স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ - আবুল মাল আবদুল মুহিত
স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ - আবুল মাল আবদুল মুহিত
ভূমিকা
আমি আমার স্মৃতিকথার দ্বিতীয় খণ্ড ‘স্মৃতিময় কর্মজীবন’ সমাপ্ত করেছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একটি দিনপঞ্জি দিয়ে। তখন আমার বয়স ৩৭ বছর। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ কোনাে বছর আর ছিল না। বিংশ শতাব্দীতে আমরাই একমাত্র দেশ, যেখানে দেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র, রক্তক্ষয়ী ও ব্যাপকভাবে বিধ্বংসী একটি যুদ্ধ করতে হয়। অথচ এটি কোনাে গৃহযুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি লুটেরা, শঠ, নির্মম জনগােষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিপ্রিয়, নির্বিরােধী, নিয়মতান্ত্রিক জনগােষ্ঠীর জীবন-মরণ যুদ্ধ। সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য আমরা মােটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তনে রাতারাতি হয়ে গেলাম দৃঢ়সংকল্প ও দুঃসাহসী এক বীর জাতি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ভূখণ্ড শত্রুমুক্ত হলাে ঠিকই কিন্তু শত্রুরা রেখে গেল ধ্বংসপ্রাপ্ত বিধ্বস্ত একটি দেশ। তিরিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেলাম আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ । আমাদের লক্ষ লক্ষ মা-বােনের ইজ্জত একটি বর্বর দস্যু দলের মতাে হরণ করে বিদায় হলাে তারা। এরপর আমাদের প্রধান কাজ হলাে অর্থনীতির পুনর্বাসন এবং উৎপাদনে দ্রুতগতিতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। জনগণের পুনর্বাসনে তেমন অসুবিধা হলাে না, কারণ তারা নিজেরাই সে দায়িত্ব পালন করল।
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ। প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যে জর্জরিত; ৬৫ শতাংশ নিরক্ষর। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ফলে আমাদের জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত হলে আমাদের আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল স্বাধীন দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ এবং নতুন উদ্যোগে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অন্তর্ভুক্তি।
আমার স্মৃতিকথার এই তৃতীয় খণ্ডে আমি শুধু একাত্তরের কাহিনিই লিখতে বসেছি। তবে তাতে ১৯৭২ সালের স্মৃতিও স্থান পাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালে আমি ছিলাম সুদূর আমেরিকায় পাকিস্তান দূতাবাসে ওয়াশিংটনে পদায়িত অর্থনৈতিক কাউন্সেলর। ৩০ জুন সেখানে পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করে আমি
চূড়ান্তভাবে সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে ব্ৰত হই। সে যুদ্ধ কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র হাতে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ ছিল না। সে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল করার জন্য বিশ্ব জনমত সৃষ্টির প্রয়াস এবং পাকিস্তানকে জব্দ করার জন্য সে দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক ঘৃণা ও অসহযােগিতা উদ্রেক করা। সেই উদ্যোগে সহযােগী হন প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালি জনগণ, বন্ধু দেশ ভারতের ডায়াসপােরা এবং সংবেদনশীল মার্কিন জনগণ। সংবাদ মাধ্যম, বুদ্ধিজীবীবৃন্দ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যুবক, কিশাের ও শিক্ষকবৃন্দ এবং অসংখ্য বিবেকতাড়িত মানবতাবাদী সাধারণ মানুষ এতে মূল্যবান ভূমিকা রাখেন।
এ বই এবং স্মৃতিকথার অন্যান্য খণ্ড সম্পাদনা করতে গিয়ে আমি লক্ষ করি। যে অনেক বিষয়ে আমার স্মৃতিনির্ভর বিবরণ যথাযথ হয়নি এবং বেশ কিছু বিষয়ের উল্লেখ বাদ পড়েছে। কালানুক্রমও সঠিকভাবে রক্ষিত হয়নি। স্মৃতি অম্লান : ১৯৭১ বইয়ের এই নতুন সংস্করণে এগুলাে সংশােধিত যথাসাধ্য হলাে।
এ বইয়ের ১৯৯৬ সালের ভূমিকায় আমি বলেছিলাম তদানীন্তন ভােরের কাগজ-এর সম্পাদক মতিউর রহমান বইটি লিখতে আমাকে প্ররােচিত করেন। তাঁরই উদ্যোগে মাত্র চার মাসে অন্যান্য কাজের ফাঁকে আমি বইটি রচনা করি । এবার সে বইয়ের সংশােধিত ও পরিবর্ধিত নতুন সংস্করণটিও প্রকাশ করছে মতিউর রহমানের প্রথমা প্রকাশন।
১০ অধ্যায়ের গ্রন্থটি এবার বর্ধিত আকারে ১৩ অধ্যায়ের একটি গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। পুরােনাে বইটির আদলই বদলে গেছে। পরিশিষ্ট থেকে চারটি অংশ নতুন একটি অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে। একেবারেই দুটি নতুন অধ্যায় হিসেবে সংযােজিত হয়েছে ১৯৭২ সালের কাহিনি।
প্রায় নতুন এ বই পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি বিশেষ আনন্দবােধ করছি। এটি আমাদের বিজয়ের গাথা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে গৌরবােজ্জ্বল সময়ের কাহিনি।
আবুল মাল আবদুল মুহিত
ঢাকা
জুলাই ২০১৭
<p style="text-align: justify;"> প্রথম অধ্যায়
অমীমাংসিত দাবি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ যুগে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি, তখনই এই তত্ত্ব ও দাবির সঙ্গে পরিচয় হয়। স্কুলে সে যুগে কোনাে সমাজবিজ্ঞান পড়ানাে হতাে না, তবে নবম-দশম শ্রেণিতে জনপ্রশাসন বলে একটি বিষয় ছিল। বিষয়টি মােটামুটিভাবে সমাজবিজ্ঞানেরই তালিম দিত। কিন্তু রাজনীতি-সচেতন সব ছেলেই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে ভাসা-ভাসাভাবে ওয়াকিবহাল ছিল। তখন অবশ্য আরেকটি ব্যাপার ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীরা ছিলেন অনেক দূরে এবং সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন। কিন্তু প্রাদেশিক মন্ত্রীরা স্কুলে এসেও পুরস্কার বিতরণ করতেন। আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার মােহাম্মদ সাদুল্লার কাছ থেকে একটি পুরস্কার পাবার ঘটনা আমার খুব মনে আছে। মােটের ওপর বােঝা যেত যে স্বায়ত্তশাসনে কাছের লােক ক্ষমতা প্রয়ােগ করবে, তাতে অভিমতের কদর থাকবে এবং এতে যে একটি সমজাতিক গােষ্ঠী ক্ষমতাসীন থাকবে, তাতে কোনাে সংশয়ের অবকাশ ছিল না ।
১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হলাে, আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র—একটি রাজনৈতিক পরিবারের ছেলে এবং নিজেও বেশ সক্রিয়। আমরা লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবী । আমাদের শহরে সরকারবিরােধী অসহযােগ আন্দোলনে ২৪ এপ্রিল তারিখে আলকাস শহীদ হয়েছে। পাকিস্তান নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন। উদারতা, ন্যায়নীতি, স্বাধীনতা আর শ্রীবৃদ্ধি দিয়ে আমরা ভারতকে তাক লাগিয়ে দেব। আমরা খুব সংহত ও ঐক্যবদ্ধ এবং আমাদের নেতা শৃঙ্খলা ও দৃঢ়চিত্ততার প্রতিভূবিশেষ। কিন্তু সেই স্বপ্ন ছিল খুব স্বল্পস্থায়ী ।
১১
বছর যেতে না যেতে নানা বিষয়ে দেশের দুই ভাগের মধ্যে বনিবনায় ফাটল দেখা দিল। আমরা ভেবেছিলাম, আমরা একটি আদর্শ দেশ হব, আমাদের ভৌগােলিক দূরত্ব সত্ত্বেও আমরা শক্তিশালী দেশ হব। আমরা হব অনন্য। কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা এল, প্রতিনিধিত্ব ও ভাষা নিয়ে। তারপর আরও কত কিছু।
সিলেটে শুরু থেকেই আমরা ভাষা নিয়ে ছিলাম বিশেষ তৎপর। এর কারণ বােধ হয় ছিল কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের দশাের্ধ্ব বছরের সাধনা। ১৯৩৬ সালে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন কতিপয় দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল যুবকগণ।
এই প্রতিষ্ঠান একটি প্রগতিশীল, আত্মসচেতন, উন্নতমনা মুসলমান তরুণসমাজ গঠনে ব্রতী হয়। কৈশােরে আমি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হই এবং তরুণ বয়সেই ১৯৫০ সালে এর আজীবন সদস্য হই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার। অব্যবহিত পরই এই প্রতিষ্ঠান দাবি করে বসল যে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে। ১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে সাহিত্য সংসদের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলাে। স্মরণ থাকে যেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কিন্তু শুরু হয় অনেক পরে, ১৯৪৮-এর জানুয়ারি মাসে। সাহিত্য সংসদ ১৯৪৭-এর ৯ নভেম্বরে একটি আসর ডাকে, যেখানে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুসলিম চৌধুরী ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এরপর এ বিষয়ে আরেকটি বড় আলােচনা সভা হয় নভেম্বরের ৩০ তারিখে, যেখানে প্রবন্ধ পাঠ করেন তরুণ সংসদকর্মী হােসেন আহমদ। আর এদিন বিশেষ বক্তব্য দেন। সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও সাহিত্যিক ড. সৈয়দ মুজতবা আলী। এ দুই সভায় সভাপতিত্ব করেন কথাসাহিত্যিক মতিন উদ্দিন আহমদ। তার পরও ৮ ডিসেম্বরে আরেক সভা হয় সংসদের সভাপতি শিক্ষাবিদ নজমুল হােসেন চৌধুরীর সভাপতিত্বে । তাতে প্রবন্ধ পাঠ করেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মােহাম্মদ আজরফ । এসব আলােচনা সভার প্রথম দিকে আমাদের বয়সী অনেক তরুণ উপস্থিত ছিল কিন্তু দ্বিতীয় সভায় শহরের সুধীসমাজ ভেঙে পড়ে। তাই বিতর্কে আমাদের উৎসাহ আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪৮-এর প্রদেশব্যাপী ভাষা আন্দোলন তাই আমাদের একটু বেশি করেই দোলা দেয়।
১৯৪৭-এর আগে আমাদের আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের জন্য। ১৯৪৮-এ আন্দোলন শুরু হলাে অন্য বিষয় নিয়ে, অন্য মাত্রায়, অন্য রকমের। ভাষা আন্দোলন ছাড়া আরও অনেক বিষয় হয়ে উঠল গুরুত্বপূর্ণ। দেশরক্ষার জন্য বিরাট খরচ হয় কিন্তু পূর্ব বাংলা তাতে অংশীদার নয়। দেশরক্ষা যদি গুরুত্বপূর্ণই হবে, তবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জন্যই তাে তা গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের খরচ জোগানাের জন্য রাজস্ব চাই কিন্তু প্রাদেশিক যে দু-একটি সূত্রে রাজস্ব আদায় হয়, সেগুলাের ওপর এত চাপ কেন? ব্রিটিশ আমলে প্রাদেশিক একটি
১২
উল্লেখযােগ্য রাজস্ব সূত্র ছিল বিক্রয় কর। পাকিস্তানের শুরুতেই কেন্দ্রীয় সরকার এই সূত্রটিকে প্রদেশের হাত থেকে কেন্দ্রে নিয়ে গেল । শিল্পোন্নয়ন হবে মানুষের সুখের জন্য, সে দায়িত্ব তাে প্রাদেশিক সরকারের। সেটা প্রদেশের হাত থেকে কেন কেন্দ্র নিয়ে যাবে? কেন্দ্র তাে আমাদের অনেক দূরে, সেখানে আমাদের প্রতিনিধিও কম। মন্ত্রী তাে প্রায় নেই। শিক্ষার মাধ্যম তাে আমাদের ব্যাপার, ভাষার স্বীকৃতি আমাদের অধিকার। এসব বিষয়ে প্রথমে যৎসামান্য এবং কালক্রমে জোরালাে সমালােচনায় সুধীমহল মুখর হয়ে উঠল। তারই ফলে এবার স্বায়ত্তশাসন আলােচনার মঞ্চ থেকে আন্দোলনের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। বিষয়টি গুরুতর আকার ধারণ করল যখন সংবিধান প্রণয়নের জন্য মূলনীতি কমিটি তাদের সুপারিশ পেশ করল।
১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নভেম্বর ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে সরকারবিরােধী সব গােষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণসমাজ, মূলনীতি কমিটির সুপারিশের ওপর এক মহাসম্মেলনের আয়ােজন করে। আমি তখন সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজের ছাত্র। আমরা প্রাদেশিক নানা ছাত্রসংগঠনের ওপর বীতশ্রদ্ধ, কোনােটাই পছন্দের নয়। তাই ১৯৫০ সালে দাঙ্গার পর, বােধ হয় ফেব্রুয়ারি কি মার্চে, একটি নির্দলীয় প্রগতিশীল শিক্ষা সমিতি সংগঠন করি। যেকোনাে সমস্যার মােকাবিলা করতে আমরা এগিয়ে যেতাম কিন্তু আমাদের মতামত ছিল আমাদের নিজস্ব কোনাে কেন্দ্রীয় সংগঠনের নির্দেশের আমরা তােয়াক্কা করতাম না। এই সমিতির আহ্বায়ক হিসেবে আমি ঢাকার মহাসম্মেলনে যাই সিলেটের প্রতিনিধি হিসেবে। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান, পরবর্তী সময়ে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী এবং বাংলাদেশে এরশাদের আমলে কিছুদিন প্রধানমন্ত্রী। এই মহাসম্মেলনের প্রধান সুপারিশ হয় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ফেডারেল সরকার হবে সীমিত ক্ষমতার, তার রাজস্ব আদায় হবে পূর্বনির্ধারিত খাতে আর তার দায়িত্ব হবে মাত্র দুটি বিষয়ে, যথা পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা (সেখানেও আঞ্চলিক স্বয়ম্ভরতা গড়ে তুলতে হবে)।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে সরকারবিরােধীরা বানাল যুক্তফ্রন্ট আর ঘােষণা করল একুশ দফার নির্বাচনী কর্মসূচি। এই কর্মসূচির ১৯ ধারায় দাবি করা হলাে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। ফেডারেল কর্তৃত্ব হবে তিনটি বিষয়ে—পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও মুদ্রা। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে সংবিধান রচনাকালে স্বায়ত্তশাসন নিয়ে চলে জোরালাে বিতর্ক। এই তিন বিষয়ের বাইরে ফেডারেল কর্তৃত্ব হয় প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর, ভারী শিল্পের ওপর, আর্থিক খাতের ওপর এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর। পূর্ব বাংলার ৪০ জনের মধ্যে ২৩ জন গণপরিষদ সদস্য এই সংবিধানের পক্ষে ভােটদানে
১৩
বিরত থাকেন। তাঁদের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল যথাযথ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অভাব । এ ছাড়া আরও আপত্তি ছিল, যেমন যুক্ত নির্বাচন সম্বন্ধে সিদ্ধান্তহীনতা, পশ্চিমে এক ইউনিট স্থাপন এবং রাষ্ট্রপতির অত্যধিক স্ববিবেচনার ক্ষমতা। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি যে সংবিধান পাস হলাে, তাতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কিছুটা খর্ব হলেও ফেডারেল সরকার ছিল সীমিত ক্ষমতার । এ নিয়ে ছাত্র মহলে দুই রকম চিন্তাধারা ছিল । নয় বছরে সংবিধান রচিত হয়েছে এবং সত্যিকার অর্থে প্রথম জাতীয় পরিষদ গঠিত হতে যাচ্ছে। বলে অনেকেই খুশি হন। নির্বাচনের প্রস্তুতি তখন চলছে এবং ১৯৫৭-তে তা অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘােষণা দেওয়া হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রভাবে ছাত্রলীগ এই সংবিধান গ্রহণ করল না। তখন সলিমুল্লাহ হল ইউনিয়নে ছাত্রলীগের কর্তৃত্ব বহাল ছিল । সহসভাপতি ছিলেন ইব্রাহিম তাহা এবং সাধারণ সম্পাদক এ টি এম শামসুল হক। দুজনই ছাত্রলীগের প্রতিনিধি। ২৩ মার্চে সংবিধান। দিবস পালনে তাঁদের সায় নেই কিন্তু ছাত্রসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ উৎসব উদ্যাপন করতে চায়। তাই একটি বিশেষ কমিটির হাতে এই উৎসব উদ্যাপনের ভার দিল হল ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষ। সেই বিশেষ কমিটির আহ্বায়ক হই আমি। সলিমুল্লাহ হলে আমরা চমৎকার আলােকসজ্জার ব্যবস্থা করি । একটি আতশবাজি জ্বালাতে গিয়ে আমার বাঁ হাতের খানিকটা পুড়ে যায় বলে উৎসবটির কথা বিশেষ করে মনে আছে।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন বহাল হলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে যবনিকা পড়ল। আইয়ুব খান ‘ফেডারেল সরকারের নাম পরিবর্তন করে তার নাম দেন ‘কেন্দ্রীয় সরকার। তারপর তিনি রাজকীয় কায়দায় একটি সংবিধান দিলেন, যেখানে সারা দেশে প্রতিষ্ঠা করা হলাে ‘শাসনতান্ত্রিক একনায়কত্ব। এতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন শিকেয় উঠল। প্রদেশের সমুদয় ক্ষমতা ন্যস্ত হলাে রাষ্ট্রপতির একান্ত অনুগত তারই নিযুক্ত প্রদেশপালের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকারের সব ক্ষমতার উৎস হলেন পরােক্ষ নির্বাচনে পার পেয়ে যাওয়া রাষ্ট্রপতি আর মন্ত্রিসভা অথবা জাতীয় পরিষদ হলাে তার বশংবদ। এই ব্যবস্থার প্রতিবাদে আবার স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন জোরদার হলাে। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগের ১১ দফা মূলতই ছিল স্বায়ত্তশাসনের সনদ, অবশ্য তখন সামরিক শাসনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক সরকারব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণ ছিল মুখ্য বিষয়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে শাসনতান্ত্রিক একনায়ক লিপ্ত হলেন ১৭ দিনের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে। এ যুদ্ধই আইয়ুব খানকে শেষ করল এবং খলনায়ক ভুট্টোকে রঙ্গমঞ্চে নিয়ে এল। তবে এ যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে আরও জোরালাে করল। মনে রাখা ভালাে যে ব্রিটিশ
১৪
শাসনের অবসানে আমাদের দেশের নাম হয় পূর্ববাংলা। তবে পাকিস্তানের। শাসনতন্ত্র ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চে এই নাম পরিবর্তন করে রাখল পূর্ব পাকিস্তান। যুদ্ধকালে আমাদের বিচ্ছিন্ন ও অসহায় অবস্থান সবার কাছে ধরা পড়ে। যুদ্ধ শেষে লাহােরে এক সম্মেলনে বসলেন আইয়ুববিরােধী নেতারা। তাঁদের আলােচনার বিষয় ছিল কাশ্মীর সমস্যা এবং যুদ্ধোত্তর রাজনীতি। কিন্তু এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সমস্যার দিকে নজর দিতে কেউ রাজি হলেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আবির্ভাব হয় আমাদের বাঁচবার সনদ ছয় দফা কার্যক্রম।
ছয় দফার পাঁচটি দফাই ছিল স্বায়ত্তশাসন নিয়ে। প্রথম দফায় ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি। প্রত্যক্ষ ভােটে ফেডারেল সংসদীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল এক নম্বর দফা। এক ব্যক্তি এক ভােটের ব্যবস্থা করে সমতার নামে যে ধোকাবাজি চলছিল, তাকে বিসর্জন দিতে হবে। দুই নম্বর দফায় সেই পুরােনাে দাবি, ফেডারেল সরকারের কর্তৃত্ব হবে পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা বিষয়ে, সামনে আসলাে। তিন নম্বর দফায় ছিল প্রদেশের রাজস্ব ক্ষমতা। ফেডারেল সরকারের খরচ প্রদেশগুলাে জোগাবে কিন্তু সমুদয় রাজস্ব সূত্র হবে প্রাদেশিক সরকারের। চার নম্বর দফায় ছিল বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব থাকবে আঞ্চলিক ভিত্তিতে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য হবে আঞ্চলিক সরকারের দায়িত্ব। ছয় নম্বরে ছিল পুরােনাে দাবি, অর্থাৎ আঞ্চলিক দেশরক্ষার ক্ষমতা গড়ে তােলা এবং এ জন্য আঞ্চলিক বাহিনী গঠন। ছয় দফার প্রথম দফা নিয়ে ঝগড়া বেশি দিন স্থায়ী হলাে না কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের দফাগুলাে অমীমাংসিত থেকে গেল এবং এরই মীমাংসা পাওয়া গেল মুক্তিযুদ্ধে।
১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহােরে এক সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফার প্রথম ঘােষণা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের পরবর্তী কাউন্সিল সভায় ১৯ মার্চ এই কার্যক্রম গৃহীত হয় এবং শেখ মুজিব হন দলের সভাপতি। কিন্তু কদিনের মধ্যেই ৫ মে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং বন্দী অবস্থায়ই ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারিতে হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি। এই মামলা খারিজ হয় ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যান রাওয়ালপিন্ডির গােলটেবিল বৈঠকে আগামী দিনের সংবিধানের রূপরেখা নির্ধারণ করতে। গােলটেবিল বৈঠক শেষ হলাে ১৪ মার্চে কিন্তু সংবিধানের রূপরেখা ঠিক হলাে না। সেই ছাত্রাবস্থায় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন করেছি। এবারে ১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করি একজন সরকারি আমলা হিসেবে।
১৫
আমি তখন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিসভা বিভাগের উপসচিব। সে সময় সরকারের কলেবর অনেক ছােট ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীর সংখ্যা ১২-১৪ জনের বেশি ছিল না। মন্ত্রিসভা বিভাগে ছিলেন একজন সচিব এবং গােটা ১০ জন শাখাপ্রধানসহ (বর্তমানের সহকারী সচিব) দুজন উপসচিব। ১৯৬৮ সালের শেষে ওয়াশিংটনে দূতাবাসে পরবর্তী চাকরিতে যাব বলে আমি মন্ত্রিসভা বিভাগে পাততাড়ি গুটাচ্ছি। অন্তত তিন বছরের জন্য ওয়াশিংটন যাচ্ছি, সুতরাং তার আগে লম্বা ছুটি দেশে কাটাব বলে আগেভাগেই তৈরি হচ্ছি। কিন্তু গােলটেবিল বৈঠকের সম্ভাবনা আমার ছুটি নাকচ করে দিল। যথাসময়ে আমার ওপর হুকুম হলাে যে আমাকে পিন্ডি প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং বৈঠকের সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের দেখভাল করতে হবে। ফিরে গিয়ে আমাকে আমারই পুরােনাে বাড়িতে যেতে হলাে। তবে এবার বন্ধুবর গােলাম মােস্তফার অতিথি হিসেবে। সে আমার উত্তরসূরি হিসেবে মনােনীত হয়েছে বলে আমি বাড়ি ছেড়ে দিই এবং তারা ততক্ষণে সেখানে পুরােদস্তুর বহাল হয়ে গেছে। পরবর্তী পাচ মাসের মতাে ওই বাড়িতে আমি আমার বন্ধু ও উত্তরসূরির অতিথি কামরায়। আস্তানা গাড়ি।
গােলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা পিন্ডির পূর্ব পাকিস্তান হাউস ও পশ্চিম পাকিস্তান হাউসে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে রােজই দেখা হতাে, আলাপ হতাে। সরকারি দলের বেশির ভাগ প্রতিনিধিও নানা কাজে ডাকতেন বলে তাঁদের সঙ্গেও আলাপ-আলােচনা হতাে। গণতন্ত্রায়ণের বিধান নিয়ে কোনাে সমস্যা ছিল না, তবে স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে অনেক বাধাবিপত্তি। আমার নিজের ধারণা হয় যে প্রতিরক্ষা ও রাজস্ব বিষয়ে ফেডারেল সরকারকে আরও ক্ষমতা দিলে বাকি বিষয়ে ছয় দফার ভিত্তিতে একটি সমঝােতা হতে পারে। কিন্তু গােলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলাে সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষের জন্য। তারা ক্ষমতা ছাড়তে মােটেই রাজি ছিল না। আইয়ুব যেতে পারেন কিন্তু সামরিক শক্তি দখলদারি ছাড়বে না, আর তাঁদের মদদ দেন। কতিপয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ—পশ্চিমের জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পূর্বের মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। আর আমলাতন্ত্র প্রায় সম্পূর্ণভাবে ছিল সামরিক শক্তির দোসর। জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আসীন হলেন, ওপর স্তরে সব তছনছ হয়ে গেল কিন্তু আমাদের স্তরে সবার ছুটিছাটা বা বদলি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেল। অবশেষে মাসখানেক ছুটি নিয়ে আগস্টের মাঝামাঝি আমি আমেরিকায় পাড়ি দিলাম—ওয়াশিংটনে দূতাবাসে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর হিসেবে। পাকিস্তান সরকারের আমলা হিসেবে এই ছিল আমার শেষ পদ।
আমি পাকিস্তান ছাড়ার প্রাক্কালে ইয়াহিয়া রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সুপারিশ আহ্বান করেন এবং একই সময়ে একটি বেসামরিক মন্ত্রিসভা গঠন
১৬
করেন। হামিদুল হক চৌধুরী তখন প্রায়ই ওয়াশিংটনে যেতেন, সেখানে তাঁর মেয়ে এবং অসুস্থ জামাতা ছিলেন। তিনি গেলে সব সময়ই তাঁর সঙ্গে আলাপআলােচনা হতাে। তার মুখেই প্রথম জেনারেল ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য উদ্যোগের কথা শুনলাম। তিনি যথার্থই ইয়াহিয়ার বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। চৌধুরী বললেন যে রাজনীতিবিদদের সময় বেঁধে দিয়ে সংলাপে বসিয়ে দিলে সমাধান একটি বেরিয়ে আসবেই, ১২০ দিনে জাতীয় পরিষদ একটি সংবিধান রচনা করতে সক্ষম হবে। এর কিছুদিন পরই ইয়াহিয়া ২৮ নভেম্বরের ঘােষণায় জানালেন যে ১. এক ইউনিট ভেঙে দেওয়া হবে, ২. প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং সংবিধান প্রণয়নের ব্যবস্থা হবে। ১৯৭০-এর ৩০ মার্চ জারি হলাে দুটো আদেশনামা। প্রথম আদেশে এক ইউনিট ভেঙে চার প্রদেশ ও এক ফেডারেল এলাকা হলাে পশ্চিম পাকিস্তানে। দ্বিতীয় আদেশে ১৬৯ জন পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যসহ ৩১৩ সদস্যের এক জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ দেওয়া হলাে ৫ অক্টোবর। একই সঙ্গে প্রাদেশিক পরিষদগুলােরও নির্বাচনের ব্যবস্থা নেওয়া হলাে। জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে বসে ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করবে আর প্রেসিডেন্ট তা অনুমােদন করবেন। স্বায়ত্তশাসন। সম্বন্ধে কোনাে স্বচ্ছ দিকনির্দেশনা এতে ছিল না। আরও মজার ব্যাপার হলাে যে পশ্চিমের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি ছয় দফা সম্বন্ধে কোনাে বক্তব্যই দিল না। পশ্চিমের সবাই-রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, সামরিক বাহিনী মায় সাংবাদিক গােষ্ঠী—মােটামুটিভাবে ছয় দফাকে অবহেলা করে গেল, যেন স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি মােটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের ছয় দফা প্রায় চার বছর ধরে লােকমুখে, মাঠেঘাটে সর্বত্র। এই হিসাবে ছয় দফা বাঙালিদের ম্যাগনাকার্টার আসন নিয়েছে।
১৯৬৯-৭০ সালে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কাজে অথবা ভ্রমণে আসেন এবং তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনার খানিকটা সুযােগ আমার হয়। প্রথমেই এলেন অর্থমন্ত্রী নবাব মােজাফফর আলী কিজিলবাস। একবার এলেন তথ্য বা প্রচারমন্ত্রী জেনারেল শের আলী। আবার এলেন প্রখ্যাত আমলা পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্টের সভাপতি আজিজ আহমদ। আর একবার এলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার আবদুর রশিদ। জাতিসংঘের ২৫তম অধিবেশনে যােগ দিতে এলেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি ওয়াশিংটনেও এলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনার জন্য।
পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্ক নিয়ে জেনারেল শের আলীর কোনাে মাথাব্যথাই ছিল না। তাঁর মতে, সমস্যা ছিল বিবদমান রাজনীতিবিদদের নিয়ে, তাঁরা দেশ শাসনে অপরিপক্ক। সদিচ্ছা থাকলেও যােগ্যতা নেই এবং বিশেষ করে শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণ
১৭
