়ােজিত হতাে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এদের দুটি উদ্যোগে হাজির ছিলাম। একটি ছিল তহবিল আদায়ের জন্য ১৭ সেপ্টেম্বরের নৈশভােজ এবং অন্যটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ ও ৯ অক্টোবরের শিক্ষাসভা।
মার্কিন সরকার শুরু থেকেই পাকিস্তানের প্রতি নমনীয় ভাব গ্রহণ করে। এ রকম বর্বরতা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য নিন্দা তাে দূরের কথা, কোনাে রকমের উদ্বেগ প্রকাশেও সরকারের কুণ্ঠা ছিল। এর বিরুদ্ধে শুধু কংগ্রেস ও সংবাদমাধ্যমই সােচ্চার ছিল না, সরকারি কর্মচারীরাও ছিলেন ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী। তৃতীয় অধ্যায়ে ঢাকার কনসাল জেনারেল ও তার সহকর্মীদের ভিন্নমতের বার্তার কথা বলেছি। তবে মার্কিন সমরাস্ত্র ব্যবহার নিয়ে সাধারণ উদ্বেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সরকার ঘােষণা করে, কোনাে সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে না এবং হবেও না। এ ঘােষণা স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ১৫ এপ্রিল দেওয়া হয় ।
১৯৬৫ সালের সমরাস্ত্র সরবরাহের নিষেধাজ্ঞার পর ১৯৭০ সালে একবারের জন্য রেয়াতের কথা প্রথম অধ্যায়ে আছে। এ বিষয়ে কংগ্রেস খুব সক্রিয় থাকে এবং তাই নির্বাহী বিভাগের তরফ থেকে বারবার বলা হয় যে বস্তুতপক্ষে ২৫ মার্চের পর সব সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে, যদিও সরবরাহের সামগ্রী ছিল যৎসামান্য। কিন্তু এই ঘােষণা বা অঙ্গীকার ছিল মিথ্যা এবং এ বিষয়ে হােয়াইট হাউস ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের মধ্যে নীতিগত মতৈক্য ছিল না। স্টেট ও ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট বােধ হয় সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখতেই চেয়েছিল কিন্তু নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির ভাবনা ছিল অন্য রকম। প্রথমত, যেসব চুক্তি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, তার অধীনে সরবরাহ বন্ধ রাখার কোনাে ইচ্ছা তাদের ছিল না। দ্বিতীয়ত, কোনাে উপায়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করা ছিল। তাদের উদ্দেশ্য। তৃতীয়ত, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অস্ত্র পাচার করার কথাও নিক্সন। বিবেচনা করতে নির্দেশ দেন। এসব তথ্য অবশ্য অনেক পরে জানা যায়, বিশেষ করে যুদ্ধ শেষে এন্ডারসনের প্রতিবেদন থেকে।
জুন মাসে সৌভাগ্যবশত এই মিথ্যা ভাষণের প্রমাণ আমাদের হস্তগত হয় । দূতাবাসে কর্মরত সােলায়মানের মাধ্যমে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহের বিল অব
১১১
লােডিংয়ের খসড়া বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারে পৌছে যায়। সাজেদা সােলায়মান এই খসড়া জোগাড় করেন এবং এনায়েত রহিম এটি ডা. গ্রিনাে ও টমাস ডাইনের কাছে পৌছে দেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর টেড শুলজ এই তথ্য পেলেন ডা. গ্রিনাের কাছে। তারপর তিনি অনেক অনুসন্ধান করে ২২ জুন তাঁর প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তারপরও তিনি ২৫ ও ২৯ তারিখে আরও দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ২২ জুন প্রথম খবর পাওয়া গেল যে পদ্ম জাহাজ সমরাস্ত্র নিয়ে গত রাতে পাকিস্তানের পথে রওনা হয়েছে এবং সুন্দরবন জাহাজ আরও সমরাস্ত্র নিয়ে ৮ মে নিউইয়র্ক ছেড়েছে। পদ্মার ছবিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ২৫ মের খবরে জানা গেল যে এ ছাড়া আরেকটি জাহাজ কাউখালীও নিষেধাজ্ঞা ঘােষণার পর ২ এপ্রিলে নিউইয়র্ক ছাড়ে। ২৯ এপ্রিল জানা গেল যে আরও সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হবে। শুধু নতুন কোনাে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না, তবে আগে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার অধীনে সরবরাহ আটকানাে হবে না এবং তা সহজসাধ্যও নয়। সমরাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে মিথ্যা ভাষণ শুধু সংবাদমাধ্যমে নয়, কূটনৈতিক মহলে এবং বিশেষ করে কংগ্রেসে প্রচণ্ড উত্মা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
সিনেটর কেনেডি তার শরণার্থী সাব-কমিটির শুনানির ব্যবস্থা করেন ২৮ জুন। এতে সাক্ষ্য দেন নির্বাহী বিভাগের অনেক কর্মকর্তা, স্টেট, এইড ও ডিফেন্সের কর্মকর্তারা। যদিও শরণার্থীদের নিয়ে, তাদের অবস্থা, ক্যাম্পে দুর্দশা, বাংলাদেশের বিভীষিকা থেকে পলায়ন এবং ত্রাণকাজের ব্যবস্থা ও অর্থায়ন নিয়েই ছিল মূল আলােচনা; সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে অব্যাহত মার্কিন সমরাস্ত্র সরবরাহ। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ক্রিস ভান হােলেন স্বীকার করলেন যে তারা যখন নিষেধাজ্ঞার কথা ঘােষণা করেন, তখন সম্পাদিত চুক্তির অধীনে সরবরাহ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন না। তিনি আরও বলেন যে আরও কিছু সমরাস্ত্র (যদিও যৎসামান্য) সম্ভবত জাহাজজাত হবে, তবে নতুন কোনাে নিকাশপত্র বা লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না বা পুরােনাে লাইসেন্স নবায়িত হচ্ছে না। সমরাস্ত্র সরবরাহ অক্টোবরের ৮ তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কিসিঞ্জার এ ব্যাপারে ডিসেম্বরে কৈফিয়ত দিয়ে বলেন যে সমরাস্ত্র সরবরাহ অত্যন্ত গৌণ বিষয় ছিল এবং ৩৫ মিলিয়ন ডলারের সরবরাহ বন্ধ করা হয় শুধু, চার-পাঁচ মিলিয়ন ডলারের সরবরাহ অব্যাহত থাকে। কিসিঞ্জারের কূটনীতিতে নৈতিকতার কোনাে স্থান নেই বলে বিষয়টি তার কাছে অত্যন্ত গৌণ বলে মনে হয়। একটি ঘাতক গােষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ করা, তা যতই সামান্য হােক না কেন, কী রকম জঘন্য কাজ, সেই বােধটিই নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির নির্মম কূটনীতিতে ছিল না।
সিনেটর কেনেডি তাঁর সাব-কমিটির দ্বিতীয় শুনানির ব্যবস্থা করেন জুলাই মাসের ২২ তারিখে। এবার শরণার্থী শিবিরগুলােতে ব্যাধি ও ক্ষুধা এবং
১১২
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ছিল প্রধান আলােচ্য বিষয়। এতে সাক্ষ্য দেন। স্টেটের আন্ডারসেক্রেটারি জন আরউইন এবং শরণার্থীবিষয়ক সমন্বয়কারী ফ্যাঙ্ক কেলগ। এই শুনানি শেষে পাকিস্তান দূতাবাসের কাউন্সেলর আকরম জাকির সঙ্গে আমার সামান্য বচসা হয়। আকরম জাকি আমার অনেক দিনের পরিচিত। ১৯৫৩ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি বাংলাদেশে আসেন একটি ছাত্র শুভেচ্ছা মিশনের সদস্য হিসেবে। সিলেটে তিনি আমার আব্বার সঙ্গে পরিচিত হন এবং ঢাকায় তারা সবাই সলিমুল্লাহ হলে আমার আমন্ত্রণে অতিথি ছিলেন। আমি তখন হল। ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে তাঁদের দেখাশােনা করি। ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যােগ দেন। ১৯৫৮ সালে বিলেত থেকে দেশে ফেরার পথে আমি ব্রাসেলসে বিশ্ব শিল্পমেলা দেখতে যাই এবং বেশ কয়েক দিন ওখানে থাকতে বাধ্য হই। তখন ওখানে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন বগুড়ার সাত আনি বাড়ির হাবিবুর রহমান, যার ডাকনাম ছিল ভুলু মিয়া এবং আকরম জাকি ছিলেন তৃতীয় সচিব। আমি ব্রাসেলসে থাকতে প্রায়ই আকরম জাকির ওখানে আড্ডা জমাতাম এবং তখনই তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তী সময়ে করাচিতে যখন চাকরি করতাম, তখন আবার তার সঙ্গে যােগাযােগ হয়। আমরা তখন সিন্দ জাতীয় পরিষদ ভবনে কাজ করতাম—আকরম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আর আমি পরিকল্পনা কমিশনে।
বাঙালিদের বিশ্বাস করা যায় না বলে তাঁকে আনা হয় সাময়িকভাবে রাষ্ট্রদূতকে সাহায্য করতে। এবার তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ তেমন ছিল না, তবে তাঁর স্ত্রী দুএকবার যােগাযােগ করেন। শুনানি শেষে আকরম আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিযুক্ত করেন। আমি প্রত্যুত্তরে সহাস্যে বললাম যে আমার দেশপ্রেম অত্যন্ত খাটি আর তিনি একজন জালিমের ভূমিকা নিয়েছেন। আমি বেশ রূঢ়ভাবেই তাকে বললাম, তােমরা আমাদের দেশ থেকে বিদায় নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। শরণার্থী সাব-কমিটির স্টাফরা তখন আমাদের কাছে ভিড় করতে শুরু করেছে। আকরমকে তাঁর সহকারী কুতুবুদ্দিন আজিজ টেনে নিয়ে বিদায় হলেন। আকরমের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে দেখা ম্যানিলায়, সম্ভবত ১৯৭৫ সালে। তখন তিনি ওখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং আমি এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক। দুই দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক।
সমরাস্ত্র সরবরাহের বিস্তৃত বিবরণ যতই বেরােতে থাকল, কংগ্রেসে ধৈর্যচ্যুতির ব্যাপারটা ততই প্রকট হয়ে দেখা দিল। ১ জুলাই দুজন
১১৩
ম্যাসাচুসেটসের প্রতিনিধি ব্র্যাডফোর্ড মাের্স—যৌথভাবে সামরিক সাহায্য, বিক্রয় বা সরবরাহ বন্ধের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করেন। সিনেট প্রস্তাব নম্বর ১২৪ এবং হাউস প্রস্তাব নম্বর ৭৬৫। কিন্তু এসব কোনাে কিছুতেই সামরিক বর্বরতার প্রতি আমেরিকার সমর্থন শিথিল হলাে না। ডিসেম্বরের যুদ্ধের সময় দেখা গেল যে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ ইজারায় পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে। ইলিনয়ের সিনেটর আদলাই স্টিভেনসন (তৃতীয়) ১৪ ডিসেম্বর এই তথ্য ফাঁস করেন। কিসিঞ্জারের জবানিতে জানা যায় যে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সমরাস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য উদ্যোগ ছিল আণবিক অস্ত্রসজ্জিত জাহাজ এন্টারপ্রাইজের বঙ্গোপসাগরে যাত্রা। মন্টানার সিনেটর ইগলটন এ খবর প্রকাশ করেন ১৫ ডিসেম্বর। সত্যি সত্যিই ক্ষমতামদমত্ত এক জনবিচ্ছিন্ন জুটি তখন আমাদের তৃতীয় মহাযুদ্ধের মুখে। ঠেলে দিতে মােটেই দ্বিধান্বিত ছিল না।
টেড শুলজের খবর ছিল সামরিক বিষয়ে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের বিপদ দেখা দেয়। ২১ জুন প্যারিসে ছিল পাকিস্তান দাতাগােষ্ঠীর বৈঠক। এ জন্য পাকিস্তানে একটি ব্যাংক ফান্ড মিশন যায় মে মাসের শেষ দিনে এবং প্রায় ১২ দিন সেখানে থেকে সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। এই মিশনের নেতা ছিলেন খােদ পিটার কারগিল আর এর সদস্য ছিলেন মােট ১০ জন—দুজন ফান্ডের, দুজন ব্যাংকের ইসলামাবাদ দপ্তরের, দুজন ঢাকা দপ্তরের আর চারজন ওয়াশিংটন থেকে। তাদের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় জুলাই মাসে, তবে প্যারিসে কারগিল একটি মৌখিক বিবরণ দেন। প্রতিবেদনের মূল কথা ছিল বাংলাদেশে ভীতির রাজত্ব এবং অস্বাভাবিক অবস্থা। দাতাগােষ্ঠীর সভায় ঠিক হয় যে অবস্থা স্বাভাবিক না হলে কোনাে রকম অর্থনৈতিক সাহায্য কাজে আসবে না এবং পাকিস্তানও কোনাে রকমের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে পারবে না। সুতরাং ওই পর্যায়ে সাহায্যের বিষয়টি বিবেচনা করা সমীচীন হবে না এবং ঋণ রেয়াতির ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। শুধু মার্কিন সরকার ছাড়া কেউই পাকিস্তানের অনুরোধ বিবেচনা করতে রাজি ছিলনা। ২৬ তারিখে ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকার বার্নার্ড নসিটার খবর দিলেন যে কারগিলের বিবৃতি ছিল মারাত্মক, একেবারে বিধ্বংসী এবং আমেরিকাও শেষ পর্যন্ত সাহায্য স্থগিত রাখার ব্যাপারে রাজি হয়। ওয়াশিংটন পােস্ট সামরিক সরবরাহের খবরটি দিতে পারেনি। এবার তার খেসারত দিল তারা অর্থনৈতিক অঙ্গনের বিস্তৃত তথ্য সরবরাহ করে। তবে ২৩ তারিখে ওয়াশিংটন পােস্ট খুব সুন্দর একটি সম্পাদকীয় লিখেছিল যখন নিষেধাজ্ঞা একটি নিষেধাজ্ঞা নয়’ (When an Embargo is not an Embargo) শিরােনামে।
১১৪
মার্কিন সরকার কিন্তু নসিটারের বক্তব্য মানল না। শরণার্থী সাব-কমিটির শুনানিতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বক্তব্য হলাে যে অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত রাখা। তারা সমর্থন করে না এবং মার্কিন সাহায্য অব্যাহত থাকবে। বাস্তবে অবশ্য ১৯৭১ সালে কোনাে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি এবং ত্রাণকাজের জন্য যে সাহায্য দেওয়া হয়, তারও অতি নির্দিষ্ট ভাগ খরচ করা হয় । তবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বক্তব্য সর্বসাধারণের কাছে মােটেই গ্রহণযােগ্য ছিল না। ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজতার ওপর সম্পাদকীয় লিখল : ‘আরও বাঙালি হত্যায় সাহায্য (Helping to kill more Bengalis)। বার্নার্ড নসিটার ৮ জুলাই আবার খবর দিলেন যে বিশ্ব ব্যাংক পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে, তাতে তারা পাকিস্তানকে কঠোরভাবে সমালােচনা করেছে, যে কারণে প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারা ওই সাহায্য বিতরণ স্থগিত রেখেছেন।
আগেই বলেছি যে ব্যাংক মিশন বাংলাদেশে যাবার প্রাক্কালে মাইক উইহেন ও হেনরিক ভানডার হাইডেনের সঙ্গে আমার লম্বা আলােচনা হয়। তারা ফিরে এলে মাইক খবর দিলেন এবং তাঁর সঙ্গে এবং ম্যানফ্রেড ব্লোবেলের সঙ্গে পৃথকভাবে আমার আবার আলােচনা হলাে। ম্যানফ্রেড ব্লোবেল ছিলেন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। ব্লোবেল জানালেন যে দেশটির অবস্থা খুবই অনিশ্চিত এবং অর্থনীতি একান্তই অচল। এমতাবস্থায় পাকিস্তান কোনাে রকম অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যবহারই করতে পারবে না। তাদের ঋণ রেয়াতির আবেদন যৌক্তিক, কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে না এলে প্রয়ােজনীয় সংস্কারে হাত দেওয়া যাবে না। তাই ঋণের বােঝা লাঘব করলেও পাকিস্তানের ঋণ পরিশােধের ক্ষমতা বাড়বে না। সুতরাং এই মুহূর্তে দেশটিকে ঋণ রেয়াত দেওয়া যাবে না। ব্লোবেলের কথাবার্তায় সােজা ও পরিষ্কার বক্তব্য বেরিয়ে এল। ব্লোবেল। মােটামুটিভাবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে ভালাে ধারণা পােষণ করতেন। তাই তাঁর বক্তব্যে হতাশা এবং একধরনের ক্ষোভ সহজেই ধরা পড়ল ।
মাইক জার্মান হলেও অনেকটা হৃদয়তাড়িত মানুষ। মাইক আমার বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের কুশলবার্তা নিয়ে আসেন। মাইক বললেন যে তিনি মাহবুবুজ্জামানের সঙ্গে সিলেটে গিয়েছিলেন। মাহবুবুজ্জামান তখন চা বাের্ডের সভাপতি ছিলেন এবং বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসর নেন। পরে তিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সিলেটে তাঁরা এক রাত ছিলেন সার্কিট হাউসে। সেখানে নৈশভােজে জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় সেনাপতিদের সঙ্গে তাদের মােলাকাত হয়। মাইক বললেন যে সেনাধ্যক্ষরা তাদের মানুষ নিধনের কাহিনি নিয়ে গল্প করছিল আর তার ধারণা হলাে যে বিষয়টি তাদের জন্য ছিল একটি খেলা, যেন তারা পাখি শিকারে বেরিয়েছে। মাহবুবুজ্জামান নাকি তাদের
১১৫
ব্যবহার অপছন্দ করেন এবং তাদের দলাধিপতির কাছে অভিযােগ করেন। কৃষিসচিব সালাহউদ্দিন মিশনকে তাদের গর্বাধ্য বক্তব্য তুলে ধরেন, সভা শেষে নিরিবিলিতে তাঁকে বলেন যে সরকারি বক্তব্য ও বাস্তবের মধ্যে কোনাে সম্পর্ক নেই। সালাহউদ্দিন বাংলাদেশে সচিব হন এবং পরে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার উপপরিচালক হিসেবে অবসর নেন। সালাহউদ্দিন ২০১৬ সালে ওয়াশিংটনে ইন্তেকাল করেন।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন যে পাকিস্তানের কড়া সমালােচনা করবে, তাতে কোনাে সন্দেহ ছিল না। তবে নসিটারের খবরের পর সেই প্রতিবেদন জোগাড়ের হিড়িক পড়ে গেল। আমি দুটি প্রতিবেদনের খসড়া পেয়ে গেলাম হারুনের কাছে। একটি ছিল ভানডার হাইডেনের মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন। এটি ছিল অভ্যন্তরীণ একটি খসড়া । তিনি খুলনা, চালনা, যশাের আর কুষ্টিয়া গিয়েছিলেন এবং এসব জায়গায় কী দেখলেন, তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এই প্রতিবেদনটির তারিখ ছিল ২৩ জুন। অন্যটি ছিল কারগিল প্রতিবেদনের প্রাথমিক খসড়া। এটিকে খানিকটা সংশােধন করে কিছু কড়া মন্তব্য নমনীয় করে ১৫ জুলাই বিতরণ করা হয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেদন দুটি নিউইয়র্ক টাইমস-এর কাছে পৌছে দিই। ১৩ জুলাই টেড শুলজ আবার একটি মারাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন এবং তাতে কারগিল ও ভানডার হাইডেন প্রতিবেদন থেকে কিয়দংশ উদ্ধৃত করেন। এ দুটি প্রতিবেদন একই সঙ্গে আমি মুজিবনগরেও পাঠিয়ে দিই।
কিছুদিন পর খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকে অনুসন্ধান চালানাে হয়। গ্রেগরি ভােটা এ বিষয়ে আমাকে কিছু প্রশ্ন করেন। আমি পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে দিলেও বিশ্ব ব্যাংকে আমার যাতায়াত ছিল অবারিত। আমার মনে হলাে, বিল ম্যাকুলককে দোষী সাব্যস্ত করার জন্যই এই অনুসন্ধান পরিচালিত হয়। বিল সম্বন্ধে আগেই বলেছি যে তিনি খুব স্বাধীনচেতা লােক ছিলেন এবং উত্তেজিত হওয়া তার স্বভাবেই ছিল। সৌভাগ্যবশত এই প্রতিবেদন দুটো আমাকে বিলের কাছে চাইতে হয়নি। তাঁর কাছে চাইলে তিনি যেভাবেই হােক না কেন, তা আমাকে সরবরাহ করতেন। পাকিস্তান ডেস্কের সব কাগজপত্রই বিশেষ প্রকল্প বিভাগে বিতরণ করা হতাে। সেখান থেকে যে এগুলাে প্রকাশিত হতে পারে, অনুসন্ধানে সেদিকে মােটেই খেয়াল করা হয়নি। অনেকের ধারণা ছিল যে কারগিল এই প্রতিবেদনের প্রচার স্থগিত হলে বিরক্ত হন এবং নসিটারের সব তথ্য তাঁর কাছ থেকেই প্রচারিত হয়। এত বড় প্রতিষ্ঠানে যেখানে গােপনীয়তার কালচার তেমন শক্ত নয়, সেখানে এ ধরনের তথ্য ফাঁসের বিষয় মােটেও অস্বাভাবিক নয়। পাকিস্তানের নালিশের কারণেই অনুসন্ধানটি পরিচালিত হয়। তবে তাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
১১৬
বিশ্ব ব্যাংক মিশন ১৯টি জেলার ১২টিতে ভ্রমণ করে এবং বাংলাদেশের অবস্থার ৪টি বিশেষত্ব চিহ্নিত করে। প্রথমত, সারা দেশে ধ্বংসলীলার প্রধান হােতা ছিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। দ্বিতীয়ত, যােগাযােগ ও যানবাহনব্যবস্থা পুরােপুরি ব্যাহত। তৃতীয়ত, দেশ থেকে যানবাহন সব উধাও হয়ে গেছে। কিছু গেছে। বিদেশে, প্রচুর ধ্বংস হয়েছে আর বাকি চলে গেছে যুদ্ধসজ্জায় এবং সবশেষে দেশব্যাপী ভীতি ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ, যার প্রধান কারণ হচ্ছে সামরিক বর্বরতা ও নিষ্পেষণ । এর ফলে অর্থনীতি হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অচল এবং অদূর ভবিষ্যতে তার চাঙা হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা ছিল না। ভানডার হাইডেনের প্রতিবেদনটি ছিল মারাত্মক। খুলনা প্লাটিনাম চটকল এলাকা সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য ছিল যে এটি দেখে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি এলাকার কথা তার মনে হয়। কুষ্টিয়া যেন ছিল মহাযুদ্ধের বােমায় বিধ্বস্ত একটি এলাকা। সেখানকার অবস্থা ও অল্প কিছু বিহ্বল লােকজনকে দেখে মনে হয় আণবিক বােমাবর্ষণের পরবর্তী সকাল। কুষ্টিয়া যেন ছিল পাকিস্তানিদের ‘মাইলাই। ভিয়েতনামের মাইলাইতে মার্কিন সেনাবাহিনী উন্মাদের মতাে গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চালায় এবং তার জন্য সেনাবাহিনীর একজন। অধিনায়কের কোর্ট মার্শাল হয়। হাইডেন বিভিন্ন জায়গায় যান এবং সবখানেই দেখেন যে লােকজন সব পালিয়েছে এবং সরকারি কর্মচারীদের অনেকেই খুন হয়েছেন। এ দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির পক্ষেও পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান অসম্ভব হয়ে পড়ল।
কনসাের্টিয়ামের সভায় সাহায্য না মিললে পাকিস্তান সরকার কিছু বাঙালি দালালকে ওয়াশিংটনে পাঠাল বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে দেনদরবার করতে এবং মার্কিন মুলুকে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালাতে। ৩ জুলাই এলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন ও বিচারপতি নুরুল ইসলাম। সাজ্জাদ তখন রাজশাহী থেকে এসে ঢাকায়। উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছেন আর নুরুল ইসলাম হয়েছেন রেডক্রসের সভাপতি। সাজ্জাদ তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বাংলাদেশের শত্রুতা করেছেন, যদিও কিছুদিন সৌদি আরবের হাওয়া খেয়ে পরবর্তী সময়ে এ দেশেরই অন্ন-বস্ত্র সাবাড় করেছেন। নুরুল ইসলাম কিছুদিন জেল খেটে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপােষকতায় এ দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পুনর্বাসিত হন। তারপর জেনারেল এরশাদের সৌজন্যে আইনমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতি পদও অলংকৃত করেন। পরে দুষ্কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে এসে পুনর্বাসনের নতুন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁদের ব্যবহার ছিল পাকিস্তানি ক্রীতদাসের উপযুক্ত এবং তাই সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। এ ছাড়া আরও কয়েকজন অপরিচিত দালাল এসেছিলেন, যাদের উপস্থিতি আমরা মােটেই টের পাইনি। এ রকম দুজনার নাম আমার মনে আছে, একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক
১১৭
মােহর আলী এবং আরেকজন শিক্ষক কাজী দীন মােহাম্মদ। ৫ জুলাই কিন্তু দুজন ভারী ওজনের দালাল এসে পৌছালেন ওয়াশিংটনে। মাহমুদ আলী ও হামিদুল হক চৌধুরী। মাহমুদ আলী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দ্বিতীয়বার আমেরিকায় আসেন। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে।
পাকিস্তান কনসাের্টিয়ামের জন্ম হয় ১৯৬০ সালে । ১৯৫৮ সালে ভারত তার দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রাসংকটের সম্মুখীন হয়। পাঁচসালা পরিকল্পনার দুই বছর শেষে দেখা গেল যে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব ব্যাংকের উদ্যোগে তখন ভারতের দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি উদ্ধারকার্য শুরু হয়। এই উদ্ধারকার্যে বিশ্ব ব্যাংকের নেতৃত্বে অংশ নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। ১৯৫৮ সালের ২৭ আগস্ট এসব দাতা ভারতকে এক বছরের জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের ব্যবস্থা করে । পরবর্তী বছরের ১৭ মার্চ এই দাতাগােষ্ঠী আরও ২৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। ইতিমধ্যে দাতাগােষ্ঠীর মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসে নতুন উদ্যোগের সূচনা হয়। সিনেটর শারমান কুপার ও সিনেটর জন কেনেডি, পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি, ভারতের জন্য একটি নিয়মিত দাতাগােষ্ঠী গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। হাউসে কংগ্রেসম্যান চেস্টার বাউলস এ রকম আরেকটি প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। সিনেটর কেনেডি মার্কিন সরকারকে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য সাহায্য সংস্থা। গঠনে পরামর্শ দেন এবং বিশ্ব ব্যাংককে এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে বলেন। বিশ্ব। ব্যাংকের সভাপতি ইউজিন ব্ল্যাক ‘তিনজন বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে ভারত ও পাকিস্তানে অবস্থা বিশ্লেষণে পাঠান। তারা তিনজন ছিলেন আমেরিকার এলান স্পাউল, ব্রিটেনের স্যার অলিভার ফ্রাঙ্কস এবং জার্মানির হারমার্ন অ্যাবস। তারাই ভারত ও পাকিস্তানের জন্য সাহায্য কনসাের্টিয়াম গঠনের পরামর্শ দেন।
১৯৬০ সালে তাই দুটি কনসাের্টিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল এসব দেশের উন্নয়ন উদ্যোগে বুদ্ধি দান এবং অর্থসংস্থান। ১৯৬২ সালে প্যারিসের ওইসিডি তুর্কির জন্য একটি দাতাগােষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯৬৩ সালে বিশ্ব ব্যাংক নাইজেরিয়া, কলম্বিয়া, সুদান ও তিউনিসিয়ার জন্য দাতাগােষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে, তবে এগুলাের নাম হয় কনসালটেটিভ গ্রুপ, কনসাের্টিয়াম নয় । ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জন্য যে দাতাগােষ্ঠী স্থাপিত হয়, তার নাম হয় এইড গ্রুপ। সে সময় এ ধরনের ২০টি দাতাগােষ্ঠী ছিল এবং ১৮টিতেই বিশ্ব ব্যাংক নেতৃত্ব দিত। তুরস্কের জন্য ছিল ওইসিডি ক্লাব আর ইন্দোনেশিয়ার জন্য নেদারল্যান্ডস ক্লাব (এখন এই দুই ক্লাবেও বিশ্ব ব্যাংক নেতৃত্ব দেয়)। কোনাে
১১৮
কোনাে দাতাগােষ্ঠী বছরে অন্তত একবার সভা করে। যেমন ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ এইড গ্রুপ। আবার কোনােটি কালেভদ্রে বসে, যেমন সুদান বা নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে। এগুলাের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অর্থসংস্থান; তবে বর্তমানে বােধ হয় নীতিবিষয়ক সংলাপ মুখ্য বিষয় হয়েছে। বর্তমানে এই সব দাতাগােষ্ঠি তেমন নেই এবং তাদের সভাসমিতিও অনেক সীমিত। বহুদিন বাৎসরিক সভা করতাে, কখনাে বছরে একাধিক সভাও করতাে।
এসব দাতাগােষ্ঠী প্রতিষ্ঠার পেছনে দুই রকমের প্রভাব কাজ করেছে। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে নিশ্চয়ই আদর্শবাদ ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী । দাতাগােষ্ঠী গঠনের প্রস্তাব প্রথমে দেন লেডি জ্যাকসন (বারবারা ওয়ার্ড)। তিনি মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন। বারবারা ওয়ার্ড বস্তুতই মানুষের মঙ্গল কামনা করতেন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনহিতে নিবেদিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল তাঁর আদর্শ ও অঙ্গীকার। অন্যদিকে তখন ছিল শীতল যুদ্ধের প্রতিযােগিতা। ভারতে মিশ্র অর্থনীতির সাফল্যকে পুঁজিবাদী দুনিয়া অত্যন্ত গুরুত্ব দিত। কারণ, তখন সমাজতন্ত্রের বিকল্প ছিল তাদের লক্ষ্য। মার্কিন কংগ্রেসের উদ্যোগ এবং বিশ্ব ব্যাংকের নেতৃত্ব যেমন একদিকে ছিল মানুষের মঙ্গলে নিবেদিত, তেমনি আরেক দিকে ছিল কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মােকাবিলা করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞাপ্রসূত।
১৯৫৮ সালে সিনেটর মনােরােনি এক প্রস্তাবে আইডিএ-র সূচনা করলেন। ভারতের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা গেল যে উন্নয়নের জন্য সহজ শর্তে সাহায্য দরকার, শুধু বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে তা সম্ভব নয়। জাতিসংঘে তখন ধনী দেশের অনুদান থেকে একটি উন্নয়ন তহবিল গঠনের জন্য দাবি উঠেছে। ভি কে আর ভি রাও তার জন্য শক্ত অর্থনৈতিক ও মানবিক যুক্তি হাজির করেছেন। সিনেটর মনােরােনি প্রস্তাব করে বসলেন যে এ রকম একটি তহবিল স্থাপনে আমেরিকা উদ্যোগী হােক। এর থেকেই ১৯৬০ সালে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি (আইডিএ) বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠল। এতে দাতাগােষ্ঠী প্রতি তিন বছরের জন্য অনুদান দেয় এবং সে তহবিল গরিব দেশের উন্নয়নে নিয়ােজিত হয়। বাংলাদেশ এই তহবিল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত মােট ৭০০০ মিলিয়ন ডলার পায় ।
মাহমুদ আলী আমাদের ছাত্র বয়সের আদর্শ নেতা, প্রগতিশীল, ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ একবার সিদ্ধান্ত নেয় যে দলের নেতৃত্বে কোনাে ব্যবস্থাপক বা আইনসভার সদস্য থাকতে পারবেন না। তাই প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক দেওয়ান আবদুল বাসেতকে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর তার পদ ছাড়তে হলাে। সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ
১১৯
সম্পাদক বানান। পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগে মাহমুদ আলী বিশেষ স্থান পেলেন না । তবে তিনি সিলেটের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং ছাত্রদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী হাজেরা মাহমুদও ছিলেন ছাত্রদের অত্যন্ত প্রিয়। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে এবং ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় শান্তি আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৫১ সালে মুসলিম লীগ ছেড়ে তিনি হন যুবলীগের প্রাদেশিক সভাপতি। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে আইন পরিষদের সদস্য হন এবং পরবর্তী সময়ে ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যােগ দেন। কৃষক-শ্রমিক দলের আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় তিনি প্রাদেশিক মন্ত্রী হন। কিন্তু তার পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল তাঁর যৌবনের আদর্শদীপ্ত নেতৃত্বের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তিনি তখন সুবিধাবাদ ও পাকিস্তান কায়েমি স্বার্থবাদের অন্যতম হােতা। ১৯৬৯-এর গােলটেবিল বৈঠকে তাঁর ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূল। তিনি সে সময় প্রচণ্ডভাবে শেখ। মুজিবের বিরােধিতায় লিপ্ত হন এবং ১৯৭১ সালে জেনারেল ইয়াহিয়ার ক্রীতদাসে পরিণত হন।
আমার আব্বার মৃত্যুসংবাদ ঘােষিত হলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সে বিষয়ে অনুসন্ধান করেন এবং আমাকে সঠিক খবর জানাতে উদ্যোগ নেন। পারিবারিকভাবে তাই আমাদের মধ্যে একটি ভালাে সম্পর্ক ছিল। তিনি ওয়াশিংটনে এসে রাষ্ট্রদূত হিলালির বাড়িতে আস্তানা গাড়েন। আমি তখন দূতাবাস ছেড়ে দিয়েছি। তিনি আমাকে টেলিফোন করেন এবং তার সঙ্গে দেখা। করতে বলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হই, তবে পাকিস্তান দূতাবাস বা রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে যেতে আপত্তি জানাই। তখন তিনি বললেন যে বিশ্ব ব্যাংকের পাকিস্তানি সহসভাপতি মােহাম্মদ শােয়েবের দপ্তরে কি আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারি? মােহাম্মদ শােয়েব পাকিস্তানি, তবে আন্তর্জাতিক আমলা। তিনি যখন পাকিস্তানে অর্থমন্ত্রী, তখন আমি সরাসরি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। এবং তাঁর দক্ষতা অবলােকন করেছি। তার সঙ্গে ওয়াশিংটনেও ভালাে যােগাযােগ ছিল। তাঁর দপ্তরে আমি পৌছালে তিনি আমাদের দুজনকে রেখে অন্যত্র চলে গেলেন।
মাহমুদ আলী প্রথমেই ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতি উষ্ম প্রকাশ করে বললেন, ‘তিলকে তাল করা তাদের স্বভাব। তােমার আব্বার মৃত্যুসংবাদ তাদেরই এক তেলেসমাতি। আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম যে একজন হাফিজ নামের উকিল তাে মারা গেছেন, তা তাে আর অস্বীকার করা যায় না। তার জবাব ছিল যে তেমন কিছু হয়নি, কিছু গােলযােগে সামান্য কজন মারা গেছেন এবং তাদেরও অনেকে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছেন। সিলেটে যারা পাকিস্তানি বর্বরতার
১২০
শিকার হন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দিন আহমদ—হাসপাতালের সুপরিনটেনডেন্ট। তিনি সার্জন, আহত লােকজনকে ছেড়ে পালাতে রাজি ছিলেন না। তাই পাকিস্তানি দস্যুরা যখন শহর দখল করল, তখন তিনি হাসপাতালেই কর্মরত ছিলেন। জল্লাদরা তাঁকে পেয়েই হত্যা করে এবং কয়েক দিন পর্যন্ত তাঁকে দাফন করতে দেয়নি। তাঁর স্ত্রী সিলেট মহিলা। কলেজের প্রিন্সিপাল হােসনে আরা মাহমুদ আলীর একরকমের ভাগনি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তার ভাগনি-জামাইকে কেন হত্যা করা হলাে? তাঁর জবাব হলাে, ডাক্তার তাে ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। এ রকম ডাহা মিথ্যা তিনি সজ্ঞানে বললেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলােচনায় মেজাজ ঠিক রাখা বেশ কষ্টকর ছিল। তাঁর বক্তব্যের মােদ্দাকথাটা ছিল, “তােমাদের মুজিব একজন বিদেশি এজেন্ট, দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। আমরা ভারতের হাত থেকে। পাকিস্তানকে বাঁচানাের চেষ্টা করছি। তাঁর কথায় ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল বড়ই প্রকট। মাহমুদ আলী আমার স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন এবং সবশেষে উপদেশ দিলেন, কোনাে আন্তর্জাতিক বা বিদেশি সংস্থায় কি তুমি কাজ করতে পারাে না?’ একই উপদেশ দুই মাস আগে দেন ড. নূরুল ইসলাম।
প্রায় দেড়-দুই বছর আগে হাজেরা মাহমুদ ইন্তেকাল করেছেন। মাহমুদ আলী। তারপরই নিঃসঙ্গ ও হৃদরােগী। ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে এপ্রিলে ইসলামাবাদে। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় কয়েক মিনিটের জন্য। পাকিস্তান সরকার তখনাে তাঁকে লালনপালন করছে। তিনি ফেডারেল মন্ত্রীর মর্যাদায় আছেন এবং কনসেপ্ট নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। যৌবনে মাহমুদ আলীর সাপ্তাহিক নওবেলাল ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনের মুখপত্র। ১৯৯৬ সালে কনসেপ্ট ছিল। ঠিক তার উল্টো, মান্ধাতার আমলের সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারার বাহক। এই চিন্তাধারায় বাংলাদেশ তখনাে পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভাের এবং সেই আদর্শে পরিচালিত। তার প্রমাণস্বরূপ তাদের পকেটে আছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর একসময়ের ক্রীতদাস সদ্যপ্রয়াত বামপন্থী আবদুল হক, মােহাম্মদ নুরুল্লা নামের এক দেশদ্রোহী কুলাঙ্গার এবং পাকিস্তান সেনা গােয়েন্দা সংস্থার কিছু। এজেন্ট। কনসেপ্ট-এর জগৎটিই কল্পলােক অথচ মাহমুদ আলীর কাছে সেটিই ধ্রুব সত্য ছিল।
হামিদুল হক চৌধুরী এসে উঠলেন পাকিস্তান দূতাবাসের সন্নিকটে এমবেসি রাে হােটেলে। নাফিসা তখন ওয়াশিংটন ছেড়ে জেনেভায় চলে গেছেন, তাই হক চৌধুরী এবার হােটেলে। তাঁর ডাকে একদিন অপরাহ্ েতাঁর হােটেলে গেলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার যে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্বন্ধে তিনি সত্যভাষণ করলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে যে রকম আগাগােড়া মিথ্যাভাষণ আর বানােয়াট কাহিনি
১২১
রয়েছে, তাতে তাঁর ওই সময়ের সে সত্যভাষণকে অত্যাশ্চর্য বলে মনে হয়। তিনি বললেন যে এমন কোনাে পরিবার বাংলাদেশে নেই, যাদের কেউ না কেউ সামরিক বাহিনীর হাতে, না হয় বিহারিদের হাতে মারা যায়নি। তিনি তার নিজের কিছু আত্মীয়স্বজনের উল্লেখ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে যােগ দিলেন যে ইপিআর ও বাঙালিরাও অনেক পাকিস্তানি নিধন করেছে, যদিও তুলনায় তা যৎসামান্য। তাঁর কথা ছিল, হাজার বছরে উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বা সখ্য হলাে না এবং এর কোনাে ভবিষ্যৎ নেই। ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলবে, মুসলিম তহজিব-তমদুন নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝােতা না করে বাংলাদেশের উপায় নেই।
তিনি স্বীকার করলেন যে আগামী কয়েক বছর, হয়তাে এক দশক, বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি যথাসময়ে নিজেকে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে তিনি টিপ্পনী কাটলেন যে বাঙালির এই দুরবস্থার জন্য সবটা দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের এবং তাদের অদূরদর্শী নেতৃত্বের। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনাে দোষ তিনি দেখতে পান না, তবে ভুট্টো সম্বন্ধে তার যথেষ্ট সংশয় আছে। আগেও বলেছি, জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর কেমন যেন একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। আলােচনার একপর্যায়ে হক চৌধুরী উত্তপ্ত হয়ে বললেন, তােমার বাংলাদেশ চুলােয় যাবে আর সেখানে আমাকে কখনাে পাবে না। আমরা ভদ্রভাবে এ বিষয়ে আলাপ করার জন্য ১৯৭২-পরবর্তী কোনাে সময়ে জেনেভায় মিলিত হব বলে ঠিক করলাম । ১৯৭২-এর মধ্যে বাংলাদেশ মুক্ত হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস ছিল এবং তার জন্য একটি যুক্তিসম্মত অবস্থানও আমি তত দিনে রচনা করে ফেলেছি। ১৯৭২ সালে ঢাকায় ইস্টার্ন প্রগ্রেসিভ শু ইন্ডাস্ট্রির নুরুল ইসলাম আমাকে জানান যে হক চৌধুরী আমাদের আলােচনার যে বিবরণ তাঁকে দেন, সেটি মােটামুটিভাবে আমার স্মৃতিরই অনুকূল।
হক চৌধুরীর সঙ্গে জেনেভার বৈঠকের সুযােগ আমার আর হয়নি। তবে ১৯৭৭ সালে তিনি যখন তােমার বাংলাদেশে হিজরত করেন, তখন নুরুল ইসলামের মাধ্যমে আমাকে আগাম সংবাদ দেন এবং জানান যে তিনিই ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বােধ হয় আর সেই ভুল স্বীকার করতে তেমন প্রস্তুত ছিলেন না। আমি যখন ওয়াশিংটনে তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, তখন হন্তদন্ত হয়ে রাষ্ট্রদূত হিলালির এক বরকন্দাজ তাঁর দরবারে হাজির হন। তিনি কোনাে একটি চিঠিতে হক চৌধুরীর দস্তখতের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তিনি তাঁকে জানান যে ওই রকম আরেকটি চিঠিতে মাহমুদ আলী ইতিমধ্যে দস্তখত করেছেন আর হিলালি সে চিঠির খসড়া দেখে
১২২
দিয়েছেন। হক চৌধুরী সেই বরকন্দাজকে চিঠির খসড়াটি রেখে চলে যেতে বললেন এবং আরও বললেন যে চিঠিটি যখন তাঁর কাছ থেকে যাবে, তখন। বিষয়টি তিনি আরেকটু বিবেচনা করে দেখবেন । বরকন্দাজ হয়তাে আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, তবে হক চৌধুরী তাঁকে সরাসরি বিদায় নিতে বললেন। বরকন্দাজ ছিলেন একজন ব্যক্তিগত সহকারী এবং হামিদুল হক মন্তব্য করলেন। যে ওদের এই মুরব্বিয়ানা এবং সবজান্তা ভাবই সব অনর্থের মূল।
হামিদুল হক চিঠিটি আমাকে পড়তে দিলেন। এটি ছিল ম্যাকনামারার কাছে একখানা চিঠির খসড়া। সেদিনই তিনি ম্যাকনামারার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, আর এই চিঠিতে তাঁর বক্তব্য লিখে জানাচ্ছিলেন। তার কথা ছিল যে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া পূর্ব পাকিস্তানেরই মঙ্গলের জন্য এবং ওখানে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে গেলে এই সাহায্যের প্রয়ােজন। তিনি আমাকে শুধালেন যে এমন কোনাে শর্ত কি বেঁধে দেওয়া যায়, যাতে সমুদয় সাহায্য শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই খরচ করা হবে? আমার কাছে ব্যাপারটি কৌতুকের বিষয় বলে মনে হলাে। হামিদুল হক বুদ্ধিমান ব্যক্তি, অর্থনৈতিক বা আর্থিক বিষয়ে বেশ চালাক। আমার ছাত্রজীবনে তার আধুনিক চিন্তাধারা আমাকে অভিভূত করে এবং আমার মনে হয়েছে যে তার লােভের কারণও তাঁর দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস। প্রথম যখন তাঁকে দেখি, তখন আমি সদ্য কলেজে ঢুকেছি আর তিনি পূর্ব বাংলার অর্থমন্ত্রী। অনেক রাজনীতিবিদকে চিনি, মন্ত্রীও দেখেছি। কিন্তু এই দেখলাম একজন চতুর লােক, অন্য ধরনের রাজনীতিবিদ। তার মুখে প্রশ্নটা শুনে আমার হাসির উদ্রেক হলাে। পাকিস্তানের সাহায্যের প্রয়ােজন ছিল মনস্তাত্ত্বিক কারণে, সামরিক জান্তার আত্মবিশ্বাসের জন্য এবং আন্তর্জাতিক সমাজে তাদের গ্রহণযােগ্যতার জন্য। আর্থিক সমস্যাটি ছিল নিতান্তই গৌণ। আমি শুধু তাঁকে বললাম, আপনার কাজ আপনি করুন, আমার প্রচেষ্টা হবে সব সাহায্য বন্ধ করা। হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরবর্তী সাক্ষাৎ হয় ১৯৭৭ সালে এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে । সেদিন তার স্নেহময়ী স্ত্রী ইন্তেকাল করেন।
জুন-জুলাইতে আমেরিকার বিভিন্ন বাঙালি সমিতিও সংহত হতে থাকে। শিকাগাে ও নিউইয়র্ক এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নেয়। শিকাগােতে এফ আর খান মে মাসেই বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি নিয়মিত পাক্ষিক সংবাদপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা নেন। ১৭ মে শুরু করে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মােট ১৭টি বাংলাদেশ নিউজলেটার প্রকাশিত হয়। এতে থাকত আমেরিকায় বাঙালিদের উদ্যোগের খবর, বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডের খবর এবং দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র থেকে নেওয়া মন্তব্য। প্রথম দু-একটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন শামসুল বারী, তিনি ডিফেন্স লিগের সম্পাদক ছিলেন। তারপর সব কটি
১২৩
নিউজলেটার সম্পাদনা করেন ভেন্ডারবিল্ট থেকে মুহাম্মদ ইউনূস। ৬ জুন এফ আর খান শিকাগােয় সব বাঙালি সমিতির প্রতিনিধিদের আহ্বান করেন। উদ্দেশ্য ছিল একটি সমন্বয় পরিষদ গঠন করা। এ বিষয়ে খানিকটা দ্বিমত ছিল। অনেক সমিতি ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লিগকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল। তাদের ধারণা হলাে যে নতুন করে আবার সমন্বয় পরিষদ গঠনের প্রয়ােজন নেই। সব সমিতিই একযােগে কাজ করতে পারে। যেমন শিকাগাে লিগের মাধ্যমে ওয়াশিংটন ইনফরমেশন সেন্টারকে সাহায্য দেওয়া যেতে পারে। পশ্চিম উপকূলে লস অ্যাঞ্জেলেসের সমিতি সমন্বয়ের কাজ করতে পারে। নিউইয়র্কের সঙ্গে কিছু সমিতি একযােগে নানা উদ্যোগ নিতে পারে। যা হােক, ৬ জুনের সভায় অনেক সমিতি থেকে প্রতিনিধি হাজির হলেন। ওয়াশিংটন বাংলাদেশ লিগ নিউইয়র্কের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল, কিন্তু তারাও প্রতিনিধি পাঠাল আর আমি হলাম তাদের প্রতিনিধি । নিউইয়র্ক লিগ এ এইচ মাহমুদ আলীকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাল। মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রতিনিধিরা এলেন শিকাগােতে।
এই সভায় চাঁদা আদায় ও প্রচারের ওপর খুব জোর দেওয়া হয়। চাঁদা আদায়ের জন্য ট্যাক্স রেয়াতির বিষয়ও বিবেচনা করা হয় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সমর্থন হবে প্রথমত চাঁদা দিয়ে এবং দ্বিতীয়ত স্বেচ্ছাসেবক ও লবিস্ট পাঠিয়ে। আরেকটি বিষয় নিয়েও অনেক আলােচনা হয়। সেটি ছিল বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠা এবং দূতাবাসের কর্মচারীদের আনুগত্য পরিবর্তন। মিশন প্রতিষ্ঠার খরচ আছে এবং সব বক্তা দুটো মিশন চান। একটি নিউইয়র্কে এবং আরেকটি ওয়াশিংটনে। আমি সেখানে তিক্ত কথা বললাম। নিউইয়র্কের মিশন মাহমুদ আলী মে মাস থেকে চালাচ্ছিলেন এবং শত অঙ্গীকারের পরও তাঁকে খরচ চালানাের জন্য এক সেন্টও তখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে দুই মিশনের ধারণা ছিল অবাস্তব। একটি মিশনের খরচ জোগানাের প্রস্তাব আমি দিলাম ।
একটি বিষয়ে আমার মন বেশ খারাপ হয়ে গেল। বিভিন্ন সমিতি প্রতিষ্ঠার হিসাব যখন নেওয়া হচ্ছিল, তখন দেখা গেল যে অনেক উদ্যোক্তা সমিতির সঙ্গে নিজেদের নাম যােগ করতে রাজি নন। তাঁদের আত্মীয়স্বজন দেশে ভােগান্তির শিকার হতে পারেন, এই ভয়ে তারা চিহ্নিত হতে চান না। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার কিন্তু যার এ রকম শঙ্কা রয়েছে, তার পক্ষে অন্য ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে আনুগত্য প্রকাশের জন্য চাপ দেওয়ার কোনাে অধিকার আছে কি না, আমি সেই প্রশ্নটি তুলে ধরলাম। শামসুল বারী এ বিষয়ে দোটানা
১২৪
মনােভাবের নিন্দা করলেন। জাতি হিসেবে জীবন-মরণের সমস্যা যখন এত প্রবল, তখন এ ধরনের গা বাঁচানাের মনােভাব কতটা সংগত। এ প্রসঙ্গে একটি কাহিনি এ সময় বহুল প্রচার লাভ করে। এতে কৌতুক ও রূঢ় বাস্তবতা দুটোই প্রকাশ পায়। কোনাে এক ব্যক্তিকে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আহ্বান। জানালে তিনি নাকি বলেন যে তাঁর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তাঁকে লাে-প্রােফাইল বজায় রাখতে হবে। কারণ, দেশে তার পিতা একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। দূতাবাসের কর্মচারীদের অবস্থান সম্বন্ধে আমি একটি সমাধান প্রস্তাব করলাম। যাঁরা দূতাবাসে কাজ করে যাবেন, তাঁদের ঔপনিবেশিক সরকারের অনুগত ভৃত্য হিসেবে বিবেচনা করে দেশের শত্রু মনে করলেই হলাে। সারা দেশ যদি হয় বিদ্রোহী, এদের দখলদারদের প্রতি আনুগত্যে কিছু যাবে-আসবে না। আমার মনে হয়েছিল যে দূতাবাসের কর্মচারীরা আন্দোলনে যােগ দিলে উত্তম কিন্তু তাঁদের যদি অসুবিধা থাকে, তার জন্য মুষড়ে পড়ার বা তা নিয়ে অনবরত সময়ক্ষেপণের প্রয়ােজন নেই।
রাতে ওয়াশিংটনে ফিরলে পরে আতাউর রহমান চৌধুরী খবর দিলেন যে আমাকে পিন্ডিতে বদলি করা হয়েছে। তিনি টিপ্পনী কাটলেন যে পাকিস্তানিরা জেনে গেছে আমি অচিরেই দূতাবাস পরিত্যাগ করছি। কয়েক দিনের মধ্যেই কথাটির যথার্থতা প্রমাণিত হয়ে গেল। আমার উকিল বার্নি আমার হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করছিলেন। তার পরামর্শে আমি স্টেট ডিপার্টমেন্টে বন্ধুস্থানীয় কারাের কাছ থেকে এ ব্যাপারে খবর চাই । তিনি তখন বললেন যে পাকিস্তানিরা বােধ হয় আমার মতলব জানে। প্রচার অ্যাটাশে কুতুব নাকি কথাচ্ছলে তার কাছে জানতে চেয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদানের নীতিটি কী? তাঁর প্রশ্ন ছিল, কোনাে বন্ধুদেশের নাগরিক যদি সেই দেশের বিরােধিতা করে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়, তাকে কি তখন সেই সুযােগ দিতে হবে?’ একই সঙ্গে উদাহরণ হিসেবে তিনি আমার কথাটি তােলেন।
আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে যে কিছুদিন আগে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়ে একটি খবর সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও আইন দপ্তর সম্মিলিতভাবে এ ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ নীতি গ্রহণ করে। এস্তোনিয়ার অথবা লিথুয়ানিয়ার একজন নাবিক জাহাজ ত্যাগ করে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। কিন্তু কোস্টগার্ড তাঁকে জাহাজত্যাগী (deserter) হিসেবে জাহাজের ক্যাপ্টেনের হাতে সােপর্দ করে এবং নাবিকটি বােধ হয় গুম হয়ে যায় কিংবা দেশে ফিরে কারাবদ্ধ হয়। সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় এবং মার্কিন জাতির ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমেরিকা ছিল নিপীড়িতের আশ্রয়, বুভুক্ষুর ভরসা, শরণার্থীর বসতিকেন্দ্র এবং প্রতিবাদীর শেষ
১২৫
অবলম্বন। এভাবেই আধুনিক আমেরিকা গড়ে ওঠে। ইউরােপ ও আফ্রিকার জনগণ এই দেশটিতে বসতি স্থাপন করে। এস্তোনিয়ার বা লিথুয়ানিয়ার ওই ঘটনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে কোনাে আশ্রয়প্রার্থীকে আর যথাযথ বিবেচনা ছাড়া ফেরত পাঠানাে যাবে না। স্টেট ডিপার্টমেন্টের বন্ধু কুতুবকে বলেন, যুক্তরাজ্য আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু । কিন্তু স্কটল্যান্ডের কেউ (ধরুন দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব) যদি বলেন ব্রিটেন স্কটল্যান্ডকে নিষ্পেষণ করছে এবং আমি তার প্রতিবাদে ব্রিটিশ দূতাবাস পরিত্যাগ করছি এবং আমার নিরাপত্তার জন্য এখানে আশ্রয় চাচ্ছি, তাহলে তাকে আশ্রয় দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনাে উপায় নেই।
১২ তারিখে নিউইয়র্কে র্যালি ছিল, ভারতের জয়প্রকাশ নারায়ণ, কংগ্রেসম্যান। রায়ান এবং পাকিস্তানের ইকবাল আহমেদ সেখানে বক্তব্য দেন। আমার ওখানে যাওয়ার কথা ছিল না, আমার কথা ছিল ২৬ জুনের কনভেনশনে যাবার । শিকাগাের মতাে নিউইয়র্কের সব সমিতির প্রতিনিধিদের নিয়ে ওই কনভেনশন ডাকা হয়। ১৫ তারিখে আমার দূতাবাস ছাড়ার পূর্বনির্ধারিত দিন ছিল কিন্তু সেটাকে ৩০ জুনে পরিবর্তন করায় আমি কনভেনশনে যাওয়া থেকে বিরত থাকি। সেই কনভেনশনেও একটি প্রধান আলােচ্য বিষয় ছিল দূতাবাসের কর্মচারীদের আনুগত্য পরিবর্তন। ওই কনভেনশন ছিল অনেক বড়। শিকাগােতে আমরা এফ আর খানের বাড়িতে সমবেত হয়েছিলাম ২৫-৩০ জন। কিন্তু নিউইয়র্কের সমাবেশ ছিল প্রায় ৪০০ লােকের। এসব সমাবেশের ফলে আমেরিকার বাঙালিরা অনেক বেশি সংগঠিত হন এবং বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে মার্কিন জনমত গঠনেও তা খুব সহায়ক হয়। কংগ্রেসে সংশােধনী প্রস্তাবের পক্ষে তদবির করার প্রয়ােজনীয়তা এবং বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারকে এ ব্যাপারে সাহায্য করার বিষয়টিও কনভেনশনে প্রাধান্য পায়। বস্তুতপক্ষে জুলাই থেকে আমেরিকার নানা এলাকা থেকে বাঙালিরা অব্যাহত ধারায় কংগ্রেসে লবি করতে রাজধানীতে আসতে থাকেন। ওয়াশিংটন ইনফরমেশন সেন্টার হয়ে ওঠে সারা দেশের মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ লবিস্ট সংস্থা।
জুলাইয়ের প্রথম দিকে কিসিঞ্জার ভিয়েতনাম ও উপমহাদেশ সফরে গেলেন। আমরা তাে স্থির নিশ্চিত ছিলাম যে ভারত ও পাকিস্তানে তিনি মূলত বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলােচনা করবেন। তার হয়তাে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখাও হবে। তাঁর প্রত্যাবর্তনের পর ১৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট নিক্সন সান ক্লিমেন্ট থেকে ঘােষণা দিলেন যে ২২ বছর পর আমেরিকা চীনের সঙ্গে যােগাযােগ করেছে। কিসিঞ্জার পাকিস্তানে মােটেও অসুস্থ হয়ে পড়েননি, বরং এ সময় তিনি পিকিং ঘুরে এসেছেন। আমেরিকা পাকিস্তানকে কেন এত খাতির করে চলছে, তার একটি ব্যাখ্যা তখন পাওয়া গেল। পাকিস্তান হয়েছে আমেরিকার চীন যাবার রাস্তা।
১২৬
একই সঙ্গে আরেকটি বিষয়ও প্রতিভাত হলাে যে হােয়াইট হাউসের বিবেচনায় বাংলাদেশ সমস্যা তেমন গুরুতর কিছু নয়, পাকিস্তানের একটি মামুলি নিজস্ব ব্যাপার। কিসিঞ্জার পাকিস্তান ছাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৯ জুলাই ইয়াহিয়া। ‘সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘােষণা দিলেন। এর আগে ২৮ জুন ইয়াহিয়া তাঁর বহু প্রতীক্ষিত ঘােষণায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বাঙালিদের সঙ্গে সমঝােতায় তাঁর কোনাে আগ্রহ নেই।
জাতিসংঘে অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার পাঁয়তারা চলছিল। ১৬ জুলাই মহাসচিব ২৮ মিলিয়ন ডলার ত্রাণ সাহায্যের জন্য আপিল জানালেন। সিনেটর কেনেডির শরণার্থী সাব-কমিটিও এ ব্যাপারে ২২ তারিখে একটি শুনানি চালাল।
২৭ মার্চ আমার বাড়িতে যখন ওয়াশিংটনের বাঙালি সমাজ সমবেত হয়, তখনই আমি ঘােষণা করি যে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে এবং আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ছাড়া কোনাে উপায় নেই। কথাটি নিতান্তই হুজুগে বলিনি, কিন্তু এর তাৎপর্য তখন যে খুব পরিষ্কার ছিল, তা-ও নয় । আমার ছেলেমেয়েরা তখন সব কটিই শিশু, কনিষ্ঠতম সন্তান টিভিতে বাংলাদেশের নাম শুনলে উত্তেজিত হয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শের কোনাে সুযােগ নেই। মাসখানেক তাে দেশের সঙ্গে কোনাে যােগাযােগ নেই। আমেরিকা বা অন্যত্র যারা পরিচিত, তাঁদের সঙ্গে নিরন্তর। মতবিনিময় হচ্ছে। কিন্তু দূতাবাস ছেড়ে একটি অনিশ্চিত পথে পা বাড়ানাের বিষয়ে একমাত্র পরামর্শদানকারী তখন শুধু আমার স্ত্রী। এপ্রিল এক ট্রান্সের হুজুগের মধ্যে পেরিয়ে গেল। বাংলাদেশে তখনাে তাদের দখল সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে পাকিস্তানও খুব হম্বিতম্বি করতে পারছে না। মে মাসে এল ধীরেসুস্থে বিবেচনার এবং একই সঙ্গে মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতার সময়।
পাকিস্তান আমার স্বপ্নের দেশ ছিল । ছাত্রাবস্থায় নানা কারণে কখনাে নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে হয়নি—যদিও বঞ্চনা ও শঠতা উপলব্ধি করতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী বিজয় দিয়েছিল আত্মপ্রত্যয় ও উচ্চাশা। পাকিস্তানি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা যখন নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে (হক মন্ত্রিসভা) বদনাম দিয়ে বরখাস্ত করে ইস্কান্দার মির্জাকে পাঠাল লাট সাহেব করে শাসন পরিচালনায়, তখন ক্ষুব্ধ হয়েছি, তবে আশা ছাড়িনি। পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও আমলাতন্ত্রের আঁতাতের প্রতিবাদ করেছি, তাদের কর্তৃত্ব মেনে নিইনি। সে জন্য কয়েক ঘণ্টার জন্য গ্রেপ্তারও হয়েছি, তবে সৌভাগ্যবশত (ভালাে ছাত্র, সামনে পরীক্ষা—এই অজুহাতে) অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মতাে অনির্দিষ্টকালের। জন্য কারাবাস করতে হয়নি।
১২৭
তখনকার জেলা প্রশাসকদের ক্ষমতা ছিল অনেক এবং রাজনীতিবিদেরা এত প্রতিহিংসাপরায়ণ বা দলবাজ ছিলেন না। সেই বয়সে স্বপ্ন দেখি দুই রকমের। একটি হলাে আইন ব্যবসা করব এবং রাজনীতিতে সক্রিয় থাকব। আর অন্যটি ছিল বিশ্ব-সরকার প্রতিষ্ঠায় জোর তদবির করে যাব। জাতিসংঘ। সম্বন্ধে এক আন্তর্জাতিক প্রবন্ধ প্রতিযােগিতায় অংশ নিয়েছিলাম ১৯৫১ সালে । তখন থেকেই বিশ্ব-সরকার সম্বন্ধে ইতিবাচক ধারণা আমি পােষণ করতে থাকি এবং আটলান্টিক সনদ রচয়িতা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও প্রধানমন্ত্রী চার্চিল দুজন হন আমার নমস্য ব্যক্তি। মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে নাজিমুদ্দিন রােডের রেডিও স্টেশনে বিশ্ব-সরকারের সম্ভাব্যতা নিয়ে এক বিতর্কসভার আয়ােজন করি। শুধু পরিচালনা ও মূল বক্তব্য দেওয়া ছাড়াও আমার সহযােগীদের অনেক বক্তৃতাও আমাকে তৈরি করে দিতে হয়। পাকিস্তানকে মনে হতাে বিশ্ব-সরকার আদর্শের পথপ্রদর্শক। দুই বিচ্ছিন্ন এলাকা নিয়ে গঠিত একটি জাতিসত্তা বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন এলাকা নিয়ে এক বিশ্বসত্তার দিশারি হবে বলে মনে খুব গর্ববােধ করতাম।
১৯৫৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কাকডাকা ভােরে হঠাৎ পুলিশ ধরে নিয়ে গেল লালবাগ থানায়। অপরাহ্নে আমরা সাতজন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আশ্রয় নিলাম। পাঁচজন ছাত্রনেতা আর দুজন রাজনৈতিক অঙ্গনের সক্রিয় ব্যক্তি। ছাত্রদের মধ্যে আমরা ছিলাম ডাকসুর সহসভাপতি নীরােদ নাগ (নব্বইয়ের প্রথম ভাগে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য), ফজলুল হক হলের সহসভাপতি মনসুর আলী (পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়ার আমলের মন্ত্রী), সলিমুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আনাম (পরবর্তীকালে সংবাদপত্র সম্পাদক), ছাত্রনেতা প্রয়াত আবদুল আওয়াল, ছাত্রলীগ নেতা আবদুল মােমেন তালুকদার (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে আওয়ামী লীগের প্রতিমন্ত্রী) আর সলিমুল্লাহ হলের সহসভাপতি আমি। অন্য দুজন ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত শামসুজ্জোহা (খান সাহেব ওসমান আলীর পুত্র এবং বর্তমান সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের পিতা) এবং শ্রমিকনেতা জামিল । ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা সাতজন ছিলাম কারাগারের মানসিক ওয়ার্ড বলে পরিচিত একটি কোণে। ২১ তারিখে জেলে এল আরও শ চারেক ছাত্রছাত্রী এবং আমরা তাদের সঙ্গে থাকতে চলে গেলাম অন্য একটি ওয়ার্ডে। মাসােৰ্ধকাল জেলের ভাত খেতে হয় এবং অনেক বক্তৃতা শুনতে হয়। মুখ্য সচিব নিয়াজ মােহাম্মদ খান ও ঢাকার জেলা প্রশাসক ইয়াহিয়া খান চৌধুরী বন্দীদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন। ঢাকার কমিশনার গােফরান ফারুকী, আমাদের উপাচার্য ওয়াল্টার জেনকিনস এবং আমাদের প্রভােস্ট ডা. ওসমান গনি আমাদের নেতৃস্থানীয় কিছু ছাত্রের সামনে বক্তব্য দেন। ইতিমধ্যে
১২৮
ঐক্য ভাঙার প্রচেষ্টা চলল পুরােদমে, কেউ কেউ চুপিচুপি দাসখত দিয়ে মুক্তি পেয়ে গেলেন। মুখরােচক ঘটনা ঘটল যেদিন এক বড় ভাই দাসখতে সই দিয়ে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু তারই কনিষ্ঠ ভ্রাতা, সম্ভবত স্কুলের ছাত্র, আমাদের সঙ্গে থেকে গেল।
গভীরভাবে অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী মােকাম্মেল হক (পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সচিব এবং মন্ত্রী) কোনােমতেই দাসখত সই করবেন না। স্কুলের ছাত্র শামসুল আরেফীন (পরে সাংবাদিক) এবং মওদুদ আহমদও (পরে আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ এবং স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন) আদর্শে অটল, কিছুতেই দাসখত দিতে রাজি নন। জেলখানা আসলে আমাদের একটি ক্লাবে পরিণত হয়। বিভিন্ন হল থেকে আমাদের জন্য প্রায়ই খাবার যেত বলে সব সময় জেলের ব্লিচিং পাউডারযুক্ত খাবার খেতে হতাে না। বইপত্তর পেতেও জেল কর্তৃপক্ষ তেমন কড়াকড়ি করত না। এত বড় একটি জনতাকে খুশি রাখার জন্যই বােধ হয় কর্তৃপক্ষ হল থেকে আমাদের জন্য পাঠানাে সব খেলার সামগ্রী সহজেই আমাদের কাছে পৌছে দিত । সবই ভালাে ছিল, তবে কোন্দলের অভাব ছিল না। আমার কাছে আপত্তির বিষয় ছিল একটিই। আমি যে ইচ্ছেমতাে ঘােরাফেরা করতে পারি না, এতেই ছিল আমার ক্ষোভ। অনেক দিন ধরে ঘরে বসে আছি, তাতে কোনাে আপত্তি নেই, কিন্তু ইচ্ছা হলেও যে আমি চলতে-ফিরতে পারব না, এই অত্যাচারটি ছিল অসহ্য এবং এক হিসাবে অসম্মানজনক।
জেলে বসে আমি এক বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম । এস্টাবলিশমেন্টের মধ্যে থেকেও তাে দেশসেবা করা যায়। নিজের দেশের প্রশাসনে নিয়ােজিত থেকেও তাে মানুষের মঙ্গলসাধন সম্ভব। অর্থাৎ রাজনীতি ছাড়াও তাে উপায় আছে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম যে কেন্দ্রীয় উর্ধ্বতন চাকরির জন্য পরীক্ষার্থী হব। এত দিন এ বিষয়ে কখনাে চিন্তা করিনি। আমার শিক্ষক জে এস টার্নার একদিন আমার খোজে এলেন। জানতে চাইলেন, এমএ পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য তিনি কী কী বই আমাকে পাঠাবেন। আমি তাকে বললাম যে দুটো পরীক্ষা একসঙ্গে দিতে চাই। এমএ ও সিএসএস। তাঁর মন্তব্য ছিল, তােমাকে তাে জলদি বেরিয়ে আসতে হবে।’ বৃহত্তর রাজনীতির দাবা খেলায়, প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলী যেদিন ঢাকায় এসে পৌছালেন, সেদিন মধ্যরাতে আমরা মুক্তি পেলাম।
১৯৫৬ সালে দেশােন্নয়ন ও জনসেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যােগ দিই। যদিও অর্থ উপার্জনের জন্য তখন বেহতর অন্য অনেক রাস্তা ছিল, বিদেশে উচ্চশিক্ষারও সুযােগ ছিল কমবেশি । শিক্ষানবিশি শেষ করে আমি
১২৯
বেশি দিন চাকরি করি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে, প্রথমে পরিকল্পনা কমিশনে, পরে মন্ত্রিসভা সচিবালয়ে এবং সবশেষে ওয়াশিংটন দূতাবাসে। সামরিক শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক কেন্দ্রীয় সরকার এবং অবাঙালি নিয়ন্ত্রিত জনপ্রশাসন কী করে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করেছে, দাবিয়ে রেখেছে আর বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে, তার । প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার অনেক বেশি। কিন্তু আমি মনে করেছি যে এর প্রতিকার করা যায় এবং অধিকার আদায় করা যায়। ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যর্থতা দুই-ই আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাই আশা পুরােপুরি ছাড়তে পারিনি। পাকিস্তান যে বিশ্ব-সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি উত্তম চ্যালেঞ্জ, এই ভাবনাটা প্রায়ই আমার মনে দোলা দিত।
কিন্তু মার্চ মাসে ইয়াহিয়ার শঠতা এবং ভুট্টো ও সামরিক জান্তার হঠকারিতা আমাদের জন্য মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে এল। ষাটের দশকের মধ্যভাগে। আমার এক সহকারী দুই দেশের বৈষম্য নিয়ে খুব কথা বলত। সে আমার সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করত। তার একবার খেয়াল হলাে যে বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদ পাচারের বিষয়টি নিয়ে কিছু গবেষণা করবে। আমি সে জন্য তাকে একটি কাজ দিলাম এবং কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তরে গবেষণা করতে। পাঠালাম। আমার সেই সহকারী পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য ড. আবদুস সাত্তার প্রায়ই বলত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ এক থাকতে পারবে না এবং ভাগটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই মঙ্গল। আমি তার কথা শুনতাম, তবে তার ধারণাকে তত আশকারা দিতাম না। সে বিদেশে প্রশিক্ষণে গিয়ে প্রায়ই এ বিষয়ে লম্বা লম্বা চিঠি লিখত এবং তাতে তার সুচিন্তিত মতামত জানাত। আমি বলতাম যে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি এসব সমস্যা বা বিরােধের অবসান ঘটিয়ে উপমহাদেশে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। ১৯৭২ সালেও দিল্লিতে এক আসরে আমি কমনওয়েলথ অব সাউথ এশিয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করি।
১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা শুরু করল, তখন কিন্তু আমার সহযােগী প্রয়াত ড. আবদুস সাত্তারের (একসময় বাংলাদেশের সচিব) বিচারটিই আমার কাছে সঠিক মনে হলাে। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান একত্রে থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি দস্যুদের উৎখাত করা ছাড়া আমাদের কোনাে উপায় নেই। কিন্তু একটি খটকার সদুত্তর আমি ডা. সাত্তারের কাছ থেকে কোনাে দিন পাইনি। মার্চে তিনি ঢাকায় ছিলেন এবং অসহযােগ আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। অথচ তারপর কেন যে তিনি পাকিস্তানে গেলেন এবং কারাবরণ করলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযােগ হারালেন, তা আমার বােধগম্য
১৩০
হয়নি। অত আগে অত গভীরভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী খুব কম ব্যক্তিকেই আমি দেখেছি।
২৭ মার্চের পর পাকিস্তান দূতাবাসে থাকলেও আমি কাজ করেছি একান্তই বাংলাদেশের জন্য এবং বাঙালিদের জন্য। আমার এই সরকারে অবস্থান কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে বাঙালিদের কাজে লেগেছে। যেমন প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়ানাে, মার্কিন সাহায্যে গম বা সার খরিদ বন্ধ রাখা, বিশ্ব ব্যাংকের নানা প্রকল্পে বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি। তবে মে মাস থেকে দূতাবাসে কাজ করা খুব অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ঔপনিবেশিক শাসনে নিস্পিষ্ট মাতৃভূমিতে একজন ক্রীতদাস কিংবা পাকিস্তানের দালাল হিসেবে পরিচিতি আমার কাছে অসহ্য মনে হয়। ইতিমধ্যে জনমত গঠনে যাঁরা ভূমিকা রাখতে পারেন, তেমন অনেক মার্কিন নেতা বা কর্মীর সঙ্গে হয়েছে আমার ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ। মার্কিন মুলুকের বাঙালি মহলের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও যােগাযােগ । এমতাবস্থায় পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা বস্তুতই আমার একটি বড় অসুবিধা বা বােঝা হয়ে দাঁড়ায়। রাজ্জাক খান ছিল আমার খুব ঘনিষ্ঠ। তাকে যখন বরখাস্ত করা হলাে, সেদিনই আমার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল ।
ওয়াশিংটন দূতাবাসে আমরা একটি বড় গােষ্ঠী ছিলাম এবং আমরা সবকিছুই একজোটে করেছি। আমার নিজের সিদ্ধান্ত আমার সহযােগীরা মেনে নিলেন। জুনের প্রথম দিকে আমি দূতাবাস ছাড়ব। তখন আমাদের রাস্তা যে আলাদা হবে, তাতে কোনাে সন্দেহের অবকাশ ছিল না এবং আমরা তার জন্য প্রস্তুত হতে। থাকলাম। স্বীকার করতেই হবে যে পরের মাসটি আমার জন্য মােটেও সুখের ছিল না। রােজগার নিয়ে তত সমস্যা ছিল না। বিল ম্যাকুলক কয়েকটি বক্তৃতার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তাতে বেশ পয়সা পাওয়া যাবে । টি সােয়েজি তার নতুন বাড়িতে জায়গা দিতে রাজি হয়েছেন। কংগ্রেসের বন্ধুবান্ধব নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে রােজগারের ব্যবস্থা হবেই। আমার বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়াবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। তবে আমাদের এক বুড়ি প্রতিবেশী তাতে মােটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না । বাড়ির মালিক দম্পতি আমাদের খোঁজখবর নিতে এলে তিনি তাঁকে সরাসরি শাইলক বলে অভিযুক্ত করলেন। কেন তিনি দুর্দিনেও আমাদের ভাড়া নিচ্ছেন?