নেই। কিন্তু তাঁদের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। কারণ, তারা জনগণের কাছের লােক আর তাদের প্রতিনিধি। তবে সামরিক বাহিনী তাদের প্রতি কড়া নজর রাখবে। তিনি একটি চমৎকার উপমা ব্যবহার করে তাঁর ধারণাটি বিশ্লেষণ করেন। একধরনের প্রেটোরিয়ান গার্ডদের ভূমিকা ছিল তাঁর আদর্শ। বন্যায় নদীর পাড় যাতে না ভাঙে, সে জন্য বাঁধ দেওয়া হয় এবং চাপ বেশি হলে বাধকে মজবুত করা হয়। বাঁধ মজবুত করা মানে পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। রাজনীতিবিদেরা দেশ পরিচালনা করতে পারেন, তবে বাধ গড়ে দেবে সামরিক বাহিনী এবং প্রয়ােজনে সময়ে সময়ে তারা তা মজবুত করে দেবে। শের আলী বস্তুতই সামরিক বাহিনীর দেশ শাসনের ঐশী ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন বলে আমার মনে হয়। জেনারেল শের আলীকে আমি তত চিনতাম না। কারণ, তিনি বহুদিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিদেশে অবস্থান করেন। লাহােরে আমি যখন সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে প্রশিক্ষণে, তখন তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তখনাে তিনি কোনাে দেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তবে তার একটি ঘােড়া ছিল আমাদের একাডেমির আস্তাবলে । ঘােড়াটি ছিল বয়স্ক ও বেয়াড়া, কামড় দিত, কিন্তু আবার খুব তেজি এবং পলাে খেলায় অভ্যস্ত ছিল। এই ঘােড়াটিকে অনেকেই এড়িয়ে যেত কিন্তু এটি ছিল আমার প্রিয় এবং ঘােড়াটির সঙ্গে আমার একধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। এই ঘােড়ার সহিসের বদৌলতে জেনারেল শের আলীর সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হবার সুযােগ হয়। রাজনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ প্রথম ও শেষবারের মতাে হয় ওয়াশিংটনে। শের আলী কিছুদিন পরই পদত্যাগ করেন। তিনি নাকি অবাধ নির্বাচনের ঘাের বিরােধী ছিলেন বলেই মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নেন।
আজিজ আহমদ যখন ওয়াশিংটনে আসেন, তখন তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তবে পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ওয়াশিংটন তাঁর অতিপরিচিত জায়গা। তিনি ওখানে রাষ্ট্রদূত ছিলেন একসময়। তারপর পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে ওয়াশিংটনে তার জানাশােনা ছিল বিস্তর। তিনি অবিভক্ত বাংলায় তার চাকরিজীবন শুরু করেন এবং মহকুমা ও জেলা হাকিম হিসেবে খুবই দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি ওই সময়ে ঋণ সালিসের পরীক্ষামূলক নানা উদ্যোগ নেন। জনশ্রুতি ছিল যে শেরেবাংলার ঋণ সালিস বাের্ডের আইন তাঁরই পরীক্ষামূলক উদ্যোগ থেকে উদ্ভূত। পূর্ব বাংলায় তিনি হন প্রথম মুখ্য সচিব, তখন তার অভিজ্ঞতা মাত্র ১৭ বছরের এবং জ্যেষ্ঠতায় তিনি সর্বোচ্চ ছিলেন না (টি আই এম নুরুন্নবী চৌধুরী ছিলেন তার চেয়ে জ্যেষ্ঠ)। তাঁর সম্বন্ধে জানা যায় যে তিনি প্রাদেশিক মন্ত্রীদের কার্যাবলি সম্বন্ধে গােপন প্রতিবেদন। কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতেন। তিনি পাকিস্তান মন্ত্রিসভা বিভাগের একজন সুযােগ্য সচিব ছিলেন। প্রথম যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়, তখন একমাত্র
১৮
বেসামরিক অফিসার হিসেবে তিনি হন উপপ্রধান সামরিক প্রশাসকদের একজন। তিনি যখন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস সমিতির সভাপতি (বােধ হয় ১৯৬৬ সালে। কিছুদিন), তখন আমি ছিলাম এই সমিতির সম্পাদক। পূর্ব বাংলায় অনেক পাকিস্তানি, যারা তার সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁরা মনে করতেন যে প্রাদেশিকতার বিষবৃক্ষ রােপণে তাঁর অবদান ছিল মুখ্য। বাঙালিদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ ব্যবহারের প্রতিভূ হিসেবে অনেকেই তাকে দোষারােপ করতেন।
তাঁকে প্রথম দেখি ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৬ তারিখে, যেদিন সলিমুল্লাহ হলে ঢাকা সিটির পুলিশ সুপার খুনি মাসুদ মামুন প্রবেশ করে অনেক কামরার দরজা-জানালা ভেঙে প্রায় ২৭ জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। যখন মাসুদ মামুন তার ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তখন হলের অবস্থা দেখতে তার পেছনে পেছনে আসেন মুখ্য সচিব আজিজ আহমদ, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার নিয়াজ মােহাম্মদ খান এবং আরও অনেক উচ্চপদস্থ পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা। আমি ছিলাম হলের মিলনায়তনে, তাঁদের আগমন দেখেই দৌড়ে বেরুতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম তবে চালাকি করে তাঁদের পেছনে লাইন লাগালাম।
তারা মিলনায়তনে একধরনের সচিবালয়ের নিদর্শন পেলেন। মিলনায়তনে কয়েকটি টেবিল সাজানাে ছিল এবং টেবিলে যেন দপ্তরের নাম লেখা ছিল। যেমন এক টেবিলে ছিল জনসংযােগ’ । সেখান থেকে ঢাকার ছাত্রাবাস ও মহল্লার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা হতাে। মহল্লার সর্দাররা তখন ছাত্রদের জোর সমর্থক। তাই তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করা ছিল খুবই জরুরি।
একটি টেবিলে লেখা ছিল ‘ইশতেহার, ঘােষণা ও প্রচারপত্র, পুস্তিকা রচনা ও প্রকাশনা’। সেখান থেকে যতসব ঘােষণা ও প্রচারপত্র লেখা হতাে ও ছাপানাে হতাে। ছাপা হতাে অবশ্য কাছের একটি প্রেসে। এক টেবিলে লেখা ছিল প্রচার দফতর। সেখান থেকে ঢাকায় মাইকিং করা, প্রচারপত্র বিলি করা—এসব কাজ হতাে। একটি টেবিল ছিল কেন্দ্র হিসেবে স্থাপিত আর সেখানে আমাদের হল ইউনিয়নের খেলাধুলা বিভাগের মহাসচিব এমএসসির ছাত্র ইকরামুল আমিন ছিলেন মুখ্য সচিব। তিনি আমাদের মতাে কর্মীদের ব্যস্ত রাখতেন।
সেদিন জনাব আজিজ আহমদের সহযােগীদের দেখলাম এই সচিবালয় নিয়ে হাসি-মশকরা করছেন। পুরােনাে দিনের কথা ভেবে গর্ববােধ হয় যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুলিবর্ষণের পর সপ্তাহখানেক ঢাকা বস্তুত ছাত্রদের দখলে ছিল। তাদের হুকুমে সরকারি অফিস প্রায় বন্ধ থাকে। বড় বড় কর্তারা অবশ্য কাজ করে গেছেন কিন্তু বেশির ভাগ কেরানিকুল অফিসমুখাে ছিল না।
রাওয়ালপিন্ডিতে আমি যখন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারে উপসচিব ছিলাম (জুলাই ১৯৬৬ সাল থকে জুলাই ১৯৬৯ সাল), তখন আজিজ আহমদ সাহেবকে
১৯
ভালােই চিনতাম। তিনি ছিলেন একজন সুপুরুষ এবং কাপড়চোপড়ে খুব দুরস্ত । তবে কেমন যেন দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। এমনকি সামাজিক পরিবেশেও সে দূরত্ব বজায় থাকত। তবে বাঙালিদের সঙ্গে একটু যেচেই সদ্ব্যবহার করতেন। মনে হতাে বাংলাদেশে তিনি যে সংকীর্ণতার পরিচয় দেন তারই যেন। খেসারত দিচ্ছেন।
ওয়াশিংটনে আলাপ-আলােচনায় মনে হলাে যে তিনি দেশের আসন্ন সংকট নিয়ে বেশ চিন্তিত । তিনি বললেন যে বাঙালিদের ওপর অনেক অত্যাচার হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান বঞ্চিত হয়েছে এবং অন্যায় সহ্য করেছে। তবে অনেকেই এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং যথেষ্ট সদিচ্ছা বর্তমান। পশ্চিম পাকিস্তানকে অনেক দিতে হবে, সদিচ্ছা নিয়ে অনেক এগােতে হবে। কিন্তু তিনি জানেন না যে সরকার যারা পরিচালনা করছেন, তারা এ বিষয়ে তত গুরুত্ব দেন কি না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি উপদেশও দিলেন যে শেখ সাহেবকে নমনীয় হতে হবে, দেশ ভাঙা উচিত হবে না। আজিজ আহমদ যখন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী (তিনি অনেক দিন স্টেটমন্ত্রী ছিলেন আর ভুট্টো নিজে ছিলেন মন্ত্রী), তখন দুবার তার সঙ্গে আলােচনা। হয়। প্রথমবার যখন ১৯৭৪ সালের জুন মাসে তিনি ভুট্টোর সঙ্গে ঢাকায় আসেন। এবং আবার ১৯৭৫ সালে বােধ হয় জুলাইতে জেদ্দায় ইসলামি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে। কিন্তু এই দুবারই তাঁর মধ্যে কোনাে নমনীয়তার নিদর্শন পাইনি।
চালচলন ও মনমানসিকতায় নবাব কিজিলবাস ছিলেন ব্রিটিশ যুগের সরকারি দলের রাজনীতিবিদ। কাপড়চোপড়ে ধােপদুরস্ত, কথাবার্তায় খুব চালু, বক্তৃতায়। দক্ষ, বিনােদনে (রেস-পার্টি এগুলােতে অভ্যস্ত এবং মেহমানদারিতে অনবদ্য। তিনি বৈদেশিক দেনা ও লেনদেনের ভারসাম্য নিয়ে কিছু কথা বললেন। বিষয়টি ১৯৭০-এ বেশ গুরুতর আকার ধারণ করে এবং হেমন্তে একটি কার্যক্রম মােটামুটিভাবে গৃহীত হয়। অবশ্য ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কারণে এই কার্যক্রমের আর বাস্তবায়ন হয়নি। দেশের জটিল সাংবিধানিক সমস্যা নিয়ে—পূর্ব-পশ্চিমের সম্পর্ক নিয়ে—তার কোনাে চিন্তাভাবনা আছে বলে আমার মনে হলাে না। অবশ্য তার সঙ্গে কোনাে পূর্বপরিচয় না থাকায় সে রকম আলাপ হয়তাে জমে ওঠেনি।
সরদার আবদুর রশিদ আসলে একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিনি উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পুলিশবাহিনীর ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন। তাঁকে বোেধ হয় রাজনীতিতে নিয়ে আসেন ডা. খান সাহেব । জেনারেল ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে আমাকে করনিংয়ে যেতে হয়। করনিংওয়্যার কোম্পানি তখন করাচিতে বিনিয়ােগের চিন্তা করছিল। তারা সরদার রশিদকে কারখানা ভ্রমণে আমন্ত্রণ করে এবং তাদের একটি বার্ষিক নৈশভােজে প্রধান। অতিথি বানায়। নিউইয়র্কের কাছে হাকেনসাক বিমানবন্দর থেকে আমরা একটি
২০
এক্সিকিউটিভ জেটে করনিংয়ে যাই। সরদার রশিদ ওয়াশিংটনে এসেও আমাদের সঙ্গে মিলিত হন। সরদার রশিদ স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি ভালাে বুঝতেন। তিনি মনে করতেন যে ছয় দফা পাকিস্তানকে খুবই দুর্বল করে দেবে এবং এতে দেশরক্ষা একটি নাজুক অবস্থায় পর্যবসিত হবে। তবে ছয় দফা পুরােপুরি গৃহীত কখনাে হবে না এবং শেখ সাহেবকে কিছু ছাড় দিতে হবে । তিনি বলেন যে তাঁর গােয়েন্দা সংস্থা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরাে ও সামরিক গােয়েন্দা সংস্থার হিসাবে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি আসনে নির্বাচিত হবে। পূর্ব পাকিস্তানি বাকি সাংসদদের সঙ্গে পশ্চিমের সাংসদেরা হাত মিলিয়ে এমন একটি সাংবিধানিক সমাধান দিতে পারেন, যাতে দেশরক্ষা বিষয়ে আপস না করেও পূর্ব পাকিস্তানকে আর্থিক বিষয়ে যথােপযুক্ত স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যেতে পারে।
১৯৭০ সালে আমেরিকায় পাকিস্তান থেকে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য আগন্তুক ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের রজতজয়ন্তী অধিবেশনে বক্তৃতা দেন, মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, কাশ্মীর নিয়ে দেনদরবার ইত্যাদি করেন। ব্যবসায়ীদের এক সভায় তিনি বক্তৃতা দেবেন বলে আমি একটি খসড়া দিই। তবে জ্যেষ্ঠতর অনেক আমলা এ ব্যাপারে তৎপর ছিলেন বলে আমার ভূমিকা সামান্যই ছিল। এই সভা এবং প্রেসিডেন্ট প্রদত্ত একটি অভ্যর্থনা ভােজে যােগদানের জন্য আমি নিউইয়র্কে যাই। জেনারেল ইয়াহিয়ার মদে আসক্তি সর্বজনবিদিত। তবে প্রকৃতিস্থ অবস্থায় তিনি খুব আসর জমাতে পারতেন। সামরিক বিষয় ছাড়া অন্য যেকোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর তেমন আগ্রহ ছিল বলে মনে হতাে না এবং গুরুত্বের বিষয়ে তাকে মনে হতাে চপল। এদিকে তিনি তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের একেবারে উল্টো ছিলেন। আইয়ুব ছিলেন রাশভারী লােক, যেকোনাে বিষয়ে চিন্তা না করে মন্তব্য করতে বিরত। প্রতিটি সমস্যা তিনি গভীরভাবে বিবেচনা করতেন এবং তা নিয়ে পড়াশােনা করা ছিল তার অভ্যাস।
ওয়াশিংটনে জেনারেল ইয়াহিয়ার কর্মসূচি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম রাতে রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের গণ্যমান্য সব পাকিস্তানির একটি ভােজসভায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মিলিত হবার ব্যবস্থা করেন। এই আসরে তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব আশাবাদ ব্যক্ত করেন। যথাসময়ে নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে তিনি জানান। ইতিমধ্যে অবশ্য নির্বাচনের তারিখ ৫ অক্টোবরের পরিবর্তে ৭ ডিসেম্বরে নির্ধারিত হয়েছে। ভােজসভায় তিনি ছিলেন খুব নিরুদ্বেগ এবং অনেক হাস্যরসের সৃষ্টি করেন। উপস্থিত সবাইকে যখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলাে, তখন তিনি নানা রকম কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য সমানে করতে থাকেন। আমাকে দেখে
২১
বললেন, এই লােকটা আমার জন্য কাজ করত, তবে গােলযােগ করত (troublesome) বলে তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারপর যােগ করলেন, ‘তার এখানে নিযুক্তি আগেই হয়েছিল, তাই আমি তাকে ছেড়ে দিই।’
পরদিন সকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে তার বৈঠক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাষ্ট্রদূত হিলালি এবং পররাষ্ট্রসচিব সুলতান মােহাম্মদ খান। সম্ভবত অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মির্জা মােজাফফর (এম এম) আহমদ ছিলেন না। বৈঠক শেষে দুপুরে রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে মধ্যাহ্নভােজে হােমরাচোমরারা থাকবেন। সেক্রেটারি অব স্টেট বিল রজার্স, দেশরক্ষা সেক্রেটারি মেলভিন লেয়ার্ড, নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার, সহকারী সেক্রেটারি অব স্টেট জো সিসকো, মার্কিন এআইডি প্রশাসক জন হানা, আইএমএফের নির্বাহী পরিচালক পিয়ার সােয়াইটজার, বিশ্ব ব্যাংকের পিটার কারগিল, কজন কংগ্রেস সদস্য এবং আরও কজন। আমি লাঞ্চে নিমন্ত্রিত নই কিন্তু ঠিক লাঞ্চের প্রাক্কালে আমার ডাক পড়ল। রাষ্ট্রদূতের বাড়ি দূতাবাস থেকে মিনিট তিনেকের পথ। ওখানে পৌছাতেই রাষ্ট্রদূত নিচে নেমে এসে বললেন যে প্রেসিডেন্টের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়ের যে ব্রিফ ছিল, তার মােদ্দাকথা তাঁকে বুঝিয়ে বলতে হবে। ব্যাপারটি নিয়ে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এবং তার সুরাহা লাঞ্চের আগেই করতে হবে।
পাকিস্তানে তখন ঘােরতর অর্থনৈতিক সংকট, বৈদেশিক ঋণের বােঝা খুব বেশি এবং লেনদেনে ভারসাম্য মােটেই নেই। এই সংকট সমাধানের জন্য একটি প্রস্তাব আলােচিত হচ্ছিল। তার প্রধান বিষয় ছিল নিম্নরূপ :
১. পাকিস্তান মুদ্রামান হ্রাস করবে।
২. দাতাগােষ্ঠী পাকিস্তানকে মােটা হাতে অপ্রকল্প সাহায্য দেবে। পাকিস্তান তখন বছরে সাহায্য পেত প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। অপ্রকল্প সাহায্য ছিল প্রায় ১০০ মিলিয়ন এবং খাদ্য সাহায্য প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার। তখন বৈদেশিক সাহায্য ছিল তিন রকমের। প্রকল্প সাহায্য ছিল সবচেয়ে বেশি। অপ্রকল্প সাহায্য ছিল পণ্যদ্রব্য বা রসদ কেনার জন্য যেমন সার, ইস্পাত, সিমেন্ট, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। তৃতীয় সাহায্য ছিল খাদ্যশস্য বা ভােজ্যতেলের জন্য।
৩. আইএমএফ স্ট্যান্ডবাই সুযােগের অধীনে ঋণ দেবে। ৪. পাকিস্তান বৈদেশিক দেনা মেটানাের জন্য কয়েক বছরের অবকাশ পাবে। সেই যুগে গরিব উন্নয়নশীল দেশের জন্য ঋণ স্বস্তির ব্যবস্থা কনসাের্টিয়ামেই হতাে। ষাটের দশকে ঋণের পুনর্বিন্যাস (মওকুফ বা স্বস্তি) নিয়ে অন্তত আরও চারটি দাতা ক্লাব (কনসাের্টিয়াম) সিদ্ধান্ত নেয়; যথা : ঘানা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক। পরবর্তীকালে হর্তাকর্তা প্যারিস বা লন্ডন ক্লাব তখন সক্রিয় ছিল না, কালেভদ্রে তারা বাণিজ্যিক ঋণের বিষয়ে কোনাে সিদ্ধান্ত নিত।
২২
সংকট সমাধানের এই প্রস্তাবে সমস্যা ছিল দুটো বিষয়ে। প্রথমত, মুদ্রামান হ্রাস কখন হবে আর তাতে রপ্তানি বােনাসের হার কীভাবে প্রভাবিত হর্বে । পাকিস্তানে রপ্তানি বােনাস পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় ১৯৫৯ সালে। এতে রপ্তানিকারকেরা অতিরিক্ত আয় করত, যদিও আমদানি দাম থাকত কম । বস্তুতপক্ষে রপ্তানিকারকদের জন্য মুদ্রামান ছিল হ্রাসকৃত। দ্বিতীয় অমীমাংসিত বিষয় ছিল অপ্রকল্প সাহায্যের কলেবর। মার্কিন খাদ্য সাহায্য প্রায় ২০ মিলিয়ন বাড়বে বলে জানা ছিল। পাকিস্তান অপ্রকল্প সাহায্য বাবদ আমেরিকার কাছে প্রায় ২০০ মিলিয়ন চাচ্ছিল, কিন্তু মার্কিন ধারণা ছিল যে ১২০-১৪০ মিলিয়নই যথেষ্ট। কারণ, বিশ্ব ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ২৫ মিলিয়ন এবং আইএমএফ থেকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মিলে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে।
দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটি একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যাতে একমাত্র অন্য ব্যক্তি ছিলেন কিসিঞ্জার, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আর কেউ ছিলেন না। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন যে নিক্সন ২০০ মিলিয়নে রাজি হয়েছেন কিন্তু ডা. হানা বলেন যে তা হতে পারে না, ভুল-বােঝাবুঝি হয়েছে। রাষ্ট্রদূত আমাকে প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে গেলেন, ডা. হানাও সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট আমাকে বললেন, “তােমাদের ব্রিফমতাে কথা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছেন যে ২০০ মিলিয়ন সাহায্য পাব। তারপর ড. হানাকে বললেন, আপনারা আলােচনা করে সংশয় নিরসন করুন। আর হেনরি এলে তার কাছেই শুনতে পাবেন।’ হেনরি কিসিঞ্জার কিছুক্ষণ পর এলেন, তাঁকে রাষ্ট্রদূত হিলালি এবং ড. হানা যৌথভাবে বিষয়টি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। হেনরি ড. হানার ব্যাখ্যাকে সমর্থন করলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে তখন বােঝালেন যে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের সাহায্য মিলে মােট ২০০ বা তার বেশি বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান হবে। আমার মনে পড়ে, মার্কিন এইডের পণ্য সাহায্য ১৭০ মিলিয়নে রফা হয়। তবে এ বিষয়ে পরবর্তী দেড় বছরে কোনাে চুক্তি স্বাক্ষরের সুযােগ হয়নি। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ‘পাকিস্তানের দিকে ঝোঁক’ নীতি সত্ত্বেও ১৯৭১-এ এই পণ্য সাহায্য বা অন্য কোনাে রকম সাহায্য তিনি পাকিস্তানকে দিতে পারেননি। শুধু ত্রাণ সাহায্য অব্যাহত থাকে, যদিও নানা কারণে বিস্তৃত কোনাে ত্রাণ কার্যক্রমও গ্রহণ করা যায়নি।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দুটি বিষয়ে সাফল্য লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের কারণে প্রেসিডেন্ট জনসন ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশেই সামরিক সাহায্য বা সমরাস্ত্র বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবার এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে শক্ত যুক্তি দেখান এবং এ বিষয়ে একটি বিশেষ এককালীন
২৩
অব্যাহতি লাভে সক্ষম হন। কিছু নির্দিষ্ট সমরাস্ত্র এবং স্পেয়ার্স দান ও বিক্রয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়। দ্বিতীয় সাফল্যের বিষয়টি বহুদিন ছিল অত্যন্ত গােপনীয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন জেনারেল ইয়াহিয়াকে তাঁর তরফ থেকে গণচীনের সঙ্গে দূতিয়ালিতে নিয়ােগ করেন এবং ইয়াহিয়ার উদ্যোগের ফলে সরাসরি চীনমার্কিন সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৭১ সালে। মাতাল হলেও ইয়াহিয়া তাঁর স্বার্থ ভালােভাবে সংরক্ষণ করতে জানতেন। এ দুটি বিষয়ে সাফল্য আর বিশেষ করে চীন-মার্কিন সম্পর্ক সম্বন্ধে শক্ত গােপনীয়তা বজায় রাখা অবশ্য কৃতিত্বের বিষয়। ইয়াহিয়া যখন সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন, তখন তাকে একবার দেখেছি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং দৃঢ়ভাবে তার আবেদন তুলে ধরতে। মন্ত্রিসভার দেশরক্ষা কমিটির সভায় ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করেন। আমি পদাধিকারবলে এই কমিটির সচিব ছিলাম। তিনি যুক্তি দেখালেন যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রয়ােজন সহজে মিটেছে কিন্তু সেনাবাহিনী অবহেলিত হয়েছে। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রয়ােজন আধুনিক দামি ও জটিল যন্ত্রপাতি এবং সেগুলাে সামরিক সাহায্য বা ঋণে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু সেনাবাহিনীর দামি ও জটিল সমরাস্ত্র ছাড়াও অনেক সাধারণ রসদের প্রয়ােজন এবং এগুলাে বৈদেশিক সাহায্য বা ঋণে পাওয়া যায় না। অথচ দেশি উৎপাদনক্ষমতাও পর্যাপ্ত নয়। এর ফলে সেনাবাহিনীর দক্ষতা যথােপযুক্ত নয় এবং সেনাবাহিনীর জন্য নিজস্ব সম্পদ থেকে বরাদ্দ বাড়ানাে প্রয়ােজন। এ বিষয়ে আরও আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল যে সভার পর তিনি কয়েকবারই এ সম্বন্ধে তাগিদ দেন ও তদবির করেন। রসদের জন্য দাবিদাওয়া গােটা সামরিক খাতেই সর্বত্র খুব বেশি। কারণ, জাতীয় সম্পদের এমন অপচয় এবং এসব লেনদেনে কালােটাকা কামানাের এমন সুযােগ আর কোথাও ছিল না। গােপনীয়তার আড়ালে, জরুরি প্রয়ােজনের ধুয়াতে এবং একটি সীমিত গােষ্ঠীর মনােপলিতে এ রকম বড় কলেবরের লেনদেন অন্যত্র কোনাে বিষয়ে হয় না।
ইয়াহিয়া দেশে ফিরে গিয়েই চীন ভ্রমণে যান; দূতিয়ালির কাজটি ছিল বড় প্রয়ােজনীয়। ইয়াহিয়া যখন চীনে, তখনই ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের। কালরাতে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলীয় এলাকা এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলােচ্ছাসের কবলে পড়ে। ইয়াহিয়া ১৪ নভেম্বর বেইজিং থেকে ফেরার। পথে ঢাকায় থামেন। উড়ােজাহাজে তিনি দুর্গত এলাকা দেখে এলেন। কোনাে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করার প্রয়ােজনীয়তা দেখলেন না এবং দ্বিতীয় রাজধানীতে কিছুদিন অবস্থানের কথাও বিবেচনা করলেন না। সারা পৃথিবী যখন এই দুর্যোগে হতভম্ব এবং সাহায্য ও ত্রাণকাজে উদ্যোগী, তখন পাকিস্তানের শাসকেরা ছিলেন ঘুমিয়ে। ব্রিটিশ ও মার্কিন নৌবাহিনী এসে মানুষকে দাফন করল, ঢাল
২৪
তলােয়ারহীন প্রাদেশিক সরকার পানি ও ত্রাণসামগ্রী পৌছাতে নিতান্তই হিমশিম খাচ্ছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তাদের হেলিকপ্টার, সি ১৩০ পরিবহন বিমান, নৌযান এলসিটি ইত্যাদি নিয়ে বসে রইল। ২১ নভেম্বরে দুর্যোগের ১০ দিন পর বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে বদনাম কুড়িয়ে, দেশের মানুষের উন্মা আহরণ করে তাদের টনক নড়ল। অনেকের মনেই প্রশ্ন দোলা দিল, পশ্চিমে কি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এতটুকু দরদ বা চিন্তাভাবনা আছে; না এই এলাকা শুধুই এক দুগ্ধবতী গাভি, শােষণের জন্য এক উপনিবেশ? স্বায়ত্তশাসনের আশু প্রয়ােজনীয়তা সজোরে ঘােষণা করল ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়।
আমেরিকায় সে সময় বাঙালি গােষ্ঠী ছিল খুব ছােট। নিউইয়র্কে ছিল সবচেয়ে বড় সমাবেশ। ওখানে পাকিস্তান লীগ—মােটামুটি তাদেরই সমিতি ছিল। মূলত সিলেটি রেস্তোরার মালিক আর কর্মীরাই এই সমিতি চালাতেন। তাদের নেতা তখন কাজী শামসুদ্দিন আহমদ ‘আ বিট অব বেঙ্গল’ নামক একটি রেস্তোরার মালিক। কাজী সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম মােলাকাত ১৯৬৩ সালে, আমার প্রথম নিউইয়র্ক ভ্রমণকালে। তার বড় ভাই কাজী বদরুদ্দিন হায়দরকে ছাত্রাবস্থায় আমরা খুব সমীহ করতাম। ১৯৪৭ সালে সাহিত্য সংসদের রাষ্ট্রভাষা আলােচনায় তিনি বাংলার পক্ষে বক্তব্য দিয়ে আমাদের প্রিয়পাত্র হন। তখন তিনি ছিলেন জেলা জনশিক্ষা কর্মকর্তা। শামসুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে অনেক দিন যােগাযােগ নেই। তবে পরবর্তীকালে তিনি হবিগঞ্জ জেলায় তাঁর গ্রামে বসবাস করেন। পাকিস্তান লীগের সদস্যরা ঠিক করলেন যে তাঁরা তাঁদের সমিতিকে চাঙা করবেন পূর্ব পাকিস্তান লীগ নামে এবং পূর্ব পাকিস্তানের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করবেন। তাদের সহকর্মী ও বুদ্ধিদাতা হিসেবে তারা পেলেন ডা. খন্দকার আলমগীর (যিনি পঞ্চাশের দশকে মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতিতে প্রগতিশীল গােষ্ঠীর একজন নেতা ছিলেন), সৈয়দ আনােয়ারুল করিম (যিনি তখন জাতিসংঘে পাকিস্তান স্থায়ী মিশনের উপপ্রধান) এবং আবুল হাসান মাহমুদ আলী (যিনি তখন নিউইয়র্কে পাকিস্তান কনস্যুলেট জেনারেলের ভাইস কনসাল)।
নতুনভাবে উজ্জীবিত পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগের মােকাবিলায় পাকিস্তান সরকারের ব্যর্থতার তীব্র সমালােচনা করল। তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও জাতিসংঘের মহাসচিবকে আহ্বান জানাল এই সংকট নিরসনের খাতিরে পূর্ব পাকিস্তানে আশু স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের বক্তব্য ছিল যে বাঙালিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ব্যাহত হচ্ছে। তারা দাবি করল যে ১৯৪০-এর লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ভিন্ন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দরকার। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাফল্যে তারা বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানাল
২৫
এবং পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আবেদন জানাল। ছাত্র ও জ্ঞানী সমাজের পক্ষ থেকে লীগের সংস্কৃতি ও সমাজসেবা সম্পাদক রফিক আহমদ স্বায়ত্তশাসন পেরিয়ে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করলেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল আশাতীত। ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও পাকিস্তান দূতাবাসের আমরা কজন এ বিষয়ে বাজি রেখেছিলাম। আওয়ামী লীগ ১৪০টি আসন পেতে পারে বলে ছিল সর্বোচ্চ আশাবাদ। কিন্তু ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি যখন ছয় দফার সমর্থনে গেল, তখন হলাে দুই রকমের কথাবার্তা। আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের বন্ধুরা বলতে থাকলেন, ছয় দফা তাে একটি সংলাপের ব্যাপার, রাজস্ব ক্ষমতাবিহীন কেন্দ্রীয় সরকার তাে হতে পারে না। আবার কেউ কেউ বললেন যে ভুট্টো পশ্চিমের নেতা আর শেখ সাহেব পূর্বের নেতা, তাঁরা এককভাবে তাে কেউ ফেডারেল সরকার বানাতে পারবেন না । আমাদের রাষ্ট্রদূত তাে বলেই বসলেন যে ভুট্টো হবেন উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র দপ্তর তিনিই পরিচালনা করবেন। তাঁর অভিমতের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করলেন তাঁর বাঙালি সহকারী এনায়েত করিম কিন্তু হিলালি অভিমতটিকে পাত্তাই দিলেন না।
আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় কিন্তু আমাদের অনেকটা বেপরােয়া করে তুলল। পাকিস্তানের ৬৮টি বৈদেশিক মিশন, যার মাত্র ১৪টিতে বাঙালি রাষ্ট্রদূত ছিলেন, সেগুলােকে কেমন করে ঢেলে সাজাতে হবে, সে বিষয়ে আমরা নসিহত দিতে শুরু করলাম। বৈদেশিক মিশন একটিই হবে, কিন্তু দুই অঞ্চলের জন্য থাকবে দুই স্বতন্ত্র দপ্তর। বাংলাদেশের ভাগ্য বাঙালিরাই নির্ধারণ করবে। একটি বড় প্রশ্ন হলাে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক হবে ঘনিষ্ঠ । আর সেই ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ হলাে চীন ও ব্রিটেনের সম্পর্কের অনুকরণ । রাজনীতিতে ভিন্নমতাবলম্বী হয়েও বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে যাতে নিজের স্বার্থসিদ্ধি হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। মােটামুটিভাবে ছয় দফার ব্যবস্থায় পূর্ব ও পশ্চিমের সহাবস্থান সহজসাধ্য বলেই ছিল সাধারণ ধারণা। আমরা অনেকেই ভাবতাম যে পাকিস্তানের শ্বেতহস্তী সামরিক বাহিনীর জন্য না হয়। আমরা খানিকটা বেশি খরচই জোগালাম, তবু তাে অন্যান্য বিষয়ে নিজের ভাগ্য নিজেই ঠিক করতে পারব।
ভবিষ্যৎ নিয়ে এ রকম আশাবাদের পরিবেশে আমি তাে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একটি রচনাই লিখতে শুরু করে দিলাম। এত দিন আমরা দুই অর্থনীতির কথা বলেছি। এবার তাে নিজেদের অর্থনীতির জন্য পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম স্বতন্ত্রভাবে বানাতে হবে। স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা শুধু স্লোগানই নয়,
২৬
এর জন্য প্রস্তুতি প্রয়ােজন, নতুন ব্যবস্থাপনা গড়ে তােলা প্রয়ােজন। ১৯৭১-এর বর্ষশুরুতে তাই আমরা ছিলাম খুবই আশাবাদী এবং একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে খুবই নিবেদিত । এত বছরের অমীমাংসিত স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি এবার পার পাবে। দেশের দুই ভাগের সম্পর্কে উত্তেজনার নিরসন হবে। নিজের ভাগ্য | নিজে নিয়ন্ত্রণ করার ফলে বৈষম্য ও বঞ্চনা নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ বন্ধ হবে।
মানুষ ভাবে এক কিন্তু বিধি হয় বাম। ব্যালটের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বাঙালিরা পেল বুলেটের মুখে মৃত্যু। স্বায়ত্তশাসনের সুন্দর স্বপ্নকে বানচাল করে দিল সামরিক বর্বরতা। গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিল পাকিস্তানি সমরতন্ত্র। বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপরীতে দাঁড়াল পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ। ১৯৭১-এর শুরুতে যে আশায় আমরা উদ্বেলিত হয়েছিলাম, তাকে গুঁড়িয়ে-মুড়িয়ে। দিল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর চক্রান্ত এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অপরিণামদর্শিতা। বাংলাদেশের বুকে নেমে এল অমানিশার অন্ধকার, গণহত্যার কালরাত্রি এবং প্রতিফল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের দুর্জয় প্রত্যয়।
২৭
<p style="text-align: justify;"> দ্বিতীয় অধ্যায়
স্বায়ত্তশাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধ
ছয় দফা বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে একটি কনফেডারেশনের পরিকল্পনা বলে বিবেচিত হতে পারে। যারা এই কার্যক্রম প্রণয়ন করেন, তাঁরা অবিভক্ত ভারতে যেসব সাংবিধানিক কাঠামাের চিন্তা করা হয়, সেগুলােকে ভালোঁ করে যাচাই করেন এবং বিশেষ করে ১৯৪৬ সালে প্রদত্ত ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান অনুসরণ করেন। ১৯৩৯ সালে অন্তত তিনটি প্রস্তাব ছিল, রহমত আলীর প্রস্তাবে ছিল তিন বিষয়ের কনফেডারেশন—দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং অভিন্ন উৎস থেকে প্রবাহিত পানিসম্পদ। স্যার সিকান্দর হায়াত খানের কনফেডারেশনে ছিল। পাঁচটি বিষয়, যথা : পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা, যােগাযােগ, বাণিজ্য শুল্ক ও মুদ্রা। মাওলানা মওদুদীর কনফেডারেশনের ছিল তিনটি বিষয়—দেশরক্ষা, যােগাযােগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য। ১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাবে তাে দুটি স্বতন্ত্র মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন ১৬ মে যে। প্রস্তাব দেয়, তাতে কনফেডারেশনের দায়িত্ব ছিল চারটি—দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি, যােগাযােগ এবং এ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়ােজনীয় রাজস্ব ক্ষমতা। এসব চিন্তাধারার সঙ্গে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সামনে আসে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা। এর সুদূরপ্রসারী ফসল হতে পারত একটি উপমহাদেশীয় কমনওয়েলথ। মহামতি গােপালকৃষ্ণ গােখলের কথার যথার্থতাই বােধ হয় প্রমাণ করতে চেয়েছিল ছয় দফা কার্যক্রম। বাংলা আজ যা ভাবে, সারা ভারত তা-ই ভাবে কালকে’—এমন সুন্দর সম্ভাবনাকে কিন্তু পাকিস্তানের জবরদখলকারী সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিল।
১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বেরােতে না বেরােতেই শুরু হয়ে গেল স্বায়ত্তশাসনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র । ভুট্টোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সামরিক বাহিনীর ক্ষমতালােলুপতার যােগসাজশ হলাে। ১৯৭১-এর ১৭ ফেব্রুয়ারিতে লারকানার
২৮
শিকার সম্মেলনেই ভুট্টো এবং সামরিক নেতাদের ঘৃণ্য আঁতাত প্রতিষ্ঠা হয় : ইয়াহিয়া হয়তাে তাতে নির্বোধ দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তারপর ঘােষণা, চ্যালেঞ্জ, নির্ঘণ্ট আলােচনা—সবই ছিল শঠতার আশ্রয় নিয়ে সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। এই খেলা অনেকের চোখেই ধরা পড়ে, তবে কেউ আশা ছাড়তে প্রস্তুত বা রাজি ছিলেন না। নিউইয়র্কের পাকিস্তান লীগ তত দিনে পূর্ব পাকিস্তান। লীগে রূপান্তরিত হয়েছে। ১২ মার্চ তারা জাতিসংঘের সামনে শােভাযাত্রা করল। এবং জাতিসংঘের ও মার্কিন নেতা-নেত্রীদের কাছে বাঙালিদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সাহায্যের আবেদন করল। এই আবেদনের শেষ পরিচ্ছদটি তুলে ধরছি :
আমাদের যদি সাহায্য করতে অসুবিধা হয়, আমরা অনুনয় করছি, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীকে সাহায্য করতে বিরত থাকুন। তাদের জালিম ঔপনিবেশিক শাসনকে আর চলতে দেবেন না।
১৯৭০-এর নির্বাচনে ছয় দফার আশাতীত সাফল্য বাঙালি হিসেবে আমাদের গর্ববােধ ও আত্মবিশ্বাস খুব করে বাড়িয়ে দেয়। এত দিনে যেন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠী তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গভীর প্রত্যয়ের পরিচয় দিল। একটি জাতির রাজনৈতিক বিকাশে সুযােগ, কৌশল, সংগঠন এবং নেতৃত্ব অত্যন্ত বিনিশ্চায়ক ভূমিকা পালন করে। আমি নিজে দেখেছি কেমন করে বাঙালি আমলারা সুযােগের সদ্ব্যবহার করেন এবং নেতৃত্বের সৎসাহসের বলে ষাটের দশকের শুরুতে আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে থাকেন। সে সময় তাদের নেতৃত্বে ছিলেন দুজন অবাঙালি নিবেদিত শুভানুধ্যায়ী। জেনারেল আজম খান তখন পূর্ব পাকিস্তানের লাট সাহেব এবং ডেভিড খালেদ পাওয়ার প্রদেশের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব। তাঁরা বাঙালি উচ্চপদস্থ আমলাদের ভিন্নমত পােষণের সাহস ও স্বাধীনতা দেন। আইয়ুব খান তখন তাঁর একনায়কত্বের বৈধতা আহরণে ব্যস্ত। দেশের দুই ভাগের সম্পর্কে খানিকটা সমতা সৃষ্টির একটি প্রয়াস তাঁকে নিতে হয়। নানা বিষয়ে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্বন্ধে, তাঁকে অনেক কমিশন-কমিটি বানাতে হয় এবং এদের সুপারিশ বিবেচনা করতে হয়। এসব কমিশন-কমিটিতে অবশ্য বাঙালি সদস্য নিতে হয়। বাঙালি সদস্যরা এই প্রথমবারের মতাে ভিন্নমত প্রকাশ করতে থাকেন। সাধারণত ভিন্নমত আলােচিত হলেও প্রতিবেদন পাকাপাকি করার সময় সমঝােতার ফয়সালা দেওয়াই ছিল চিরাচরিত রীতি। এই রীতির ব্যতিক্রম কদাচিৎ হতাে।
১৯৫৮ সালে রেলওয়ের প্রাদেশিকীকরণ এবং ১৯৫৯ সালে রাজধানীর স্থান নির্ধারণের জন্য যে দুটি কমিশন প্রতিবেদন পেশ করে, সেখানে একজন বাঙালিই দুবার ভিন্নমত দিয়ে তাঁর স্বতন্ত্র অভিমত ব্যক্ত করেন এবং এর জন্য তিনি সরকারের খাতায় একজন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হন। এই ব্যক্তি
২৯
ছিলেন চুয়াডাঙ্গার ব্রিটিশ ভারতীয় কেন্দ্রীয় প্রকৌশলী সার্ভিসের সদস্য চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান মালিক আবদুল বারী। আমি শুনেছি যে তাঁর ভাই ডা. আবদুল মােত্তালেব মালিক যখন দখলীকৃত বাংলাদেশের লাট সাহেব হন, তখন আবদুল বারী তাতে ঘাের আপত্তি তােলেন এবং তাঁর এই দাসবৃত্তিতে ক্ষুব্ধ হয়ে দেশ ত্যাগ করেন। বিদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁরই ইচ্ছায় তাঁর দাফন বিলেতে সম্পন্ন হয়। তিনি পাকিস্তানের দখলীকৃত উপনিবেশে সমাহিত হতে আপত্তি করেন। বহু যুগ আগে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা খেলাফত আন্দোলনের মনমাতানাে বাগ্মী মাওলানা মােহাম্মদ আলীও ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে সমাহিত হতে আপত্তি করেন। তাঁরও সমাধি বিলেতের চিরমুক্ত মাটিতে হয়।
যে কথাটি বলতে চাচ্ছিলাম, তা হলাে জেনারেল আজমের নেতৃত্বে বাঙালি আমলারা নির্ভয়ে ও সজোরে তাদের ভিন্নমত ব্যক্ত করার সাহস সঞ্চয় করেন। প্রায় প্রতিটি কমিশন-কমিটিতে তারা স্বতন্ত্র প্রতিবেদন পেশ করতে থাকেন। ভিন্নমতের প্রতিবেদনের (note of deissent) যে কী ক্ষমতা, আমরা এর আগে তা কখনাে টের পাইনি। তখনকার দিনের সুপ্রসিদ্ধ ফাইন্যান্স কমিশন রিপাের্ট এই পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা যায়। পাঁচজন বাঙালি সদস্য ডেভিড খালেদ পাওয়ারের নেতৃত্বে এবং লাট সাহেবের সমর্থন পেয়ে তাদের নিজস্ব মতামতে অটুট থেকে তদনুযায়ী তাদের ভিন্নমত ব্যক্ত করেন। পাঁচজন পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য, বিশেষ করে সভাপতি এতে খুব বিপদে পড়ে গেলেন। তাই শেষ পর্যন্ত তিনটি মতামত প্রকাশিত হলাে। পাঁচ বাঙালি সদস্যের এক প্রতিবেদন, চার পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যের এক প্রতিবেদন এবং সভাপতি হাফেজ মজিদের (তদানীন্তন কেন্দ্রীয় অর্থসচিব) এক স্বতন্ত্র প্রতিবেদন। কেন্দ্র ও প্রদেশের আর্থিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে অনুকূল সুপারিশ—যদিও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। ১৯৭০ সালে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি ধাপে ধাপে ছয় দফাকে জাতীয় সনদে রূপান্তর করে এবং সাংগঠনিক শক্তি বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ, নির্ভীক নেতৃত্বে বাঙালি জাতির চরিত্রকে একেবারে বদলে দেয়। ভিক্ষুক বাঙালি, ভীরু বাঙালি, নমনীয় বাঙালি। ও ‘সাইল’ বাঙালি, সাহসিকতা, আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধিকার চেতনায় মহীয়ান হয়ে ওঠে। আমাদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারে এই নতুন বাঙালি পরিচয় ছিল পরিস্ফুট।
এ অবস্থায় মার্চের প্রথম দিনে ইয়াহিয়ার ধোকাবাজি বারুদের স্কুপে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গরূপে দেখা দিল। অসহযােগ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সফল হতাে বলে আমার মনে হয় না। অসহযােগ আন্দোলনের ক্রমবিকাশ এবং অভূতপূর্ব সাফল্য প্রবাসে আমাদের যে ভরসা দেয়, এত দিন
৩০
পর মনে হয়, তা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়ার মনােবৃত্তি গড়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে তখন পাকিস্তানের রাষ্টদূত ছিলেন আগা হিলালি । তাঁর ভাই আগা শাহি তখন ছিলেন জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি এবং পরবর্তী সময়ে তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তাঁদের পূর্বপুরুষ (বােধ হয় পিতা) ইরান থেকে দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর স্টেটে অভিবাসন করেন। তারা দুই ভাই মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং দুজনই ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন। আগা হিলালি ১৯৩৬ সালে চাকরি শুরু করেন এবং তিনি বাংলা প্রেসিডেন্সির আমলা ছিলেন। বিভাগােত্তরকালে কিছুদিনের জন্য তিনি ঢাকায় সচিবালয়ে ছিলেন। তারপর পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যােগ দেন। ওয়াশিংটনে ছিল তাঁর সর্বশেষ নিযুক্তি। এর আগে তিনি ভারত, সােভিয়েত রাশিয়া ও যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম মােলাকাত রাওয়ালপিন্ডিতে, আমার ওয়াশিংটন যাবার কয়েক মাস আগে। হিলালি রাওয়ালপিন্ডিতে আসার জন্য কয়েকবারই প্রচেষ্টা নেন কিন্তু তদানীন্তন পররাষ্ট্রসচিব এস এম ইউসুফ তাতে রাজি না হওয়ায় তাঁর সে সুযােগ হয়নি।
অবশেষে তিনি এলেন কিছু সরকারি ও কিছু পারিবারিক কাজে। সাংকেতিক যত বাণী (সাইফার মেসেজ) কেন্দ্রীয় সরকারে প্রেরিত হতাে বা কেন্দ্রীয় সরকার থেকে পাঠানাে হতাে, তার জিম্মাদার হিসেবে আমি সেগুলাে পড়তে পারতাম। সেই সূত্রেই হিলালির বিভিন্ন উদ্যোগ আমার জানা ছিল । তখন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে মাত্র একটি সচিবের পদ ছিল। যার ফলে অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কোনাে দিন সচিবের মর্যাদা পেতেন না এবং যুগ্ম সচিব হিসেবেই অনেকে অবসর নিতেন। যেমন এস কে দেহলভি একসময় সচিব ছিলেন, কিন্তু মেয়াদপূর্তির পর তিনি ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হয়ে যান এবং সেখান থেকেই বােধ হয় যুগ্ম সচিবের মর্যাদায় ও বেতনে অবসর গ্রহণ করেন। পররাষ্ট্র দপ্তর তাই একটি প্রস্তাব করে যে আরও কিছু সচিবের পদ সৃষ্টি করা হােক এবং শুধু অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতকে সেই মর্যাদা দেওয়া হবে (বাংলাদেশে এই অবস্থা নেই, আমাদের ফরেন সার্ভিসে সম্ভবত ১১ জন সচিবের পদ আছে)। প্রস্তাব করা হয় যে ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত রাশিয়ার অন্তত তিন কি চারটিতে যিনি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁকে সচিবের মর্যাদা দেওয়া। যেতে পারে। আগা হিলালির স্বাভাবিকভাবেই এই প্রস্তাবে ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল এবং একটি দ্রুত সিদ্ধান্ত তাঁর জন্য খুবই উপকারী হতাে। তিনি এ বিষয়ে আমাকে খোঁজখবর নিতে অনুরােধ করেন। অবশ্য তা ছাড়া তাঁর রাজত্বে যে নতুন কর্মচারী অচিরে হাজির হবে, তাকে পরখ করে নেবারও বােধ হয় তাঁর একটি ইচ্ছা ছিল।
৩১
প্রস্তাবটির মধ্যে যুক্তি ছিল বলে আমার মনে হয় এবং যথাযথ মহলে আমি সেই অভিমতও ব্যক্ত করি। কিন্তু পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের আপত্তিতে প্রস্তাবটি অন্তত ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। পরবর্তী খবর আমার জানার কথা নয়। কারণ, আমি ওই সময়ই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে এবং ওই দেশটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক চুকিয়ে দিই। আগা হিলালি একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাঁর একটি অভ্যাস বা কৌশল ছিল খুব চমৎকার। তখনকার দিনে বিদেশে যারা চাকরি করতেন, তারা সহজে দেশের মধ্যে যে অনবরত পরিবর্তন বা উন্নয়ন হচ্ছে, সে সম্বন্ধে মােটেই ওয়াকিবহাল থাকতেন না। এখন আনাগােনা অনেক বেশি, তথ্য বিনিময়ে হয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, টেলি ও টিভি সংযােগ হয়েছে যুগান্তকারী এবং ভ্রমণও অনেক বেড়েছে। তার ফলে বাইরে থাকলেও প্রবাসীদের বিচ্ছিন্নতা অনেক কমেছে। হিলালি নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখবার জন্য খুব চেষ্টা করতেন। দেশ থেকে সরকারি বা বেসরকারি যারাই ওয়াশিংটনে যেতেন, তাঁদের সঙ্গে যােগাযােগ করে তিনি খবর আদায় করতেন। আমার অনেক বন্ধুবান্ধব, যারা তখন ওয়াশিংটনে গিয়েছেন, তাঁরা এর সাক্ষী। লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যবসায়ী জিয়াউল হক টুলু ১৯৭০ সালে এক পাট ডেলিগেশনের সদস্য হয়ে যান। একসময়ের সচিব সালাউদ্দিন আহমদ বিশ্ব। ব্যাংকের সঙ্গে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প ঋণের বিষয়ে চুক্তি আলােচনা করতেও যান। ওই বছরই। হিলালি তাঁদের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেশের খবর আদায় করতেন। তাঁরা দুজনই এখন ইহজগতে নেই। তার একটি বাঁধা ব্যবস্থা ছিল এসব অভ্যাগতকে আপ্যায়ন করা এবং এই সুযােগে নিজের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করা।
হিলালি যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং একই সঙ্গে মেক্সিকোতেও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। বছরে বােধ হয় একবার তিনি মেক্সিকো যেতেন। ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিমার্চে তিনি মেক্সিকোতে যান। এর কিছুদিন আগে তিনি পাকিস্তান ঘুরে গিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়নি। ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গেও। তিনি অচিরেই অবসর গ্রহণ করবেন, তারই প্রস্তুতি হিসেবে ছিল পাকিস্তান সফর। পূর্ব পাকিস্তানে তিনি যখন যান, তখন ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন, এ দুটি বিষয়ে তিনি বিশেষ করে অবহিত হতে প্রয়াস পান। দেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করে তিনি আমাদের কাছে তাঁর অভিজ্ঞতা বিবৃত করেন। ওই আলােচনাকালেই তিনি বলেছিলেন যে ভুট্টোকে ছাড়া কোনাে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা হতে পারে না আর এতেই এনায়েত করিম প্রতিবাদ করে বলেছিলেন যে কোয়ালিশন সরকার হলেও ভুট্টো যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন, তার কোনাে নিশ্চয়তা নেই, প্রধানমন্ত্রী নিজেই হয়তাে সেই দায়িত্ব নিতে পারেন । ২ মার্চে ফ্লোরিডা থেকে হিলালি আমাকে টেলিফোন করেন, সম্ভবত রাতের
৩২
বেলা। তিনি তখন মেক্সিকোর পথে। ততক্ষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘােষণার ফলে ঢাকা ফেটে পড়েছে এবং উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। তিনি এ বিষয়েই কথা বললেন। দপ্তরে সারা দিন এ নিয়েই আলােচনা হয়েছে। আমার দপ্তর যে তলায় ছিল সেখানে আমরা তিনজন কর্মকর্তা ছিলাম। আমার মিনিস্টার এ আর বশির (আরেকজন সিএসপি কর্মকর্তা) ও প্রচার অ্যাটাশে এস এন কুতুব। প্রায়ই আমার দুজন সহকারী, যারা অন্য দালানে কাজ করতেন—সার অ্যাটাশে কর্নেল হক নওয়াজ এবং খাদ্য অ্যাটাশে ইকরামুল্লা খান—তারা আমাদের। আলােচনায় শামিল হতেন। মাঝেমধ্যে নৌবাহিনী অ্যাটাশে কমান্ডার (ঠিক মনে নেই) শামসি এতে যােগ দিতেন। একতরফা পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আমরা। ইয়াহিয়াকে দোষারােপ করেছি এবং আমি বলেছি যে ইয়াহিয়া নিজে ঢাকায় গিয়ে এর সুরাহা না করলে দেশ ভাগ হয়ে যাবে ।
আমি হিলালিকে আমার মতামত জানালাম আমাদের দপ্তরে আলােচনার জের টেনে। হিলালির উপদেশ ছিল যথাযথ, তােমরা মাথা গরম কোরাে না, বিদেশে উত্তেজনা প্রকাশ করা সমীচীন হবে না। তবে তিনি একটি মন্তব্য যােগ করেন, যা এখনাে অবিকল আমার স্মরণ রয়েছে। How can he accept a centre with only two and half subjects?’ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ভুট্টো কী করে আড়াই বিষয়ে দায়িত্বশীল একটি কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেবেন? বিপদটি এখানেই, গণতন্ত্র মেনে নিলে কায়েমি স্বার্থ তাে ব্যাহত হয়। যদিও নির্বাচনী প্রচারে ভুট্টো ছয় দফা নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। শুধু রুটি, কাপড় ও মাকান’-এর (বাড়ি) অঙ্গীকার করেছেন; স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে তাঁর তথা গােটা পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ঘাের আপত্তি। অগ্রসর এলাকার যারা দেশ শাসনের সর্বস্তরে অন্যায়ভাবে ক্ষমতাশালী ছিলেন, স্বায়ত্তশাসন ছিল তাদের দুচোখের শূল। অনগ্রসর এলাকাকে বঞ্চিত করার এবং শােষণ করার সব সুযােগকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন একেবারে বিতাড়ন করে দেবে। তাই ছয় দফাকে যেকোনােভাবে বানচাল করতে হবে।
আগা হিলালি দ্বিতীয় দফা টেলিফোন করেন ৮ মার্চে, হয়তাে মেক্সিকো থেকে অথবা আমেরিকায় ফিরে ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তনের আগে। সেই একই নসিহত-উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করাে। মনে হলাে যে বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চে যে। একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণা দেননি, তাতে তিনি বেশ আশ্বস্ত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে দেখা হয় কয়েক দিন পর (২৬ মার্চের আগে) এনায়েত করিমের বাড়িতে এক পার্টিতে। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের উপসহকারী সচিব ক্রিস ভান হােলেন (অবসর শেষে ১৯৮০ সালে তিনি এশিয়ান সার্ভেতে নিক্সন-কিসিঞ্জার ঝোঁক নীতির ওপর একটি উৎকৃষ্ট প্রবন্ধ লেখেন) এবং
৩৩
বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষ প্রকল্প বিভাগের পরিচালক রবার্ট সেডােভ। তখন বােধ হয় ঢাকায় সংলাপ শুরু হয়েছে বা হতে যাচ্ছে। সুতরাং সবাই খুব আশাবাদী। এরপর পাকিস্তান দূতাবাস পরিত্যাগ করা পর্যন্ত আগা হিলালির সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। কথাবার্তা হয়েছে অন্যজনের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হিলালি অবসর নেন এবং বর্তমানে পাকিস্তানের করাচিতে বসবাস করেন।
হিলালি রাষ্ট্রদূত হিসেবে খুব সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন আসরে তিনি বক্তৃতা দিতেন, পাকিস্তানের অর্থনীতি, বিনিয়ােগের সুযােগ ও বাণিজ্যের সুবিধা নিয়ে কথা বলতেন। এসব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে প্রায়ই আলাপ-আলােচনা হতাে এবং আমাদের মধ্যে খানিকটা ঘনিষ্ঠতা ছিল। বেগম হিলালির আতিথেয়তার সুনাম ছিল । তিনি ছিলেন একজন সুন্দরীশ্রেষ্ঠ এবং উচ্চমার্গের মেজবান। রান্নাবান্না ও মহিলা সমিতি সংগঠন নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ভালােই সম্পর্ক ছিল। মাঝেমধ্যে তাঁর অতিথিদের জন্য বিশেষ কোনাে রান্নার অনুরােধ আমার স্ত্রীকে রাখতে হতাে। ১৯৭১-এর মার্চের পর আগা হিলালির সঙ্গে দেখা হয় বিশ্ব ব্যাংকের লবিতে ১৯৮৭ সালে, একটু সময়ের জন্য। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলের শেষে হিলালি দম্পতির সঙ্গে দেখা করাচির সিন্দ ক্লাবে। অতিথিপরায়ণ বেগম হিলালি আগের মতােই আছেন, সুন্দরী, পরিশীলিত এবং সহজ মাধুর্যময় । ১ মের সারাটি দিন তাদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভােজে একটি চমৎকার সময় কাটাই। ঘটনাচক্রে তাদের পাচক ছিলেন একজন বাঙালি। অনেক কথা হলাে অবিভক্ত বাংলার প্রশাসন নিয়ে এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের গুণাবলি নিয়ে। সামরিক শাসন থেকে মুক্তির কথা ছিল আমার গর্বের বিষয়। ১৯৭১-এর তিক্ত অভিজ্ঞতা খুব সাবধানে হিলালি দম্পতি এড়িয়ে গেলেন। যুদ্ধের রণনিনাদ নিতান্ত ভদ্রলােককেও কেমন যেন উন্মত্ত এবং যুক্তিহীন বানিয়ে দেয়।
ফ্লুতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছি শনিবার ৬ মার্চ। বিল ম্যাকুলক বিশ্ব ব্যাংকে পাকিস্তান বিভাগে কাজ করে। সেই সূত্রে পরিচয়। জার্মানিতে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যখন মােতায়েন ছিল, তখন একজন চিত্রশিল্পে অনুরাগী মেয়ে ব্রিজিটের সঙ্গে পরিচয় ও পরিণয়। তারা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । বিলের একটি মােটরবােট আছে, গ্রীষ্মে আমরা পটোমাক মােহনা আর চিঝাপিক উপসাগরে এই নৌযান নিয়ে বেড়াতে যাই। চিঝাপিক উপসাগরের কাঁকড়া খুবই প্রসিদ্ধ, বিশেষ করে নরম শেলের কাঁকড়া, যা অত্যন্ত সুস্বাদু। বিল একজন করিতকর্মা মার্কিন যুবক, কংগ্রেসের আনাচকানাচে, সাংবাদিক মহলে, শিক্ষক মহলে সর্বত্র তার পরিচিত লােক আছেন। মার্কিন মুলুকে বাধ্যতামূলক সামরিক সার্ভিস এ ধরনের বিস্তৃত পরিচিত গােষ্ঠীর উন্মেষে অবদান রাখত। বিল বাংলাদেশের বন্ধু, কার্যোপলক্ষেই সে বৈষম্যের ও বঞ্চনার কাহিনি অনেকটা জানে। বাংলাদেশের
৩৪
ঘটনাবলি নিয়ে সে-ও চিন্তিত ও উৎসুক। বিল টেলিফোন করল যে তার এক পরিচিত ব্যক্তি ওয়াশিংটন পােস্ট কাগজের একজন সম্পাদক, তার বিভাগ হলাে জাতীয় বিষয়াবলি (national affairs)। সে বাংলাদেশের ওপর একটি কাহিনি লিখেছে এবং আরও লিখবে। তার সঙ্গে আমি গােপনীয়তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। আমি রাজি হলে তার বন্ধু রন কোভেন আমাকে টেলিফোন করবে। রােনাল্ড কোভেনের ওই দিনের কাহিনিটি আমার ভালাে লেগেছে, আমি এককথায় রাজি হয়ে গেলাম।
দু-এক দিনের মধ্যে একটি বিশ্লেষণধর্মী কাহিনি প্রকাশ করবে বলে রন আমার সাহায্য চাইল। আগামী দিন কী হতে পারে, তা নিয়ে সে খুব চিন্তিত এবং বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে বিস্তৃত আলােচনা করতে চায়। আমি শয্যাশায়ী বলে সে কয়েকটি প্রশ্নের ওপরই জোর দিল । একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার সম্ভাবনা নিয়ে আমরা অনেকক্ষণ আলাপ করলাম। শেখ সাহেব নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রশিক্ষিত ব্যক্তিত্ব, যুদ্ধবাজ বিপ্লবী নন। তার চারপাশে উত্তপ্ত যুবকেরা রয়েছে। সত্যি কিন্তু তার নেতৃত্ব ছাড়া তারা এগােতে পারবে না। আমার অভিমত আমারই মনের মাধুরী দিয়ে রচিত, রনকে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হলাে। টিক্কা খান সম্বন্ধে রনের আরেক প্রশ্ন । টিক্কা খানের বেলুচিস্তানের কসাই বলে যে পরিচিতি ছিল, তার বিস্তৃত বর্ণনা এবং তার রক্তলােলুপতা আমি ভালাে জানতাম। রনকে সেই বিবরণ শুনতে হলাে। ৮ মার্চ রনের কাহিনি বেরােল ‘East Pakistan Leader stops short of Declaring Independence’ (পূর্ব পাকিস্তানের নেতা স্বাধীনতা ঘােষণায় বিরত থাকেন)। সেই কাহিনিতে রন এক জায়গায় লেখে, ‘Tikka was described by one qualified source as’ ‘blood thirsty’ (এক ওয়াকিবহাল সূত্র টিক্কাকে রক্তলােলুপ বলে বর্ণনা দেয়)।
রনের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় তার কয়েক দিন পর দুপুরে শে কাম্যি (ল) নামের এক ফরাসি রােস্তারায়। রন দম্পতি আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়। আশির দশকে রন দম্পতির মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয় এবং রন প্যারিসে চলে যায়। তারপর আর আমাদের যােগাযােগ নেই। রনের মা বােধ হয় ছিলেন ফরাসি এবং রন ফরাসি রান্না খুব পছন্দ করত। রনের মাধ্যমে পাচক কামি (ল) আমার বন্ধু বনে যায়। একবার ব্রিন মরের ছাত্রী আমার মেয়েকে দিনে বেশ দেরিতে আমি কাম্যির (ল) রেস্তোরায় নিয়ে যাই। খানা তখন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কাম্যি ঝটপট করে অত্যন্ত উপাদেয় খাবার তৈরি করে আমার মেয়েকে তাক লাগিয়ে দেয়। কাম্যি (ল) রেস্তোরা অনেক দিন হলাে বন্ধ হয়ে গেছে । ওয়াশিংটনে অনেক রেস্তোরাই এভাবে বিলীন হয়ে যায়, অনেকে আবার হাতবদল হলেও নাম রেখে দেয়।
৩৫
৪ আগস্টে ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কের অবশিষ্ট সব বাঙালি কূটনীতিবিদ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেন। এই উপলক্ষে একটি সংবাদ সম্মেলনের প্রয়ােজন পড়ে। আমার অনুরােধে রন কোভেনই তখন জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। সম্মেলনটি আমিই ডাকি বলে বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতিনিধি বা নেতা হিসেবে আমাকে কোনাে কোনাে সংবাদ মাধ্যম দলনেতা বলে পরিচয় দেয়। আসলে পাকিস্তান মিশন দুটি থেকে পদত্যাগকারী দলের নেতা ছিলেন জাতিসংঘে ডেপুটি স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আনওয়ারুল করিম। অবশ্য তিনি বােধ হয় সব সময় পেছনের সিটে বসতে স্বস্তি বােধ করতেন।
মার্চ মাসে ঢাকায় বিদেশি সংবাদদাতারা ভিড় করেন। ২৭ মার্চ পাকিস্তান সরকার তাদের ৩৫ জনকে শুধু ঢাকা থেকে নয়, বরং পাকিস্তান থেকেই বিতাড়ন করে। ঢাকায় তাদের উপস্থিতি বিদেশে আমাদের বাংলাদেশের খবর পেতে খুবই সাহায্য করে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সিডনি শেনবার্গ ও টিলমান ডুরডিন, ওয়াশিংটনের ইভনিং স্টার-এর হেনরি ব্রেডশার, বাল্টিমাের সা-এর জন উডরাফ, ওয়াশিংটন পােস্ট-এর সেলিগ হ্যারিসন, অ্যাসােসিয়েটেড প্রেসের আরনল্ড জেইটলিন-তারা প্রায় প্রতিদিন খবর দিতে থাকেন। ৯ মার্চ ইয়াহিয়া যখন ঢাকায় যাবেন বলে ঘােষণা দিলেন, তখন শুরু হলাে প্রতীক্ষার লুকোচুরি খেলা। অবশেষে ১৬ তারিখ সংলাপ শুরু হলে যেন রােজনামচা বেরােতে থাকল। ইতিমধ্যে শুধু জাতীয় দৈনিক নয়, মফস্বলের কাগজেও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হতে থাকল। নিউইয়র্ক টাইমস ও বাল্টিমাের সান ৩ তারিখে আর বােস্টনের ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর ৪ তারিখেই সম্পাদকীয় লিখল। এদের কথা ছিল একটাই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযােগ যেন বুলেটের আঘাতে বিধ্বস্ত না হয়। ২২ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত খবরে আশা ও ব্যর্থতার দ্বন্দ্ব প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটন পােস্ট-এ বাংলাদেশের খবরে যেসব শিরােনাম কদিন ব্যবহৃত হয়, সেগুলাে ছিল নিম্নোক্ত :
২২ তারিখ : Pakistan : Accord Hopes Rise পাকিস্তান : সমঝােতার উজ্জ্বল সম্ভাবনা
২৩ তারিখ : Pakistan Leaders confer, Agree to Delay Assembly পাকিস্তান নেতাদের আলােচনা, পরিষদ বৈঠকের দেরিতে সম্মতি
২৪ তারিখ : Pakistan talks Hit Deadlock; 35 killed as violence flares পাকিস্তানি সংলাপে অচলাবস্থা : সহিংসতায় ৩৫ জন নিহত
২৫ তারিখ : Pakistanis Agreement Reported : Complete Agreement Reported in Pakistan Political Discussion
৩৬
পাকিস্তানি মতৈক্যের সংবাদ : পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংলাপে সম্পূর্ণ সমঝােতার খবর।
২৫ তারিখে সামরিক আক্রমণের পর মার্চ মাসে যে খবর বেরােয়, তাতে ছিল পাকিস্তানিদের ধ্বংসলীলা ও হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ বিবরণ। বহিষ্কৃত সাংবাদিকেরা যেসব বিবরণ দিতে শুরু করলেন, তা ছিল যেমন হৃদয়বিদারক, তেমনি উত্তেজনাকর। হেনরি ব্রেডশার ২৭ তারিখে লিখলেন, ‘Army shells, burns | rebel Dacca (সামরিক বাহিনী বিদ্রোহী ঢাকায় কামান দাগে এবং জ্বালিয়ে। দেয়।)। পরের দিন লিখলেন, Dacca is burning.’ (ঢাকা জ্বলছে)। তিনি এর । সঙ্গে দিলেন ঢাকার ধ্বংসলীলার একটি নির্ঘণ্ট । ২৯ তারিখ সিডনি শেনবার্গ লিখলেন, ‘Sticks and Spears against Tanks. (ট্যাংকের মােকাবিলায় লাঠি আর বল্লম)। একই দিনে হেনরি ব্রেডশার আবার লিখলেন, ‘Pakistan in agony after the storm. (ঘূর্ণিঝড়ের পর পাকিস্তানের আবার যাতনা)। মার্চ মাসে বাল্টিমাের সান-এ চারটি, নিউইয়র্ক টাইমস ও ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর তিনটি করে এবং ওয়াশিংটনের ইভনিং স্টার ও ডেইলি নিউজ-এ দুটো করে সম্পাদকীয় লেখা হয়। মার্কিন সংবাদপত্রে শীতল যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কহীন বিদেশি একটি কাহিনি এ রকম গুরুত্ব, এর আগে কোনাে দিন পায়নি এবং পরেও বিগত ৪৫ বছরে আর পেয়েছে বলে আমার জানা নেই।
প্রতি মুহূর্তে ঢাকার খবর পাওয়া সত্ত্বেও আমাদের উৎকণ্ঠার সীমা ছিল না। যেকোনাে আসরে এবং কূটনৈতিক পার্টিতে ঢাকার সংলাপ, অসহযােগ আন্দোলন ও পাকিস্তান বিভাগ আলাপ-আলােচনার মুখ্য বিষয়। মার্কিন মুলুকে ছড়িয়ে পড়া বাঙালিরাও তখন অনবরত টেলিফোন করছেন আর জটলা পাকাচ্ছেন। ইতিমধ্যে হারুন রশীদের এক সহকর্মী উলফ ডুয়েস ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের মিশন সমাপ্ত করে ওয়াশিংটনে ফিরেছেন। ওয়াশিংটনে আমার অনুজসম হারুন অর রশীদ তখন বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি করতে আসেন। তার পিতা ছিলেন ঢাকায় আমার সচিব আবদুর রশীদ সিএসপি। হারুন করাচিতে আমার সহকর্মী ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনে ডেপুটি চিফ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা খুবই ঘনিষ্ট ছিলাম । হারুন রশীদ আমাদের হয়ে মুজিবনগরেও গিয়েছিলেন এপ্রিল মাসেই।
উলফ ডুয়েস বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের জ্বালাময়ী বক্তৃতা টেপে ধারণ করে নিয়ে এসেছেন। এই টেপের কদর সর্বত্র, সবাই শুনতে চায় অথবা কপি চায় । ২১ মার্চ ছিল রােববার। হারুন রশীদ আর আমি চললাম নিউইয়র্কে; ওখানে বাঙালিরা অনেক সংগঠিত এবং দলে ভারী। তাদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন ছিল আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেদিন পূর্ব পাকিস্তান লীগের একটা সভা ছিল। ডিসেম্বরেই পাকিস্তান লীগের নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান লীগ করা হয় এবং মার্চের শেষে
৩৭
আরেক দফা নাম বদলে এই সংগঠনই হয় বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা। নিউইয়র্কের বন্ধুবর্গ সংলাপ নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন না, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়াই সমীচীন মনে করেন। তারা সারা আমেরিকার বাঙালিদের সংগঠনের বিষয় আলােচনা করেন এবং ওয়াশিংটনকে একটি নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে আহ্বান জানান। এ সভায় খন্দকার আলমগীর ছিলেন একজন প্রধান উদ্যোক্তা এবং বাঙালি কূটনীতিবিদেরাও উপস্থিত ছিলেন বলে আমার মনে হয়। কাজী শামসুদ্দিনের চিঠিপত্র লেখায় আমার মনে হলাে যে এস এ করিম ছিলেন তার বুদ্ধিদাতা। ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী ছিলেন যেন এই সংগঠনেরই একজন সক্রিয় কর্মী।
আমরা ফিরে এসেই ঠিক করলাম যে ওয়াশিংটনে আমাদের একটি সংগঠন গড়ে তােলা দরকার। ওয়াশিংটনে তখন বেশ কজন বাঙালি ছিলেন। দূতাবাসে আমাদের সংখ্যা ছিল খুব ভালাে। উপমিশন-প্রধান ছিলেন মিনিস্টার এনায়েত করিম, রাজনৈতিক কাউন্সেলর ছিলেন শাহ আবু মােহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া, শিক্ষা কাউন্সেলর ছিলেন আবু রুশদ মতিন উদ্দিন, হিসাবরক্ষক (দ্বিতীয় সচিব) ছিলেন মােহাম্মদ আতাউর রহমান চৌধুরী, তৃতীয় সচিব ছিলেন সৈয়দ মােয়াজ্জেম আলী (তার প্রথম নিযুক্তি)। তিনজন স্থানীয় অফিসার ছিলেন—শিক্ষা বিভাগের আবদুর রাজ্জাক খান, প্রশাসনে এ এম শরফুল আলম এবং প্রচারে শেখ রুস্তম আলী। এ ছাড়া আরও অনেক কর্মচারী ছিলেন, যাদের কিছু ছিলেন স্থানীয় অধিবাসী। বিশ্ব ব্যাংকে ছিলেন তিনজন কর্মকর্তা—পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের হারুন রশীদ, ড. আবদুন নুর এবং ড. মনােয়ার হােসেন। এ ছাড়া কিছু পেশাজীবী বা ছাত্রও ছিলেন যেমন এনায়েতুর রহিম, ড. শামসুল হক, এম এ বাতেন, মাহবুব আলী, ড. এম আবদুল আজিজ এবং ভয়েস অব আমেরিকার ইশতিয়াক আহমদ, ইকবাল আহমদ ও মােহাম্মদ কাফী। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু ছাত্র বা প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন (যেমন মহসিন রেজা সিদ্দিকী, ফরহাদ ফয়সল, নাসিম রহমান, রফিকুল হুদা চৌধুরী, ডা. মুশফেকুর রহমান), যাঁদের সঙ্গে তখন আমাদের যােগাযােগ ছিল না। ২৩ মার্চ আমরা সবাই এনায়েত করিমের বাড়িতে সমবেত হলাম। এদিন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা এবং একটি কেক বানিয়ে নিয়ে এলেন মিসেস আসমা কিবরিয়া। এই আসরে নৈশভােজ হলাে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জাতীয় সংগীত হলাে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা পরিচালনার জন্য একটি সমিতি গঠন করা হলাে। এই সমিতি গঠন নিয়ে খানিকটা ইতস্তত ভাব ছিল এবং সভাপতি নির্বাচন নিয়ে কিছুটা ঠেলাঠেলি হয় । এক-আধজন প্রস্তাব করলেন যে আমাকে দায়িত্বটি নিতে হবে। তবে আমরা সবাই জোর করলাম যে আমাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতায় সর্বোচ্চ এনায়েত করিম হবেন
৩৮
আমাদের নেতা। সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হলাে হারুন রশীদকে। ওই দিন রাতে আমাদের আশা ছিল যে একটি সমঝােতা হবে, তবে নতুন দেশটি হবে অন্য রকমের, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের একটি কনফেডারেশন। এ ধরনের আশাবাদ তখন ওয়াশিংটনের ওয়াকিবহাল মহলে সর্বত্র বিরাজ করছিল। ২৪ মার্চ ইন্দোনেশীয় কূটনীতিবিদ ইব্রাহিমের বাড়িতে আমাদের দাওয়াত ছিল, সেখানেও সব আলােচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশের সমঝােতা। ইন্দোনেশীয় এই পার্টিতে ছিলেন কাপড়শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লােকজন। যুগােস্লাভিয়া, তুরস্ক ও ভারতের কজন কূটনীতিবিদ এবং স্টেট ও কমার্স ডিপার্টমেন্টের কজন কর্মকর্তা। ইন্দোনেশিয়া তখন কাপড় ও পােশাকশিল্প গড়ে তুলবার জন্য পাকিস্তানের সাহায্যপ্রার্থী। যুগােস্লাভিয়া পােশাক রপ্তানির জন্য আমেরিকার সঙ্গে কোটা নিয়ে আলােচনা করছে। পাকিস্তান ১৯৭০ সালে একটি সুবিধাজনক কোটা চুক্তি সম্পন্ন। করছে। এই কোটা চুক্তি সম্পন্ন করতে পাকিস্তান দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্যসচিব আবদুর রব। মার্কিন দলপতি ছিলেন জুলিয়ান কাটজ, স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহকারী সচিব। এই কোটা নিয়ে প্রস্তুতিপর্বে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের সহকারী উপসচিব স্টেনলি নেমার এবং আমি খসড়া চুক্তি প্রস্তুত করি । কোটা চুক্তির আলােচনার শেষ পর্যায়ে জটিলতার সমাধানও হয় আমার বাড়িতে একটি নৈশভােজে। এ কারণে যুগােস্লাভিয়া, তুরস্ক ও ইন্দোনেশীয় দূতাবাসে আমার কদর খানিকটা বেড়ে যায়। যা হােক, সব আশার গুড়ে বালি দিয়ে এল ২৫ মার্চের কালরাত্রি। ২৫ তারিখের কাগজপত্রে যা বেরিয়েছিল, তাতে এই ভয়ংকর পরিণতির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
ওয়াশিংটন গ্রিনউইচের পশ্চিমে । ওখানকার ঘড়ি গ্রিনিচের ছয় ঘণ্টা পেছনে আর পাকিস্তানের ঘড়ি ঠিক ছয় ঘণ্টা এগিয়ে। তাই ঢাকায় যখন হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়, তখন ওয়াশিংটনে ২৫ মার্চের দুপুরবেলা। কিন্তু এ খবর প্রায় ১২ ঘণ্টা অনুক্ত ছিল । ইয়াহিয়া করাচিতে পৌছে ২৬ তারিখে তাঁর বর্বরতার প্রথম ঘােষণা দেন। ২৫ মার্চের শেষ রাতে, অর্থাৎ ছাব্বিশের ভােরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের পাকিস্তান ডেস্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্রেইগ ব্যাক্সটার টেলিফোন করে বললেন, “তােমাদের দেশ সম্বন্ধে জরুরি খবর আছে, এক্ষুনি রেডিও শােনাে।’ টেলিভিশনের যুগে রেডিও নিয়ে কে মাথা ঘামায়, আমার বাড়িতে কোনাে রেডিও নেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী খুবই বিচলিত। তখন মনে হলাে, গ্যারেজে গাড়িতে একটি রেডিও আছে। ত্রস্তে শীতের কাপড় গায়ে দিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। খবরে শুনলাম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘােষণা। টিক্কা খানকে বাংলাদেশে রক্তের বন্যা বহানাের হুকুম দিয়ে তিনি ঢাকা থেকে পালিয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বস্তুতই বাংলার জনগণকে আক্রমণ করেছে। কামান দাগিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে তারা শুরু
৩৯
করেছে এক ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যালীলা, স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে এভাবেই গুঁড়িয়েমুড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার। এতেই রচিত হলাে সংযুক্ত পাকিস্তানের কবর এবং শুরু হলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের জন্য নিতান্তই অপ্রস্তুত জনগােষ্ঠীকে বাঁচবার জন্য তুলে নিতে হলাে হাতিয়ার। শুরুতে সেই হাতিয়ার ছিল শিকারের বন্দুক, লাঠি, তির, বল্লম আর জনস্রোত । কিন্তু পঁচিশের রাতে যে ট্যাংক, কামান ও সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলাে, তার বিরুদ্ধে মান্ধাতার আমলের প্রতিরােধ টিকল না। মফস্বলে সংখ্যার জোরে বাঙালিদের সাফল্যের মােকাবিলায় মােতায়েন হলাে বিমানবাহিনী এবং সংগঠিত বাহিনীর অভিযান। ঢাকাকে নিমেষে ঠান্ডা করে দিল ইয়াহিয়ার রক্তলােলুপ সামরিক শক্তি। প্রতিরােধ গড়ে উঠল ঢাকার বাইরে, চট্টগ্রামের বন্দরে, মফস্বল শহরে ও বাজারে।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারিত হলাে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে । যেখানে সব সমস্যার সমাধান ছিল একটি কনফেডারেশনে, সেখানে শুরু হলাে। এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সংগঠিত সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির প্রতিরােধ প্রথম ধাক্কায় খুব মার খেল । শহরের পর শহরে পাকিস্তানি দস্যুবাহিনী দখল বসাল । কিন্তু মানুষের মতের বিপরীতে এই দখল হলাে সাময়িক। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সূচনার খবর শুনলাম ভাের রাতে একটি গাড়ি-রেডিওতে। ২৩ বছর যাদের সঙ্গে থেকেছি, তাদের এই ব্যবহার আমাদের ব্যথিত করল না, করল ক্ষুব্ধ। ওয়াশিংটন যাবার প্রাক্কালে আমরা প্রায় পাঁচ বছর পশ্চিম পাকিস্তানে থেকেছি, তখনাে আমাদের বাক্সপেটরা ওখানে রয়েছে। এমন হিংস্রতার সঙ্গে এরা যে ছােবল দিতে পারে, তা ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে। মিলেমিশে না থাকতে পারলে ভদ্রভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়া যেত । এ রকম সামরিক পদক্ষেপের তাে প্রয়ােজন ছিল না। ব্যাপারটি ছিল একেবারে অভাবনীয়। সমঝােতার খবরই বেশি করে ফলাও হচ্ছিল। সমঝােতা না হলে এ রকম আন্দোলনে ধরপাকড় করে উত্তেজনা হ্রাসের প্রচেষ্টা হয়, তারপর সুষ্ঠু পরিবেশে সংলাপ আবার চলে। আমার বিবেচনা এই রকম ছিল বলে খবরটি আমাকে বিমূঢ় করে দেয়। ধীরে ধীরে সংবিৎ ফিরে পেলাম, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত মহল নিয়ে হলাে পরবর্তী চিন্তা। কে কোথায় আছে, কার সর্বনাশ হচ্ছে, তাই নিয়ে আমরা ভাবিত হলাম। ধাতস্থ হতে বেশ সময় লাগল। বেশি দেরি করে দূতাবাসে গেলাম, সেদিন শুক্রবার। এমন একটি বর্বর কাণ্ড হয়েছে যে কারও মুখে কথা নেই। আমাদের তিনতলার আড্ডা সেদিন বসল না। সবাই গম্ভীর ও ম্রিয়মাণ, কেউ দুঃখিত, কেউ হয়তাে আহ্লাদিত আর আমি ক্ষুব্ধ। আলােচনার কোনাে অবকাশ সেদিন ছিল না। বাঙালিরা ঠিক করল যে তারা পরদিন বিকেলে আমার বাড়িতে সমবেত হবে।
৪০
২৭ মার্চ বিকেলে ওয়াশিংটনের বাঙালি সমাজ আমার বাসায় হাজির। যে খবর পেয়েছে, সে-ই এসেছে। আমার মনে হলাে, পরিবার-পরিজন নিয়ে আমাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা সবাই হাজির, পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ করতে হবে এবং একে প্রতিহত করার কথা ভাবতে হবে। ঢাকার হত্যাযজ্ঞ এবং দেশব্যাপী ধ্বংসলীলা পাকিস্তানের কবর রচনা করেছে, এখন বিবেচনার বিষয় একটি। কী করে কত দ্রুততার সঙ্গে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে উৎপাটন করা যাবে। উদ্যোক্তা হিসেবে আমাকেই বলতে হলাে, আমরা এখন আর পাকিস্তানি নই এবং পাকিস্তানি হায়েনাদের শায়েস্তা করা আমাদের কর্তব্য। প্রবাসে আমরা জনমত গড়ে তুলতে পারি। আমাদের দেশে ত্রাণকার্য ও যুদ্ধ-উদ্যোগে সাহায্য করতে পারি এবং পাকিস্তানকে সর্বতােভাবে অপদস্থ করতে পারি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলাে যে মার্কিন ও আন্তর্জাতিক নেতাদের কাছে বার্তা পাঠাতে হবে। আরও ঠিক হলাে যে সােমবারে শােভাযাত্রা হবে—কংগ্রেসের সিঁড়িতে, বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সামনে আর স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে। পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে কি না, সে বিষয়েও আলাপ-আলােচনা হলাে, তবে তাতে গুরুত্ব দেওয়া হলাে না। যাদের স্বীকারই করছি না, তাদের কাছে ফরিয়াদ করে কী লাভ।
বাঙালিদের আসরে বিতর্ক স্বাভাবিক, এদিনও অনেক বিতর্ক হলাে। বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য আরও খবরের অপেক্ষায় থাকা সমীচীন কি না, দূতাবাসে কর্মরত বাঙালিরা কি দূতাবাস পরিত্যাগ করবেন? এই আসরে একজন বাঙালির পাকিস্তানি স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি এসব আলােচনায় খুব স্বস্তি বােধ করছিলেন না । পরবর্তী সময়ে আমরা জানলাম যে তিনি সভার বিবরণী এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার পুরাে কথা সযত্নে দূতাবাসে পৌছে দেন। তিনি এর পরও মাঝেমধ্যে আমাদের আসরে আসতেন এবং আমরা কখনাে তাঁকে বিতাড়ন করার ব্যবস্থা নিইনি। আমেরিকার মুক্ত মাটিতে এসব গােয়েন্দাগিরির কোনােই মূল্য ছিল না । গােপনীয়তা ও গােয়েন্দাগিরিতে আমরা এতই অভ্যস্ত ছিলাম যে আমাদের অনেকেই টেলিফোনে কথা বলতে দ্বিধা বােধ করতেন। আমাকে অনেকেই উপদেশ দেন যে আমি যেন সাবধানে চলাফেরা করি। কারণ, টিকটিকিরা আমার পেছনে লেগেছে। আমার কাছে বিষয়টি হাস্যকরই মনে হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য টেলিফোনে আড়ি পেতে শােনার কোনাে ব্যবস্থা অথবা কারও পেছনে টিকটিকি লাগানাের ধারণাটিই ছিল উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত। আমার টেলিফোন নিয়ে এক কাহিনি তখন বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করে। জুলাই মাসে মুজিবনগর থেকে মাহবুব আলম চাষীর এক চিঠিতে এই খ্যাতির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমি শুধু মার্কিন মুলুকে নয়, যত্রতত্র যেসব বাঙালিকে চিনতাম, তাদের সঙ্গে আলাপ
৪১
করতাম। মার্চ মাসে দেখি টেলিফোনের বিল হঠাৎ প্রায় ১০-১৫ ডলার থেকে ৬৬ ডলারে উপনীত হয়েছে। এপ্রিলের বিল হলাে ৩৪১ ডলার। তারপর কিন্তু শেষােক্ত ডলারের নিচে আর নামেনি। কতিপয় ব্যক্তি প্রতিদিন একবার টেলিফোন না করে থাকতে পারতেন না। টরন্টো থেকে প্রতি সকালে আসমত আলী একবার যােগাযােগ করতেনই ।
২৯ তারিখের বিক্ষোভের জন্য কাজ ভাগ করে নেওয়া হলাে। প্রথম কর্তব্য ছিল আমেরিকায় সর্বত্র খবর পৌছানাে। ঠিক হলাে যে যার যেখানে যােগাযােগ আছে, তিনিই সেখানে খবর দেবেন এবং দলেবলে র্যালিতে যােগ দিতে আহ্বান জানাবেন । উদ্যোক্তা ব্যক্তিরা তক্ষুনি টেলিফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলেন এবং ফজলুল বারী এতে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। বাইরে থেকে যারা আসবেন, তাঁরা উদ্যোক্তা যেকোনাে ব্যক্তির বাসায় রাত্রি যাপন করতে পারবেন। তাই তাদের বিভিন্ন ঠিকানা বলে দেওয়া হলাে। র্যালির জন্য পুলিশের কাছ থেকে অনুমােদন নিতে হবে। এ দায়িত্ব নিলেন ফজলুল বারী ও মাহবুব আলী। ফজলুল বারী সুনামগঞ্জের অধিবাসী। পড়তে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন । ভিসার সুবিধার জন্য তখন দূতাবাসে তিনি একটি ছােটখাটো চাকরি করেন। মার্কিন কৃষি বিভাগে একটি ছােট দপ্তর ছিল আন্তর্জাতিক তুলা কমিটির সচিবালয়। মাহবুব আলী সেখানে চাকরি করতেন। তিনিও সিলেটের অধিবাসী। তারা দুজনই ছিলেন অনেকটা বেপরােয়া। তৃতীয় কর্তব্য ছিল স্লোগান, ফেস্টুন, পােস্টার ইত্যাদি লিখতে হবে। এ দায়িত্ব নিলেন এনায়েত রহিম। এনায়েত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চতর শিক্ষায় ওয়াশিংটনে আছেন। তারা সবাই বর্তমানে ওয়াশিংটনের বাসিন্দা এবং নানা ধরনের পেশায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। এনায়েত রহিম দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ারে প্রথম। অধ্যাপক নিযুক্ত হন। আমাদের আরেকটি কাজ ছিল দাবিনামা বা আপিল প্রস্তুত করা। এ দায়িত্ব নিলাম হারুন রশীদ আর আমি। পরের দিন নিউইয়র্ক থেকে এস এ করিম এসে আমাদের ভার অনেকটা লাঘব করলেন।
২৮ মার্চ আমার প্রথম কাজ হলাে কয়েকটি তারবার্তা পাঠানাে। তারবার্তা বাংলাদেশ নাগরিকদের তরফ থেকে গেল প্রেসিডেন্ট নিক্সন, সেক্রেটারি রজার্স, নিরাপত্তা সহকারী কিসিঞ্জার এবং সিনেটে বৈদেশিক বিষয়ের চেয়ারম্যান সিনেটর ফুলব্রাইটের কাছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্ট এবং নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে আবেদন পাঠানাে হলাে। দুপুরে এনায়েত করিমের বাড়িতে দেখা হলাে কজন উৎসাহী কর্মীর সঙ্গে, যাঁরা ইতিমধ্যে ওয়াশিংটনে হাজির হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন টেনেসির ন্যাশিভিল থেকে মুহাম্মদ ইউনূস ও হাবিবুর রহমান, শিকাগাে থেকে শামসুল বারী এবং ওহাইও
৪২
থেকে ডা. এস হাসান। শামসুল বারীকে ফজলুল বারী নিয়ে গেলেন পুলিশের অনুমােদনপত্র নিতে। মুহাম্মদ ইউনূস দেখি জোরেশােরে পােস্টার লিখতে লেগে গেছেন। আমাদের আপিলের খসড়া তৈরি হলে হারুন এর কপি বানাতে চলে গেলেন। সন্ধেবেলা আমার বাড়িতে কিছু লােক জড়াে হলেন। একটি সিদ্ধান্ত হলাে যে দূতাবাসের কর্মচারীরা র্যালিতে যােগ দেবেন না। গউসুদ্দিন এই সিদ্ধান্ত মানতে রাজি ছিল না, সে ঠিক করল যে সে র্যালিতে যােগ দেবে। রাতেই লােকজন বাইরে থেকে আসতে লাগল । ডেট্রোয়েট থেকে এক গােষ্ঠী বােধ হয় রাত তিন-চারটায় এসে হাজির হলাে আমার দুয়ারে। আমার বাড়িতে বড় বড় দুটো কামরা ছিল, একটি বসবার ঘর এবং একটি বেসমেন্ট বৈঠকখানা। শীতের রাতে কোনাে রকম মাথা গুঁজতে অসুবিধা ছিল না। কত লােক সে রাতে এই বাড়িতে ছিলেন, ঠিক গুনিনি, তবে দুই ডজনের কম যে নয় তাতে সন্দেহ নেই।
র্যালি প্রথমে জমল ক্যাপিটল হিলের প্রশস্ত সিঁড়িতে। সকাল নয়টা থেকে সমাবেশ শুরু হলাে এবং দুপুরের পর তা একটি বড় র্যালিতে রূপ নিল। বাঙালি ছাড়াও ভারতীয় ও মার্কিন গুটিকয়েক শুভানুধ্যায়ীও তাতে যােগ দেন। দূতাবাসের কর্মচারীরা এতে অংশগ্রহণ না করলেও অনেক সরকারি চাকুরে এতে শরিক হন। হারুন রশীদ তাে ছিলেনই (তিনি ওই দিনই পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করেন), এ ছাড়া অনেক প্রশিক্ষণার্থী কর্মকর্তা এতে ছিলেন, যথা বােস্টন থেকে আসা খােরশেদ আলম (একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, তখন হার্ভার্ডে ফেলােশিপ নিয়ে ছিলেন), ওয়াশিংটনে প্রশিক্ষণরত দুজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা আবদুর রহিম (মরহুম, সচিব) এবং এ বি এস সফদার (সাবেক সচিব)। গউসুদ্দিন এই র্যালিতে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে যােগ দেয়। সে পাকিস্তানের পতাকায় আগুন লাগালে এক সংকটের সৃষ্টি হয়। পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া তত দোষণীয় ছিল না কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত আগুন জ্বালানােই ছিল আপত্তির কারণ। পুলিশের উপদেশে আগুন নির্বাপণ বাহিনী আগমনের আগেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়। জাতীয় ও স্থানীয় টেলিভিশন সংস্থা র্যালির খবর পেয়ে এসে হাজির হলাে। তাদের কাছে অনেকেই বক্তব্য দেন অথবা প্রশ্নোত্তর প্রদান করেন। শামসুল বারী ও এনায়েত রহিমই মুখপাত্রের মতাে বক্তব্য দেন এবং অন্যরা বিশেষ মন্তব্য করেন। এই দ্বিতীয় দলের মধ্যে শুধু খােরশেদ আলম এবং এ বি এস সফদারের চেহারাটাই মনে আসছে।
প্রায় দুশাে লােকের র্যালি। কংগ্রেসের অনেক জনপ্রতিনিধির দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তাঁদের স্টাফ অনেকেই বাঙালিদের কথা ও আবেদন মন দিয়ে শােনেন। বিক্ষোভকারীরা পরে হােয়াইট হাউসের সামনে দিয়ে এসে প্রথমে বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের দপ্তরে এবং পরে স্টেট ডিপার্টমেন্টে তাঁদের আপিল পেশ
৪৩
করেন। দূতাবাস কর্মচারী ফজলুল বারী চুপিসারে (অর্থাৎ মাঝেমধ্যে দেখা দিয়ে অথবা খানিকটা দূরত্ব রেখে) প্রায় সারা দিনই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। আমি আমার গাড়িতে করে এক-দুবার ক্যাপিটল হিলে এবং আবার শােভাযাত্রাকালে তাঁদের সঙ্গ দিই এবং কয়েকজনকে লিফটও দিই। দিনের শেষে যারা অনেক দূর থেকে এসেছেন, তারা অতিরিক্ত কালক্ষেপণ না করেই বাড়ির পথ ধরলেন, যাতে মঙ্গলবারে কাজে যেতে পারেন। বাকি শ খানেক লােক, বিশেষত শিক্ষার্থীরা আমার বাড়িতে সমবেত হলেন। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ও কৌশল নিয়ে সেখানে আলােচনা হয়।
প্রথম সিদ্ধান্ত হলাে যে যেখানে সম্ভব, সেখানে বাংলাদেশ লিগ গড়ে তুলবেন এবং নিউইয়র্ক লিগ হবে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। তবে প্রয়ােজনমতাে বিভিন্ন সংস্থা মিলে যথাসময়ে একটি নতুন সমন্বয় কমিটি গঠন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, তহবিল গড়ে তুলতে হবে। এর প্রয়ােজন হবে স্থানীয় সাংগঠনিক খরচ মেটাতে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে। তখনাে শরণার্থী সমস্যা দেখা দেয়নি। তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের সঙ্গে আশু যােগাযােগ স্থাপন করতে হবে। স্বাধীনতা ঘােষণার কথা আমরা ২৭ মার্চেই খবরের কাগজে দেখেছি। দূতাবাসের কর্মচারীদের র্যালিতে যােগ না দেওয়া নিয়ে একটি বিতর্কের সূচনা হয়। র্যালির আয়ােজন মূলত দূতাবাসের কর্মচারীরাই করেন কিন্তু প্রকাশ্যে আন্দোলনে নামার সময়টি উপযুক্ত কি না এ নিয়ে ছিল মতদ্বৈধতা। এক দলের অভিমত ছিল যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকাঠামাে তখনাে তৈরি হয়নি বিধায় সরকারি চকুরেদের অপশন তেমন ছিল না। আরেক দলের অভিমত ছিল যে আন্দোলনের প্রতিষ্ঠালগ্নে সরকারি চাকুরেদের সমর্থন একে শক্তিশালী করবে। এই বিতর্কে প্রধান অংশগ্রহণকারী ছিলেন খােরশেদ আলম, আলমগীর মুহিউদ্দিন, এনায়েত করিম, শামসুল কিবরিয়া, ফজলুল বারী ও ড. আবদুন নুর। উত্তপ্ত বিতর্ক ঝিমিয়ে আসে মুহাম্মদ ইউনূস ও শামসুল বারীর সমন্বয় প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এবং খানিকটা বােধ হয় খিদের তাড়নায়। স্থির হলাে যে এ বিষয়ে কূটনীতিবিদেরা অতিসত্বর একটি স্বচ্ছ সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন।