কিন্তু আমাদের চিন্তা ছিল অন্য রকম। প্রথমত, যদি মুক্তিযুদ্ধ ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা হব দেশহীন । তখনাে প্রবাসের আকর্ষণ আজকের মতাে ছিল না। ওয়াশিংটনে এ রকম অনেক দেশহীন লােকের বাস ছিল। তাঁদের কেউ কেউ অবশ্য সমাজের উচ্চমার্গে বিচরণ করতেন। কিন্তু বেশির ভাগেরই জীবন ছিল খুব সাদামাটা ও নিঃসঙ্গ। আমাদের এক বান্ধবী ছিলেন মারিকিতা। তাঁর পিতা ছিলেন স্বাধীন চেকোস্লোভাকিয়ার আমেরিকায় সর্বশেষ রাষ্ট্রদূত। মহাযুদ্ধের শেষে
১৩১
চেকোস্লোভাকিয়ায় রাশিয়ার বশংবদ সরকার প্রতিষ্ঠা হলে তাঁরা দেশহীন হন। মারিকিতা সুখে থাকতেন, তখন তিনি জীবনের মধ্যাহ্নে। শােরহাম হােটেলে তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। তিনি কূটনৈতিক মহলে ঘােরাফেরা করতেন, নিজে সুন্দর পার্টি দিতেন। কিন্তু তাঁর জীবনটি ছিল কেমন যেন অর্থহীন, পরগাছার জীবন । মারিকিতার কথা মনে হলে মন খারাপ হয়ে যেত। দেশে আত্মীয়স্বজনের অবস্থানও ছিল আরেকটি চিন্তার বিষয়।
আমাদের পরিবার এমনিতে খুব বৃহৎ, একান্নবর্তী না হলেও ঘনিষ্ঠ। আমরা ১৩ ভাইবােন আর আমার স্ত্রীর পরিবারের ৯ জন। এ ছাড়া আরও কত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। মা-বাবার দেখা জীবনে আর পাব কি না, তা অনিশ্চিত। ঢাকা-ওয়াশিংটনের বিমান টিকিটের মূল্য তখন প্রায় ১ হাজার ৩০০ ডলার আর ভ্রমণ এখনকার মতাে অত সহজ নয়। তার ওপর রয়েছে আত্মীয়স্বজনের ওপর পাকিস্তানিদের হামলার আশঙ্কা। কেউ কেউ উপদেশ দিলেন আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে, একটা কিছু যদি হিল্লে হয়। আরেক উপদেশ ছিল ইসলামাবাদে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়া। এম এম আহমদ ও মাহমুদ আলী দুজনই এই উপদেশ দিয়েছিলেন। আরেক পরামর্শ ছিল দূতাবাস ছেড়ে দাও, তবে কোনাে আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি নিয়ে চুপ করে সরে পড়াে, মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে যাও। এ রকম পরামর্শ দিয়েছিলেন ড. নূরুল ইসলাম, জাকারিয়া খান চৌধুরী এবং একসময় পাকিস্তানের দালাল মাহমুদ আলী। আমার স্ত্রীকে অনেক শুভানুধ্যায়ী এসে বােঝালেন যে আমি অল্পে উত্তেজিত হয়ে যাই। তাই তাকে শক্ত হাতে আমাকে সুস্থির করতে হবে।
আমাদের একান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রথমে জানালাম বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে, নিউইয়র্কে ২৯ মে শনিবার। ১৫ জুন আমি দূতাবাস ত্যাগ করব । চৌধুরী সাহেবের প্রতিক্রিয়া আগেই লিপিবদ্ধ করেছি। এফ আর খানকেও সিদ্ধান্তটি সেদিনই জানাই। তবে ১৫ জুনের তারিখটি আমি পরে ৩০ জুনে। বদলাই, যে কথা আগে বিবৃত করেছি।
জুন মাসটি আমার খুব মনঃকষ্টে কাটে। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল । আবু সাঈদ চৌধুরীর আশ্বাস ভালাে লাগে কিন্তু দ্বিধা পুরােপুরি কাটেনি। সবচেয়ে খারাপ লাগে দূতাবাসের সহকর্মীরা যখন আগেভাগেই সরে যেতে থাকেন। আতাউর রহমান চৌধুরী মাঝেমধ্যে খবর নিতেন। আর প্রায় প্রায়দিন রাতদুপুরে মােয়াজ্জেম আর নিশাত একবার এসে দুনিয়ার সব খবর দিয়ে যেত। নিশাত ছিল আমার এক সম্পর্কে ভাইঝি। ৩০ জুন আমি দূতাবাস থেকে বিদায় নিলাম আর সেদিনই এলেন বােস্টন থেকে তৈয়ব মাহতাব। মাহতাব মুজিবনগরে যাচ্ছেন। যােগাযােগ যন্ত্রপাতির জন্য প্রশিক্ষণ দিতে। আমার কাছ থেকে মুজিবনগর সরকারের কাছে প্রতিবেদন নিয়ে যাবেন। ওয়াশিংটন থেকে পররাষ্ট্রসচিব মাহবুব
১৩২
আলমকে আমার হাতে লেখা সাত পৃষ্ঠার চিঠিটি ছিল মুজিবনগর সরকারের কাছে ওয়াশিংটন মিশনের পাঠানাে প্রথম প্রতিবেদন। ১৭ ও ২৪ জুলাই আমাকে আরও দুটি প্রতিবেদন পাঠাতে হয়। তারপর এই কাজ বাংলাদেশ মিশন গ্রহণ করে এবং ২৪ আগস্ট সেখান থেকে প্রথম প্রতিবেদন শামসুল কিবরিয়া প্রেরণ করেন। আমার ৩০ জুনের প্রতিবেদন থেকে কয়েকটি মন্তব্য এখানে উদ্ধৃত করছি। এই প্রতিবেদনের কপি ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুজিবনগর সরকারের কাগজপত্র থেকে আমি খুঁজে পাই। জিয়াউর রহমানের আমলে এসব কাগজ নাকি ধ্বংস করা হয়েছে।
‘সিনেট ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টের সংশােধনী নিয়ে খুব সক্রিয়, অধুনা সিনেটে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের নেতা হিউ স্কটও এই সংশােধনীর একজন প্রস্তাবক হয়েছেন।…
‘পাকিস্তানে মার্কিন সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার খবরের এই সংশােধনী অনেকের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে এবং সিনেটে এটি পাস হবেই। তবে সামনের অধিবেশনে গ্রীষ্মবিরতি আছে বলে হয়তাে সেপ্টেম্বরের আগে বিষয়টি বিবেচিত হবে না।
‘সিআরএল গােষ্ঠী কংগ্রেসে খুবই সক্রিয়…আমরা একটি জায়গা খুঁজছি, যেখানে একটি ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন করা যায়। এ রকম একটি সেন্টার লবিস্টদের কাজ বুঝিয়ে দেবে, তাদের কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে এবং বাংলাদেশ সম্বন্ধে সব তথ্য সরবরাহ করবে। আমাদের খবর দিতে হবে যে বাংলাদেশে প্রতিরােধ শুধু চলছে না, বরং তা শক্তি সঞ্চয় করছে। বাংলাদেশ স্রেফ ভারতের সাহায্যপ্রাপ্ত একটি আন্দোলন নয়, এটি বাঙালিদের একটি সশস্ত্র, সক্রিয় ও শক্তিশালী সরকার। আপনাদের সঙ্গে আমাদের একটি নিয়মিত যােগাযােগসূত্র স্থাপন করতে হবে।
‘সর্বোপরি আগ্রহকে জিইয়ে রাখার জন্য মাঝেমধ্যে নতুন ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসতে হবে, মানুষের অনুভূতির কাছে আপিল করতে হবে। মাঝেমধ্যে মুজিবনগর থেকে লােকজন এসে আন্দোলনকে চাঙা করতে পারেন। আপনি বা ডা. মল্লিকের মতাে লােক ভ্রমণে এলে ভালাে হয়। আপনারা সরকারি লােকজনের সঙ্গে হয়তাে দেখা করতে পারবেন না কিন্তু সংবাদমাধ্যম ও কংগ্রেস আপনাদের লুফে নেবে।
‘এখানকার চিন্তাভাবনা ও ভবিষ্যৎ-চিন্তা হচ্ছে নিম্নরূপ : ১. ইয়াহিয়া সামরিক সমাধানে বিশ্বাসী, ২. পশ্চিম পাকিস্তান ভারত ও হিন্দুদের শায়েস্তা করার জন্য চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে বদ্ধপরিকর, ৩. পাকিস্তান চীনা সাহায্য সম্বন্ধে নিশ্চিত এবং ভারত এ বিষয়ে শঙ্কিত, ৪. অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের প্রভাব খুব সহজে অনুভূত
১৩৩
হয় না, তাই পাকিস্তান কষ্ট করে হলেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এ অবস্থায় সাফল্যের জন্য বাঙালি মুক্তিবাহিনীকেই প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে। তারা প্রশাসনকে বিকল করে দিতে পারে, যােগাযােগব্যবস্থা ব্যাহত করতে পারে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিতে পারে। তবে জায়গা দখল করে তা ধরে রাখার জন্য তাদের। সামরিক শক্তি বৃদ্ধি প্রয়ােজন, যা সময়সাপেক্ষ। ভারত ডিসেম্বরের আগে বড় রকমের কোনাে উদ্যোগ নিতে পারবে না, তবে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা সব হিসাব ব্যর্থ করে দিতে পারে। কিছু এলাকা দখল করে আমাদের সেখানে প্রতিষ্ঠা পেতে। হবে। তাহলে আমরা স্বীকৃতি ও সাহায্য পাব। তবে সীমান্ত যুদ্ধ ঘটলে পাকিস্তানের পাগলা কুকুরেরা একটি উপমহাদেশীয় যুদ্ধ লাগিয়ে দিতে পারে । পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের আশঙ্কা আছে। এই হলাে এখানকার উচ্চ মহলের চালু গালগল্প এবং ভবিষ্যৎ-চিন্তা।
‘বিশ্ব ব্যাংক পাকিস্তানের ব্যাপারে লম্বা ছুটিতে আছে। নিক্সন চান। ম্যাকনামারা পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে যান। তবে ম্যাকনামারা ভিয়েতনামের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আর নিক্সনের খেলা খেলবেন বলে মনে হয় না । নিক্সন ম্যাকনামারাকে ভীষণ অপছন্দ করেন। মুদ্রা তহবিলের সােয়াইটজারের ওপর চাপ পড়বে প্রবল, তবে বিশ্ব ব্যাংককে ফেলে সােয়াইটজার এগােতে পারবেন বলে মনে হয় না।’
আমরা যখন আমাদের নিকটতম বন্ধুমহল থেকেই এ রকম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম, তখন বিশ্ব ব্যাংকের বাঙালিরা কিন্তু আমাদের পরিত্যাগ করেনি। হারুন তাে নিজেই ছিল মুক্তিযােদ্ধা। আর ছিল অর্থনীতিবিদ ড. মনােয়ার হােসেন ও শিক্ষাবিদ ড. শেখ আবদুন নুর। মনােয়ার ও পুতুলের অনেক মার্কিন ও ভারতীয় বন্ধুবান্ধব ছিল এবং তারা সব সময় সদলে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিল। নুর ও নাজমা সব সময়ই আমাদের খোজ নিত। আমাদের এই নিঃসঙ্গ সময়ে একদিন। মাহবুবুল হকের স্ত্রী আমার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে আসেন। মাহবুবুল হকের স্ত্রী খাদিজা হক বাঙালি এবং বাণী নামে সমধিক পরিচিত। মাহবুবুল হক পাকিস্তানের নামকরা অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনাবিশারদ। তাঁর স্ত্রীও এদিক থেকে কম যান না। মাহবুব পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে আমার সহকারী। পরে তিনি প্রধান অর্থনীতিবিদের পদ অলংকৃত করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি পাকিস্তানে পরিকল্পনামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীও হন। ১৯৯০ সালে তিনি জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার পৃষ্ঠপােষকতায় মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। পরপর ছয়টি বিখ্যাত প্রতিবেদন উপস্থাপনার পর তিনি পাকিস্তানে একটি মানব উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করেন, যার নির্বাহী সভাপতি তিনি এবং বাণী তার সহসভাপতি ও প্রকৃত পরিচালক হন।
১৩৪
বাণীর কাছ থেকে পাকিস্তানি মহলের অনেক খবর আমার স্ত্রী জানতে পারলেন। বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলে তখন বেশ কজন পাকিস্তানি কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে আমার সগােত্রীয় প্রশাসক ছিলেন তিনজন—সৈয়দ শাহিদ হােসেন, আবুল ওয়াসে মইনি ও বশির আহমদ। বাণীর খবরে প্রকাশ হলাে যে বন্ধুমহলে সবচেয়ে ভয়ংকর ও ঘৃণিত ব্যক্তি বলে আমার সুনাম রয়েছে। আমাকে পারলে গুলি করে মারা উচিত বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। এই কথােপকথন আমাদের খুব চাঙা করে, আমরা আরও দৃঢ়চিত্ত হই। বাণীর সহানুভূতি—যাতে নিশ্চয়ই তাঁর স্বামীরও অবদান ছিল—আমাদের খুব প্রীত করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র মাহবুবের সঙ্গে মেজাজ খারাপ না করে কুশল বিনিময় করা যেত। যুদ্ধ যে কী ভয়ংকর জিনিস, মানুষের সুরুচিকে কীভাবে যে তা ধ্বংস করে দেয়!
মে মাসে অনেক চিঠি পেলাম। ইসলামাবাদ থেকে মন্ত্রিসভা সচিবালয়ের উপসচিব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী হেদায়েত আহমদ ১৮ তারিখ লেখে, ‘কিন্তু সত্যি বলতে কি লেখার তেমন কিছু নেই, যদিও পরিহাসের বিষয় হলাে যে দেশে ইতিমধ্যে এত কিছু ঘটে গেছে, আমি এখন পর্যন্ত সিলেট থেকে কোনাে চিঠি পাইনি কিংবা সেখানে জীবন ও সম্পদের যে কী ক্ষতি হয়েছে, সে সম্পর্কে কিছু জানি না। তােমরা সম্ভবত আন্তর্জাতিক সূত্রে এ বিষয়ে অনেক বেশি জানাে। তারপরে তিনি জানালেন যে বাঙালি কর্মকর্তাদের—মুজিবুল হক, আনিসুজ্জামান, আজহার আলী এবং আরও কজনকে পশ্চিমে নিযুক্ত করা হয়েছে। তেমনি পাকিস্তানিদের-হাসান জহীর, আলমদর রাজা, আখলাক হােসেন, মনসুর কাজিম ও খালেদ মাহমুদকে পূর্বে পাঠানাে হচ্ছে। হেদায়েত আহমদ বাংলাদেশে শিক্ষাসচিব, রাষ্ট্রদূত ইত্যাদি পদে থেকে ইউনেসকোর ব্যাংকক আঞ্চলিক দপ্তরে পরিচালক হিসেবে অবসর নেন। আমার ভগ্নিপতি তথ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা বজলুন নুর করাচি থেকে ৩০ মে লেখে, ‘বাড়ি থেকে অবশেষে চিঠিপত্র। পেয়েছি। ঢাকায় ও সিলেটে আত্মীয়স্বজন ভালােই আছেন। তবে সংকটের সময় সবাই বাড়ি ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যান। আপনাদের বাড়িতে কিছু ক্ষতি হয়েছে এবং জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে।…আমরা এখন সিলেটে যাব না। ঢাকার সঙ্গে যােগাযােগব্যবস্থা এখনাে চালু হয়নি। তা ছাড়া খাওয়াদাওয়ার জিনিস দুষ্প্রাপ্য অথবা দুমূল্য, বেবি ফুড, চিনি ইত্যাদি নাকি পাওয়াই যায় না। লােক আতঙ্কিত, কোনােমতে নিশ্বাস ফেলছে।
সানফ্রানসিসকো থেকে পুরােনাে এক বন্ধু আবুল কাসেম লেখে, ‘গিন্নির আসার কথা, কিন্তু দেড় মাস ধরে কোনাে খবর নেই। মার্চের ২২ তারিখ বগুড়ায় গিয়েছিল আমার শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করতে ।…মার্কিন কনসাল জেনারেল খবর
১৩৫
দিয়েছেন যে বউ-বাচ্চা দুজনই ভালাে আছে। কিন্তু ভালাে থাকা সত্ত্বেও চিঠি পাচ্ছি না, তাই একটু চিন্তিত। বন্ধুবান্ধবের খবরের জন্য ঢাকায় চিঠি দিয়েছি। মন্ট্রিয়ল থেকে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক এ এফ মুহম্মদ আমার ভাই ড. আবু আহমদ আবদুল মুহসীর সহকর্মী, তিনি লেখেন, ইতিমধ্যে আমার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দেশে যাওয়ার সময় হয়ে এল। কিন্তু দেশের অবস্থার জন্য যাওয়া হবে কি না, বলতে পারি না। ভাবছি মুহসী ভাইকে একটা চিঠি দেব। কিন্তু তার খবর বহুদিন থেকে পাইনি।…তার হাতে চিঠি পৌছাবে কি না, জানি না। তা ছাড়া চিঠি দিয়ে আবার তাদের কোনাে মুশকিলে ফেলে দিই কি না, তা নিয়েও ভয় হয়। আমার ভাই পাকিস্তানে আইসিআই কোম্পানির বিক্রয় ম্যানেজার আবদুল মুবদি (বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করে), ২১ মে করাচি থেকে লেখে, ‘আমি চিকিৎসার জন্য করাচিতে আসি ২৬ এপ্রিল। ১ তারিখে রেডিওতে খবর শুনে ৫ তারিখে ঢাকা যাই (ওই দিন আমার আব্বার মৃত্যুসংবাদ ঘােষিত হয়)। তবে খােদা মেহেরবান, সবাই ভালাে আছেন ।…ঢাকায় বাড়িভাড়া খুব কমে গেছে।
‘আমি আমার দপ্তরের কাছে কোথাও বাড়ি খুঁজছি।…এক মাস পর আব্বাআম্মা সিলেটে নিজ বাড়িতে ফিরেছেন। আব্বার শরীর ভালাে যাচ্ছে না। জিনিসপত্র মফস্বল এলাকায় যেতে পারে না বলে ওখানে দ্রব্যমূল্য গগনচুম্বী। আমি তাদের ঢাকায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। বুবু, দুলাভাই তাঁদের মেয়েদের নিয়ে অবশেষে তাদের ফ্ল্যাটে ফিরেছেন (চট্টগ্রাম শহরে)।…আমাদের উৎপাদন ম্যানেজার চলে গেছে বলে আমাকে ওই দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। বিক্রয় কমে যাওয়ায় সেদিকেও কাজ নেই, ফলে উৎপাদন কী হবে, তার কোনাে ভরসা নেই।…আমি আগামী মাসে মাস তিনেকের জন্য যুক্তরাজ্যে যাবার তালে আছি।’ মুবদি ময়মনসিংহ রােডে একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে আমার আম্মাআব্বাকে নিয়ে আসে এবং পরে লন্ডনে চলে যায়। দেশ স্বাধীন হলে পরে সে দেশে ফেরে। এসব চিঠিতে দেশের দুরবস্থা এবং মানুষের মনে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার সম্যক পরিচয় মেলে। এ রকম যখন খবর এবং নিজের বাড়িতে বন্ধুবান্ধবের পরিত্যক্ত অবস্থা, তখন মন আর ভালাে থাকে কী করে।
আমার আব্বা সিলেটে খুব বিপদের মধ্যে ছিলেন। তিনি আদিতে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় তিনি মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তারপর আর কোনাে দল করেননি। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাঁর অভিমত না নিয়ে তাঁকে শান্তি কমিটির সদস্য নিযুক্ত করে। তিনি সে জন্য সিলেট ছাড়ার তালে ছিলেন। আমার ভাই তাদের ঢাকায় অধিষ্ঠিত করে লন্ডনে চলে যান। আব্বার সিলেট ত্যাগ তাকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে।
১৩৬
তাঁকে কোনাে দিনই শান্তি কমিটিতে যেতে হয়নি। তিনি সিলেটে ফেরেন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে।
মে মাসেই একটি ভিন্নধর্মী চিঠি পেলাম। বন্ধুবর আজিজুল জলিল ব্রাসেলস থেকে লিখেছেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমসাময়িক, চাকরিতে এক গােত্রের, পিন্ডিতে একই সঙ্গে কাজ করতাম। জলিল পাকিস্তানে থাকতে ১৯৭০ সালে বিশ্ব ব্যাংকে একটি চাকরি পান। তখন ব্রাসেলসে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাউন্সিলর নিযুক্ত হওয়ায় বিষয়টি ভেবে দেখবার জন্য তিনি সময় চেয়ে নেন। বিশ্ব ব্যাংকের চাকরি তখন তত লােভনীয় ছিল না। ডেস্ক-প্রধান না হলে কাউন্সিলরের সমকক্ষ হওয়া দুরূহ ছিল, এমনকি বেতন-ভাতাও ছিল তুলনামূলক কম। পরিবর্তন শুরু হয় ম্যাকনামার শেষ সময় বিংশ শতকের আশির দশক থেকে। ওদিকে বেতনভাতা বেড়েছে আর এদিকে তা অনবরত কমেছে। জলিল লেখেন যে তিনি অতিসত্বর ওয়াশিংটনে আসছেন ব্যাংকের চাকরিতে যােগ দিতে । আমার মনে হলাে যে তিনি ডুবন্ত জাহাজ থেকে সরে যাচ্ছেন। ১২ জুন তাঁকে ডালাস বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা করে জর্জটাউনে এক হােটেলে নিয়ে গেলাম। তার মামা পাকিস্তানের বাণিজ্যসচিব আবদুর রব কিছুদিন আগে লন্ডন ও ব্রাসেলস ভ্রমণে যান। তাঁর কাছ থেকে জলিল কী বৃত্তান্ত শুনেছেন, সেটা জানতে চাইলাম। তিনি পরিষ্কারভাবে কিছু বলতে না পারলেও বুঝলাম যে মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জলিল খুব আশাবাদী নন। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে বেশি দিন একত্রে ঘর করা যাবে বলেও তার বিশ্বাস নেই। জলিল কিছুদিনের মধ্যে আমাদের পাড়া বেথেসড়ায় বাড়ি ভাড়া নেন। জলিল ও লিলি সব সময় আমাদের উৎসাহ দেন ও পাশে দাঁড়ান।
১৩৭
<p style="text-align: justify;"> সপ্তম অধ্যায়
সাফল্যের প্রথম উপলব্ধি
জুলাই মাসটি কাটে খুব ব্যস্ততার মধ্যে এবং পূর্ববর্তী মনঃকষ্ট ও দুর্ভাবনা নানা কাজের ও চিন্তার চাপে বিদায় নেয়। জেনারেল ইয়াহিয়া ২৮ জুন তাঁর বহু প্রতীক্ষিত ঘােষণা দিলেন। যাঁরা আশাবাদী ছিলেন, এরপর তাঁদেরও আশার কোনাে ভিত্তি রইল না। তিনি সংবিধান রচনার জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটির কথা বললেন। সাংবিধানিক কোনাে নতুন দিকনির্দেশনা তিনি দিলেন না, ছয় দফা সম্বন্ধে তাঁর কোনাে বক্তব্য ছিল না। তিনি আওয়ামী লীগকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করলেন এবং নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে দুষ্কৃতকারীদের তালিকা তৈরির ঘােষণা দিলেন। তার হিসাব ছিল, চার মাসের মধ্যে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা পাবে, অবশ্য তাদের সামরিক আইনের অধীনে কাজ করতে হবে। এই উদ্ভট প্রস্তাব ইয়াহিয়া বাঙালিদের হজম করতে বললেন এবং কয়েকজন কুলাঙ্গার তার এ ঘােষণা বাস্তবায়নের কাজে মেতে গেল। দু-একজন কুইসলিং বাঙালিও তাতে শামিল হলাে। ইয়াহিয়ার এই ঘােষণার বিশ্লেষণ ও তার প্রকৃত অর্থ সম্বন্ধে বহুজনের জন্য বহু বিবৃতি ও মন্তব্য আমাকে প্রস্তুত করতে হলাে। সমঝােতার কোনাে উপায় কি আর আছে? ইয়াহিয়ার প্রস্তাবে বাংলাদেশে কেউ কি সায় দেবে? পশ্চিমের রাজনীতিবিদেরা কি এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে?
এ সময় আমার আরেকটি অতি জরুরি কাজ ছিল, আশ্রয় প্রার্থনার জন্য প্রবাসন দপ্তরে হাজিরা দেওয়া। বার্নি আগেই আমাকে সব কাগজপত্র প্রস্তুতিতে সাহায্য করে। একদিন দারা-পুত্র-পরিবার-পাঁচজন এবং আমার পাচক আবদুল কাদিরকে নিয়ে গেলাম প্রবাসন দপ্তরে। দেশহীন হবার আশঙ্কা মােটেই ভালাে। লাগছিল না। যে কর্মকর্তার কাছে আমরা গেলাম, তিনি বাংলাদেশ সংকট সম্বন্ধে
১৩৮
অবহিত ছিলেন, তবে বাংলাদেশ থেকে আমরাই ছিলাম তার কাছে প্রথম আশ্রয়প্রার্থী। সামান্য সমস্যা হলাে আমার ছােট ছেলেকে নিয়ে। তার জন্ম আমেরিকায় অথচ তাকে পারিবারিক কারণে আশ্রয়প্রার্থী হতে হচ্ছে। আশ্রয় প্রার্থনার দরখাস্ত পেশ করার সময় পাঁচটি হাতের আঙুলের ছাপ দিতে হবে । আমাদের দেশে আঙুলের ছাপ নেওয়া হতাে শুধু ক্রিমিনালদের ক্ষেত্রে। তাই আঙুলের ছাপ দিতে গিয়ে খুব খারাপ লাগছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক চুকাবার বিষয়ে অতি সযত্নে আমি ইয়াহিয়ার কাছে একটা পদত্যাগপত্রের খসড়া কয়েক দিন ধরে প্রণয়ন করতে থাকলাম। আতাউর রহমান চৌধুরী পাকিস্তান দূতাবাসে আমার দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে দিলেন। আরও জানালেন যে আমি ইসলামাবাদ যেতে চাইলে পিআইএকে বললেই তারা আমার ভ্রমণের ব্যবস্থা করবে। পিআইএর কাছে সেই পাওনা আমার এখনাে রয়ে গেছে। ২১ জুলাই জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে আমি আমার ব্যক্তিগত বিদ্রোহের চিঠি পাঠালাম। তার অবৈধ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা একটি অসম্মানজনক অবস্থান বলে আমি চিঠিতে তাঁর সরকারের শ্রাদ্ধ করলাম। তাঁকে বাংলাদেশে গণহত্যা ও অবশ্যম্ভাবী দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করলাম। চিঠিটির কিয়দংশ ১৩ আগস্টের ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়; শিরােনাম ছিল একজন। কূটনীতিবিদের পদত্যাগ : পাকিস্তানের পাপের খতিয়ান।
এনবিসি টিভি সেই সময় একটি সাপ্তাহিক প্রােগ্রাম করত, যার নাম ছিল ‘মন্তব্য’ (Comments)। আধা ঘণ্টার প্রােগ্রাম পরিচালনা করতেন এড নিউম্যান আর তাতে একজন বক্তাকে হাজির করা হতাে যেকোনাে নির্দিষ্ট বিষয়ে আলােচনার জন্য। এ রকম একটি প্রােগ্রামে মিশিগানের সিনেটর হার্ট বিশ্ব খাদ্যসংকটের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী ও দুর্ভিক্ষের কথা উল্লেখ করেন। তিনি সিনেটর কেনেডির শরণার্থী কমিটির শুনানির কথাও বলেন । এনবিসি এ ব্যাপারে আরেকটি প্রােগ্রাম করার উদ্দেশ্যে সিনেটর কেনেডির সঙ্গে যােগাযােগ করে। তিনি বা তাঁর সহকর্মীরা পরামর্শ দেন যে এ বিষয়ে আমি বক্তব্য দিতে পারি। এনবিসির পামেলা হিল তখন এড নিউম্যানের তরফ থেকে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেন। আমি তিন সপ্তাহের মতাে হলাে পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়েছি কিন্তু তখনাে কোনাে প্রকাশ্য বক্তব্য দিইনি। তাই এই সুযােগ আমি নিতে মনস্থ করি। আলাপ-আলােচনার পর স্থির হলাে যে দুর্ভিক্ষের বিষয়ে আমি বলব বটে, তবে আমার মূল বক্তব্য হবে কেন পাকিস্তান সরকার ছাড়লাম, সে বিষয়ে। Why I Quit’ নামে আমার বক্তৃতাটি ২৭ জুলাই রেকর্ড করা হয়। এবং ১ আগস্ট তা প্রচারিত হয়। বক্তৃতায় আমি বলি যে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শােনা যাচ্ছে এবং তাতে দেড় কোটি মানুষ আক্রান্ত হবে।
১৩৯
২৬ জুলাই লন্ডনে ঘটা করে বাংলাদেশের ডাকটিকিট ছাড়া হলাে। আমরা ওয়াশিংটনের ইভনিং স্টার পত্রিকায় ২৭ তারিখেই সব কটি টিকিটের ছবি দেখলাম। নিউইয়র্কে এ এইচ মাহমুদ আলী এ নিয়ে একটি বিশেষ সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যবস্থাও করলেন। ডাকটিকিটের প্রকাশনা শুধু অর্থ আদায়ের একটি বিষয় ছিল না। এতে জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বেরও ঘােষণা নিহিত ছিল । পত্রিকায় ডাকটিকিটের ছবি দেখে আমাদের খুব আনন্দ হয়েছিল। একই সময়ে শােনা গেল যে পাকিস্তানের উন্মাদ সরকার শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসন শুরু করেছে। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে আগেই কড়া সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আন্তর্জাতিক জনমত জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকান প্রতিনিধি ম্যাসাচুসেটসের ব্র্যাডফোর্ড মাের্স এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানালেন। তিনি তাঁর আরও ৫৩ জন সহকর্মীকে নিয়ে একটি চিঠি প্রকাশ করলেন।
কংগ্রেসম্যান মাের্স ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে যােগ দেন এবং ১৯৭৫ সালে সংস্থাটির উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিচালক নিযুক্ত হন। প্রায় ১০ বছর এই পদে তিনি অত্যন্ত যােগ্যতার সঙ্গে কর্তব্য সম্পাদন করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন। কিসিঞ্জার-নিক্সন জুটি দাবি করে যে তাদের হস্তক্ষেপে জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে রেহাই দিতে বাধ্য হন। কিন্তু সত্যি কথাটা হলাে, ক্ষমতা হস্তান্তর করার আগে। ইয়াহিয়া শেখ সাহেবকে ফাঁসি দেওয়ার চেষ্টা করেন, কারারক্ষীর মানবতাবােধের জন্য সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইয়াহিয়ার ওপর বিশ্বজনমত ও নেতৃবৃন্দের প্রচণ্ড চাপ ছিল, যাতে তিনি শেখ মুজিবকে ফাঁসি না দেন। হয়তাে সে কারণেও ইয়াহিয়া শেখ সাহেবকে ফাঁসি দিতে ইতস্তত করেন। তবে তিনি তখন যে রকম উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন, তাতে শেখ মুজিব বস্তুতই অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
৫ জুলাই মুজিবনগর থেকে বার্তা এল পাকিস্তান দূতাবাসের সব বাঙালি কূটনীতিবিদের কাছে। এ এইচ মাহমুদ আলী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বার্তা সবাইকে বিতরণ করেন। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার বিদেশে অনেকগুলাে মিশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্য ঘােষণা করার এটাই উপযুক্ত সময় এবং আপনাদের এসব মিশনে কাজ করার দায়িত্ব নিতে হবে। আপনার আনুগত্য আপনি তারবার্তার মাধ্যমে কলকাতার ৯ সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের বাংলাদেশ মিশনে এক পক্ষকালের মধ্যে জানিয়ে দিলে আপনার দায়িত্ব নির্ধারণ করা হবে। বাংলাদেশ সরকার আপনাদের
১৪০
সবাইকে আপনাদের উপার্জন ও চাকরির নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আপনারা স্থানীয়ভাবে। সাহায্যের জন্য বন্ধুস্থানীয় মিশনের সঙ্গে যােগাযােগ রাখবেন।’
এই বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কের কূটনীতিবিদেরা একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তারা এই নির্দেশ মানবেন এবং আগস্টের শুরুতে তাদের আনুগত্য ঘােষণা করবেন। এস এ করিমের নামিবিয়া কমিশনের তরফ থেকে আফ্রিকায় যাওয়ার কথা ছিল। তিনি জুলাইয়ের শেষে এই সফর থেকে ফিরে আসবেন। এনায়েত করিম তখন হাসপাতালে সুস্থ হওয়ার পথে। তাকে গৃহ পরিবর্তন করতে হবে। কারণ, তাঁর বাড়িটি ছিল পাকিস্তানের সম্পত্তি । আবু রুশদ তাঁর মেয়ে ও জামাইকে লন্ডনে বের করে আনার ব্যবস্থা হাতে নিলেন। এক মাসের কম সময়ে সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে, এই পরিপ্রেক্ষিতে শামসুল কিবরিয়া প্রস্তাব করলেন যে আমি যেন আমার প্রকাশ্য ঘােষণাটি দিতে খানিকটা দেরি করি । যুক্তি ছিল যে আমি যদি বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করি, তাহলে পাকিস্তান সরকার তাঁদের ওপর আগেই হামলা করতে পারে ।
আমার সহকর্মীদের সিদ্ধান্ত মাহমুদ আলী মুজিবনগরে পৌছে দিলেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে এল বিপত্তি। এস এ করিম তখন আফ্রিকায়। এনায়েত করিমের দ্বিতীয়বারের মতাে হৃদ্রােগ হলাে এবং তাঁকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নিতে হলাে। আমি প্রথমে কানাঘুষার মাধ্যমে অবহিত হলাম যে আগস্টের। সিদ্ধান্তে অটল থাকা যাবে না। চৌধুরী জানালেন যে কোনাে কূটনীতিবিদই এখন দূতাবাস ছাড়বেন না। সুতরাং তিনি একা আর কী করবেন । আবু রুশদ বললেন যে তার ঢাকায় যাওয়াই শ্রেয়, তিনি প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষক মানুষ, তাঁর ঝামেলার মধ্যে গিয়ে লাভ নেই। মিসেস কিবরিয়া আমার স্ত্রীকে জানালেন যে এই অবস্থায় তাঁরা আফগানিস্তানে বদলিতে চলে যাবেন। মােয়াজ্জেম আর নিশাত, যারা তখনাে নিয়মিত আমার আস্তানায় আসে, তাদের অভিমত হলাে, তারা জ্যেষ্ঠদের অনুসরণ করবে। আমি আমার ১৭ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে মুজিবনগর সরকারের কাছে এই অবস্থা বিবৃত করে আমার টিভি প্রােগ্রামের নােটিশ দিলাম। জুলাই মাসে সহকর্মীদের সঙ্গে আমার আর যােগাযােগ রইল না। কিন্তু তখন আমার একাকিত্ব ঘুচে গেছে। কংগ্রেসে গালাগার সংশােধনী নিয়ে তােলপাড় শুরু হয়েছে। গ্রীষ্মবিরতির আগেই তারা সিদ্ধান্ত নিতে চান, তাই লবিং অনেক বেড়েছে। সিনেটর কেনেডি সদলবলে ভারত ও বাংলাদেশে যাবেন। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে; তার জন্য প্রস্তুতি চলছে। ভ্রমণসূচি বানানাে ছাড়াও রয়েছে অবস্থা ও সমস্যা নিয়ে ব্রিফিং, বিশেষ করে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নিয়ে।
বাংলাদেশ সরকার আনুগত্য পরিবর্তনের জন্য শুধু কূটনীতিবিদদেরই নির্দেশ দেয়। নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত ছিল যে কেউ যদি দূতাবাস
১৪১
ছেড়ে দেয় বা কাউকে যদি বরখাস্ত করা হয়, তবে তাকে অবশ্য কোনাে না। কোনাে মিশনে নিযুক্ত করা হবে। সমস্যা ছিল দুই রকমের। প্রথমত, সব দেশে মিশন স্থাপন করা সম্ভব ছিল না, যেমন রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহকে বাগদাদ ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে তাঁর আনুগত্য পরিবর্তনের ঘােষণা দিতে হয়। তিনি ২১ আগস্ট এই পদক্ষেপ নেন এবং মুজিবনগরে গিয়ে সেখানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয়ত, টাকাপয়সারও একটি সমস্যা ছিল, বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ খুব সহজসাধ্য ছিল না এবং নানা কাজে তার প্রয়ােজন ছিল। ভারত সরকারের কাছ থেকে একটি সাহায্য বৈদেশিক মুদ্রায় পাওয়া গেলেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ জারি হয়। এতে বাঙালি কুটনীতিবিদদের আনুগত্য পরিবর্তনের নির্দেশ দিতে মুজিবনগর সরকার যে কয়েক মাস দেরি করে তার কারণটি আমরা বুঝতে পারলাম। সরকারি চাকুরেরা সাধারণত বিপ্লবী হন না, তাঁদের স্বাভাবিক আচরণ হলাে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। ন্যূনতম সংঘাত বা প্রতিরােধের পথ তাঁদের প্রিয়।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল সরকারি চাকুরেদের কাছে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। তারা অবৈধভাবে দখলকারী একটি সরকারের চাকরিতে থাকবেন, নাকি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করবেন। অবস্থার বিপাকে অনেকেই অবশ্য বিদ্রোহ ঘােষণা করতে সক্ষম ছিলেন না। বিদেশে নিযুক্ত কূটনীতিবিদদের অনেকে এ রকম অক্ষমতার শিকার ছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগেরই ছিল সাহস ও বিশ্বাসের অভাব । আগস্টে ওয়াশিংটনের ছয়জন ও দুজন স্থানীয় কর্মকর্তা, লন্ডনে চারজন, হংকংয়ে একজন এবং ইরাকের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। বাংলাদেশ সরকার অক্টোবর পর্যন্ত এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং অবশেষে চূড়ান্ত নােটিশ জারি করে। তাতে আরও সাতজন সাড়া দেন। এবং চারজন নভেম্বরের কয়েক দিন সময় চেয়ে নেন। এ ছাড়া বিজয়ের আগে লন্ডনে আরেকজন আনুগত্য পরিবর্তন করেন। অবশ্য শুরুতেই ভারতে সাতজন এবং আমেরিকায় এপ্রিলে একজন ও জুনে একজন কূটনীতিবিদ ছাড়াও কলকাতায় একজন, লন্ডনে একজন এবং ওয়াশিংটনে একজন আধা কূটনৈতিক কর্মকর্তা বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। নিম্নপদস্থ আরও কতজন কর্মচারী সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার সঠিক হিসাব আমার জানা নেই।
কূটনীতিবিদদের আনুগত্য পরিবর্তন পাকিস্তান সরকারের বৈধতা নিয়ে জটিল প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে শক্তিশালী করে। ১৯৭২ সালে যখন দেশে ফিরলাম, তখন বাংলাদেশের নানা জায়গায় সামরিক ও বেসামরিক মহলে শুনেছি যে আনুগত্য পরিবর্তনের একেকটি ঘােষণা তাদের মনে। বিজয়ের উদ্দীপনা সঞ্চার করত এবং আরও দৃঢ়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে
১৪২
প্রেরণা দিত। বিদেশে নিযুক্ত বাঙালি কূটনীতিবিদদের মােট ৩ জন ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। এ ছাড়া তাদের সঙ্গে ছিলেন। ৮ জন অকূটনৈতিক কর্মকর্তা এবং আরও প্রায় ৮০ জন নিম্নপদস্থ কর্মচারী। কিন্তু তারপরও ৫৪ জন কূটনীতিবিদ পাকিস্তানের সেবায় লিপ্ত থাকেন বিজয় দিবস পর্যন্ত । যাদের মধ্যে রাষ্ট্রদূত ছিলেন ১১ জন। বাংলাদেশের পক্ষে মাত্র ৩ জন রাষ্ট্রদূত, ২ জন মিনিস্টার এবং আরও ৩৩ জন কূটনৈতিক কর্মকর্তা আনুগত্য পরিবর্তন করেন। ৭ জন রাষ্ট্রদূতসহ আরও ৪৩ জন কূটনীতিবিদ পাকিস্তানের পরাজয় অবধি দেশটির সেবা করে যান। আর ৬ জন বাঙালি কূটনীতিবিদ, যাদের মধ্যে ৩ জন ছিলেন রাষ্ট্রদূত, বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে যাবার পরও পাকিস্তানের চাকরিতে বহাল থাকেন। তাদের মধ্যে একজন হুমায়ুন খান পন্নী পাকিস্তান থেকে অবসর নিয়ে বাংলাদেশে এসে বিএনপির পক্ষে রাজনীতি করে, আমাদের জাতীয় পরিষদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। ছি ছি ছি!