৪৪
<p style="text-align: justify;"> তৃতীয় অধ্যায়
আমেরিকায় জনসংযােগে হাতেখড়ি
পাকিস্তানের হিসাব ছিল যে ৭২ ঘণ্টায় বাঙালিদের ঠান্ডা করে দেওয়া যাবে। সামরিকতন্ত্র স্বভাবতই অস্ত্রের ঝনঝনানিতে বিশ্বাসী ছিল। বাঙালিদের সামরিক সামর্থ্য সম্বন্ধে পাকিস্তানিদের সব সময়ই একটি অবজ্ঞার ভাব ছিল। ব্রিটিশ আমলের সামরিক কৌশলও এই বিশ্বাসে অবদান রাখে। ১৮৫৭ সালে ভারতে যখন প্রথম ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়, তখন ব্রিটিশ সরকারের একমাত্র অনুগত গােষ্ঠী ছিল শিখ, পাঠান ও পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হিসাবে ওই স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল একটি সিপাহি বিদ্রোহ এবং এতে প্রধান ভূমিকা পালন করে বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও দাক্ষিণাত্যের সেনাবাহিনী। এ যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ব্রিটিশ কৌশল হলাে ভারতীয়দের একটি বিশেষ গােষ্ঠীকে সামরিক জাতি’ (Martial race) হিসেবে চিহ্নিত করা। এই তথাকথিত জাতির মধ্যে বাঙালি অথবা উত্তর প্রদেশের অধিবাসীরা ছিল না; ছিল পাঞ্জাবি, শিখ ও পাঠানগােষ্ঠী। তাই পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালিদের শায়েস্তা করার জন্য একটি অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর মূল কৌশল ছিল শঠতা, মিথ্যাচার ও আচমকা আক্রমণ। এর উদ্দেশ্য ছিল সব রকমের প্রতিরােধ বলপ্রয়ােগে নিঃশেষ করা। এর বিশেষ টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকজন এবং বাঙালি সশস্ত্র গােষ্ঠী (সামরিক বাহিনী, সীমান্ত বাহিনী এবং পুলিশ বা আনসারের বাঙালি সদস্যবৃন্দ)।
এই পরিকল্পনায় একই সময়ে সারা দেশে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে সব শহরে পাকিস্তানি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে চিরতরে মুছে দেওয়া ছিল ইয়াহিয়ার হুকুম । এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সব প্রস্তুতি আগেই নেওয়া হয়েছিল। শুধু অপেক্ষা ইয়াহিয়ার মােক্ষম সময় নির্ধারণ। ২৫ মার্চের দুপুর রাতে নির্ধারিত হয় সেই সময়। এই পরিকল্পনার কথা পাকিস্তানিরা সব
৪৫
সময়ই অস্বীকার করে যায় এবং পরিবর্তে বাঙালি বিদ্রোহের এক উদ্ভট নীলনকশা প্রচার করে। তবে ১৯৭৭ সালে সিদ্দিক সালেক নামের একজন সামরিক জনসংযােগ অফিসার তাঁর বই Witness to Surrender (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) প্রকাশ করলে এই তথ্য পাওয়া যায়। পরিকল্পনাটি ছিল একটি শক্রদেশ দখল করার জন্য সর্বোচ্চ বলপ্রয়ােগের একটি নীলনকশা এবং গণহত্যা ও ব্যাপক ধরপাকড় ছিল এর লক্ষ্য। এই পরিকল্পনার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় জেনারেল খাদেম হােসেন রাজার ২০১২ সালে প্রকাশিত বই A Stranger in My Own Country : East Pakistan, 1969-71-এ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস)। এর জন্য অশিক্ষিত পাঠান ও পাঞ্জাবি সেনাদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সযত্নে সৃষ্টি করা হয়। হিন্দু নিধন ও ইসলাম রক্ষা হয় এর স্লোগান ।
কিন্তু বাহাত্তর ঘণ্টায় ব্যাপারটি সম্পন্ন হলাে না। ঢাকাকে সহজেই মৃতের শহর বানানাে গেল । কিন্তু অন্যত্র তেমনটি হলাে না। বন্দর শহর চট্টগ্রাম দখল করতে চলে এল ৬ এপ্রিল। রংপুর আর নােয়াখালীতে প্রাথমিক প্রতিরােধ ব্যর্থ হলাে ২৬ এপ্রিল। এসব প্রতিরােধ ঘটে মানুষের রক্তে, লাঠি-বল্লমের আঘাতে এবং মান্ধাতার আমলের বন্দুক-রাইফেলের গুলিতে। সীমান্ত বাহিনীর কিছু দল এবং কয়েকটি রেজিমেন্টের সামান্য অংশ শেষ মুহুর্তে পাকিস্তানিদের শঠতা ধরতে পেরে বিদ্রোহ করে বা পালিয়ে কিছু উপযুক্ত প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। প্রাথমিক এই প্রতিরােধ নির্মূলে কালক্ষেপণ বিদেশে আমাদের জন্য একধরনের সুযােগ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানিরা তখনাে ঠিক ভেবে উঠতে পারেনি যে তারা আমাদের পরাজিত বিবেচনা করবে, না কিছু খাতির করে চলবে। এই সুযােগে মার্কিন মুলুকে জনসংযােগে আমার হয় হাতেখড়ি। বস্তুতপক্ষে সারা এপ্রিলে ছিল আমার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা।
৩০ মার্চ ওয়াশিংটনের হিল্টন হােটেলে ছিল পূর্বনির্ধারিত সাউথ এশিয়া স্টাডি কনফারেন্স। মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় আগ্রহী রাজনীতি শিক্ষকদের সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশ নিতে আসেন অধ্যাপক খালেদ বিন সাইদ, রশিদুজ্জামান ও সাজ্জাদ ইউসুফ। তাঁরা সবাই কোনাে না কোনাে সময় ঢাকায় শিক্ষকতা করেছেন এবং পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। ওই দিনই ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকায় বেরিয়েছে লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের লােমহর্ষক কাহিনি। সাইমন ড্রিংকে পাকিস্তানি দস্যুরা ২৫ মার্চ রাতে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে বন্দী করতে পারেনি। ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে ওই হােটেলে আটকে রেখে দুদিন পর করাচিতে পাঠানাে হয়। তবে সাইমন ড্রিং এবং আরও একজন খুব চতুরতার সঙ্গে এই ফাঁদে আটকা পড়েননি। তারা কারফিউর ৪৮ ঘণ্টা শহরে পালিয়ে বেড়ান এবং কারফিউতে বিরতি হলে বিধ্বস্ত
৪৬
ও নিহত ঢাকাকে কিছুটা ঘুরে দেখতে সক্ষম হন। ২৮ তারিখ ড্রিং বাংলাদেশ ছাড়েন ব্যাংকক হয়ে। তার প্রতিবেদন শুরু হয় এই বলে, আল্লাহ এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের নামে ঢাকা আজ পদদলিত এবং ভীত শহর।’ গণহত্যা, বস্তির পর বস্তি ধ্বংস, এলােপাতাড়ি কামান ও বন্দুক ছােড়া, ব্যাপক এলাকায় অগ্নিসংযােগ এবং অসংখ্য গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়ার দস্যুদল ঢাকায় নিয়ে আসে গােরস্থানের নিস্তব্ধতা, মৃতদেহের স্থূপ এবং বসতির ধ্বংসাবশেষ। সাইমন ড্রিং অভিমত প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনকে শেষ করে দিয়েছে। সম্মেলনে প্রশ্ন ওঠে, এই রকম ভয়াবহ নিপীড়ন কি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানকে সত্যি সত্যি বাঁচাতে পারবে? একই সঙ্গে চিন্তা জাগে যে শান্তিপ্রিয়, অস্ত্রে অনভ্যস্ত ও স্লোগানে পারদর্শী বাঙালি কি সত্যি সত্যি একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চালাতে পারবে? শেখ সাহেব যখন জেনেশুনেই পালিয়ে না গিয়ে ধরা দিলেন, তখন কেউ ভাবলেন যে নিশ্চয়ই একটি সমঝােতা হবেই। বাঙালি বিশেষজ্ঞরা তথ্যের অপর্যাপ্ততার দোহাই তুলে কঠিন প্রশ্নের সরাসরি মােকাবিলা করলেন না, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ফাটকাবাজিতে নামলেন না। তবে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবার মনেই জাগল সন্দেহ, অমীমাংসিত প্রশ্ন হলাে, কত দিনে এই বিচ্ছেদটি হবে।
পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিচ্ছেদের সমতুল্য অভিজ্ঞতা বেশি মজুত ছিল না। ১৯৬৭ সালে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার বিচ্ছেদ ছিল সবচেয়ে নিকটবর্তী ঘটনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া উদ্ধত ও পশ্চাৎপদ সিঙ্গাপুরকে বিদায় করে বরং খুশিই হয়। আলজেরিয়া আর ফ্রান্সের বিচ্ছেদ ছিল বেশ অন্য ধরনের। আলজেরিয়াকে ফ্রান্সের অঙ্গ বিবেচনা করলেও সম্পর্কটি ছিল মূলত ঔপনিবেশিক। বায়াফ্রা ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘােষণা করে কিন্তু ৩২ মাস পর এই আন্দোলন পুরােপুরি ব্যর্থ হয়। নরওয়ে ও সুইডেন ১৮১৫ সালে এক শাসনের অধীনে আসে, যদিও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল খুব জোরদার । তবে ১৮৯২ সাল থেকে তাদের মধ্যে মন-কষাকষি শুরু হয় এবং ১৯০৫ সালে নরওয়ে একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণা করে বসে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আলােচনার মাধ্যমে তাদের ছেদনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘােষণা করে এবং এ নিয়ে যুদ্ধ চলে বহুকাল । যদিও মার্কিন মুলুকে স্বাধীনতা বহাল হয় ১৭৭৯ সালে, তবে ব্রিটেনের তা স্বীকার করতে লাগে আরও পাঁচ বছর (১৭৮৩)। তারপর আবার ১৮১২ সালে দুই দেশ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের ছেদনপ্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে স্বভাবতই সন্দেহের এবং অনিশ্চয়তার যথেষ্ট অবকাশ ছিল। রশিদুজ্জামান ও সাজ্জাদ ইউসুফের সঙ্গে আলােচনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি অভিমত দিলাম যে
৪৭
পাকিস্তানের কবর রচিত হয়ে গিয়েছে আর বাংলাদেশ থেকে তাদের বিতাড়ন শুধু সময়ের ব্যাপার। আমেরিকা পেয়েছিল ফ্রান্সের সাহায্য, আমাদের পেতে হবে ভারতের সহায়তা।
খালেদ বিন সাইদের সঙ্গে ৩১ তারিখ দুপুরে লাঞ্চ। আলােচনার বিষয়। একটি—বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের বঞ্চনা ও অবহেলার কাহিনি তাঁর ভালাে করেই জানা। পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ, সেনাপতি আর আমলারা কীভাবে বাঙালিদের অবজ্ঞা ও অবহেলা করেন এবং তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করেন, খালেদ বিন সাইদ সে সম্বন্ধে অনেক লিখেছেন। মুখ্য সচিব আজিজ আহমদ যে পূর্ব বাংলার মন্ত্রীদের সম্বন্ধে কেন্দ্রে গােপনীয় প্রতিবেদন পাঠাতেন, সে কাহিনি খালেদই প্রথম ফাস করেন। খালেদ মাদ্রাজের লােক, পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছেন, তারপর বাংলাদেশে পাড়ি দিয়েছেন। তাই পাকিস্তান অবশ্যই তার খুব প্রিয়। পাকিস্তানের এই অবশ্যম্ভাবী ভাঙন তাকে খুবই ব্যথিত করেছে বলে মনে হলাে। আমাদের আলােচনায় আরব্ধ এই ছেদনপ্রক্রিয়া রােধের কোনাে রাস্তা আমরা খুঁজে পেলাম না। শুধু দুঃখ রইল, কেন ভদ্রভাবে সংলাপের মাধ্যমে বিচ্ছেদটা সম্পন্ন করা গেল না। খালেদ বিন সাইদ কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হন, কিংস্টনে কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করতেন।
১ এপ্রিল বিশ্ব ব্যাংক আমার কাছে এক সমস্যা উত্থাপন করল। বেশ কজন বাঙালি ছাত্র আইডিএ ঋণের খরচে বিদেশে প্রশিক্ষণে ছিল । তারা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের খরচে আমেরিকা, জাপান এবং সম্ভবত সুইডেনে শিক্ষারত ছিল। অসহযােগের এক মাসে বাংলাদেশ থেকে তাদের মাসােহারা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়নি । টাকাটা বিশ্ব ব্যাংকের কাছে আছে, তবে খরচ করার হুকুম আসবে ঢাকা থেকে। এ ব্যাপারে একটি বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে আলােচনার প্রয়ােজন। দুপুরে তাই বিশ্ব ব্যাংকে গেলাম। স্থির হলাে যে আমি বাংলাদেশের নির্দেশ চাইব, তবে সাময়িকভাবে মাসােহারা প্রদানের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের কাছে সুপারিশ করব। ২৬ এপ্রিল এ ব্যাপারে দ্বিতীয় সভায় আমার সুপারিশ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে। আমার মনে হয়, এই সুপারিশের ভিত্তিতেই সারা বছর এই শিক্ষার্থীরা তাদের মাসােহারা পায়। কারণ, বাংলাদেশ থেকে তখন এসব নগণ্য বিষয় তদারকের সুযােগ ছিল না। বিশ্ব ব্যাংকের পাকিস্তান ডেস্কের প্রধান তখন মাইকেল উইহেন এবং উপপ্রধান আলফানসাে শিবুসাওয়া। অত্যন্ত উদ্যোক্তা একজন অফিসার ছিলেন উইলিয়াম ম্যাকুলক এবং অর্থনীতিবিদ ছিলেন ভানডার হাইডেন। এ ছাড়া আরও অনেকেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁদের ওপরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন ক্রিস্টোফার মেলমথ, উপপরিচালক গ্রেগরি ভােটা এবং পরিচালক পিটার কারগিল । পিটার কারগিল ছিলেন বিচিত্র এক ব্যক্তিত্ব।
৪৮
বিরাটকায় ইংরেজ এই ব্যক্তির জন্ম হয় ব্রিটিশ ভারতে, যেখানে তাঁর পিতা ছিলেন ভারতীয় রেল বিভাগের একজন কর্তাব্যক্তি। নেহরু পরিবারের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ছিল এবং ইন্দিরা গান্ধী যখন অক্সফোর্ডে পড়েন, তখন পিটার ছিলেন তাঁর খানিকটা জ্যেষ্ঠ। পিটার ১৯৩৮ সালে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন। পাকিস্তানের মির্জা মােজাফফর আহমদ ছিলেন তাঁর সহকর্মী। দেশ বিভাগের পর পিটার পাকিস্তানে চাকরি করেন এবং সিন্ধু প্রদেশের অর্থসচিব থাকাকালে বিশ্ব ব্যাংকে যােগ দেন। তিনি পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ব্যাংকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সহসভাপতি হন এবং সবশেষে সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে অবসর নেন, তখন তিনি ছিলেন অর্থ বিভাগের দায়িত্বে। বিশ্ব ব্যাংকে আড়ালে তাঁকে বলা হতাে সম্রাট কারগিল। উপমহাদেশে তাঁর জানাশােনা ও প্রতিপত্তি ছিল বিস্তৃত। তিনি উপমহাদেশীয় খাবার পছন্দ করতেন এবং ভাত ও ডাল না হলে তাঁর মতে উপমহাদেশীয় খাবারই মাটি হয়ে যেত। ব্রিটিশ রানি তাঁকে নাইটের মর্যাদায় ভূষিত করেন। আশির শেষভাগে তিনি পরলােকগত হন।
বিশ্ব ব্যাংক পাকিস্তানে পানিসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা নেয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকা চুক্তি সম্পাদনে (১৯৬০) বিশ্ব ব্যাংকের ভূমিকা ছিল। বস্তুতপক্ষে ব্যাংকের সভাপতি ইউজিন ব্ল্যাক সে ব্যাপারে একধরনের মধ্যস্থতা করেন। ১৯৬৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের খেয়াল হলাে যে বাংলাদেশের পানি সমস্যা নিয়ে তারা তেমন উদ্যোগ নেয়নি। তাই খেসারত হিসেবে একটি বিশেষ প্রকল্প বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর দায়িত্ব দেওয়া হয় রবার্ট সেডােভকে। রবার্ট একটি উদ্যোগী গােষ্ঠীকে তার বিভাগে নিয়ােগ করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন রিস্টো হার্মা, রবার্ট এলিসন, উলফ ড্রয়েস, আমাদের হারুন রশীদ এবং আরও অনেকে। বাংলাদেশের বহু বছরের বাসিন্দা টম হেক্সনার এই বিভাগে প্রায়ই উপদেষ্টার কাজ করতেন। এই বিভাগের সব কর্মকর্তা ছিলেন বাংলাদেশের বন্ধু। তাঁরা মনে করতেন যে বাংলাদেশ বৈষম্যমূলক ব্যবহারের শিকার এবং এখানে বিনিয়ােগে অত্যধিক জোর না দিলে চলবে না। বাংলাদেশের ওপর বিশ্ব ব্যাংক একটি ব্যাপক প্রতিবেদন প্রণয়ন করে ১৯৭২ সালে। নয় খণ্ডে প্রকাশিত জমি ও পানিবিষয়ক প্রতিবেদনটি এই বিভাগের উদ্যোগেই প্রস্তুত হয়। এখনাে কৃষি ও পানির অনেক মৌলিক বিষয়ে এই প্রতিবেদন একটি প্রামাণ্য দীপিকা।
পাকিস্তান ডেস্ক ও বিশেষ প্রকল্প বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসব্যাপী ছিল আমার দ্বিতীয় দপ্তর। তাদের সমর্থন ও সহমর্মিতা ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তাদের কাছে সব সময়ই ভরসা পেয়েছি। বিল ম্যাকুলকের কথা আগেই বলেছি। ১ এপ্রিলে বিল খবর দিল যে সিনেটর কেনেডি সেদিন বাংলাদেশের ওপর কংগ্রেসে
৪৯
বক্তব্য দেবেন। দিনের শেষে আমি সিনেটরের দপ্তরে হাজির হলাম । বৃহস্পতিবার বিকেলে অনেক স্টাফ তখন বাড়ি ফিরছেন। একজন বক্তৃতার একটি নকল আমাকে দিলেন এবং বললেন যে সিনেটর হ্যারিসও একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। সিনেটর হ্যারিসের দপ্তরে তাঁর সহকারী উইলিয়াম মেইনের সঙ্গে দেখা হলাে। তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন কদিন পর সময় করে তার সঙ্গে দেখা করতে । তিনি আরও জানালেন যে তাঁর সিনেটর এ বিষয়ে আরও জানতে আগ্রহী এবং আরও উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত। বিল মেইন মার্কিন ফরেন সার্ভিসের সদস্য। হিসেবে ভিয়েতনামে একসময় চাকরি করেন। তিনি প্রগতিশীল মনােভাবের লােক ছিলেন এবং সিনেটর হ্যারিস যখন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হন, তখন তার একনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। সিনেটর হ্যারিসের নির্বাচনী অভিযান বেশি দূর এগােয়নি এবং তিনি আর সিনেটর পদপ্রার্থীও হননি। বিল মেইন কার্টার প্রশাসনে (১৯৭৭-৮০) স্টেট ডিপার্টমেন্টে আন্তর্জাতিক বিষয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৭১ সালের পর তার সঙ্গে পরিচয় ঝালিয়ে নেবার সুযােগ হয় ১৯৭৮-৭৯-তে। একসময় তিনি ওয়াশিংটনের কার্নেগি শান্তি ফাউন্ডেশনের কর্ণধার এবং প্রসিদ্ধ ত্রৈমাসিক ফরেন পলিসির সম্পাদক ছিলেন।
বিল মেইনের সঙ্গে ৬ এপ্রিল আমার লম্বা বৈঠক হয় এবং সেদিনই সিনেটর হ্যারিসের সঙ্গে আলাপ হয়। বিল আমাকে সিনেটর কেসের সহকারী জন মার্ক্সের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। সিনেটর কেসের দপ্তরে অনেকবার গিয়েছি কিন্তু তার সঙ্গে প্রথম মােলাকাত হয় ১৯৭২ সালে এক বিশেষ উপলক্ষে। যেসব বন্ধু ১৯৭১ সালে আমাদের সমর্থন দিয়েছেন বা ভরসা জুগিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ কজনকে আমরা আমাদের বিজয়ের পর স্মরণ করি। এই ফর্দে ছিলেন মােট ৪০ জন মার্কিন—১১ জন জনপ্রতিনিধি (৬ জন সিনেটর ও ৫ জন প্রতিনিধিসভার সদস্য), ৮ জন জনপ্রতিনিধির সহকারী এবং আরও ২১ জন কর্মী (শিক্ষাবিদ, লবিস্ট, বুদ্ধিজীবী)। আমরা এই উপলক্ষে এসব ব্যক্তিকে একটি ছােট স্মরণিকা এবং স্বীকৃতি সনদ প্রদান করি। এই ফর্দ পরিশিষ্ট ১-এ দেওয়া হলাে। সিনেটর কেইসকে এই স্বীকৃতি সনদ দিতে গেলে তার সঙ্গে দেখা হয়। সিনেটর কেইস বায়াফ্রা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের কড়া সমর্থক ছিলেন। আর সেই সময় বায়াফ্রা আন্দোলনকারীদের অবাধ গতি ছিল তাঁর কাছে। বায়াফ্রা আন্দোলন ব্যর্থ হলে তিনি খুব অপদস্থ হন। এ কারণে ১৯৭১ সালে তিনি যদিও আমাদের সমর্থন করেন কিন্তু আমাদের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করতে রাজি ছিলেন না।
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল মার্কিন কংগ্রেসে আমাদের সমস্যা নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দেন দুজন সিনেটর। আমি তাতে এত ভরসা পাই এবং উল্লসিত হই যে এস্তে সিনেটরদের দপ্তরে হাজির হই। তখন একমাত্র ভারত ছাড়া অন্যত্র কোথাও
৫০
আমরা সামান্যতম সমবেদনার প্রকাশ দেখতে পাইনি। তখন মানবাধিকারের জন্য পৃথিবী সােচ্চার ছিল না। শীতল যুদ্ধে দ্বিখণ্ডিত পৃথিবীতে আমাদের সমস্যা ছিল যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল শীতল যুদ্ধের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন। তাই আমাদের দুঃখে সমবেদনা জানানাের বা আমাদের ওপর অত্যাচারের নিন্দা প্রকাশের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। এই অসহায় অবস্থায় এ দুই সিনেটরের বক্তৃতা আমাকে খুব আন্দোলিত করে। এখন যখন ওই দুটি বক্তৃতা পড়ি, তখন। মনে হয় এগুলাে ছিল নিতান্ত সাদামাটা বা মামুলি মন্তব্য। কিন্তু ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ও তখনকার মানসিকতার মানদণ্ডে বক্তৃতা দুটি ছিল বীরােচিত ও হৃদয়স্পর্শী। সিনেটর কেনেডি প্রশ্ন করেন যে মার্কিন সরকার কি হত্যাকাণ্ডের জন্য নিন্দা প্রকাশ করবে না, নিরীহ জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে এবং সহিংসতা রােধে প্রচেষ্টা নেবে না? সিনেটর হ্যারিস কিন্তু সেই শুরুতেই অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের আবেদন জানান।
আগেই বলেছি, গউসুদ্দিন আহমদ ২৭ মার্চেই সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি সােমবারের র্যালিতে যােগ দেবেন। তিনি ভালাে করে জানতেন যে পাকিস্তান দূতাবাস এর জন্য তাকে শাস্তি দেবে। তিনি দেশের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন, তাকে বরখাস্ত করা হবে। তখন দূতাবাসে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি বাঙালি, তাঁকেই গউসের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রদূত নির্দেশ দিলেন। গউস হত্যাযজ্ঞের খবরে বিচলিত হয়ে হুজুগের বশে র্যালিতে অংশ নিয়েছেন এবং এর জন্য অনুতপ্ত—এ রকম ধরনের ব্যাখ্যা দিলে তাকে সাবধান করে মাফ করে দেওয়া হবে—এমনই একটি ধারণা তাকে দেওয়া হয়। গউস বুঝেশুনে র্যালিতে যােগ দেন এবং এ ধরনের ব্যাখ্যা দিতে মােটেও প্রস্তুত ছিলেন না। আমাকে তিনি জানালেন যে অ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরির জন্য তিনি মােটেই চিন্তিত নন এবং তিনি ক্ষমা চাইতেও রাজি নন। গউস অতি শান্তশিষ্ট যুবক, এখনাে ওয়াশিংটনে আছেন নিজের ব্যবসা নিয়ে। সিলেটের ছেলে, ওখান থেকে কলেজ পাস করে ভাগ্যান্বেষণে আমেরিকা যাত্রা এবং সেখানে দূতাবাসে সামান্য চাকরিলাভ। দেশমাতৃকার ওপর পাকিস্তানি বর্বর আক্রমণ তাঁর সহ্যসীমা অতিক্রম করে। তাই একসময়ের আদরের ও সমীহের পতাকা তিনি কংগ্রেসের সিঁড়িতে জ্বালিয়ে দেন। গউস কোনাে অপকর্ম করেছেন বলে কোনাে আরজি দিতে অস্বীকার করলেন । ১ এপ্রিলে গউসুদ্দিন আহমদকে দূতাবাসের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলাে। বাংলাদেশ মুক্ত হলে গউস তার জন্য জয়ােল্লাস করেন। কিন্তু আবার চাকরির জন্য ধরনা দিতে বিরত থাকেন। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনে আমি একাত্তরের কর্মীদের সমবেত করবার এক প্রয়াস নিই। সে সময় গউস আবার সাড়া দেন।
৫১
এখন দেশের সঙ্গে তার যােগাযােগ অনেক কম কিন্তু মনের গহনে রয়েছে গভীর দেশপ্রেম এবং দেশবাসীর জন্য শুভাকাঙ্ক্ষা। আমেরিকায় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি আক্রমণের প্রথম শিকার হন গউসুদ্দিন আহমদ, একজন অপরিচিত নীরব দেশপ্রেমিক।
৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনের শহরতলি এলাকায় জর্জ মেসন কলেজে পাকিস্তানের ওপর আলােচনা করবার আমার একটি পূর্বনির্ধারিত প্রােগ্রাম ছিল। আমার মানসিক অবস্থা একটি জ্ঞানজাগতিক বক্তৃতা দেবার জন্য উপযুক্ত ছিল না বিধায় আমি প্রােগ্রামটি বাতিল করব ভাবছিলাম। আমার স্ত্রী বললেন যে আমি কলেজের মঞ্চে বর্তমান বিপর্যয় সম্বন্ধে বক্তব্য দিতে পারি। ওখানকার শিক্ষার্থীরা তাকেও বােধ হয় দাওয়াত করেছিল। শেষ পর্যন্ত আমি প্রােগ্রাম বহাল রাখতে মনস্থ করি । সেখানে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ লেগেছে, সে বিষয়ে প্রায় এক ঘণ্টা আমি বক্তব্য দিই। পাকিস্তানি আক্রমণের বর্ণনায় মােটামুটিভাবে মার্কিন পত্রপত্রিকায় যা বিবৃত হয়েছে, তারই সারমর্ম তুলে ধরি। আমার বক্তৃতা শেষ হলে দেখলাম, অনেক কোমলমতি তরুণ-তরুণীর চোখ ছলছল করছে। প্রশ্নোত্তরের নির্ধারিত সময় ছিল আধঘণ্টা কিন্তু আমাদের আসর কোনাে সময়সীমা ছাড়াই চলল। সকাল ১০টায় আমার আলােচনা সভা শুরু হয় এবং দুপুর গড়িয়ে তা শেষ হয়। আসর শেষে অনেকে এসে ভিড় করল দুটি প্রশ্ন নিয়ে । প্রথমত, আমি কি আমার আত্মীয়স্বজনের কোনাে খবর জানি আর দ্বিতীয়ত, তারা কি কোনাে উপায়ে দুস্থদের জন্য অর্থ সাহায্য দিতে পারে? দুটি প্রশ্নেই আমার উত্তর ছিল নেতিবাচক। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের যােগাযােগ বন্ধ হয় ২৫ মার্চে এবং সেই অচলাবস্থা বস্তুতপক্ষে বহাল থাকে মাসাধিককাল। তখনাে কোনাে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি এবং পাকিস্তানে বাঙালিদের জন্য সাহায্য প্রেরণে আমার কোনাে গরজ ছিল না।
জর্জ মেসন কলেজের সহমর্মিতা দিয়ে শুরু হয় আমার দিনটি এবং সারাটি দিন ছিল পরিপূর্ণ। ওখান থেকে আমি যাই বিশ্ব ব্যাংকে। সেখানে গিয়ে পেলাম এক শক্তিশালী বাংলাদেশ সমর্থক গােষ্ঠী। হার্ভার্ড থেকে করিতকর্মা মহীউদ্দীন আলমগীর এসেছেন অনেক কাগজপত্র নিয়ে। তার সঙ্গে তরুণ অধ্যাপক স্টিফেন মার্গলিন ও ডা. রিচার্ড টেবর্স। হার্ভার্ডের তিন বিশিষ্ট অধ্যাপক ডিন রবার্ট মেসন, রবার্ট ডর্ফম্যান আর স্টিফেন মার্গলিন একখানি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছেন পূর্ব পাকিস্তান সংকটের ওপর প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে। তাঁরা পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য নিয়ে আলােচনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেন যে দুই অংশের বিচ্ছেদ অপরিহার্য এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সবার জন্য মঙ্গলজনক। তাঁরা বলেন, ‘অবশেষে একটি
৫২
স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব অপরিহার্য। প্রশ্ন হচ্ছে, এর জন্য কত রক্তক্ষরণ হবে। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থী হবে যদি আমাদের অদূরদর্শী নীতি পূর্ব পাকিস্তানকে আর একটি শক্তি—রাশিয়া অথবা চীনের—কোলে ঠেলে দেয়। মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহার যত-না বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিলম্বিত করবে, ততই মার্কিন ভাবমূর্তি সংগত কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে মার্কিন জনমত গঠনে বিশেষ অবদান রাখে। এ রকম আরও দু-চারটি প্রতিবেদন এপ্রিল মাসেই প্রস্তুত হয়। রিপাবলিকান পার্টির চিন্তাকোষ রিপন সােসাইটি একটি প্রতিবেদন বানায়। শিকাগােতে শামসুল বারীর উদ্যোগে অধ্যাপক রােনাল্ড ইনডেন ও এডওয়ার্ড ডিমক আরেকটি প্রতিবেদনে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে আলােচনা করে বাংলাদেশের অপরিহার্যতার বিষয়ে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছান। বােস্টন থেকে বাংলাদেশ সম্বন্ধে খুবই সচেতন অধ্যাপক গুস্তাভ পাপানেক ও জন টমাস একটি ছােট প্রবন্ধে জানিয়ে দেন যে বাংলাদেশ আর বায়াফ্রা এক নয় । বাংলাদেশের অভ্যুদয় অবশ্যম্ভাবী। হার্ভার্ডের এই দল গেল কংগ্রেসে তাদের কথা বলতে এবং তাদের গবেষণার প্রতিপাদ্য বিষয় জনপ্রতিনিধিদের জানাতে। পরদিন ৭ তারিখে নিউইয়র্কের রিপাবলিকান প্রতিনিধি সেমুর হেলপার্ন এই প্রতিবেদন কংগ্রেশনাল রেকর্ডে নিবিষ্ট করেন।
এই অধ্যাপকদের অনেকেই পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা গােটা উপমহাদেশ সম্বন্ধে গভীরভাবে পরিচিত ছিলেন। ডিন মেসন সেই ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনাকাজে সাহায্য করতে আসেন। সুপ্রসিদ্ধ হার্ভার্ড উপদেষ্টাগােষ্ঠীকে তিনিই নির্বাচিত করেন। হার্ভার্ডে উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন প্রশাসকদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবস্থা তিনিই শুরু করেন ১৯৫৬ সালে, এই কার্যক্রম এখন মেসন কার্যক্রম নামে পরিচিত। রবার্ট ডর্ফম্যান বাংলাদেশের কৃষি ও পানিব্যবস্থার ওপর অনেক মূল্যবান কাজ করেন, সুপ্রসিদ্ধ কৃষি ও পানি প্রতিবেদন (১৯৭২) প্রণয়নে তাঁর অবদান ছিল বিস্তর। গুস্তাভ পাপানেক সারা দক্ষিণ এশিয়ায় কাজ করেছেন, তাঁর স্ত্রী হান্নাও অনেক গবেষণা চালিয়েছেন, পাপানেকের অসংখ্য ছাত্র প্রশাসন ও গবেষণায় এ দেশে নিযুক্ত। জন টমাস অল্প বয়সে এ দেশে কেয়ার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর পিএইচডি গবেষণা ছিল কুমিল্লা পূর্তকর্ম নিয়ে। তিনিও এ দেশে অনেক কাজ করেছেন। স্টিফেন মার্গলিন এ দেশে এসে কাজ না করলেও তার অনেক গবেষণা এ দেশকে নিয়ে এবং তাঁরও প্রচুর ছাত্র এই এলাকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তি। রােনাল্ড ইলডেন এই এলাকায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, অনেক থেকেছেন ও পড়েছেন। তিনি বাংলায় অধ্যাপনা করতেন এবং ধ্যানধারণায় বাঙালি র্যাডিক্যালদের সমগােত্রীয় ছিলেন ।