মার্কিন কংগ্রেস আগস্টে গ্রীষ্মের ছুটিতে যায়। জুনের শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লম্বা ছুটি শুরু হয়। কংগ্রেসের ছুটির আগে খুব জোরেশােরে লবিংয়ের কাজ শুরু হলাে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র-শিক্ষকেরা এসে কংগ্রেসের দালানে দালানে পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য বন্ধের জন্য তদবির করতে থাকেন। আমার নিজের ব্যস্ততাও এ সময় খুব বেশি ছিল। বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার গােটা বিষয়টি সমন্বয় ও পরিচালনা করছিল। অবশেষে প্রতিনিধি পরিষদে ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইন বিবেচনার জন্য হাজির হলাে। ৩ আগস্ট ছিল চূড়ান্ত দিন। তার আগে ২ আগস্টে টাইম ও নিউজউইক দুটি সাপ্তাহিকীই বাংলাদেশকে নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনি প্রকাশ করল । টাইম-এর শিরােনাম ছিল পাকিস্তানের তীব্র যন্ত্রণা—সােনার বাংলাদেশে বিধ্বস্ত’ । নিউজউইকও কম গেল না, তাদের শিরােনামটি ছিল বাংলা—একটি জাতিকে হত্যা’।
১ তারিখে এনবিসিতে দেওয়া আমার বক্তৃতাও তখন বহুল প্রচারিত এবং কংগ্রেসের দুই পরিষদেই তা নিয়ে আলােচনা হচ্ছে। ৩ তারিখে আইনটি নিয়ে। বিতর্ক শুরু হলাে। দুটি দেশে সাহায্য প্রদান নিয়ে সংশােধনী প্রস্তাব। পাকিস্তানে অবস্থা স্বাভাবিক না হলে এবং শরণার্থীদের নির্ভয়ে ফেরার ব্যবস্থা না হলে সে দেশে সব সাহায্য বন্ধ থাকবে। গ্রিসে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানেও সাহায্য বন্ধ করা হবে। বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারে কংগ্রেস সাধারণত এ রকম বিধিনিষেধ আরােপ করে না, তারা সার্বিকভাবে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়। বৈদেশিক সাহায্যে প্রধানত পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন ঘটে। তাই এই সংশােধনী দুটি পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় আমেরিকান নির্বাহী বিভাগের হাত বেঁধে দেয়। এতে নির্বাহী বিভাগের বন্ধুবর্গ এবং পাকিস্তান ও গ্রিসের শুভানুধ্যায়ীরা
১৪৩
বেশ বিচলিত হলেন। গালাগার সংশােধনীর বিরুদ্ধে কয়েকজন আপত্তি তুললেন। কিন্তু পাকিস্তানের পৈশাচিক কর্মকাণ্ড এতই নিন্দিত ছিল যে সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনের কোনাে রাস্তাই তখন ছিল না।
নিরপেক্ষ নীতির দাবিতে এবং মানবিক কারণে ত্রাণকার্য অব্যাহত রাখার যুক্তিতে পাঁচজন প্রতিনিধি—নিউজার্সির পিটার ফ্রিলিং হাইসেন, ফ্লোরিডার রবার্ট সাইকস, ইন্ডিয়ানার উইলিয়াম ব্রে, নিউইয়র্কের মারিও বিয়াগি এবং পেনসিলভানিয়ার রবার্ট নিক্স পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দেন। ইলিনয়ের রবার্ট ডারউইনস্কি একটি খুব ধূর্ত প্রস্তাব দিলেন যে এক বছরের জন্য সাহায্য বহাল রেখে পরবর্তী সময়ে বিষয়টি পর্যালােচনা করা হােক। ক্যালিফোর্নিয়ার উইলিয়াম মেইলি বিতর্কটিকে সােজা রাস্তায় আনতে গিয়ে পরিষ্কার করে নিলেন যে মানবিক সাহায্য নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে না। পাঁচজন প্রতিনিধি নিউজার্সির কর্নেলিয়াস গালাগার, নিউইয়র্কের বেলা আবজুগ, হাওয়াইয়ের প্যাটসি মিঙ্ক, ইলিনয়ের জন এন্ডারসন ও ড্যান রস্টেনস্কি অবশ্য সংশােধনীর পক্ষে বক্তব্য দেন। আমরা কজন তখন অধীর আগ্রহে গ্যালারিতে বসে বিতর্ক শুনছি এবং ভােটের জন্য অপেক্ষা করছি। অনেক প্রতিনিধি নির্বাহী বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চান না। অনেকে গ্রিসের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অপছন্দ করেন । অনেকে মনে করেন, আমাদের যুদ্ধটা আসলে দুই দলের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই। অনেক প্রতিনিধি বাংলাদেশ-পাকিস্তান নিয়ে তত উদ্বিগ্নও ছিলেন না। সিনেটের অবশ্য অবস্থা অন্য রকম, সেখানে সদস্যরা অত্যন্ত সজাগ এবং পররাষ্ট্র বিষয়ে সচেতন। আমার মনে পড়ে, ভােট নেওয়া হয় প্রায় সন্ধেবেলায়। ১৯২ জন প্রতিনিধি সংশােধনীর বিপক্ষে ভােট দিলেন, কিন্তু ২০০টি হ্যা’ ভােটে আমাদের বিজয় হলাে। মনে হলাে যেন আমরা একটি যুদ্ধ জয় করেছি। কংগ্রেসম্যান। গালাগার ও তার সহকারী চার্লস খুব খুশি। সদা চঞ্চল বেলা আবজুগের উল্লাস আমার চোখে পানি এনে দিল। আমার সঠিক মনে নেই তবে ফজলুল বারী ও রাজ্জাক খান বােধ হয় সেদিন গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে আরেকটি যুগান্তকারী বিষয় নিয়েও আমরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এস এ করিম জুলাইয়ের শেষে আফ্রিকা ভ্রমণ শেষ করে নিউইয়র্কে ফিরলেন। তিনি এসেই জানালেন যে এনায়েত করিমের অসুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনে তাঁর সহকর্মীরাও আনুগত্য পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত পাল্টেছেন। তিনি আমাকে টেলিফোন করে বললেন যে বাঙালিদের আর পাকিস্তান দূতাবাসে কাজ করা সমীচীন নয় এবং তিনি এ ব্যাপারে তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করতে ওয়াশিংটনে আসছেন। তিনি জানতে চাইলেন যে মুজিবনগরের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার আলােচনা হয়েছে কি না। আমি তাঁকে
১৪৪
জানালাম যে আমার ২৪ জুলাইয়ের প্রতিবেদনে আমি এ ব্যাপারে শুধু সাবধান করে দিয়েছি, নির্দিষ্টভাবে কিছু বলিনি। আমি কিন্তু ইতিমধ্যে ওয়াশিংটন ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে ৪ জুলাইয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়ােজন করেছি। আমার বন্ধু রােনাল্ড কোভেন আমার নামে হলঘর রিজার্ভ করে রেখেছেন। এস এ করিম আফ্রিকা যাওয়ার আগেই এ উপলক্ষে একটি বিবৃতির খসড়া আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সেটি সম্পাদনা করে ইতিমধ্যে স্টেনসিল কেটে রেখেছি। প্রস্তুতি সবই ঠিক, এমনকি এনায়েত করিমের পরিবারের জন্য একটি বিকল্প বাসস্থানও দেখে রাখা হয়েছে। তারা পাকিস্তানের নিজস্ব ভবনে থাকতেন, তাই বিকল্প ব্যবস্থাটি করতে হয়েছিল ।
সম্ভবত ১ আগস্ট রােববার এস এ করিম এসে শামসুল কিবরিয়ার বাড়িতে আস্তানা গাড়লেন এবং একজন একজন করে তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলােচনা চালালেন। সর্বশেষ তিনি বিকেলে আমাকে ডাকলেন তাঁদের বৈঠকে যােগ দিতে। তিনি জানালেন যে ৪ আগস্ট আনুগত্য পরিবর্তনে সবাই একমত হয়েছেন, বাকি রয়েছে শুধু এনায়েত করিমের মতামত নেওয়া। তার অবস্থা নিয়ে মুজিবনগরের সঙ্গে আলােচনা করা হবে, যাতে তাঁর পরিচর্যার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় । মিসেস হুসনা করিম সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন যে তার স্বামী আনুগত্য পরিবর্তনের যে সিদ্ধান্ত হাসপাতালে যাবার আগে নিয়েছিলেন, তার কোনাে পরিবর্তন চান বলে তার জানা নেই। যদি পুনর্বিবেচনা করতে হয়, তাহলে তার অভিমত নেওয়া উচিত। আমার মনে পড়ে, আমরা তিনজন তখন এনায়েত করিমের সঙ্গে আলােচনার জন্য সিবলি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে যাই—এস এ করিম, মিসেস হুসনা করিম ও আমি। শামসুল কিবরিয়া সম্ভবত মুজিবনগরের সঙ্গে যােগাযােগে ব্যস্ত ছিলেন। তখন আন্তমহাদেশীয় টেলিফোনে অনেক সময় লাগত, বােতাম টিপলেই হতাে না।
হাসপাতালে এনায়েত করিমের কামরায় পৌছেই এস এ করিম তাকে জানালেন যে তার অসুস্থতার কারণে তাঁর অনেক সহকর্মীর মন ভেঙে গেছে, তবে সবার সঙ্গে কথা বলে তার মনে হয়েছে, ৪ আগস্টেই তাঁরা সবাই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিতে চান। তাঁর সম্মতি থাকলে বিষয়টি এখানেই নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। তাঁকে পাকিস্তানি বাড়ি থেকে স্থানান্তরের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তার সম্বন্ধে মুজিবনগরের সঙ্গেও যােগাযােগ করা হচ্ছে। এনায়েত করিম এ বিষয়ে ভাববার কোনাে অবকাশ না দিয়েই জানালেন যে তাঁর অসুস্থতার কারণে পূর্বতন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনাে সুযােগ বা কারণ নেই। তাঁর স্ত্রী নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলনে তার তরফ থেকে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে উপস্থিত থাকবেন। যাকে কেন্দ্র করে সকলের এত চিন্তা এবং দোটানা ভাব, তার কিন্তু এ ব্যাপারে
১৪৫
সামান্যও উদ্বেগ ছিল না। তিনি হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বটে কিন্তু তার সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা তাতে এতটুকুও শিথিল হয়নি।
৩ আগস্ট ঘরে ফিরে আমাদের অনেক কাজ। পরদিনের অনেক প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। বিবৃতি ছাপাতে হবে। পদত্যাগী কূটনীতিবিদদের একটি পরিচয়নামা বানাতে হবে। পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মচারীদের প্রতি দুর্ব্যবহারের ফিরিস্তি তৈরি করতে হবে। পরিচিত সাংবাদিকদের সংবাদ সম্মেলনের ব্যাপারে জানাতে হবে। তাদের বলতে হবে যে সেখানে বড় রকমের একটি ঘােষণা দেওয়া হবে। রন কোভেন ও বেন ওয়েলসকে অবশ্য আসল। কথাটি জানিয়ে দিলাম। তবে পরদিন সকাল পর্যন্ত তাদের বিষয়টি গােপন রাখতে অনুরােধ জানালাম। লন্ডন, শিকাগাে ও মুজিবনগরে যােগাযােগ করার চেষ্টা করলাম। দূতাবাসের অনেকেই অনেক রাত পর্যন্ত নানা কাজে ব্যস্ত রইলেন। আমার কাজ গুছিয়ে নিতে ভাের হয়ে গেল। আমি যখন বিচারপতি চৌধুরীকে লন্ডনে পেলাম, তখন সেখানে তাঁর জন্য ছিল কাকডাকা ভাের। তিনি বােধ হয় আমার কথাটি ঠিক ধরতে পারেননি। তাই ঘণ্টাখানেক পর আবার তিনিই টেলিফোন করলেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনের সব বাঙালি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করবেন এবং একটি সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করবেন। অনেক চেষ্টার পর শেষ রাতে মুজিবনগর থেকে তৈয়ব মাহতাবের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। পররাষ্ট্রসচিব মাহবুব আলমও তাঁর পাশে অধীর আগ্রহে বসে আছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা হলাে, তারা ওয়াশিংটন সময়টা ঠিকমতাে জেনে নিলেন। কারণ, একই সঙ্গে কলকাতা ও দিল্লি থেকেও ঘােষণাটি প্রচার করা হবে।
আমাদের সংবাদ সম্মেলনে কিন্তু প্রথম দিকে সাংবাদিক ছিলেন খুব কম। আমার বক্তব্য ইতিমধ্যে টেলিভিশন, রেডিও ও সংবাদপত্রে প্রচারিত হয়েছে। তাই তারা নতুন কিছু আশা করেননি। তা ছাড়া সাংবাদিকেরা ঠিক ওই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ সম্মেলনে ভিড় করেন। একই সময়ে বেলা ১১টায় হােয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাঁর চীন উদ্যোগ সম্বন্ধে একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সেখানে আগের দিন হাউসে পাস হওয়া ফরেন। অ্যাসিস্ট্যান্স আইন নিয়ে আলােচনাও স্বভাবতই প্রত্যাশিত ছিল। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার মূল বক্তব্যে যাওয়ার আগেই পাকিস্তানের বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেন। তিনি তিনটি বিষয়ে কথা বলেন। প্রথমত, শরণার্থীদের জন্য এবং বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকানাের লক্ষ্যে মার্কিন উদ্যোগের বিবরণ দেন তিনি।
১৪৬
দ্বিতীয়ত বলেন যে এ বিষয়ে অতিরিক্ত পদক্ষেপের জন্য সেক্রেটারি বিল রজার্স সত্বর জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক করতে যাচ্ছেন। তৃতীয়ত, তিনি কংগ্রেসের বিধিনিষেধের বিষয়ে তাঁর ঘাের আপত্তি জানান এবং বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখলে সেখানে প্রভাব বিস্তারের সুযােগ থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এটি হবে পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ নিরসন ও ভারতে শরণার্থীপ্রবাহ রােধে সবচেয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং আমাদের বিশ্বাস, এই পথে এগােলে ভবিষ্যতে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির সম্ভাবনা থাকবে। নিক্সনের মনে পাকিস্তান কিন্তু ভাগ হয়েই গিয়েছিল এবং তাঁর সব চিন্তা ও উদ্বেগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। নিক্সনের সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই আমেরিকার সব বাঙালি কর্মচারীর পাকিস্তানকে অস্বীকার করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের কথা রাষ্ট্র হয়ে পড়ে। তাই দেরিতে এলেও প্রেসক্লাবে (হােয়াইট হাউস থেকে রাস্তা পেরিয়ে কাছেই) জমল সংবাদমাধ্যমের ভিড় আর বিশেষ করে টেলিভিশনের জন্য আমাদের অনেক কথার পুনরাবৃত্তি করতে হলাে, অনেকবার ছবি তােলার জন্য পােজ দিতে হলাে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল যে পাকিস্তানিরা এ খবরে একদম হতভম্ব হয়ে যায়। এত বড় ঘটনা ঘটবে তারা মােটেই আঁচ করতে পারেনি। আর এনায়েত করিমের পরিবার যে আগের রাতে ম্যাকলিনে পাড়ি দিয়েছে, তা-ও টের পায়নি। আমার মনে হয় যে রাষ্ট্রদূত হিলালি একে তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে গ্রহণ। করেন। মাস দুয়েক পর পাকিস্তান সরকার যখন তাকে অবসর দিয়ে জেনারেল। এ এন এম রাজাকে রাষ্ট্রদূত করে পাঠাল, তখন তার খুবই মনঃকষ্ট হয়। পাকিস্তান দূতাবাসের ভাড়া করা জনসংযােগ কর্মকর্তা কুতুবুদ্দিন আজিজ এ। সম্বন্ধে তাঁর বই Mission to Washington-এ লেখেন, যখন প্রেসিডেন্ট নিক্সন পাকিস্তানের জন্য তার সমর্থন ঘােষণা করছিলেন, ঠিক তখন পাকিস্তান দূতাবাসের ১৪ জন বাঙালি কর্মচারী ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘােষণা করছিলেন। যে ব্যক্তি এই ঘটনা পরিচালনা ও তদারক করেন, সেই মুহিত পাকিস্তানের নিন্দাবাদ ঘােষণা রচনা করেন। তারা এ ব্যাপারে দূতাবাসকে কোনাে পূর্বাভাস দেননি।
৪ আগস্ট ৬ জন কূটনীতিবিদসহ ১৪ জন বাঙালি পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। এর আগে দুজন। কূটনীতিবিদসহ আরও আটজন কর্মচারী বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করেন । এদিন নিক্সনের ভাষ্য প্রমাণ করে, আমেরিকার পাকিস্তানি দূতাবাস প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানি দূতাবাসে পরিণত হয়। এর কিছুদিন পর বাংলাদেশ থেকে
১৪৭
হাফিজুর রহমান মালিক ওয়াশিংটনে অর্থনৈতিক মিনিস্টার হয়ে আসেন আর। হাবিবুর রহমান নামের একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট দূতাবাসে ফিরে যান। নিউইয়র্কে ইবরাহিম চৌধুরী মার্কিন বাঙালি হিসেবে চাকরিতে নিয়ােজিত থাকেন। যেসব বাঙালি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করেন, তাদের মােট সংখ্যা ছিল ২২। এর মধ্যে ৮ জন ছিলেন কূটনীতিবিদ ও ৩ জন ছিলেন স্থানীয়ভাবে নিযুক্ত কর্মকর্তা (অ্যাটাশে)। অন্যদের মধ্যে ছিলেন দেশভিত্তিক এবং স্থানীয় বাঙালি কর্মচারীবৃন্দ। প্রথম যারা দূতাবাস ছাড়েন, তাঁরা হলেন ওয়াশিংটনে হিসাব বিভাগের কর্মচারী গউসুদ্দিন আহমদ (২ এপ্রিল), নিউইয়র্কে ভাইস কনসাল আবুল হাসান মাহমুদ আলী (২৬ এপ্রিল), ওয়াশিংটনে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুর রজ্জাক খান (১৭ মে) এবং ওয়াশিংটনে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর আবুল মাল এ মুহিত (৩০ জুন)।
আনুগত্য পরিবর্তনকারী দলকে সংবাদ সম্মেলনে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব ছিল আমার। প্রায় সবার পরিবার সংবাদ সম্মেলনে হাজির ছিল। তবে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন মিসেস হুসনা করিম। তাঁর স্বামী তখন হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে গুরুতর অসুস্থ। দলের নেতা সৈয়দ আনওয়ারুল করিমকে তাঁর বিবৃতি দিতে আহ্বান জানিয়ে আমার কর্তব্য শেষ হলাে। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সংবাদ সম্মেলনের সঙ্গে তুলনায় আমাদের সম্মেলনের গুরুত্ব ছিল না। তাই সাংবাদিকেরা আমাদের ওখানে পৌছাতে পৌছাতে আমাদের বক্তব্য শেষ হয়ে যায় আর তখন চা পান পর্ব চলছে। কিছুটা এ জন্যও। পরের দিন খবর পরিবেশনায় নিউইয়র্ক টাইমস একটা বড় রকমের ভুল করে বসল। আর সেই ভুলটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র সংকলনেও স্থান পেয়েছে। যেহেতু সংবাদ সম্মেলন আমার ডাকা, তাই বেন ওয়েলস ভাবলেন যে। বক্তৃতাটি আমিই দিয়েছি। আমার নামেই নিউইয়র্ক টাইমস এস এ করিমের প্রদত্ত বিবৃতিটি চালিয়ে দিল। এস এ করিমের বিবৃতিটির শিরােনাম ছিল ‘আমাদের সিদ্ধান্তের মুহূর্ত’ (Our Moment of Decision)। এখানে তার উপসংহার অংশটুকু উদ্ধৃত করছি :
গণতন্ত্র ও জুলুমবাজের মধ্যে পছন্দের সময় এসেছে এখন এবং আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা বিশ্বের কাছে আবেদন করছি বাংলাদেশকে সমর্থন করতে, যাতে ফ্যাসিবাদ ও উপনিবেশবাদের অপশক্তি বাধাপ্রাপ্ত হয়। একটি জাতির হত্যা ও ধ্বংস বন্ধের জন্য আমরা সকল দেশকে আহ্বান করছি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে। এই মুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানকে কোনাে রকম অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যদানের প্রশ্নই ওঠে না। এ রকম সাহায্য শুধু গণহত্যাকেই প্রশ্রয় দেবে। আমরা এ দেশের
১৪৮
জনগণ ও সংবাদমাধ্যমকে বাংলাদেশের সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থনদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমরা তাে আসলে আপনাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকেই উৎসাহ ও প্রেরণা পেয়েছি।
কয়েক দিন ধরে এই খবর বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে প্রথম স্থান দখল করে রাখল। ৫ আগস্ট ইয়াহিয়ার গােয়েন্দাপ্রধান জেনারেল আকবর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বিহারি হত্যার বানােয়াট কাহিনি তুলে ধরলেন এবং এক অবিশ্বাস্য সামরিক বিদ্রোহের অভিযােগে আওয়ামী লীগকে দায়ী করলেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা এত বেশি জানাজানি হয়ে গিয়েছিল যে এই বিলম্বিত শ্বেত মিথ্যাকথন মােটেই পাত্তা পেল না। সমষ্টিগতভাবে আমেরিকায় বাঙালি কর্মচারীদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নালিশ জনচিত্তে খুব বড় মাপের দাগ কাটল । ঘটনাটা তাে বাঙালি শরণার্থী অথবা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবৃন্দ বা সেনাদের চাপে হয়নি, ওরা তাে রয়েছে সাত সমুদ্র তেরাে নদীর ওপারে। আবার এমন দেশে ঘটনাটা ঘটেছে, যেখানকার সরকার পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিল। দুটি পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস ও বাল্টিমাের সান ৫ আগস্ট পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে কূটনীতিবিদদের পদত্যাগ এবং নিক্সনের পাকিস্তানকে সমর্থন করে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে তাদের সম্পাদকীয় লেখে। পাকিস্তানকে নিন্দা বা তিরস্কার করতে মার্কিন ব্যর্থতার বিপরীতে তুলে ধরা হয় বাঙালিদের কাছে পাকিস্তানের সম্পূর্ণ অগ্রহণযােগ্যতা। কূটনীতিবিদদের মতাে নিঝঞ্চাট লােকেরা পর্যন্ত এই দুরাচারী জান্তাকে বর্জন করেছেন। দুটি সম্পাদকীয়তেই অবিলম্বে পাকিস্তানে সব রকম সাহায্য প্রদানে পূর্ণ বিরতি দাবি করা হয়। ৯ আগস্টের ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান এ বিষয়ে একটি চমৎকার। সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। তাতে তারা লেখে, এই আনুগত্য পরিবর্তনের ঘটনা খুবই নাটকীয় এবং এটি হলাে একটি শক্তিশালী বিবৃতি ও দৃঢ় পদক্ষেপ। কূটনীতিবিদেরা সচরাচর পদত্যাগকারীদের মধ্যে সর্বশেষে এগিয়ে। আসেন। কিন্তু যখন এমনটি ঘটে, তখন তা দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
বাংলাদেশ থেকে চট্টগ্রামের নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য মােস্তাফিজুর রহমান। সিদ্দিকী (পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী) ওয়াশিংটনে এসে পৌছালেন ৫ আগস্ট। তিনি এলেন আমেরিকায় বাংলাদেশ মিশনের নেতা হিসেবে। বাংলাদেশ মিশন মার্কিন আইনে একটি নিবন্ধিত বিদেশি এজেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেল এবং আগস্টেই ১২২৩ কানেটিকাট অ্যাভিনিউতে (উত্তর-পশ্চিম) দপ্তর স্থাপন করল। বাণিজ্যিক এলাকায় একটি সেলাইয়ের দোকানের দোতলায় দপ্তরটি ছিল এবং এটিই হয় আমেরিকায় বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস। এম আর সিদ্দিকীর কাছে
১৪৯
চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের অনেক কাহিনি শােনা গেল। তাঁর বক্তব্যে প্রকাশ পেল ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) বীরােচিত উদ্যোগ ও প্রতিরােধ, রেলওয়ে ও কয়েকটি কারখানার বিহারিদের তাণ্ডবলীলা এবং মেজর জিয়াউর রহমানের (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) শেষ মুহূর্তের বিদ্রোহ। তাঁর কাছে আমরা শুনলাম ড. আজিজুর রহমান মল্লিকের (পরবর্তী সময়ে ভারতে হাইকমিশনার ও পরে অর্থমন্ত্রী) নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের গৌরবময় ভূমিকা। আরও শুনলাম আমরা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মােহাম্মদ আবদুল হান্নানের চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘােষণা এবং রেডিও কর্মকর্তা বেলাল মােহাম্মদ ও আবুল কাশেম সন্দ্বীপের বুদ্ধি ও সাহসিক অবদানের কথা। একই সঙ্গে আমরা জানলাম, মুজিবনগর সরকারের অগােছাল, অবস্থা, পাশাপাশি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের সুদৃঢ় অবস্থান ও অটল অঙ্গীকারের কথাও।
মুক্তিযুদ্ধ একধরনের বিদ্রোহ, সহিংস আন্দোলন, বিপুল ত্যাগ, অপরিসীম। কষ্ট ও বেদনা, মােটকথা একটি সার্বিক কাঠিন্যের প্রতিভূ। অথচ আমেরিকায় আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অতি অমায়িক, সদা স্মিতহাস্যে উদ্ভাসিত, অত্যন্ত নম্রভাষী, অতিমাত্রায় সজ্জন, খুব সহনশীল একজন নিপাট ভদ্রলােক মােস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী। কনট্রাস্টটি ভালােই কাজ করেছিল । এতে আমেরিকায় আমাদের ভাবমূর্তি হয় উজ্জ্বল ও গ্রহণযােগ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনে পৌছেই এম আর সিদ্দিকীকে লন্ডন হয়ে তার সঙ্গে ঢাকায় যেতে আহ্বান করেন। কিন্তু ভ্রমণপত্রের ঝামেলায় সিদ্দিকীকে সে ভ্রমণ কিছুদিন পর করতে হয়। বছর তিনেক পর ১৯৭৫ সালে এম আর সিদ্দিকী বাংলাদেশের। রাষ্ট্রদূত হয়ে ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তন করেন। এই প্রত্যাবর্তন নিশ্চয়ই খুব। আনন্দজনক ছিল। ১৯৭১ সালের রাষ্ট্রদূতের কোনাে সরকারি স্বীকৃতি ছিল না, কোথাও দেখা করতে গেলে অনেক ঝামেলা পােহাতে হতাে। তবে কংগ্রেস, সংবাদমাধ্যম এবং বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছিল অবারিত দ্বার। ১৯৭৫-এ সরকারি স্বীকৃতি ছিল, শানশওকত ছিল, সরকারি মহলে সহজেই আনাগােনা করা যেত । তবে সংবাদমাধ্যম, ক্যাম্পাস অথবা কংগ্রেসে আমরা তেমন প্রিয়পাত্র ছিলাম না। তত দিনে আমরা অসভ্য সামরিক শাসনের আঁতাকলে আবদ্ধ এবং জাতির পিতার নির্মম হত্যার অপরাধে কলঙ্কিত হয়ে পড়েছি।
আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা এমনভাবে গঠিত যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বিভিন্ন স্বার্থগােষ্ঠীকে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য সবিশেষ উদ্যোগী হতে হয়। আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব মার্কিন ব্যবস্থায় একেবারে স্বতন্ত্র । তৃতীয় পৃথক সংস্থা হচ্ছে বিচার বিভাগ। এই সাংবিধানিক ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার
১৫০
রক্ষার যে রকম উত্তম ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনি কিছু কিছু ঘাটতিও রয়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থায় যারা নির্বাহী দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকেন, তাঁদের হাতেই থাকে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ ও ক্ষমতা। রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় এই উদ্যোগ সব সময়। যথাযথ হয় না। নির্বাহী বিভাগের প্রস্তাবে সব সময় জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। আইন পরিষদের উদ্যোগ হয় বিভক্ত এবং অগােছাল। এই শূন্যতা পূরণে প্রচাপ গােষ্ঠী (Pressure groups) আমেরিকায় রাষ্ট্র পরিচালনায় একটি মূল্যবান অবদান রাখে। তাই ওয়াশিংটনে অথবা যেকোনাে স্টেটের রাজধানীতে লবি একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা।
অনেক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হলাে লবিং, নির্বাহী বিভাগে অথবা কংগ্রেসে। অনেক জনহিতকর কাজে নিবেদিত প্রতিষ্ঠানই আছে আমেরিকায়, যাদের কাজ হচ্ছে শুধু লবিং। সব বৈদেশিক মিশনকেই কমবেশি লবিং করতে হয়। শুধু লবিংয়ের জন্য সেখানে বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠান আছে। আমাদের স্বৈরাচারী শাসক জেনারেল এরশাদ এ রকম একটি প্রতিষ্ঠানকে বার্ষিক নির্দিষ্ট ফিতে তাঁর ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করার জন্য নিযুক্তি দেন। লবিংয়ের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় নিবন্ধিত হতে হয়। তারা কী কাজ করছে, কার হয়ে কাজ করছে, তাদের হিসাবপত্রের নিরীক্ষিত বিবরণ, তাদের হয়ে যারা কাজ করে তাদের পরিচিতি ও সংযােগ—এসব বিষয়ে লবিংয়ে নিযুক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন পেশ করতে হয়। বাংলাদেশ মিশনও তেমনি একটি বিদেশি এজেন্ট হিসেবে বিচার বিভাগের অধীনে নিবন্ধিত হয় । মিশন একজনকে নিয়েও হতে পারে। আবার একটি বিরাট প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। আমাদের মিশন পাকিস্তান দূতাবাস যারা পরিত্যাগ করে এসেছেন বা পরিত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবাইকে নিয়ে গঠিত হয়। তবে প্রথম থেকেই গউস ও মুহিদ এতে যােগ দেননি এবং হাবিবুর রহমান কদিন পরই। পাকিস্তান মিশনে প্রত্যাবর্তন করেন।
মিশনের বেশির ভাগ সদস্যকেই দপ্তরের বাইরে বেশি ঘােরাফেরা করতে হতাে। কংগ্রেসে লবিং, ইনফরমেশন সেন্টারের কাজ, বাইরে জনসংযােগ (সভা-সমিতি, বৈঠক-সাক্ষাৎকার ইত্যাদি), সংবাদপত্রের দপ্তরে অথবা সাংবাদিকের আস্তানায় হানা দেওয়া—এসব কাজে সকলকেই হতে হয় তৎপর । দপ্তর পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব নেন শামসুল কিবরিয়া আর তাকে সাহায্য করতেন সৈয়দ মােয়াজ্জেম আলী, আতাউর রহমান চৌধুরী, শরফুল আলম, আফতাবুদ্দিন আহমদ, মজিবুল হক আর আবু সােলায়মান। আফতাবুদ্দিন মােটামুটিভাবে দপ্তরেই দৈনিক ১৮-২০ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় কাটাতেন। এমনকি বাথরুম দেখাশােনার কাজও তিনি নিজে করতেন। শেখ রুস্তম আলী
১৫১
কিছুদিনের মধ্যেই একটি সাপ্তাহিকী প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ৩ সেপ্টেম্বর প্রথম বুলেটিন বেরােয় এবং ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তারপর বুলেটিনটি হয় পাক্ষিক এবং মে মাসের ৫ তারিখে মিশনটি দূতাবাসে উন্নীত হলে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। প্রকাশনাটি ছিল আবু রুশদের দায়িত্বে এবং এর মান নিঃসন্দেহে উঁচু ছিল। রাজ্জাক ও ফজলুল বারী সব সময় হয় কংগ্রেসে, নয় সংবাদমাধ্যমের কাছাকাছি থাকতেন। ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশনের সদস্যরাও কংগ্রেসে ব্যস্ত থাকতেন বেশি এবং ফলে ইনফরমেশন সেন্টারের সঙ্গেই বেশি সম্পৃক্ত ছিলেন। সম্ভবত আমাকেই সব কটি মহলে—কংগ্রেস, ইনফরমেশন সেন্টার, সংবাদমাধ্যম, বিশ্ব ব্যাংক, ইউএসএইড, কৃষি বিভাগ ও ট্রেজারি বিভাগ, সংগঠিত সুশীল সমাজ এবং মিশন দপ্তরের সর্বত্র রােজই কিছু না কিছু সময় কাটাতে হতাে। আমার সুবিধা ছিল যে আমার কর্মদিনের বিস্তৃতি কখনাে ১২ ঘণ্টার কম ছিল না। ঘুমের প্রয়ােজন। কমিয়ে ফেলায় এই রুটিনেও লেখাপড়ার সময় ছিল। এবং এতে আমাকে আমার ব্যক্তিগত সহকারীর মতাে মুজিবুল হক খুব সাহায্য করতেন।
পুরাে আগস্ট মাস ছিল নানাভাবে ঘটনাবহুল। শেখ সাহেবের বিচার নিয়ে হইচই চলছে। কংগ্রেসম্যান মাের্সের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হলাে ১০ আগস্টে ১১ জন গণ্যমান্য সিনেটরের আপিল। সেক্রেটারি রজার্স পরের দিন রাষ্ট্রদূত হিলালিকে এ বিষয়ে ডেকে পাঠালেন। কিছুদিন পর খবর বেরােল যে বিখ্যাত সিন্ধি আইনবিদ এ কে ব্রোহি শেখ মুজিবের আইনজ্ঞ হবেন। ৯ আগস্ট দিল্লিতে রুশ-ভারত বন্ধুত্ব চুক্তি সম্পাদিত হলাে। বহুদিন ধরেই রাশিয়া এ রকম একটি চুক্তির প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, অবশেষে চীন-মার্কিন বন্ধুত্বের সূচনা এই চুক্তিকে ত্বরান্বিত করল । বাংলাদেশ সমস্যাও এই চুক্তি চূড়ান্তকরণে ইন্ধন জোগায়। চীন-মার্কিন-পাকিস্তান চক্রের বিপরীত ভারতও একটি পরাশক্তির সহায়তা খোঁজে। ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার এবং ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সাহায্যের প্রতিবাদে ওয়াশিংটন, বাল্টিমাের, নিউইয়র্ক ও ফিলাডেলফিয়ায় নানা বিক্ষোভের আয়ােজন করে। ৫ আগস্ট হােয়াইট হাউসের সামনে ডা. গ্রিনাে, মহসিন সিদ্দিকী—এঁরা পিকেট করেন।
১ আগস্ট নিউইয়র্ক ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ কনসার্ট আয়ােজিত হয়। ওস্তাদ রবিশঙ্কর বাংলাদেশের ঘটনাবলিতে খুবই বিচলিত হন। তিনি জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেন এবং তখনই কনসার্ট ফর বাংলাদেশের পরিকল্পনা হয়। এক ঢিলে দুই পাখি । প্রথমত, এই কনসার্ট বাংলাদেশ সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
১৫২
দ্বিতীয়ত, এতে বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের জন্য কিছু সাহায্য আদায় হয়। জর্জ হ্যারিসন তাঁর বাংলাদেশ’ গানে এই কনসার্টের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেন। ‘আমার বন্ধু আমার কাছে এলেন, তার চোখে শুধু বেদনা আর দুঃখ । তিনি। বললেন, তিনি শুধু জানেন তার দেশ মরে যাচ্ছে। বিটলস দলের ম্যানেজার এলান ক্লাইন এই কনসার্টের পুরাে ব্যবস্থা চার-পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করেন এবং পুরাে খরচ বিটলস গােষ্ঠী বহন করে। এতে অংশ নেন দলের প্রায় সবাই—জর্জ হ্যারিসন, রিংগাে স্টার, লিওন রাসেল ও বিলি প্রেস্টন। ওস্তাদ রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খানও অংশ নেন এবং উদীয়মান গায়ক বব ডিলানও এসে হাজির হন। দুই আসরে ৪০ হাজার লােক ভেঙে পড়ে। পরবর্তী সময়ে কনসার্টের রেকর্ডটি প্রকাশিত হয় এবং এর সমুদয় আয় জাতিসংঘের বাংলাদেশ-সম্পর্কিত ত্রাণকাজে ব্যবহৃত হয়। হিসাবের গােলমালে কয়েক মিলিয়ন ডলার অব্যবহৃত থাকে। ভাগ্যের অদ্ভুত খেলায় আমি যখন বাংলাদেশ সরকারের বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব, তখন এই অব্যবহৃত তহবিল। বাংলাদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে নিয়ােজিত হয়। কনসার্টের ওই আসরে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের জন্য একটি আপিল স্বাক্ষরিত হয়। পাঁচ হাজার লােকের স্বাক্ষরিত ওই আপিল পরবর্তী সময়ে মার্কিন কংগ্রেশনাল রেকর্ডে নিউইয়র্কের প্রতিনিধি বিংগামের প্রচেষ্টায় লিপিবদ্ধ হয়। ফিলাডেলফিয়া ও নিউইয়র্কের বাঙালি ও মার্কিন সমর্থক গােষ্ঠী এই কনসার্টে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন করে এবং নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করে।
৯ আগস্ট দিল্লিতে যখন রুশ-ভারত চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে, তখন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট আর সেক্রেটারি বিল রজার্স বাংলাদেশে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ বিষয়টি পাকাপাকি করছেন। জাতিসংঘের মনিটর ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ ও বিতরণ পর্যবেক্ষণ করবেন। এ বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে লিখিত চুক্তি হবে । খাদ্য সরবরাহ রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান পাবে। মহাসচিব ২৪ আগস্ট ঢাকায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পল মার্ক অরিকে পাঠালেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণে পল এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তারই মাধ্যমে সব বার্তা বিনিময় হয়। তিনি ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলকে নিরাপদ ও নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং ওখান থেকে সব যােগাযােগ রক্ষা করতেন। পল প্রথমে আসেন জাতিসংঘে পূর্ব পাকিস্তান ত্রাণ প্রতিষ্ঠানের (UNEPRO) প্রধান হিসেবে। ২১ ডিসেম্বর এই প্রতিষ্ঠানের নাম হয় জাতিসংঘ ঢাকা ত্রাণ প্রতিষ্ঠান (UNROD) এবং আরও অনেক পরে এর নাম হয় জাতিসংঘ বাংলাদেশ ত্রাণ প্রতিষ্ঠান (UNROB)। পল মার্ক অরি পরবর্তী সময়ে প্যারিসে ওইসিডির সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৫৩
সিনেটর কেনেডি সদলবলে শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্র পরিদর্শনে যান ৮ আগস্ট। তার বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেই ভ্রমণসূচি বাতিল করে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে আহ্বান জানায়, তবে তার সহকারীদের প্রবেশপত্র দিতে ইতস্তত করে। সিনেটর কেনেডির সঙ্গে গিয়েছিলেন তার স্টাফ ডেল ডিহান এবং জেরি টিংকার, প্রিন্সটনের অধ্যাপক ডিন জন লুইস ও এমআইটির অধ্যাপক পুষ্টিবিশারদ নেভিন স্ক্রিমশাে। তারা আমেরিকায় ফিরে এসে একটি চমৎকার প্রতিবেদন পেশ করেন। পাকিস্তান ও ভারতে সংকট’ নামে এই প্রতিবেদন সিনেটর কেনেডি নভেম্বরে প্রকাশ করেন এবং তা কংগ্রেশনাল রেকর্ডেও লিপিবদ্ধ হয়। সিনেটর কেনেডি শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় গ্রহণকারীদের দুঃখ-দুর্দশার যে পরিচয় পান, তাতে খুবই অভিভূত হন। ১৬ আগস্ট তিনি দিল্লিতে একটি সংবাদ সম্মেলনে নিক্সনের পাকিস্তানপ্রীতি সম্বন্ধে কঠোর মন্তব্য করেন। তিনি এতই ক্ষুব্ধ হন যে বলেন, আরেকটু হলে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছেদের প্রস্তাব করতেন। তিনি বলেন, এমন পৈশাচিক আচরণ কোনাে সভ্য দেশের হতে পারে না। তিনি শরণার্থীদের জন্য অতিরিক্ত বৈদেশিক সাহায্যের আবেদন করেন।
ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তন করে ২৬ আগস্ট তিনি ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেই সম্মেলনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মীকান্ত ঝা এবং আমাকে সিনেটর তার পাশে নিয়ে বসেন। তিনি তাঁর বিবৃতিতে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়ােগের দাবি করেন। সিয়েটো ও সেন্টোকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলেন। তিনি দুঃখ করে বলেন যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকা প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার এবং ৪৫ হাজার জীবন দিয়েছে ভিয়েতনামে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য আর বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যার জন্য নিক্সন সরকার পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তিনি পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য প্রদান তৎক্ষণাৎ বন্ধ করতে বলেন। প্রায় একই সময়ে রিপাবলিকান সিনেটর চার্লস পার্সি সস্ত্রীক ভারত ও পাকিস্তান ভ্রমণে যান। তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করার সুযােগ পান এবং জনশূন্য শরণার্থী প্রত্যাবর্তন কেন্দ্র দেখে আসেন ।
শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন নিয়ে সিনেটর পার্সি পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। ২৮ তারিখ তিনি দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানে সমুদয় মার্কিন সাহায্য বন্ধের আহ্বান জানান। অক্টোবরে বিচারপতি চৌধুরী ওয়াশিংটনে এলে সিনেটর পার্সির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এই মােলাকাতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই উপস্থিত ছিলেন। সিনেটর বলেন যে শেখ মুজিবের বিষয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গেও
১৫৪
আলাপ করেছেন এবং তাঁকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে শেখ মুজিবের প্রাণহানি হবে না। এ রকম উক্তি সারা ১৯৭১ সালে ওই একবারই শুনেছি এবং তা সিনেটর পার্সির মুখে।
ব্যক্তিগতভাবে আগস্ট মাসটি ছিল আমার জন্য বড়ই ব্যস্ততার । কংগ্রেসে লবি ও বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের কাজটি মাসের শুরুতেই সমাধা হলাে। মাসের মধ্যে দুবার বাইরে যেতে হলাে এবং অনেক টেলিভিশন প্রােগ্রামে যােগ দিতে হলাে। ১ তারিখের এনবিসি প্রােগ্রামের পর আবার ২ তারিখে পিবিএসের ওয়াশিংটন নিউজ কনফারেন্সে বসতে হলাে। সেদিনই কানাডীয় রেডিওতে বক্তব্য দিতে হলাে, ইয়াহিয়া সরকারের অবৈধতা এবং বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের বিষয়ে শ্রোতাদের মনােযােগ আকর্ষণ করে। ৫ তারিখে আবার পিবিএস আমার একজন সহকর্মীকে নিয়ে আগ্রনস্কি শােতে হাজির হতে দাওয়াত করল। এই প্রােগ্রামে শামসুল কিবরিয়া এবং আমি অংশ নিই।
ওয়াশিংটনের ফক্স টেলিভিশনে দুপুরে প্যানারােমা বলে একটি টক শাে হতাে। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রদূত হিলালি সেখানে পাকিস্তানের বক্তব্য তুলে ধরেন। ১২ তারিখে তাঁরা আমাকে বাংলাদেশের কথা বলতে ডাকলেন। আধঘণ্টাব্যাপী এই খােলামেলা আলােচনায় পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য, চিন্তাভাবনার ভিন্নতা, ভাষার তফাত এবং চলমান গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়গুলাে প্রাধান্য পেল। একজন উপস্থাপক মােরি পােভিচ বারবার ব্যক্তিগত কষ্ট বা বঞ্চনার কথা উত্থাপন করলেন। তার কথা ছিল যে পাকিস্তানিরা বা রাষ্ট্রদূত কি এখানে বাঙালিদের ওপর অত্যাচার করছেন? আমার জবাব ছিল যে বৈষম্যের বিষয়টিও ঠিকই উপলব্ধি করা যেত, কিন্তু এখন যা ঘটছে তা আরও ব্যাপক ও গুরুতর। একটা জাতিকে হত্যা এবং একটি দেশকে ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত আজ পাকিস্তান, সব বাঙালিই আজ নিষ্পেষিত ও পদদলিত। সুতরাং ওয়াশিংটনে আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সহাবস্থান করছি কি না, সে প্রশ্ন নিতান্তই গৌণ। ১৫ তারিখে একটি মনােজ্ঞ টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হলাে। এবিসির ‘ইস্যুজ অ্যান্ড অ্যানসারস’ প্রােগ্রামে হাজির হলেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আগা হিলালি ও লক্ষ্মীকান্ত ঝা। আগেই বলেছি, সামাজিকভাবে তারা ছিলেন বন্ধু, দুজনই একই বছরে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যােগ দিয়ে ১১ বছর একসঙ্গে এক দেশে কাজ করেন। ওয়াশিংটনে দুজনই দক্ষ ও জনপ্রিয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁরা। বলতেনও বেশ ভালাে।
টরন্টোতে একটি সম্মেলনে যাই এম আর সিদ্দিকী ও আমি। সেখানে বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন অতিরিক্ত সভা-সমিতির ব্যবস্থা করে, তাদের প্রধান আগ্রহ ছিল সিদ্দিকীর কাছ থেকে দেশের ও নেতৃত্বের খবর পাওয়ার ব্যাপারে।
১৫৫
ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তনের আগে আমাদের মন্ট্রিয়ল যেতে হলাে বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশনের আহ্বানে এবং পীড়াপীড়িতে। সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেন কুইবেক প্রদেশে তখন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার আগে মােয়াজ্জেম সেখানে রসায়নশাস্ত্রের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন। তাঁর অনেক গুণ—সুপুরুষ, বলেন ভালাে, লেখাপড়ায় মেধাবী আবার গান-বাজনাতেও পারঙ্গম। প্রায় ছয় বছর পর মােয়াজ্জেমের সঙ্গে দেখা ১৯৬৩ সালে বােস্টনে। তখন সেখানে তিনি একটি প্রসিদ্ধ ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন, উস্টারের এই ল্যাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের টিকা নিয়ে গবেষণা চলছিল। মিসেস হােসেনও ছিলেন রসায়নশাস্ত্রের একজন মেধাবী গবেষক। ১৯৭১ সালে মােয়াজ্জেম ছিলেন। কুইবেক সিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে তার পরিচয় ছিল। বাঙালি সংগঠন করা ছাড়াও জাহাজ পরিত্যাগী, পালিয়ে আসা বা কানাডায় আটকে পড়া বাঙালিদের পুনর্বাসন ও রাজনৈতিক আশ্রয়লাভের বিষয়ে তিনি জোর তদবির করেন এবং তাদের জন্য বেশ সুযােগ-সুবিধা আদায়ে সক্ষম হন। মােয়াজ্জেম সম্ভবত গত সহস্রাব্দে আশির দশকের শেষলগ্নে বা নববর্ষের প্রথম দিকে অকালে ঝরে পড়েন।
টরন্টোতে অবস্থানকালে পরিচয় হলাে আসমত আলীর সঙ্গে। তিনি এখন ওয়াশিংটনে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী। তাঁর স্ত্রী জাহানারা আলীও মহিলা উদ্যোক্তা এবং সমাজজীবনে খুবই সক্রিয়। আসমত আলী ওয়াশিংটনে আমাকে প্রায় প্রতিদিন একবার টেলিফোন করতেন খবর শােনা এবং করণীয় কী তা জানার জন্য। প্রতিদিন ভােরে তাঁর টেলিফোনটি না পেলে মনে হতাে কোথায় যেন কী একটা ঘটে গেছে।
ওখানে মিজানুর রহমান বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশনের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বােধ হয় আমার এক বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন, অঙ্কে খুব ভালাে ছাত্র। একটি ব্যতিক্রমী বিক্ষোভকারীদের অতি ক্ষুদ্র দল (সংখ্যায় বােধ হয় ১০-১২ জন) আমাদের সম্মেলন হলের কাছে একদিন কিছু সময়ের জন্য জড়াে হয় । তাদের হাতে ছিল পাকিস্তানকে রক্ষার দাবি জানিয়ে কয়েকটি প্ল্যাকার্ড। এটি ব্যতিক্রমী ছিল এই জন্য যে পাকিস্তানিদের এ রকম বিক্ষোভে এই প্রথম একজন বাঙালির সঙ্গে দেখা হলাে। তার নাম ভুলে গেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে আমার বছর তিনেকের কনিষ্ঠ ছিল। বােধ হয় অঙ্কের ছাত্র ছিল (তার পিতা ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক)। তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনাে দিন হইচই করতে দেখিনি। রাজনীতিতে তার কোনাে আগ্রহ আছে বলেও জানতাম না।
তাকে দেখে আমার বিস্মিত হবার পালা। তার সঙ্গে একান্তে কথা বলে তার যে পরিচয় পেলাম, সে জন্য মােটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একজন সুশিক্ষিত
১৫৬
বিজ্ঞানী যে উগ্র জামায়াত সমর্থক হতে পারে, তখন তা আমার জানা ছিল না। সে যথার্থই মনে করত যে স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের অধীনে চলে যাবে আর সেখানে ইসলামমাফিক জীবন যাপন করা যাবে না। জামায়াতের রাজনীতি মূলত ক্ষমতার রাজনীতি এবং জামায়াতিরা ধর্মকে রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রাপ্তির জন্য ব্যবহার করে এবং এই খেলায় শিক্ষিত মুনাফেকরা সিদ্ধহস্ত। কিন্তু ওই ছেলেটি ছিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, নিতান্তই সুবােধ কিন্তু পথভ্রষ্ট। জানি না এখন সে কী অবস্থায় আছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সে কীভাবে গ্রহণ করেছে। এ রকম পাকিস্তান সমর্থক কোনাে বাঙালির সঙ্গে ১৯৭১ সালে আমার দেখা হয়নি। অন্য সমর্থকেরা হয় চাকরির খাতিরে অথবা রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তাদের অবস্থান ঠিক করেছিলেন। অনেকে চালাকি করে দুই নৌকায় পা রেখেছিলেন। কিন্তু এই ছেলেটি ছিল নেহাতই গােবেচারা ও বিভ্রান্ত।
আগস্ট মাসের শেষে পশ্চিম উপকূলের বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশনের দাওয়াতে এম আর সিদ্দিকী ও আমি কয়েকটি জায়গায় একধরনের ঝটিকা সফরে যাই। আমরা প্রথমে গেলাম লস অ্যাঞ্জেলেসে ২৭ তারিখে, ওখানে বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশনের সভা। শামসুদ্দোহা ছিলেন অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি, তিনি একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই আমাদের যােগাযােগ হয়। যােগসূত্রটি স্থাপন করে দেন ড. এ এম এ রহিম এবং এম শহীদুল্লাহ খান। ড. রহিম তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে পিএইচডি করছেন, পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য। তিনি বাংলাদেশে সচিবের পদ থেকে অবসর নিয়ে বেশ কিছুদিন একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে মাঝেমধ্যে কাজ করতেন।
এম শহীদুল্লাহ ছিলেন ঢাকাস্থ নিপার একজন প্রশিক্ষক ও গবেষক; তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে উচ্চশিক্ষায় রত। বােধ হয় তিনি এখনাে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করেন। তারা আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন। ড. দোহাকে আমার মনে হলাে। একজন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক, কাজপাগলা ও খুবই মিশুক। তিনি অতি অল্প বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন। চন্দন দাস ছিলেন সমিতির সম্পাদক। তাঁর সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশে একবার দেখা হয়। এখন বােধ হয় ক্যালিফোর্নিয়াতেই আছেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের দলে ছিল দুই গােষ্ঠী। ছাত্র-শিক্ষক ও তরুণ পেশাজীবী একদল এবং বহুদিন ধরে মার্কিনবাসী নানা ব্যবসা-বাণিজ্য বা পেশায় নিয়ােজিত আরেকটি দল। বয়ােজ্যেষ্ঠদের দলে পেলাম সিরাজুল ইসলাম ও মুজিবুর রহমানকে (অন্য কারও নাম মনে নেই)। সিরাজুল ইসলাম জাহাজ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় থেকে যান চল্লিশের দশকে। তাঁর মতাে আছে আরও ২০২৫টি পরিবার, তারা সবাই সিলেটের মানুষ এবং বেশির ভাগই বিয়ে করেছেন
১৫৭
স্প্যানিশ বা আফ্রিকান মার্কিন মহিলা। তাঁদের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক যৎসামান্য কিন্তু এই সংকটে তাঁরা সবাই খুব সক্রিয়। অ্যাসােসিয়েশনের খরচপত্রের জন্য তারা মুক্তহস্তে দান করেন, আমরা তাঁদেরই অতিথি হয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকি।
আমি বছরখানেক পর আরেকবার লস অ্যাঞ্জেলেসে গেলে তারা আমাকে তাঁদের একজনের র্যাঞ্চে পিকনিকে নিয়ে যান। মুজিবুর রহমান বরিশালের লােক। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে যান এবং তখন থেকেই বিখ্যাত অ্যাম্বাসেডর হােটেলের হিসাবরক্ষণ বিভাগে কাজ করেন। তিনি উচ্চশিক্ষিত বলে সিলেটের সব ক্যালিফোর্নিয়াবাসী তাকে খুব সম্মান করে এবং তিনি তাদের আপনজন হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু যখন আমেরিকা ভ্রমণে যান। (১৯৫৮ সালে), তিনি তখন তাঁর সাহচর্য পান এবং বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘মিতা বলে। সম্বােধন করতেন। তিনি বারবার শেখ মুজিবের দেশপ্রেম ও সরলতার কথা বলতেন। শেখ সাহেবকে তিনি অনেক জায়গায় নিয়ে যান এবং সর্বত্র তার নাকি একই প্রশ্ন ছিল, ‘মিতা আমাদের দেশটা এমন হবে কবে?
লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে গেলাম ডেভিস ক্যাম্পাসে। আমার ছােট ভাই মুবদির সহপাঠী গােলাম মােস্তফা ওখানে ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক। কটা মাত্র বাঙালি পরিবার, কিন্তু তারা মার্কিন সমর্থকদের একটি বড় গােষ্ঠী জোগাড় করেছে। আমরা ক্যাম্পাসে বক্তৃতা করলাম, সংবাদ সম্মেলন করলাম ও তাদের সঙ্গে নৈশভােজে মিলিত হলাম। ছােট শহরে বাংলাদেশের সমর্থনে জমজমাট একটি দিন গেল । ওখানকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম খুব ফলাও করে আমাদের বক্তব্য এবং বাংলাদেশের কাহিনি তুলে ধরল। ২৮ তারিখ রাতটা আমরা ডেভিসে কাটালাম, আমি মােস্তফার বাসায় আর সিদ্দিকী আরেক অধ্যাপকের বাসায়। পরদিন আমরা গেলাম সানফ্রানসিসকোতে। ওখানে সংবাদ সম্মেলন, বার্কলে ক্যাম্পাসে সভা এবং রেডিও-টেলিভিশন প্রােগ্রাম। ওখানে বাঙালিদের নেত্রী ছিলেন আমেনা পন্নী (তিনি সে দেশেই থেকে যান)। ঢাকায় ষাটের দশকে তাঁকে চিনতাম রেডক্রসের সম্পাদক হিসেবে। আমার নােটবইয়ে দেখছি যে ফারুক নামের আরেকজন ছাত্র আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেন।
সানফ্রানসিসকো থেকে বেশ রাত করে আমরা লস অ্যাঞ্জেলেসের বিমান শাটল ধরলাম। ওখানে আমাকে কয়েকটি ক্লাস নিতে হবে ইউসিএল ক্যাম্পাসে, তারপর আছে সংবাদ সম্মেলন। যেকোনাে ক্যাম্পাসে বক্তৃতা করতে গেলে হাতে সময় থাকলে সব সময়ই কিছু ক্লাসে বক্তৃতা করার জন্য আহ্বান পেতাম। সামরিক শাসন, গণহত্যা, গণতান্ত্রিক ধারা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, উপমহাদেশের রাজনীতি, মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য—এসব বিষয়ে বক্তৃতা করার সুযােগ আমি কখনাে হাতছাড়া করতাম না। লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে আমাকে
১৫৮
দৌড়াতে হলাে ডেনভারে। তখন ডেনভার একটি স্টেট রাজধানী। আজকালকার মতাে বড়লােকের আস্তানা নয়, জায়গাটির জাঁকজমক বা জৌলুশও তেমন ছিল না। ডেনভারে একটি শক্তিশালী বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন গঠন করেছে মুবদির আরেক সহপাঠী শের আলী। মােস্তফা আর শের আলী দুজনই ছিল মেধাবী ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রথম ছাত্রগােষ্ঠীর মধ্যে সেরা দুজন। শের আলী অনেক দিন ক্যানসার গবেষণায় নিয়ােজিত ছিল। শের আলীও আমাদের জন্য সংবাদ সম্মেলন ও নৈশভােজ সভার আয়ােজন করেছিল। ডেনভারের সংগঠন বাঙালি ও মার্কিন জনগণের সম্মিলিত সমিতি। অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি জেরাল্ড হ্যান্ডরিকস আর সম্পাদক শের আলী, কোষাধ্যক্ষ ছিলেন একজন ভারতীয় আমেরিকান।
ডেনভারের ব্যস্ত কার্যক্রম শেষে পরদিন ভােরে আমরা ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তন করলাম। লস অ্যাঞ্জেলেস ও ডেনভারে বােধ হয় আমরা সবচেয়ে বেশি শ্রোতাকে আকৃষ্ট করি। কিন্তু ডেভিস ও সানফ্রানসিসকোতে সংবাদমাধ্যম ছিল সবচেয়ে বেশি উৎসুক ও সহানুভূতিশীল। সবখানেই বাঙালিরা আমাদের পেয়ে যেন বাংলাদেশের খানিকটা স্পর্শ অনুভব করল । তবে আমাদের সফর মূলত সফল হয় অগণিত মার্কিন সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীর আন্তরিকতার ফলে । তার একটি নিদর্শন পাওয়া যাবে ডেভিসের একটি ছাত্রীর চিঠিতে। সংগঠকদের। মধ্যে একজন ছিল সুসান নিল্ড। সে লেখে, ‘আমি বিশ্বাস করি, আপনারা লস। অ্যাঞ্জেলেসে সহিসালামতে পৌছেছিলেন এবং ওয়াশিংটনে ফিরে এখন নিদ্রাহীন। ব্যস্ততার ক্লান্তি পুষিয়ে নেবার সুযােগ পেয়েছেন ।…ডেভিসে বাংলাদেশ লিগের সূচনাটি ভালােই হয়েছে। আপনাদের সে জন্য ধন্যবাদ। এখানকার এবং সানফ্রানসিসকোর সংবাদপত্রগুলাে (ডেইলি ডেমােক্র্যাট ডেভিস, সানফ্রানসিসকো এক্সামিনার ও সানফ্রানসিসকো ক্রনিকল) খুব ফলাও করে খবর ছেপেছে। সানফ্রানসিসকোতে আমার মা কেকিউইডিতে আপনার প্রােগ্রাম দেখে এতই অভিভূত হয়েছেন যে তিনি আমাকে টেলিফোনে তার সন্তুষ্টি ও উদ্দীপনার কথা জানিয়েছেন। চিঠিটি ১ সেপ্টেম্বরে লেখা। এখানে দুটি কথা বলা দরকার : প্রথমত, আমরা ডেভিস থেকে ২৯ তারিখ সকালে মােটরগাড়ি করে সানফ্রানসিসকো যাই এবং সেখানে ব্যস্ত দিন কাটিয়ে উধ্বশ্বাসে দৌড়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের শেষ শাটল বিমান ধরি। দ্বিতীয়ত, সানফ্রানসিসকোতে কেকিউইডি ছিল একটি শিক্ষামূলক টিভি প্রতিষ্ঠান এবং তাদের প্রােগ্রামটি ছিল তথ্যসমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় ।
টরন্টোতে অক্সফাম আগস্টের ১৯ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত একটি সম্মেলন আহ্বান করে বাংলাদেশ সমস্যা বিবেচনার জন্য। আমাকে তারা সে সম্মেলনে
১৫৯
একজন বিশেষজ্ঞ (রিসাের্স পারসন) হিসেবে যােগ দিতে আহ্বান জানায় । ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠা হলে তারা এম আর সিদ্দিকী এবং এস এ করিমকেও দাওয়াত করে এবং আমাকেও তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধি হতে বলে । আমার উকিল বার্নি বিয়ারম্যানকে আমি বিষয়টি জানালাম। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আমেরিকার বাইরে সাধারণত যেতে দেওয়া হয় না। বার্নি। করিতকর্মা পুরুষ, দু-চার দিন পরই সে আমাকে জানাল যে আমি দাওয়াত কবুল করতে পারি। সে কোনাে রকমে আমার ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেবে। আমি এই উপলক্ষে বাংলাদেশের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ নামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করলাম, যাতে যেতে না পারলেও আমি তা পাঠিয়ে দিতে পারি। কিন্তু দিন যত ঘনিয়ে এল,ততই প্যাচ লাগতে থাকল। প্রথমে তারা বলেছিল যে একটি ভ্রমণ দলিলেই কাজ হবে, পরে বলে, এতে সমস্যা রয়েছে। বার্নি কিন্তু দারুণ আশাবাদী, নিশ্চয়ই সে কোনাে কৌশল ঠিক করে রেখেছে। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলাে। প্রবাসন দপ্তর আমাকে এবং আমার পরিবারের সব সদস্যকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে চিরস্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার দান করল (অর্থাৎ যাকে বলে গ্রিন কার্ড, তা-ই প্রদান করল)। আইনের কোনাে ফাকে আমাকে এই সুযােগের উপযুক্ত বিবেচনা করে তারা সব সমস্যার সহজ সমাধান করে দিল।
টরন্টোতে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা সব নামকরা ব্যক্তি। আমি পৌছার পরই কানাডার একজন প্রসিদ্ধ রেডিও সাংবাদিক স্ট্যানলি বার্ক এবং অক্সফামের জ্যাক (তার নামটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না) আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন। স্ট্যানলি বার্ক ভাঙ্কুভারে চলে যাচ্ছেন, টরন্টোতে তাঁর সময় শেষ হয়ে গেছে। তিনি তাঁর বিশ্লেষণশক্তি ও ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতার জন্য কৃতিত্বের দাবিদার ছিলেন। কিন্তু বায়াফ্রা যুদ্ধে তার ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় তখন তিনি অনেকটা অপাঙক্তেয় হয়ে গেছেন। বার্ক অত্যন্ত জোরেশােরে বায়াফ্রার আন্দোলনকে সমর্থন করতেন এবং অনেককে সে সময় তার শত্রুতে পরিণত করেন। তিনি বাংলাদেশেরও সমর্থক কিন্তু এ ব্যাপারে বিশেষ উচ্চবাচ্য করতে চান না। প্রথমে আমার কাছে তিনি পরিস্থিতির বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা চান এবং আমার মতামত তাঁর মনমতাে হওয়ায় তিনি শিগগিরই আমাকে নিয়ে একটি রেডিও প্রােগ্রাম করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
জ্যাক বিপ্লবী, তিনি বাংলাদেশের নিকটবর্তী শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রগুলােতে প্রায়ই যান। তাঁর একটি দুঃসাহসিক পরিকল্পনা রয়েছে, একটি ঝটিকা বাহিনী নিয়ে গিয়ে মিয়ানওয়ালি জেল থেকে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার করা। তিনি বাংলাদেশের গেরিলাদের জন্য অস্ত্র পাচার করতে চান, সুন্দরবনের সমুদ্র উপকূল নাকি এর জন্য খুবই উপযুক্ত | তার শুধু প্রয়ােজন যােগাযােগের। তাকে মনে হলাে একজন।
১৬০
রােমান্টিক বিপ্লবী বা মুক্তিযােদ্ধা, কল্পনাবিলাসী এবং মােটেই বাস্তববাদী নন। তবে তাঁর সঙ্গে কথা বলে ভালাে লাগে, তিনি অনুপ্রাণিত করতে পারেন, আশার সঞ্চার করতে পারেন। জ্যাকের সঙ্গে এরপরও আমার অনেক দিন যােগাযােগ ছিল। জ্যাক সত্যি সত্যি মুজিবনগরে একটি ডাকোটা নিয়ে হাজির হন, এটি অক্সফামের ত্রাণকাজে নিয়ােজিত ছিল। পরে বােধ হয় যুদ্ধজাহাজ হিসেবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এটি ব্যবহার করে।
টরন্টো সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন একজন কানাডীয় কূটনীতিবিদ স্যার হিউ কিনলিসাইড, যিনি একসময় জাতিসংঘের আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন । অধ্যাপক ও সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন কেনেথ গলব্রেইথ (তিনি আমেরিকাবাসী হলেও জাতিতে কানাডীয়) ছিলেন মূল বক্তা কিন্তু অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে পারেননি, তবে তার বাণী পাঠিয়েছিলেন। সারা দুনিয়া থেকে সব পেশার লােক ছিলেন এই সম্মেলনে। আমেরিকা থেকে আসা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ছিল অত্যন্ত দীর্ঘ। পরবর্তীকালে জিন্নাহ ও ভুট্টোর জীবনীলেখক হিসেবে খ্যাত স্ট্যানলি। ওলপার্ট, হার্ভার্ডের পাপানেক দম্পতি গুস্তাব ও হানা, রােডি দম্পতি জন ও কর্নেলিয়া এবং রবার্ট ডর্ফম্যান ছিলেন লেখাপড়ার জগৎ থেকে। সিনেট সদস্যদের মধ্য থেকে ছিলেন তাদের বিশ্বস্ত সহকারী টমাস ডাইন ও মাইক গার্টনার। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন শান্তির জন্য ধর্ম কাউন্সিলের হােমার। জ্যাক এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশনের নরমান ডাল । কানাডার দল ছিল স্বভাবতই ভারী। পার্লামেন্ট সদস্য এন্ড্র ব্রুইন সবে শরণার্থীকেন্দ্র দেখে এসেছেন। কুইবেকের সংসদ সদস্য ক্লদ শ্যারন, চীনবিশারদ কূটনীতিবিদ চেস্টার রনিং, অক্সফামের জন শে এবং সাংবাদিক ও বিভিন্ন গির্জার প্রতিনিধিবৃন্দ। ব্রিটেন থেকে সংসদ সদস্য রক্ষণশীল দলের বার্নার্ড ব্রেইন (সদ্য উপমহাদেশ সফর করে। এসেছেন) এবং একসময়কার মন্ত্রী শ্রমিক দলের জুডিথ হার্ট। ভারত থেকে এসেছেন অধ্যাপক নুরুল হাসান, তখন কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্য ও পরে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এবং সাংবাদিক অজিত ভট্টাচার্য (পরে ডেটলাইন বাংলাদেশ বইয়ের লেখক)। আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশনের মহাসচিব আইরিশ নিল ম্যাকডারমট আসেন জেনেভা থেকে।
পণ্ডিত মানুষ নুরুল হাসান, প্রাণবন্ত মহিলা জুডিথ হার্ট, গম্ভীর সাংসদ এন্ড্র। ব্রুইন, কূটনীতিবিদ চেস্টার রনিং, বুদ্ধিজীবী অজিত ভট্টাচার্য ও জেনারেল জয়ন্ত । চৌধুরীর সঙ্গে আমার বিস্তর আলাপ-আলােচনা হয়। মৃদুভাষী অজিত ভট্টাচার্য গভীর সহানুভূতির সঙ্গে শরণার্থীকেন্দ্রে মানুষের দুর্দশার কথা বললেন। জুডিথ হার্টকে মনে হলাে খুব চটপটে এবং পাকিস্তানের আশু বিভক্তি নিয়ে তার মনে কোনাে সন্দেহ নেই। জেনারেল জে এন চৌধুরী ভারতের প্রথম বাঙালি
১৬১
সেনাধিনায়ক ছিলেন। তখন অবসর নিয়ে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিভাগপূর্বকালে স্কুলপাঠ্যে পাবনার এই কৃতী সন্তানের কথা পড়েছি। তাঁর সঙ্গে কথা বলে খুবই নিরাশ হই। তিনি বললেন যে আধুনিক কালে বাঙালিরা সামরিক বীর্য বা দক্ষতার কোনাে পরিচয় দিতে পারেনি। বাংলাদেশের গরিব ও গ্রামীণ লােকজন যে সুদক্ষ ও সশস্ত্র পাকিস্তানিদের জব্দ করতে পারবে, সে বিষয়ে তিনি মােটেই আশাবাদী নন। ভারতের পক্ষে এ রকম সামরিকভাবে অপ্রস্তুত একটি জাতির সাহায্যে চট করে এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে না। তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপে মনে হলাে, তিনি নিজেকে একজন ব্যতিক্রমী বাঙালি বলে বিবেচনা করেন। তিনি নিজগুণে ভারতের সেনাধিনায়ক হয়েছেন বলে বাঙালিদের সামরিক হীনতার অপবাদ ঘুচে যায়নি। বাংলাদেশের জনগণ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা আইয়ুব খানের অবনত গােষ্ঠীর’ (Downtrodden races) ধারণা থেকে খুব আলাদা মনে হলাে না। জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরী অবশ্য চেহারায় ততটা বাঙালি ছিলেন না। লম্বা-চওড়া স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ, কাপড়চোপড়ে ধােপদুরস্ত, যদিও গাত্রবর্ণে সাধারণ ভারতীয়দের মতাে ঘন শ্যামল। আমি খুব মনঃক্ষুন্ন হয়ে তাকে শুধু বললাম, আপনি পরিবর্তিত বাংলাদেশের রূপ দেখেননি। তিরিশের দশকের বাঙালি। মুসলমান এবং আজকের বাংলাদেশের জনগণ মােটেও এক নয়। আমরাই আমাদের যুদ্ধ জিতব। আপনারা আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছেন সে জন্য অজস্র ধন্যবাদ। তবে আমাদের উদ্যমহীন বা অপদার্থ এবং যুদ্ধে অপারগ ভাববেন না। আপনার নিরাশা খুব যৌক্তিক নয়, অনেক বেশি ভাবাশ্রিত ও পূর্বসংস্কার প্রভাবিত। জেনারেল চৌধুরী বললেন, ‘আশাবাদী সাহসী যুবক, তােমার আশাবাদ সার্থক হােক এবং আমার দুর্ভাবনা ও সন্দেহ অমূলক প্রমাণিত হলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হব।’
টরন্টো কনফারেন্স শেষে একটি ঘােষণা দেওয়া হয়। এতে সিদ্দিকী সাহেব এবং আমি দস্তখত দিতে বিরত থাকি। কারণ, আমাদের মতে ঘােষণাটি আরও শক্তিশালী হতে পারত, আরও জোরালােভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করা যেত। ঘােষণায় বলা হয়, সম্মেলন অবিলম্বে হত্যা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। একটি রাজনৈতিক সমঝােতার প্রেক্ষাপটেই শুধু তা সম্ভব এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সম্মতি ছাড়া কোনাে রকম স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। এতে শেখ সাহেবের বিচার প্রহসন বন্ধ রাখতে বলা হয় এবং সাবধান করে দেওয়া হয় যে তাঁকে হত্যা করলে এই সংকটের সমাধান সুদূরপরাহত হবে। ঘােষণায় পাঁচটি দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রথমত, পাকিস্তানে সব সামরিক সম্ভার সরবরাহ বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানে সব অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত রাখা। তৃতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘ প্রশাসিত জরুরি
১৬২
দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ ও ত্রাণকাজ পরিচালনা করা এবং তার জন্য সম্পদ সরবরাহ করা। চতুর্থত, ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেখাশােনার আর্থিক ব্যয়ভার আন্তর্জাতিকভাবে বহন করা এবং পঞ্চমত, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষার জন্য বিশ্ববিবেকের হস্তক্ষেপ।
আগস্ট মাসে বাংলাদেশে গেরিলাদের সাফল্যের কাহিনি আমাদের মনে বল সঞ্চার করে। আনুগত্য পরিবর্তনের সময় যাদের মনে কিছু দ্বিধা বা খুঁতখুঁতি ছিল, আগস্টের ব্যস্ততা, দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাবলি এবং এখানে-সেখানে সাফল্যের উদাহরণ সে মনােভাবকে একেবারে দূর করে দেয়। ১৯৭১ সালের বাকি সময়ে আমাদের মধ্যে কাউকে কখনাে আর এ নিয়ে খেদ করতে দেখিনি। বরং অন্যান্য দেশে কূটনীতিকেরা কেন এই পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, সে বিষয়েই ছিল তাঁদের আক্ষেপ ও বিস্ময়বােধ। এ ব্যাপারে আমার নিজের বিচার ছিল অবশ্য খানিকটা স্বতন্ত্র । যারা জীবিকা হারানাের ভয়ে অথবা অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় চুপ করে ছিলেন, তাঁদের জন্য আমার কিছুটা সহানুভূতি ছিল। তারা বিপ্লবী নন বা খুব রাজনীতিসচেতন নন। চাকরিজীবনে প্রবেশ করে স্বকীয়তা হারানাে অস্বাভাবিক নয় এবং মেরুদণ্ডটা সেখানে ক্রমেই বাকতে থাকে। এঁরা ঝুঁকি নিতে ভয় পান, সবচেয়ে নমনীয় লাইন নিতে আগ্রহী হন। কিন্তু আমার আপত্তি ছিল তাঁদের ব্যাপারে, যারা এই সুযােগে এগিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের প্রতি নিজেদের আনুগত্যকে বিশেষভাবে প্রচার করতে চেয়েছেন, আগ বাড়িয়ে পাকিস্তানপ্রীতির পরিচয় দিতে চেয়েছেন এবং তাঁদের বাঙালি সহকর্মীদের ক্ষতি করতে চেয়েছেন। সরকারি চাকুরেদের মধ্যে এই দ্বিতীয় গােষ্ঠীটি ছিল আলবদর ও রাজাকারদের সমতুল্য। সত্যিকার কুইসলিং ও পঞ্চম বাহিনী। ১১ আগস্ট গেরিলারা ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলের একাংশ ধ্বংস করে দেন, এই সাফল্য ছিল তাদের। অত্যন্ত দুঃসাহসী এবং সুষ্ঠু অভিযান পরিকল্পনার একটি চমৎকার উদাহরণ। এতে প্রমাণিত হয় যে পাকিস্তানিদের ঘাঁটিতে গিয়েও আমরা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারি। মাস শেষ না হতেই জানা গেল, নৌ-কমান্ডাে বাহিনীর সাফল্যের কথা । তারা পাকিস্তানি বন্দরে গিয়ে জাহাজ ডুবিয়ে এসেছেন সেখানে মাইন পেতে এসে। এক সপ্তাহে এ রকম চারটি সাফল্যের কাহিনি আমাদের বুককে কয়েক হাত প্রশস্ত করে দেয়।
২ আগস্ট লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমেদের ট্রাফালগার স্কয়ারের এক সমাবেশে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা ছিল। আরেকটি সাড়া জাগানাে ঘটনা। মহিউদ্দিন যখন করাচিতে আন্তঃপ্রাদেশিক বিনিময়ের অধীনে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পড়াশােনা করে, তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমরা স্বামী, স্ত্রী, কন্যা গিয়েছিলাম করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে।
১৬৩
বেড়াতে। সেখানে মহিউদ্দিনের সঙ্গে দেখা। এর আগে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে এক সভায় তাঁর সঙ্গে সামান্য আলাপ হয়েছিল। মহিউদ্দিন। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের গাইডের ভূমিকা গ্রহণ করে। সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ বা ল্যাবরেটরি অথবা ছাত্রাবাস দেখিয়ে মহিউদ্দিন মাঝেমধ্যে মন্তব্য করে, এটা আমাদের পাটের টাকায় নির্মিত। ওটা আমাদের বঞ্চনার মূল্যে করা। ছাত্রাবস্থায়ই, ১৯৬৫ সালের দিকে, মহিউদ্দিন ছিল ঘাের জাতীয়তাবাদী (বিএনপির জাতীয়তাবাদের বিশেষ সংস্করণ তখন অবিদিত ছিল), নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন ও পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষুব্ধ। সেই মহিউদ্দিনের ট্রাফালগার স্কয়ারের ঘােষণায় তাই মােটেও আশ্চর্য হইনি, বরং মনে হয়েছিল যে এটাই তার চরিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আজ পরিণত বয়সেও মহিউদ্দিন তার উৎসাহ, উদ্দীপনা ও আদর্শবাদ বজায় রাখতে পেরেছে। এরশাদের পতনের পর সে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী উপপ্রতিনিধি হয়ে যায়। কিন্তু বিএনপি সরকার তাকে অকালে ডেকে পাঠিয়ে চাকরি থেকে অবসর দেয়। এসব নব্য জাতীয়তাবাদী মহিউদ্দিনের জাতীয়তাবাদ কী করে সহ্য করবে? মহিউদ্দিন প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক এবং জনহিতে নিবেদিত। রাষ্ট্রাদর্শে উদ্বুদ্ধ। মুসলিম লীগের মান্ধাতার আমলের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির অনুসারীরা তাকে কোনােভাবেই সহ্য করতে পারল না। মহিউদ্দিন এখন একজন উঁচুমানের কলাম লেখক। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে এবং সচিব হিসেবে সে অবসরে যায় ।
আগস্ট মাসটা বেশ ভালাে গেল । নিউইয়র্কে ১৪ তারিখে একটি সার্থক র্যালি অনুষ্ঠিত হলাে। এতে প্রচুর পাকিস্তানি ও মার্কিন প্রতিনিধি বাংলাদেশের পক্ষে আওয়াজ তােলেন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে জুন মাস থেকে আমি আমার মােটরগাড়িটি বিক্রয়ের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। অনিশ্চিত রােজগারের আশঙ্কায় আমি আমার দামি মার্সিডিস বেঞ্জ গাড়িটি বিক্রি করে একটি ছােট ডজ গাড়ি কেনার পরিকল্পনা নিই। বােধ হয় আগস্ট মাসেই গাড়ির খদ্দের পেলাম। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে আমার কূটনীতিক নাম্বার প্লেটও বিদায় হলাে। এর একটিই অসুবিধা ছিল পূর্বতন পার্কিং সুবিধার সম্পূর্ণ অবসান । আমার নতুন গাড়ির জন্য আমার সন্তানেরা লাল রং পছন্দ করে। আমার মনে হলাে, এই রংটাই আমাদের মানায় ভালাে—বিদ্রোহী ও উজ্জ্বল । আগস্টে সত্যিই সাফল্যের প্রথম উপলব্ধি এল।
১৬৪
<p style="text-align: justify;"> অষ্টম অধ্যায়
ধীরেসুস্থে অগ্রগতি এবং আমার প্রতিবেদন প্রস্তুতির লম্বা তালিকা
রণাঙ্গনটা যখন উপমহাদেশে, মূলত বাংলাদেশে, তখন প্রবাসে আন্দোলনকারী বাঙালি ও তাদের সমর্থকেরা কতটা কী করতে পারে? এই প্রশ্ন বারবার আমার মনের কোণে উকি দিয়েছে। প্রথম উদ্যোগ ছিল, আমাদের সপক্ষে বিশ্বজনমত গঠন করে পাকিস্তানকে তার উন্মাদ ধ্বংসলীলা থেকে বিরত করা। কিন্তু ভদ্রভাবে ওই খ্যাপা কুকুরসম জান্তাকে বােঝানাে ও সৎপথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যে নিতান্তই অর্থহীন প্রচেষ্টা, তা সহজেই বােঝা গেল । দ্বিতীয় উদ্যোগ ছিল বিনা যুদ্ধেই পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে জব্দ করা । এ উদ্দেশ্যে কংগ্রেসে সংশােধনী পাস করা, মার্কিন নির্বাহী বিভাগকে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থনদানে। বিরত রাখা, বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও অন্যান্য দাতাগােষ্ঠীকে পাকিস্তানে সাহায্য দেওয়া থেকে নিবৃত করা। তৃতীয় উদ্যোগ ছিল মুজিবনগর সরকারকে বা মুক্তিযুদ্ধে নিয়ােজিত বাঙালি নানা গােষ্ঠীকে অর্থ সাহায্য বা অস্ত্র সাহায্য প্রদান করা। আমি তিনটি কাজেই নিজেকে নিয়ােজিত করি। এ ক্ষেত্রে জনমত পক্ষে রাখা হয় প্রধান করণীয়। কারণ, জনমত সপক্ষে না আনতে পারলে এবং তা ধরে রাখতে না পারলে কংগ্রেসে সংশােধনী পাস করা যাবে না, নির্বাহী বিভাগের ওপর চাপ বজায় রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হবে এবং অর্থ সাহায্য পাওয়াও দুরূহ হবে। তাই আমাদের উদ্যোগ মােটামুটিভাবে একটি বিষয়েই নিবদ্ধ হয়—জনমত গঠন ও তাকে সােচ্চার রাখা।
পূর্বেই বলেছি যে বাংলাদেশ মিশন একটি নিয়মিত সাপ্তাহিক বের করতে শুরু করে। শিকাগাে থেকে ডিফেন্স লিগের প্রকাশনা, ওয়াশিংটন ইনফরমেশন সেন্টারের
১৬৫
প্রচারপত্র এবং আরও নানা সমিতি বা প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব সাময়িকী বা সংবাদপত্র বেরােত, তাদেরও উদ্দেশ্য ছিল এই জনমতকে শক্তিশালী করা ও সক্রিয় রাখা। আমরা সারা দেশে ক্যাম্পাসে, গির্জায়, পৌর মিলনায়তনে, স্কুল বা কলেজের ক্লাসে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সভায় এবং বিশেষ করে সংবাদ সম্মেলনে—আমাদের কথা। বলার সুযােগ নিতে থাকলাম। আমাদের বাঙালি সমিতি ও সমর্থক গােষ্ঠীগুলাে যত্রতত্র আমাদের জন্য এ রকম সুযােগ সৃষ্টি করে চলল। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস সেদিক দিয়ে ছিল ব্যস্ততায় পূর্ণ। এম আর সিদ্দিকী বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সফর ও বক্তৃতা অব্যাহত রাখলেন। শামসুল কিবরিয়া ও আবু রুশদও মাঝেমধ্যে বক্তৃতা দিতে থাকলেন। আবু রুশদ দৈনিক পত্রিকায়ও চিঠি ছাপাতেন।
এ দুই মাস আমাকে বিস্তর লেখাপড়ার কাজ করতে হয় এবং অনেক বক্তৃতা দিতে হয়। ৬ সেপ্টেম্বরে আর্জেন্টিনার পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমেন (পরবর্তীকালে বাংলাদেশে পররাষ্ট্রসচিব এবং বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত) এম আর সিদ্দিকীকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি চারটি বিষয়ে তথ্য চেয়ে পাঠান। প্রথমত, বাংলাদেশে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শােষণের চিত্র। দ্বিতীয়ত, পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করবার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ধ্বংসকাহিনি। তৃতীয়ত, পাঞ্জাবিদের সামরিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সারা দেশ নিয়ন্ত্রণের কাহিনি। এবং সবশেষে বাংলাদেশে পাকিস্তানের গণহত্যার চিত্র। তিনি আরও জানান, সত্বর তিনি বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আনুগত্য ঘােষণা করবেন এবং এই তথ্যাদি যেন তাঁর বাড়ির ঠিকানায় দ্রুত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমার মনে হলাে, তিনি তাঁর ঘােষণার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আবদুল মােমেন প্রতিটি ব্যাপারে অত্যন্ত পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নেন। তিনি যে কাজ করেন, সে বিষয়ে সব খুঁটিনাটি জানতে চেষ্টা করেন। সারা জীবনই তিনি একধরনের কঠোর শৃঙ্খলা মেনে চলেছেন। পরবর্তীকালে কানাডায়, ফ্রান্সে ও চীনে তাঁকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দেখেছি এবং একসাথে কাজ করারও সুযােগ হয়েছে।
সিদ্দিকী সাহেবের কাছে লেখা চিঠিতে তার চরিত্রের যে পরিচয় পেয়েছিলাম, সেটাই সব সময় তাঁর কাজকর্মে উপলব্ধি করেছি। আগেও তাঁর সঙ্গে পরিচয় ছিল, কিন্তু তখন ততটা জানতাম না। সরকারি কাজে ইসলামাবাদেও তাঁকে দেখেছি একজন দায়িত্বশীল ও নিয়মানুবর্তী কর্মকর্তা হিসেবে। এই চিঠিটা আমার কাছে এল এসব তথ্য সন্নিবেশিত করে মােমেন সাহেবকে একটি জবাব দেবার জন্য। তাঁর প্রশ্নের সঙ্গে ছিল আরও অনেক ছােটখাটো জিজ্ঞাসা এবং সঠিক পরিসংখ্যানের দাবি। আমি এই উপলক্ষে তিনটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করি। যথা : বাংলাদেশে অর্থনৈতিক শােষণ, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গঠন ও দেশটির গােষ্ঠীগত বিভাজন এবং পাকিস্তানের ইতিহাসে গণতন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার
১৬৬
দুর্ভোগের কাহিনি। গণহত্যা সম্বন্ধে ইতিমধ্যে কিছু প্রকাশনা মজুত ছিল। এসব মােমেন সাহেবকে বুয়েনস এইরেসে পাঠিয়ে দিলাম। ১১ অক্টোবর আবদুল মােমেন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করে লন্ডন হয়ে মুজিবনগরে যান। বাংলাদেশ মুক্ত হলে কিছুদিন তিনি পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে কাজ করে কানাডায় বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার নিযুক্ত হন।
আরেকটি লেখার কাজ সেপ্টেম্বর মাসে আমাকে সম্পন্ন করতে হয়। এটি ছিল বেশ কসরতের ব্যাপার। তবে এখন মনে হয় কাজটি ছিল মজার। পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভায় যে ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল পাঠায়, তার মধ্যে ছয়জন বেসরকারি সদস্য ছিলেন বাঙালি দালাল। এ ছাড়া একজন সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন বাঙালি। পাকিস্তানের ইতিহাসে এত বাঙালি সদস্য কোনাে দিন এ সভায় যােগ দেননি। সরকারি কর্মকর্তা ইউসুফ জে আহমদ ছিলেন একজন দক্ষ কর্মকর্তা এবং তাঁর সম্বন্ধে আমাদের কূটনীতিবিদেরা ওয়াকিবহাল ছিলেন। সমস্যা হলাে বেসরকারি সদস্যদের নিয়ে। তাঁদের জীবনালেখ্য প্রণয়নের ভার পড়ল আমার ওপর। মাহমুদ আলী, শাহ আজিজুর রহমান, জুলমত আলী, এ টি সাদী, ড. ফাতেমা সাদেক ও মিসেস রাজিয়া ফয়েজের জীবনালেখ্য বানিয়ে দিতে বেশ কষ্ট হয়। কারণ, সকলের সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট জানাশােনা ছিল না। তবে মােটামুটিভাবে এসব জীবনবৃত্তান্ত ও চরিত্র অঙ্কন ছিল বস্তুনিষ্ঠ । দু-একটি এখানে উদ্ধৃতির দাবি রাখে।
শাহ আজিজুর রহমান : ৫০ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ পাকিস্তান আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। অতি অল্প বয়সে ছাত্র নেতৃত্ব থেকে পদোন্নতি নিয়ে তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পরােক্ষ নির্বাচনে ১৯৬৫ সালে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিরােধী দলের উপনেতা পদে অভিষিক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যােগ দেন কিন্তু ১৯৭০ সালে কতিপয় ভিন্নমতাবলম্বী সদস্যকে নিয়ে জাতীয় প্রগতিশীল লীগ (NPL) প্রতিষ্ঠা করেন। এনপিএল ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করে। ১ মার্চ ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা না করার জন্য তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে দোষ দেন। তিনি বর্তমানে ভীতি থেকে জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন করছেন কি না, জানা নেই। তবে হতে পারে তিনি আগে উসকানিদাতা এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন। ২৬ মার্চ তাঁর বাড়িও সামরিক আক্রমণের শিকার হয় এবং তার পরিবারেও কিছু লােক মারা যান। গুজবে প্রকাশ যে তার চোখের সামনে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের ওপর সামরিক বাহিনীর অত্যাচার তাকে জাতিসংঘে ইয়াহিয়া জান্তার প্রতিনিধি হতে বাধ্য করে।
১৬৭
এ টি সাদী : প্রায় ৪০ বছর বয়স্ক ঢাকা হাইকোর্টের এই অ্যাডভােকেটের বাড়ি বগুড়ায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে অপরিচিত এই ব্যক্তি বহুদিন মানসিক রােগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। ১৯৬৩ সালে উচ্চ মহলের পৃষ্ঠপােষকতায় হঠাৎ তিনি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি মনােনীত হন। প্রত্যাবর্তনের পর আবার তিনি বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যান এবং কিছুদিন মানসিক হাসপাতালে কাটান। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান দরদি দল নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে সারা দেশেই তিনি হন সে দলের একমাত্র নির্বাচনপ্রার্থী। এই নির্বাচনী যুদ্ধে সাদীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তিনিই হয়েছেন ইয়াহিয়ার বাঙালি জনপ্রতিনিধি।
মিসেস রাজিয়া ফয়েজ : খুলনা ডকইয়ার্ডের একজন ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রী মিসেস ফয়েজ একজন সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে আকস্মিকভাবে তিনি রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ করেন। তখন জাতীয় সংসদে পরােক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্যরা মহিলা সদস্যদের নির্বাচিত করতেন । এই কায়দায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে তিনি আইয়ুবের কনভেনশন মুসলিম লীগের পক্ষে সংসদ সদস্য হন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অবসান হয়। ইয়াহিয়া অন্তঃপুর থেকে খুঁজে এনে তাকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠালেন।
বাংলাদেশ সরকারও ১৯৭১ সালের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। সেই দলটি অবশ্য জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেল না। কিন্তু লবিং করে, জনসমাবেশে বা ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করে, খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কোনাে না কেনােভাবে যােগাযােগ করে তাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে সাধারণ অধিবেশনে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের তালিকা পরিশিষ্ট ২-এ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্যসংকট এক মারাত্মক আকার ধারণ করে। ১৯৭০-৭১-এ খাদ্যঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩ লাখ টন (৫ লাখ টন শুধু ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায়)। ১৯৭০ সালের জুলাইয়ে মজুত ছিল মাত্র ৬ লাখ টন। ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত মােট আমদানি হয় ১১ লাখ টন, যার প্রায় ২ লাখ টন অন্যত্র খালাস। করতে হয়। আবার ১৯৭১-৭২ সালের হিসাব অনুযায়ী খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতি হবে ৩০ শতাংশ। এত ঘাটতি, কিন্তু আমদানির ক্ষমতা সীমিত। মাসে ২ লাখ টন খালাস করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। এই সমস্যার ওপর রয়েছে আরও দুটি ফাঁড়া। প্রথমত, মানুষের রােজগার নেই যে পয়সা দিয়ে খাবার কিনবে। দ্বিতীয়ত, সামরিক বাহিনী খাদ্যকে গণদমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে। এর জন্য প্রয়ােজন ছিল খাদ্য বিতরণে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ এবং
১৬৮
মুজিবনগর সরকারের ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলাের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ। আমি এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক, ইউএসএইড ও ইউএস অ্যাগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট থেকে আসল খবর সংগ্রহে সমর্থ হই এবং পাকিস্তানের কাগজপত্রও হস্তগত করি । পুরাে খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমাকে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হয়। মুজিবনগর সরকারের জন্য একটি, সিনেট শরণার্থী সাব-কমিটির জন্য একটি এবং বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারের জন্য আরেকটি। সিনেট শরণার্থী সাবকমিটি অক্টোবরের ৩০ এবং নভেম্বরের ৪ তারিখে বাংলাদেশ সমস্যার ওপর তার তৃতীয় শুনানির ব্যবস্থা করে। এই শুনানির প্রতিবেদনে আমার বিশ্লেষণ পরিশিষ্ট হিসেবে স্থান পায়।
সিনেটে অক্টোবরে স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী বিবেচিত হবে। তাই ৬ সেপ্টেম্বরে কংগ্রেসের অধিবেশন শুরু হলেই আবার লবিং শুরু হলাে। ইনফরমেশন সেন্টারের হুকুমে একটি প্রতিবেদন বানালাম ‘পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত রাখার যৌক্তিকতা। রেহমান সােবহান বাংলাদেশ ঘুরে যুক্তরাজ্য হয়ে আবার আমেরিকায় এলেন কংগ্রেসে লবিং করতে এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ব্যাংক বার্ষিক সভা ও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে তদবির করতে। তিনি এলে পরে এই প্রতিবেদন নতুন করে সাজাতে হলাে ‘পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্যদাতাদের জন্য কৌশল’ শিরােনামে। এটি ইনফরমেশন সেন্টার ছাপিয়ে দেয় এবং বিশ্ব ব্যাংকের বার্ষিক সভায় এটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। যারা লবি করতে বাইরে থেকে আসেন, তাঁদের চাহিদা মেটানাের জন্য হুকুম হলাে স্যাক্সবিচার্চ সংশােধনীর ওপর একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য উপস্থাপনের। এসব কাজে একটি আনন্দ ছিল। একটা কাজের কাজ করতে পারছি বলে ভালাে লাগত।
আমার প্রায় ব্যক্তিগত কর্মচারী মজিবুল হক একদিকে আমার বক্তব্য টাইপ করত আর বারবার সংশােধন করত। অন্যদিকে আমার সহধর্মিণী এ কাজে আমাকে সব সময় সাহায্য করতেন, মালমসলা জড়াে করে দিতেন। মে-জুন। মাসে যে হারে প্রতিবেদন বানাতে হচ্ছিল, এবার তা করতে হলাে আরও দ্রুত। লয়ে। মে মাসের ফসল ছিল মােটামুটি দুটি, বাংলাদেশ কেন স্বায়ত্তশাসন চায়’ এবং মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ ও প্রত্যাশা। জুন মাসে মুজিবনগর সরকারের কাছে আমার প্রথম প্রতিবেদন ছাড়াও লবিস্ট ও সাংবাদিকদের জন্য রচনা করতে হয় ‘সমঝােতার সম্ভাবনা এবং পাকিস্তান সরকার কেন বাংলাদেশে কোনাে ত্রাণকার্য। বাস্তবায়ন করতে পারবে না। পাকিস্তানি সমঝােতা ও সংলাপের ফানুসের জবাবে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ এবং শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া কোনাে সমঝােতা হতে পারে না। মার্কিন উদ্যোগে যখন জাতিসংঘ ত্রাণ কার্যক্রম প্রণীত হতে
১৬৯
থাকে, তখন আমাদের বিশ্বাস ছিল যে পাকিস্তানকে দিয়ে এই ত্রাণকাজ পরিচালনা করা যাবে না।
আমি ছেলেবেলা থেকে বক্তৃতা করতে ভালােবাসি। এ ব্যাপারে আমার হাতেখড়ি হয় যখন সিলেট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি, সম্ভবত ১৯৪২ সালে। আসামের জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) আমাদের স্কুল পরিদর্শনে এলেন। ক্লাস পরিদর্শন যখন শেষ পর্যায়ে তখন আমাদের ক্লাস শিক্ষক বললেন যে আমার ক্লাসে একজন ছাত্র ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে বেশ পটু। জনশিক্ষা পরিচালক এস এন সেন থেমে বললেন, ছেলেটিকে বক্তৃতা করতে বলেন। আমার শিক্ষক আমার দিকে ইশারা করলেন। ডিপিআইয়ের সঙ্গে ছিলেন। আমার পরিচিত স্কুল পরিদর্শক নজমুল হােসেন চৌধুরী। তাঁদের দুজনার উপস্থিতিতে আমি সাহস সঞ্চয় করে একটি বক্তৃতা ইংরেজিতে দিয়ে দিলাম । কোথাও এক ম্যাগাজিনে একজনের একটি বাণী পড়েছিলাম। তারই অনুকরণে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা। এরপর বক্তৃতা বা বিতর্ক প্রতিযােগিতায় দুই ভাষায়ই আমি সাফল্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। বক্তব্যের জন্য কিছু বিষয় (পয়েন্টস) স্থির করা একটি ভালাে বক্তৃতার জন্য অপরিহার্য। সময় না থাকলেও কয়েক মুহূর্তের জন্যও এ রকম চিন্তা করা দরকার। বক্তৃতায় সময় সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এবং আগে থেকেই সময়ের একটি বিভাজন করে নেওয়া প্রয়ােজন। বক্তৃতার একটি কাঠামাে—কেমন করে শুরু হবে, কতক্ষণে প্রধান বক্তব্য আসবে এবং কীভাবে উপসংহার টানতে হবে—শুরুতেই ভেবে নেওয়া ভালাে। এসব কারণে অনেক। সময় লিখিত বক্তব্য এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তবে লিখিত বক্তব্য পাঠে সুরের ওঠানামা অথবা ভাবের স্বাভাবিক প্রকাশ ব্যাহত হয়। সে যা-ই হােক, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি বক্তৃতার জন্য আমি কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে নিতাম। তারপর প্রশ্নোত্তরে বা ক্লাসে কথাবার্তা চলত লাগামহীন।
সেপ্টেম্বরে ছিল তিনটি বক্তৃতা অনুষ্ঠান। ১২, ১৩ তারিখ কাটালাম পিটসবার্গে লাট্রোব বেনেডিক্টাইন কলেজে। বিল ম্যাকুলক এই বক্তৃতার আয়ােজন করেন এবং আমাকে গাড়িযােগে পিটসবার্গে নিয়ে যান। সেখানে ছিল একটি পাবলিক বক্তৃতা এবং ছােট ছােট আরও অসংখ্য আলােচনা সভা বা ক্লাস। ইতিহাস অথবা রাজনীতির ক্লাসে সহজেই বাংলাদেশের সমস্যা আলােচনা করা যেত । দুদিনে কলেজে আমি একজন পরিচিত ব্যক্তিতে পরিণত হই। আমি বােধ হয় সেখানে দশ-বারােটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। ১৭ সেপ্টেম্বর ফিলাডেলফিয়ায় গেলাম সেখানকার ডেলাওয়ার উপত্যকার বাংলাদেশ লিগ এবং ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গলের যৌথ নৈশভােজে। এই নৈশভােজে বাংলাদেশের জন্য চাদা আদায় করা হয়।
১৭০
ওয়াশিংটনে আমি বেশ বেলা পর্যন্ত কংগ্রেসে ছিলাম, তাই প্রায় সােয়া শ মাইল রাস্তা যেতে আমাদের খানিকটা দেরি হয়ে যায়। এই নৈশভােজে আমরা বক্তা ছিলাম দুজন আর আমাদের পরিচয় ও ধন্যবাদ জানান লিগের সভাপতি মজহারুল হক (টুনু)। ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গলের সভাপতি অধ্যাপক চার্লস কান ছিলেন অন্য বক্তা। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল ছয় দফার উদ্ভব এবং মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। চার্লসের অনুরােধে অর্থনৈতিক সাহায্য ও স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী সম্বন্ধেও আমাকে বলতে হয়। নৈশভােজে ওই এলাকার সব বাঙালি ছাড়াও ছিলেন ফিলাডেলফিয়ার পড়ুয়া ও গির্জা গােষ্ঠীর নানা স্তরের প্রতিনিধি । আমাদের ওয়াশিংটন ফিরতে প্রায় ভাের হয়ে গেল। নৈশভােজের শেষে আমার স্ত্রী এবং আমি বাঙালি পরিবেষ্টিত হয়ে আরও অনেক সময় কাটাই। রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই আমার স্ত্রীর কড়া নির্দেশে গাড়ি থামিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য বিশ্রাম নিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে তারপর আবার যাত্রা শুরু করি। ফিলাডেলফিয়ায় আবার যেতে হলাে ৮ ও ৯ অক্টোবর।
ইউপেনে (পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) তখন দুই দিনের টিচ-ইন প্রােগ্রাম ছিল। এই প্রােগ্রামে পাকিস্তানি প্রগতিশীল দলের পক্ষে আইজাজ আহমদও আমাদের পক্ষে বক্তৃতা দেন। তাঁর আক্রোশ ছিল অনির্বাচিত সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। আইজাজ জ্বালাময়ী বক্তৃতায় অভ্যস্ত ছিলেন, যে ক্ষেত্রে আমার মােটেও দক্ষতা ছিল না। আইজাজ ১৯৭১ সালেই কানাডার নদী উপকূলে হারিয়ে যান, পানিতে ডুবে অকালে তার মৃত্যু হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর কো-অপারেটিভ ফোরাম নামে একটি সংস্থা জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সংকট নামে একটি আলােচনা সভা আহ্বান করে। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন রবার্ট ক্রিচফিল্ড, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর-এর কলাম লেখক। বক্তৃতা করি আমরা তিনজন, ভারতীয় দূতাবাসের তথ্যসচিব জর্জ শুকলা, আমাদের মিশন থেকে জনাব আবু রুশদ ও আমি। সভায় যােগদানকারীদের সবাই ছিলেন সচেতন, জ্ঞানী ও আগ্রহী। সিকুরা নামক একজন ব্যক্তি (উপমহাদেশ সম্বন্ধে বিশেষভাবে ওয়াকিবহাল) শেষ মুহূর্তে এসে সভায় বক্তব্য দেন। তার কথাগুলাে তেমন মনে নেই কিন্তু তাঁর নামটা দেখি নােটে লেখা আছে। এই সভায় প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল। দীর্ঘ, যদিও আমি দেরি করে হাজির হয়ে খানিকটা অসুবিধার সৃষ্টি করি ।
ওয়াশিংটনে একটি ছােট সংগঠন হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের সমিতি। কেনেডি স্কুল ১৯৬৩ সালের আগে গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে পরিচিত ছিল । ডিন এডওয়ার্ড মেসন ১৯৫৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের মধ্যপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য
১৭১
একটি আন্তর্জাতিক ফেলােশিপ প্রােগ্রাম শুরু করেন। এই প্রােগ্রামে অংশগ্রহণকারী আমাদের দেশের অনেক কর্মকর্তা কেনেডি স্কুলের ছাত্র । কেনেডি, স্কুলের ছাত্ররা ওয়াশিংটনেও সরকারি মহলে প্রভাবশালী ছিলেন। ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের একজন কর্মকর্তা ড. জনসন কেনেডি স্কুল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মিরিয়াম ছিলেন পাকিস্তানের সত্যিকার বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। তারা হয়তাে কোনাে সময়ে করাচিতে মার্কিন পরামর্শক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানিদের বর্বরতা এই দম্পতিকে খুবই বিচলিত ও ক্ষুব্ধ করে।
মিরিয়াম খুব স্পষ্টবাদী ছিলেন। তিনি সরাসরি রাষ্ট্রদূত দম্পতির সঙ্গে এ বিষয়ে উত্তপ্ত আলােচনা করেন। তাঁরা বাংলাদেশের শক্ত সমর্থকে পরিণত হন। ড. জনসন আমাকে কেনেডি স্কুল সমিতির মাসিক বৈঠকে অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করেন। ৭ অক্টোবর জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে কামরায় এক মধ্যাহ্নভােজ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের বিভক্তি ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়ে সেখানে আলােচনা হয়। তবে আমার বক্তৃতার একটি প্রধান বিষয় হয় ইয়াহিয়া-উপাখ্যান। একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করেন। কিন্তু তারপর তিনিই দেশটিকে বর্বরের মতাে ধ্বংস করেন। আমার প্রতিপাদ্য ছিল ইয়াহিয়া—একজন রােমান্টিক দুরাত্মা’, গ্রিক বিয়ােগান্ত নাটকের পথভ্রষ্ট নায়ক। নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম কয়েক দিনের জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। সেখানে ফকির শাহাবুদ্দিন একদিন। নির্দেশ দিলেন যে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রুকলিন ক্যাম্পাসে একটি র্যালি হবে ১৩ অক্টোবর, সেখানে সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদারের সঙ্গে আমাকে যেতে হবে। আমি ভেবেছিলাম আমি ফণীবাবুর বক্তৃতা অনুবাদ করব কিন্তু ফণীদা কিছু সময় বাদে আমাকেই সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আর কারও বেলায় যদি নাও হয়, ফণীদার মনে আমার বক্তৃতা খুব রেখাপাত করে।
জাতিসংঘে প্রেরিত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল ১৬ অক্টোবর ওয়াশিংটন গেল চার দিনের সফরে। আমাকে এর মধ্যে ১৭ তারিখ যেতে হলাে ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে, গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। শার্লটসভিল প্রেসিডেন্ট জেফারসনের স্মৃতিবিজড়িত এলাকা। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস স্থপতি জেফারসনের কীর্তির নিদর্শন বহন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী সাজ্জাদ ইউসুফ তখন শার্লটসভিলে ছিলেন এবং এখনাে বােধ হয় সেখানে তার উত্তরসূরিরা আছেন। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও গির্জা কাউন্সিলের উদ্যোগে ওখানে তখন একটি টিচ-ইন প্রােগ্রাম চলছিল। তার সমাপনী নৈশভােজে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমার দাওয়াত । আমি সস্ত্রীক সেখানে যাই এবং রাতটা সাজ্জাদ ইউসুফের সঙ্গে
১৭২
কাটাই। সেখানে আমার বক্তৃতায় বিশেষ করে স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী পাসের গুরুত্ব তুলে ধরতে হয় এবং বাংলাদেশের খাদ্যসংকট নিয়ে আলােচনা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকও বক্তব্য দেন। প্রেসাবাইটেরিয়ান গির্জার হাওয়ার্ড গর্ডন এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
এরপর শুরু হয় আমার ঘন ঘন বক্তৃতার পালা। ২০-২১ অক্টোবর যেতে হলাে কারবনডেল সাদার্ন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সেখানে টিচ-ইন প্রােগ্রামে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়াও আমাকে রেডিও-টেলিভিশনে হাজির হতে হবে। অন্ধ্র প্রদেশের সি কুমার রত্নম তখন সারা ক্যাম্পাসে এবং সংবাদমাধ্যমে সি কে নামে সমধিক পরিচিত। তিনি আমাকে নিতে এলেন সেইন্ট লুই বিমানবন্দরে। এরপর বােধ হয় আরও ঘণ্টা দেড়েকের গাড়িভ্রমণ। কারবনডেলে আমি ছিলাম অধ্যাপক আর্থার লিনের বাড়িতে। ২০ তারিখ সন্ধেবেলা ছিল পাবলিক বক্তৃতা, মূলত ছাত্ররা আয়ােজন করে। বক্তাদের প্যানেলে আরও সদস্য ছিলেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টার সভা। বাংলাদেশের বিজয় সম্বন্ধে কোনাে সংশয় ছিল না। প্রশ্ন ছিল তার আগে আর কত হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও বাঙালি বিতাড়ন চলবে। পরদিন ছিল রেডিও ও টেলিভিশন প্রােগ্রাম। সেই সঙ্গে একটি অভ্যর্থনা সভা, উদ্যোক্তা ভারত অ্যাসােসিয়েশন । অপরাহে আমাদের ওয়াশিংটন প্রত্যাবর্তনের পালা, দেড় ঘণ্টা মােটরগাড়িতে আর দুই ঘণ্টার বিমানযাত্রা।
২৬ তারিখ ছিল ওয়াশিংটনের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা। পাকিস্তান কি সত্যি সত্যি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে—এটাই ছিল সবার মুখে প্রশ্ন। বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে কারও মনে কোনাে সন্দেহের অবকাশ ছিল না। ৩১ তারিখ আমরা পুরাে পরিবার গেলাম ওয়েস্ট পয়েন্টে। সামরিক একাডেমিতে ক্রেইগ ব্যাক্সটার অধ্যাপক—তিনিই ১ নভেম্বর আমার কয়েকটি বক্তৃতার ব্যবস্থা করেন—একটি পাবলিক বক্তৃতা আর বাকি ক্লাসে। আমরা ৩১ তারিখ গিয়েছি। কারণ, ওই দিন ছিল হেলােইন উৎসব। শিশুরা নানা রঙের কাপড়চোপড় পরে বিচিত্র সাজে সেদিন বিকেলে বেরােয় ‘ট্রিক অর ট্রিটে। দোরে দোরে তারা ধরনা দেয় আর সবাই তাদের চকলেট-লেবেথুস দেয়। কিছু কিছু ভয় দেখানােও হয়। হেলােইনের সময় ছদ্মবেশ পরা, আগুন পােহানাে, বাজি পােড়ানাে এবং ভূতের গল্প বলা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এখন অবশ্য আগুন জ্বালানাে বা বাজি পােড়ানাে নিষিদ্ধ। অধুনা ‘ট্রিক অর ট্রিট’ও বাদ পড়ে যাচ্ছে। দুষ্ট লােক ক্যান্ডির পরিবর্তে ক্ষতিকর জিনিস দেয়। আবার ছেলেমেয়েদের তাড়ায়। তেমনি শিশুরাও অন্যদের, বিশেষ করে বুড়িদের জ্বালায় ।
১৯৭১ সালে কিন্তু ওয়েস্ট পয়েন্টে সুন্দর ছিমছাম হেলােইন উৎসব হয়। আমার মেয়ে এবং ক্রেইগের মেয়ে একসঙ্গে ট্রিক অর ট্রিটের পরিকল্পনা করেছিল
১৭৩
বলে আমরা ৩১ তারিখেই ওখানে পৌছে গেলাম। ওয়েস্ট পয়েন্টে যে বিষয়টি চোখে পড়ল তা হলাে সেখানকার শিক্ষা কার্যক্রম। ক্যাডেটরা শৃঙ্খলা মানে এবং সামরিক প্রশিক্ষণ পায়। সেই সঙ্গে তারা ভালােভাবে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষাও লাভ করে। ওয়েস্ট পয়েন্টের পড়াশােনার মান এবং শিক্ষকদের যােগ্যতা ছিল যেকোনাে ভালাে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ। তাই সেখানে ক্লাসে বক্তৃতা করার ব্যাপারটি ছিল খুবই উপভােগ্য। উপমহাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি, স্বাধীনতাসংগ্রামের ঐতিহ্য, জাতিসত্তার বিকাশ, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশের বিচ্ছিন্নতা—এমন সব বড় বিষয় নিয়ে বিস্তর আলােচনা হলাে। পাকিস্তান বিভিন্ন সামরিক জোটে আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত আছে বলে পাকিস্তান সংকটের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিল খুব বেশি। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতি কোনাে রকম অন্ধ সমর্থন বা বিশেষ সহানুভূতি অন্ততপক্ষে ক্যাডেটদের মধ্যে মােটেও দেখা গেল না। ওয়েস্ট পয়েন্টে আমার বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের কল্পকথা। পাকিস্তান আসলে কখনাে একটি জাতিসত্তা হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এটা ছিল একটি মিথ বা কল্পকাহিনি।
দেশের খবরে শুনলাম, ডা. আবদুল মােতালেব মালিক লাটবাহাদুর হয়েছেন। ৩ সেপ্টেম্বর। তাঁকে ছাত্র বয়স থেকে চিনি আমার বন্ধুর চাচা হিসেবে। সারা জীবন তিনি ক্ষমতার কাঙাল ছিলেন, তবে এবার যা করলেন, তা ছিল কল্পনার বাইরে। তিনি ইয়াহিয়া মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠতম সদস্য ছিলেন এবং ইয়াহিয়া ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ যখন তাঁর মন্ত্রিসভা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন, তখন ডা. মালিক নাকি তার সে পদক্ষেপের বিরােধিতা করেছিলেন। তার যুক্তি, এতে প্রেসিডেন্ট বেসামরিক পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হবেন এবং বিশেষ করে কোনাে বাঙালি তার চারপাশে থাকবে না। ইয়াহিয়ার কাছে বেইজ্জত হওয়ার পরও তিনি তার হত্যাযজ্ঞের দোসর হবেন, এটা ভাবতে পারিনি। আমি খুব রেগেমেগে তাঁকে একটি পত্রাঘাত করি। সে পত্রের ভাগ্য সম্বন্ধে আমি ওয়াকিবহাল নই, তবে মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস প্রকল্পের অতি উদ্যোগী গবেষক আফসান চৌধুরী সেটি হস্তগত করে মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংকলনে তা প্রকাশ করে দেন। ডা. মালিক কয়েকজন পরিত্যক্ত ও ধিকৃত রাজনীতিককে ধরেবেঁধে মন্ত্রী বানান। বুঝতে পারছিলাম না তাদের নামগুলাে শুনে হাসব না কাদব, কারণ তাদের প্রায় সবাই এমন গুণের অধিকারী যে মন্ত্রী তাে দূরের কথা, সংসদ সদস্য হওয়ার যােগ্যতাও তাদের নেই। কুইসলিং মন্ত্রিসভা অবশ্য এর চেয়ে ভালাে কী করে হবে ।
সিনেটর কেনেডি শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্র দেখে আসার পর শরণার্থী সাহায্যের জন্য একটি বিল পেশ করেন ২৩ সেপ্টেম্বর। তিনি তাতে শরণার্থীদের জন্য ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ চান। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এই প্রস্তাবের বিরােধিতা না করে
১৭৪
১ অক্টোবর ২৫০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের জন্য একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। সিনেটর কেনেডির শরণার্থী সাব-কমিটি তার তৃতীয় শুনানি দুই দিনে—৩০ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বর সম্পন্ন করে। এবার তাতে অনেক বেসরকারি ব্যক্তিত্ব সাক্ষ্য দিতে হাজির হন। অক্সফামের এলান লেদার এবং শান্তির জন্য ধর্ম সম্মেলনের মহাসচিব হােমার জ্যাক ছিলেন দুজন সাক্ষী। এ ছাড়া ডিন জন লুইস ও অধ্যাপক নেভিন স্ক্রিমশাে, যারা সিনেটরের সঙ্গে ভারতে গিয়েছিলেন, তাঁরাও সাক্ষ্য দেন। সরকারপক্ষ থেকে স্টেটের ক্রিস ভান হােলেন এবং এইডের মরিস উইলিয়ামস আবার সাক্ষ্য দিলেন।
এবারের আলােচনার প্রধান বিষয় ছিল, কী করে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ রােধ করা যাবে, কীভাবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের আরও সাহায্য করা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কীভাবে সংকটের সমাধান মিলবে। কিছুদিন আগে প্রিন্সটনে তখন অধ্যয়নরত মনজুর আহমদ (বর্তমানে ইউনিসেফ থেকে অবসরপ্রাপ্ত) আমাকে ডিন লুইসের প্রতিবেদনের খসড়াটি পাঠান। তার সঙ্গে তিনি তাঁর নিজস্ব এক প্রতিবেদন জুড়ে দেন। একই প্রতিবেদন তিনি। শরণার্থীবিষয়ক প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির একজন সদস্য জেমস পার্কিনসের কাছেও পাঠান । মনজুরের মতাে অসংখ্য বাঙালি তাদের নিজেদের অবস্থানে থেকেও নিরলসভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য কাজ করে গেছেন। শুনানিতে আমাদের তরফ থেকে যে কথা বােঝানাের চেষ্টা করা হয় তা ছিল এই, মূল সমস্যার সমাধান না হলে দুর্ভিক্ষ চলতেই থাকবে, খাদ্য বিতরণ সম্ভব হবে না। এবং শরণার্থীর লাইন আরও বাড়তে থাকবে। শুনানিতে খাদ্যসংকটের ওপর আমার প্রতিবেদনটি প্রাধান্য পায়।
শেষ পর্যন্ত অক্টোবরেই ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইন সিনেটের বিবেচনায় এল। এর জন্য আমরা প্রায় দুই মাস ধরে একটানা তদবির চালিয়েছি। আমাদের লবিং যে কত সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে অক্টোবরের শুরুতে লেখা আমার নিজস্ব মন্তব্য সম্পর্কে একটি ধারণা দিচ্ছি। ইনফরমেশন সেন্টার থেকে সবার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। আমার ব্যক্তিগত দায়িত্ব ছিল নিজের মতাে করে তদবির করা এবং অন্য লবিস্টদের জন্য একজন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা, অর্থাৎ রিসাের্স পারসনের ভূমিকা পালন করা। লবিস্টদের কর্তব্য ছিল প্রাপ্ত তদবিরের মূল্যায়ন করে একটি অভিমত প্রদান, যাতে পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করা যায়। আমার মন্তব্য রয়েছে ১৭ জন সিনেটর ও তাদের সহকারীদের নিয়ে। সিনেটর মন্ডেইল, কেনেডি আর ক্র্যানস্টন সম্বন্ধে লেখা আছে যে তাঁদের কাছে তদবিরের প্রয়ােজন নেই। তাদের সহকারী ডেহান, টিংকার, মরিস আর টিপার নিজেরাই লবিস্টের ভূমিকায় আছেন।
১৭৫
আলাবামার ডেমােক্র্যাট সিনেটর জেমস এলেন এবং তাঁর সহকারী জর্জ মিচেল দুজনই পরিস্থিতি সম্পর্কে সবিশেষ ওয়াকিবহাল নন এবং তারা তখনাে সিদ্ধান্ত নেননি। মন্টানার সিনেটর ইগলটন প্রস্তাবকদের একজন, সুতরাং তাঁর কাছেও তদবিরের প্রয়ােজন নেই। ইউটার ডেমােক্র্যাট সিনেটর মস বিতর্ককালে সংশােধনী সমর্থন করে বক্তৃতা দেবেন। ওরেগনের রিপাবলিকান সিনেটর প্যাকউড সংশােধনী সমর্থন করবেন। পেনসিলভানিয়ার রিপাবলিকান সিনেটর শােয়াইকারের সহকারী বেটি কনলে আমাদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং সিনেটরকে প্রভাবিত করার জন্য একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছেন (১৯ অক্টোবর দেখা হওয়ার কথা)। তিনজন সিনেটরের দপ্তরে গিয়ে তাঁদের সহকারীদের কাছ থেকে আবার যােগাযােগ করার নির্দেশ পেলাম। টেনেসির রিপাবলিকান সিনেটর বিল ব্রুকের সহকারী ডেক্সহাইমার, মন্টানার ডেমােক্র্যাট সিনেটর লি মেটকাফ এবং অ্যারিজোনার রিপাবলিকান সিনেটর ব্যারি গােল্ডওয়াটারের সহকারী লেনার্ড কিলগাের জানালেন যে পুনর্বার তদবিরের প্রয়ােজন আছে, তারা তখনাে সিদ্ধান্ত নেননি। আইডাহাের রিপাবলিকান সিনেটর লেন জর্ডান এবং তার সহকারী জোনস মানবিক সাহায্য সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করলেন এবং সবশেষে জানালেন যে তারা সংশােধনী সমর্থন করতেও পারেন।
দক্ষিণ ক্যারােলাইনার ডেমােক্র্যাট সিনেটর আর্নেস্ট হলিংসের দপ্তরে গিয়ে শুরু হয় আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। তাঁর সহকারী মাইকেল কপস জানালেন যে সিনেটর সহানুভূতিশীল কিন্তু কোনাে সিদ্ধান্ত নেননি। সিনেটর পরে আমাদের কড়া সমর্থকে পরিণত হন এবং আমাদের দেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হাওয়াইর ডেমােক্র্যাট সিনেটর ড্যানিয়াল ইনােয়ে ছিলেন ওই রাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর হিরাম ফংগের ঠিক উল্টো। তার সহকারী ক্লিফোর্ড গােরেন ছিলেন আমাদের ঘাের সমর্থক এবং তার প্রভাবে সিনেটরের সঙ্গে আমার একধরনের সখ্য স্থাপিত হয়। উত্তর ডাকোটার ডেমােক্র্যাট সিনেটর কুয়েনটিন বার্ডিক এবং তাঁর সহকারী ইবেল ট্রফট জানালেন, সিনেটর সব বৈদেশিক সাহায্যের বিরুদ্ধে, তাই তাঁর কাছে সাহায্য বন্ধের তদবির করতে হবে না। ইলিনয়ের ডেমােক্র্যাট সিনেটর আডলাই স্টিভেনসন (তৃতীয়) এবং তাঁর সহকারী স্যাম ব্লেক ছিলেন আমাদের বন্ধু। সিনেটর সংশােধনীর একজন সহপ্রস্তাবক ছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি প্রথম দিকেই সফরে আসেন। মেরিল্যান্ডের রিপাবলিকান সিনেটর চার্লস মেথায়াস ছিলেন নীতিমান ব্যক্তি, তিনি সামরিক সাহায্য বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যাপারে তিনি প্রেসিডেন্টের বিচারকে প্রাধান্য দিতে চান। সিনেটর কিন্তু বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন এবং তাঁর সহকারী গােল্ডবার্গও ছিলেন আমাদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল।
১৭৬
এই মন্তব্যগুলাে এখন দেখে মনে পড়ছে যে ওই সময়ে কংগ্রেসের অলিতেগলিতে কত যে ঘুরেছি আর কত সময় কাটিয়েছি! একধরনের নেশাগ্রস্তের মতাে। এই মন্তব্যগুলাে লিখেছিলাম ইনফরমেশন সেন্টারের অবগতির জন্য কিন্তু এখন দেখছি কাগজখানা আমার কাছেই রয়েছে। অবশ্য আমরা মাঝেমধ্যেই লবিংয়ের অগ্রগতি ও অবস্থা নিয়ে পর্যালােচনায় বসতাম এবং এসব মন্তব্যের ভিত্তিতে পরবর্তী কার্যধারা ঠিক করে নিতাম। এ বিষয়ে সবচেয়ে উদ্যোগী ও ওয়াকিবহাল ছিলেন টমাস ডাইন এবং তার পরামর্শ আমরা সাগ্রহে গ্রহণ করতাম। টমের একটি অলিখিত নীতি ছিল গােলমেলে জায়গায় আমাকে ঠেলে দেওয়া অথবা রেহমানের জন্য অপেক্ষা করা।
২৬ অক্টোবর সিনেটর ফুলব্রাইট বৈদেশিক সাহায্য বিলটি উত্থাপন করেন। এতে শরণার্থীদের জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য বরাদ্দ করা হয় এবং স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনীর অধীনে পাকিস্তানে সব রকম সাহায্য স্থগিতের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন, সুতরাং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রস্তাব ডেমােক্র্যাটরা নাকচ করবে বা বদলাবে, নির্বাহী বিভাগের বিরােধিতা করবে, এটা স্বাভাবিক। অনেক রক্ষণশীল সিনেটর কোনাে রকম সাহায্য প্রদানেই অরাজি। আবার অন্যরা সামরিক সাহায্যের বিরােধিতা করেন, তবে অর্থনৈতিক বা মানবিক সাহায্য দিতে চান। অনেকে গ্রিসে সাহায্য প্রদান বন্ধ করতে চান । তেমনই অনেকে পাকিস্তানে সাহায্য প্রদান স্থগিত করার পক্ষপাতী। কম্বােডিয়ার সাহায্য অব্যাহত থাকবে, তবে অনেকেই তাকে কঠোর শর্তে আবদ্ধ করতে চান। অনেকে আবার স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী যেভাবে পাস হয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট নন—কেউ কেউ চান নির্বাহী বিভাগকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দিতে, আবার অন্যরা চান যেন তাতে খানিকটা স্ববিবেচনার সুযােগ থাকে। রাজনীতির এসব নানা চিন্তাধারা ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইনের ভাগ্য নির্ধারণ করবে বলে শেষ ফল সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না।
এই অবস্থায় এক নতুন মাত্রা যােগ হলাে জাতিসংঘে চীনের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্কে। ২৫ ও ২৬ অক্টোবর এ ব্যাপারে জাতিসংঘে বিতর্ক চলে। আমেরিকা। ২২ বছর পর চীনকে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে মেনে নিতে রাজি হয়। কিন্তু সমস্যা হলাে, এর ফলে তাইওয়ানের কী হবে। তাইওয়ানের স্বতন্ত্র অস্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে তাকে জাতিসংঘে রাখতে চায় আমেরিকা। কিন্তু বেশির ভাগ সদস্য তাইওয়ানের জায়গায় চীনকে অভিষিক্ত করে তাইওয়ানকে বাদ দিতে চায়। তীব্র এই বিতর্কে অনেক দেশের কড়া আমেরিকাবিরােধী মনােভাব প্রকাশ পায় এবং চীনের অন্তর্ভুক্তি ও তাইওয়ানের বহিষ্কার মার্কিন শক্তির পরাজয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলাে এ নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করে—হই-হুল্লোড় করে ও
১৭৭
নেচেগেয়ে তারা মার্কিন পরাজয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। মার্কিন সিনেটে এ ব্যাপারে গভীর উত্মা প্রকাশ করা হয় এবং অনেকেই পুরাে ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইনের বিরােধিতা করে বসেন। এই আইনের আওতায় শুধু তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশই সাহায্য পেত না, বরং বিভিন্ন জাতিসংঘ সংস্থার জন্য বরাদ্দও এই আইনের অধীনেই হতাে। তিন দিন ধরে বিতর্ক চলল। বিতর্কের শেষ পর্যায়ে সিনেটর চার্চ এক ঘণ্টাব্যাপী একটি বিবৃতি দিলেন। তাঁর বক্তৃতার শিরােনাম ছিল, ‘একজন উদারপন্থী বৈদেশিক সাহায্যকে বিদায় দিলেন।’ ভােটের সময় প্রচুর সিনেটর অনুপস্থিত থাকলেন। ৪১-৭১ ভােটে পুরাে আইনটিই বাতিল হয়ে গেল। এই প্রথমবারের মতাে সিনেট কোনাে রকম বৈদেশিক সাহায্য দিতে অস্বীকার করল। রক্ষণশীল অনেকেই বৈদেশিক সাহায্য বন্ধের এই ব্যাপারটিতে উল্লাস প্রকাশ করলেন।
তবে আইন বাতিল হলেও বৈদেশিক সাহায্য প্রদান বন্ধ হলাে না। তার কলেবর কমে গেলেও সাহায্য প্রদানের ধারাটি এখনাে অব্যাহত । এই ভােটের ফলাফল হয় দুই রকমের। এক. সামরিক সাহায্য প্রদানের বিষয়ে সযত্ন বিবেচনা ও সতর্কতা এবং সে কারণে স্বতন্ত্র সামরিক সাহায্য বিলের দাবি। এবং দুই. মানবিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানে রাজনৈতিক বিবেচনা বর্জন ও তার জন্য আরেকটি স্বতন্ত্র বিল। বাস্তবে কিন্তু শীতল যুদ্ধ অবসানের পরও অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য বরাদ্দে রাজনৈতিক বিবেচনা এখনাে অগ্রাধিকার পায়। যা-ই হােক, সিনেটে কিছুদিনের মধ্যেই দুটো ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইন। এসে হাজির হলাে। একটি হলাে শুধু অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্যের জন্য ১১১৪ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ, আর অন্যটি শুধু সামরিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক ১১৮৫ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ। ১০ নভেম্বর স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনীসহ অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য বিলটি পাস হলাে, পরের দিন অন্যটিও। কিন্তু এখানেই বিষয়টির নিষ্পত্তি হলাে না। কংগ্রেসের দুই পরিষদ দুই রকম বিল পাস করল । তাই এ দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করার প্রয়ােজন পড়ল । এই সামঞ্জস্য আনতে আবার কিন্তু সামরিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য—সব মিলিয়ে একটি আইনই বিবেচিত হলাে ১৭ ডিসেম্বর। এবার স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী এবং বাংলাদেশের জন্য ২৫০ মিলিয়ন ডলার ত্রাণ সাহায্য আবারও পাস হলাে। যদিও সংশােধনীর প্রয়ােজন তত দিনে ফুরিয়ে গেছে, বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানি দখল থেকে মুক্ত।
মার্কিন বাজেট-প্রক্রিয়া বড় জটিল এবং কিছুটা এ কারণেই বাজেটে আয়ব্যয়ে ভারসাম্য রাখা মুশকিল হয়। ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইন পাস হওয়া মানে বৈদেশিক সাহায্যবিষয়ক বাজেট পাস হওয়া নয়। আরেকটি স্তরে তা পুনরায়
১৭৮
বিবেচিত হয়। বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ আইন বিবেচনা করে স্বতন্ত্র কমিটি এবং তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আবার বিলটি দুই পরিষদে পাস করতে হয়। ১৯৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সিনেট এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিনিধি পরিষদ অ্যাপ্রােপ্রিয়েশন বিল পাস করে। দুই পরিষদের সম্মেলনে সিনেটের এবং প্রতিনিধি পরিষদের উদ্দেশ্য ও বরাদ্দের সমন্বয় সাধন করে অবশেষে বৈদেশিক সাহায্য আইন পাস হলাে ১৯৭২ সালের জুন মাসে। যেকোনাে সময়ই বাজেট পাস হতে বছরের বেশি সময় লাগে, ১৯৭১ সালে অবশ্য বিশেষ কারণে প্রায় দুই বছর লেগেছিল। অধুনা বিষয়ভিত্তিক কমিটি ও বরাদ্দ কমিটি ছাড়াও আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে সার্বিক সমন্বয় ও দিকনির্দেশনার জন্য। এতে বাজেটের বিভিন্ন সীমানা বা চৌহদ্দি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যেমন আয়-ব্যয় এবং পাবলিক ঋণের সীমানা।
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর ছিল বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের যৌথ বার্ষিক সভা। সব সদস্যদেশের (১৯৯৬ সালে ১৭৫) অর্থমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর বিশ্বের সব ব্যাংক ও অর্থ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যােগ দেন। বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের যৌথ বার্ষিক সভা বলতে গেলে লঙ্কাকাণ্ড। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। রমজানের বিশেষ নির্ঘণ্ট বিবেচনা করে ১৯৭৪ সালের পর থেকে তারিখটি মাঝে মাঝে অক্টোবরে চলে যায়। পরপর দুই বছর ওয়াশিংটনে, তারপর তৃতীয় বছর অন্য মহাদেশের কোনাে শহরে। ১৯৭০ সালে সভা হয় কোপেনহেগেনে এবং সেবারই প্রথম এই সভা বিক্ষোভের। মুখােমুখি হয়। তখন ইউরােপে ছাত্রদের বিদ্রোহের সময়। ভিয়েতনামে ব্যর্থতা সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের ছাত্রদের উত্তেজিত করে রেখেছে, আন্তর্জাতিক সমস্যা ও দায়িত্ব নিয়ে নতুন ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। সর্বত্র বিরাজ করছে একধরনের হতাশা ও ক্ষোভ। সব রকম নিয়ম-প্রথার প্রতি দারুণ আক্রোশ ও এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ফলে ম্যাকনামারা তখন অত্যন্ত নিন্দিত একজন ব্যক্তি এবং তাঁর বিশ্ব ব্যাংকও শত্রবিশেষে পরিণত হয়েছে। এই বিক্ষোভের সঙ্গে জুড়ে ছিল একটি সহজ-সরল ও খােলামেলা জীবনের জন্য আকুতি। সংগীতজগতে তাই ছিল রক অ্যান্ড রােলের প্রভাব এবং শিল্পকলায়। বিশুদ্ধ আইকনােক্লোজম। প্রগতিশীল চিন্তাধারা হয়ে যায় উগ্রপন্থার নামান্তর। কোপেনহেগেনের পর বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এ ধরনের বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে আরও অনেকবার । আগে পাঁচ দিন সভা চলত আর অংশগ্রহণকারীরা সবাই রােববারই সমবেত হতেন। এখন মূল সভা হয় তিন দিন। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয় আরও অনেক সভা ও বৈঠক।
১৭৯
১৯৭৪ সালে গঠিত হয় বিশ্ব ব্যাংকের উন্নয়ন কমিটি (ডেভেলপমেন্ট কমিটি) আর অর্থ তহবিলের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি (ইন্টেরিম কমিটি)। এদের সভা এক দিন করে সময় নিয়ে যায়। এরা অবশ্য বছরে আরেকবার মিলিত হয়। বর্তমানে বৈঠক শুরু হয় এক শনিবারে এবং পরবর্তী শনিবারে শেষ হয় । ১৯৭১ সালে সভায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল বােধ হয় আড়াই-তিন হাজার, এখন তা হবে আট-দশ হাজার। সভার ফাঁকে ফাঁকে অনেক দ্বিপক্ষীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়। অনেক বাণিজ্যিক কাজকর্ম, অনেক সারগর্ভ সেমিনার ও বক্তৃতা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বুদ্ধি ও কৌশলের আদান-প্রদান ইত্যাদি হলাে এই সভার আনুষঙ্গিক ব্যাপার। বিশ্ব ব্যাংকের অঙ্গ সংস্থা আছে চারটি। এদের সভাও একই সময়ে হয়। ১৯৫৬ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা (আইএফসি), ১৯৬০ সালে গঠিত হয় সহজ শর্তে ঋণদানকারী আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি (আইডিএ), ১৯৬৬ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক শিল্পবিরােধ নিষ্পত্তি সমিতি (আইসিএসআইডি) এবং ১৯৮৮ সালে বহুজাতিক বিমা গ্যারান্টি সমিতি (এমআইজিএ)। বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের গভর্নর বাের্ডের বার্ষিক যৌথ সভা যথার্থই বিশ্ব অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও মেধার সর্ববৃহৎ ও সর্বোচ্চ সম্মেলন।
আমরা ঠিক করলাম যে এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের নেতারা যারা এসেছেন, তাঁদের কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। বিশেষ করে পাকিস্তানের দাতাগােষ্ঠীর কাছে তদবির করব পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ অব্যাহত রাখতে এবং কোনাে রকম ঋণ রেয়াতি না দিতে। সভা শেষে পাকিস্তান কনসাের্টিয়াম বসবে, সেখানে যেন মত পরিবর্তন না হয়। আগেই বলেছি, এ জন্য আমরা একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করি এবং ইনফরমেশন সেন্টার সেটি ছাপায়। আমরা আরও সিদ্ধান্ত নিই যে বার্ষিক সভায় বাংলাদেশের সমস্যা তুলে ধরতে আমরা একটি র্যালিও করব। রেহমান সােবহান এবং আমি রােববার থেকেই শেরাটন পার্ক হােটেলের লবিতে আস্তানা গাড়লাম। পরিচিত লােকের সন্ধানে আমরা বলা যায় ঘাপটি মেরে বসে আছি। ড. নূরুল ইসলাম সম্ভবত তখন বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনিও এই সভায় এলেন এবং একদিন আমাদের সাহায্য করলেন। বিভিন্ন প্রতিনিধিদল এই সভা উপলক্ষে হােটেলেই তাদের সাময়িক দপ্তর স্থাপন করে। এসব দপ্তরে গেলে কারও না কারও সঙ্গে দেখা হয়েই যেত। কখনাে আবার সাক্ষাতের জন্য সময় নির্দিষ্ট করা যেত। ড. ইসলামের বন্ধু ফিলিপাইনের বেনিটো লাগার্ডা চিলির অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের মােলাকাতের ব্যবস্থা করে দেন। পরে ১৯৭৪ সালে আমি যখন ফিলিপাইনে যাই, তখন সেখানে আমার মুষ্টিমেয় পরিচিত ব্যক্তির
১৮০
মধ্যে একজন হন বেনিটো। ১৯৭৭ সালে আমার ম্যানিলা ছাড়ার আগেই তিনি। সম্ভবত ওখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হন। চিলির অর্থমন্ত্রী আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানালেন, কিন্তু তিনি বললেন, তাঁদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের দেখা করা উচিত। তাঁদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন নিউইয়র্কে । সমর্থনের ব্যাপারে আলােচনার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীই উপযুক্ত ব্যক্তি এবং আমরা যাতে তাঁর সাক্ষাৎ পাই তার জন্য তিনি তাঁর সহযােগীকে বলে দেবেন। নিউইয়র্কে চিলির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কদিন পর আমার মােলাকাত হয়। সে বিষয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচনা করব।
রেহমানের বন্ধু শ্রীলঙ্কার লাল জয়বর্ধন আমাদের জন্য তার মন্ত্রীর সঙ্গে মােলাকাতের ব্যবস্থা করেন। লাল তখন ছিলেন শ্রীলঙ্কার পরিকল্পনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব। ১৯৭৩ সালে আমি বিশ্ব ব্যাংকের একান্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে শ্রীলঙ্কায় গেলে লাল আমার দেখাশােনা করেন এবং খুব খাতির করেন। হেলসিংকিতে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিশ্ব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র (ওয়াইডার) স্থাপিত হলে তিনি হন তার প্রথম নির্বাহী পরিচালক। একসময় তিনি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টাও হন। শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী তখন ছিলেন এন এম পেরেরা, একজন ট্রটস্কিপন্থী রাজনীতিবিদ। তিনি যৌবনে দেশ থেকে পালিয়ে কলকাতায় থাকেন এবং সেখানে এক বাঙালি মহিলার পাণি গ্রহণ করেন। আমাদের দলে ছিলাম ড. ইসলাম, রেহমান এবং আমি, তেমনি তাদের দলেও আরও কয়েকজন ছিলেন। শ্রীলঙ্কা তখন ছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বিমান চলাচলের যােগসূত্র।
জানুয়ারি মাসে ভারতীয় বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার পর ভারত পাকিস্তানের জন্য ভারতের আকাশসীমা ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। ভারতীয় বিমানটি ছিনতাই করে দুজন কাশ্মীরি মুজাহিদ এবং তারা সেটাকে লাহােরে নিয়ে যায়। যাত্রীদের ছেড়ে দিয়ে ছিনতাইকারীরা ভুট্টোর উসকানিতে বিমানটি পুড়িয়ে দেয় ও পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়। ভারতের নিষেধাজ্ঞার পর পাকিস্তান কলম্বাে হয়ে ঢাকায় বিমান যােগাযােগ চালু করে এবং এই পথেই সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র পরিবহন। করে চলে। পাকিস্তানকে প্রদত্ত এই সুযােগ বন্ধ করার জন্য শ্রীলঙ্কাকে বিভিন্ন উপায়ে অনেক আবেদন-নিবেদন করা হয়। এবার আমরা সরাসরি একজন। ক্ষমতাশালী ও প্রগতিশীল মন্ত্রীকে বলতে পারলাম। শ্রীলঙ্কা যে সামরিক উদ্যোগে পাকিস্তানকে সাহায্য করছে এবং এভাবে বাংলাদেশে গণহত্যায় ইন্ধন জোগাচ্ছে, এটাই ছিল আমাদের বক্তব্য। পেরেরা উত্তরে জানালেন যে তার ধারণা ছিল তাঁরা শুধু বেসামরিক বিমান পরিবহনে সাহায্য করছেন। তিনি দেশে ফিরে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন।
১৮১
আমি একদিন ভারতীয় অর্থমন্ত্রী যশােবন্ত চ্যানের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি জানতে চাইলেন, অন্যান্য প্রতিনিধিদল, বিশেষ করে পাকিস্তানের দাতাদেশগুলাে আমাদের কী বলেছে। তার কাছে শুনলাম, মার্কিন কর্তৃপক্ষ মুজিবনগরে বাংলাদেশের নেতৃত্বের সঙ্গে আলাপে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু শেখ সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করতে বা তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ নেতৃত্বের যােগাযােগ স্থাপনে তাদের কোনাে উৎসাহ নেই। শেরাটনে পিটার কারগিল এবং পাকিস্তান ডেস্কের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতাে। আমার ধারণা, একমাত্র মেলমথ ছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনাে ব্যাংক কর্মকর্তা পাকিস্তানের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন না। মেলমথ তখন কারগিলের দপ্তরে কাজ করেন, বােধ হয় সহকারী পরিচালক। ভােটা ও উইহেনকে পাকিস্তানের বন্ধু বলা যায় না, তাঁরা ছিলেন। বাস্তববাদী এবং বাংলাদেশের সেই অস্বাভাবিক অবস্থায় পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানের কোনাে যৌক্তিকতা তাঁরা খুঁজে পেতেন না।
২৮ সেপ্টেম্বর আমাদের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হলাে। হােটেলের সামনে গােটা পঞ্চাশেক বিক্ষোভকারী নানা পােস্টার হাতে নিয়ে সমাবেশ করলেন। বাঙালি কিছু যুবকের সঙ্গে যােগ দেন অনেক বাঙালি ও মার্কিন মহিলা। মহিলাদের কারও কারও কোলে বাচ্চা। আমি হােটেলে যাওয়ার পথে তাদের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলে যাই। এই র্যালির আয়ােজন করে বাংলাদেশ মিশন ও ইনফরমেশন সেন্টার। এ দুই দপ্তরের লােকজন অনেকেই বিক্ষোভে ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা প্রতিনিধিদের হাতে নানা প্রচারপত্র এবং আমাদের প্রতিবেদন গুঁজে দিচ্ছিলেন। আমি হােটেল লবিতে গেলে ব্যাংক ও ফান্ড কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমাকে ধরে বসলেন। তিনি বললেন, আমি একজন বিক্ষোভকারী। সুতরাং আমাকে সভাস্থলে থাকতে দেওয়া হবে না। উচ্ছেদ করার আগে তিনি স্বীকার করলেন, সভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনাে ব্যক্তি যদি আমাকে আহ্বান করেন বা কারও সঙ্গে আমার মােলাকাতের পূর্ব ব্যবস্থা থাকে, তাহলে অবশ্য তিনি আমাকে থাকতে বা প্রবেশ করতে দেবেন। দুর্ভাগ্যবশত কারগিলের টেলিফোনে তখন। কাউকে পেলাম না। তাই আমার উচ্ছেদ আটকানাে গেল না। রেহমান কিন্তু খুব বুদ্ধি করে আগেই আমার কাছ থেকে সরে গেলেন। আগেই তিনি লবিতে পৌছেছিলেন এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। আমার কাছে যেসব প্রচারপত্র ইত্যাদি ছিল, সেগুলাে রেহমান সযত্নে উদ্ধার করে সরে দাঁড়ান। এটা একটা কৌতুকপ্রদ অভিজ্ঞতা ছিল।
অপরাহে অতি সহজেই আমি সভাস্থলে ফিরে গেলাম। ১৯৭২ সালে ব্যাংক ও ফান্ডের বার্ষিক সভায় আমি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে ছিলাম এবং দলের তদারক আমিই করছিলাম। সে সময় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বেনেট আমাকে বলেন,
১৮২
আগের বছর তিনি তার কর্তব্য পালন করেছিলেন মাত্র, সেটা ব্যক্তিগত কোনাে ব্যাপার ছিল না। ১৯৬৯ সালের বার্ষিক সভায় বেনেটের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং পরবর্তী সময়ে (৭১-এর পর) সেটা আরও ঝালিয়ে নেওয়ার সুযােগ হয়।
যা হােক, সেবার কোনাে না কোনােভাবে আমরা অনেক প্রতিনিধিদলের কাছে আমাদের বক্তব্য পৌছাতে সক্ষম হই। একদিন পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্টেট ব্যাংকের গভর্নর শাকির দুররানি। তিনি যখন পিআইএর নির্বাহী পরিচালক ছিলেন, তখন তাকে চিনতাম। মির্জা মােজাফফর আহমদ তখন মন্ত্রীর সম্মানে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। কিন্তু তাঁকে কিছুদিন আগে একজন ছুরিকাঘাত করে, সে জন্য তিনি দলের নেতৃত্ব দিতে পারেননি। আজিজ আলী মােহাম্মদ বললেন, দলে আমার সহকর্মী সাইদুজ্জামানও আছেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন যে তাঁর সঙ্গে কি আমার কোনাে যােগাযােগ হয়নি? সত্যি সত্যি কিন্তু সাইদুজ্জামানের সঙ্গে আমার কোনাে যােগাযােগ হয়নি এবং আমিও কোনাে বিশেষ উদ্যোগ নিইনি।
সাইদুজ্জামান তখন পাকিস্তান সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক বিভাগে যুগ্ম সচিব। আমার খুব ইচ্ছা ছিল হাফিজুর রহমান মালিকের সঙ্গে কথা বলার কিন্তু তিনি ওই সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন না। সাইদুজ্জামানের সঙ্গে পরে মুহূর্তের জন্য একবার দেখা হয় এবং তিনি বলেন, সভা শেষে তিনি আমার সঙ্গে যােগাযােগ করবেন। সপ্তাহ শেষে তিনি ফিলাডেলফিয়া বা নিউজার্সি থেকে আমাকে টেলিফোন করেন। কুশলাদি বিনিময় ও বন্ধুবান্ধবের খবরাখবরের পর তিনি জিজ্ঞাসা করেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় কখন হতে পারে বলে মনে হয়? আপনাদের পরিকল্পনা কী রকমের? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়তাে ওই সময় কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার জবাব ছিল, হয়তাে আগামী শীতে যুদ্ধে আরও শক্তি নিয়ােজিত হবে। সাইদুজ্জামানকে আমাদের প্রতিবেদনের তথ্য সম্বন্ধে মন্তব্য করতে অনুরােধ করি। এসব তথ্য বিশ্ব ব্যাংক ও ইউএসএইডের সূত্র থেকে আমি সংগ্রহ করি। আমি ভাবলাম, সাইদুজ্জামান এর যথার্থতা সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করতে পারেন।
২ অক্টোবর সভা শেষে পাকিস্তান দাতাগােষ্ঠীর সভা বসল বিশ্ব ব্যাংকের দপ্তরে। পাকিস্তান দলের নেতৃত্ব দেন রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি । সবাই ভেবেছিলেন যে বড় বিক্ষোভ হবে, তাই সভায় যাওয়ার রাস্তা ছিল পেছন দিয়ে। আসলে কিন্তু বিক্ষোভের কোনাে পরিকল্পনাই সেদিন ছিল না। আমরা মােটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে পুরােনাে সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা হবে না। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম ও সুইডেন তাদের অস্বস্তির কথা প্রকাশ করল। পাকিস্তান ব্যাংক ও ফান্ড ছাড়া আর কোনাে দাতাকে ঋণ পরিশােধ করা থেকে বিরত ছিল। শুধু
১৮৩
আমেরিকা পাকিস্তানের কষ্ট লাঘবের জন্য উদগ্রীব ছিল এবং তাদের চাপে জাপান ও হল্যান্ডও চুপ থাকে। কনসাের্টিয়াম বৈঠকে পাকিস্তানের কোনাে লাভ হলাে না।
আমেরিকার উদ্যোগে স্থির হলাে যে প্রয়ােজনে কনসাের্টিয়াম ২৬ অক্টোবরের পর অধিবেশন ডাকতে পারবে। ভারতে শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে কনসাের্টিয়ামের সভা ছিল স্টকহােমে ২৬ অক্টোবর। বিশ্ব ব্যাংক সে সভায় এক প্রতিবেদনে জানায়, ৫ অক্টোবর পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৮৫ লাখ এবং এদের জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয়ের পরিমাণ হবে ৫৫০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শরণার্থীদের মােট সংখ্যা এক কোটি এবং এদের জন্য ২১৫ মিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক সাহায্য মিলে বাকি আর প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ভারত সরকার। পাকিস্তান কনসাের্টিয়াম সাহায্য পাবার জন্য আরেকটি উদ্যোগ নেয় । তাদের এবারের যুক্তি হলাে যে পূর্ব পাকিস্তানে পুনর্বাসনের জন্য সাহায্য দরকার । একটি পুনর্বাসন কার্যক্রমও তৈরি করা হয় সেপ্টেম্বরে।
আবার ব্যাংক মিশন গেল পাকিস্তানে। মেলমথ, পিচিওটো, দুগান ও হারমা। একই সঙ্গে ইউএসএইডেরও এক মিশন গেল পণ্য সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। মেলমথ ও পিচিওটোর সঙ্গে মধ্যাহ্নভােজের ব্যবস্থা করলাম, যাতে তাদের আমাদের কথা বলতে পারি। ইউএসএইডে উপপ্রশাসক মরিস উইলিয়ামস নিজে যাবেন, তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। মরিস আমাদের অনেকের সঙ্গেই নিয়মিত যােগাযােগ বজায় রাখেন। মরিস আমাদের দেশকে ভালাে চিনতেন । পাকিস্তানে এইডের উপপরিচালক ও পরিচালক ছিলেন অনেক দিন এবং তাঁর অনেক পাকিস্তানি ও বাঙালি বন্ধু ছিল। মরিস উইলিয়ামস বিশ্ব খাদ্য কাউন্সিলের (ডব্লিউএফসি) প্রথম নির্বাহী পরিচালক হন এবং পরে ওইসিডিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে অবসর নেন। পাকিস্তান থেকে মিশনগুলাে প্রত্যাবর্তন করে ২৬ অক্টোবরের আগে। তাদের অনুসন্ধান ও বিচারের পরিপ্রেক্ষিতেই বােধ হয় ভারত কনসাের্টিয়াম সভার পর পাকিস্তানের জন্য বৈঠক ডাকার কোনাে প্রয়ােজনীয়তা কেউ অনুভব করলেন না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কনসাের্টিয়াম সদস্যদের কাছে। কোনাে ঋণ রেয়াতি পেল না এবং কোনাে দাতাই নতুন কোনাে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করল না। অবশ্য পাইপলাইনের সাহায্য কেউ স্থগিতও করেনি। জাতিসংঘের মাধ্যমে কিছু ত্রাণ সাহায্য দেওয়া হয় এবং আমেরিকা সরাসরি খাদ্য ও ত্রাণ সাহায্য অব্যাহত রাখে, যদিও প্রকৃতপক্ষে তারাও অতি সামান্য পরিমাণ খাদ্যশস্য বা অন্য সাহায্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাতে মনস্থ করে। তখনাে কিন্তু জাতিসংঘে কোনাে মুক্তি আন্দোলনের প্রতিনিধিদের গ্রহণের রেওয়াজ প্রতিষ্ঠা পায়নি। পরবর্তীকালে
১৮৪
যেমনটি করা হয় ফিলিস্তিনের জন্য। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যে এই সম্মেলনে যেখানে সব দেশের প্রতিনিধিরা আসবেন, তাদের যদি কোনােমতে প্রভাবিত করা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতিসংঘ সনদের নানা ধারায়ই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত। বাংলাদেশে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অস্বীকৃত হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এবং সেখানে অত্যন্ত বড় আকারে গণহত্যা সংঘটিত হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্যা বিশ্ব শান্তিকে বিঘ্নিত করে। জাতিসংঘ এর যেকোনাে একটি বিষয় নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারত। কিন্তু শীতল যুদ্ধের পরিবেশে ও দুই শিবির বিভক্ত পৃথিবীতে তা হওয়ার উপায় ছিল না। তাই মহাসচিব চমৎকার সব প্রতিবেদন রচনা করলেও তাতে কোনাে ফল হয়নি।
১ আগস্ট মহাসচিব বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, এই দুঃখজনক পরিস্থিতিতে মানবিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এমনভাবে মিলেমিশে আছে যে এর একটা থেকে আরেকটাকে কোনােমতেই আলাদা করা যাবে না। সংকটটি সত্যিকার অর্থে জাতিসংঘের সামনে একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ এবং সামগ্রিকভাবে এর মােকাবিলা করা দরকার।’ জাতিসংঘের সমুদয় কর্মকাণ্ড ছিল একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধত্ৰাণকার্য। ভারতে শরণার্থীদের জন্য ত্রাণকার্য আর বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় ত্রাণকার্য। আর এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই বলেছিলেন যে নিক্সন সরকার পাকিস্তানকে নীতিবিগর্হিতভাবে যে সমর্থন দিচ্ছিল, তারই প্রায়শ্চিত্ত করতে চায় ত্রাণকাজে উদ্যোগী হয়ে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাধারণত বছরে একটি অধিবেশন বসে এবং এই অধিবেশন সেপ্টেম্বরের তৃতীয় মঙ্গলবারে শুরু হয়। পৃথিবীর এমন কোনাে বিষয় নেই যা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আলােচিত হয় না। ১৯৯৫ সালের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫৩টি বিষয় আলােচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাধারণ অধিবেশন ছাড়াও আছে বিশেষ অধিবেশন এবং জরুরি বিশেষ অধিবেশন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে জরুরি বিশেষ অধিবেশন হয়েছে মােট ৮টি। তার মধ্যে প্রথম অধিবেশনটি ছিল ১৯৫৬ সালে সুয়েজ সমস্যা নিয়ে আর সর্বশেষটি ছিল ১৯৮১ সালে নামিবিয়া সমস্যা নিয়ে। বিশেষ অধিবেশন হয়েছে মােট ১৫টি, এর তিনটি হয়েছে নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে (১৯৭৮, ১৯৮২ ও ১৯৮৬ সালে)। তিনটি হয়েছে নামিবিয়া সমস্যা নিয়ে (১৯৬৭, ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে)। দুটি হয়েছে ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে (১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে)। দুটি হয়েছে জাতিসংঘের অর্থায়ন, বিশেষ করে শান্তি উদ্যোগ বিষয়ে (১৯৬৩ ও ১৯৭৮ সালে)। উন্নয়ন বিষয়ে হয়েছে চারটি, যার সর্বশেষটি ছিল আফ্রিকার অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে (১৯৭৪, ১৯৭৫, ১৯৮০ ও ১৯৮৬ সালে)। অন্য অধিবেশনটি ছিল ১৯৬১ সালে তিউনিসিয়ার মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে ।
১৮৫
১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন শুরু হয় ১৪ সেপ্টেম্বর। প্রথমে শােনা গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন তকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ। কিন্তু এ সময় কানাঘুষায় জানা গেল যে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে একটা সমঝােতার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেলের দপ্তর এ বিষয়ে তৎপর। এ ব্যাপারে তাঁর উদ্যোগ ছিল ব্যক্তিগত এবং তাতে মুজিবনগর সরকারের কোনাে সম্মতি বা নির্দেশ ছিল না। মুজিবনগর সরকারের তরফ থেকে অনেক আগেই এ বিষয়ে পরিষ্কার বক্তব্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তি ছাড়া কোনাে সমঝােতার বিষয়ই মুজিবনগর সরকারের বিবেচনার মধ্যে ছিল না। বাংলাদেশ অবশেষে ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। এতে ছিলেন আটজন রাজনৈতিক নেতা। ন্যাপের (মােজাফফর) সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য আবদুস সামাদ আজাদ, সংসদ সদস্য ফণীভূষণ মজুমদার ও সংসদ সদস্য সিরাজুল হক। ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ডা. আসাবুল হক, ফকির শাহাবুদ্দিন আহমদ ও ড. মফিজ চৌধুরী। আরও ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, অধ্যাপক রেহমান সােবহান, রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ ও রাষ্ট্রদূত খুররম খান পন্নী। এ ছাড়া আমেরিকার বাংলাদেশ মিশন থেকে ছিলেন তিনজন সদস্য—মিশনপ্রধান সংসদ সদস্য মােস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ আনওয়ারুল করিম ও আমি। দলনেতার সুপারিশে তার সহকারী হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নিউইয়র্ক মিশনের আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে।
প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আখতারুজ্জামান বাবু তখন আমেরিকায় ছিলেন। তিনি বেশ কিছুদিন আগে বার্মা হয়ে ভারত গিয়ে সেখান থেকে বিলেতে পাড়ি জমান। ওয়াশিংটনে এসে তিনি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। জাতিসংঘ প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে এলে তিনি তাদের সঙ্গ দেন। তবে তাঁকে যথারীতি প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দিতে মুজিবনগর সরকার রাজি হয়নি। আমরা পরে জেনেছি যে প্রতিনিধিদল গঠনের বিষয়টি উচ্চতম রাজনৈতিক স্তরে নির্ধারিত হয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের কিছু বিতর্কমূলক উদ্যোগের কারণে দল গঠনে তাঁকে সবিশেষ ভূমিকা রাখতে দেওয়া হয়নি। প্রতিনিধিদলের নিয়ােগপত্র এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তান দল সম্বন্ধে খবর, ১৯৭০-৭১-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা এবং আরও কিছু সরকারি কাগজপত্র আমার ঠিকানায় এসে পৌছায় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে।
১৮৬
<p style="text-align: justify;"> ________________________________________
আমি জানতাম না যে এই দলের সচিব হিসেবে আমাকে মনােনীত করা। হয়েছে। আমি ওয়াশিংটনে কয়েক দিন (২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর) বিশ্ব ব্যাংক ও অর্থ তহবিলের বার্ষিক সভা নিয়ে ব্যস্ত থাকব এবং কয়েক দিন পর নিউইয়র্কে যাব বলে বিচারপতি চৌধুরীকে অবহিত করি। বিচারপতি চৌধুরী সম্ভবত ২৮ সেপ্টেম্বর এসে পৌছান, ওয়াশিংটন থেকে সিদ্দিকী সঙ্গে সঙ্গেই নিউইয়র্কে চলে যান। অন্য সদস্যরাও দু-এক দিনের মধ্যে এসে পড়েন। বিচারপতি চৌধুরী আমার অনুপস্থিতিতে দলের সচিবের দায়িত্ব ফকির শাহাবুদ্দিনকে নিতে বলেন। তিনি কোনাে রকম উচ্চবাচ্য করে দায়িত্বটি গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত যােগ্যতার সঙ্গে তা পালন করেন। আমি নিউইয়র্ক পৌছে তাঁকেই দায়িত্ব চালিয়ে যেতে অনুরােধ করি এবং বস্তুতপক্ষে মাঝপথে দায়িত্ব পরিবর্তনের সুযােগ বিশেষ ছিল না। শাহাবুদ্দিন আহমদ প্রতিদিন সযত্নে কে কার সঙ্গে দেখা করেছেন বা করবেন, কোন প্রতিনিধিদল কী বক্তব্য দিচ্ছে, কোথায় কোন সদস্যকে কী কাজে যেতে হবে—এসব বিষয় তদারক করতেন। বাংলাদেশ সম্বন্ধে সাধারণ পরিষদে কে কী বক্তব্য দিচ্ছে, তিনি তার খোজ রাখতেন এবং সব বিবৃতির একটি ধারাবাহিক সংগ্রহ তিনি প্রকাশ করতেন। ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া মােট ৪৭টি দেশের প্রতিনিধিদল সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ সম্বন্ধে মতামত প্রদান করে। শাহাবুদ্দিন যে সংকলন তৈরি করেন, তার একটি কপি আমার ব্যক্তিগত কাগজপত্রে এখনাে সংরক্ষিত আছে।
প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে পৌছার পর ১ অক্টোবর বিচারপতি চৌধুরী একটি সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন এবং বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন দাবি করেন। এই সম্মেলনের আয়ােজন করে জাতিসংঘ সাংবাদিক সমিতি। ওই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক জয়ন্ত কুমার ব্যানার্জি ছিলেন এই সমিতির সভাপতি এবং মাহমুদ আলীর সঙ্গে তার বেশ পরিচয় ছিল। প্রতিনিধিদলের কয়েকজন প্রতিনিধি খুব কম সময়ই আমেরিকায় ছিলেন। আবদুস সামাদ আজাদ ও অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ অচিরেই মুজিবনগরে প্রত্যাবর্তন করেন। দলের বাকি সদস্যরা শুধু নিউইয়র্কেই সময় কাটাননি, তারা ওয়াশিংটন সফরে আসেন এবং আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে ভ্রমণ করেন। প্রতিনিধিদলকে সাহায্য করেন নিউইয়র্ক লিগের কর্মীরা, বিশেষ করে ফারুকুল ইসলাম ও মাহবুব হােসেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নিউইয়র্ক লিগের তরফ থেকে মুজিবনগরেও গিয়েছিলেন। ফারুকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ভাই ছিল এবং মাহবুব সম্ভবত এখন ব্যবসায় লিপ্ত। এ ছাড়া জামশেদ রেজা খান ড. মল্লিকের সার্বক্ষণিক ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জামশেদ নিউইয়র্কে
১৮৭
লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী ছিলেন। ওয়াশিংটন থেকে রাজ্জাক খান ও ফজলুল বারীও প্রতিনিধিদলকে সাহায্য করতে যান। দলের সদস্যরা বিভিন্ন সমিতি বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রিত হয়ে নানা জায়গায় বক্তৃতা দিতে যান।
ড. মল্লিক, বিচারপতি চৌধুরী ও সৈয়দ আবদুস সুলতানের জন্য আমন্ত্রণ আসত সবচেয়ে বেশি। ড. মল্লিক বলা যায় আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। বিচারপতি চৌধুরীকে সব সময়ই নিউইয়র্কে থাকতে হতাে। তাই তিনি বাইরে যেতেন শুধু উইক-এন্ডের সুযােগ নিয়ে । জাতিসংঘসহ আমেরিকার সর্বত্র বাংলাদেশ সমস্যা ছিল দারুণ আগ্রহ ও উৎকণ্ঠার বিষয়। কিন্তু জাতিসংঘের লম্বা আলােচ্যসূচিতে বিষয়টি স্থান পেল না। না পাওয়ার পক্ষে যে যুক্তিটি দেওয়া হয় তা ছিল অসার এবং অন্যায়। বলা হয়েছিল বিষয়টি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ একটি সমস্যা। সুতরাং মানুষের যতই দুর্দশা হােক না কেন, শরণার্থীর লাইন যতই লম্বা হােক না কেন এবং হত্যাকাণ্ড যতই ভয়াবহ হােক না কেন, এ নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া চলবে না। শান্তি ও সমৃদ্ধির দিশারি জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল বাংলাদেশ সংকটে এমনই অথর্ব ও অকার্যকর।
আমরা থাকতাম দুটি হােটেলে—বেলমন্ট প্লাজা আর পিকউইক আর্মসে। বেলমন্ট প্লাজা পরে ডােরাল ইন হােটেল নামে পরিচিত হয়। আর পিকউইক আর্মস এখনাে আছে। বেলমন্ট প্লাজা আমাদের একটি বিশেষ হারে কামরা ভাড়া দিত, মনে হয় ১০ কি ১২ ডলার। আর পিকউইক আর্মসে আরও কমে থাকা যেত। খুব কাছেই একটি ভারতীয় রেস্তোরা ছিল আর সেখানে হ্রাসকৃত হারে আমরা খেতে পারতাম। রেস্তোরার মালিক মাঝেমধ্যে বাঙালিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় মাছ-ভাতের আয়ােজন করতেন। বিচারপতি চৌধুরীর জন্য একটি সুইট নেওয়া হয় এবং সেখানেই ছিল প্রতিনিধিদলের দপ্তর। বিভিন্ন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করতে পারদর্শী ছিলেন ড. মফিজ চৌধুরী। তিনি নাছােড়বান্দার মতাে টেলিফোনে লেগেই থাকতেন। রাষ্ট্রদূত পন্নী ও ফতেহ তাদের কূটনৈতিক পরিচিতির সুযােগ নিয়ে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে বিশেষ দক্ষতা দেখান। চিলির অর্থমন্ত্রীর বরাত দিয়ে একদিন রাষ্ট্রদূত পন্নীর সঙ্গে আমি গেলাম চিলির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করতে। আমরা ভেবিছিলাম, চিলির বিপ্লবী সরকার আমাদের পক্ষে বিশেষ বক্তব্য দেবে। পন্নী একসময় চিলিতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তার সেই সম্পর্কের কারণেও আমরা খুব আশাবাদী ছিলাম। আরেক দিন আমি ফণী মজুমদারের সঙ্গী হয়েছিলাম। সেদিন আমরা ব্রুকলিন কলেজে এক র্যালিতেও জ্বালাময়ী বক্তব্য দিই। আমাকে দুটো বক্তৃতা দিতে হয়—একটি ছিল ফণীবাবুর বক্তৃতার অনুবাদ এবং অন্যটি আমার নিজের ।
১৮৮
১২ অক্টোবর জেনারেল ইয়াহিয়া তার ক্ষমতা হস্তান্তরের নীলনকশা ঘােষণা করেন। ঘােষণাটি বস্তুত ছিল একজন উন্মাদের হুংকার। তিনি এতে ১২ কোটি পাকিস্তানিকে ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদের আহ্বান জানান। এবার তিনি গ্রিক রাজাদের মতাে সংবিধানবিশারদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি জানালেন। যে তিনি ২০ ডিসেম্বর একটি সংবিধান উপহার দেবেন এবং ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন নির্বাচন সম্পন্ন হবে। ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বসে তার সংবিধান অনুমােদন করবে এবং তখনই সেনাশাসনের অবসান ঘটবে। ব্রুকলিন কলেজের সমাবেশ ছিল ইয়াহিয়ার এই উসকানিমূলক ঘােষণা যেদিন প্রকাশিত হয় সেদিন, অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর। সে কারণেই বােধ হয় আমাদের বক্তব্য সেদিন হয় অত্যন্ত জ্বালাময়ী এবং তাতে গভীর ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে।
১৪ তারিখ রাতে আমরা খবর পেলাম, ঢাকায় মুক্তিযােদ্ধারা প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের দুরাচারী ছােট লাটবাহাদুর আবদুল মােনায়েম খানকে খুন করেছেন। খবরটি যখন পাওয়া গেল, তখন বেলমন্ট প্লাজায় সম্ভবত ড. মল্লিকের কামরায়। আমরা কজন সমবেত ছিলাম। রাষ্ট্রদূত পন্নী ও ফতেহ, ড. মফিজ চৌধুরী ও ফকির শাহাবুদ্দিন আর আমি ছাড়াও হয়তাে আরও কেউ ছিলেন। একটি মানুষ খুন হয়েছে, নিতান্তই নির্মমভাবে, কিন্তু যুদ্ধের কারণে এই হত্যা বিবেচিত হচ্ছে সাফল্যের নিদর্শন হিসেবে। একজন রাজাকারের, ঘরের শত্রু বিভীষণের জীবনাবসান হয়েছে, তাই সবাই উল্লসিত। আমরা ভাবলাম যে খবরটি বিচারপতি চৌধুরীকে দেওয়া দরকার। তাই আমাদের দু-একজন তাঁর কামরায় গিয়ে তাঁকে ডাকলাম। খবরটি কারও মনে কোনাে শােকের অনুভূতি জাগাল না। আমরা মনে করেছিলাম যে একজন গাদ্দারের এটাই ছিল উপযুক্ত পাওনা। বেশ খানিকটা পর আরও নানা বিষয়ে আলােচনা শেষে ড. মল্লিকই বােধ হয় মন্তব্য করেন যে যুদ্ধ মানুষের পাশবিক বৃত্তিকে এভাবেই জাগিয়ে তােলে। সমাজের উঁচু স্তরের একজন শত্রুপক্ষের সদস্যের হত্যার বিষয়টিকে কী সহজভাবেই না আমরা মেনে নিলাম।
১৬ তারিখ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ওয়াশিংটনে এলেন। এখানে তারা বাঙালি সমাজের সঙ্গে মিলিত হলেন। কংগ্রেসের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গেও মােলাকাত করলেন। তাঁরা লাফায়েত পার্কের সিউয়ার সিটি র্যালিতে গেলেন এবং প্রার্থনাসভায়ও অংশ নিলেন। ওয়াশিংটনেই সিনেটর পার্সির সঙ্গে আমাদের প্রতিনিধিদলের মােলাকাত হয়। বিচারপতি চৌধুরী সিনেটরকে শুধালেন শেখ মুজিব সম্বন্ধে তাঁদের খবরটি আসলে কী। ২৫ মার্চের পর এই সাত মাসে প্রথম এ ব্যাপারে আমি নিজের কানে একটা বিশ্বাসযােগ্য খবর শুনলাম। আগেই বলেছি, সিনেটর আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান সফরে যান।
১৮৯
এবং তিনি নিক্সনের বেশ কাছের লােক ছিলেন। নিক্সনের বরাত দিয়েই তিনি জোরের সঙ্গে বলেন যে শেখ মুজিব জীবিত আছেন এবং তার প্রাণহানি হবে না।
প্রতিনিধিদল একদিন আমার বাড়িতে সমবেত হলে ডা, আসাবুল হক পাকিস্তান দূতাবাসে হাফিজুর রহমান মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চান। তারা দুজনই চুয়াডাঙ্গার লােক এবং ছেলেবেলার বন্ধু । আমাদের বাড়ির কোণে ছিল একটি পিপলস ড্রাগ স্টোর, আমরা সেখানে গিয়ে একটি টেলিফোন বুথ থেকে তাঁকে টেলিফোন করলাম। অনেক কষ্টে ডা. হক অবশেষে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারলেন। আমরা যখন ঘরে ফিরলাম, তখন আমাদের অভিযানের বিষয় সম্পর্কে অবহিত হয়ে রাষ্ট্রদূত পন্নী এক কাণ্ড করে বসলেন। তিনি হাফিজুর রহমান। মালিককে খুব ভালাে জানতেন, তিনি আমার বাসা থেকেই তাকে টেলিফোন করে বসলেন। অন্য প্রান্তে যখন কেউ টেলিফোন ধরল, তখন তিনি বিশুদ্ধ উর্দুতে বললেন যে মালিক সাহেবের সঙ্গে কর্নেল হক নওয়াজ কথা বলতে চাচ্ছেন। অতি সহজেই তিনি মালিক সাহেবকে লাইনে পেলেন, তবে তাঁদের কথােপকথন খুব বেশি সময় স্থায়ী হয়নি। মালিক সাহেব ছিলেন খুব ভীতু প্রকৃতির লােক। আমার ছাত্রাবস্থা থেকে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ, কিন্তু ওয়াশিংটনে তিনি আমাকে সযত্নে এড়িয়ে চলতেন।
একদিন তাঁর ভাইপাে আমার বন্ধু ফজলে বারী মালিক সুইজারল্যান্ড থেকে আমাকে টেলিফোন করলেন। তিনি কোনােমতেই মালিক সাহেবের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারছেন না, আমি যদি কিছু করতে পারি। বিষয়টি ছিল গুরুতর। ফজলে বারীর আব্বা বিলেতে ইন্তেকাল করেছেন, তিনি তার মেয়ে লিপির সঙ্গে ট্রেনভ্রমণকালে মারা যান। তার ইচ্ছেমতাে তাঁকে লন্ডনে সমাহিত করা হবে। বড় ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ মালিক সাহেবকে পৌছাতে হবে। আমি মালিক সাহেবকে ফোন করলাম এবং তিনি তার স্বভাবসিদ্ধ রীতিতে আমার সঙ্গে আলাপ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। আমি শুধু জানালাম যে তার জন্য জরুরি খবর আছে, তাঁর ভাইপাে সুইজারল্যান্ড থেকে তাঁকে খুঁজছে। আমি পুরাে খবর না দিয়ে ভাবলাম যে কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যও হয়তাে তিনি যােগাযােগ করবেন। অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল। আমারই খারাপ লাগল । তাই আবার তাঁকে টেলিফোন করলাম। তিনি তখন থাকতেন ফেয়ারফ্যাক্স হােটেলে। হােটেলের টেলিফোন অপারেটর জানাল, দুই ঘণ্টা ধরে তিনি সুইজারল্যান্ড আর যুক্তরাজ্যে অনবরত টেলিফোন করে চলছেন, তার লাইন পাওয়া মুশকিল।
ফজলে বারী আমার সঙ্গে কথা বলেই লন্ডনের পথে রওনা হয়ে যান। লন্ডনে তখনাে লিপি পৌছাননি, তাঁরা ট্রেনে রয়েছেন। তাই মালিক সাহেব কারও সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারছিলেন না। মানুষের ভীতি যে কী পর্যায়ে যেতে পারে,
১৯০
মালিক সাহেবের কাণ্ডকারখানা না জানা থাকলে তা বােঝা মুশকিল। ওয়াশিংটনে তার সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঈদের জামাতে । সেদিনও তিনি পলায়নপর ছিলেন। আমার বন্ধু ফজলে বারির সূত্রে মালিক সাহেবের সঙ্গে আমার ছাত্রজীবনে পরিচয় ছিল । চাকরিতে যােগ দেওয়ার পর তার সঙ্গে যােগাযােগ অনেক বেড়ে যায়। তিনি সব সময়ই আমাকে নিকটাত্মীয় বিবেচনা করতেন। সহকর্মীদের সহায়তায় সব সময় এগিয়ে থাকতেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় ও তারপরও তিনি একেবারে আলাদা একজন ভীতু পাকিস্তানি হয়ে যান। আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি আর স্বাভাবিক জীবনে যেতে পারেননি। অবসর জীবনেও ছিলেন নিঃসঙ্গ। যা-ই হােক তার ছেলে টিটু সেদিন তার বাবাকে পালাতে দেয়নি, সে আমাকে তার কাছে। নিয়ে যায়। হাফিজুর রহমান মালিক পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে ছিলেন, ঢাকায় জেলা প্রশাসক এবং কৃষিসচিবও হন। শেষ জীবনে তিনি বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি করতেন। সম্ভবত গত শতাব্দীর নব্বইয়ের প্রথম ভাগে মারা যান। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল ও সাদাসিধে ভদ্রলােক ছিলেন তিনি।
সাধারণ অধিবেশনে ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতা সরদার শরণ সিং এবং পাকিস্তান দলের নেতা মাহমুদ আলী প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হন। আর দুই দেশের রাষ্ট্রদূত সমর সেন ও আগা শাহি এই বাগযুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। সরদার শরণ সিংয়ের ১৫ মিনিটের বক্তব্যে মাহমুদ আলী বাদ সাধেন প্রায় ১০ মিনিট। তারপরও আরও আধঘণ্টা তিনি শরণ সিংয়ের বক্তব্যের জবাব দেন। মাহমুদ আলীর বক্তব্যেরও পাল্টা জবাব দেন রাষ্ট্রদূত সেন। পাকিস্তানের কথা কিন্তু অতি সামান্যই ছিল। বিষয়টি আমাদের অভ্যন্তরীণ আর ভারত সেখানে খামােখা নাক গলাচ্ছে। কিছু শরণার্থী অবশ্য ওপারে গেছে কিন্তু তাদের সংখ্যাও ভারত অতিরঞ্জিত করে দেখাচ্ছে এবং তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনকে ব্যাহত করছে। বস্তুত তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই সে সময় ব্যাপারটিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে এবং কেবল শরণার্থীদের সাহায্যের কথা বলে। শুধু উরুগুয়ে, ক্যামেরুন আর রােমানিয়া মানবাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা ওঠায়।
উন্নত বিশ্বের দেশ অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ প্রশ্নে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলাের মতােই অবস্থান নেয়। অন্যান্য উন্নত দেশ এবং তৃতীয় বিশ্বের কতিপয় দেশ রাজনৈতিক সমঝােতার কথা জোরেশােরে বলে । মুসলমানপ্রধান দেশের মধ্যে শুধু ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র, আফগানিস্তান ও ইরাক ছিল বাংলাদেশের প্রতি সামান্য নমনীয়। অধিবেশনে ফ্রান্সের শুম্যান, কানাডার শার্প, নিউজিল্যান্ডের মলড়ন, ব্রিটেনের স্যার আলেক এবং জ্যামাইকার গ্যালিমাের গভীরভাবে তাদের ক্ষোভ
১৯১
ও আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। মিশেল শার্প প্রশ্ন তােলেন, ‘কখন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় অন্য দেশকে এত ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে যে তা আর কোনাে অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না? স্যার আলেক সরাসরি বলেন, চূড়ান্ত সমাধান হবে যখন পূর্ব পাকিস্তানে এমন বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা হবে, যার প্রতি লােকের আস্থা থাকবে এবং সবাই শান্তিতে দেশ গড়ার কাজে মনােনিবেশ করতে পারবে।’
শীতল যুদ্ধে নিমগ্ন পৃথিবীতে কিন্তু পাকিস্তানি বর্বরতাকে সবাই মেনে নিল আর শরণার্থীদের সাহায্যের কথা বলেই যেন পার পেয়ে গেল । আমার ব্যক্তিগত দুঃখ হলাে যে চিলির বিপ্লবী সরকারের প্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে কোনাে মন্তব্য করলেন না। তাঁদের কথা হলাে যে তাদের প্রেসিডেন্ট আলেন্দে এক সমাজতান্ত্রিক দেশের সম্মেলনে বক্তৃতা করতে গিয়ে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছেন এবং এ ব্যাপারে তাদের সহমর্মিতা জানিয়েছেন। সুতরাং এ ব্যাপারে তাদের আর বেশি কিছু করণীয় নেই। আমরা জাতিসংঘ দপ্তর ও সম্মেলন এলাকায় বিচরণ করতাম সাংবাদিক সমিতি ও ভারতীয় মিশনের খাতিরে। পাকিস্তানিরা ভাবল যে এস এ করিম এ ব্যাপারে তাঁর পাকিস্তানি কূটনৈতিক পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন এবং তাই তাকে তারা অবাঞ্ছিত ঘােষণা করল। তাদের আশা ছিল যে এতে করিমকে জাতিসংঘ ভবন থেকে উচ্ছেদ করা যাবে । করিমকে সাহায্য করার যে অন্য রাস্তা আছে, তা দেখে তারা খুবই মনঃক্ষুন্ন হলাে। অধিবেশনে যেসব প্রতিনিধিদল তাদের বক্তৃতায় বাংলাদেশ সংকটের উল্লেখ করে, তাদের সংখ্যা ছিল ৪৭। (পরিশিষ্ট ৩-এ তাদের ও দেশের নাম দেওয়া হলাে)।
অক্টোবরে ডেনভার থেকে জানতে পারলাম যে সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেন সেখানে পৌঁছেছেন। বিশ্ব সাংবিধানিক কনভেনশনের আন্তর্জাতিক কমিটি তাঁর আশ্রয়। বস্তুত স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে তিনি দেশ থেকে পালিয়েছেন। সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেন তখন হাইকোর্টের অ্যাডভােকেট। ছাত্র বয়স থেকে আমি তাকে চিনি। তিনি খুব ভালাে নাট্যশিল্পী ছিলেন এবং সুন্দর বক্তৃতা দিতেন। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির প্রবক্তা। ১৯৬০ সালে আমি পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হই। প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি হলেও সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করত। তদানীন্তন প্রাদেশিক মুখ্য সচিব মােহাম্মদ আজফর ছিলেন পদাধিকারবলে এই সংগঠনের সভাপতি। সংস্কৃতি অঙ্গনে আমার আগ্রহ দেখে তিনি আমাকে এই প্রতিষ্ঠানটিকে সক্রিয় করার ভার দেন। আর্টস কাউন্সিলটিকে দাঁড় করাতে গিয়ে যাদের সহায়তা পাই, তাদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন সৈয়দ সাহেব। আর্টস কাউন্সিলের জন্য পরবর্তী মুখ্য সচিব
১৯২
সৈয়দ হাশেম রাজার (তিনি নিজে ছিলেন কবি ও সংস্কৃতিসেবী) আনুকূল্যে আমি নয় বিঘা সরকারি জমি ইজারা নিতে সক্ষম হই। এই জমির ওপরই বর্তমান শিল্পকলা একাডেমি অবস্থিত।
তখন এই জমি ছিল জলাভূমি। বিখ্যাত ক্রিকেটার প্রয়াত আবদুল হাফিজ কারদার তখন পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগে সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ে সমুদয় অনুদানের দায়িত্বে ছিলেন। আমরা যখন ছাত্র, সে সময় কারদার সলিমুল্লাহ হলে আমার আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে আসেন। তখন থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয় এবং সিভিল সার্ভিসে যােগদানের পর সেই পরিচয় আরও দৃঢ় হয়। কারদার এই জলাভূমির উন্নয়নের জন্য দুই কিস্তিতে আট লাখ টাকা বরাদ্ধ করেন। হাশেম রাজার হুকুমে তদানীন্তন ডিআইটির (এখনকার রাজউক) চেয়ারম্যান প্রয়াত আবুল এহসান এই জমি উন্নয়নের ভার নেন। একই সঙ্গে বাস্তুকলাবিদ থারিয়ানি বিনা মজুরিতে আর্টস কমপ্লেক্সের নকশা প্রণয়ন করেন। সেই নকশা অনুযায়ী আর্ট গ্যালারি ও প্রশাসনিক ভবনের দালান বানানাে হয়। নকশায় উল্লেখিত একটি হ্রদ, দুটো নাট্যমঞ্চ, একটি উন্মুক্ত মঞ্চ ও একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স বাস্তবে স্থাপিত হয়নি। তবে বর্তমানে এই এলাকাটির প্রাণচাঞ্চল্য খুবই ভালাে লাগে।
সরকার-নিয়ন্ত্রিত আর্টস কাউন্সিলকে সক্রিয় করার উদ্দেশ্যে একটি নির্বাচিত কার্যকরী কমিটির প্রয়ােজন রয়েছে বলে আমার মনে হয়। এই কমিটি গঠনে যারা এগিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ সাহেব। তাঁর হাতেই সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে আমি বিদেশে পাড়ি দিই। সৈয়দ সাহেব খুব স্পষ্টবাদী লােক ছিলেন এবং নিজস্ব মতামত সাহসিকতার সঙ্গে পােষণ করতেন। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তার যে প্রচণ্ড দুর্ভোগ হবে, তা অনুধাবন করতে আমার মােটেই অসুবিধা হলাে না। আমার মনে হলাে, তার দেশ থেকে পলায়নের খবরটি যথাস্থানে পৌছে দেওয়া দরকার। তাই প্রথমেই বিচারপতি চৌধুরীকে বিষয়টি জানালাম, পরে আবু রুশদকেও জানালাম।
সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেন পরে বাংলাদেশে বিচারপতির আসন অলংকৃত করেন এবং তাঁর স্বাধীন চিন্তাধারা অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঢাকায়। প্রথম যে অনুষ্ঠানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানাে হয়, সেখানে মূল বক্তা হিসেবে বিচারপতি হােসেন এক মনােগ্রাহী বক্তব্য দেন। এই বক্তব্য শােনার সুযােগ আমার হয় এবং এতে একদিকে আমার মধ্যে যেমন উছলে ওঠে নিহত জাতির পিতার জন্য গভীর শােক ও হতাশা, তেমনি অন্যদিকে জেগে ওঠে প্রচণ্ড ক্ষোভ। এবং জাতির পিতাকে তার যথােপযুক্ত আসনে সমাসীন করার বলিষ্ঠ সংকল্প । বিচারপতির সাহস ও নীতিবােধ তাঁকে সামরিক স্বৈরশাসনের শিকারে পরিণত করে। জীবনের মধ্যাহ্নে বিচারপতি হােসেনের অকালমৃত্যু ছিল খুবই দুঃখের।
১৯৩
সৈয়দ সাহেব ৩০ সেপ্টেম্বর হনলুলুতে পৌছান এবং তার ভিসার মেয়াদ ছিল ৩০ মার্চ (১৯৭২) পর্যন্ত । তিনি এ নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন এবং আমাকে এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতে বলেন। সৌভাগ্যবশত একাত্তরে দেশ স্বাধীন। হওয়ায় এ ব্যাপারে তাকে আর অসুবিধায় পড়তে হয়নি। কিন্তু এ-ও অনস্বীকার্য। যে পরিবার-পরিজন নিয়ে সহসা বিদেশে তিনি অথই জলে পড়েন এবং অনেক বিপত্তির সম্মুখীন হন।
মানুষের সমস্যার অন্ত নেই। ওহাইওর সিনসিনাটি থেকে জামাল খান জুন মাসে ওয়াশিংটনে আসেন কংগ্রেসে লবিং করতে। অক্টোবরে তার এক চিঠি পেলাম। তিনি জানালেন যে জুন মাসে তিনি আমার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলেন। যাঁরা ওয়াশিংটনে লবিং করতে আসতেন, তাঁদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে থাকতেন কিন্তু সবাইকে যে ভালাে করে চিনব, তার কোনাে উপায় ছিল না। জামাল খানের সমস্যা ছিল তাঁর বিয়ে নিয়ে। বাংলাদেশের একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে। তার জন্য পাসপাের্ট ও ভিসা জোগাড়। করতে হবে এবং তাঁকে আমেরিকায় নিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ মিশন। হিসেবে তাকে সাহায্য করার সুযােগ আমাদের ছিল না। বাংলাদেশ থেকে বেরােতে গেলে পাকিস্তানের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া তাঁর কোনাে উপায় ছিল না। তবে ভারতে শরণার্থী হলে আমরা হয়তাে বিশেষ ব্যবস্থায় তার ভ্রমণের সুযােগ করে দিতে পারতাম । জামাল খানের বিয়ে কেমন করে হয় অথবা আদৌ হয় কি না, সে খবর তখন নিতে পারিনি। এখন তার চিঠিপত্র পড়ে খুব খারাপ লাগছে, তাঁকে খালি চিঠি লিখেই আমরা কর্তব্য সমাধা করি, কিন্তু তার প্রয়ােজন ছিল আরও বেশি—কিছু ভরসা, কিছু সহমর্মিতা।।
আরেকটি চিঠি পেলাম মুজিবনগর থেকে, চিঠিটি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হােসেন তৌফিক ইমামের। ব্যক্তিগত চিঠি, তবে বিষয়াবলি সবই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে । মুজিবনগরে সরকারি কর্মকাণ্ডে সমন্বয়ের অভাব এবং বিশেষ করে পররাষ্ট্র দপ্তরের একলা চলাে নীতি সম্বন্ধে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তৌফিক ইমাম। বিদেশে অবস্থানকারী গণ্যমান্য বাঙালিদের মুজিবনগর সরকারকে সাহায্য করার ব্যাপারে গড়িমসি তাকে খুব পীড়িত করছে বলে জানলাম। ভালাে পরিকল্পনাবিদ, ভালাে প্রশাসক, ভালাে ম্যানেজারের তাঁদের প্রয়ােজন কিন্তু তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। এই অভিযােগ পররাষ্ট্রসচিব মাহবুব আলমও অনেকবার করেছেন। মুজিবনগর সরকারের অপরিকল্পিত বিস্তারও তৌফিক ইমামকে বিচলিত করছে। তবে একটি বিষয় বুঝতে পারলাম যে আমরা যেসব খবরাখবর সরবরাহ করি, তা মন্ত্রিসভায় পৌছায় না। পরবর্তী সময়ে তাই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনেক চিঠিপত্র ও তারবার্তা প্রেরিত হতে থাকে।
১৯৪
তৌফিকের চিঠিতে আরেকটি বিষয় প্রতিভাত হলাে যে আমরা যে অনবরত সাংবাদিক ও অন্য পর্যটকদের খাতির করতে বলি, তাতেও তাদের অনেক অসুবিধা হয়। আমি নিজে রিচার্ড লেভিন আর আনা টেইলরের বিষয়ে লিখেছিলাম। তাঁদের জন্য ভারত সরকারের ছাড়পত্র জোগাড় এবং নানা সাক্ষাৎকার ও ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে গিয়ে তাদের বেশ হিমশিম খেতে হয় । কিছুদিন পর তৌফিকের আরেকটি চিঠি এল একটি বড় ফরমায়েশ নিয়ে—স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসনের কাঠামাে কেমন হবে, সে বিষয়ে মন্ত্রিসভার জন্য একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের নানা উদ্যোগের সঙ্গে প্রথমে প্রাদেশিক সরকারে এবং পরে কেন্দ্রীয় সরকারে আমি যুক্ত ছিলাম বলে আমার ওপর এই হুকুম (আমি আমার প্রতিবেদন ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের মহাসচিব প্রয়াত রুহুল কুদুসের কাছে প্রেরণ করি)। রিচার্ড লেভিন। এখন বাংলাদেশে বেশ পরিচিত ব্যক্তি। তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ মুক্তির গান ছবিটি বানিয়ে লেভিনকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন। লেভিনের জন্য অনুরােধপত্রটি যে আমারই লেখা, তা এই স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করি। তৌফিক ইমামের চিঠিতে পাই লেভিনের নানা ঝামেলার অভিজ্ঞতা এবং তখনই স্মৃতির মণিকোঠা থেকে ঘটনাটি বেরিয়ে আসে।
আগস্ট মাসে ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং করপােরেশনে আমার কমেন্টস’ প্রােগ্রাম তাদের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযােগ করে দেয়। সেই সুবাদে পামেলা হিল আবার আমাকে খানিকটা কাজ করতে অনুরােধ করেন। এবার কাজ করতে হবে রবার্ট (সংক্ষেপে বব) রজার্সের সঙ্গে। বব ভারত ও বাংলাদেশে দুই মাস কাটিয়ে ওয়াশিংটনে ফিরেছেন। তিনি বাংলাদেশের ওপর একটি দুই ঘণ্টার প্রােগ্রাম বানাচ্ছেন। অনেক শব্দ আর ছবি ধরে নিয়ে এসেছেন। শরণার্থীকেন্দ্রের কাহিনি নিয়ে এসেছেন। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা ছবি ও কথায় ধরে নিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভিডিও তুলেছেন। ধ্বংসলীলার ছবি ও কাহিনি নিয়ে এসেছেন। তাঁকে এই প্রােগ্রাম সম্পাদনায় সাহায্য করতে হবে, বিশেষ করে বাংলা কথার অনুবাদ করে। অক্টোবরের শেষ দিকে কয়েক দিন আমাকে এই ব্যাপারে স্টুডিওতে কাটাতে হলাে।
২৬ নভেম্বর রাতে দুই ঘণ্টার প্রােগ্রাম ক্রনােলগ পরিবেশিত হবে। বব রজার্স বললেন, ‘মার্চ মাসে যার শুরু হয় একটি রাজনৈতিক সংকট হিসেবে, তা রূপান্তরিত হয়েছে একটি বিরাট ট্র্যাজেডিতে। পূর্ব পাকিস্তান। ঐতিহাসিকভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেশ। সেখানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা দুর্ভিক্ষ হয়। কিন্তু এবারের বিপর্যয় একান্তই মনুষ্যসৃষ্ট এবং এ বিপর্যয় মৃত্যু, ধ্বংস ও মানুষের দুঃখকষ্টের হিসাবে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ছাড়িয়ে যাবে।
১৯৫
উপসংহারে তিনি বলেন, ১০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক সংকটের সহিংস দিকের খবর ও কাহিনি নিয়ে আমার কারবার এবং ভয়াবহতা আমার চারণভূমি। কিন্তু এ রকম জঘন্য বর্বরতা ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখােমুখি এর আগে কখনাে হইনি। আর সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলাে যে বিশ্ববিবেক চুপ করে বসে আছে এবং এই বিপর্যয়কে ঘটতে দিচ্ছে। এই প্রােগ্রামের পরিবেশক ছিলেন সাংবাদিক গ্যারিক আটলি এবং প্রযােজক ছিলেন ইলিয়ট ফ্র্যাঙ্কেল । ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমাকে বাংলা কথােপকথন শুনতে হয় এবং ছবির সঙ্গে তার মিল করতে হয়। এই কাজ করতে গিয়ে মওদুদ আহমদের গলা শুনলাম; মওদুদ বব রজার্সকে ভিডিও গ্রহণ এবং মানুষের সঙ্গে যােগাযােগ করতে সাহায্য করেন। তার একটি কাজ ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের বন্ধু ও পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করা। নভেম্বরের ৮ তারিখে সম্পাদনার কাজ শেষ হলাে। কিন্তু প্রােগ্রামটি পরিবেশনার আগেই উপমহাদেশীয় যুদ্ধের দুন্দুভি বেজে ওঠে।
২২ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনী আত্মরক্ষামূলক অনুপ্রবেশের সূচনা করে, যদিও কোনাে ভূখণ্ড দখলে তাদের আগ্রহ ছিল না। মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা তাদের দখলে আসতে শুরু করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে থাকে। তাদের হিসাব ছিল যে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে বৃহৎ শক্তির চাপে যুদ্ধবিরতি ঘটলে মুক্তিবাহিনীর দখল আর থাকবে না এবং বাংলাদেশে তাদের দখল জাতিসংঘের আশীর্বাদে জায়েজ হবে। বব রজার্সের প্রােগ্রাম অনেক কল্পকথার অবসান ঘটায়। চার দিন ধরে তাঁর দল বাংলাদেশের গেরিলাদের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ায়। পাকিস্তানি বীর সেনাবাহিনীর শত প্রচেষ্টায়ও তাদের দখল ব্যাহত হয়নি। আরেক দৃশ্যে পাকিস্তানি বর্বরদের সঙ্গে তাঁর দল ঘুরে বেড়ায় এবং সর্বত্র দেখা যায় ধ্বংসলীলা আর বর্বরতা। জীবন বাজি রেখে শরণার্থীদের পাকিস্তান থেকে পলায়নের দৃশ্য এ বিষয়ে পাকিস্তানি প্রচারকে ভোতা করে দেয়। কথার চেয়ে ছবি অনেক বেশি শক্তিশালী ও অর্থবােধক। ক্রনােলগ প্রােগ্রাম (২৬ নভেম্বর) পাকিস্তানি মিথ্যাচারের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে ।
১৯৬
<p style="text-align: justify;"> নবম অধ্যায়
বিজয়ের আনন্দ
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী যতই সংহত ও সংগঠিত হতে থাকল, ততই পাকিস্তানভারত যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়তে থাকল। গেরিলাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা তখন তটস্থ। তাদের বর্বরতা ও অত্যাচারও বাড়তে থাকল। ফলে শরণার্থীর লাইন আর শেষ হয় না। পাশবিক অত্যাচার আর গণহত্যার কোনাে বিরাম নেই। এই অবস্থায় ভারতে অনেকেই সরাসরি যুদ্ধের কথা ভাবতে থাকেন। ভারতরাশিয়া বন্ধুত্ব চুক্তির ফলে চীনা আক্রমণের আশঙ্কা দূরীভূত হয়। চীনের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও বিদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের অনুকূলে ছিল না। ভারতের জন্য দীর্ঘদিন শরণার্থীদের দেখাশােনা একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে বাঙালির পশুপ্রবৃত্তির বিকাশ এবং যুবসমাজের র্যাডিক্যাল নীতির অনুসারীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে অতি দ্রুত একটি রাজনৈতিক সমাধানে না পৌছালে তাতে ভারতেরই জন্য ছিল সমূহ বিপদ। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ সময় খুব ভালােভাবেই বােঝেন যে তাঁর হাতে সময় খুব কম। অক্টোবরের শেষ দিকে তিনি তিন সপ্তাহের ঝটিকা সফরে বিশ্ব পরিভ্রমণ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক উদ্যোগের পরিসর ও যথার্থতা যাচাই করা। তিনি সফরে গেলেন বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানিতে। এর আগে তিনি রাশিয়া ঘুরে আসেন সেপ্টেম্বরের শেষে।
ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটনে এসে পৌছান ৩ নভেম্বর। ২৯ অক্টোবর বৈদেশিক সাহায্য বিল সিনেটে প্রত্যাহৃত হলে বস্তুত একটি সংকটের সৃষ্টি হয়। সেই সংকটকালে এসে পৌছালেন শ্রীমতী গান্ধী। তিনি আসার আগে থেকেই খবরের কাগজে দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা নিয়ে লেখালেখি চলছিল। কতগুলাে প্রধান সংবাদপত্রে এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কলাম সম্পাদকীয়ও লেখা হয়। খবরে আরেকটি বিষয় যা প্রাধান্য পায়, তা হলাে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য এবং সীমান্ত
১৯৭