৫৩
তাঁরা তাঁদের এই দেশ সম্বন্ধে ধারণা এবং অনুভূতি বিচার করে এবং তাঁদের গবেষণা ও জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শক্ত সমর্থক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
অপরাহে হারুন, বিল ম্যাকুলক এবং আমি গেলাম সিনেটর কেনেডির দপ্তরে । বিল আমাদের কেনেডির দুজন সহকারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। জেরি টিংকার পরবর্তী সময়ে সিনেটের শরণার্থী সাব-কমিটির স্টাফ ডাইরেক্টর হন। তাঁর পুরাে জীবনটিই সিনেটর কেনেডির সহকারী হিসেবে কাটে। ১৯৯৪ সালে হঠাৎ জেরি ইহধাম ত্যাগ করেন, তখন তার বয়স মাত্র ৫৫ বছর। জেরি একজন রুচিসম্পন্ন জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন এবং উপমহাদেশীয় রাজনীতি ও সমাজ সম্বন্ধে তার বিস্তর পড়াশােনা ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে সিনেটর কেনেডির সঙ্গে আগস্ট মাসে তিনি শরণার্থীদের অবস্থা দেখতে ভারতে আসেন এবং বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সিনেটরের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। জেরি সারা জীবন বাংলাদেশের বন্ধু ছিলেন। ১৯৮৭ সালে আমি যখন মার্কিন কংগ্রেসে এরশাদবিরােধী মতবাদ সৃষ্টিতে প্রয়াসী হই, জেরিই তখন। প্রথম ঢিলটি মারতে সাহায্য করেন। ১৯৮৭ সালের ১৬ অক্টোবর জেরি সিনেট ও হাউসের পররাষ্ট্র এবং তহবিল বরাদ্দবিষয়ক কমিটির স্টাফদের সঙ্গে আমার মধ্যাহ্নভােজের ব্যবস্থা করেন।
এই আলােচনার ফলেই ১৯৮৮ সালে সােলার্জ সংশােধনী ও শুনানি প্রাধান্য লাভ করে। জেরি নানাভাবে অনেক বঙ্গসন্তানকে সাহায্য করেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে আমরা এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হারিয়েছি। জেরির স্ত্রী অ্যান বিশ্ব ব্যাংকে কাজ করেন এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিষয়ে তার উৎসাহ আছে। সিনেটর কেনেডির অন্য সহকারী, যার সঙ্গে আমাদের সেদিন পরিচয় হয়, তিনি হলেন ডেল ডিহান। বর্তমানে বােধ হয় কোনাে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ডেল শরণার্থী কমিটির ডাইরেক্টর হিসেবে জেরির পূর্বসূরি ছিলেন। তিনিও সিনেটরের সঙ্গে ১৯৭১ সালে শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রে এবং ১৯৭২ সালে ঢাকায় আসেন। ডেল সত্তরের দশকের শেষ দিকে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার উপহাইকমিশনার হিসেবে কাজ করেন। ডেলও বাংলাদেশের বন্ধু এবং তাঁর পৃষ্ঠপােষকতায় বেশ কজন বাঙালি জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনে পেশাজীবী হিসেবে কাজ করেন। তাঁদের দপ্তরে এই যে আমরা গেলাম, তারপর তা হয়ে উঠল পুরােনাে সিনেট প্রাসাদে আমাদের অন্যতম আখড়া। সিনেটর কেনেডির দপ্তর পরবর্তীকালে অন্য প্রাসাদে স্থানান্তরিত হয়েছে, যার নাম রাসেল প্রাসাদ।
এই দিন থেকে পরবর্তী আট মাস ক্যাপিটল হিল হয় আমার প্রধান কর্মস্থল। পাকিস্তান দূতাবাসে যখন ছিলাম, তখন মাত্র দুবার ওখানে গিয়েছিলাম রাষ্ট্রদূত
৫৪
হিলালির সঙ্গে। একবার বােধ হয় কংগ্রেসম্যান সাইকসের সঙ্গে দেখা করতে আর অন্যবার ওটো পাসম্যানের সঙ্গে মােলাকাতে। একবার উদ্দেশ্য ছিল চালের জন্য দরবার করা, পিএল ৪৮০-এর অধীনে পাকিস্তানকে চাল বরাদ্দ করার জন্য। আর অন্যবার একটি আইনকে একটু শিথিল করার জন্য। বৈদেশিক সাহায্য আইনের একটি বিধান ছিল যে কমিউনিস্ট দেশের সঙ্গে যেসব দেশ ব্যবসা করে, তারা মার্কিন সাহায্য পাবে না এবং যাদের জাহাজ ওই সব দেশে মাল নিয়ে যায়, তারাও এভাবে বঞ্চিত হবে। বিধানের দ্বিতীয় ভাগের প্রয়ােগকে শিথিল করার জন্য আমরা দরবার করি। কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারটি ছিল মূলত কূটনৈতিক বিভাগের কাজ। তাই অর্থনৈতিক বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হতাে না। মুক্তিযুদ্ধের আট মাস আমি মােটামুটিভাবে একজন কংগ্রেশনাল লবিস্ট ছিলাম এবং অনেক পরিচয় ও বন্ধুত্ব, যা ওই সময়ে হয়, তা বহুদিন অটুট থাকে।
১৯৮৭ সালে দেখলাম যে ১৯৭১-এর বহু খেলােয়াড় চলে গেলেও কংগ্রেসে প্রভাব বিস্তারের ধারা একই রকম রয়েছে এবং ফ্যাক্সের বদৌলতে সশরীরে। উপস্থিতির প্রয়ােজনীয়তা অনেক কমে গেছে। হারুন রশীদ ও বিল ম্যাকুলক সিনেটর কেনেডির দপ্তর থেকেই বিদায় নিলেন। তারপর শুরু হলাে অন্যান্য দপ্তরে আমার বিচরণ। প্রথমে গেলাম বিল মেইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত বিস্তৃত আলােচনার জন্য। খানিকটা আলােচনার পর বিল আমাকে নিয়ে গেলেন সিনেটর হ্যারিসের কামরায়। সিনেটর প্রথমেই বললেন যে তিনি আমাদের আত্মীয়, মাতৃকুলে তাঁর মার্কিন ইন্ডিয়ানদের রক্ত রয়েছে তাই। তিনি ওকলাহােমা রাজ্যের সিনেটর ছিলেন। সিনেটর এবং তাঁর সহকারী দুজনই যথার্থ কিছু করার জন্য ছিলেন উদগ্রীব। সিনেটর বললেন যে সমুদয় সমস্যা নিয়ে একটি ব্যাপক সমাধানের প্রস্তাব তিনি বিবেচনা করছেন। এতে পাকিস্তানে অস্ত্র সাহায্য শুধু বন্ধ হবে না, অর্থনৈতিক সাহায্যও বন্ধ রাখা হবে। সব বরাদ্দ এবং আরও অতিরিক্ত সাহায্য দিয়ে একটি তহবিল গঠন করা হবে বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তানের পুনর্বাসনের জন্য। আর বিবাদ মীমাংসার জন্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে কে এ রকম মধ্যস্থতায় ভূমিকা নিতে পারেন। আমি ইরানের শাহের নাম প্রস্তাব করলাম। এই প্রস্তাব করার একটি বিশেষ কারণ ছিল। ইরানের শাহ ভারত ও পাকিস্তানের বন্ধু ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রস্তাব দেন।
একদিন এক মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনােভাবের কথা আলােচনাকালে বলেন যে ইরানের শাহ এই বিষয়ে বেশ সচেতন। তার ধারণা ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং কাশ্মীরের
৫৫
স্বায়ত্তশাসন নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝােতা হতে পারত। এই আলােচনা ১৯৬৮ কি ১৯৬৯ সালে হয়। আমার ধারণা হয় যে শাহ নেহরুর মৃত্যুপূর্বকালীন উপমহাদেশীয় শান্তি পরিকল্পনার কথাই বিবেচনা করছিলেন। এই পরিকল্পনায় কাশ্মীর হতাে ভারতের একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য আর পূর্ব পাকিস্তান হতাে পাকিস্তানের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবসা, বিনিয়ােগ ও ভ্রমণের সুযােগ হতাে অবারিত। এই প্রেক্ষিত মনে রেখে আমি ইরানের শাহকে মধ্যস্থ বানাতে সুপারিশ করি। সিনেটর হ্যারিস তার প্রস্তাব পেশ করেন ১৯ এপ্রিল কিন্তু ইতিমধ্যে আমার এই সুপারিশ নিয়ে আমি পস্তাতে শুরু করি। সেই দুঃখের কাহিনি একটু পরে বলছি।
বিল মেইন বললেন যে এই প্রস্তাবের জন্য আরও সমর্থক দরকার এবং অন্য প্রতিনিধিদের কাছে এ বিষয় নিয়ে তিনি আমাকে আলােচনা করতে বললেন। তাঁর কাছে জানলাম যে নিউজার্সির রিপাবলিকান সিনেটর কেইস এবং মিনেসােটার ডেমােক্রেটিক সিনেটর মন্ডেইল যৌথভাবে একটি প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছেন সব সামরিক সাহায্য বা বিক্রয় বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। আমি বিল মেইনের দপ্তর থেকে গেলাম জন মার্ক্সের দপ্তরে। জন ছিলেন সিনেটর কেসের সহকারী । জন মার্ক্স বিপ্লবী ধরনের ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর একটি আকর্ষণীয় গোঁফ ছিল। পরবর্তীকালে তিনি একটি বইয়ের যৌথ লেখক হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। এ বই প্রকাশে বেশ অসুবিধা পােহাতে হয়। কারণ, এটা ছিল সিআইএর অভ্যন্তর নিয়ে লেখা। জন আমাকে কেস মন্ডেইল প্রস্তাবের নকল দিয়ে বললেন যে আপাতত তারা সিনেটর হ্যারিসের ব্যাপক প্রস্তাবটি ঠেকিয়ে রাখতে চান। এই প্রস্তাবে ছিল সব সামরিক সাহায্য বা সমরাস্ত্র বিক্রয়ে বিরতি। ১৫ এপ্রিল এই প্রস্তাব পেশ করা হয় এবং ১৩ মে সিনেট পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটিতে তা পাস হয়।
সিনেটর মন্ডেইল ছিলেন উদারপন্থী অভিজাত গােছের নেতা। তিনি প্রেসিডেন্ট কার্টারের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হন। তাঁর সহকারী ছিলেন রােজার মরিস, একসময় বােধ হয় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা উপদেষ্টার দপ্তরে কাজ করেন। প্রেসিডেন্ট জনসনের আমলে তিনি পাকিস্তানও ভ্রমণ করেন। আমার মনে হলাে, তিনি খুব নীরব কর্মী এবং তার অনুভূতিকে খুব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তার সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানি সাংবাদিক কুতুবুদ্দিন আজিজ তাঁকে পাকিস্তানের বন্ধু বলে মনে করেন। আমার সে রকম কোনাে ধারণা হয়নি এবং সিনেটর মন্ডেইল বাংলাদেশ সংকট নিয়ে যে চারবার বক্তব্য দেন, তাতে পাকিস্তানের জন্য কোনাে সমর্থনের নিদর্শন পাওয়া যায় না। বস্তুতপক্ষে একজন মানবতাবাদী উদারপন্থী নেতা বা
৫৬
কর্মীর পক্ষে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কার্যকলাপের প্রতি কোনাে রকম নমনীয়তা প্রদর্শনের কোনাে অবকাশ ছিল না। নেহাত অন্ধ, অজ্ঞ অথবা উন্মাদের পক্ষেই তা ছিল সম্ভব।
এপ্রিলের শুরুতেই যেসব মার্কিন বিজ্ঞানী বা ডাক্তার ঢাকায় কলেরা গবেষণা ল্যাবরেটরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমার যােগাযােগ হয়। যােগাযােগ হয় দুটি সূত্রে। বাল্টিমােরে উইলিয়াম গ্রিনাে আমার খবর পান পাকিস্তানি জাহাজের কিছু বাঙালি নাবিকের কাছ থেকে। বােস্টনে ডেভিড ন্যালিন সম্ভবত খবর পান মহীউদ্দীন আলমগীর এবং রিচার্ড টেইলরের কাছ থেকে। ঢাকায় এই সিআরএল গােষ্ঠীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সুযােগ বড় ছিল না। ১৯৬০ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয় একটি SEATO (দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় চুক্তি সংস্থার) প্রকল্প হিসেবে। এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। প্রাদেশিক রাজধানীতে আমার প্রথম চাকরি ছিল স্বরাষ্ট্র বিভাগে, ১৯৬০ সালে । আমার মূল দায়িত্ব ছিল প্রটোকল । তখন প্রদেশে কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের কোনাে প্রতিনিধি ছিলেন না। তাই কৃটনীতিবিদদের যৎসামান্য দেখভাল করা এবং রাষ্ট্রীয় অতিথি ও বড় কর্তাদের সফরের দেখাশােনার দায়িত্ব ছিল স্বরাষ্ট্র বিভাগের প্রটোকল দপ্তরের। সেই সুযােগে কলেরা ল্যাবরেটরির উদ্বোধনে সংশ্লিষ্ট হবার সুযােগ আমার হয়। প্রায় ১৮ বছর পর এই প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিকীকরণে আবার বিশেষ ভূমিকা রাখার আমার সুযােগ হয় বাংলাদেশ সরকারের বহিঃসম্পদ বিভাগের সচিব হিসেবে।
আইসিডিডিআরবি (উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র) ছিল এ দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৩ সাল থেকে বাংলাদেশের বাইরে থাকার ফলে সিআরএল গােষ্ঠীর সঙ্গে একাত্তরে আমার কোনাে পূর্বপরিচয় ছিল না। বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানি হামলা শুরু হয়, তখন বাল্টিমােরে দু-তিনটি পাকিস্তানি জাহাজ নােঙরে ছিল। এদের একটি জাহাজে আমার এক ভাইপাে ফখরুজ্জামান চৌধুরী (সাদ) কাজ করত। সে এই পরিস্থিতিতে কী করবে, সেই ব্যাপারে আমার পরামর্শ চায় এবং আমি তাকে জাহাজ ছাড়তে বুদ্ধি দিই। তার বন্ধুরা সেই কারণে আমার পরিচয় পায়, যদিও তাদের কারও সঙ্গে তখন আমার আলাপ হয়নি। আমার ভাইপাে শেষ পর্যন্ত জাহাজ ছাড়ল না কিন্তু আরও কয়েকজন তরুণ অফিসার ৮ এপ্রিল জাহাজ ছাড়ল। তাদের সহায়তা করেন। উইলিয়াম গ্রিনাে। তিনি তখন জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান ফ্যাকাল্টিতে অধ্যাপক। বাংলাদেশ তার পরিচিত এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন বাঙালি । বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার নামে ওয়াশিংটনে যে শক্তিশালী লবি দপ্তর গড়ে ওঠে, এই ডা. গ্রিনাে তার নেতা ছিলেন। পরবর্তীকালে উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র
৫৭
যখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হয়, তখন তিনি হন এর প্রথম পরিচালক।
আবদুল আউয়াল মিন্টুর নেতৃত্বে ছয়জন নাবিক ৮ এপ্রিল ময়নামতি ও শালিমার জাহাজ পরিত্যাগ করেন। বাল্টিমাের সান পত্রিকায় তাঁদের দুজনের নাম প্রকাশিত হয়, আবদুল আউয়াল ও তাহেরুল ইসলাম। আমার মনে হয়, আরও দুজন—আনােয়ার ও কাশেমকে নিয়ে ডা. গ্রিনাে একটি স্টেশন ওয়াগনে চড়ে আমার বাসায় আসেন পরবর্তী রােববার ১১ এপ্রিল। ইতিমধ্যে তাদের আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে একজন উকিলের সঙ্গে যােগাযােগ হয়েছে, ওখানকার বাঙালি ছাত্র কজনের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। ডা. গ্রিননা তাদের আমার এখানে নিয়ে আসেন ভরসা দিতে। তারা সবাই মাত্র জুলদি একাডেমি থেকে পাস করে। জাহাজে যােগ দিয়েছে এবং খুবই কম বয়সী—বিশের মতাে বয়স হবে। ডা. গ্রিনের সঙ্গে আগে টেলিফোনে আলাপ হয়েছে, এই প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় । দুর্দিনে গড়ে ওঠা সেই সখ্য আজও অটুট। মিন্টু এখন এ দেশে একজন বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও শিল্পপতি। আনােয়ার নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। কাশেম বােধ হয় ফিলাডেলফিয়া এলাকায় স্থায়ী বসবাস করেন, ১৯৮৫ সালে সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। ফিলাডেলফিয়ায় আরও অনেক নাবিক স্থায়ী বাসিন্দা, তাঁরা বিভিন্ন সময়ে ফিলাডেলফিয়া, বাল্টিমাের বা নিউজার্সি থেকে পাকিস্তানি জাহাজ পরিত্যাগ করেন। তাঁদের এই দৃপ্ত পদক্ষেপ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা। এসব তরুণ এক হিসেবে জ্যেষ্ঠদের উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করেন।
ডেভিড ন্যালিন ১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে ওয়েস্ট পয়েন্টের মার্ক ফার্মাসিউটিক্যালের একজন উঁচুদরের গবেষণা পরিচালক ছিলেন। ন্যালিন উপমহাদেশীয় পুরাকীর্তির সংগ্রাহক। বাংলার অনেক পুরাকীর্তির নিদর্শন তিনি নুয়ার্ক জাদুঘরে দান করেছেন। ডেভিড বেশ ভালাে বাংলা বলতে পারেন। একদিন তিনি আমাকে টেলিফোন করে বাংলায় কথা বলতে থাকেন। তিনি দেশের খবর এবং দূতাবাসে আমাদের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করেন। আমি তার পরিচয় চাইলে তিনি বললেন, আমাকে নলিনী বাবু মনে করতে পারেন। আমি একটু সাবধান হয়ে গেলাম এবং নেহাত লৌকিকভাবে তাঁর অনুসন্ধিৎসা নিবৃত্তির প্রয়াস পেলাম। তিনি তখন ফোনটি দিলেন আনা ব্রাউন টেইলরকে এবং আনা আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। জানা গেল যে আনা আমার শ্যালিকা সিনারা বেগম এবং তাঁর স্বামী আবদুল মান্নান আহমদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । আনার স্বামী ডা. জেমস টেইলরও একসময় সিআরএলে ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আর যােগাযােগ নেই। আনা জার্মান নাৎসি শিবিরে বন্দী ছিলেন এবং কোনাে রকম সহিংসতা বা জুলুম তাঁর সহ্য হতাে না। কোনাে রকম মিথ্যাচার তার
৫৮
কাছে ছিল কবিরা গুনাহ। আনা বস্তুতই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হয়ে যান। ডেভিড ও আনা দেশের যে খবর দিলেন, তা নিতান্তই ভয়াবহ। যেসব বিদেশিকে ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে অপসারণ করা হয়, তাঁদের সঙ্গে তাঁদের যােগাযােগ হয়েছে এবং তাঁদের কাছ থেকেই তারা বাংলাদেশে সামরিক হামলার টাটকা খবর পেয়েছেন। তাঁরা আমাদের আত্মীয়স্বজনের খবর দিতে পারলেন না এবং তাদের পরিচিত লােকজনের খবর জানতে চাইলেন। আমাদের কাছে তখন। কোনাে খবর ছিল না।
বাংলাদেশের সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগ পাকিস্তানি হানাদাররা একেবারে বন্ধ করে রেখেছিল। ভারতীয় সূত্রে কিছু খবর পাওয়া যাচ্ছিল, তাতে অত্যুক্তি ছিল খুব বেশি। ইউএসএইড দপ্তরে আমার বন্ধু টাউনসেন্ড সােয়েজি রােজই তাদের সরকারি সূত্রে পাওয়া বিশ্বস্ত খবর সরবরাহ করত। এই সােয়েজি একরকম প্রতিবাদ করেই কিছুদিন পর ইউএসএইডের চাকরি পরিত্যাগ করে। একসময় সে বিশ্ব ব্যাংকে কাজ করত। তার স্ত্রী ফেলিসিটি কাজ করত একটি প্রকাশনা সংস্থায়। সােয়েজি দম্পতি উপমহাদেশের বিষয়ে সব সময়ই আগ্রহী ছিল। তারা একটি ছেলে ও একটি মেয়ে দত্তক গ্রহণ করে যাদের নাম রাখে ইন্ডিয়া ও পিটার।
ঢাকায় ১৯৭০-৭১ সালে মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড বাংলাদেশের সঙ্গে ভালােভাবে পরিচিত ছিলেন। সম্ভবত দশক খানেক আগে তিনি ঢাকায়। কনসাল হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এবং আমাদের পরিচয় সেই সময় থেকে। ১৯৬১ সালে আমার বিয়েতে সামান্য যে কজন বিদেশি উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ব্লাড দম্পতি। একজন দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল এবং অল্প বয়সেই তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কুলীন গােষ্ঠী এফএসও ওয়ান শ্রেণিতে প্রবিষ্ট হন। তিনি বাংলাদেশের ঘটনাবলির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন এবং তাঁর মতে পাকিস্তানিরা পাশবিক তাণ্ডবে মত্ত হয়। তিনি এবং তাঁর সহযােগী আরও ১৯ জন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সংকটে মার্কিন নমনীয় নীতির প্রতিবাদ করে একটি বার্তা প্রেরণ করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে এ ধরনের ভিন্নমত প্রকাশের একটি বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। সেই ডিসেন্ট চ্যানেলের সুযােগ নিয়েই ৬ এপ্রিল আর্চার ও তাঁর সহকর্মীরা তাঁদের বার্তা প্রেরণ করেন।
এই খবর ওই সময়ই সােয়েজির মাধ্যমে আমি জানতে পারি এবং অতিসত্বর এ খবর রাষ্ট্র হয়ে পড়ে। আর্চার ব্লাডকে এ জন্য অনেক ঝামেলা পােহাতে হয়। অল্প বয়সে যে কর্মকর্তা অনেক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি বােধ হয় শেষ পর্যন্ত একটি ভালাে রাষ্ট্রদূতের পদও পাননি। তিনি কূটনৈতিক চাকরিতে বেশ কিছুদিন কোনঠাসা ছিলেন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট গহিনকে
৫৯
প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন ভারতে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন। রাষ্ট্রদূত গহিন আর্চার ব্লাডকে ভারতে তাঁর ডেপুটি হিসেবে নেন। তারপর আর্চার আফগানিস্তানে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন কিন্তু আফগানিস্তানে অস্থিতিশীল অবস্থায় তাঁর আর সেখানে যাওয়া হলাে না। তখন তিনি কূটনৈতিক দপ্তর থেকে অবসর নিয়ে পেনসিলভানিয়া রাজ্যে কলগেট কলেজে অধ্যাপনা করেন। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তাদের লাইব্রেরিটি তাঁর নামে আর্চার ব্লাড মেমােরিয়াল সেন্টার’ রেখেছে। আর্চার বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা যান। দেশের সত্যিকার খবর তাই আমরা কিছু কিছু পেতাম কিন্তু আত্মীয়স্বজনের খবর বহুদিন সম্পূর্ণরূপেই অজ্ঞাত ছিল ।
আনা ও ডেভিড বস্তুতই ছিলেন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযােদ্ধা। তারা বিবৃতি দিয়ে, চিঠি লিখে এবং নানা খবর ও মন্তব্যের সংকলন বানিয়ে মার্কিন জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন ও প্রচারমাধ্যমকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। আনা ও জেমস টেইলর এর মধ্যে একদিন আমাদের বাসায় এসে হাজির। তাঁরা সমবেদনা প্রকাশ করলেন, আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করলেন। তাঁদের পরিচিত লােকজন নিয়ে স্মৃতিচারণা ও আলাপ-আলােচনা করলেন। আনা মে মাসে একটি একক বিক্ষোভ শুরু করলেন এবং ৯ মে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের সন্নিকটে শেরিডন সার্কেলের সবুজে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন। শনিবার সকাল ১০টায় তাঁকে তাঁর ব্রত পালনে উৎসাহ জোগাতে আসেন প্রায় ৩০ জন বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। আমাদের সেখানে যেতে খানিকটা দেরি হয়ে যায়। ওই দিন অপরাহে পাকিস্তানের বিশেষ দূত মির্জা মােজাফফর আহমদ ওয়াশিংটনে পৌছেই আনার বিক্ষোভের খবর পেলেন। আনা। সপ্তাহখানেকের জন্য জেঁকে বসবেন ঠিক করেছিলেন কিন্তু সােমবারই পুলিশ তাঁকে ওখান থেকে উঠে যেতে বলল। স্থানটি পাকিস্তান দূতাবাসের কাছে বলে তারা এতে আপত্তি জানাল । আনা কিন্তু নাছােড়বান্দা। নতুন করে অনুমতি নিয়ে তিনি হােয়াইট হাউসের সামনে লাফায়েত পার্কে তার বিক্ষোভ আবার শুরু করলেন ১৪ মে। এবার আরও তিন দিনব্যাপী ছিল তাঁর অনশন ধর্মঘট। এবার তাঁর সঙ্গে যােগ দেন আরও অনেকে। ডেভিড ন্যালিন তাে বটেই। তা ছাড়া ওয়াশিংটনে উচ্চশিক্ষায় লিপ্ত প্রকৌশলী মহসিন সিদ্দিক, কোলের এক বাচ্চাসহ মেগি আইজেনস্টাইন এবং জোন ডাইন ও তাঁর হাঁটি হাঁটি পা পা কন্যা এমি। আনার ক্ষোভ ছিল দুই কারণে। প্রথমত, বাংলাদেশে সামরিক বর্বরতা। দ্বিতীয়ত, মার্কিন নেতৃত্বের মিথ্যাচার ও পক্ষপাতিত্ব । প্রথমে ১০ তারিখ এবং পরে ১৫ তারিখে ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকায় আনার বিক্ষোভের ছবি বেরােল।
৬০
এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় ভাগ থেকে মে মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ছিল ভিয়েতনাম র্যালি, সভা ও অনেক শােভাযাত্রা। সেই তুলনায় আনার বিক্ষোভ ছিল অত্যন্ত শালীন ও নীরব, অত্যন্ত গভীর অথচ সুসভ্য।
লাফায়েত পার্কে বাংলাদেশের জন্য বিক্ষোভ কিন্তু সেখানেই শেষ হলাে না। অক্টোবরে ওই পার্কে দশ দিনব্যাপী একটা বড় বিক্ষোভ আয়ােজিত হয়। ষাটের দশকের শেষ দিকে সল্টলেকে কলকাতার একটি উপশহর প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। উপশহর নির্মাণের জন্য অনেক মালমসলাও ওখানে জড়াে করা হয়। ১৯৭১ সালের বাঙালি শরণার্থীরা ওখানে আশ্রয় নেয় এবং পানি ও পয়ােনিষ্কাশনের জন্য সংগৃহীত অনেক বড় বড় কংক্রিট পাইপেই তারা ঘর বাঁধে। পাইপ দিয়ে গড়ে ওঠা এই শরণার্থী আশ্রয়কেন্দ্রের অনুকরণে লাফায়েত পার্কে স্থাপন করা হয় সিউয়ার সিটি শরণার্থী কেন্দ্র। এই পাইপের নকল শহরে অনেক মার্কিন নাগরিক এবং যৎসামান্য বাঙালি সঙ্গী শরণার্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁরা শরণার্থীদের মতাে শাড়ি, লুঙ্গি ও গেঞ্জি গায়ে দিতেন আর লঙ্গরখানার ডালভাত খেতেন। শরণার্থীদের দুরবস্থার চিত্রটি তুলে ধরার এটি ছিল একটি সার্থক প্রচেষ্টা। এই উদ্যোগটি নেয় ফিলাডেলফিয়ার ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল সমিতি এবং ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার। বাংলাদেশের জন্য সাহায্য ও সমর্থন আদায়ের এটি ছিল একটি নাটকীয় পন্থা। এখানে বাংলাদেশ এবং শরণার্থীদের জন্য প্রার্থনাসভার অনুষ্ঠান হয়। এসব শরণার্থী কেন্দ্রে আসেন। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি। যেমন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ১৪ অক্টোবর এই বিক্ষোভ শুরু হয় ওয়াশিংটনে। ১ নভেম্বর অনুরূপ একটি বিক্ষোভ শুরু হয় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সামনে দাগ হ্যামারশােল্ড প্লাজায়। সাত দিনব্যাপী এই বিক্ষোভেও নিউইয়র্কের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা হাজিরা দেন। কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ সেপ্টেম্বরে ভারতে গিয়ে শরণার্থী কেন্দ্র এবং মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মকাণ্ড দেখে আসেন। তিনি এই বিক্ষোভে যােগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে কবিতার আসর করেন। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে তিনি যশােরের পথে’ নামে একটি কবিতাও প্রকাশ করেন।
মার্কিন মুলুকের বাঙালিরা ২৯ মার্চেই বাঙালি কূটনীতিবিদদের কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তারা সবাই পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে বাংলাদেশের কাজে নেমে পড়বেন। বাংলাদেশের জন্য যে আমাদের কাজ করতে হবে, সে ব্যাপারে কোনাে দ্বিমত ছিল না, তবে কীভাবে তা করা যাবে, সে সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে। যে খবর আমরা পাচ্ছিলাম, তাতে দেখা যাচ্ছিল যে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরােধের জন্য স্থানীয় নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে কিন্তু তাঁদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং কেন্দ্রীয় কোনাে
৬১
পরিচালনা নেই। একখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা, অন্যত্র প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, আবার অন্যত্র কোনাে বাহিনীর সেনাপতি। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করছি একটি সরকার ঘােষণার জন্য। আমাদের কমিটির এক সভায় ঠিক হলাে যে ভারতে গিয়ে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করতে হবে। এই উদ্যোগের জন্য উৎসাহী স্বেচ্ছাসেবকও পাওয়া গেল।
হারুন রশীদ আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন, প্রতিরােধের শক্তি ও গুরুত্ব উপলব্ধি। করবেন এবং আমাদের করণীয় সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে আসবেন। সবাই চাঁদা দিয়ে তাঁর প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করবেন। চাঁদা তােলা কিন্তু তত সহজ হলাে না। আমার বন্ধু আতাউর রহমান চৌধুরী বললেন যে আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে চাঁদা। তুলবার দায়িত্ব নিই, তবে তিনি প্রয়ােজনীয় ডলার অগ্রিম দিতে রাজি আছেন। চৌধুরীর খরচে টিকিট কেনা হলাে, মনে হয় তেরাে শ ডলার লেগেছিল। হারুন ১৩ এপ্রিল দিল্লির পথে ওয়াশিংটন ত্যাগ করলেন। ওই দিনই খবর পাওয়া গেল যে একটি সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছে এবং তারাই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবে। মধ্যরাতে (তখন লন্ডনে ১৪ তারিখ সকাল) জাকারিয়া খান চৌধুরীর সঙ্গে কথা হলাে। জাকারিয়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু । বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে লন্ডনে যান ব্যারিস্টার হতে আর সেখানেই থেকে যান। বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে লন্ডনে নানা আন্দোলনে জাকারিয়া সব সময় সক্রিয় ছিলেন। বােধ হয় ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। পরবর্তীকালে জাকারিয়া জেনারেল জিয়ার উপদেষ্টা, অর্থাৎ মন্ত্রী হন এবং সক্রিয় রাজনীতি করেন। জাকারিয়া ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে লন্ডনে পৌছান এবং বিদেশে বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রস্তুতি সম্বন্ধে তিনিই প্রথম বক্তব্য দেন।