এলাকায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মাঝেমধ্যে সংঘাত। যেদিন প্রধানমন্ত্রী এসে পৌছালেন, সেদিনই খবরে বেরােল বাংলাদেশ নৌ-কমান্ডাের সাফল্যের কাহিনি, তারা একটি তেলবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে। পরপর দুদিন নিক্সন-গান্ধী বৈঠক হলাে। সে বৈঠকের দুটো বিবরণ আছে। কিসিঞ্জার বলেন যে তা খুব উষ্ণ ছিল কিন্তু হাসারের মতে, আলােচনা ছিল দুই বধিরের মধ্যে। নিক্সন শ্রীমতী গান্ধীর কোনাে আহ্বানেই সাড়া দিতে প্রস্তুত ছিলেন না এবং বৈঠকে কিসিঞ্জার তাঁদের নানা উদ্যোগের কথাই বলে যান। শ্রীমতী গান্ধী চাচ্ছিলেন যে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমঝােতা করতে প্রভাবিত করুক। রাজনৈতিক সমঝােতা ছাড়া এই সংকট সমাধানের কোনাে উপায় নেই। আর বিষয়টি ঠিক পাকিস্তানের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। পাকিস্তানের অপরিণামদর্শিতার জন্য ভারত শরণার্থীদের দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়েছে। নিক্সনকিসিঞ্জার কিন্তু পাকিস্তানের ওপর সে ধরনের চাপ প্রয়ােগ করতে আগ্রহী ছিলেন না। তাদের আনুকূল্যে কলকাতায় যে আলােচনা হচ্ছিল, তা ছিল অর্থহীন, অত্যন্ত নিম্নস্তরের এবং তার উদ্দেশ্য ছিল মুজিবনগর সরকারের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা।
৭ নভেম্বরের ওয়াশিংটন পােস্টএ দিল্লি থেকে জিম হােগল্যান্ড যে সংবাদ সরবরাহ করেন, তাতে মার্কিন উদ্যোগে আলােচনা সম্পর্কে এ রকমই ধারণা দেওয়া হয়। এই সংবাদ বিবরণীতে বলা হয় যে এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তান মার্কিন উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করছে। শ্রীমতী গান্ধী সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের গুরুত্ব বােঝানাের পরও মার্কিন প্রচেষ্টা ঢিমেতেতালা গতিতেই চলে। নভেম্বরের ১৫ তারিখে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব এস এম সুলতান খান এলেন ওয়াশিংটনে। কিসিঞ্জার তার কাছে প্রস্তাব দিলেন যে শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপ করা দরকার। পাকিস্তানের জবাব ছিল যে তার জন্য উপযুক্ত সময় হবে ডিসেম্বরের শেষে যখন দেশে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। শ্ৰীমতী গান্ধী যখন ওয়াশিংটনে, জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন চীনে। চীন যেখানে তর্জন-গর্জন এবং পাকিস্তানকে সার্বিক সহায়তার অঙ্গীকার করছে, ওয়াশিংটন সেখানে নিশ্ৰুপ এবং এক রকম নিষ্ক্রিয়। ৪ নভেম্বর নিক্সনের অভ্যর্থনার জবাবে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি আমাদের অঞ্চলের পরিস্থিতি সম্বন্ধে আপনাদের গভীর অনুভূতি ও সিদ্ধান্ত বুঝতে । আমি খুঁজতে এসেছি সেই রকম বুদ্ধিদীপ্ত প্রণােদনা, সামান্য একটি আবেগ, যা মানবজাতিকে কখনাে কখনাে হতাশার চোরাবালি থেকে উদ্ধার করে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।’
৫ তারিখ নিক্সন ও গান্ধীর মধ্যে দ্বিতীয় দফা আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলােচনা শেষে বাংলাদেশ মিশনের আমরা সবাই প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর সঙ্গে ব্লেয়ার হাউসে দেখা করতে যাই। আমাদের সঙ্গে সেদিন এনায়েত করিমও ছিলেন।
১৯৮
দ্বিতীয়বার হৃদরােগে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি ১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ মিশনে আসতে শুরু করেন। আমি সেদিনই প্রথম ইন্দিরা গান্ধীকে সামনাসামনি দেখি। তাঁর পরিধানে অত্যন্ত শালীনভাবে পরা একটা শাড়ি। ঢুকেই তিনি আমাদের সবাইকে সালাম জানান। তিনি কথাবার্তা বলেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কিন্তু একটি লজ্জাবনত ভাব কখনাে তাকে ছেড়ে যায় না। মাঝেমধ্যে তিনি আঙুলের নখ খুঁটছিলেন এবং মুখ নিচু করে কথা বলছিলেন। তাকে মনে হলাে খুবই চিন্তিত। আমার মনে হলাে যে নিক্সনের সঙ্গে তাঁর আলােচনা মােটেই ফলপ্রসূ হয়নি বলে তিনি খানিকটা অন্যমনস্ক এবং খুবই বিমর্ষ হয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ এই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মহিলাকে কেন যে ‘ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী’ নামটি দিয়েছিলেন, তার যথার্থতা টের পেতে কোনাে বেগ পেতে হলাে না। তাঁর নানা বক্তব্যের দুটি কথা আজও আমার কানে বাজে। একসময় প্রায় স্বগতােক্তির মতােই বললেন যে শেখ সাহেব যদি আগে এ ব্যাপারে আমাদের সাবধান করে দিতেন। সমস্যার জটিলতা তাঁকে খুবই বিচলিত করেছে বলে মনে হলাে। আরেকটি কথা বললেন যে সামরিক শাসকদের সঙ্গে কথা বলাই দুরূহ, তাদের কায়দার সঙ্গে রাজনীতিবিদেরা অপরিচিত। তিনি আরও যােগ করলেন যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে শত্রুতা থাকলেও সংলাপ চালানাে যায়। তিনি এই বলে খেদোক্তি করলেন যে ভুট্টো যদি ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলেও হয়তাে আলােচনার সুযােগ হতাে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর উচ্চাশা, হামবড়া ভাব, শঠতা, মিথ্যাচার এবং শয়তানির বিষয়ে জানতেন না বলেই শ্রীমতী গান্ধী এমন মন্তব্য করতে পারলেন বলে আমার মনে হয় ।
আমাদের সঙ্গে মােলাকাতের পরই শ্ৰীমতী গান্ধী গেলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। তার বক্তৃতায় তিনি শুধু কয়েকটি কথাই বললেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে। ভারত অযাচিতভাবে এক নতুন ধরনের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে—আরেক দেশের নির্যাতিত নাগরিকেরা দলে দলে ভারতে শরণার্থী হচ্ছে এবং এ পরিণতি হয়েছে গণতন্ত্রকে নিষ্পেষণের কারণে। এ সমস্যার সমাধান ভারতের হাতে নেই। এর সমাধানে প্রধান ভূমিকা হবে বাংলাদেশের মানুষের। তাদের বাদ দিয়ে কোনাে স্থায়ী সমাধান মিলবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার রয়েছে শুধু শেখ মুজিব আর বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। দক্ষিণ এশিয়ায় যে অবস্থা বিরাজ করছে, সে সম্বন্ধে তাঁর বিশ্লেষণ ও ধারণা তিনি সবার কাছে তুলে ধরেছেন। এখন তাদের সবার কর্তব্য হচ্ছে এই সংকটের সমাধান করা। অনেকক্ষণ ধরে চলে প্রশ্নোত্তরের পালা। ক্ষমতার মদে মত্ত এবং সম্ভবত নেশায় বেহুঁশ জেনারেল ইয়াহিয়া কয়েক দিন আগে একটি উক্তি করেছিলেন যে মেয়েলােকের সঙ্গে তিনি
১৯৯
কী আলাপ করবেন। প্রশ্নোত্তরের একপর্যায়ে তাঁর এই উক্তির ওপর শ্রীমতী গান্ধী। কঠোর অথচ কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সংলাপে তাঁর কোনাে আপত্তি নেই। তবে দুই দিক থেকে আগ্রহ না থাকলে। আলােচনা হতে পারে না, হাত মুষ্টিবদ্ধ থাকলে হাত মেলানাে যায় না। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যে ধরনের মন্তব্য করছেন, তাতে মনে হয় না যে তার। সঙ্গে বন্ধুসুলভ আলােচনার কোনাে সুযােগ আছে। প্রধানমন্ত্রী গান্ধী তারপর নিউইয়র্কে যান এবং সেখানে অনেক বক্তব্য দেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের। বক্তৃতায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংকট হচ্ছে সুসভ্য এবং সমুন্নত মূল্যবােধের ওপর মারাত্মক আক্রমণ। আজ একটি ব্যক্তির মান রক্ষার জন্য কোনাে কোনাে দেশ সারা উপমহাদেশের শান্তিকে হুমকি দিচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে এতে পাকিস্তানকে রক্ষা করা যাবে বা তাকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যাবে। একজন। অনির্বাচিত ব্যক্তি, যে সামরিক স্বৈরশাসক, তাকে সমর্থন করে পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাখা যাবে না।’
শ্রীমতী গান্ধী আমেরিকা ত্যাগ করার পরপরই অবশেষে পাকিস্তানে মার্কিন যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হলাে। কংগ্রেস এ ব্যাপারে হােয়াইট হাউসকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ৮ নভেম্বর সরবরাহ বন্ধ হলাে, তার কদিন পর উপমহাদেশে যুদ্ধ বাধলে কিসিঞ্জারের মাথাব্যথা হলাে কীভাবে তৃতীয় দলের মাধ্যমে পাকিস্তানকে যুদ্ধাস্ত্র পাঠানাে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরে ১৫ নভেম্বর লােকসভায়। এক বক্তৃতায় তাঁর বিশ্বভ্রমণের একটি বিবরণ দেন। এককথায় তিনি বললেন যে বিশ্বনেতাদের তিনি সংকটের আশু রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অনুরােধ করেছেন। বাংলার মানুষের দুর্দশা এবং ভারতের ওপর শরণার্থীদের চাপের অসহ্য অবস্থা তুলে ধরেছেন। তাঁরা সবাই সহানুভূতিশীল এবং সবাই যুদ্ধ পরিহার করে একটি সমাধান চান। তবে তারা কী করতে পারবেন এবং পাকিস্তানের শুভবুদ্ধির উদ্রেক কীভাবে হবে, সে ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার সুযােগ খুব কম। শ্রীমতী গান্ধী ওয়াশিংটনে থাকতেই ৫ নভেম্বর সাড়ে তিন শ মার্কিন বুদ্ধিজীবী প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাকিস্তানকে সাহায্য ও উৎসাহদান বন্ধ করতে আবেদন করেন। তারা বলেন যে উপমহাদেশে মার্কিন উদ্যোগ একটি বিরাট ভুল ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। এটি গণহত্যার বিস্তারে সাহায্য করছে এবং তাই এই নীতি অবিলম্বে পরিহার করা দরকার। এই আবেদনে স্বাক্ষর করেন ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ, যাদের মধ্যে নােবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অনেক ব্যক্তিও ছিলেন। ১০ থেকে ১২ নভেম্বরে ওয়াশিংটনে একটি বড় রকমের সম্মেলন হলাে বাংলাদেশকে নিয়ে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে মার্কিন প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে মতবিনিময়ের জন্য একটি সম্মেলন ডাকে। নিউইয়র্কের হােমার
২০০
জ্যাক এতে সভাপতিত্ব করেন। সিনেটর কেনেডি এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। এতে বক্তব্য দেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের পাকিস্তান ডেস্কের পরিচালক ব্রুস লেইনগেন, শিকাগাের অধ্যাপক এডওয়ার্ড ডিমক, ভারত ও পাকিস্তান থেকে সদ্য প্রত্যাগত কংগ্রেসম্যান ফ্রিলিং হাইসেন এবং বাংলাদেশ মিশনের সদ্য রােগমুক্ত কুটনীতিবিদ এনায়েত করিম। পাকিস্তান মিশনের মুজাহিদ হােসেন বাংলাদেশ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আপত্তি তুলে সম্মেলন বয়কট করেন। এই সম্মেলনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। বলা হয় যে তারা বাংলাদেশ সংকটের একটি গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে পারেন।
ওয়াশিংটনে বাল্টিমােরে জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডভান্সড স্টাডিজ সেন্টার অবস্থিত। ১১ নভেম্বর আমাকে সেখানে বক্তৃতা করতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার সংকট ছিল আমার বক্তব্য। জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা আর ওয়াশিংটনের ভ্রান্ত পাকিস্তান নীতি নিয়েই ছিল এই সভার সব প্রশ্নোত্তর ও আলােচনা। নভেম্বরের মাঝামাঝি ব্যাপারটি দারুণ আশঙ্কাজনক ও একেবারে অনিশ্চিত পর্যায়ে পৌঁছায়। একদিকে যেমন সমস্যাটি বুঝতে কোনাে কষ্টই ছিল না, তেমনি। অন্যদিকে তার সমাধানের পথও পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই স্বীকার করছেন যে অবস্থা গুরুতর, যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকট এবং পাকিস্তানকে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝােতা করতেই হবে। কিন্তু সমস্যাটি ছিল বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে? কীভাবে এই সমঝােতার পথে এগােনাে যায়? ওয়াশিংটন সারা বছর পাকিস্তানের প্রতি এতই নমনীয় ছিল যে এখন তাদের অন্য রকম উপদেশের কোনাে মূল্যই নেই। কিসিঞ্জারের প্রস্তাবে সুলতান খানের জবাব প্রকৃতপক্ষে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ারই নামান্তর ছিল। ইয়াহিয়া সরকার সমঝােতার জন্য যথার্থ কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে না। তারা নতুন সংবিধান অনুযায়ী নতুন সরকার যদি-বা প্রতিষ্ঠা করে, তাতে দেখা যাবে সে বিষয়টি বিবেচিত হচ্ছে মাস দেড়েক পর অর্থাৎ অনেক দেরিতে। লাই পেলে বাদর মাথায় চড়ে বসে। ওই সময়ে পাকিস্তানে। ইয়াহিয়া জান্তার অবস্থা ছিল সে রকম।
নভেম্বরের শেষ দিকে অবস্থা গুরুতর আকার ধারণ করল। বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি ও ভারতীয় বাহিনী মুখােমুখি যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। নভেম্বরের দ্বিতীয় পক্ষে আমেরিকার সংবাদপত্রে শুধুই সীমান্ত যুদ্ধের খবর এবং নিক্সন। প্রশাসনের নানা উদ্যোগ নিয়ে জল্পনাকল্পনা প্রকাশিত হতে থাকল। মার্কিন কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বলবে, পাকিস্তান ও ভারতকে যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে প্রয়াস পাবে, বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করবে। ওয়াশিংটন পােস্ট ১৮, ২৪ ও ২৬ নভেম্বর সম্পাদকীয় লিখল, নিউইয়র্ক টাইমস লিখল ২২,
২০১
২৩ ও ২৫ তারিখে। বাল্টিমাের সান২৪ ও ২৫ তারিখে এবং ওয়াশিংটন ইভনিং স্টার ১৬ ও ২৫ নভেম্বর। আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, মার্কিন নীতি পরিবর্তন, যুদ্ধ। পরিহার—এগুলােই ছিল সব সম্পাদকীয় মন্তব্যের বিষয়। সিনেটে দুই দলের নেতা সিনেটর মাইক ম্যানসফিল্ড এবং সিনেটর হিউ স্কট ২৪ তারিখে মার্কিন সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থানের জন্য আবেদন করলেন এবং নভেম্বরে সিনেটর হ্যারিস ও সিনেটর মন্ডেইল বাংলাদেশ সমস্যার ওপর একটি জাতিসংঘ সম্মেলনের ব্যবস্থা করতে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তারবার্তা পাঠালেন। এই সম্মেলনের ব্যাপারে তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশের প্রতিনিধিদেরও আহ্বান করা। ৪ ডিসেম্বর সিনেটর হ্যারিস প্রস্তাবটি সিনেটে পেশ করলেন।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ভারতের উত্তরাঞ্চলে আক্রমণের খবর খুব আশ্চর্যজনক ছিল না। পাকিস্তানের পুরাে পরিকল্পনারই লক্ষ্য ছিল কোনােমতে বিষয়টিকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে পরিণত করা। যুদ্ধ বাধলে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতির জন্য সচেষ্ট হবে। শুধু এই রকম পরিস্থিতিতেই পাকিস্তান বাংলাদেশে তাদের জবরদখল বজায় রাখতে পারবে। নতুবা বাঙালিদের রােষের মুখে তাদের প্রাণ নিয়ে পালানােরও কোনাে উপায় থাকবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের যতই দুরবস্থা হােক না কেন, ওয়াশিংটনে তাদের মুরব্বি নিক্সন ও কিসিঞ্জার ছিলেন খুবই সক্রিয় এবং আশাবাদী। যুদ্ধের শুরুতেই এই জুটি ভারতকে জব্দ করার সুযােগ খুঁজতে থাকে। সরাসরি ভারতকে আক্রমণকারী ঘােষণা করে তারা দৌড়ে নিরাপত্তা পরিষদে গিয়ে হাজির হন পাকিস্তানকে বাঁচানাের রাস্তা বের করতে। ৯ ডিসেম্বর সিনেটর গােল্ড ওয়াটার কিসিঞ্জারের বেনামি প্রেস বক্তব্য কংগ্রেশনাল রেকর্ডে তুলে ধরেন। কিন্তু সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসন কদিন পর নিক্সন-কিসিঞ্জারের সত্যিকার মনােভাব ও পরিকল্পনার অন্য রকমের বিবরণ দিতে শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এন্ডারসন কিছু কিছু ভেতরের খবর সরবরাহ করতে থাকেন এবং ৫ জানুয়ারি থেকে ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সভার পূর্ণ বিবরণী ছাপতে থাকেন। এই গ্রুপ ছিল কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে দৈনন্দিন সমস্যা মােকাবিলার জন্য একটি বিশেষ আন্ত-এজেন্সি সংস্থা।
কিসিঞ্জার মােটেই সত্যের সন্ধানে ছিলেন না, তার কথা ছিল ভারতকে অপদস্থ করতে হবে এবং পাকিস্তানিদের বাঁচাতে হবে। মার্কিন উদ্যোগে ৪ ডিসেম্বর বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হলাে এবং তখনই জোরেশােরে একটি যুদ্ধবিরতি ঘটাবার চেষ্টা শুরু হলাে। মার্কিন উদ্যোগে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচ করতে ৪, ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর তিনবার রাশিয়াকে ভেটো দিতে হলাে। এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয় বিষয় হলাে ফ্রান্স ও ব্রিটেন প্রতিবারই ভােটদানে বিরত থাকে ।
২০২
৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর পরপর তিন দিন নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ সংকট নিয়ে বিতর্ক ও ভােট চলল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ বুশ (পরবর্তীকালের প্রেসিডেন্ট) তােতাপাখির মতাে ভারতকে গালাগাল করলেন। তবে গালাগালিতে রেকর্ড স্থাপন করলেন নবনিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত হােয়াং হােয়া (পরবর্তী সময়ের প্রধানমন্ত্রী)। তাঁর সমস্ত উন্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ পেল সােভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে। অর্থাৎ সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই ছিল তার আসল বিষােদ্গার। নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যরা প্রস্তাবের নানা খসড়া বানালেন কিন্তু সব কটিরই মূল বিষয় ছিল একটি যুদ্ধবিরতি। শুধু পােল্যান্ড বারবার বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নটি উত্থাপন করে।
৬ ডিসেম্বর অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হয়। এদিন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করল এবং বাংলাদেশ ও ভারত একটি যৌথ কমান্ড প্রতিষ্ঠা করল । ভারতের কথা হলাে, যেকোনাে আলােচনায় বাংলাদেশকে ডাকতে হবে। এ সময় নিরাপত্তা পরিষদের সামনে এল পাঁচটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব। তার মধ্যে শুধু রাশিয়ার প্রস্তাবে পাকিস্তানি ধ্বংসলীলা বন্ধ করে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হলাে। বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপানের এক যৌথ প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতি চাওয়া হলাে। আর বাকি তিনটি প্রস্তাবে ছিল পাকিস্তানি দুরভিসন্ধি সফল করার প্রচেষ্টা, যুদ্ধবিরতি ‘এবং সেনা প্রত্যাহারের কথা। এই প্রস্তাবগুলাের একটি দেয় আমেরিকা, একটি চীন এবং অন্যটি পাঁচটি অনুন্নত দেশ (আর্জেন্টিনা, সিয়েরা লিওন, সােমালিয়া, নিকারাগুয়া ও বুরুন্ডি)। আবারও রাশিয়ার ভেটো বাঙালিদের রক্ষা করল।
মার্কিন সরকার তাদের এই ব্যর্থতা মানতে প্রস্তুত ছিল না। তাই বিষয়টি তারা সাধারণ পরিষদের সামনে নিয়ে যেতে চাইল। প্রেসিডেন্ট ট্রম্যানের পররাষ্ট্রসচিব ডিন এচেসন ১৯৫০ সালে কোরীয় যুদ্ধকে নিয়ে এই ট্র্যাডিশনের সূচনা করেন। সে সময় নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতার সুযােগ নিয়ে তিনি বিষয়টিকে সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করেন। সাধারণ পরিষদ তখন উত্তর কোরিয়া ও চীনকে আক্রমণকারী ঘােষণা করে এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে সাহায্যের আবেদন জানায়। এই পদক্ষেপের দ্বারা যে প্রস্তাব পাস হয়, তার নাম হয় শান্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া’ (Uniting for peace)। পরে আরও অনেকবার এই ট্র্যাডিশন অনুসরণ করা হয়। যেমন ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সুয়েজ আক্রমণ (১৯৫৬) বা মধ্যপ্রাচ্যের ১৯৬৭ সালের যুদ্ধকালে।
এবারও এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হলাে। তবে ভারতকে পাকিস্তান আর আমেরিকা ছাড়া অন্যরা আক্রমণকারী বলতে রাজি হলাে না। তবে সাধারণ পরিষদ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাল এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অবস্থা সৃষ্টি
২০৩
এবং তাদের দুর্দশা নিরসনে সাহায্যদানের আবেদন করল। প্রস্তাবটি পাস হলাে ৭ ডিসেম্বর এবং এর পক্ষে ভােট পড়ল ১০৪, বিপক্ষে ১১ আর ১০ ভােটদানে বিরত থাকল। একটি উন্নয়নশীল দেশের দুই অংশের বিচ্ছেদ বেশির ভাগ সদস্যই কোনােমতে মেনে নিতে পারছিল না। নিউইয়র্ক টাইমস-এর হেনরি টেনার ১১ তারিখে বিচারপতি চৌধুরীকে নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। সেখানে বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য ছিল যে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদের একটি মৌলিক বিষয়—আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারেরই নিশ্চয়তা চাইছে। তিনি আরও বলেন যে জাতিসংঘে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিকে একটি বিষয় বােঝাতেই তিনি হয়রান। বাংলাদেশ বস্তুতপক্ষে একটি জাতির বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে না—পাকিস্তান আসলেই এক জাতিভিত্তিক দেশ নয় এবং পাকিস্তানের দুই অংশকে নিয়ে কোনাে একক জাতীয়তাবাদ কখনাে প্রতিষ্ঠা পায়নি।
সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবটি পাকিস্তান খুশির সঙ্গে ও বিদ্যুৎ-গতিতে গ্রহণ করল । কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশ তাদের বিরােধিতায় রইল অটল । ১০ তারিখে ঢাকা থেকে জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক অরির মাধ্যমে জেনারেল নিয়াজি যুদ্ধবিরতির আবেদন পাঠালেন। তারা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সরে পড়তে চান, তবে তাঁদের বাংলাদেশ থেকে নিরাপদে অপসারণ করতে হবে। শিগগিরই নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসবে তাদের বলে আশ্বস্ত করা হলাে। কিন্তু এ ছাড়া আর কিছুই হলাে না। উল্টো জেনারেল ইয়াহিয়া জানালেন যে নিয়াজির ওই বার্তা অননুমােদিত। এদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টো ওই দিনই জাতিসংঘে এলেন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। পরের দিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংও এলেন । ১২ তারিখে মার্কিন উদ্যোগে আবার নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শুরু হলাে। আবার উত্থাপিত হলাে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এবং আবারও রাশিয়ার ভেটো, এই নিয়ে তৃতীয়বার। এবারও বাংলাদেশের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠল, তবে ভারত ও ভুটান ছাড়া কেউ তখনাে দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি বলে এই প্রশ্নে ইতিবাচক সমাধান হলাে না।
এই ব্যর্থতা কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদকে নিষ্ক্রিয় করতে ব্যর্থ হলাে। প্রথমে শুরু হলাে ইতালি-জাপানি উদ্যোগ। যার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধ বন্ধ করবে এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সংলাপ শুরু হবে। এই উদ্যোগের পরিশীলিত পরিণতি ঘটে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উদ্যোগে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল পূর্বে ও পশ্চিমে দুটি স্বতন্ত্র যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করা, পশ্চিমের সেনারা নিজেদের এলাকায় ফিরে যাবে। আর পূর্বে দুই বাহিনীর অধিনায়ক যুদ্ধবিরতি দিয়ে সেনা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেবেন। একই সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের জনগণের ইচ্ছা অনুসারে ওই অঞ্চলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া
২০৪
হবে। এই উদ্যোগের জন্য নিরাপত্তা পরিষদ তাদের অধিবেশন মুলতবি রাখল, যাতে অনানুষ্ঠানিক আলােচনা চলতে পারে।
১৫ তারিখে জুলফিকার আলী ভুট্টো নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন দাবি করে বসলেন। পােল্যান্ড নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করল । এই প্রস্তাবে চারটি বিষয় ছিল। প্রথমত, বাংলাদেশে শেখ মুজিব ও তার সহকারীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের এক জায়গায় সমবেত করে তাদের পাকিস্তানে অপসারণ করা। তৃতীয়ত, পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের নিরাপদ ব্যবস্থা এবং চতুর্থত, পশ্চিমে যুদ্ধবিরতি ও সেনা প্রত্যাহার । ভুট্টো এই প্রস্তাবে একেবারে খেপে ওঠেন। তিনি খুব আশা করেছিলেন যে চীন ভারতকে আক্রমণ করবে। তিনি আরও আশা করেছিলেন যে মার্কিন নৌবাহিনী চট্টগ্রামে পৌছে যাবে। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি দেখলেন যে বাংলাদেশে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই । নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টো সেদিন রাতে এক অনবদ্য নাটকের অবতারণা করলেন। সিক্ত চোখে দারুণ ভাবাবেগের সঙ্গে তাঁর টেবিলের কাগজপত্র সব ছড়িয়েছিটিয়ে তিনি সবাইকে হতভম্ব করে অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। তাঁর সেদিনের বক্তৃতা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি :
‘আমি মনে করি যে নিরাপত্তা পরিষদে এসে বিচার চাওয়া আমার অবশ্যকর্তব্য ছিল। কিন্তু আমাকে বলতেই হবে যে নিরাপত্তা পরিষদ আমার দেশের প্রতি সুবিচার করেনি। এর দীর্ঘসূত্রতা শুরু থেকেই আমাদের বিরক্ত করেছে। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে নিরাপত্তা পরিষদ অসার কথামালা রচনায় উৎকর্ষ লাভ করেছে।…ভেটোর ব্যাপারটি আমাদের সম্পূর্ণ হতাশ করেছে। চলুন, আমরা ভেটোর জন্য স্মৃতিসৌধ বানাই। আমরা স্মৃতিসৌধ বানাই অক্ষমতা ও অপারগতার জন্য।
‘জনাব সভাপতি, আমি ইঁদুর নই, আমার জীবনে আমি কখনাে পলায়নপর হইনি। আমি আততায়ীর সম্মুখীন হয়েছি, আমি কারারুদ্ধ হয়েছি। আজ আমি পালাচ্ছি না, তবে আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে চলে যাচ্ছি। আমি মনে করি, এখানে আর একটি মুহূর্ত থাকা আমার নিজের এবং আমার দেশের জন্য অসম্মানজনক। আপনাদের যা খুশি সেই সিদ্ধান্ত নিন, ভার্সাই চুক্তির চেয়েও অধম চুক্তি রচনা করুন, আগ্রাসনকে জায়েজ করুন, দখলদারিকে বৈধ করুন—আমি এতে অংশীদার হতে চাই না। আমরা লড়ে যাব, আমার দেশ আমাকে আহ্বান করছে। আমি নিরাপত্তা পরিষদে আমার সময় কেন অপচয় করব? আমার দেশের এক অংশের লজ্জাকর আত্মসমর্পণে আমি অংশ নিতে চাই না। আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ নিয়ে আপনারা থাকুন। আমি চললাম।
২০৫
অবশ্য লবিতে তিনি বললেন যে পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদকে বয়কট করছে না। রাষ্ট্রদূত শাহি তাে আছেনই। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে আর অংশ নিতে চান না। ভুট্টোর এই নাটকীয় ব্যবহার টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত হওয়ায় তা যথেষ্ট কৌতূহল ও কৌতুকের উদ্রেক করে। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ তখন ঢাকায় পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি দখলদারদের পঙ্গপালের মতাে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ সারা মার্কিন মুলুকে আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে। শুধু হােয়াইট হাউস এই আনন্দ-উল্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। শ্ৰীমতী গান্ধীর যুদ্ধবিরতি ঘােষণা যেমন তার বুদ্ধিমত্তা ও ন্যায়পরায়ণতার প্রমাণ দেয়, তেমনি কৌতুকের উদ্রেক করে জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণের অগ্নিবাণ । তিনি বলেন যে পূর্ব পাকিস্তান ভারতীয় আগ্রাসনের শিকার হলেও তিনি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। পরদিন অবশ্য সেনাপতিদের চাপে ইয়াহিয়া যুদ্ধবিরতি মেনে নেন এবং সে সঙ্গে তাঁর উম্মাদ নেতৃত্বেরও অবসান ঘটে। এরপর ভুট্টো হলেন পাকিস্তানের নতুন সামরিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি। ভুট্টোর স্বপ্ন এভাবে অবশেষে সফল হলাে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। তাঁর দাবি ছিল যে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি, তিনি পশ্চিমের, তাই ক্ষমতায় তার ভাগ থাকতে হবে। সত্যিই তিনি বিচ্ছেদিত পাকিস্তানের (শুধু পশ্চিম নিয়ে অবশিষ্ট) প্রেসিডেন্ট ও সর্বেসর্বা হয়ে বসলেন। অন্যদিকে জেনারেল ইয়াহিয়া হলেন গৃহবন্দী এবং পরে এই অবস্থায়ই এই ধিকৃত, প্রায় উন্মাদ প্রেসিডেন্ট মৃত্যুবরণ করেন।
আগেই বলেছি, আগা হিলালি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অবসর নেন। তার উত্তরসূরি হন জেনারেল নবাবজাদা এ এম রাজা। তিনি ওয়াশিংটনে এসে যেন পানিতে পড়লেন। ৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে তার পরিচয়পত্র দেন। এসব অনুষ্ঠানে দুই দেশের সম্পর্ক বা সমস্যা নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার রীতি আছে। অথচ এই দিনের বিশেষত্ব ছিল যে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় যে সংকট—উপমহাদেশে যুদ্ধ—তা নিয়ে কোনাে তরফ থেকেই কোনাে বক্তব্য দেওয়া হলাে না। নভেম্বরের শেষ দিক থেকেই মার্কিন পত্রপত্রিকাগুলাে। উপমহাদেশের অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ নিয়ে অনবরত লিখতে শুরু করে। আমি চারটি দৈনিকের বিভিন্ন প্রতিবেদনের একটি সংগ্রহ দিনে দিনেই সম্পন্ন করতাম। ওয়াশিংটন পােস্ট, ওয়াশিংটন ইভনিং স্টার, বাল্টিমাের সান আর নিউইয়র্ক টাইমস ছিল এই চারটি পত্রিকা। এখন দেখছি যে ১ থেকে ২০ ডিসেম্বরের আমার যে সংগ্রহ রয়েছে, তাতেই তিনটি অতিকায় নথি তৈরি হয়েছে। মার্চের শুরু থেকে আমি এই সংগ্রহ শুরু করি এবং ডিসেম্বরে পৌছার আগে মােট নথি হয় ১০টি (নভেম্বরের দুটিসহ)। অবশ্য তার মধ্যে কোনাে কোনােটি ছিল
২০৬
ক্ষীণকায়। যেমন মে মাসের নথিটি। যা-ই হােক, নভেম্বর-ডিসেম্বরের এই ২০ দিনে এসব পত্রিকায় অনবরত সম্পাদকীয় মন্তব্য এবং প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের কলাম প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটন পােস্ট-এ সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল ৮টি এবং নিউইয়র্ক টাইমস-এ ছিল ১১টি। এসব মন্তব্যে যুদ্ধ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয় কিন্তু প্রায় সব কটিতেই মার্কিন ভূমিকা নিয়ে বিরূপ সমালােচনা করা হয় এবং জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও খেদ প্রকাশ করা হয়। আরেকটি বিষয় ছিল উপমহাদেশে রাশিয়ার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি।
১৬ ডিসেম্বর ইভনিং স্টার, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, বাল্টিমাের সান ও নিউইয়র্ক টাইমস—এই চারটি পত্রিকাই উপমহাদেশীয় পরিস্থিতি নিয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য করে। এদের শিরােনাম ছিল যথাক্রমে ‘মস্কো ও যুদ্ধ’, ‘আমাদের আসওয়ান মনে রাখা দরকার’, ব্যর্থতার দোসর হিসেবে আমেরিকা এবং কূটনৈতিক বিপর্যয়। প্রথম দুটি মন্তব্যে বলা হয় যে এ যুদ্ধের ফলে উপমহাদেশে সােভিয়েত প্রভাব বাড়বে, তবে মার্কিন সরকার যদি এ অবস্থায় প্রত্যাহার নীতি অনুসরণ করে, তাহলে ভুল করবে। আসওয়ান প্রকল্পে মার্কিন সাহায্য প্রত্যাহারের ফলেই নাসেরের মিসরে সােভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধি পায় । বাল্টিমাের সান ও নিউইয়র্ক টাইমসও সােভিয়েত প্রভাবের বিস্তার দেখতে পায়, তবে তারা অভিযােগ করে বলে এর জন্য দায়ী আমেরিকা। আমেরিকার ভ্রান্ত কৌশল তাকে পরাজিতের দলে স্থান দিয়েছে। যুদ্ধ শেষে ১৭ তারিখে ওয়াশিংটন পােস্ট-এর সম্পাদকীয় শিরােনাম ছিল পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করেছে। এতে মন্তব্য করা হলাে, সমস্ত ঘটনাটি, মার্চে শুরু হয়ে গতকালের আত্মসমর্পণ পর্যন্ত একটি বিরাট ট্র্যাজেডি…অনেক কষ্ট এবং অনেক হিংস্রতা ঘটেছে…। উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়েছে এবং আট মাসে তা ভেঙে পড়েছে। পুনর্গঠন ও পুনঃস্থাপনের কাজে অনেক বেশি সময় লাগবে।’ নিউইয়র্ক টাইমস ‘সংলাপের সময় শিরােনামে উপদেশ দেয়, আর তাতে বলা হয়, তিনটি দেশের সর্বোত্তম স্বার্থে এখন হলাে আলাপের সময়। বহুদিন ধরে আলােচনার রাস্তা যে বন্ধ হয়ে গেছে, তার পুনরুদ্ঘাটন দরকার। সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং যুদ্ধ শেষে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এই সংলাপ একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী উপমহাদেশের জন্য অপরিহার্য।
ওয়াশিংটন পােস্ট ৭ ডিসেম্বর একটি কড়া সম্পাদকীয় লেখে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিপর্যয়ের পেছনে আমেরিকা’—এই শিরােনামে পত্রিকাটি প্রশ্ন করে, ‘বিপর্যয় ডেকে আনার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নীতিমালার বিকল্প আর কিছুই হতে পারত না। আমেরিকার কূটনীতির কোনাে যৌক্তিকতা আমাদের বােধগম্য নয়।…বর্তমান সংকটের উৎস হলাে পূর্ব পাকিস্তানে অনুসৃত
২০৭
পাকিস্তানের ব্যবহার ও নীতি। শুধু তাতেই সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে । আমেরিকা শুধু সমাধানে অবদান রাখতেই ব্যর্থ হয়নি, বরং সব সমাধানকে কষ্টসাধ্য করে ফেলেছে। এটাই বুঝি বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এত প্রচারিত নিক্সন মতবাদ (নিক্সন ডকট্রিন)। আমরা এগােনাের পরিবর্তে পেছন ফিরছি; এ যেন বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের শীতল যুদ্ধের মানসিকতা; সেন্টো, সিয়াটো এবং নিরাপত্তা সাহায্যের পুনরাবৃত্তি। বাল্টিমাের সান-এ একই ধরনের কঠোর সমালােচনা করা হয় ১০ ডিসেম্বর। একটি দুর্বল নীতির নিকৃষ্টতম বাস্তবায়ন শিরােনামে সম্পাদকীয়তে মার্কিন সরকারের পাকিস্তান নীতির ভ্রান্তি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, আমেরিকার পাকিস্তান নীতি প্রায় এক বছর ধরে অবধারিতভাবে বিপর্যয়ের পথ অবলম্বন করেছে। এই নীতিতে সবচেয়ে লাভবান। হয়েছে রাশিয়া আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিন্দিত হয়েছে আমেরিকা। এসব কিছু দেখে মনে হয়, এমনভাবে মার্কিন বৈদেশিক নীতি খুব কমই হোঁচট খেয়েছে।’
সম্পাদকীয় মন্তব্য ছাড়াও সংবাদপত্রগুলাে অনেক গােপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির বাংলাদেশ বিরােধিতাকে কার্যকর হতে দেয়নি। কিসিঞ্জার যখন সংবাদমাধ্যমের কাছে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন, তখন তার বক্তব্যের ভুলভ্রান্তি এত বিস্তৃতভাবে আলােচিত হয় যে ভারতের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিতে নির্বাহী বিভাগকে সাবধান হতে হয়। পাকিস্তানকে তৃতীয় সূত্রের মাধ্যমে সাহায্য করার প্রচেষ্টা থেকেও নির্বাহী বিভাগকে নিবৃত্ত হতে হয় । নিক্সনের আণবিক সমাধানের বিবেচনাও সংবাদমাধ্যমের সতর্কতার কারণে নিয়ন্ত্রণে থাকে। আণবিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত জাহাজ এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হবার আগেই সাংবাদিকেরা দেশরক্ষা সেক্রেটারি মেলভিন লেয়ার্ডকে এই রণতরির অগ্রগমন সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে থাকেন। আর ১৬ ডিসেম্বর থেকে জ্যাক এন্ডারসন একের পর এক গােপন কাহিনি ফাস করতে থাকেন। তখন দেখা যায় যে কিসিঞ্জারের বক্তব্য নেহাতই ভুল ছিল এবং তা সত্য কথা ঢাকার জন্যই বলা হয়েছিল। নিক্সন-কিসিঞ্জার স্পষ্টতই পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছিলেন, তারা কখনাে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেননি। পাকিস্তানের প্রতি ঝোঁক এবং ভারতের প্রতি বৈরিতা তাদের খামােখাই বাংলাদেশের বিরােধিতায় লিপ্ত করে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে অন্য যে মহল থেকে অত্যন্ত মূল্যবান সাহায্য মেলে তা হলাে মার্কিন কংগ্রেস। কংগ্রেস নির্বাহী বিভাগকে সব সময় দায়বদ্ধ রাখে এবং নিক্সন-কিসিঞ্জারের ক্ষতিকর পদক্ষেপকে সত্যিকারভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়। পুরাে সংকটকালেই কংগ্রেসের অবদান ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে । অবশ্য হাতে গােনা জনপ্রতিনিধি নিক্সন-নীতিকে সমর্থন করেন। ১ থেকে ১৭ ডিসেম্বর কংগ্রেসে মােট ৬২টি বক্তৃতা ছিল বাংলাদেশ বা উপমহাদেশীয় সংকটের ওপর।
২০৮
তাতে নিক্সন-কিসিঞ্জার নীতির সমর্থনে বক্তৃতা হয় মাত্র ৯টি। ভারতকে দোষী বলে ঘােষণা দেওয়ার বিরুদ্ধে কংগ্রেস সােচ্চার হয় এবং তারপরই কিসিঞ্জার তাঁর ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন। ১৩ ডিসেম্বর সিনেটর আদলাই স্টিভেনসন মার্কিন নিরপেক্ষতার দাবি নাকচ করে দেন। তিনি জানালেন যে নামমাত্র খরচে পাকিস্তান মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইজারা নিয়েছে এবং তা যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৫ তারিখে সিনেটর টমাস ইগলটন প্রশ্ন করেন, ‘কেন মার্কিন যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরে আছে? কেন একটি মার্কিন বাহিনী এশিয়ার নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে ধাবিত হচ্ছে?’ মার্কিন নাগরিকদের অপসারণ করার ভুয়া যুক্তি তিনি তার বক্তব্যে খণ্ডন করেন এবং পাকিস্তানিদের অপসারণ করার দায়িত্ব না নিতে সাবধান করে দেন।
সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস যুদ্ধের শুরুতেই ৪ ডিসেম্বর (কিংবা প্রকৃতপক্ষে তার আগেই) আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে সংকট সমাধানের জন্য প্রস্তাব দেন (৩০ নভেম্বর তিনি এবং সিনেটর ওয়াল্টার মন্ডেইল এ বিষয়ে একটি আবেদন প্রচার করেন)। সিনেটর স্টিভেনসন ৩ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদকে সক্রিয় করার পরামর্শ দেন। তিনজন প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য পিটার ফ্রিলিং হাইসেন, রবার্ট সাইকস ও জেরাল্ড ফোর্ড নির্বাহী বিভাগের সমর্থনে বক্তব্য দেন ৬ ও ৭ ডিসেম্বর। ৯ ডিসেম্বর সিনেটর ব্যারি গােল্ড ওয়াটার, ১০ ডিসেম্বরে সিনেটর হিউ স্কট, ১৩ তারিখে সিনেটর গর্ডন এলট এবং ১৫ তারিখে সিনেটর এডওয়ার্ড গার্নে নিক্সন নীতিকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে সিনেটর কেনেডি, চার্চ, স্যাক্সবি, বায়া, ম্যাকগভার্ন, সাইমিংটন, স্টিভেনসন, হামফ্রে, ক্র্যানস্টন, ফুলব্রাইট, ইগলটন পার্সি, হ্যারিস এবং হার্টকে নিক্সন নীতি ও উদ্যোগের সমালােচনা করেন। প্রতিনিধি পরিষদে ব্যাডফোর্ড মাের্স, হেনরি হেলস্টোস্কি, পিটার ম্যাকলােস্কি, গালাগার, বিংগাম, লিগেট ও ফ্রেজার নিক্সন-কিসিঞ্জার নীতি ও উদ্যোগের তীব্র সমালােচনা করেন। ডিসেম্বরের ৯ তারিখেই দুজন প্রতিনিধি হেলস্টোস্কি ও ম্যাকলােস্কি বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন। হেলস্টোস্কির প্রস্তাবের বিষয় ছিল ব্যাপক। প্রথমত, মার্কিন সরকারের দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন। দ্বিতীয়ত, ভারত ও পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে মার্কিন কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান। চতুর্থত, দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধবিরতি এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত থেকে সব বিদেশি সেনা প্রত্যাহার । পঞ্চমত, সব যুদ্ধবন্দী এবং শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। ষষ্ঠত, বাংলাদেশে সরকার গঠনের জন্য অবাধ নির্বাচন। সপ্তমত, এসব উদ্যোগে মার্কিন সহায়তা, বিশেষভাবে অর্থনৈতিক ও মানবিক সাহায্য প্রদান।
২০৯
২ ডিসেম্বর মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বার অ্যাসােসিয়েশনে (আইনের ছাত্রদের সংসদ) আমার বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। বক্তৃতার বিষয় ছিল বাংলাদেশ সংকট কি উপমহাদেশীয় যুদ্ধে পরিণত হবে? দিনটি যথাযথ সময়েই নির্দিষ্ট হয়েছিল। পরের দিনই যুদ্ধ বাধে। মার্কিন সরকার, কংগ্রেস এবং জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে ছিল আমার বক্তৃতা। যে ছাত্রটি আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়—লারি জনসন—সে পাকিস্তানে বছর তিনেক ছিল। যদিও তার বেশি পরিচিতি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান সম্বন্ধে কিন্তু পাকিস্তানের বর্বরতা তাকে বাংলাদেশের বন্ধুতে পরিণত করে। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স ইনস্টিটিউট চার দিনব্যাপী একটি সম্মেলন ডাকে ডিসেম্বরের ৬ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত। সম্মেলনের আলােচ্য বিষয় ছিল বিশ্বে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা।
৭ তারিখ আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল পাকিস্তানে সামরিক একনায়কত্ব’। সেখানে পৌছে দেখি দ্য মইন ট্রিবিউন-এ একটি ছবি, যেখানে ভারতীয় স্বীকৃতিতে উল্লাস প্রকাশ করে বাঙালি গায়ক-গায়িকারা গান গাইছেন। সেই ছবিতে অত্যন্ত প্রাণবন্ত বন্ধুবর জামিল চৌধুরীকে (পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক এবং পরে অতিরিক্ত শিক্ষাসচিব) দেখা যাচ্ছে। দ্য মইন রেজিস্টার ও আইওয়া স্টেট ডেইলি পরের দিন খুব ঘটা করে বাংলাদেশের খবর পরিবেশন করল আর জাতিসংঘ ও মার্কিন সরকারকে তাদের গাফিলতির জন্য সমালােচনা করল। ওই সম্মেলনে বক্তৃতা করা ছাড়াও আরেকটি আসরে (বােধ হয় ভারতীয় অ্যাসােসিয়েশন) আমাকে আবার বক্তৃতা করতে হলাে। ৮ তারিখে ওয়াশিংটন ফিরতেই আমার স্ত্রী জানালেন যে গতকাল থেকে সিনেটর স্যাক্সবি হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজছেন। ফলে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার দপ্তরে যােগাযােগ করতে হলাে। মাইক গার্টনার আমাকে সিনেটরের সঙ্গে আলাপ করতে বললেন। সিনেটর বললেন যে পরের দিন সকালে আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে।
সকাল নয়টা কি সাড়ে নয়টায় তার দপ্তরে হাজির হলাম। সিনেটর প্রশ্ন করলেন, “তােমাদের নেতৃত্বে যারা আছেন, তারা কি একটি স্বাধীন দেশ পরিচালনা করতে পারবেন? আমি বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য প্রস্তাব দিতে চাই কিন্তু আমাকে আশ্বস্ত করাে যে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের পরও যথেষ্ট উপযুক্ত ব্যক্তি আছেন, যারা দেশকে চালাতে পারবেন। তারপর তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যদি দেশে ফেরেন, তাতে অবস্থার কী রকম উন্নতি বা পরিবর্তন হবে? সবশেষে তিনি বললেন, ‘ইয়াহিয়া আমাকে মিথ্যা কথা বলেছেন। এবং আমাকে শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে দেননি। এখন তিনি নিক্সনের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করছেন, কোনােমতে পার পেতে চাচ্ছেন। এই অবস্থায় আমি
২১০
চাই যে তাঁকে বাংলাদেশকে মেনে নিতে হবে আর শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে। তবে তােমাদের খুব সাবধানতার সঙ্গে দেশ চালাতে হবে। প্রতিশােধ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তুলতে হবে। সিনেটরকে আশ্বস্ত করা ছিল আমার কাজ, তবে তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমিও খুব আশ্বস্ত হই। তার উদ্বেগ ও প্রশ্ন ছিল যথার্থ বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীসুলভ ।
সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তে যে শুধু একটি আশাবাদ ব্যক্ত হবে এবং সমস্যার সমাধান হবে বাংলাদেশের যুদ্ধক্ষেত্রে তাতে বােধ হয় কারও কোনাে সন্দেহ ছিল না। তাই সবাই (বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা) চাইছিল বাংলাদেশ যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানিদের আশু আত্মসমর্পণ। পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধক্ষেত্রে যে লড়াইটি হচ্ছে তা যে নেহাত মামুলি ব্যাপার সে বিষয়ে কারও সন্দেহের অবকাশ ছিল না। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান অথবা পশ্চিম পাকিস্তানের পতন যে এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য নয়, তা ছিল খুবই পরিষ্কার। তাই ৮ ডিসেম্বর থেকে আমরা অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিলাম পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ঘােষণার দিকে। যশাের ছাউনি পাকিস্তানিরা ছাড়ল ৭ ডিসেম্বর। তারপর যৌথ বাহিনী প্রায় যুদ্ধ এড়িয়ে ঢাকার পথে এগােতে থাকল। কত জলদি তারা ঢাকা পৌছায়, সেটাই ছিল আমাদের সব জল্পনাকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু।
ডিসেম্বরে যখন খবর পাওয়া গেল যে জেনারেল নিয়াজির বার্তা আসছে, তখন তা যে আত্মসমর্পণের বার্তা হবে, তাতে কোনাে সন্দেহ ছিল না। পল মার্ক অরি পাঠালেন সন্দেশটি। নিশ্চিত হবার জন্য তিনি ডা. মালিক ও জেনারেল রাও ফরমান আলীর সম্মতিও নিলেন। কিন্তু নিউইয়র্কে সংবাদ পৌছাতেই কিসিঞ্জার হয়ে গেলেন ইয়াহিয়ার মুখপাত্র। তিনি জানালেন যে এই বার্তা পাকিস্তান অনুমােদন করে না। অতি বুদ্ধিমান কিসিঞ্জার কিন্তু এবার একটি ভুল করে বসলেন। চীনা রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর যা কথাবার্তা হয় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের আলােচনার যে বিবরণ তিনি পেয়েছিলেন, তাতে তার ধারণা হয় যে চীন কখনাে পাকিস্তানকে পরাজিত হতে দেবে না। তাই তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে চীন কোনাে না কোনােভাবে এ যুদ্ধে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি করবে। এই উদ্যোগে মার্কিন অবদান হিসেবে এন্টারপ্রাইজকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানাে হলাে। ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করা ছিল নিক্সন-কিসিঞ্জারের উদ্দেশ্য। তাই মার্কিন পরামর্শে জেনারেল ইয়াহিয়া জানালেন যে নিয়াজির আত্মসমর্পণের বার্তায় তাঁর সম্মতি নেই। এ অবস্থায় নিরাপত্তা পরিষদ সারা দিন অপেক্ষা করেও ১১ তারিখে কোনাে বৈঠকে বসতে পারল না।
এদিকে সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওতে ঢাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে শুরু হয় জল্পনাকল্পনা। ঢাকা বিধ্বস্ত হয়ে যাবে! কত লােক যে মারা পড়বে! একই সঙ্গে
২১১
জেনারেল মানেকশর আত্মসমর্পণের আহ্বানও জোরেশােরে প্রচারিত হতে থাকল । তাতে যদি ঢাকা রক্ষা পেয়ে যায়। খবর এল, ঢাকার আকাশ মুক্ত। খবর এল বিভিন্ন সীমান্ত থেকে ঢাকার পথ সবদিকেই উন্মুক্ত। বিজয় যে আসন্ন, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ ছিল না, তবে উদ্বেগ ছিল ব্যাপক। উন্মাদ ইয়াহিয়া আর নিরুপায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যদি শেষ লড়াই লড়তে চায়, তাহলে ঢাকায় হবে বােমা বর্ষণ আর রাস্তায় রাস্তায় হবে লড়াই। নিয়াজির আত্মসমর্পণের বার্তা নাকচ হওয়ায় আমরা বেশ মুষড়ে পড়লাম । কিসিঞ্জারের কেরামতির খবর তখনাে ফাঁস হয়নি, তাই ইয়াহিয়ার ওপরই সব আক্রোশ গিয়ে পড়ল। বহুদিন পর ডিসেম্বরের ওই সময়ে পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের ধ্যানধারণার বৃত্তান্ত শুনে মােটেও আশ্চর্য হইনি। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীদের বরাতে তাদের সে সময়ের চিন্তাভাবনার যে তথ্য পাই, তাতে তাদের দোষ দেবার মওকা বিশেষ নেই।
১৩-১৪ ডিসেম্বরও পাকিস্তানপন্থীদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে মার্কিন নৌবহর চট্টগ্রামে ভিড়বে আর চীনা সেনাবাহিনী ভারত আক্রমণ করবে। অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও ওয়াকিবহাল পাকিস্তানপন্থী বাঙালিরাও মনেপ্রাণে এই বিশ্বাস করেছিল। কিসিঞ্জারেরই যখন এই রকমের হিসাব ছিল, তাতে ওই পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদেরই বা দোষ কী! নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির এই অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ মুক্তিযুদ্ধকে আরও এক সপ্তাহের জন্য প্রলম্বিত করে। তবে এঁদের সবচেয়ে বড় অপরাধ হলাে এঁরা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে সম্ভব করে তােলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় বাঙালি রাজাকার ও আলবদররা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযােগ পেয়ে ১৪ ডিসেম্বরের জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তাই এক হিসেবে হেনরি কিসিঞ্জারকে ঢাকার জঘন্য বুদ্ধিজীবী ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার আসল হােতা বলে বিবেচনা করা যায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই দুষ্ট ব্যক্তি, একসময়ের একজন মহা ক্ষমতাশালী বিশ্বনেতা এখন নিজগৃহে স্বেচ্ছায় বন্দী, যুদ্ধাপরাধের আসামি হিসেবে জীবনের শেষ দিনগুলাে যাপন করছে। এবং এটিই তার যথাযথ প্রাপ্য বলে সারা পৃথিবীর বৃহত্তর জনগােষ্ঠী মনে করে।
১৩ তারিখ যখন আবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বসল, তখন কিছু পাকিস্তানি একটি প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়। তাদের কথা ছিল যে বিষয়টি এখন নিজেদের মধ্যে ফয়সালা করে নেওয়া ভালাে। পাকিস্তানিরা পশ্চিমে চলে যাবে, ভারতীয়দেরও বাংলাদেশ ছাড়তে হবে। বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ আর পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঠিক করবে এবং পাকিস্তান তার বিশ্বাসযােগ্যতা প্রমাণ করবে শেখ মুজিবকে নিউইয়র্কে পাঠিয়ে। নিরাপত্তা পরিষদে শেখ সাহেব এ ধরনের ফয়সালা উপস্থাপন করবেন। লন্ডনে, নিউইয়র্কে ও ওয়াশিংটনে নানা মহল থেকে এ ধরনের প্রস্তাব এল । লন্ডনে নাকি প্রস্তাবকারীদের মধ্যে কিছু বাঙালি
২১২
কুলাঙ্গারও ছিলেন। ওয়াশিংটনে বন্ধুবর মাহবুবুল হক এ রকম একটি প্রস্তাবের কথা আমাকে বললেন এবং জানালেন যে পাকিস্তান সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে কোনাে সাড়া তাঁরা পাননি। প্রস্তাবটি ছিল একান্তই কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির, যারা পাকিস্তানকে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট হবেন। আমি আমাদের মিশনপ্রধান সিদ্দিকী সাহেবকে বিষয়টি জানালাম এবং তিনি আমার বাসায় মাহবুবের সঙ্গে সম্ভবত আলাপও করলেন। আমরা বললাম যে বিষয়টি আমরা নিউইয়র্কে আমাদের প্রতিনিধিদের নেতা বিচারপতি চৌধুরীকে জানাব। সঙ্গে সঙ্গে এ-ও বললাম যে যুদ্ধের যে অবস্থা, তাতে এ ধরনের উদ্যোগের কোনাে সুযােগই হয়তাে মিলবে না। বিচারপতি চৌধুরী এ রকম প্রস্তাব সম্বন্ধে ইতিমধ্যেই অবহিত ছিলেন এবং তিনি বিনা দ্বিধায় ও এককথায় তা নাকচ করে দিলেন। সুতরাং আমাদের দৌড় এখানেই শেষ হলাে। তবে ভুট্টোও নাকি এ রকম এক সম্ভাবনার কথা নিউইয়র্কে উত্থাপন করেন, কিন্তু তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। ১৪ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর গত্যন্তর ছিল বলে মনে হয় না।
ওয়াশিংটনে এই সময়ে আমেরিকার রাজনীতিবিজ্ঞান পরিষদের দক্ষিণ এশীয় গােষ্ঠীর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। মূলত শিক্ষক ও গবেষণাকারীদের এই গােষ্ঠীতে কংগ্রেস প্রতিনিধি কোরমানের স্ত্রী ক্যারল একটি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করছিলেন। তিনি নিজে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে উৎসাহী, তাঁর দুই ভাই দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৩ অথবা ১৪ তারিখে ক্যারল সম্মেলনে যােগদানকারীদের সম্মানে একটি নৈশভােজের আয়ােজন করেন। সেই আসরে বাংলাদেশ থেকে মুহিত দম্পতি আমন্ত্রিত। কোরমানের সঙ্গে ক্যাপিটল হিলে আমার পরিচয়ের কারণেই বােধ হয় আমরা দাওয়াতটা পাই। এই নৈশভােজে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মীকান্ত ঝাকে কিছু বক্তব্য রাখতে অনুরােধ করা হয়। ঝা তাঁর বক্তৃতায় বললেন, আজকের এই অনুষ্ঠান আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ ও তার জনগণের জন্য উৎসর্গ করতে পারি। এই সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং নির্যাতিত জাতি আমাদের সব শুভেচ্ছা ও সমর্থনের যথার্থ দাবিদার।
সবশেষে আমাদের মেজবান আমাকেও কিছু বলতে আহ্বান করলেন। আমি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ধন্যবাদ জানালাম ভারতের সহমর্মিতা ও সহায়তার জন্য। মার্কিন জনসাধারণ, কংগ্রেস ও প্রচারমাধ্যমকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানালাম। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার প্রশংসা করলাম। আশু যুদ্ধাবসান এবং ধ্বংসের হাত থেকে বাংলাদেশের পরিত্রাণ লাভের জন্য সবাইকে প্রার্থনা করতে বলে আমার বক্তব্য শেষ করলাম। সেই আসরে সমস্ত আলােচনা ছিল ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে। কীভাবে দেশটিকে পুনর্গঠন করা যাবে। কীভাবে সেখানে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসা যাবে। কোরমানদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি ফিরতে
২১৩
পােটোম্যাক নদী পেরােতে হয়। আমরা ভার্জিনিয়া থেকে মেরিল্যান্ডে যাব। রাস্তাটি সুন্দর এবং শীতের সময়েও তার শ্যামলিমা পুরােপুরি পরিত্যক্ত হয় না। সেদিন রাতে আমরা দারুণ উৎকণ্ঠায় ছিলাম। বিজয় আসন্ন কিন্তু আমরা ছিলাম বিষন্ন । ঢাকায় কী হবে, সেই চিন্তায় আমরা উদ্বিগ্ন।
১৪ তারিখ ওয়াশিংটন পােস্ট সংবাদ প্রতিবেদনের শিরােনাম দেয় ‘ঢাকা ধ্বংসের সম্ভাবনায় প্রশান্ত’। দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু সে দেশটির অবস্থা কী দাড়াবে—ধ্বংসস্তুপ ও মৃত্যুপুরি কি না? নানাজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, দুর্ভাবনা ও আশঙ্কার সে বিষয়টিকে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে করতে, আমি খুব অন্যমনস্কভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। বাড়ির কাছে ছিল একটি ট্রাফিক লাইট। লাল বাতিতে একেবারে না থেমেই এগিয়ে চলেছি, খেয়ালই নেই। ঘাপটি মেরে বসে থাকা পুলিশ প্যাট্রোল গাড়ি যখন হাজির হলাে, তখন সংবিৎ ফিরে এল। পুলিশ আমার অন্যায় ব্যবহারের জন্য টিকিট লিখে দিল। আমি দোষ স্বীকার করলাম। কারণটিও বলতে চেষ্টা করলাম। তবে অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ি চালানােটা নিশ্চয় অনুচিত ছিল। এই ট্রাফিক টিকিট কিন্তু পরবর্তীকালে আমাকে অনেক যন্ত্রণা। দেয়। প্রথমে তাে আমার গাড়ির বিমা কেউ দিতে চায় না। খুব দয়া করে কেউ বিমা দিলে আমাকে, উচ্চ হারে তা কিনতে হলাে।
ঢাকায় আত্মসমর্পণ নিয়ে যখন আমরা উদ্বিগ্ন, তখন আরেক উপদ্রব বলে মনে হলাে ভারতীয় কোনাে কোনাে মহলের তৎপরতা। ১১ তারিখে ওয়াশিংটন পােস্ট এ খবর বেরােল যে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের জন্য ভারত জেলা প্রশাসনে সহায়ক পাঠাবার ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমাদের মনে হলাে, ব্যাপারটি শুধু গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের বিষয় নয়, বরং বাংলাদেশের মেধা ও কৃতিত্ব নিয়ে ভারতের ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত। স্বাধীন বাংলাদেশে জেলা প্রশাসন কেমন হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব আমরা এবং মুজিবনগর সরকার ইতিমধ্যে এলাকাভিত্তিক প্রশাসনের কাঠামাে তৈরিও করে রেখেছিল। তা ছাড়া দেশে ফিরে আমরা যে একটি চলমান প্রশাসনযন্ত্র পাব, সে বিষয়েও খানিকটা নিশ্চয়তা ছিল। মােটামুটিভাবে বাংলাদেশের প্রশাসন সামরিক জান্তার দোসর ছিল না, ছিল শুধু হুকুমবরদার এবং অনেক ক্ষেত্রে অনিচ্ছুক আজ্ঞাবহ। আমারই উদ্যোগে আমরা মুজিবনগরে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আমাদের অভিমত ব্যক্ত করলাম যে এসব সহকারীকে গ্রহণ করা উচিত হবে না। কদিন পর আরেক খবর বেরােল যে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের একটি দল মনােনীত করেছে। এবারও আমরা দৃঢ়কণ্ঠে আমাদের অভিমত জানালাম যে এ বিষয়েও আমাদের নিজেদের বিশেষজ্ঞ আছেন। এবং কোনাে ভারতীয় দলের প্রয়ােজন নেই। আমাদের বিধানসভা যথাসময়ে অন্যান্য দেশ থেকে এবং অবশ্যই ভারত থেকে মতামত নিতে পারে।
২১৪
ফেব্রুয়ারিতে যখন ঢাকায় পৌছালাম, তখন শুনলাম ও দেখলাম যে ভারতের বাংলাদেশের অবস্থা সম্বন্ধে কোনাে ধারণাই ছিল না। তাঁদের অনেকেই ভাবতেন যে বাংলাদেশের প্রশাসন সম্পূর্ণই পাকিস্তানিদের দখলে ছিল, বাঙালি কর্মকর্তা তেমন ছিলেন না। তারা আরও ভাবতেন যে বাংলাদেশ অত্যন্ত গরিব দেশ, যেখানে ভালাে ঘরবাড়ি নেই এবং তাদের নিজস্ব উৎপাদনক্ষমতাও নেই। ফলে তাদের জন্য বাংলাদেশে অবাক বিস্ময় অপেক্ষা করছিল । সুতরাং যাকে আমরা উপদ্রব বিবেচনা করেছিলাম, সেটা বস্তুতই ছিল তাঁদের সদিচ্ছার নিদর্শন। ভারতীয় বেসামরিক কর্মকর্তা, যারা বিজয়ী সেনাবাহিনীর সঙ্গে আসেন, তারা অচিরেই প্রত্যাবর্তন করেন। ফেব্রুয়ারিতে তাদের খুব কমজনেরই দেখা আমি বাংলাদেশে পাই। নিজেদের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা খুব ভুল ছিল না। মার্চ মাসের প্রথমার্ধে আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও ফেরত পাঠিয়ে দিই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যেখানে নয় মাস আইনের কোনাে শাসন ছিল না এবং পাকিস্তানিরা তাদের তল্পিবাহক রাজাকার বাহিনী গড়েছিল, সেখানে আমরা নিজেদের হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করি। যেকোনাে জাতির জন্য এটি ছিল দারুণ আত্মশ্লাঘার বিষয়।
১৫ তারিখ মধ্যরাত পর্যন্ত আমরা আত্মসমর্পণের ঘােষণার অপেক্ষায় রইলাম । এন্টারপ্রাইজের গতিবিধি তখন সর্বজনবিদিত বলে তাতে আমরা তেমন গা করলাম না। আকাশপথ বা জলপথ কোনাে দিক দিয়ে পাকিস্তানিদের পলায়ন তখন আর সম্ভব ছিল না। শুধু একটি আশঙ্কা ছিল যে উন্মাদের মতাে না তারা চূড়ান্ত পরাজয়ের আগে একটি বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটায়। আমাদের আশঙ্কা এক হিসাবে সঠিক প্রমাণিত হয়। ১৪ তারিখ তারা বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদেরই হুকুমে আলবদরের সদস্যরা একটা পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়। একই দিনে তারা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তাদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সৌভাগ্যবশত প্রদেশপাল ডা. মালিক তাদের এই উদ্যোগ বানচাল করে দেন এবং সম্ভবত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন পাকিস্তানি বেসামরিক কর্মকর্তারাও এটি নাকচ করে দেন। মধ্যরাতের একটু পরই মােয়াজ্জেম ও নিশাতের টেলিফোনে পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত সুখবর। বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা ১৬ ডিসেম্বর অপরাহুে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। বাংলাদেশে সুদীর্ঘ কালরাত্রির অবসান হবে। ওয়াশিংটন সময় অনুযায়ী আর ঘণ্টা দুই পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি খুনি ও লুটেরা বাহিনীর জবরদখল শেষ হবে এবং বাংলাদেশ রাহুমুক্ত হবে। এই মুহূর্তটির জন্য বাঙালির নয় মাসের এত কষ্ট, এত বঞ্চনা, এত মৃত্যু ও এত ত্যাগ। এত দিনের ক্ষোভ ও বেদনার পরিসমাপ্তি হলাে মুক্তির আনন্দে।
২১৫
শেষ মুহুর্তের উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ছাপিয়ে এল বিজয়ের আনন্দ। এই আনন্দউৎসবে নিহিত ছিল কৃতিত্বের অনুভূতি, যদিও তা বেদনাহীন ছিল না। স্বজন হারানাের ব্যথা আর দেশ ধ্বংসের ক্ষোভ এই আনন্দ-উচ্ছাসের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। আমার মনে পড়ল সিকি শতাব্দী আগের ১৪ আগস্ট দিনটির কথা—কৈশােরের উচ্ছ্বাসভরা নিখাদ আনন্দের উৎসব, যার জন্য আমরা রাত জেগে ঘরবাড়ি ও চারপাশের পরিবেশ সাজানাের ধুমে মগ্ন ছিলাম। এবারকার আনন্দের অনুভূতি আরও গভীর হলেও তা ছিল ভিন্নমাত্রার, ব্যথায় মিশ্রিত এবং কৃতিত্বে দীপ্ত । অনেক দিন পর নিরুদ্বেগে এবং প্রশান্তির সঙ্গে ঘুমের আশ্রয় নিলাম।
অন্যান্য যেকোনাে দপ্তরের মতাে বাংলাদেশের মিশনেরও সময় ছিল নয়টাপাঁচটা। তবে প্রায়ই রাত আট-নয়টা পর্যন্ত সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হতাে। ১৬ ডিসেম্বর বােধ হয় সকাল নয়টার ঘণ্টাখানেক আগেই দপ্তরটি সরগরম হয়ে উঠল। শুধু বাঙালিরা নন, বাংলাদেশের সব বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী কিছু সময়ের জন্য হলেও বিজয় উৎসবে শামিল হলেন। মিশন অফিস সারা দিন লােকে লােকারণ্য। শুভেচ্ছা বিনিময়, হাত মেলানাে, কোলাকুলি আর সাময়িক আড্ডার মধ্যে সারা দিন কাটল। সর্বত্র হইচই, স্বস্তি আর আনন্দ। সাময়িকভাবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা হলাে বিতাড়িত। দিনের শেষে মিশনের সব কর্মী আমরা সমবেত হলাম আমাদের ভবিষ্যতের কার্যক্রম ঠিক করতে। এখন কী করা কর্তব্য? প্রথমেই তাে একটি সংবাদ সম্মেলন করে শােকরিয়া আদায় করতে হবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির রূপরেখা তুলে ধরতে হবে। কিন্তু বােধ হয় দূরত্বে অবস্থানের কারণে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় আসন্ন সমস্যাবলির দিকে। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা কেমন করে প্রতিষ্ঠা করা যাবে? কীভাবে অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে? কীভাবে অর্থনৈতিক পুনর্বাসন সম্ভব হবে? জনহিতকর প্রশাসন কেমন করে স্থাপিত হবে?
১৭ তারিখে আমাদের সংবাদ সম্মেলনে ভিড় হলাে খুব বেশি। আমরা আমাদের সব সমর্থক ও সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। ভারতকে তার বিশেষ অবদানের জন্য ধন্যবাদ জানালাম। বাংলাদেশের ধ্বংসলীলার কথা বর্ণনা করতে তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরলাম। জাতীয় পুনর্গঠনে জাতিসংঘ, বিশ্ব ব্যাংক, অর্থ তহবিল এবং অন্যান্য দেশের সাহায্য কামনা করলাম। দেশের আদর্শ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা তুলে ধরা হলাে। সমমনা ও সমগােত্রীয় বাঙালি জাতির পরিচয় দিতে গিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলাে যে অবাঙালি ও পাহাড়ি জনগােষ্ঠী হচ্ছে জাতির শক্তি এবং তাদের নিরাপত্তা ও বিকাশ হবে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবিলম্বে মুক্তির দাবিও তুলে ধরা হলাে।
২১৬
সংবাদ সম্মেলনে আমাদের প্রতিনিধি মােস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকীর ভাষণ সব সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশিত হলাে। ১৭ তারিখ মার্কিন সংবাদপত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খবর বেরােল, প্রথমটি হলাে পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতিতে সায় প্রদান এবং নেতৃত্বের পরিবর্তন-ইয়াহিয়া যে বিদায় হবেন, তাতে কোনাে সন্দেহ ছিল না। তবে ভুট্টো নাকি অন্য কোনাে সেনানেতা রাষ্ট্রভার গ্রহণ করবেন, তা নিয়ে ছিল কিছু অনিশ্চয়তা। দ্বিতীয় খবর ছিল ঢাকায় বিজয় উল্লাসকালীন কতিপয় পাকিস্তান-সহযােগীর শাস্তি। পত্রিকায় ছবি দিয়ে তাদের শাস্তিদানের খবর বেরােল আর প্রতিহিংসার সম্ভাব্য গতি নিয়ে মন্তব্য ছাপা হলাে। রেসকোর্স ময়দানে তিনজন বিহারির নির্যাতন নিয়ে ছিল এই হইচই এবং এদের প্রকাশ্য শাস্তিদানই সব মনােযােগ আকর্ষণ করে। তৃতীয় বিষয় ছিল নিক্সন প্রশাসনের নীরবতা। সংবাদপত্রগুলাে বাংলাদেশের দাবি, স্বীকৃতি ও সাহায্য-সম্পর্কিত বক্তব্য এড়িয়ে যায়। আমাদের সংবাদ সম্মেলনের খবরের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের নীরবতার খবরও বেরােল। প্রশাসনের সব মন্তব্য ছিল রাশিয়া সম্বন্ধে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঘােলা পানিতে মাছ শিকারের অভিযােগ তুললেন কিসিঞ্জার। নিক্সনের সঙ্গে রাশিয়ার শীর্ষ বৈঠকে উপমহাদেশ নিয়ে কথাবার্তা হবে বলে জানানাে হলাে। মােটকথা সংবাদপত্রগুলােতে বাংলাদেশের বিষয়টি ছেড়ে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক এবং উপমহাদেশে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি নিয়েই সরকারি সব বক্তব্য প্রকাশিত হলাে ।
১৬ ডিসেম্বর ভারত যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করল এবং ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করল, ইয়াহিয়ার আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি মেনে নিল এবং সেখানে নতুন সামরিক প্রশাসক হিসেবে ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। চীন ও আমেরিকার উদ্যোগ পাকিস্তানিদের পরাজয় ঠেকাতে পারল না এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাও বানচাল করতে পারল না। জাতিসংঘের ভূমিকা শুধু ত্রাণকার্য ও মানবিক সহায়তায়ই সীমাবদ্ধ রইল। যুদ্ধবিরতির কয়েক দিন পর ২১ ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে যেন নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিল। তবে এই প্রস্তাবের একটি সুফল ছিল। তা হলাে আনরবকে ত্রাণ ও পুনর্বাসনকাজ চালিয়ে যাবার এখতিয়ার প্রদান। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবটি পরিশিষ্ট ৪-এ সন্নিবেশিত হলাে।
২১৭
<p style="text-align: justify;"> দশম অধ্যায়
স্বাধীন বাংলাদেশে
১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর বিকেলেই বােধ হয় গেলাম বােস্টনে। আলমগীরের পুনর্বাসন পরিকল্পনা পাকা করা হবে। বােস্টনে নেমেই যেতে হলাে নৈশভােজে। তারপর রবার্ট ডর্ফম্যানের পপুলেশন সেন্টারে। প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে ছাপতে প্রায় মধ্যরাত হয়ে গেল। আলমগীরের বাড়িতে কয়েক ঘণ্টা ঘুমুতে না ঘুমুতে হয়ে গেল তাের। তারপরই ইয়েলের পথে পাড়ি। ইয়েলে থাকতেই শুনলাম ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার লােমহর্ষক কাহিনি। ওয়াশিংটনে টেলিফোন করলে আমার স্ত্রী জানালেন যে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমদও শহীদদের মধ্যে একজন। ইতিহাসের অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছর পর ভর্তি হয়। এই রকম কর্তব্যপরায়ণ, স্পষ্টবাদী ও দায়িত্বশীল ছাত্র খুব কম ছিল। জনসেবা ছিল তার জীবনের ব্রত । সে শুধু আমার বন্ধু ও সহকারী ছিল না। সে ছিল আমার পরিবারের একজন, যেমন আমি ছিলাম তার পরিবারের একজন। তার মতাে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি খুব কম ছিল এবং সে নিজে তাে ঝগড়ায় যেতই না, বরং সব ঝগড়ায় সমঝােতার চেষ্টা করত। এ রকম সােনার মানুষকে অমানুষ আলবদররা পৈশাচিক আনন্দে হত্যা করে।
১৯ তারিখে মার্কিন সংবাদপত্রে এই গণহত্যার খবর প্রকাশিত হলে তা সবাইকে ক্ষুব্ধ করে। ওয়াশিংটন পােস্ট ও ইভনিং স্টার এই মর্মান্তিক ঘটনার ওপর সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ড. নূরুল ইসলাম ঢাকা যাচ্ছেন। আমাদের খুব খুশি লাগছে কিন্তু সেই মুহূর্তে এই হত্যাকাণ্ডের খবরে মন খারাপ হয়ে গেল। কী জঘন্য প্রতিহিংসা, পরাজয়ের মুহুর্তে বাংলার কতিপয় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের—অধ্যাপক, ডাক্তার, শিল্পী, সমাজসেবককে—কী নৃশংসভাবেই না হত্যা করা হলাে! এমন বীভৎস কায়দায় হত্যা শুধু ধর্মোন্মাদ নরপশুদের পক্ষেই
২১৮
সম্ভব। তা না হলে হৃৎপিণ্ডের ডাক্তারের হৃৎপিণ্ডটাকে আর কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে পারে? চোখের ডাক্তারের চোখ ওপড়াতে পারে কে? লেখকের হাত কাটতে, কিংবা অধ্যাপকের জিহ্বা ছিন্ন করতে পারে কে? বিগত দিনের রাজাকারদের অত্যাচারের কাহিনি এই নৃশংসতার কাহিনির কাছে ম্লান হয়ে গেল। ওয়াশিংটনে যখন ফিরলাম, বুদ্ধিজীবী হত্যাই হলাে আমাদের আলােচনার এবং শােকের একমাত্র বিষয়।
সামনে ঈদুল আজহা। প্রশ্ন হলাে, ওয়াশিংটন ইসলামিক সেন্টারের জামাতে আমরা যাব কি যাব না। এই সেন্টারে আমাদের বিরােধী প্রচারণা চলেছে। সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় যারা প্রভাবশালী, তারা সবাই পাকিস্তানের বন্ধু, বেশির ভাগই আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ইসলামের নামে আমাদের ওপর যে নির্যাতন চলেছে নয় মাস ধরে, তার প্রতিবাদে সেন্টারের জামাতে নামাজই পড়তে চায় না। অন্যদিকে ড. শামসুল হক বাঙালিদের জন্য অন্যত্র একটি জামাতের ব্যবস্থাও করে ফেলেছেন। শামসুল হক ছাত্রজীবনে। আমাদের সমসাময়িক ছিলেন, বাণিজ্য অনুষদে পড়াশােনা করেন। তিনি বেশ আগেই আমেরিকায় পাড়ি দেন এবং ওয়াশিংটনে তার একটি ছােটখাটো গােষ্ঠী ছিল। মনে হয়, তারা এখনাে ওখানেই আছেন। আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা সদম্ভে এবং সরবে ইসলামিক সেন্টারে যাব এবং নামাজ আদায় করব। আমাদের দিক থেকে একটাই শর্ত : একটি বৃহৎ মুসলমান-অধ্যুষিত দেশের নতুন। পতাকা সেন্টারে অন্যান্য পতাকার সঙ্গে ওড়াতে হবে। মােয়াজ্জেম আমাকে জোরেশােরে সমর্থন করল, আতাউর রহমান চৌধুরীও ভেবেচিন্তে সম্মতি দিল।
আমাদের স্টাফদের বেশির ভাগই সেন্টারে আমাদের প্রতিষ্ঠা চায়। সেন্টার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলােচনা শুরু হলাে। মসজিদের ইমাম সম্ভবত একজন মালয়েশীয় মুসলমান, তিনি আমাদের পক্ষ সমর্থন করেন। অবশেষে আমাদের পতাকা ওড়ানাের সিদ্ধান্ত হলাে। মিশনের খুব কম ব্যক্তিই সেন্টারে নামাজ পড়তে গেলেন, তাঁদের বেশির ভাগ ড, হকের জামাতে যােগ দেন। আমি সপরিবার মসজিদে গেলাম এবং নামাজ শেষে আমরা সব বাঙালি আমাদের পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম । সেন্টারে পাকিস্তানি মিশনের মালিক সাহেব ও তার ছেলে টিটো এবং শ্যালকও উপস্থিত ছিলেন। আমি মালিক সাহেবকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে তিনি পালানাের পাঁয়তারা করেন, তবে তাঁর ছেলে ও শ্যালকের জন্য তা হয়ে উঠল না। তাঁদের সঙ্গে প্রায় পাঁচ মাসে এই প্রথম দেখা, তারা খুশি হয়। ঢাকায় আমাদের সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠ । পাকিস্তান ধর্মের যে অপব্যবহার করে, তাতে দেখলাম অনেক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিও এই ঈদের জামাতে যােগ দিতে ইতস্তত করে। ক্ষোভ তখনাে ছিল তুঙ্গে। পরবর্তী ঈদুল ফিতরের
২১৯
আগেই আমরা ইসলামিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা বাের্ডের সদস্য হই এবং সেই জামাতে সব বাঙালিই সাগ্রহে শরিক হয়।
ঘটনাস্থল থেকে দূরত্ব সমস্যা বিশ্লেষণ এবং দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনার সুযােগ করে দেয়। ডিসেম্বরের অবশিষ্ট দিনগুলােতে আমি দুটি কাজে হাত দিই। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বলগ্নে আমি ফ্লতে শয্যাশায়ী ছিলাম, আবার বিজয়ের পরমুহুর্তে একই অসুখে শয্যাশায়ী হলাম। এবার বাড়ির সবাই মিলে শয্যাশায়ী। টেলিফোনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হলাে এবং ফার্মেসিকে বাড়িতে ওষুধ সরবরাহ করতে বলতে হলাে। যা-ই হােক, জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার সানফ্রানসিসকোতে যাবার কথা। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়া কেন্দ্রে বাংলাদেশ নিয়ে ১৩ জানুয়ারি আলােচনা সভা হবে। এই সম্মেলনে যাবার আগেই আমার হাতের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। কাজের একটি ছিল প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্বিন্যাস সম্বন্ধে একটি প্রতিবেদন। এটি ছিল ফরমায়েশি কাজ, প্রধানমন্ত্রীর হুকুমে প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। আমার প্রস্তাবগুলাে আমি ৪ জানুয়ারি মহাসচিব রুহুল কুদুসের কাছে পাঠাই। ঢাকায় পৌছে জানতে পারলাম যে আমার কোনাে প্রস্তাবই কমিটির মনঃপূত হয়নি। কারণ, প্রস্তাবগুলাে নাকি ছিল বৈপ্লবিক। এ রকম অনেক প্রস্তাব নিয়ে আমি এখনাে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছি। কতগুলাে মৌলিক প্রস্তাব হলাে ১. সচিবালয় ও দপ্তর-পরিদপ্তর বা সংস্থার মধ্যে কাজের বর্তমান বিভাজন রহিত করে প্রতিটি দায়িত্বের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ এজেন্সি স্থাপন। নীতিনির্ধারণ হবে রাজনীতিবিদদের কাজ, বাস্তবায়ন হবে এজেন্সির দায়িত্ব। ২. সরকারে কেরানিকুল থাকবে না। সবাই নিজের স্তরে সিদ্ধান্ত দেবে, শুধু কাগজ চালাচালি করবে না। ৩. অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়ের সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণের অবসান এবং এজেন্সিগুলােকে তাদের বাজেট ও আইন বানানাে এবং তা প্রয়ােগের ক্ষমতা প্রদান। ৪. অর্থনীতি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে একত্রে রাখা এবং সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ৫. স্বয়ম্ভর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের জাতীয় রাজস্বের সিংহভাগের ওপর কর্তৃত্ব প্রদান। ৬. সব সার্ভিস ক্যাডারের বিলুপ্তি করে কতগুলাে গ্রেড সৃষ্টি। প্রতিটি এজেন্সি ও স্থানীয় সরকার তাদের আমলাদের এসব গ্রেডে নিযুক্তি বা পদোন্নতি দেবে। এ ছাড়া সাধারণভাবে কিছু প্রস্তাব ছিল যেমন সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আদম ও কৃষিশুমারির কাজ শুরু করা, পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নেওয়া এবং শক্তিশালী জনসংখ্যা পরিকল্পনা কার্যক্রম গ্রহণ করা।
আমার দ্বিতীয় কাজটি ছিল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে একটি রূপরেখা প্রণয়ন। এ বিষয়ে ২৩ ডিসেম্বরই একটি সংক্ষিপ্ত প্রস্তাব মিশন
২২০
প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠায়। সেটাকে একটি সম্পূর্ণ প্রতিবেদন হিসেবে ১০ জানুয়ারি আমি মহাসচিবের কাছে পাঠালাম। এই প্রতিবেদনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কয়েকটি বিষয়ে মনােযােগ দিতে বলা হয়। প্রথম বিষয়টি ছিল মুদ্রামান নির্ধারণ এবং রপ্তানি উদ্যোগ। অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন ছিল অত্যন্ত জরুরি। মানবসম্পদ রপ্তানির ওপর জোর দেবার প্রস্তাব ওঠে। দ্বিতীয় বিষয় ছিল বৈদেশিক সাহায্য। পাকিস্তানের দেনা সম্বন্ধে সিদ্ধান্তের প্রয়ােজন ছিল আর সেখানে বাংলাদেশে অবস্থিত প্রকল্প ও বাস্তবায়নরত প্রকল্প বিষয়ে সিদ্ধান্তটিই ছিল জরুরি। তৃতীয় বক্তব্য ছিল পুনর্বাসন পরিকল্পনা নিয়ে। জাতিসংঘের ত্রাণ উদ্যোগের সুযােগ নিয়ে এই কার্যক্রম অবিলম্বে শুরু করা ছিল সমীচীন। একই সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি উন্নয়ন কার্যক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন ছিল আরেকটি জরুরি বিষয়। চতুর্থ বিষয় ছিল বিশ্ব ব্যাংকের সাহায্য। বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের সদস্য হওয়া, দাতা সংস্থা গড়ে তােলা, পুনর্বাসন কার্যক্রমে সাহায্য আদায় এবং উপমহাদেশীয় পানিসম্পদ উন্নয়নে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা—এই চারটি সুপারিশ আমি প্রদান করি।
বিশ্ব ব্যাংকের সভাপতি ম্যাকনামারা জানুয়ারিতে ভারত সফরে যাচ্ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানাের জন্য আমরা সুপারিশ করি। বস্তুতপক্ষে ম্যাকনামারা কয়েক ঘণ্টার জন্য ঢাকায় যান। এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে রেহমান সােবহান তাঁর দেখাশােনা করেন। আমার সর্বশেষ বিষয় ছিল বৈদেশিক বিনিয়ােগ। বৈদেশিক ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ না করে নির্দিষ্ট খাতে বৈদেশিক বিনিয়ােগের সুযােগ দান, বৈদেশিক বিশেষজ্ঞ গ্রহণ করা এবং বৈদেশিক মূলধনকে দেশি বিনিয়ােগের সমতুল্য সুযােগ-সুবিধা প্রদান ছিল আমার প্রতিবেদনের প্রস্তাব। এ বিষয়ে ফেব্রুয়ারি-মার্চে ঢাকায় পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে অধিকতর কাজ করার আমার সুযােগ হয়।
জানুয়ারির প্রথম দিকে সিদ্দিকী সাহেব ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌছে তাঁকে তক্ষুনি লন্ডনে যেতে বলেন। কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই তিনি ঢাকা যাবেন। কিন্তু তাঁর ভ্রমণসংক্রান্ত কাগজপত্র ঠিক ছিল না বলে কদিন পর তিনি ঢাকায় যান। কিছুদিনের মধ্যেই এস এ করিম এবং এস এ এম এস কিবরিয়াকেও ঢাকায় তলব করা হলাে। এস এ করিম হলেন পররাষ্ট্রসচিব এবং কিবরিয়া প্রথমে মহাপরিচালক ও পরে সচিব। এর মধ্যে ড. নূরুল ইসলাম বার্তা পাঠালেন যে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়েছে এবং কমিশনে তারা আমাকে চান।
২২১
<p style="text-align: justify;"> একাদশ অধ্যায়
পুনর্গঠন ও পরিকল্পনা প্রণয়নের সূচনা
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিল আশা-হতাশা, সাফল্য-ব্যর্থতা, সুখ-দুঃখ ও আনন্দ বেদনার নাগরদোলাবিশেষ। আগেই বলেছি, ওই পর্বে আমার সময় কাটে নানা দেশের খবরের কাগজে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ আহরণ করে । নানা পত্রিকায় এ সময় বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রবন্ধ, মন্তব্য ইত্যাদি অনেক কিছু লেখা হয়। তার চেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এবং পাকিস্তানের বর্বর কার্যকলাপ নিয়ে বিতর্ক ও বক্তব্য। এই ব্যস্ততার মধ্যে মাঝেমধ্যে মনে হতাে কী। করে আমরা ২৩টি বছর এমন একটি গােষ্ঠীর সঙ্গে কাটালাম, যারা এমন হিংস্র ও পৈশাচিক হতে পারে এবং এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে। কিন্তু যতই সময় যেতে থাকল, মনে হলাে, নৈতিকতার মানদণ্ডে আমাদের অবস্থান ছিল উঁচুতে এবং ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে সব দিক দিয়ে আমাদের ভূমিকা ছিল প্রশংসিত। আমরা ছিলাম অবনমিত ও দলিত গােষ্ঠী, যারা হঠাৎই ভীষণভাবে আক্রান্ত হয়। একটি শান্তিপ্রিয় জাতিকে আত্মরক্ষার জন্য রাতারাতি অস্ত্র হাতে নিতে হলাে। প্রতিবেশী ভারতের আশ্রয়, সহায়তা ও সহমর্মিতা আমাদের পাকিস্তানের হিংস্র আক্রমণকে রুখে দাঁড়াতে সাহস ও শক্তি জোগায়। আমাদের সহজাত বুদ্ধি বাতলে দেয় গেরিলা যুদ্ধের কৌশল, শিখিয়ে দেয় তার ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতা।
একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিপুল বিজয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অবশেষে দেশে স্বশাসন প্রতিষ্ঠিত হলাে এবং ধ্বংস ও হত্যার কালরাত্রির অবসান ঘটল । ওয়াশিংটনে বসে আমার মনে হলাে যে যেভাবেই হােক আমাকে স্বাধীন বাংলাদেশে যেতে হবে। সেখানে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে কোনাে না কোনাে ভূমিকা আমি অবশ্যই রাখতে পারি। আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল স্বাধীন দেশটির জন্য এমন একটি প্রশাসনব্যবস্থার ব্যাপারে, যা হবে একই সঙ্গে জনকল্যাণকামী, জনপ্রতিনিধিদের
২২২
অনুগত এবং তাঁদের কাছে দায়বদ্ধ। এ জন্য আমি সামান্য কিছু কাজ করে একটি পরিকল্পনাও তৈরি করে ফেলেছিলাম। ঠিক সেই সময় হাওয়াই জাহাজে ভ্রমণের ক্ষেত্রে স্যার ফ্রেডি লেকার এক বিপ্লব সাধন করলেন। নিউইয়র্ক থেকে দিল্লি যাত্রায় আগে যেখানে বিমানভাড়া ছিল প্রায় ১ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার, সেটা তাঁর উদ্যোগে নেমে এল ৪৫০ ডলারে। আমি স্থির করলাম যে আমাকে ঢাকায় যেতেই হবে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সরকারের জন্য আমি কাজ করতে পারি। আমার ৭০ বছরের বৃদ্ধ পিতা, যাকে অনেক ঝামেলা করে পাকিস্তানি ফাঁদ এড়াতে হয়েছে, তাকে এবং আম্মাকে সালাম জানানাে, আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া এবং স্বচক্ষে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা সম্পর্কে। ধারণা লাভ করাও ছিল আমার উদ্দেশ্য।
আমি যখন এ রকম চিন্তা করছি, তখন একদিন ডাক এল বিশ্ব ব্যাংক সভাপতি রবার্ট ম্যাকনামারার দপ্তর থেকে। তার নির্বাহী সহকারী জুলিয়ান ক্রিস্টিয়ানসেন টেলিফোন করে আমাকে জানালেন যে ম্যাকনামারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমি তার দপ্তরে হাজির হলাম। তিনি বললেন যে তিনি কিছুদিনের মধ্যে ভারত ভ্রমণে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাজি হলে তিনি এই সুযােগে এক দিনের জন্য দিল্লি থেকে ঢাকায় গিয়ে সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনা করতে চান। সম্ভবত তিনি একটি তারিখও দিলেন, যা ছিল ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২। আমি তাকে জানালাম যে আমি যত জলদি পারি, ঢাকার সঙ্গে যােগাযােগ করে তাকে জবাব দেব। আমি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এবং অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে রেডিওগ্রাম পাঠালাম এবং পরবর্তী সারা দিন কখন টেলিফোন আসে, এই আশায় বাড়িতে বসে রইলাম। অবশেষে ঢাকার সঙ্গে যােগাযােগ হলাে, সম্ভবত তৃতীয় দিনে। আমার মনে হলাে যে ঢাকায় ম্যাকনামারার ইচ্ছা প্রকাশটিই একটি আলােচনার বিষয় হয়ে থাকতে পারে। বিশ্ব ব্যাংককে নানা মহলে আমেরিকার প্রভাব বিস্তারের একটি প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করা হতাে। তাই বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে মতৈক্যের অভাব ছিল। ম্যাকনামারার উদ্দেশ্য অবশ্য মহৎ বলেই গৃহীত হয়। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর অভিমত পাওয়া গেল যে তিনি ম্যাকনামারাকে ঢাকায় যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
আমি দেখলাম আমার জন্য এটি ঢাকায় যাবার সুবর্ণ সুযােগ। আমি আমার ভ্রমণসূচি বানিয়ে এয়ার ফ্রান্সের বিমানে ২৯ জানুয়ারি দিল্লি পৌছার ব্যবস্থা নিলাম। দিল্লি থেকে ম্যাকনামারার সঙ্গে আমি ঢাকায় যাব। কিন্তু আমার এই ভ্রমণসূচি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাহত হলাে। প্যারিস পর্যন্ত ঠিকই পৌছালাম। সেখানে একটি রাত কাটিয়ে পরের দিন আবার এয়ার ফ্রান্স ধরলাম সকাল ১০টায়। আমার ভ্রমণসূচি অনুযায়ী আমি ২৯ জানুয়ারি সকালে দিল্লি পৌছাব ।
২২৩
দিল্লিতে দিনটা কাটিয়ে রাতে কোনাে হােটেলে থেকে ৩০ তারিখ সকালে ঢাকার পথে বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারার সহযাত্রী হিসেবে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিমানে ঢাকায় যাব। ম্যাকনামারা সাহেব সেদিন অপরাহেই দিল্লি ফিরে যাবেন, তবে আমি থাকব প্রায় আড়াই মাস ।
এই ছিমছাম ভ্রমণসূচি কিন্তু বাস্তবে কার্যকর হলাে না। প্যারিস ছিল সেদিন বৃষ্টিস্নাত । প্যারিস ছাড়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের বিমান এক ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেল। বৃষ্টির ধারা ছিল অবিরাম আর সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যেই বজ্রপাত হচ্ছিল। হঠাৎ আমাদের বিমানে যেন বজ্রাঘাত হলাে, পুরাে বিমান দারুণভাবে কেঁপে উঠল। পাইলট জানালেন যে ঝড়ের কারণে বিমানকে কিছুক্ষণের মধ্যেই দক্ষিণ ফ্রান্সের নিস শহরে নামতে হবে, সময় লাগবে হয়তাে ১৫-২০ মিনিট। আমরা নিসে নামলাম। আমাদের লাউঞ্জে নিয়ে যাওয়া হলাে। কিছু পানীয় ও খাবার দেওয়া হলাে। জানাল যে অতিসত্বর মধ্যাহ্নভােজের ব্যবস্থা হবে। ভােজের পর আমার চিন্তার বিষয় হলাে যাত্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমাকে তাে ২৯ জানুয়ারি দিল্লি পৌছাতেই হবে। আমি খুঁজে পেলাম একজন বৈমানিককে। তিনি জানালেন যে তিনিই আমাদের নিসে নামিয়েছেন। তার কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, আমরা আর কতক্ষণের মধ্যে দিল্লির পথে রওনা দেব। তিনি আমাকে বললেন যে আমি যেন তাকে অনুসরণ করি। তিনি আমাকে নিয়ে বিমানবন্দরের এয়ার টাওয়ারে উঠলেন। তারপর বিমানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ওই যে দেখুন, বিমানের হাম্পটিতে বজ্রাঘাতে একটা বিরাট গর্ত তৈরি হয়েছে। তা নিয়েই বিমানটি কোনােমতে এয়ারপাের্টে নেমেছে। এখন এই বিমানে বড় রকমের মেরামত লাগবে। এয়ার ফ্রান্স প্যারিস থেকে আরেকটি হাওয়াই জাহাজ পাঠাচ্ছে। সেটাতেই আমাদের দিল্লি যাওয়া হবে। আজ রাতটা এখানেই থাকতে হবে। সকালে যত দ্রুত সম্ভব নতুন বিমানটি দিল্লির পথে উড়াল দেবে। এয়ার ফ্রান্স এখন আপনাদের রাত্রিযাপনের জন্য হােটেল-মােটেল খুঁজছে।
আমি হিসাব করে দেখলাম যে আমার তাহলে আর ম্যাকনামারার সঙ্গে ঢাকায় যাওয়া হবে না। খানার টেবিলে দেখা হলাে আমার সমসাময়িক নাট্য অভিনেতা মকসুদুস সালেহিনের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর তার সঙ্গে খুব কমই দেখা হয়েছে। আমি তাঁকে সম্ভবত ১৯৬১ সালে হাওয়াইতে নাট্য প্রশিক্ষণের সুযােগ করে দিই। তারপর তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তাঁর সহযাত্রী ছিলেন আরও দুজন বঙ্গসন্তান, তাঁরা সবাই ঢাকাযাত্রী, তবে তারা কলকাতা পর্যন্ত যাত্রার নিশ্চয়তা পেয়েছেন। ঢাকায় তখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে শুধু ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ডাকোটা বিমানই যাত্রী নিয়ে অবতরণ করতে পারত। ত্রাণসামগ্রী পরিবহনের জন্য ছােট আয়তনের বিমানই শুধু যেতে পারত।
২২৪
বিমানবন্দরটি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর আক্রমণে যুদ্ধের শুরুতেই (৩ ডিসেম্বর) অব্যবহার্য হয়ে যায়।
৩০ জানুয়ারি সকাল প্রায় ১০টায় আমরা একটি বিমানে চড়ে আবার দিল্লির পথে পাড়ি দিলাম। মাঝে দু-তিনটি যাত্রাবিরতি ছিল, যেখানে বিমান তেল নেয় আর আমরা চা-নাশতা করি। ৩১ জানুয়ারি সকাল নয়টায় আমরা দিল্লি পৌছালাম। আমার কোনাে হােটেল ঠিক করা ছিল না। সালেহিনরা আমাকে ক্ল্যারিজ হােটেলে নিয়ে গেলেন। তখন ক্ল্যারিজের বড় দুরবস্থা। হােটেলটা বেশ পুরােনাে ও নােংরা। বিছানায় মনে হলাে ছারপােকাও আছে। কাপড়চোপড় বদলে আমি বললাম যে আমি বাংলাদেশ মিশনে যাচ্ছি। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আছেন। তিনি আমাদের ঢাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। তাঁকে টেলিফোন করে ঠিকানা নিয়ে আমি কৈলাসটিলায় আমাদের দূতাবাসে গেলাম। তিনি জানতেন যে আমি ম্যাকনামারার সঙ্গে ঢাকায় যাব। তাঁকে আমাদের দুর্ঘটনার কথা বললাম। তিনি জানালেন যে ঢাকাকলকাতায় যােগাযােগ করে তিনি পরের দিনই আমার ঢাকায় যাত্রা নিশ্চিত করতে পারবেন, তবে সালেহিন ও তার বন্ধুদের কলকাতায় হয়তাে আরও দুতিন দিন অপেক্ষা করতে হবে। তিনি আমাকে পাশের একটি কামরায় অপেক্ষা করতে বললেন আর সালেহিনরা বিদায় নিয়ে গেলেন। খানিক পর তিনি আমাকে বললেন যে দুপুরে তার সঙ্গে খেতে হবে এবং বিকেলে বন্ধুদের এক সভায় বক্তৃতা দিতে হবে। তখন দিল্লিতে বাংলাদেশ নিয়ে রােজই সভা-সমিতি হয় এবং মিশনের চার-পাঁচজন কর্মকর্তাকে নানা সভায় বক্তৃতা করতে হয়।
আমাকে বিকেল চারটার সময় একজন মিশন কর্মকর্তা একটি সভায় নিয়ে গেলেন। সেখানে আমার বক্তব্য ছিল যে ব্রিটিশ শাসনের প্রাক্কালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে প্রায় সারা ভারত–আসাম ও বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তান-বেলুচিস্তান পর্যন্ত এবং কাশ্মীর থেকে সিংহল সীমান্ত পর্যন্ত ছিল একটি সাম্রাজ্য। ব্রিটিশ আমলেও শেষ পর্যন্ত সারা ভারত ছিল একটি দেশ। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে দেশ বিভাগ হয়ে দুটি দেশ হলাে—ভারত ও পাকিস্তান। তাদের মধ্যে জন্মলগ্ন থেকেই ছিল বিরােধ। সেই বিরােধ থেকে ১৯৪৮ সালেই দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ হয় এবং তারপর আর কখনাে তাদের মধ্যে মৈত্রীর সুযােগ হয়নি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ফলে এই সুযােগটি এবার এসেছে এবং আমি একটি Commonwealth of South Asia-র স্বপ্ন দেখছি। আমার সেদিনের সেই স্বপ্ন অবশ্য এখনাে স্বপ্নই রয়ে গেছে, তবে প্রায় ৭০ বছর পর বর্তমানে এটি সম্ভব হতে পারে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখাকে মেনে নিলে ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের মীমাংসা পাওয়া যেতে পারে। আর এই তিন দেশের মধ্যে ভ্রমণের সুযােগ
২২৫
বাড়লে আমার স্বপ্নের সেই কমনওয়েলথ সত্যিই স্থাপিত হতে পারে। প্রার্থনা করি আমাদের উপমহাদেশের সবার সুমতি হবে এবং শান্তির সুবাতাস আমাদের আচ্ছাদন করবে। হােটেলে ফেরার আগে আমি জানলাম যে ৩১ জানুয়ারি সকালে আমি কলকাতায় যাচ্ছি এবং ঘণ্টাখানেক কলকাতায় অপেক্ষা করে প্রায় ১০টায় ঢাকায় পৌছাব।
১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পৌছালাম। তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে আমার সে কী অনুভূতি! সর্বত্র ধ্বংসের চিহ্ন কিন্তু তার সঙ্গে সর্বত্রই মুক্তির আনন্দ। আরও ভালাে লাগল আমার ভ্রমণসূচি বানচাল হওয়া সত্ত্বেও তেজগাঁওয়ের ভাঙা বিমানবন্দরে আমার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতি দেখে।
অক্টোবর কি নভেম্বরে ওয়াশিংটনে শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ এ কে খানের সঙ্গে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে কথা হচ্ছিল। এ কে খান ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পপতি। তিনি বহুদিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন এবং তখন থেকে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি সুশিক্ষিত, সুরুচিসম্পন্ন উন্নত মনের মানুষ ছিলেন। বুদ্ধি-বিবেচনায় নমস্য ব্যক্তি। একাত্তরের এক সময় তিনিও দেশ পরিত্যাগে বাধ্য হন। কিছুদিন রােড আইল্যান্ডে তার জামাই মুনিরের (আমাদের সমসাময়িক পদার্থবিদ) ওখানে থেকে তিনি ওয়াশিংটনে আসেন। তার বড় মেয়ে তখন ওয়াশিংটনে। মােস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন তাঁর বড় জামাই। জনাব ও বেগম এ কে খানের বাংলাদেশের অবশ্যম্ভাবী স্বাধীনতা সম্বন্ধে কোনাে সন্দেহ ছিল না। কিন্তু একটি বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নিয়ে ছিল তার উদ্বেগ। নতুন দেশ গঠনে যে অনেক ত্যাগ ও নিবেদিত সেবার প্রয়ােজন হবে, সে সম্বন্ধে তিনি ছিলেন সােচ্চার। তিনি বলেছিলেন যে মুক্ত বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাধান্য পাবে। তবে এ ব্যবস্থার সাফল্যের জন্য পুরােনাে মিলমালিক বা ব্যবস্থাপকদের যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে সমাজে একধরনের সমতা বিরাজ করবে আর ধনীদের প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তিনি বলেন যে তাঁর শিল্প বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে তাঁর কোনাে আপত্তি বা খেদ থাকবে না। তবে তিনি চাইবেন যে ওগুলাে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হােক। কথায় কথায় তিনি বললেন, কিছুদিনের জন্য অন্তত স্যুট-কোট-টাই বাদ দিতে হবে। আমাকে যদি সরকার আমারই একটি বস্ত্র মিল সরকারের তরফ থেকে পরিচালনা করতে বলে, আমি সানন্দে সেই দায়িত্ব নেব।’
বাংলাদেশে যাওয়ার সময় এ কে খান সাহেবের কথা মনে পড়েছিল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ধ্বংসলীলার অনেক খবর পেয়েছি। সরকারের কৃচ্ছতা নীতির কথাও শুনেছি। তাই আমি খুঁজে পেতে পুরােনাে হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট
২২৬
বাক্সবন্দী করি। তারপর শুধু একটি স্যুট গায়ে এবং ছােট একটি পুরােনাে স্যুটকেস আর হাতব্যাগ নিয়ে ঢাকায় অবতরণ করলাম। বাংলাদেশে পরবর্তী আড়াই মাসে উপলব্ধি করলাম যে আমার হিসাব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপকভাবে আদর্শবাদ কাজ করে। এখন আমরা অবশ্য অনেক কোন্দল, অনেক ষড়যন্ত্রের কথা জানি। কিন্তু একই সঙ্গে তখনকার ব্যাপকতর যে বাস্তবতা ছিল, তাতে ছিল সুউচ্চ আদর্শবাদ, দেশকে নিয়ে গর্ব এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সুন্দর স্বপ্নের প্রাধান্য। ন্যায়ের প্রতি ছিল গভীর আকর্ষণ এবং দেশকে গড়ার জন্য এবং দেশের মুক্তির জন্য সব রকম ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা। সেই সঙ্গে সবাই মিলে দুঃখ-কষ্ট ভাগ করার সদিচ্ছা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা । কিন্তু এই আদর্শবাদ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অন্যকে বঞ্চিত করে সুযােগ গ্রহণ, পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করার ফন্দিফিকির এবং কখনাে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার বাসনা—এসব নীতিবিগর্হিত উদ্যোগ ক্রমেই শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। সবচেয়ে দুঃখজনক ছিল সােনালি স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ এবং ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল তরুণ-যুবাদের পদস্খলন। পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করার আহ্বান পেয়েছিলাম ওয়াশিংটন ছাড়ার আগেই। ঢাকায় পৌছেই শুনলাম যে আমাকে ওই কমিশনে সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। হবু সচিব হিসেবে আড়াই মাস ঢাকায় ছিলাম কিন্তু ওই পদে আমি আসীন হইনি।
ঢাকায় আমার আস্তানা হলাে এম মােকাম্মেল হকের সরকারি বাড়ি, যেটা ছিল ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রাস্তায়। আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম ১৯৬৯ সালের জুন মাসে। অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর পর আমি ঢাকায় এলাম। একনাগাড়ে এত দিন আমার কখনাে বাংলাদেশের বাইরে থাকা হয়নি। মােকাম্মেল হক তখন ছিলেন সমন্বিত গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রমের’ শীর্ষ কর্মকর্তা। তাঁর দপ্তর ছিল দিলকুশায় এবং সেখানে সচিবালয়ের ভিড় বা ব্যস্ততা তেমন ছিল না। আমার আড়াই মাসব্যাপী ঢাকায় অবস্থানকালে ধানমন্ডিতে সমন্বিত গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রমের মহাপরিচালক মােকাম্মেল হকের (পরে সচিব) বাড়িতে (পুরােনাে ১৫ নম্বর সড়কে) আমি আস্তানা গাড়ি। এ ছাড়া ২০ নম্বর সড়কে জিয়াউল হক টুলুর বাড়িও হয় আমার এক আড্ডাখানা। টুলুর বাড়িতে তখন সবার আনাগােনা—পরিকল্পনা কমিশনের কর্তারা, আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এবং সচিবালয়ের কর্ণধারেরা। ঢাকায় সবে একটি কূটনৈতিক মহল। গড়ে উঠেছে। তাঁদেরও আসর জমে টুলুর বাড়িতে। এই সময়ে পরিচয় হয়। মুক্তিযুদ্ধকালের অত্যন্ত সফল কুরিয়ার এবং বর্তমানের সংসদ সদস্য রহমতুল্লার সঙ্গে। গাড়ি নিয়েও আমার সমস্যা ছিল না। সকালে দপ্তরে যাওয়া এবং বিকেলে। ফিরে আসা মােকাম্মেলের সঙ্গেই হতাে। বন্ধু জিয়াউল হক টুলুও নানা জায়গায় নিয়ে যেতেন। আমার ভাই সুজনেরও বােধ হয় গাড়ি ছিল ।
২২৭
আমি যেদিন ঢাকায় পৌছালাম, সেদিন এবং পরবর্তী কয়েক দিন যেখানে যাই, যার সঙ্গে আলাপ করি; সেখানেই শুনি মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার এবং রাজাকার ও আলবদরদের নিষ্ঠুরতার পাশাপাশি জীবন রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের কৌশল, অগণিত লােকের পালিয়ে বেড়ানাের কাহিনি এবং মুক্তিযােদ্ধাদের, বিশেষ করে গেরিলা বাহিনীর বীরত্বগাথা ছিল ওই সময়ের সব গালগল্পের মূল কথা। এরই একপর্যায়ে শুনি মানুষের অন্তহীন সমস্যার কথা, অভাবের কাহিনি, রসদের অপ্রতুলতার উল্লেখ । একই সঙ্গে অনুভব করি মানুষের দুর্জয় আত্মপ্রত্যয় ও সীমাহীন আশাবাদ। দপ্তরগুলােতে কোনাে সময় বেঁধে দেওয়া নেই। সবাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত । বেতন যে মারাত্মকভাবে কমানাে হয়েছে (সর্বোচ্চ বেতন তখন এক হাজার টাকা) এবং পণ্যদ্রব্য সরবরাহ যে খুবই সীমিত, তাতে কেউ তেমন বিচলিত নয় । কষ্টের সময়, কিন্তু তাতে কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না।
সেই ১ ফেব্রুয়ারির সকালবেলায়ই আমার মােলাকাত হয় জাতির জনক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। আমি বেলা ১১টায় সচিবালয়ের বিশেষভাবে সংরক্ষিত ১ নম্বর ব্লকে উপস্থিত হলাম। তখন ওই দালানটি ছিল তিনতলা এবং সেই তিনতলার দক্ষিণ কোণে ছিল তাঁর দপ্তর। আমি তার কামরায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসতে বললেন। কুশলাদি বিনিময়ের পরই তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে ওয়াশিংটনে আমাদের ভূমিকার প্রশংসা করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন আমি কি ঢাকায় চাকরি করতে এসেছি? আমি বললাম, স্যার, এই বিষয়ে পরে আলাপ হবে। এখন এসেছি আপনার কাছ থেকে কী হুকুম, তা শুনতে। অনেকক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে কথাবার্তার পর সম্ভবত রফিকুল্লাহ চৌধুরী কামরায় এসে বঙ্গবন্ধুকে বললেন যে Le Monde-এর প্রতিনিধি জেরার্ড ভিরাটেলের সঙ্গে তাঁর মােলাকাতের সময় হয়ে গেছে এবং ভিরাটেল এসে গেছেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি বসাে এবং আমার এই মােলাকাতের সময় উপস্থিত থাকবে।’
আমি একটু দূরে গিয়ে বসলাম এবং জেরার্ড ভিরাটেল কামরায় প্রবেশ করলেন। তাঁকে তিনি সহাস্যে অভ্যর্থনা জানালেন এবং আমার পরিচয় তাঁকে দিলেন এই বলে যে আমি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী, যে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের দূতাবাসে কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা। রেখেছে। ভিরাটেলের সঙ্গে তার মােলাকাত প্রায় আধঘণ্টা কি তারও বেশি সময় চলল। পাকিস্তানিরা যে দেশটাকে কীভাবে ধ্বংস করে গেছে, তিনি সে সম্বন্ধে অনেকক্ষণ কথা বললেন। তিনি আরও জানালেন যে যারা পাকিস্তানি অত্যাচারে দেশত্যাগী হয়, তাদের পুনর্বাসনই এখন প্রধান কর্তব্য। দেশের অবকাঠামাে
২২৮
যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তাতে বড় সমস্যা হলাে দেশে যাতায়াতের ব্যবস্থা সত্বর। পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তিনি এ-ও বললেন যে নয় মাস জনগণ যে কষ্ট ও দুঃখের মধ্যে জীবন যাপন করেছিল, তার অবসানে এ দেশে নতুন উদ্যম এবং অসীম আশার সঞ্চার হয়েছে। প্রত্যাশার বিস্ফোরণ অবশ্য একটি সমস্যা। তবে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে বিভিন্ন কাজকর্মে মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনা পুনর্বাসনের কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। তবে দেশে একটি ব্যাপক পুনর্গঠন উদ্যোগের প্রয়ােজন এবং সে জন্য তিনি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে আবেদন জানিয়েছেন।
এখানে বলে রাখা ভালাে যে জাতিসংঘ ১৯৭১ সালেই ত্রাণ ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় এবং এই উদ্যোগ তখন কার্যকর হচ্ছিল। তিনি আরও বললেন যে ভারতের সহায়তার হাত শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, পুনর্বাসন কার্যক্রমেও প্রসারিত রয়েছে। সৌভাগ্যের বিষয় হলাে যে ভারতে এই মুহূর্তে উদ্বৃত্ত খাদ্যও মজুত আছে। এবং বাংলাদেশ সেখান থেকে প্রয়ােজনীয় সাহায্য পাচ্ছে। এর চেয়ে আর বেশি কথা আমার স্মরণে নেই এবং কোনাে নােটও আমি রাখিনি। ভিরাটেলের মােলাকাতের পর দেখলাম যে বঙ্গবন্ধুর আরও অনেক নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে। আমি তাই তাকে বললাম, স্যার, আমি আপনার সঙ্গে নিভৃতে কিছু কথা বলতে চাই এবং সে জন্য পরে কোনাে সময় দিলেই হবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি যেন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে গণভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। বেইলি রােডে ১৯৬১ সালে যে বাড়িটা ব্রিটেনের মহামান্য রানির পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে বসবাসের জন্য পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল, সেটাই তখন হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দপ্তর এবং তারই নামকরণ হয়েছে গণভবন। বর্তমানে প্রাসাদটি সুগন্ধা। নামে একটি সরকারি অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমি মনে করি বহু স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িতে কোনাে ইনস্টিটিউট স্থাপন করা যথাযথ নয়। এটিকে একটি স্মৃতিময় মিউজিয়ামে পরিণত করা উচিত। এটি ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের পর জাতির জনক ও রাষ্ট্রপতি (পরে প্রধানমন্ত্রী) শেখ মুজিবের প্রথম কার্যালয়। এ ছাড়া ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর প্রথম ঢাকা সফরকালে এই বাড়িতে অবস্থান করেন।
বঙ্গবন্ধুর দপ্তর থেকে বেরিয়ে আমি পরিকল্পনা কমিশনের পার্শ্ববর্তী নয়তলা ভবনে গিয়ে হাজির হলাম। পরিকল্পনা কমিশনে ছিলেন আমার সব বন্ধু—ড. নূরুল ইসলাম ছিলেন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় কমিশনের সহসভাপতি এবং তিনজন অধ্যাপক মােশাররফ হােসেন, আনিসুর রহমান ও রেহমান সােবহান ছিলেন সদস্য। আমি দেখলাম যে আনিস ইতিমধ্যেই বােস্টন থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়েছেন। আমাকে তারা কী করতে যাচ্ছেন, তার একটি প্রাথমিক ধারণা
২২৯
দিলেন। তাঁদের মনে হয়েছে যে তারা দেশ গঠনের একটি বিরাট সুযোেগ পেয়েছেন এবং সেই সুযােগটিকে কাজে লাগাবার জন্য তারা দ্রুত দেশের জন্য একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁরা এ জন্য দেশের প্রসিদ্ধ সব অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনাবিদ এবং বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞকে পরিকল্পনা কমিশনে একত্র করার চেষ্টা করছেন। তারা আমাকে জানালেন যে তাদেরই অনুরােধের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন বিভাগ পরিকল্পনাসচিব পদে আমাকে নিযুক্তি দিয়েছে। তাঁরা জানতে চাইলেন যে আমি কত দিনে ওয়াশিংটন থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হতে পারব।
আমি তাদের বললাম, পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি একটি বড় মাত্রার উদ্যোগ। কিন্তু তার আগে অর্থনীতির যে স্থবিরতা বিগত নয় মাসে সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং সহজে ও দ্রুতগতিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত সবচেয়ে বেশি জরুরি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা সবাই মিলে বােস্টনে যে তিন বছর মেয়াদি ত্রাণ ও পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়ন করলাম, তা নিয়ে কি কোনাে কাজ হচ্ছে? তিনি বললেন, তাঁদের চিন্তাধারা হচ্ছে এখন যে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা তা ত্রাণ মন্ত্রণালয় করতে পারবে এবং সে জন্য বােস্টনে প্রণীত ত্রিবার্ষিক পরিকল্পনার কোনাে বিশেষ উপযােগিতা নেই। অধ্যাপক আনিসুর রহমানের হাতে এই ত্রিবার্ষিক পরিকল্পনার একটি খসড়া ছিল। তিনি বিষয়টি আমাকে আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সেটা হাতে নিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিলেন। আমি তাতে দুঃখ প্রকাশ করে জানালাম যে শুধু যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত বিভিন্ন শিল্পকারখানার পুনরায় চালুকরণের জন্যই ত্রাণের অতিরিক্ত কিছু পরিকল্পনার প্রয়ােজন অস্বীকার করা যায় না।
এ সম্বন্ধে আলােচনায় দেখা গেল যে মতৈক্য তত সহজ হবে না। তাই আমরা অন্য ধরনের আলােচনায় লিপ্ত হলাম। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বললেন যে তাঁদের একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে উচ্চপদস্থ প্রশাসকদের নিয়ে। এসব ব্যুরােক্র্যাট হাঁটতে-বসতে নিয়মকানুনের দোহাই দিয়ে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বানচাল করে দেন। তাঁদের সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশন তখন পর্যন্ত একটি কার্যকর ডায়ালগ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। তিনি আরও বললেন যে এ কাজে তারা। আমার সহায়তা চান এবং সে জন্যই তারা মনে করেন যে পরিকল্পনাসচিব হিসেবে আমাকে তাদের প্রয়ােজন। আমি তাদের এ জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম যে আমি কিন্তু সারা দেশে এই মুহূর্তে সব মানুষের মধ্যে এবং
২৩০
ব্যুরােক্র্যাটদের মধ্যেও নতুন কর্মচাঞ্চল্য দেখতে পাচ্ছি। যেখানে এই কর্মচাঞ্চল্যকেই নির্দিষ্ট পথে প্রবাহিত করতে হবে, সেখানে আমার মনে হয় না। যে কোনাে সংঘাত বা দ্বন্দ্বের সুযােগ আছে। আগেই বলেছি যে আমি দুই-আড়াই মাসের জন্য ঢাকা ভ্রমণে এসেছিলাম এবং পরবর্তী বছরখানেকের মধ্যে আমার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করার কোনাে সুযােগ হবে না। তাই আমি পরিকল্পনা কমিশনের সম্মানিত সদস্যদের জানালাম যে আমার পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা মােটেও নেই, কাজেই পরিকল্পনাসচিব হিসেবে তাঁদের বিকল্প কোনাে কর্মকর্তার কথা চিন্তা করতে হবে।
আমি আমেরিকা ছাড়ার আগেই অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একটি মােলাকাত চেয়েছিলাম। আমাকে তাজউদ্দীন সাহেবের একান্ত সচিব আবু সায়ীদ চৌধুরী জানালেন যে তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে সন্ধ্যার পর আটটার দিকে তাঁর সরকারি বাড়িতে যেতে বলেছেন। আমি নির্ধারিত সময়ে তাজউদ্দীন সাহেবের সরকারি বাসভবনে ৩৫ হেয়ার রােডে গেলাম (বাড়িটি এখনাে তেমনই আছে), সেখানে প্রথমেই আমার দেখা হলাে বেগম জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে এবং তার একটু পরই তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের সঙ্গে যােগ দিলেন। তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা হয় ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আহত গােলটেবিল বৈঠকের সময়। তাজউদ্দীন-জোহরা দম্পতি মুক্তিযুদ্ধকালের অনেক কাহিনি বললেন। বেগম তাজউদ্দীনের কাহিনি ছিল বেশ রােমাঞ্চকর। তাজউদ্দীন সাহেব ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার আগেই বাড়ি ছেড়েছিলেন। বেগম তাজউদ্দীনকে পরে সন্তানদের নিয়ে দেশ থেকে পালাতে হয়। কলকাতায়ও তাজউদ্দীন সাহেব মুজিবনগরের মূল দপ্তরেই রাত কাটাতেন এবং বেগম তাজউদ্দীন সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র বসবাস করতেন। সুতরাং তাদের কাহিনি অনেকটা স্বতন্ত্র ছিল।
তাজউদ্দীন সাহেবের বৈশিষ্ট্য ছিল যে তিনি আস্তে আস্তে কথা বলতেন এবং আলােচনা জমাতে তাঁর বেশ সময় লাগত। তিনি একপর্যায়ে বললেন যে তিনি একসময় ভেবেছিলেন আমাকে ওয়াশিংটন থেকে মুজিবনগরে ডেকে নেবেন। কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমি ওয়াশিংটনেই থাকব। সম্ভবত এ কারণেই আমি যখন পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করলাম, তখন। আমার বাসস্থানকেই ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ মিশন হিসেবে ঘােষণা দেওয়া হয় । আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম যে আমাকে আপনার মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা। বিভাগের সচিব নিযুক্ত করা হয়েছে বলে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। তবে আমাকে বেশ কিছুদিন ওয়াশিংটনে থাকতে হবে। সে জন্য আমি এই পদ আপাতত গ্রহণ। করতে পারব না এবং আমাকে অব্যাহতি দিতে হবে। আমি আরও জানালাম যে
২৩১
এ বিষয়ে আমি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর অনুমতি গ্রহণ করব। আমি এ-ও বললাম যে আমি প্রায় দুই মাস ঢাকায় থাকব এবং এ দুই মাসে আমি সরকারের জন্য যেকোনাে কাজ করতে প্রস্তুত। আমি আরও বললাম যে এ সময় দৈনিক ১৫-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে আমি পারব। আমি প্রায় মধ্যরাতে তাজউদ্দীন-জোহরা দম্পতির কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
আমি প্রথম কদিন বিভিন্ন দপ্তরে গেলাম, অনেক মন্ত্রীর সঙ্গে মােলাকাত করলাম, বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করলাম এবং অতঃপর ৭ তারিখে আমার ভাই সুজনকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে গেলাম। প্রধান উদ্দেশ্য রেলওয়ে এবং বন্দর সম্বন্ধে অবহিত হওয়া। চট্টগ্রামের রেলওয়ে এলাকা দারুণভাবে বিধ্বস্ত । বাঙালি-বিহারি সংঘর্ষের করুণ কাহিনিতে রেলওয়ে এলাকা ভারাক্রান্ত। চট্টগ্রাম বন্দরে তখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন আমার সহকর্মী সিএসপি কর্মকর্তা এ কে এম গােলাম রব্বানীর বড় ভাই গােলাম কিবরিয়া। তিনি পাকিস্তান আমলে সম্ভবত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ ট্রাফিক কর্মকর্তা ছিলেন। সেখানে আমার পরিচিত আরও একজন কর্মকর্তা ছিলেন মেসবাহ উদ্দিন আহমদ—আমার ছাত্রজীবনের বন্ধু বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এবং কনিষ্ঠ সহকর্মী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বড় ভাই। তিনি তখন বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ছিলেন। এক ফাঁকে তাঁর সঙ্গেও যথেষ্ট আলাপ-আলােচনা হলাে এবং তিনি আমাকে সম্ভবত পরের দিন মধ্যাহ্নভােজে আপ্যায়ন করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমি দুদিন ব্যস্ত সময় কাটাই। তারা আমাকে জানালেন যে বন্দরটিকে অতি কষ্ট করে চালু রাখা হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী জাহাজ চলাচলের জন্য কিছু এলাকা থেকে মাইন সরাতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু অসংখ্য মাইন তখনাে সমুদ্রে পোঁতা অথবা পড়ে ছিল। এ জন্য তাদের সবচেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পটি হচ্ছে বন্দর থেকে মাইন অপসারণ। এ ব্যাপারে বৈদেশিক সাহায্য ছিল অতি প্রয়ােজনীয়। আনরড এ বিষয়ে কিছু সাহায্য করে, তবে স্যালভেজ অপারেশনের দায়িত্ব নেয় সােভিয়েত রাশিয়া। দ্বিতীয় দিনে আমি প্রস্তাব করলাম যে যেসব এলাকা দিয়ে জাহাজ চলাচল করছে, আমি সেই এলাকায় যেতে চাই। কিবরিয়া সাহেব বললেন যে দুপুরের খাবার খেয়েই আমরা সমুদ্রে যেতে পারি। বন্দর কর্তৃপক্ষের কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ভাই সুজনসহ আমরা জাহাজে উঠলাম। তারপর বেশ কিছু জায়গা সফর করে বন্দরে ফিরলাম। এই ভ্রমণটি নির্বিঘ্নে শেষ হলে পরে কিবরিয়া সাহেব বললেন যে তারা বড় একটি ঝুঁকি নিয়ে নৌভ্রমণটি সম্পন্ন করেছেন। মাঝেমধ্যে একটি-দুটি মাইন বিকট আওয়াজ করে চলমান নৌযান ধ্বংস করে দেয়। আমি বন্দরের প্রধান
২৩২
দপ্তর ছাড়াও কাস্টমস কালেক্টরের দপ্তর, চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার ও চট্টগ্রাম জেলার ডেপুটি কমিশনারের দপ্তরেও গেলাম। যেখানেই যাই, সবখানেই প্রধান আলােচ্য বিষয় ছিল পাকিস্তানের নির্মম গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ । চট্টগ্রামে সম্ভবত এই ধ্বংসলীলার নিদর্শন একটু বেশি ছিল।