জাকারিয়া আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধবের খবর দিলেন এবং জানালেন যে বাংলাদেশ সরকার ওই দিন কুষ্টিয়ায় শপথ গ্রহণ করবে। তবে জ্যাক (আমরা এই নামেই তাঁকে ডাকি) আরও বললেন যে মুক্তিযুদ্ধ খুব শিগগির সমাপ্ত হবে না এবং একটি দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে উচ্ছেদ করা যাবে না। যা হােক, ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা হলাে না। পাকিস্তান বিমানবাহিনী খুব জোরেশােরে কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা আক্রমণ করে এবং মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে হয়। ছুটিতে অবস্থানরত মেজর ওসমান, মহকুমা প্রশাসক তৌফিক ইলাহী চৌধুরী এবং মহকুমা পুলিশ সাহেব মাহবুবুদ্দিন আহমদ তখন ওই এলাকায় মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অবশেষে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের অভিষেক হলাে। জায়গাটির নাম এখন মুজিবনগর। তবে ১৯৭১ সালে মুজিবনগর ছিল সেখানে,
৬২
যেখানে বাংলাদেশ সরকার সমষ্টিগতভাবে কাজ করত। তাই অনেক দিন কলকাতার থিয়েটার রােডে ছিল মুজিবনগর। নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারকে বলত মুজিবনগর সরকার। আসলে এটি ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম সরকার। রাষ্ট্রপতি ছিলেন অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
গােপনীয়তার বেড়া অতিক্রম করে হারুন যখন কলকাতায় পৌছালেন, তখন মুজিবনগর সরকারের অভিষেক নিয়ে তােড়জোড় চলছে। ১৭ তারিখ সরকারের অভিষেক হলাে আর পরদিন কলকাতার পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের সমুদয় বাঙালি কর্মচারী পাকিস্তানের বাঙালি ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলীর নেতৃত্বে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে তাঁদের দপ্তরে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করলেন। হারুন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি মিশনপ্রধান হােসেন আলীর সঙ্গেও দেখা করেন। ২০ এপ্রিল হারুন আমাকে এক তারবার্তা পাঠালেন। ‘৯ সার্কাস অ্যাভিনিউতে বাংলাদেশ মিশনে বাংলাদেশের। প্রতি আনুগত্যের ঘােষণা পাঠান। তারপর নিযুক্তির হুকুম যাবে। অন্যখানে। যেসব বাঙালি কূটনীতিবিদ আছেন, তাঁদের সঙ্গেও যােগাযােগ করুন। হারুন। ওয়াশিংটন ছাড়ার আগে আমরা আরেকটি কাজ করি। একটি বেনামি সার্কুলার তৈরি করা হয় ৫ এপ্রিলে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে বাঙালিদের ঠিকানা জোগাড় করে সেটি পাঠানাে হয়। এই সার্কুলারে বাঙালিদের কর্তব্য কী হতে পারে, সে সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া হয়। প্রথমত, সর্বত্র বাংলাদেশ লিগ গঠন করতে হবে এবং পারতপক্ষে এসব সমিতির সভাপতি হবেন বাঙালি মার্কিন নাগরিক। তাঁদের প্রধান কাজ হবে জনমত গঠন করা এবং বাংলাদেশ সম্বন্ধে সঠিক খবর দেওয়া। সমিতির কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হবে নিউইয়র্ক লিগ, যারা পূর্ব পাকিস্তান নামটিকে বাংলাদেশ লিগ নামে পরিবর্তনের জন্য ব্যবস্থা ইতিমধ্যে নিয়েছে। এক জায়গায় বলা হয়, বােঝাতে হবে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বৃহত্তর গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। একটি বৈধ নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানকে একনায়কের নেতৃত্বে পরিচালিত সেনাবাহিনী যে ধ্বংস করতে বসেছে, এই বিষয়টির ওপর সবিশেষ জোর দিতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য চাঁদা আদায়ের কথাও বলা হয়। আমেরিকার সব নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার বা কংগ্রেসের নেতাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত, বার্মা ও শ্রীলঙ্কার ওপর চাপ রাখতে হবে এবং ওই দেশীয় লােকজনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের কিছু বিবরণ এতে দেওয়া হয়। সার্কুলারে যােগাযােগ করবার জন্য একটি ঠিকানা দেওয়া হয় ৩১১৭, ৭ নম্বর স্ট্রিট, নর্থ ইস্ট, ওয়াশিংটন।
৬৩
ডিসি ২০২১৭। ঠিকানা যে কার ছিল, এখন মনে পড়ে না। তবে টেলিফোন নম্বর ছিল হারুনের ৭০৩-৩৫৬-০২৭৭। সৈয়দ মােয়াজ্জেম আলী আর আমার স্ত্রী সার্কুলারগুলাে পাঠাবার ভার নেন। তাঁরা এই জন্য ৯০ জনের একটি ফর্দ বানান ।
হারুন ফিরে এলেন সম্ভবত ২৪-২৫ এপ্রিল, অধীর আগ্রহে সবাই মুক্তিযুদ্ধের খবর শুনতে চান। বাঙালি ছাড়াও বিদেশি বন্ধুরাও উদ্গ্রীব। ২৬ তারিখ বােধ হয় আমরা সমবেত হলাম আমার বাড়িতে। হারুনের মন্তব্য থেকে প্রতীয়মান হলাে যে বাংলাদেশ সরকার খুবই অগােছালাে। মুক্তিযুদ্ধের জন্য কোনাে পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। ভারতীয় সাহায্য খুবই সীমিত, হিসাব করে রাইফেল ও গুলি দেওয়া হয়। ভারত সরকার বাংলাদেশ নেতৃবর্গের নিরাপত্তা নিয়ে খুবই পেরেশান। সবার জন্য একেকটি ছদ্মনাম আছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন হলেন মােহাম্মদ আলী, তার সার্বক্ষণিক সহচর আমীর-উল ইসলাম হলেন রহমত আলী, হারুন রশীদের নাম ছিল মুরাদ আহমদ। তবে সবচেয়ে আশার খবর হলাে নির্বাসিত বাঙালিদের দেশ স্বাধীন করার জন্য সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আবালবৃদ্ধবনিতা অনির্দিষ্টকালের জন্য যুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রোশ ও ঘৃণা ছিল সীমাহীন। হারুনের বরাতে আরও জানা গেল যে আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতৃত্ব, ছাত্রদের নেতৃবর্গ এবং বুদ্ধিকোষের সক্রিয় ব্যক্তিরা সবাই যথাসময়ে সাবধান হবার সুযােগ নিয়ে কোনাে না কোনাে রকমে সীমানা পেরিয়ে ভারতে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের কর্তব্যের ধারা সম্বন্ধে কোনাে সন্দেহের অবকাশ থাকল না। সর্বতােভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করে তুলতে হবে। তাদের অর্থসাহায্য দিতে হবে, সর্বোপরি যােগাযােগ ও সম্প্রচারের জন্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য সমর্থন গড়ে তুলতে হবে, পাকিস্তানকে একঘরে করতে হবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল কূটনীতিবিদদের আনুগত্য ঘােষণা নিয়ে। হারুনের তারবার্তাটিকে মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ বলে গ্রহণ করতে আপত্তি উঠল। পাকিস্তান সরকার আঘাত হানলে তখন না হয় আনুগত্য পরিবর্তন করা যাবে। এই সিদ্ধান্ত কিন্তু বাঙালি বেসরকারি মহলে মােটেই গৃহীত হলাে না। ওয়াশিংটনের বাঙালি সমাজ কূটনীতিবিদদের বাদ দিয়েই ১০ এপ্রিল তাদের একটি সমিতি গঠন করে এবং হারুনের প্রত্যাবর্তনের আগেই সেটা নিবন্ধিত হয়। তখন থেকেই এ দুই গােষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা হয় যে দূতাবাসে যেসব বাঙালি কাজ করতেন, তাঁদের মধ্যেও দুটি দল হয়ে যায়, মােটেই খােলাখুলি নয় কিন্তু মনের গভীরে। সাধারণ কর্মচারীরা মনে করেন যে কূটনৈতিক মর্যাদার কর্মকর্তারা সঠিকভাবে তাদের সমর্থন করবেন না। তাই সবাই যেন নিজের রাস্তা দেখতে শুরু করেন।
৬৪
এর মধ্যে অন্যান্য বাঙালি প্রায় ধমক দিয়ে অথবা কড়া শাসন করে সব কূটনীতিবিদের কাছে চিরকুট পাঠাতে শুরু করেন। আমার সংগ্রহে এখনাে এ রকম দুটো বার্তা ও আলটিমেটাম রয়েছে।
এদিকে ২৬ তারিখেই নিউইয়র্কের ভাইস কনসাল এ এইচ মাহমুদ আলী পাকিস্তান কনস্যুলেট জেনারেল ছেড়ে বাংলাদেশের আনুগত্য ঘােষণা করেন। মাহমুদ আলী নিউইয়র্কে নিযুক্তি পেয়েই সাহসী ভূমিকা পালন করতে থাকেন। তিনি বাংলাদেশ লিগের ছিলেন প্রধান বুদ্ধিদাতা। একুশে ফেব্রুয়ারি তারই উদ্যোগে কনস্যুলেট জেনারেলের দপ্তরে শহীদ দিবস উদ্যাপন করা হয়। পাকিস্তান সরকার তাঁকে শাস্তি দিতে নিউইয়র্ক থেকে দেশে ডেকে পাঠায়। ভারতের বাইরে আবুল হাসান মাহমুদ আলী ছিলেন প্রথম বাঙালি কূটনীতিবিদ, যিনি বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন। পরবর্তীকালে তিনি পূর্ব জার্মানিতে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে ১৯৯৬ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার হন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের। পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ এইচ মাহমুদ আলী হলেন আমেরিকায় মুজিবনগর সরকারের প্রথম প্রতিনিধি। মাহমুদ আলীর বীরােচিত পদক্ষেপ নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হয়। ক্যাথলিন টেলটস তাঁর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করেন। আমার দোষ হলাে যে আমি বাঙালি এবং আমার স্বদেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে আমি পারিনি। আমরা দূতাবাসে কাজ করতে পারি না, আমরা হয়ে আছি জিম্মি। যে সরকার আমার জাতভাইদের হত্যা করছে, আমি তাদের চাকরি করব না। তাঁর স্ত্রী শাহীন বলেন, ‘আমার খুব খুব খারাপ লাগছে, আমি নিজে অস্ত্র তুলে নিতে চাই।’ মাহমুদ আলীর এই পদক্ষেপের পর ওয়াশিংটনে আমাদের অবস্থান নিতান্তই নাজুক হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা ইতিমধ্যে আমেরিকায় বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যস্ত। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশে বাঙালি কূটনীতিবিদদের সঙ্গে যােগাযােগ করছি। মার্চেই লন্ডনে সেলিমুজ্জামান ও রেজাউল করিমের সঙ্গে এবং প্যারিসে মনজুর হােসেন চৌধুরীর সঙ্গে আমার কথা হলাে। সেলিমুজ্জামান ধীরেসুস্থে চিন্তা করতে বললেন। কিন্তু রেজা আর মনজুর দ্রুত পদক্ষেপ নিতে খুবই উৎসাহী ছিলেন। মনজুর তাে নালিশই করলেন যে আমরা এতজন ওয়াশিংটনে বসে কেন চুপ করে আছি। এপ্রিলে যােগাযােগ হলাে সুদানে রাষ্ট্রদূত আতাউর রহমানের সঙ্গে আর টোকিওতে। কায়সার মুরশেদের সঙ্গে। কায়সারকে দপ্তরে টেলিফোন করেছিলাম, তিনি বেশি কথা না বলে পরে একটি পাবলিক কল অফিস থেকে কথা বলেন। তাঁর বাঙালি রাষ্ট্রদূত মােতাহার হােসেন মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেন না বলে তিনি জানালেন। প্রাথমিক এই উৎসাহ কিন্তু আস্তে আস্তে চলে গেল। শুধু রেজাউল করিম ৭।
৬৫
অক্টোবর বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। সেলিমুজ্জামান ও মােতাহার হােসেন বাংলাদেশ মুক্ত হলেও পাকিস্তানে থেকে যান। কায়সার। মুরশেদ যুদ্ধ শেষে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের পক্ষে আসেন। আতাউর রহমান কোনাে এক সময় আলােচনার্থে পাকিস্তান গেলে পরে তাকে আর ফেরত যেতে দেওয়া হলাে না। বােধ হয় ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান থেকে তিনি পালিয়ে। বাংলাদেশে আসেন। মনজুর চৌধুরী ১৯৭২ সালে পাকিস্তান দূতাবাস ছাড়লেও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করেন অনেক পরে। বাংলাদেশ সরকার কূটনীতিবিদদের আনুগত্য আশা করে এবং তার মূল্যও দেয়। তবে সরকারিভাবে তাঁদের ভার নিতে তাদের প্রথম দিকে অসুবিধা ছিল। কিন্তু জুন মাসে তারা ঠিক করে যে বিদেশে কতগুলাে মিশন স্থাপন করবে এবং সব কূটনীতিবিদকে আনুগত্য ঘােষণার আহ্বান জানাবে।
জনসংযােগের দৃষ্টিকোণ থেকে এ রকম আনুগত্য ঘােষণা ছিল নানাভাবে মূল্যবান। প্রথমত, এতে মুক্তিযুদ্ধে সমস্ত বাঙালি গােষ্ঠীর ব্যাপক সমর্থন প্রকাশ পেত। দ্বিতীয়ত, তারা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জনমত গঠনে এবং প্রচারণায় উত্তম ভূমিকা রাখতে পারতেন। তৃতীয়ত, এতে রণাঙ্গনে যােদ্ধারা ও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নিষ্পেষিত জনগণ ভরসা পেত ও উদ্বুদ্ধ হতাে। ৫ জুলাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় সব কূটনীতিবিদকে আনুগত্য ঘােষণার আহ্বান। জানান এবং তাঁদের চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করেন। এই আহ্বানে একটি সমগ্র দল হিসেবে সাড়া দেন ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে আমাদের সব কূটনীতিবিদ। মােট ১৪ জন কর্মচারী ৪ আগস্ট ওয়াশিংটন প্রেসক্লাবে এই ঘােষণা দিয়ে এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। শুধু কলকাতায় ১৮ এপ্রিল এভাবে পাকিস্তান মিশনে চাকরিরত সব বাঙালি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
৬৬
<p style="text-align: justify;"> চতুর্থ অধ্যায়
দুটি উদ্যোগ
পাকিস্তানের ঘনায়মান অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয় প্রথম পর্বেই আলােচনা। করেছি। আজিজ আলী মােহাম্মদ একসময় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কাজ করতেন। পরে তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে যােগ দেন। ১৯৭০ সালে তাকে পাকিস্তান সরকার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত করে। তিনি ইসলামাবাদে গেলেও তাঁর পরিবার ওয়াশিংটনেই থেকে যায় এবং তাদের। সঙ্গে আমাদের বেশ সখ্য ছিল। জানতে পেলাম যে আজিজ আলী ওয়াশিংটনে আসছেন ঋণ পরিশােধ ও অর্থ সাহায্যের বিষয়ে আলােচনার জন্য। ৮ এপ্রিল আমি ওয়াশিংটন ইভনিং স্টার-এর জর্জ শারমানের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম, তিনি অর্থনৈতিক বিষয়ে রিপাের্ট করেন। মধ্যাহ্নভােজের ফাঁকে ফাঁকে তাকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করলাম । জর্জকে মার্কিন সূত্র জানায় যে তারা পাকিস্তানকে একটি সমঝােতা করার জন্য চাপ দিচ্ছে এবং সাময়িকভাবে নতুন কোনাে সাহায্য দিচ্ছে না।
ধারণা ছিল অন্য রকম, মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সাহায্য দিতে ছিল উদ্গ্রীব। তবে বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে বিষয়টি ফয়সালা করতে বলছিল। যা-ই হােক, জর্জ পরের দিনই পাকিস্তান সংকটের একটি বিশদ বিবরণ প্রকাশ করেন এবং আজিজ আলীর মিশনের কথাও উল্লেখ করেন। তবে তাঁর প্রতিবেদনের শিরােনাম ছিল মার্কিন সরকারকে খুশি করার জন্য। Us Trying to Force Pakistan Accord. (পাকিস্তানে সমঝােতার জন্য মার্কিন চাপ)। ওয়াশিংটন পােস্ট-এর রন কোভেন এবং নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেন ওয়েলস দুজনই আমাকে সংকটটি সম্বন্ধে কিছু লিখিত বক্তব্য দিতে অনুরােধ করেন। তাঁদের এই অনুরােধ আমি সাগ্রহে গ্রহণ করি। এরপর যেখানেই বাংলাদেশের কথা বলতে যাই—সাংবাদিক মহলে, কোনাে সমীক্ষা বা চিন্তাকোষ কেন্দ্রে বা
৬৭
কংগ্রেস—সবখানেই দেখি লিখিত বক্তব্যের চাহিদা খুব বেশি এবং তার প্রতিক্রিয়াও খুব ভালাে। রন কোভেন ১০ তারিখে লিখলেন ‘Pakistan Seeks US Aid to Avoid bankruptey’ (পাকিস্তান দেউলিয়াপনা এড়ানাের জন্য মার্কিন সাহায্য চায়)। বেন ওয়েলস তার এক বিস্তৃত প্রতিবেদনে এই সংকট সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য ওই দিনই প্রকাশ করলেন। আমি তাঁদের জন্য একটি প্রতিবেদন বানাই, ‘পাকিস্তানের দেউলিয়াপনা।
আমার মনে হলাে, আমার সময়ের খুব অভাব। সকাল নয়টা থেকে প্রায় ছয়টা-সাড়ে ছয়টা কেটে যায় দপ্তরে খানিকক্ষণ হাজিরা দিতে আর বাইরে নানাজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে। তারপর পড়ার বা লিখবার সময় খুব কম। এ সময় বেশ কদিন অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এর পরিণাম হলাে আমার পরবর্তী জীবনের এক মূল্যবান অভ্যাস। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে আমি দেখলাম যে দিনে চার ঘণ্টা ঘুমালেই যথেষ্ট, ঘুম ভালাে হয় তাই অসুবিধা লাগে না অথচ অনেক সময় হাতে হাতে ফল পাওয়া যায়। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। ঘুমের এই রুটিন পালনে আমার কোনাে অসুবিধা হয়নি অথবা খুব বেশি ব্যতিক্রমও হয়নি। এখনাে কাজের চাপ থাকলে এই রুটিনে প্রত্যাবর্তন করতে খুব অসুবিধা হয় না। ঘুমটা তাই নিতান্তই অভ্যাসের ব্যাপার। সাধারণত ছয় বা সাত ঘণ্টা ঘুমে অভ্যস্ত ছিলাম কিন্তু তাকে চার ঘণ্টায় নামিয়ে নিতে শুধু একটু কঠিন ইচ্ছাশক্তির প্রয়ােজন হয়। এপ্রিল মাসে এ ধরনের আরও কয়েকটি প্রতিবেদন আমাকে প্রস্তুত করতে হয়; কোনাে কোনােটা ছিল নিতান্ত সাময়িক বিষয় নিয়ে, আবার কোনােটা ছিল দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বের বিষয় নিয়ে। সামরিক বাহিনীর উন্মত্ত কর্মকাণ্ড, বাংলাদেশ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ, পাকিস্তানের রাজনৈতিক দর্শন ও আচরণ—এ ধরনের বিষয় নিয়ে আমাকে বেশ কটি ছােটবড় প্রতিবেদন বানাতে হয়।
এপ্রিলে দুটি সম্মেলনের কথা না বললেই নয়। ইন্টেলসাট’ বিশ্ব সম্মেলন। শুরু হয় বােধ হয় ১৯৬৯ সালে। এটি ছিল আসন্ন স্যাটেলাইট টেলিযােগাযােগ বিপ্লবের নিয়মকানুন নির্ধারণের জন্য। প্রথম সম্মেলনে পাকিস্তান দলের নেতৃত্ব। দেন সম্ভবত পােস্টমাস্টার জেনারেল ওবায়েদ মােহাম্মদ। তিনি উর্দুভাষী বাঙালি ছিলেন এবং অনেক দিন পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি করেন। তাঁর সঙ্গে ঢাকায় থাকতে প্রথম পরিচয় হয় এবং পরে করাচি ও পিন্ডিতে একসঙ্গে চাকরি করি। তার খাতিরে আমাকে এই সম্মেলনে অংশ নিতে হয়। পরবর্তী প্রায় প্রতিটি অধিবেশনে তিনি আমাকে দলের নেতা মনােনীত করেন। পাকিস্তান থেকে মাঝেমধ্যে গােলাম আব্বাস নামে একজন কর্মকর্তা আমাকে সহযােগিতা করতেন। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন মার্কিন প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ওয়াশবার্ন। ১৪ এপ্রিল শুরু হয় একটি
৬৮
অধিবেশন। অধিবেশনে তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার খানিকটা উত্তপ্ত আলােচনা হয়। তুর্কি পাকিস্তানের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ। ওই দেশে তারা পাকিস্তানিদের বলে ভাই বা কারদেশ আর মার্কিনদের বলে বন্ধু বা অর্কেন্দাশ। ভ্রাতৃত্বের সুযােগ নিয়ে আমি তাকে পাকিস্তানের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য অনুরােধ করি। আমি বলে ফেলি যে বাঙালিরা শুনেছে যে তুর্কি পাকিস্তানকে সেনা ও রসদ সরবরাহের জন্য উড়ােজাহাজ দিয়েছে। আমি আরও বলি যে এটি ভ্রাতৃসুলভ কাজ হয়নি। কারণ, এই সাহায্য পেয়ে পাকিস্তানিরা বাঙালিদের খুন করছে।
১৯ এপ্রিল তারিখে আমার মিনিস্টার বশির আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে শুধালেন যে তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার কি কোনাে বচসা হয়েছে? অত্যন্ত অপ্রিয় একটি নির্দেশ তিনি ভদ্রভাবে দেবার চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন যে তুর্কি রাষ্ট্রদূত হিলালি সাহেবের কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেছেন। তিনি বলেছেন যে আমি খুব আবেগপ্রবণ এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে খুবই বিচলিত। হিলালি হুকুম দিয়েছেন যে আমি যেন সম্মেলনে আর না যাই এবং দূতাবাসে যেন থাকি। আমি বললাম, আমার তাে এইড, কমার্স এবং বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলে অনেক কাজ থাকে, তাই দূতাবাসে তাে আমি সব সময় থাকতে পারব না। বশির সুন্দর সমাধান বের করলেন। লাঞ্চ পর্যন্ত আমি দূতাবাসে থাকব। লাঞ্চে বেরিয়ে চারটা পর্যন্ত অন্যান্য কাজ সারব আর পাঁচটার পর যা খুশি তা করতে পারব। এই রুটিন বেশ কিছুদিন আমাকে মেনে চলতে হয়। আমি এর জন্য মধ্যাহ্নভােজের সময় বাড়িয়ে দিলাম। আর রােজই একজন-আধজন মেহমান ডাকতে শুরু করলাম। ২২-এ স্টেট ডিপার্টমেন্টে লাঞ্চ, ২৬-এ বিশ্ব ব্যাংকে, ২৭-এ মুদ্রা তহবিলে জেরাকিস, ২৯-এ বাংলাদেশে কর্মরত এক উপদেষ্টা রিচার্ড কিম্বল। ইন্টেলস্যাটে আর কোনাে অধিবেশনে আমি যােগ। দিইনি। ১৯৭২ সালে আমি যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধি (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স), তখন রাষ্ট্রদূত ওয়ার্শবান আমার সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশকে ইন্টেলস্যাট কনভেনশনে দস্তখত করতে আহ্বান জানান।
এই সম্মেলনে অন্য রকমের অভিজ্ঞতা হয় ইরানি দূতাবাসের এক মিনিস্টারের সঙ্গে আলাপ করে। তাকে ১৬ এপ্রিল আমি সিনেটর হ্যারিসের প্রস্তাব সম্বন্ধে অবহিত করি। সিনেটর ১৯ এপ্রিল তাঁর প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। আমি তাঁকে বলি যে ইরানের শাহ একাধারে পাকিস্তানের বন্ধু, অন্যদিকে ভারতেরও খুব ঘনিষ্ঠ । বাংলাদেশে আমরা তাঁকে সম্মান করি। আমার কলেজজীবনে ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে তিনি যখন বাঘ শিকারে সিলেটে যান, তখন থেকে তিনি আমাদের প্রিয়পাত্র। তাকে তখন যে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়, পরবর্তীকালেও তিনি সেই রকম সংবর্ধনা পান। তিনি পাকিস্তানকে সংযমী হতে উপদেশ দিতে পারেন । তিনি
৬৯
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমঝােতার জন্য মধ্যস্থতা করতে পারেন। ওয়াশিংটনে তখন ইরানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি, একসময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদের্শির জাহেদি। আমার উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে একটি ভূমিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু এটিই ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ। পাকিস্তানি বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ এমন স্তরে পৌছায় যে কোনাে রকম মধ্যস্থতার সুযােগ ছিল না। মার্কিন অনেক মহলে নভেম্বর মাসেও ধারণা ছিল যে স্বায়ত্তশাসনে রাজি হলে সম্মিলিত পাকিস্তান রক্ষা করা যেত। জুনের ২৮ তারিখে জেনারেল ইয়াহিয়ার ঘােষণার পর সমঝােতার একমাত্র রাস্তা ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্পর্ক ছেদ, কনফেডারেশনের কোনাে সুযােগ ছিল না। শেষ পর্যায়ে ইরানও এই সংকটে নিরপেক্ষ থাকেনি, পাকিস্তানের বিমানপােত ইরানে সংরক্ষিত হয়। ইরানের মাধ্যমে অস্ত্র পাচারের। চিন্তাভাবনা কিসিঞ্জারের মাথায় আসে।
২৯ এপ্রিল আমেরিকান সােসাইটি ফর ইন্টারন্যাশনাল ল-এর বার্ষিক সম্মেলন হয় স্টেটলার হিল্টন হােটেলে। ডেল ডিহান আমাকে এই সম্মেলনে যেতে আহ্বান করেন। ডেল সেখানে অধ্যাপক গিডন গটলিয়েবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। গটলিব নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি এই সম্মেলনে বক্তৃতা দেবেন মানবাধিকার সম্বন্ধে। তিনি বাংলাদেশের বিশদ খবর চেয়ে বসলেন। তার ধারণা, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে এবং পাকিস্তান সেখানে। জেনােসাইড কনভেনশনের হিসাবে আসামি। প্রশ্নোত্তরে গটলিব বলে ফেললেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং প্রয়ােজনে নির্বহন জায়েজ। সেখানেই ডেল জানালেন, কংগ্রেসম্যান গালাগার বাংলাদেশের ওপর শুনানি নির্ধারণ করেছেন। সিনেটর কেনেডি সেখানে প্রধান সাক্ষী আর অধ্যাপক গটলিবকে সাক্ষ্য দেবার জন্য আহ্বান জানানাে হতে পারে। গালাগার শুনানির প্রথম অধিবেশন হয় ১১ মে।
২৭ এপ্রিল আর না পেরে বিশ্ব ব্যাংকের সভাপতি ম্যাকনামারা সাহেবকে টেলিফোন করে বসলাম। তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা হয়েছে। প্রথমবার নবাব কিজিলবাসের দলের সদস্য হিসেবে আর দ্বিতীয়বার জেনারেল ইয়াহিয়ার জন্য রাষ্ট্রদূত হিলালির লাঞ্চে। রবার্ট স্ট্রেঞ্জ ম্যাকনামারা একজন বিতর্কিত মহামানব। অতি অল্প বয়সে শুধু মেধার জোরে তিনি দ্বিতীয় হেনরি ফোর্ডের নজরে আসেন। ৪৪ বছর বয়সে তিনি ফোর্ড কোম্পানির প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। বুদ্ধি ব্যবহার করে যারা সবকিছু করে, সেই গােষ্ঠীর একজন হিসেবে ‘হুইজ কিড’ (Whiz Kid) শব্দটি তাঁর সুবাদে অভিধানে একটি বিশেষ স্থান করে নেয়। প্রেসিডেন্ট কেনেডি তাঁকে আমেরিকার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বানান এবং প্রেসিডেন্ট জনসনের মন্ত্রী হিসেবে ভিয়েতনামের ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ সময় ১৯৬৮
৭০
সালে তিনি বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, বিশ্ব ব্যাংকে তিনি সুদীর্ঘতম সময়ের জন্য (মােট ১৪ বছর) কর্ণধার ছিলেন এবং ম্যাকনামারার বিশ্ব ব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন উদ্যোগে শুধু অর্থসংস্থানই করেনি, বরং উন্নয়ন-দর্শন ও উন্নয়নকৌশলে দিশারির ভূমিকা পালন করে।
বিশ্ব ব্যাংক ছাড়ার পরও নিরস্ত্রীকরণ ও আণবিক সমরাস্ত্র নিশ্চিহ্নকরণ, জনসংখ্যা পরিকল্পনা, দারিদ্র্য বিমােচন এবং আফ্রিকার উন্নয়ন আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আমার অভিজ্ঞতায় এমন দক্ষ বিশ্ব ব্যাংক সভাপতি আমি আর দেখিনি। বলা হয় যে কম্পিউটার জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগে। থেকেই ম্যাকনামারার মন ছিল কম্পিউটারের মতাে দ্রুতগতি, স্মৃতিধর ও বৃহৎ পরিসরের। ১৯৬৮ সালে বিশ্ব ব্যাংক বছরে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ দিত । ১৯৮০-তে এই কলেবর ছিল ১২ বিলিয়ন ডলার । ম্যাকনামারার একটি দুর্বল দিক হলাে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। ১৯৬৫-এর শুরু থেকে যুদ্ধে মার্কিন ভূমিকা বেড়ে চলল। এবং ধ্বংস ও মৃত্যুহার উঁচুতে উঠল । ১৯৬৭-এর মাঝামাঝি ম্যাকনামারা এই নীতির বিরােধিতা করতে শুরু করেন কিন্তু তিনি পদত্যাগ করেননি। এ ব্যাপারে সুদীর্ঘ ৩০ বছর নীরবতা বজায় রেখে ১৯৯৫ সালে তিনি মার্কিন-ভিয়েতনাম নীতির ভ্রান্তি স্বীকার করে আরও বিতর্কিত হন। তাঁর বই In Retrospect কিন্তু একটি অবশ্যপাঠ্য। ব্যক্তিগতভাবে মানুষের মঙ্গল, বিশ্বশান্তি এবং গরিব ও বঞ্চিতের প্রতি তার অঙ্গীকার আমাকে মুগ্ধ করে। ১৯৭২ সাল থেকে তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে জানবার সুযােগকে আমি সৌভাগ্য বলে বিবেচনা করি।
ম্যাকনামারার স্টাফ অফিসার জুলিয়ান ক্রিস্টোফারসেন আমার কথা শুনলেন। আমাকে বললেন, তিনি ম্যাকনামারার সঙ্গে আলাপ করে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করবেন। আধা ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন এল যে ম্যাকনামারা আমার সঙ্গে দেখা করবেন না, তবে তিনি সহানুভূতিশীল । আমি যেন সর্বক্ষণ দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক গ্রেগরি ভােটার সঙ্গে যােগাযােগ রাখি। গ্রেগ এই ব্যাপারে ম্যাকনামারার বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। গ্রেগ তক্ষুনি আমাকে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে ডাকলেন। গ্রেগ দম্পতির সঙ্গে আমাদের এমনিতেই ভালাে সম্পর্ক ছিল, আমরা একসঙ্গে একবার পিকনিকও করি। গ্রেগ ভােটার সঙ্গে বিশ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে বিস্তর আলােচনা হলাে কিন্তু আমাদের সংকটের আশু সমাধানের কোনাে রাস্তার সন্ধান মিলল না। গ্রেগের কথা হলাে, জাপানকে আমাদের বিষয়ে আগ্রহী করতে পারলে মার্কিন দুষ্ট প্রভাব থেকে আমরা রেহাই পেতে পারি। গ্রেগ আরও জানালেন যে আজিজ আলী মােহাম্মদের সফরটি ছিল পূর্বনির্ধারিত। তাই সামরিক হামলার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির কোনাে বিশ্লেষণ তিনি করতে পারেননি। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিটি হয়ে গেছে মুখ্য বিবেচনার বিষয়, অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি এখন