চট্টগ্রামে এক সন্ধ্যায় এ কে খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বিধ্বস্ত গৃহে ও দেশে বসেও এবং শত বাধাবিপত্তি সামনে রেখেও তিনি ছিলেন আশাবাদী। চট্টগ্রামে আমার অন্য কর্তব্য ছিল আমার বড় বােনের সঙ্গে দেখা করা। আমার দুলাভাই মােহাম্মদ মজক্কির তখন সমবায় বিভাগের উপনিবন্ধক। তার বড় মেয়ে ছিল বার্মা ইস্টার্ন কলােনিতে, তার স্বামী ডাক্তার হলেও বিহারিদের ভয়ে তাকে পালাতে হয়। আমার বােনও তাঁর সাতটি মেয়েকে নিয়ে বাটালি হিলের সরকারি বাসস্থান থেকে প্রায় দুই মাস পালিয়ে থাকেন। চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সন্ত্রাস যে কী প্রচণ্ড ছিল, তা কল্পনাতীত : গুটিকয়েক বাঙালি মিরজাফরও এই নৃশংসতায় হানাদারদের দোসর হিসেবে ভূমিকা রাখে।
আমার পরিকল্পনা ছিল যে আমি চট্টগ্রাম থেকে সিলেটে যাব। আমার বুবু বললেন যে আমরা যেহেতু সরাসরি সিলেটে যাচ্ছি, সুতরাং তিনিও আমাদের সঙ্গী হবেন এবং তাঁর সঙ্গে তাঁর দু-একটি কন্যাও থাকবে। সুজনকে একটি দ্বিতীয় গাড়ির ব্যবস্থা করতে হলাে এবং গাড়ি দুটি নিয়ে আমরা সিলেটের পথে তৃতীয় দিনে চট্টগ্রাম ছাড়লাম। তখন রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ এবং সিলেটে যেতে বেশ কটি ফেরি চড়তে হবে। এখানে-সেখানে সেতু-কালভার্ট সব বিধ্বস্ত । রাস্তা সর্বত্রই ভাঙা। মাঠ বা শুকনাে খাল বা বিলের মাঝ দিয়ে বিকল্প রাস্তা। তাই মােটরগাড়ির ওপর ধাক্কাটি খুব বেশি। আমরা কুমিল্লা পৌছাতে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেল। সেখানে আমি আমার পরিচিত সার্কিট হাউসে গেলাম। গিয়ে দেখি সার্কিট হাউসের দালানটি আছে কিন্তু সেটি আর ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসকের দপ্তরেই যেতে হলাে। সেখানে জেলা প্রশাসকের দেখা পেলাম না। তবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর দেখা পাওয়া গেল। তিনি জানালেন যে অনেক দিন হলাে একটা নতুন সার্কিট হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিলেন।
সার্কিট হাউসে গিয়ে আমরা হাত-মুখ ধুয়ে আমাদের সঙ্গে যে খাবার ছিল তা খেতে বসলাম। খাওয়া শেষ করার আগেই জানতে পারলাম যে ওই সার্কিট হাউসে মেজর জিয়া অবস্থান করছেন। তিনি তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন এবং ক্যান্টনমেন্টের অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল। আমি মেজর জিয়ার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে তাঁকে খবর দিলাম এবং তিনি যে
২৩৩
কামরায় অবস্থান করছিলেন, সেদিকে রওনা হলাম। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে পরে বললাম যে আমি দেশে এসে বাড়ির পথে কুমিল্লায় কিছু সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি নিয়েছি। তিনি এখানে আছেন শুনে ভাবলাম যে একজন বীর মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে দেখা করে যাই। তাঁর সঙ্গে এর আগে কখনাে আমার দেখা হয়নি। যদিও রাওয়ালপিন্ডিতে আমরা একই সময় বসবাস করেছি। কিন্তু তার সঙ্গে তখন। আমার পরিচয়ের কোনাে সুযােগ হয়নি। মনে হলাে তিনি সে সময় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এবং গায়ে একটা গাউন লাগিয়ে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করলেন। কুশল বিনিময়ের পর তাকে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য অভিনন্দন জানালাম। তিনিও বললেন যে বিদেশ থেকে আমরা যখন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য দেখালাম, তখন তারা তাতে খুব উৎসাহিত হন।
কিছুক্ষণ পর আমরা কুমিল্লা ছেড়ে সিলেটের পথে রওনা হলাম। আমরা কোনােমতে মৌলভীবাজারে পৌছালাম সন্ধ্যার ঘণ্টা দুয়েক পর । ওখানে পৌছেই আমাদের গাড়ি বিকল হয়ে গেল। ভাগ্য ভালাে যে মৌলভীবাজারে পৌছে গেছি। ওখানকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী আবদুল মজিদ খান সাহেবের বাড়িতে আমরা রাত কাটাবার ব্যবস্থা করলাম। মজিদ খান সাহেবের ছেলে মুকিত খান জেলা জজ হিসেবে অবসর নিয়ে এখন মৌলভীবাজারে তাঁর পিতার পেশায়ই নিয়ােজিত আছেন। মজিদ খান ছিলেন আমার বুবুর ভাসুর, দুলাভাই ও মজিদ খান ছিলেন। খালাতাে ভাই। পরদিন আরেকটি ভাঙা গাড়ি জোগাড় করা হলাে, কারণ আমাদের গাড়িটি মেরামতে সময় লাগবে, তার জন্য যন্ত্রাংশ জোগাড় করতে হবে। এই নতুন জোগাড় করা গাড়িতে কিছুদূর যেতে না যেতেই বিপত্তি ঘটল। এই গাড়িটিও বিকল হয়ে পড়ল। সম্ভবত সাদীপুর ফেরির কাছে আমরা তখন পৌছেছি। সিলেট-মৌলভীবাজারের ৩৭ মাইল রাস্তায় দুটো ফেরি ছিল। একটি সাদীপুর আর অন্যটি শেরপুর। আমাদের তখন লক্ষ্য হলাে যেকোনােভাবে যেকোনাে গাড়ি, যেটা সিলেটে যাচ্ছে, তাতে একটু স্থান জোগাড় করা।
আমাদের ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। আমরা দু-তিনটি সিলেটগামী গাড়িকে থামাতে সক্ষম হলাম। এই বহরটি ছিল সিলেটের জনপ্রতিনিধি এবং সেখানকার জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর। তিনি সম্ভবত হবিগঞ্জ থেকে সিলেটে যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে দুটি যাত্রীভরা গাড়ি। এই দুটিতে যাত্রীদের পুনর্বিন্যাস করে তিনি আমাদের জন্য জায়গা করে দিলেন। আমরা সংখ্যায় খুব কম ছিলাম না। আমরা ভাইবােন তিনজন—বুবু, সুজন ও আমি এবং সম্ভবত দুটো বাচ্চা বােনঝি। দেওয়ান সাহেবের সঙ্গে ঢাকায় আমার দেখা হয়নি, তাই স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর এই প্রথম মােলাকাতটি ছিল অত্যন্ত আনন্দময় ও উষ্ণ।
দেওয়ান সাহেব হবিগঞ্জ থেকে কলেজে পড়াশােনার জন্য সিলেটে আসেন
২৩৪
সম্ভবত ১৯৪৪ বা ১৯৪৫ সালে এবং তখন থেকেই আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। তাঁর বােনকে আমার দাদার এক শ্যালক বিয়ে করেছিলেন। তার মানে তিনি ছিলেন আমার গুরুজন। ছাত্র থাকাকালে তিনি মুসলিম লীগ রাজনীতিতে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ছাত্ররাজনীতিতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন। ছাত্রজীবনের অবসানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মূল্যবান ভূমিকা রাখেন। আওয়ামী লীগের শুরুর দিনগুলাে থেকে তিনি সংগঠনটিকে সংহত করতে ব্রতী ছিলেন এবং অনেক মুসলিম লীগবিরােধী যুবনেতাকে আওয়ামী লীগে আহ্বান করে নিয়ে আসেন। আবদুস সামাদ আজাদ, যিনি ন্যাপে একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন, তাকেও তিনি আওয়ামী লীগে নিয়ে আসেন।
দেওয়ান ফরিদ গাজীর সঙ্গে সিলেটে পৌছাতে মাত্র ৩৬ মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে আমাদের প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে গেল। পথে গাড়িঘােড়া তেমন ছিল না কিন্তু রাস্তাঘাটের অবস্থা মােটেই অনুকূল ছিল না। সিলেটে আত্মীয়স্বজন ছাড়াও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলাে। আমি বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলাের বিবরণ নানাজনের কাছ থেকে শুনলাম। সেখানে জানলাম যে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে সিলেটের জেলা প্রশাসক ছিলেন এম আবদুস সামাদ সিএসপি (পরবর্তীকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব)। সিলেটে যখন পাকিস্তানের দখল প্রতিষ্ঠা হলাে, সম্ভবত ২৭ মার্চের পর, তখন তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়া থেকে নিজেকে রক্ষা করেন এবং বেশ কিছুদিন গ্রামেগঞ্জে অবস্থান করে অবশেষে আগরতলায় পাড়ি দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিলেটে হলাে আমাদের পারিবারিক পুনর্মিলনী। দুই-দুবার বাড়ি আক্রান্ত ও লুষ্ঠিত হওয়ার ফলে তখন সেখানে বেশ দৈন্যদশা। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ তখন প্রাণপ্রবাহে গমগম। সিলেটে কিন্তু আমরা আটকা পড়ে গেলাম। ট্রেনলাইন। বিধ্বস্ত তাই ট্রেন চলাচল বন্ধ। হাওয়াই জাহাজের অভাবে কালেভদ্রে ছােট বিভার বা সিকরােস্কি প্লেন জরুরি মালপত্র আনা-নেওয়া করতে যায়। এ অবস্থায় একমাত্র কোনাে ব্যক্তি নিজস্ব গাড়িতে ঢাকায় গেলে যদি তার সঙ্গ পাওয়া যায় ।
আমি সিলেটে পৌছার অব্যবহিত পর জানতে পারলাম যে সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডি ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পৌছবেন। ওয়াশিংটন থেকে আমাকে জানানাে হলাে যে তিনি ঢাকায় আমাকে দেখার আশা প্রকাশ করেছেন। সে কথা শুনে আমি তিন দিন পরই ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ নিলাম। এ ব্যাপারে একমাত্র উপায় ছিল ঢাকাগামী কোনাে মােটরগাড়ি যাত্রীর সন্ধান পাওয়া। অবশেষে সম্ভবত ১৩ ফেব্রুয়ারি আমি মােটরগাড়ি করে ঢাকায়
২৩৫
যাওয়ার সুযােগ পেলাম। আমাদের প্রতিবেশী মান্নান সাহেবের শ্যালক বেলাল দুটি গাড়ি নিয়ে ঢাকা যাওয়ার ব্যবস্থা করে। তার সহযাত্রী খুব কম ছিল এবং সে আমাদের চারজনকে তার গাড়ি দুটিতে জায়গা করে দিল। আমার ভাই সুজন, চাচাতাে ভাই আলীম, ছােট মামা সৈয়দ শাহ আনােয়ার এবং আমি—এই হলাম চারজন যাত্রী। আমরা সকালবেলা ঢাকার পথে রওনা হলাম। সঙ্গে কিছু খানাদানাও নিয়েছিলাম। কিন্তু সিলেট থেকে রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমরা দুর্ঘটনায় পড়লাম।
সম্ভবত আগের দিন কিছু বৃষ্টি হয়েছিল বলে রাস্তা অনেক জায়গায় পিচ্ছিল হয়ে যায়। সিলেটের চার-পাঁচ মাইল দূরে একটা বড় বাঁক ঘােরার সময় আমাদের গাড়িটি, যেটা পেছনে ছিল, সেটা পিছলে গিয়ে রাস্তার পাশে পড়ে যায়। আমাদের গাড়িতে সামনের আসনে ছিল আলীম এবং পেছনের আসনে ছিলাম আমি, বেলাল ও আমার ছােট মামা। গাড়িটা থেমে যাওয়ার পর আমরা দেখলাম যে সেটা একেবারেই উল্টে গেছে। সামনের দরজা দুটি সহজেই খুলে ড্রাইভার এবং আলীম গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। তারা আমাদের সাহায্য করার পর আমি ও ছােট মামা বেরিয়ে এলাম। কিন্তু বেলালের পেছনে চোট লাগার ফলে সে নড়াচড়া করতে পারছিল না। তাকে আমরা ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এলাম। আমাদের যাত্রীদের মধ্যে শুধু বেলাল ও আমি কিছুটা আঘাত পাই। বেলাল তাে নড়াচড়াই করতে পারছিল না এবং কথাবার্তা বলতেও তার অসুবিধা হচ্ছিল। আমি মাথায় কিছুটা আঘাত পেয়েছিলাম বলে সামান্য রক্তক্ষরণ হয়। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেকোনাে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। দুটি গাড়ি আমাদের ডাকে থামল এবং সে দুটি গাড়িতে আমাদের সবার জায়গা হলাে। আমরা গাড়ি দুটিতে চড়ে সরাসরি জেলা হাসপাতালে হাজির হলাম।
হাসপাতালে চিকিৎসকেরা দ্রুত বেলালকে অস্ত্রোপচারের জন্য নিয়ে গেলেন। একজন পরিচিত ডাক্তার জানালেন যে বেলালের আঘাতটি খুবই গুরুতর এবং তার অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমার আঘাতটি পরিষ্কার করার পর তারা সেখানে বেনজিন দিয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন। অন্য তিনজনের কোনাে ধরনের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়ােজন হলাে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিকিৎসকেরা ঘােষণা দিলেন যে বেলাল মৃত্যুবরণ করেছে। বেলালের আত্মীয়স্বজন ইতিমধ্যে হাসপাতালে পৌছেছেন। আমাদের আত্মীয়স্বজনও ততক্ষণে হাসপাতালে। আমার প্রথম চিন্তা হলাে যে কী করে আমি ঢাকায় পৌছাতে পারি। আমরা হাসপাতালে থাকতেই জেলা প্রশাসক সাঈদ আহমদ এসে জানালেন যে একটি বিমান কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সিলেটে আসবে এবং কিছু মালপত্র নিয়ে ঢাকায় যাবে। আমি ইচ্ছা করলে কোনােমতে ওখানে একটি সিট পেতে পারি। বিকেলে
২৩৬
ঢাকায় পৌছে প্রথমেই আবার আমার ব্যান্ডেজ করাতে হলাে। দিনটি ১৪ ফেব্রুয়ারি। সিনেটের কেনেডি সেদিনই সকালে ঢাকায় পৌঁছেছেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তার দুই সহকারী ডেল ডিহান আর জেরি টিংকার (তাদের কথা আগে বলেছি)। এ ছাড়া তাঁর ১৬ বছরের ভাইপাে রবার্ট কেনেডির ছেলে জোসেফও ছিল সফরসঙ্গী । জোসেফ কেনেডি ম্যাসাচুসেটস রাজ্য থেকে কংগ্রেস প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় এবং তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল বলেই বিবেচিত হয়।
আমি ঢাকায় এসে আবার মােকাম্মেল হকের ধানমন্ডির বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। প্রথমেই আমার কাজ হলাে প্রটোকলের সঙ্গে যােগাযােগ করা। তারা জানালেন যে সম্ভব হলে আমি সেই সন্ধ্যায়ই ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে সিনেটর কেনেডির সহযােগীদের দেখা পেতে পারি। পরদিন সকালে সিনেটরের ব্যস্ত কর্মসূচি রয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। আদমজী শিল্পকারখানায় যাবেন। আরও কী কী জানি করবেন এবং সিনেটর চেয়েছেন যে আমি যেন তাকে সঙ্গ দিই। সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডির এটিই ছিল বাংলাদেশে প্রথম এবং একমাত্র সফর। মুক্তিযুদ্ধকালে যেসব আমেরিকান সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন, তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য এবং তিনি যত দিন সিনেটর ছিলেন, তত দিন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনায় সুখে-দুঃখে ছিলেন আমাদের একজন ঘনিষ্ঠজন এবং বড় মাপের পৃষ্ঠপােষক।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয় দুবার । যখন বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসেন এবং অতঃপর ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে, যখন তিনি ওয়াশিংটনে সফরে যান। বঙ্গবন্ধুতনয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও ছিল তাঁর উষ্ণ সম্পর্ক। আমার জানামতে, শেখ হাসিনা যতবারই আমেরিকায় ওয়াশিংটনে গিয়েছেন, প্রতিবারই ওয়াশিংটনে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সঙ্গে তাঁর মােলাকাত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার কাছে নানাভাবে ঋণী। সেই মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর সঙ্গে যে পরিচয় হয়, তাঁর জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সেই পরিচয় ছিল ঘনিষ্ঠ ও গভীর। ১৯৮৬ সালে সিনেটর হিসেবে ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁর সম্মানে বােস্টনে এক মহতী সংবর্ধনার আয়ােজন হয়। আমার সৌভাগ্য যে আমি সেখানে একজন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণের সুযােগ পাই।
ঢাকায় অবস্থানকালে সিনেটর আমাদের সব গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন—রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ত্রাণমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী। দেড় দিন তিনি ছিলেন। এর মধ্যে কুষ্টিয়া, ডেমরা এবং আদমজী এলাকা, মিরপুর, মােহাম্মদপুর ঘুরে দেখেন। তিনি বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেরা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে একটি চারাগাছ
২৩৭
লাগান এবং ছাত্রসমাবেশে সুন্দর বক্তব্য দেন। বক্তব্যটি ছিল হৃদয়গ্রাহী এবং উচ্চাশা জাগানিয়া। ভাষণের প্রথম দিকে তিনি বলেন, তােমরা জানাে যে যদিও কতিপয় সরকার তােমাদের দেশকে স্বীকৃতি দেয়নি কিন্তু পৃথিবীর মানুষ। তােমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। তােমরা অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে যে কৃতিত্ব দেখিয়েছ, সারা পৃথিবী তার স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীনতার লড়াই ও মুক্তির লক্ষ্যে আমরা ভাই এবং কোনাে মানুষ, কোনাে নীতিমালা বা কোনাে সরকার এই শাশ্বত সত্যকে অস্বীকার করতে পারবে না। উপসংহারে তিনি বলেন, আমেরিকার যা কিছু মহান ও শ্রেষ্ঠ, আমেরিকার সমুন্নত সংবিধান এবং আমাদের মহান স্বাধীনতা ঘােষণার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি তােমাদের এখানে স্বাধীনতার অভ্যুদয়কে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। আমি বলি, জয় বাংলাদেশ-বাংলাদেশ জাতির বিজয়।
সিনেটর কেনেডিকে বিদায় দিয়ে আরও দুই মাস আমি বাংলাদেশে থাকি । মনােনীত পরিকল্পনাসচিব হিসেবে আমাকে বিশেষ কিছু কাজ করতে হয় । যুদ্ধোত্তর পুনর্বাসন ও ত্রাণ কার্যক্রম প্রণয়নের জন্য জাতিসংঘ (আরব) একটি মিশন পাঠায় এবং তাতে নেতৃত্ব দেন ভারতে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত মহিমান্বিত আরনা জাইলার। এই মিশনের দেখাশােনা করা এবং তাদের কাজে ভূমিকা রাখার দায়িত্ব হয় আমার। আমি নিজে থেকে একটি যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন পরিকল্পনা রচনায় মনােনিবেশ করি। পরিকল্পনা কমিশনে অনেক তদবির করে অধ্যাপক মােশারফ হােসেনের উদ্যোগে অবশেষে একটি ষান্মাসিক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন পরিকল্পনা প্রণীত হয়। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মপরিধি ও কার্যপ্রণালি বিষয়েও আমি প্রস্তাব প্রণয়ন করি। একই সঙ্গে পাকিস্তান আমলের বৈদেশিক সাহায্যকে কীভাবে বিবেচনা করতে হবে, সে বিষয়েও প্রাথমিক চিন্তাভাবনা শুরু করি। সােভিয়েত রাশিয়া থেকে পরিকল্পনা কমিশনের একটি উচ্চপর্যায়ের দলও ঢাকায় আসে এবং তাদেরও দেখাশােনা করার কিছুটা দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়।
ঢাকায় আমার অবস্থানকালেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তাঁর সফরের আগেই মার্চের ১২ তারিখে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহৃত হয়। আমাদের পুলিশ বাহিনী পুরােপুরি সংগঠিত না হলেও এবং সেনাবাহিনীর রূপরেখা চূড়ান্ত না হলেও বিদেশি সেনাবাহিনীকে আমরা আমাদের মাটি থেকে বিদায় দিই। এ সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানা রকম অনিশ্চয়তা ছিল। ছিনতাই-রাহাজানির অনেক ঘটনা ঘটত। তবে সার্বিক বিবেচনায় অবস্থা বেশ ভালােই ছিল। ভারতীয় সেনা অপসারণের দু-তিন দিন পর আমাদের বৃহত্তর পরিবারে একটি মৃত্যুর ঘটনা
২৩৮
ঘটে। আমার বড় চাচি বেগম জাহানারা মতিনের এই মৃতদেহকে সিলেটে পাঠানাের ব্যবস্থা করতে হবে। মধ্যরাতে আমরা ইংলিশ বাজারে গিয়ে কফিন বানাই। ঠেলাগাড়িতে করে কফিন ও বরফ নিয়ে যাই ধানমন্ডির জিগাতলা মােড়ে এবং ভােরে লাশ নিয়ে মােটরগাড়িতে করে সিলেটের পথে লােকজন চলে যান। সারা রাত ধরে এসব ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে কোথাও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কোনাে চিন্তা করতে হয়নি। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তনের পথে কলকাতা ও দিল্লি গেলাম। আড়াই মাসের অভিজ্ঞতাটি ছিল খুবই মূল্যবান।
একদিকে দেখলাম দেশ গঠনে মানুষের দারুণ উৎসাহ ও একাগ্রতা। অন্যদিকে দেখলাম কায়েমি স্বার্থবাদের প্রয়াস, রাতারাতি বড়লােক হবার কদর্য ইচ্ছা এবং মানুষকে বঞ্চিত করার পাঁয়তারা। আড়াই মাসে ঘুরলাম অনেক। ধ্বংসলীলার সঙ্গে পরিচয় হলাে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর ও কুমিল্লায়। নানা জনের অভিজ্ঞতা থেকে শুনলাম চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বগুড়া, বরিশাল, খুলনা, পাবনা ও ঢাকার কত জানা-অজানা কথা। দেশব্যাপী দেখলাম সামরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের অসীম ক্রোধ। ব্যক্তি ও গােষ্ঠীস্বার্থের জন্য ধর্মের ব্যবহার ছিল সবার দৃষ্টিতেই পরিত্যাজ্য। অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন হয়ে ওঠে একটি মৌলিক আকাঙ্ক্ষা বা চেতনা। ন্যায়বিচারের আশা এবং প্রভাবমুক্ত বিচার বিভাগ হয়ে ওঠে একটি জাতীয় দাবি। বাকস্বাধীনতা, প্রচার ও প্রকাশের স্বাধীনতা, ভ্রমণের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, গান-বাজনা বা শিল্পকলাচর্চার স্বাধীনতা, পােশাকের স্বাধীনতা এগুলাে মানুষ বােধ হয় এর আগে আর কখনাে এমন করে চায়নি। নির্যাতিত, পদদলিত, স্বাস্থ্যহীন, অশিক্ষিত গরিব বাঙালির এই রূপ ও মানসিকতা নিশ্চিতই ছিল এক নতুন বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের ফলে লাভ করা এক অবিশ্বাস্য অর্জন। এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের ফলে মুক্তিযুদ্ধের শুভ্র সমুজ্জ্বল স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা সারা দেশে সৃষ্টি করে এক নবযুগ এবং এক সুউচ্চ প্রত্যাশা।
২৩৯
<p style="text-align: justify;"> দ্বাদশ অধ্যায়
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে আড়াই মাস
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধেই আমাকে দুটি কাজ দেন। দুটি বিষয়ে তার কাছে পরিকল্পনা পেশের জন্য তিনি আমাকে সময় দেন মাত্র এক মাস। প্রথম কাজটি ছিল বাংলাদেশের প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরের জন্য একটি পরিকল্পনা। সেখানে ক্ষমতার বিন্যাস কীভাবে হবে এবং কী ধরনের দপ্তরের প্রয়ােজন হবে, সে বিষয়ে সময়-নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তিনি চান। দ্বিতীয় কাজটি ছিল জেলা প্রশাসনের গণতন্ত্রায়ণ বিষয়ে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে জেলা প্রশাসনের প্রধান করা এবং জেলার বিভিন্ন বিষয়ে নির্বাচিত পরিষদকে ক্ষমতা প্রদান এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। এ দুটি বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য সমন্বিত গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রমের দিলকুশায় অবস্থিত দপ্তরে আমি আমার কার্যালয় স্থাপন করি। সেখানে একদিকে আমি আমার গবেষণা পরিচালনা করি অন্যদিকে অনেক জেলা প্রশাসক, চিন্তাবিদ, সরকারি কর্মচারী এবং আমার পরিচিত যারা জনপ্রশাসন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশােনা অথবা অধ্যাপনা করেন, তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। মাঝেমধ্যে সচিবালয়ে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তা এবং মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনা করি। এ জন্য সরকারি ট্রান্সপোের্ট পুল থেকে আমার চলাফেরার জন্য একটি গাড়ি সরবরাহ করা হয়। সমন্বিত গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রমের বড় কর্তা মােকাম্মেল হক তাঁর দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে আমাকে সহযােগিতা করেন। বিশেষ করে তার সুযােগ্য সহকারী শাহেদ লতিফ গভীর আগ্রহে আমার কাজে সহায়তা করেন।
সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানের একজন কনিষ্ঠ সদস্য শাহেদ লতিফ তখন সমন্বিত পল্লি উন্নয়ন কার্যক্রমে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি আমার বিভিন্ন কাজে তথ্য ও চিন্তা দিয়ে আমাকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করেন এবং আমার তিনটি প্রতিবেদন প্রণয়নে মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। শাহেদ লতিফের
২৪০
চরিত্রে দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল অত্যন্ত প্রবল। একটি হলাে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ আর দ্বিতীয়টি যেকোনাে ব্যর্থতায় গভীরভাবে মুষড়ে পড়া। কোনাে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ যেকোনাে সরকারি দপ্তরের চেয়ে তিনি অতি সহজে করতে পারতেন। শাহেদ লতিফ এসকাপে বেশ কিছুদিন কাজ করেন। তবে অল্প বয়সেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমি যথাসময়ে দুটি বিষয়েই বঙ্গবন্ধুকে দুটি প্রতিবেদন পেশ করি। এ দুটি প্রতিবেদনের সারবস্তু পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালে আমি আমার Thoughts on Development Administration বইয়ে প্রকাশ করি।
প্রশাসনিক কাঠামােবিষয়ক আমার প্রতিবেদনটির সুপারিশগুলাের অনেকটাই ক্রমে বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে আমার একটি মৌলিক সুপারিশ এখনাে কার্যকর হয়নি। কেন্দ্রীয় বাংলাদেশ সরকারের ক্ষেত্রে পাকিস্তান। আমলের যে কাঠামাে ছিল, তা মােটামুটিভাবে এখনাে বহাল আছে। শুধু বিভাগের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবে অনেক বেড়ে গেছে। এই কাঠামাের অন্যতম মূলনীতি হলাে যে মাঠপর্যায়ে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বিভিন্ন ডাইরেক্টরেট অথবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং কেন্দ্রে বিষয়টি বিবেচিত হবে সচিবালয়ে। অর্থাৎ নীতিনির্ধারণ হবে সচিবালয়ে, কার্যপরিচালনা হবে ডাইরেক্টরেটে। আমি ব্যবস্থাটি পছন্দ করি না। আমার প্রস্তাব হলাে যে কেন্দ্রে, অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারণের জন্য কয়েকটি স্বল্প আয়তনের বিভাগ থাকবে এবং তারা সত্যিকারভাবে নীতি নির্ধারণ করবে, কর্মপরিচালনা করবে না। আমি বিশ্বাস করি যে ভবিষ্যতে কোনাে এক সময় এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাবে। এখন যেভাবে কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারি কর্মকাণ্ডগুলাে পরিচালিত হয়, সেটি আমাদের মতাে এত মানুষের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ দেশে চলতে পারে না। আমাদের দেশে এখন সরকারি কর্মচারীরা মােটামুটিভাবে সবাই কেন্দ্রীয় সরকারের আমলা। স্থানীয় সরকারের আমলা এত কম যে তাঁদের হাতে গােনা যায়। এটিই হলাে। আমাদের জনপ্রশাসনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এবং এ কারণেই আমাদের দেশে স্বয়ম্ভর-স্বশাসিত জেলা সরকার কিছুতেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না।
তখনকার অবস্থা বিবেচনা করে আমার এই প্রতিবেদনে ২১টি মন্ত্রকের ধারণা দেওয়া হয় এবং প্রায় ৬২টি বিভাগের তালিকা দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিষয়ে আমি যে প্রতিবেদনটি দাখিল করি, তাতে প্রথমেই আমার লক্ষ্য হয় যে জেলা প্রশাসনে কী রকম কাজ হয়, তার একটি স্পষ্ট ধারণা উপস্থাপন করা। আমার হিসাবে সেখানে কাজ হতাে মােট ৬টি। যথা : ১. ভূমি রাজস্ব আদায় এবং ভূমি প্রশাসন; ২. আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা; ৩. ফৌজদারি বিচার নিশ্চিত করা, অর্থাৎ অপরাধের শাস্তির ব্যবস্থা; ৪. বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সমন্বয়, যার আয়তন
২৪১
অনবরতই বেড়ে চলেছে; ৫. স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলাে গড়ে তােলা এবং তাদের কার্যক্রমের দিকে খেয়াল রাখা; ৬. এ ছাড়া রয়েছে একটি অমনিবাস কাজ, যাকে বলা যেতে পারে বিভিন্ন আইনকানুন, যেগুলাে জনজীবনের জন্য প্রয়ােজনীয়, সেগুলাের বাস্তবায়ন করা। আমি দেখেছি যে এই যে মােটাদাগে জেলা প্রশাসকের কাজ এখানে বিবৃত হলাে, তা এখন পর্যন্ত বহাল আছে। আমার প্রতিবেদনের একটি বড় বিষয় ছিল ঔপনিবেশিক আমলে সর্বক্ষমতার অধিকারী জেলা প্রশাসকের ক্ষমতার গণতন্ত্রায়ণ এবং পরিবর্তে তাঁকে সমন্বয়কের দায়িত্ব প্রদান। তিনি বড় কর্তা হবেন না, তবে বিভিন্ন কর্মকর্তার কাজের সমন্বয় সাধন করবেন।
এই প্রতিবেদনে আমি প্রমাণ করতে চেষ্টা করি যে জনসংখ্যা এবং এলাকার ভিত্তিতে জেলার আয়তন ব্যাপকভাবে ছােট করা দরকার। আমি অবশ্য এ-ও বলি যে কাজটি সম্পন্ন করতে একটি পাঁচসালা পরিকল্পনার প্রয়ােজন। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ নেন ১৯৭৫ সালে। তিনি সারা দেশে মহকুমাগুলােকে উন্নীত করে ৬১টি জেলা প্রশাসন স্থাপন করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টে যে প্রতিবিপ্লব ঘটে, তাতে অবশ্য এই আদেশটির বাস্তবায়ন স্থগিত রাখা হয়। তবে ১৯৮৪ সালে সব মহকুমাই জেলায় রূপান্তরিত হয়। তাই বলতে পারি বঙ্গবন্ধু আমার প্রতিবেদনটি গ্রহণ করেন। শুধু আপত্তি তােলেন এই বলে যে পাঁচসালা পরিকল্পনা করে এটা করা যাবে না। এক আদেশেই সেটা করতে হবে। তিনি আমারই একটা প্রস্তাবের ওপর জোর দিয়ে বলেন যে জেলা প্রশাসনের গণতন্ত্রায়ণ এক হুকুমে না করলে এটা সহজে সাধিত হবে না। কারণ, এতে যে বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলাে মনমানসিকতার পরিবর্তন আর একমাত্র একটি বিপ্লবই তা সাধন করতে পারে। আমি সে সময় এই মন্তব্য পুরােপুরি গ্রহণ করতে পারিনি। কিন্তু এত বছর পর মনে হচ্ছে যে জনপ্রশাসনের গণতন্ত্রায়ণের জন্য বাস্তবেই একটা বিপ্লবী সিদ্ধান্তের প্রয়ােজন, যেটা আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে সম্ভব হয়নি।
আমি এ দুটি কাজ অত্যন্ত মনােযােগ দিয়ে সম্পন্ন করি। কিন্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন সমস্যা যে অত্যন্ত জটিল এবং তার সমাধান সময়সাপেক্ষ, সেটা আমার যত বেশি লােকের সঙ্গে আলােচনা হয়, ততই দৃঢ়তর হতে থাকল। তাই আমি একই সঙ্গে ছয় মাস বা এক বছরের জন্য একটি ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে থাকি। এ ব্যাপারে আমাকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেন ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী জনাব কামারুজ্জামান ও তাঁর সচিব সিদ্দিকুর রহমান এবং যােগাযােগমন্ত্রী মনসুর আলী ও তাঁর সচিব আবদুস সামাদ। আমি প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করে পরিকল্পনা কমিশনের আমার বন্ধুদের বললাম যে পঞ্চবার্ষিক
২৪২
পরিকল্পনাটি প্রণয়ন আপনারা জোরেশােরে চালিয়ে যান কিন্তু আমার স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমটিও বিবেচনা করুন। তাঁদের সম্মতি নিয়ে আমি অবশেষে আমার ছয় মাসের কার্যক্রমটি ত্রাণ ও যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ে প্রদান করলাম। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকেও আমি প্রতিবেদনটি দিলাম। মােটামুটিভাবে এই কার্যক্রম ছয় মাস নয়, প্রায় দেড় বছর স্থায়ী হয়। বস্তুতপক্ষে জাতিসংঘ বাংলাদেশ ত্রাণ কার্যক্রম (UNROB, United Nations Relief Operation for Bangladesh) foar 795 পর্যন্ত বাংলাদেশের পুনর্বাসন ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর পরই শুরু হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কার্যক্রম (১৯৭৩-৭৮)।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিজস্ব উপায়ে আমার অংশগ্রহণ আমার মনমানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে। সেই পরিবর্তনটি বাংলাদেশে আমি যে আড়াই মাস অবস্থান করি, তাতে আরও সুদৃঢ় হয়। আমি আমার আড়াই মাস দেশে অবস্থানকালে ঢাকার বাইরেও কয়েকটি জেলায় যাই। তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল ময়মনসিংহ, যেখানে আমার বড় ভাই তখনাে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানকে নিয়ে আমি যাই রংপুর ও দিনাজপুরে। সেখানে গণহত্যার কয়েকটি ভয়ংকর ঘটনাস্থল আমরা পরিদর্শন করি। রংপুরে আমাদের জানানাে হয় যে সেখানে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করে একটি গভীর কূপে ফেলে দেওয়া হয়। তখন হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়েছে প্রায় তিন মাস হলাে। কিন্তু আমার মনে হলাে যেন তখনাে পুরাে এলাকাটিতে তার বীভৎস দুর্গন্ধ রয়ে গেছে।
আমি রাজশাহী যাওয়ার জন্য একটি ভ্রমণসূচি তৈরি করি। কিন্তু সেদিন ডাকোটা বিমানটি ৫-১০ মিনিটের মতাে উড্ডয়ন করেই নিচে নেমে আসতে বাধ্য হয়। আমরা সেদিন একটি বিরাট দুর্ঘটনা থেকে কোনােমতে রক্ষা পাই। রানওয়ের শেষ সীমান্তে গিয়ে পাইলট বিমানটি বন্ধ করতে সক্ষম হন এবং আমরা তখন ত্ৰস্তে বিমানের ইমার্জেন্সি এবং অন্যান্য দরজা দিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে আসি। পাইলট আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন যে যেকোনাে মুহূর্তে বিমানে আগুন লাগতে পারে। সৌভাগ্যবশত সেদিন বিমানে আগুন লাগেনি এবং কোনাে প্রাণহানি ঘটেনি। তবে বিমানটি মেরামত করতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগে। খুলনা ভ্রমণ করার প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ওই সময় আমার খুলনা যাওয়া হয়নি। তবে খুলনার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক কামালউদ্দিন সিদ্দিকী আমার দিলকুশার অস্থায়ী দপ্তরে এসে বিস্তৃত আলােচনা করেন। তিনি খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন যে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় এখান থেকে প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র ও গাড়িঘােড়া নিয়ে যায় ।
২৪৩
আমাদের পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের আরেক সদস্য আবদুর রব চৌধুরী তখন ত্রাণকাজের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই পদে তাঁর নিযুক্তি হয় পাকিস্তান আমলে । যার ফলে এ সম্বন্ধে বিভিন্ন পরিকল্পনা এবং ত্রাণসামগ্রীর মজুত সম্বন্ধে তিনি বিশেষভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি তখন বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু এই উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বই হলাে তার সমস্যা। তাঁর কথাবার্তায় এবং বিভিন্ন সরকারি বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার মাধ্যমে তিনি একধরনের রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। তিনি বৈদেশিক বিভিন্ন সহায়তা সংস্থা ও রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন। তাঁর আত্মম্ভরিতা এমন পর্যায়ে পৌছায় যে কিছুদিন পরই তাকে এই দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়। এর কিছুদিন পরই তিনি সরকারি চাকরি থেকে অতি কম বয়সে অব্যাহতি পান।
আমি আমার ঢাকায় অবস্থানকালে হােসেন তৌফিক ইমামকে মন্ত্রিসভার সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে দেখি এবং রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে দেখতে পাই। তারা দুজনই আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হােসেন তৌফিক ইমাম ছিলেন ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যােগদানকারী একজন কর্মকর্তা। তিনি রাজশাহীতে পড়াশােনা করতেন বলে তার সঙ্গে ছাত্রাবস্থায় আমার তেমন যােগাযােগ ছিল না। তার সঙ্গে গভীর পরিচয় হয় যখন আমরা একসঙ্গে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত রাওয়ালপিন্ডিতে কর্তব্যরত । আমি তখন ছিলাম মন্ত্রিসভা বিভাগের উপসচিব এবং তৌফিক ইমাম ছিলেন সর্বজ্যেষ্ঠ মন্ত্রী খাজা মাে. শাহাবুদ্দিনের একান্ত সচিব। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পাকিস্তানের সেই শেষলগ্নে মন্ত্রী জনাব শাহাবুদ্দিনের অবদান ছিল বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক। তিনি ভাঙা বাংলায় কথা বলতেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট থাকতেন। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের ওপর তার প্রভাবও ছিল বেশ উল্লেখযােগ্য। আমি আগেই বলেছি যে ১৯৬৯ সালের গােলটেবিল বৈঠকের প্রধান উদ্যোক্তা ও সমর্থক ছিলেন তিনি।
রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন আমার কনিষ্ঠ কিন্তু সমসাময়িক ছাত্র । সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের আমি যখন সহসভাপতি, তখন তিনি ছিলেন আমার কেবিনেটের একজন উল্লেখযােগ্য সদস্য। তিনি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সিভিল। সার্ভিসে যােগ দেন। বেশ কনিষ্ঠ অবস্থানে থাকাকালেই তিনি নানা ঝামেলার সম্মুখীন হন। সে সময় তাঁকে উপদেশ দেওয়ার এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটি সুযােগ আমার হয়। তিনি ছাত্রনেতা হিসেবে খুবই বিখ্যাত ছিলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এবং সর্বশেষে সভাপতির পদে বহাল ছিলেন। সম্ভবত সে কারণেই পাকিস্তান সরকার তাঁকে
২৪৪
নানাভাবে হেনস্তা করে। তার মতাে নিবেদিতপ্রাণ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সচিব হওয়ায় আমি খুব খুশি হই এবং আমার সেই মনােভাবটি আমি তার কাছে লুকাতেও চেষ্টা করিনি। তিনি সারা জীবনই আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর স্ত্রীকেও আমি খুব ভালােভাবে চিনতাম এবং অত্যন্ত গৌরবের বিষয় যে তার কন্যা শিরীন শারমিন চৌধুরী এখন আমাদের মহান জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার। তাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি যে গভীর, আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধু সে সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। আড়াই মাস পর কলকাতা, দিল্লি, প্যারিস হয়ে আমি ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তন করলাম।
আমার ১৯৭১ সালের অভিজ্ঞতা এবং স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণ আমাকে নিশ্চিত করল যে আমাকে নতুনভাবে জীবনযাত্রা শুরু করতে হবে । আমি স্থির করলাম যে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেব এবং জনকল্যাণকর বিভিন্ন কাজে নিজেকে নিয়ােজিত করব। প্রাথমিকভাবে আমার লক্ষ্য হলাে কিছু বড় রােজগার। কারণ, ১৯৭১ সালে আমার ঋণের বােঝাটি বেশ ভারী হয়ে ওঠে। সে জন্য আমি তখন দুটি চাকরির ব্যাপারে আগ্রহী হলাম। একটি ছিল কোনাে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চাকরি এবং অন্যটি বিশ্ব ব্যাংকের কোনাে চাকরি। একদিকে যেমন আমি সরকার থেকে পদত্যাগের নােটিশ দিলাম, অন্যদিকে নতুন চাকরির অন্বেষণে লিপ্ত হলাম। আমি জানতে পারলাম যে বিশ্ব ব্যাংকে আমার দরখাস্তখানি বিশেষভাবে বিবেচিত হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকরির জন্য। আমার পরিচিত মহলে টেলিফোনযােগে আমি কিছু তদবিরও করলাম।
সে সময় বাংলাদেশ সরকার ওয়াশিংটন মিশনে নিয়ােজিত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এনায়েত করিম সাহেবকে পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ডেকে পাঠাল এবং আমাকে সাময়িকভাবে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স নিযুক্ত করল। আমি বাংলাদেশ সরকারকে জানালাম যে আমি পদটি গ্রহণ করছি বটে, তবে আমার পদত্যাগের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছি। কিছুদিন পর খবর এল যে পাকিস্তান আমলে নিউইয়র্কে নিযুক্ত আমাদের কূটনৈতিক মন্ত্রী সৈয়দ আবদুল করিম নিউইয়র্কে আমাদের স্থায়ী অবজারভার এবং একই সঙ্গে ওয়াশিংটনে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স পদে নিযুক্তি পেয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব নিযুক্ত হলেও সম্ভবত তাঁর পরিবার তখনাে নিউইয়র্কেই অবস্থান করছিল। তিনি নিউইয়র্কে প্রত্যাবর্তন করার পরপরই ওয়াশিংটনে এসে হাজির হলেন এবং বললেন যে আমাকে চ্যান্সারি-প্রধান হিসেবে ওয়াশিংটনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। তিনি আরও বললেন যে তিনি ওয়াশিংটনে খুব কমই আসবেন এবং সে জন্য এই মিশনের দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হবে।
২৪৫
আমরা ওয়াশিংটনের কানেটিকাট অ্যাভিনিউতে ১৯৭১ সালে যে দপ্তরটি বাংলাদেশ মিশনের দপ্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেখানেই থাকলাম। ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের স্বীকৃতি দিলে আমরা সেই বাড়িতে আমাদের পতাকা উত্তোলন করলাম। এ বাড়িতে আমাদের বেশ কিছুদিন থাকতে হয় এবং বাড়িটির অন্য ভাড়াটে ছিল একটি টেইলারিং শপ। সেখানেও আমার একটি দুঃখের কাহিনি বলবার আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই আমরা জোরেশােরে দুটো বাড়ি খুঁজতে থাকলাম। একটা হবে আমাদের দূতাবাসের দপ্তর আর অন্যটা হবে আমাদের রাষ্ট্রদূতের আবাসস্থল। এ দুটি ঘর কেনার জন্য আমি আমার হিসাব কর্মকর্তার সহায়তায় একটি ব্যবস্থা নিই, যাতে বাংলাদেশ সরকার থেকে কোনাে সহায়তা না নিয়েই আমরা এ দুটি বাড়ি কিনতে পারতাম এবং ৩০ বছরের মাসিক কিস্তিতে তার দাম শােধ করতে পারতাম। দপ্তরের বাড়ি পাওয়ার ব্যাপারে আমার ভাগ্য খুব অনুকূল ছিল। ওয়াশিংটনের ম্যাসাচুসেটস অ্যাভিনিউয়ের ১৬ স্ট্রিটের একটি বাড়ি ছিল Daughters of the American Revolution (DAR) প্রতিষ্ঠানের। তারা বাড়িটি আমাদের কাছে। বিক্রির আগ্রহ দেখাল। তাদের বাড়িটির অন্য খদ্দের ছিল চিলির দূতাবাস। বাড়িটির পাশেই ওদের একটি দপ্তর ছিল এবং সেটি সম্প্রসারণের জন্য বাড়িটি তারা চাইছিল। আমরা মােটামুটিভাবে DAR-এর সঙ্গে চুক্তি করলাম এবং কিছু অর্থও প্রদান করলাম। ঠিক হলাে যে আমরা তাদের কাছ থেকে বাড়িটি কিনব কিন্তু তারা আমাদের দখল দেবে এক বছর পর। অবশ্য এটাও ঠিক হলাে যে ১৯৭২ সালের বিজয় দিবসটি আমরা এ বাড়িতেই পালন করব। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি নিয়ে আমরা DAR-এর বাড়িটি খরিদের জন্য চুক্তি করলাম এবং তার জন্য প্রথম কিস্তির দামও শােধ করলাম।
ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে আমাদের প্রথম বিজয় দিবস এ বাড়িতেই উদ্যাপিত হলাে। কিন্তু তারপরই ঘটল একটি বিপদ। আর বিপদটা ছিল একেবারেই অভাবিত। আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দেশ পেলাম যে আমরা বাড়িটি যেন চিলির দূতাবাসকে দিয়ে দিই। এই সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি হিসেবে বলা হলাে যে চিলি আমাদের সরকারকে জানিয়েছে যে তারা আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের তখনকার রাষ্ট্রপ্রধান আমাদের সমর্থন করেন। সে জন্য তারা আশা করে যে ওয়াশিংটনে তাদের দপ্তরের পার্শ্ববর্তী বাড়ি, যেটা খরিদ করার জন্য তারা বহুদিন ধরে চেষ্টা করছে, সেটা যেন আমরা তাদের দিয়ে দিই। তারা এটার জন্য আমরা যে ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছি, সেটি আমাদের দিয়ে দেবে। দাবিটি ছিল একেবারেই উদ্ভট এবং এ রকম আবেদনের কোনাে নজির কারােরই জানা ছিল না।
২৪৬
ওয়াশিংটনে ঘরবাড়ি পাওয়া, বিশেষ করে দূতাবাসের জন্য একটি বাড়ি পাওয়া ছিল খুবই দুরূহ। বরং সেখানে জমি পাওয়া ছিল তুলনামূলকভাবে সহজ। তা ছাড়া চিলির এ রকম আবদারের কোনাে ভিত্তিও ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালে চিলির রাষ্ট্রপতি আলেন্দে একটি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গােছের বক্তব্য দেন। কিন্তু আলেন্দে তত দিনে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অপসারিত হয়েছেন এবং একজন একনায়ক দেশটির ক্ষমতা দখল করেছেন। আমাদের সরকার এ বিষয়ে আমাদের কোনাে মতামত না চেয়ে বলে দেয় যে তারা বাড়িটি চিলির কাছে। হস্তান্তর করবে। আমি খবর পেয়েই ঢাকায় টেলিফোন করলাম, আমাদের আপত্তি জানালাম এবং বললাম যে কোনােমতেই বাড়িটি আমি চিলির দূতাবাসকে দেব না। এ বিষয়ে অনেক লেখালেখিও হলাে কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন আমাকে টেলিফোন করে বললেন যে এ ক্ষেত্রে কোনাে বাদ না সেধে আমি যেন তাদের নির্দেশ মেনে নিই।
এই নির্দেশে আমার দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর করার কিছুই ছিল না। সিদ্ধান্তটি ছিল একেবারেই ভুল এবং এ বিষয়ে কোনাে তথ্য যাচাই না করেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিদ্ধান্তটি নেন। প্রথমত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে চিলির সমর্থন ছিল অতি দুর্বল। দ্বিতীয়ত, সেই সমর্থনকারী প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে হত্যা করে ততদিনে দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামরিক একনায়কত্ব। তৃতীয়ত, ওয়াশিংটনে দূতাবাসের জন্য এ রকম একটি বাড়ি কেনার ব্যাপারে একটি নতুন দেশ, তখন পর্যন্ত যার কোনাে দূতাবাসই ছিল না, তার কাছে এমন আবদার করা ছিল। একেবারে অচিন্তনীয় এবং অসৌজন্যমূলকও বটে। চতুর্থত, ওয়াশিংটনে চিলির দূতাবাস তখন তিনটি দালানে বিস্তৃত ছিল, তারা অতিরিক্ত বাড়ি খুঁজছিল; অন্যদিকে বাংলাদেশের তখন দূতাবাসের জন্য কোনাে ভবনই ছিল না এবং একমাত্র এটিই পাওয়ার সুযােগের তারা সদ্ব্যবহার করে।
আমাদের সরকারের এই সিদ্ধান্ত আমাকে খুবই কষ্ট দেয় এবং আমি এই হস্তান্তরে অংশগ্রহণ করতেই রাজি ছিলাম না। আমি আমাদের মিশনের নবাগত কর্মকর্তা দ্বিতীয় সচিব আনওয়ারুল করিমকে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য বললাম। তাকে শুধু বললাম যে ক্রয়মূল্যের সঙ্গে কয়েক মাসের সুদও আদায় করা যথাযথ হবে। নিয়মমতাে চিলি দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের চুক্তি হলাে এবং আমরা বাড়িটির দখল একটি দুর্বত্ত সরকারের হাতে তুলে দিলাম। এখানে উল্লেখযােগ্য যে আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যুত করা সেই পিনােচেট পরে মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে বিচারের সম্মুখীন হন এবং বন্দী অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ সরকার ওয়াশিংটনে দূতাবাস কেনার জন্য পরবর্তী প্রায় ১০ বছর চেষ্টা করেও কোনাে সুবিধা করতে পারেনি। অবশেষে তারা নতুন এলাকায়
২৪৭
জমি খরিদ করে এবং শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে সেখানে দূতাবাসটি নির্মিত হয়।
চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর আমি আমার মূল পদে অর্থাৎ অর্থনৈতিক মন্ত্রী হিসেবেই ওয়াশিংটন দূতাবাসে কাজ করতে থাকি। এর মধ্যে আমরা ১৯৭২ সালের বিশ্ব ব্যাংকের বার্ষিক সভার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। আমি পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতার আলােকে কী ধরনের কার্যক্রম আমাদের নিতে হবে তার প্রস্তাবসহ একটি বিস্তৃত চিঠি মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে পাঠালাম। আমি আরও বললাম যে এটি হবে বাংলাদেশ সরকারের কোনাে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধির প্রথম আমেরিকা সফর। সুতরাং এই সুযােগে আমরা মার্কিন সরকারের বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করার সুযােগ নেব।
মার্কিন সরকার থেকে আমরা তখন উল্লেখযােগ্য আর্থিক সহায়তা পাচ্ছিলাম। এই সহায়তা আমরা নিক্সন-কিসিঞ্জারের কারণে পাইনি। আমরা পেয়েছিলাম মার্কিন কংগ্রেসে আমাদের পক্ষে শক্ত সমর্থনের কারণে। সিনেটর কেনেডি বাংলাদেশকে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেওয়ার জন্য একটি প্রস্তাব সিনেটে ইতিমধ্যেই উত্থাপন করেছিলেন। মার্কিন সরকার যখন তাদের বৈদেশিক সহায়তা আইনে বাংলাদেশের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চাইল, তখন তাঁর প্রস্তাবে জোর না দিয়ে সিনেট সরকারি প্রস্তাবে সমর্থন দেয়। এই ২০০ মিলিয়ন ডলার আমাদের অত্যন্ত সহজ শর্তে দেওয়া হয়। বলা হয়, আমরা এই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য খরিদ করতে পারব। যদিও এ ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ ছিল, যেমন পণ্যের সরবরাহ নিতে হবে আমেরিকা এবং আরও ৩৫টি নির্দিষ্ট দেশ থেকে।
বাংলাদেশ সরকার অনুদানটি দ্রুত ব্যবহারের লক্ষ্যে একটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমি প্রস্তাব করেছিলাম যে বিভিন্ন পণ্য, যেমন : চাল, গম, ভুট্টা ও ভােজ্যতেল অথবা বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য মন্ত্রী পর্যায়ের দুটি স্বতন্ত্র কমিটি করা যেতে পারে। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ওয়াশিংটনে আমাদের জানালে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন সরকারের সম্মতি গ্রহণ করব এবং তদনুযায়ী ঢাকাকে অবহিত করব। আমার সেই প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় খাদ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। তারা প্রস্তাব করে যে বিভিন্ন টেন্ডার কমিটির পরিবর্তে একটি কমিটি করলেই যথেষ্ট হবে এবং কমিটির সিদ্ধান্তের পক্ষে ওয়াশিংটন দূতাবাস মার্কিন সরকারের সম্মতি আদায় করে পরিকল্পনা কমিশনকে অবহিত করবে। তারপরই পরিকল্পনা কমিশন ক্রয়-প্রক্রিয়া শুরু করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্তটি অনুমােদন না করে একটি বিকল্প সিদ্ধান্ত অনুমােদন করেন। তার সিদ্ধান্ত ছিল, যেহেতু বিভিন্ন পণ্য বিভিন্ন দেশ থেকে
২৪৮
আমদানি করা হতে পারে, সে জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুরােধমতাে ওয়াশিংটন দূতাবাসই ক্রয় কার্যক্রমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করবে। সেখানে মার্কিন সরকারের সম্মতি গ্রহণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইকোনমিক মিনিস্টারই দেবেন।
সিদ্ধান্তটি আমার দেখার সুযােগ হয় প্রায় দেড় বছর পর, আমি যখন ছুটি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছি তখন। খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার সিদ্ধান্তটি আমাকে দেখান। এই ক্রয় কার্যক্রম আমাকে খুব ব্যস্ত রাখে। তবে আমি আমার পরিশ্রম অনেকটা লাঘব করি আমার অন্য সহকর্মীদের এ কাজে সম্পৃক্ত করে । তথ্য কাউন্সিলর সৈয়দ নূরউদ্দিন, রাজনৈতিক কাউন্সিলর আবদুল আউয়াল, শিক্ষা কাউন্সিলর ফারুক আজিজ খান, অর্থনৈতিক প্রথম সচিব নূরুল ইসলাম অনু, আমার হিসাব দপ্তরের দ্বিতীয় সচিব আতাউর রহমান চৌধুরী এবং তাঁর উত্তরসূরি মােস্তাক আহমেদ—তারা সবাই এ কাজে সম্পৃক্ত হন। এই ২০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা বাংলাদেশ সরকারের খুবই কাজে আসে। কারণ, এই সহায়তা মােটামুটিভাবে নগদ পয়সা হিসেবেই বিবেচিত হয়। এই ক্রয়কাজে আমাকে একবার কানাডায় যেতে হয় সেখান থেকে গম খরিদ করার জন্য। বাকি সব দরপত্রই আমরা যুগপৎ ওয়াশিংটন ও ঢাকায় আহ্বান করতাম। কিন্তু সেগুলাে সব নির্দিষ্ট সময়ে ওয়াশিংটনে জমা দিতে হতাে।