৭১
ঢেলে সাজাতে হবে। পাকিস্তানকে নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসতে হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে তারা সেই প্রস্তাব পাবার আশা রাখেন। এই প্রস্তাব বিবেচনা করে বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিল তাদের পরবর্তী কৌশল সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেবে।
ওই দিনই (২৭ এপ্রিল) আমার বন্ধু সােয়েজি ইউএসএইডে আমার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সভার আয়ােজন করেন। সহকারী প্রশাসক ডােনাল্ড ম্যাকডােনাল্ডের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার। ডন পাকিস্তানে এইডের পরিচালক ছিলেন, যখন আমি করাচিতে পরিকল্পনা কমিশনে চাকরি করি। কার্যোপলক্ষে আমরা পরস্পরের কাছে পরিচিত ছিলাম, যদিও তাঁর সঙ্গে আমার কোনাে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। ডন পাকিস্তান থেকে ভিয়েতনামে যান, তারপর ওয়াশিংটনে সদর দপ্তরে এশিয়া অঞ্চলের বড় কর্তা হন। ওয়াশিংটনে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাঁর সহযােগী অনেকের মধ্যে ছিলেন হারবার্ট রিস ও টাউনসেন্ড সােয়েজি। ডন ম্যাকডােনাল্ড খুব জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। বিশেষ করে ওয়াশিংটনে কূটনৈতিক পার্টিতে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তাঁকে দেখতে লাগত নামকরা চলচ্চিত্র নায়ক ক্যারি গ্রান্টের মতাে। এ বিষয় নিয়ে তার স্ত্রীও ঠাট্টা-মশকরা করতেন। তাঁর কাছে আমার বক্তব্য ছিল দুটি। প্রথমত, পূর্ব পাকিস্তানে তখন প্রচুর গম আর সার সরবরাহ হতাে মার্কিন সাহায্যের অধীন। আমার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দূতাবাস নির্বিবাদে মাল খরিদ ও তা জাহাজজাত করছিল। প্রায়ই জাহাজকে মাঝপথে গন্তব্যস্থল পরিবর্তন করে করাচিতে পাঠিয়ে দেওয়া হতাে। আমার কাছে মনে হতাে, বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা পাকিস্তানে এভাবে স্থানান্তর করা হচ্ছিল। তাই আমি সব সরবরাহ বন্ধ করতে আবেদন করলাম।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে উর্ধ্বতন মহল থেকে চাপ থাকলেও খুব বেশি ত্রাণসামগ্রী পূর্ব পাকিস্তানে সরবরাহ করা হয়নি। সিনেটর কেনেডির উদ্যোগে মার্কিন কম্পট্রোলার জেনারেল এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখেন, যদিও প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য ঘােষণা করা হয়, তার অর্ধেকও বাস্তবে প্রদান করা হয়নি এবং ২৫ মিলিয়ন ডলারের এক খাদ্য অনুদানের কাগজপত্রই সম্পাদন করা হয়নি। ডন অবশ্য আমাকে কোনাে সরাসরি উত্তর দেননি। আমার দ্বিতীয় আবেদন ছিল, এইডের খরচে যেসব বাঙালি আমেরিকায় প্রশিক্ষণে ছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে । ইতিমধ্যে সােয়েজি অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রলম্বিত করে শিক্ষার্থীদের থেকে যাবার ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত, যাতে প্রতিটি কেস এককভাবে বিবেচনা না করতে হয়। ডন এই প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে তিন মাসের জন্য প্রায় সব প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়ানাের ব্যবস্থা করেন।
হারুন রশীদের প্রত্যাবর্তনের পর আমরা আমাদের সার্কুলারের দ্বিতীয় সংখ্যা বিতরণ করি ২৬ এপ্রিল। এতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের খবর
৭২
দেওয়া হয়, কলকাতা থেকে প্রাপ্ত টাটকা খবরাখবর পরিবেশন করা হয় এবং চাঁদা আদায়ের প্রতি জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সরকারের হুকুমমতাে প্রয়ােজন মেটানাের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে হাতে রাখতে বলা হয়। এই সার্কুলারের। একাংশ উদ্ধৃত করছি : বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে অবস্থিত। মুজিবনগর কিন্তু একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নয়। বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা যেখানে সমবেত হয়, সেখানেই হয় তখনকার মুজিবনগর। এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী মুজিবনগরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে না দিতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত না বিমান হামলা প্রতিহত করার ক্ষমতা হয়, তত দিন ভ্রাম্যমাণ মুজিবনগরই হলাে সরকারের সদর দপ্তর।
১ জুন আমাদের সর্বশেষ সার্কুলার প্রচারিত হয়। ইতিমধ্যে খবর সরবরাহ ও যােগাযােগ অব্যাহত রাখার দায়িত্ব নিউইয়র্ক ও শিকাগাে লিগ নিয়ে নিয়েছে। ১ জুনের সার্কুলারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের অনেক খবর দেওয়া হয় আর এর। প্রধান সূত্র ছিল পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পাক্ষিক গােপনীয় প্রতিবেদন। মােহাম্মদ সােলায়মান যত দিন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূতের দপ্তরে কাজ করেন, তত দিন নিয়মিতভাবে এই প্রতিবেদনের নকল তিনি আমাকে দিতেন। এই প্রতিবেদনে বস্তুতই সত্য কথা লিপিবদ্ধ হতাে এবং পরে শুনেছি যে এর জন্য কৃতিত্ব ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রসচিব মনসুর কাজিমের। মনসুর কাজিমের মূল বাড়ি বােধ হয় মাদ্রাজে ছিল, তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন ১৯৫৫ সালে এবং জীবনের প্রথম কয় বছর পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি করেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ কর্মকর্তা, মিথ্যাচার তার ধাতে ছিল না।
এপ্রিলের ৬ তারিখ ঢাকা থেকে মার্কিন অধিবাসীদের বৃহদংশকে অপসারণ করা হয়, তারা কিছুদিনের মধ্যেই তাদের দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তারা প্রায় সবাই বাংলাদেশের দূত হিসেবে ভূমিকা নেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেন সিআরএলের জন ও কর্নেলিয়া (ক্যান্ডি) রােডি । ওহাইওর সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি ছিলেন ক্যান্ডির প্রতিনিধি। এ ছাড়া সিনেটরের ছেলে ছিলেন জনের সহপাঠী । জন সিনেটরকে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন এবং পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন নমনীয়তায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সিনেটর ২৯ এপ্রিল। এ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা দেন এবং জনের চিঠি কংগ্রেশনাল রেকর্ডে নিবিষ্ট করেন। সিনেটর স্যাক্সবি সারা বছর ছিলেন আমাদের একান্ত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। অধ্যাপক রেহমান সােবহান যখন ওয়াশিংটনে পৌছান, সিনেটর স্যাক্সবি তাকে সিনেটরদের কাছে বাংলাদেশের কথা তুলে ধরার সুযােগ করে। দেন। পরবর্তীকালে তিনিই সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চের সঙ্গে একযােগে পাকিস্তানে মার্কিন অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের জন্য ফরেন এইড বিলের
৭৩
সংশােধনী উত্থাপন করেন। স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী বিল উত্থাপিত হয় ৮ জুন এবং পাস হয় ১০ নভেম্বর। কর্নেলিয়া রােডি এপ্রিলেই ওয়াশিংটনে এসে বাসা বাঁধেন। বেথেসডায় তিনি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথে তাঁর স্বামীর এক সতীর্থ গবেষক ডাক্তারের বাড়িতে আস্তানা গাড়েন এবং ইতিমধ্যে আন্দোলিত সিআরএল গােষ্ঠীকে সংগঠিত করেন।
বােস্টনে ডেভিড ন্যালিন আর আনার সঙ্গে যােগ দেন লিনকন আর মার্টি চেন। সিআরএল গােষ্ঠী ছিল প্রভাবশালী দল এবং বাংলাদেশের জন্য তারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁরাই ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন করেন। জন ও কর্নেলিয়া রােডি ১৯৭১ সালে স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী পেশ হওয়ার পর ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে কাজ করেন, তাঁরা দুজনই জনহিতে নিবেদিত কর্মী। জনস্বাস্থ্য রক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন আর কর্নেলিয়া শিক্ষা, বিশেষ করে শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করেন। অনুন্নত দেশই তাদের কর্তব্যস্থল। তাঁরা হাইতি ও ইন্দোনেশিয়ায় কাজ করে প্রায় আট বছর ভারতে ছিলেন। জন হাইতিতে ১৯৯৬ সালে ইউনিসেফের প্রতিনিধি ছিলেন। কর্নেলিয়া শিক্ষাবিষয়ক নানা কাজে লিপ্ত থাকেন এবং আমাদের ব্র্যাকের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে উপদেষ্টার কাজ করেন সত্তরের দশকের প্রথম দিকে বেশ কয়েক মাস।
অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যানের কথা প্রথম অধ্যায়ে বলেছি। সম্ভবত মহীউদ্দীন আলমগীরের প্ররােচনায় তিনি আরেকটি বিশেষ উদ্যোগ নেন এপ্রিল মাসের সূচনায়। ২৯ জন বুদ্ধিজীবী ১২ ও ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটন পােস্ট-এ একটি বড় বিজ্ঞাপন ছাপান। এটি ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে একটি আবেদন। সংক্ষিপ্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে ব্যক্ত এই আপিলে তারা রক্তপাত ও ধ্বংসের পথ পরিহার করে সমঝােতা করার আহ্বান জানান। এসব বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানকে ভালাে জানতেন এবং পাকিস্তানের উন্নয়ন সব সময়ই কামনা করতেন। তাদের আপিলের একটি কথা ছিল, আমরা বিশ্বাস করি, যেকোনাে সরকার শুধু অস্ত্রের জোরে তাদের ইচ্ছা জনগণের ওপর চাপাতে পারে না। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের জনতা যখন একবাক্যে তাদের আশা ব্যক্ত করেছে এবং তাদের আশা অত্যন্ত যুক্তিসম্পন্ন। এই ২৯ জন দস্তখতকারীর মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক এডওয়ার্ড মেসন, জন মেলর, গুস্তাভ ও হান্না পাপানেক, পিটার রােজার, এডওয়ার্ড ডিমক জুনিয়র, ওয়াল্টার ফালকন, রিচার্ড গেবল, ফ্র্যাঙ্ক চাইল্ড, জন টমাস, ওয়েন উইলকক্স, স্টিফেন লুইস জুনিয়র, পল ক্লার্ক, এডউইন ক্লার্ক (দ্বিতীয়), লেডি জ্যাকসন (বারবারা ওয়ার্ড) ও অন্যরা। রবার্ট ডর্ফম্যান সারা বছর ধরে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে যান। তিনি গালাগার শুনানিতে বক্তব্য দেন, খবরের কাগজে চিঠি লেখেন। আবার শেষের দিকে আলমগীর মুহিউদ্দিনের দেড়সালা পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নেও একজন খুঁটি হিসেবে
৭৪
কাজ করেন। একই সঙ্গে অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকের কৃষি ও পানিবিষয়ক গবেষণায়ও তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত নয় খণ্ডের এই প্রতিবেদন সম্বন্ধে তৃতীয় অধ্যায়ে আরও বলেছি। এই গবেষণায় বাংলাদেশের কতিপয় সরকারি কর্মচারী ও গবেষকও নিয়ােজিত ছিলেন। যথা প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম, প্রকৌশলী এম আর ভূঁইয়া ও অর্থনীতিবিদ মতিলাল পাল। তাঁরা সবাই অধ্যাপক ডর্ফম্যানের ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করতেন।
কথাটি যখন এসে গেল, তখন এই দেড়সালা পুনর্গঠন কার্যক্রমের কাহিনি এখানেই বিবৃত করি। সেপ্টেম্বর মাসে মুজিবনগর সরকার একটি পরিকল্পনা বাের্ড গঠন করে। এর সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী আর সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক মােশররফ হােসেন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং ড. স্বদেশ রঞ্জন বােস। এই বাের্ড গঠনের। প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমেরিকায় ড. নূরুল ইসলাম ও হারুন। রশীদকে (তাঁদের ছদ্মনাম ছিল নির্মল সেন ও মুরাদ) এই পরিকল্পনা বাের্ডে যােগ দিতে আহ্বান জানান। হারুনকে বােধ হয় বাের্ডের সদস্যসচিব বানানাের প্রস্তাব ছিল। তখন একটি ধারণা ছিল যে একটি পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নের জন্য যেসব তথ্যের প্রয়ােজন, তা সম্ভবত সবচেয়ে সহজে আমেরিকায়ই পাওয়া যাবে। বিশ্ব ব্যাংক ও ইউএসএআইডিতে যত খবর পাওয়া যাবে, কলকাতায় বা বাংলাদেশের বাইরে কোনােখানে ততটা পাওয়া যাবে না। এই বিবেচনায় মনে করা হয় যে পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নের কাজ আমেরিকায় সম্পাদন করাই ভালাে। মুজিবনগর সরকার অবশ্য এই মত পােষণ করত না, তবে আমেরিকায় এ রকম একটি উদ্যোগে তাদের কোনাে আপত্তি ছিল না।
সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগেও একটি পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়ন করা হয় (Special Programme for the Economic Rehabilitation of East Pakistan, September 13, 1971)। আলমগীর মুহিউদ্দিন এই পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নের কাজ হাতে নেন। ড. নূরুল ইসলাম, হারুন রশীদ ও আমি তাতে উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করি। আমি ফেব্রুয়ারিমার্চেই ‘Economy of Bengal’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করি। তাতে আমাদের অবস্থান এবং একটি সার্বভৌম অর্থনীতির সমস্যা ও কৌশল নিয়ে আলােচনা করি। কিন্তু যুদ্ধের ধ্বংসলীলা সেই অবস্থানকে মারাত্মকভাবে বদলে দেয় এবং পুনর্গঠন কার্যক্রমে বিষয়টি বিবেচনা করার প্রয়ােজন পড়ে। ধ্বংসলীলার বিবরণের জন্য বিশ্ব ব্যাংক ও ইউএসএআইডি ছিল একমাত্র নির্ভরযােগ্য সূত্র। বিশ্ব ব্যাংকের জুন মাসের মিশন একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। ইউএসএইড নানা বিষয়ে অনবরত নানা প্রতিবেদন প্রস্তুত করতেই থাকে।
৭৫
পাকিস্তানের সরকারি কার্যক্রমেও ক্ষয়ক্ষতি ও পুনর্গঠনের এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের কৃষি ও পানিবিষয়ক গবেষণার জন্য অনেক কাজ প্রায় দুই বছর ধরে চলছিল। পুনর্গঠন কার্যক্রম প্রণয়নের কাজে এসব বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাকে সমন্বিত করার দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ডর্ফম্যান। তাঁরই দপ্তরে, জনসংখ্যা সমীক্ষা কেন্দ্রে, আলমগীর ও অন্য বাঙালিরা এই কাজ করেন।
বিশ্ব ব্যাংক আর ইউএসএইড থেকে তথ্য ও প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়। বিশ্ব ব্যাংকের রবার্ট সেডােভের বিশেষ প্রকল্প বিভাগের লােকজন এ কাজে সাহায্য করেন। এ কাজ পরিকল্পনা পর্যায়ে ছিল কয়েক মাস, তবে কার্যক্রম প্রণয়নের প্রকৃত কাজ বােধ হয় সম্পন্ন হয় নভেম্বর ও ডিসেম্বরে। ১৭ ডিসেম্বর যুদ্ধ বিজয়ের পর আমি হার্ভার্ডে যাই আলমগীরের আহ্বানে। সেদিন রাতে কার্যক্রম চূড়ান্ত করে। আমরা কয়েকজন (বােধ হয় মতিলাল, ভূঁইয়া, আলমগীর ও আমি) নিউ হেভেনের পথে রওনা হই। ফজরের আগে। সেখানে ড. নূরুল ইসলামের কাছে কার্যক্রমের কয়েকটি খসড়া দিয়ে আমাদের পুনর্গঠন পরিকল্পনা উদ্যোগের সমাপ্তি হয়। ড. ইসলামকে আমরা ১৮ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের পথে বিদায় জানাই। এই কার্যক্রম ছিল একটি জরুরি কার্যক্রম আর এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক পুনর্বাসন এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান। এই কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের প্রয়ােজন সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার হিসাব করা হয়। ড. ইসলাম ডিসেম্বরে ঢাকায় যান অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য, ফিরে গিয়ে তিনি বিশ্ব ব্যাংকে একজন পরিচালক (Director Policy Study) হিসেবে যােগ দেবেন। তবে বাস্তবে তিনি ঢাকায় থেকে যান এবং পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে তার ডেপুটি চেয়ারম্যান হন। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি যখন এই পুনর্গঠন কার্যক্রমের খবর নিলাম, তখন শুনলাম যে বাংলাদেশের প্রয়ােজন পাঁচসালা পরিকল্পনার, সেখানে পুনর্গঠন কার্যক্রমের স্থান হলাে আবর্জনার স্তুপে। বিভিন্ন অবস্থানে থাকলে অগ্রাধিকারের বিচার এভাবে ভিন্ন মাত্রায় হয়ে থাকে। নমনীয়তা ও খাপ খাইয়ে নেওয়া নিশ্চয়ই মহৎ, তবে কখন তা সুবিধাবাদিতার চরিত্র গ্রহণ করে—সে বিষয়ে সজাগ থাকা বাঞ্ছনীয়।
এপ্রিলের ১৬ তারিখ ওয়াশিংটনে মার্কিন পদার্থবিদ্যা সমিতির কোনাে সভা ছিল। এই উপলক্ষে দুজন বাঙালি বন্ধু ওয়াশিংটনে আসেন। ফজলে বারী মালিক তখন ব্লুমিংটনে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ এবং মাহবুব আলম বােস্টনে সম্ভবত রেথিয়ন করপােরেশনে গবেষণা বিভাগে কাজ করেন। তাঁরা দুজনই আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু । ফজলে বারী আমার সহপাঠী এবং যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু দুই বছর এমএসসি পড়াশােনা করেন, তবু খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন। তিনি জার্মানিতে গিয়ে পিএইচডি করেন, তারপর।
৭৬
কিছুদিন পাকিস্তান আণবিক কমিশনে চাকরি করে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেন। সেখানে তিনি খুব নামকরা অধ্যাপক হন। সেই সময় কার্বনডেলে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। আমেরিকায় আমার প্রায় দেড় বছরে তাঁর সঙ্গে বিশেষ যােগাযােগ হয়নি এবং ব্লুমিংটনে যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। মাহবুব আলম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমসাময়িক, অনেক দিন ধরে বােস্টনে আছেন। পড়াশােনা শেষ করে ওখানেই তিনি থেকে যান। ১৯৬৩ সালে আমরা যখন হার্ভার্ডে, তখন। তার সঙ্গে আবার যােগাযােগ হয়। সে সময় তিনি অতি উত্তম পাচক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন এবং বােস্টনের সীমিত বাঙালি মহলে তিনি সবার ‘মুশকিল আসান। তার পুরােনাে একটি প্লিমাউথ গাড়ি দিয়ে তিনি সবাইকে লিফট দেন, বিপদে-আপদে দেখাশােনা করেন, ঘরবাড়ি খুঁজে পেতে সাহায্য করেন। সবাই তাকে বড় ভাই’ ডাকে, এমনকি তার বয়ােজ্যেষ্ঠরাও তাকে এই নামে ডাকেন। তার সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ হয়েছে, এর বেশি দেখাসাক্ষাৎ আর হয়নি। তবে ২৯ তারিখ র্যালিতে সম্ভবত তিনি এসেছিলেন।
ড. আলম পরবর্তী সময়ে আর্থার ডি লিটল কোম্পানিতে যােগ দেন এবং হঠাৎ অকালে দেহত্যাগ করেন। তারা দুজন ওয়াশিংটনে কনফারেন্স করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য প্রচারকার্যে ব্রতী হন। তারা কংগ্রেসে লবি করতে যান, ওয়াশিংটনের বাঙালিদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেন, ফজলে বারী তাঁর সম্মেলন শেষে কদিন আমার সঙ্গে থাকেন এবং কংগ্রেসে জোর তদবির করেন। কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গালাগারের দপ্তরে তাঁর প্রধান উপদেষ্টা চার্লস উইটারের সঙ্গে ফজলে বারীর বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। সে সময় কংগ্রেসে পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য বন্ধের জন্য কেস মন্ডেইল প্রস্তাব পেশ হয়েছে। কংগ্রেসের লবিতে ঘুরে ফজলে বারীর মনে হলাে যে এই প্রস্তাবে কাজ হবে না। সত্যি সত্যি মার্কিন সাহায্য বন্ধ করতে হলে ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইনের সংশােধনী দরকার । ফজলে বারী ও মাহবুব পরে অনেকবার ওয়াশিংটনে আসেন কংগ্রেসে তদবির করার জন্য। জুন মাসে কংগ্রেসের দুই পরিষদে পাকিস্তানে সব রকম সাহায্য বন্ধের জন্য সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করা হয়। এর পক্ষে লবি একেবারে নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
তাঁরা দুজনই বাঙালিদের সংগঠনে মূল্যবান অবদান রাখেন। মাহবুব মুজিবনগরে যােগাযােগ যন্ত্রপাতি প্রেরণে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন (এই । অধ্যায়েই বিবৃত)। বােস্টনের সক্রিয় বাংলাদেশ সমিতিতেও তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। ফজলে বারী মিডওয়েস্ট বাংলাদেশ সমিতি গঠনে উদ্যোগ নেন। ইন্ডিয়ানায় অধ্যয়নরত অনেক বাঙালিকে সংগঠিত করেন এবং তাঁদের ভাতা পাকিস্তান বন্ধ করে দিলে বা তাদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাদের সাহায্য করেন। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ফজলে বারী একটি বিশেষ সাহায্য
৭৭
করেন। তাঁর উকিল বন্ধু বার্নার্ড বিয়ারম্যানের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। যে ব্যক্তি বিনা খরচে আমেরিকায় আমার রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। বার্নির বুদ্ধি ও প্রশিক্ষণ পরবর্তীকালে আমাকে আমার এবং সহকর্মীদের আশ্রয় প্রার্থনার উপদেষ্টায় রূপান্তরিত করে।
১ এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট বাংলাদেশে ত্রাণকাজে সহায়তার হাত প্রসারিত করেন। তিনি ২২ এপ্রিল এক চিঠিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে এ কথা স্মরণ করান এবং তাঁকে মানবিক কারণে এদিকে মনােনিবেশ করতে আহ্বান। জানান। জেনারেল ইয়াহিয়া এই আবেদনে কোনাে সাড়া দিলেন না, বরং জানালেন যে আপাতত বাইরের সাহায্যের প্রয়ােজন নেই; অবস্থা বিবেচনা করে পরবর্তী সময়ে কার্যক্রম স্থির করা হবে। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পাকিস্তানপ্রীতি তখন চারদিক থেকে আক্রান্ত হতে থাকল এবং সংবাদমাধ্যম পাকিস্তানি বর্বরতার চেহারা উদ্ঘাটন করতে থাকলে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিতে চাপ দিতে থাকে। জেনারেল ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মির্জা মােজাফফর আহমদ যখন মে মাসে ওয়াশিংটনে এলেন, তখন এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও সেক্রেটারি রজার্স তাঁকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে বলেন। আহমদ দেশে প্রত্যাবর্তনের আগে উথান্টের সঙ্গেও দেখা করেন। অবশেষে ২২ মে পাকিস্তান জাতিসংঘকে ত্রাণকাজ হাতে নিতে বলল।
জুন মাসেই জাতিসংঘের মিশন স্থাপিত হলাে এবং ১৬ জুন মহাসচিব সাহায্যের জন্য আবেদন করলেন। পাকিস্তান সাহায্যের জন্য যে ফর্দ তৈরি করে, তাতে তাদের কুমতলব প্রকাশ পায়। এই ফর্দটি দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়, রাষ্ট্রদূত হিলালির স্টাফ আবু সােলায়মান এর একটি কপি আমাকে সরবরাহ করেন। খাদ্য, জাহাজ, ট্রাক ও টেলিযােগাযােগ যন্ত্র—এই ছিল সে ফর্দে। কোনাে ওষুধ, কাপড়, আশ্রয়ের জন্য তাঁবু বা নির্মাণসামগ্রীর যেন প্রয়ােজন নেই। তবে কয়েদির গাড়িও চাওয়া হয়। যেসব জিনিস সামরিক ব্যবহারের উপযুক্ত, শুধু তাই চাওয়া হয়েছে। পাকিস্তান কখনাে চায়নি যে বাঙালিদের দুর্দশা লাঘব হােক। বস্তুতপক্ষে যুদ্ধের নয় মাসে ত্রাণকার্য কখনাে জোরেশােরে চলেনি। ত্রাণদ্রব্য সরবরাহ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল জাতিসংঘের । তার জন্য জাতিসংঘের তরফ থেকে মনিটরদের পাঠানাের ব্যবস্থা হয়, কিন্তু এ বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর হয় মাত্র ১৬ নভেম্বর আর তা-ও মার্কিন চাপে। মার্কিন সাহায্যে পূর্তকর্ম হাতে নেওয়া হয় কিন্তু দেখা যায় যে পূর্তকর্মের নামে সামরিক বাংকার অথবা যুদ্ধবহরের জন্য রাস্তা মজবুত করা হচ্ছে। পরিশেষে ইউএসএইড এই সাহায্যও বন্ধ করে দেয়। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এ ধরনের বর্বরদের সঙ্গে আমরা ২৩ বছর ঘর করেছি।
৭৮
সম্ভবত এপ্রিল মাসেই বােস্টন থেকে টেলিফোন করল রেজাউল হাসান ফিরােজ। প্রথমে পরিচয়পর্ব সেরে বলল যে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য তার একটি প্রস্তাব বিবেচনা করতে হবে। তবে বিষয়টি খুবই গােপনীয়। মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ লেগে গেছে, তার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি ছিল বলে মনে হয় না। যুদ্ধে টেলিযােগাযােগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মনে হয় মুক্তিবাহিনীর উপযুক্ত সরঞ্জাম নেই। এ ব্যাপারে সে সাহায্য করতে পারবে। সে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনােলজির ছাত্র (তখন বােধ হয় গবেষক ও টিউটর) এবং ইলেকট্রনিকস তার বিচরণভূমি। সে সহজেই মালপত্র জোগাড় করতে পারবে। এগুলাে মুজিবনগরে পাঠানাের ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। দু-এক দিনের মধ্যে ওয়াশিংটনে এসে এ বিষয়ে সে বিশদ আলােচনা করবে এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য নির্ঘণ্ট বেঁধে দেবে। এ কাজে দেরি করা চলবে না।
ফিরােজ বর্তমানে দেশে সম্ভবত ইলেকট্রনিকস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তবে লক্ষ্মী তার প্রতি সুপ্রসন্ন হয়নি বলেই মনে হয়। একসময়ের ঢাকার বিখ্যাত কোর্ট ইন্সপেক্টর কাজী জহুরুল হকের পুত্র ফিরােজ। কুমিল্লায় ১৯৫৭ সালে আমি যখন শিক্ষানবিশ হাকিম ছিলাম, তখন হক সাহেব সেখানে পুলিশ দপ্তরে কাজ করতেন। তবে তাঁর সুখ্যাতি হয় ঢাকায়, যেখানে তিনি এর আগে ও পরে অনেক দিন নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৬৩ সালে আমরা যখন হার্ভার্ডে, তখন তার এক ছেলে জাহেদ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তুকলায় পড়াশােনা করতে যায়। জাহেদ আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল এবং হার্ভার্ড থেকে আমরা ফিরলে পুনরায় জহুরুল হকের সঙ্গে যােগাযােগ হয় (জাহেদ বর্তমানে কাজী ফার্মের মালিক এবং বাংলাদেশ পােলট্রিশিল্পের একজন দিকপাল)। ফিরােজের সঙ্গে পরিচয়ও তখনই। ফিরােজ যে আমেরিকায় গেছে, তা জানতাম না। কথাবার্তায় মনে হলাে, ফিরােজ কী করতে চায় এবং কী করতে পারবে, তা খুব ভালােভাবেই জানে এবং তার পরিকল্পনায় ফাঁকিজুকি নেই।
ওয়াশিংটনে ফিরােজ বােধ হয় মে মাসের শুরুতে এল তার পরিকল্পনা নিয়ে আলােচনা করতে। ইতিমধ্যে হারুন রশীদ মুজিবনগর থেকে ফিরে এসেছেন। তার কাছে শুনেছি যে যুদ্ধক্ষেত্রে সমন্বয়ের বড় অভাব। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রসম্ভার বা অন্যান্য রসদ নিতান্তই অপর্যাপ্ত। তাদের টেলিযােগাযােগের আশু প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। বরং এর জন্য তাদের চাহিদা খুবই জরুরি। ফিরােজের প্রথম কথা হলাে, বিষয়টি অত্যন্ত গােপনীয় এবং বাঙালি সমাজের কাছেও তা গােপন রাখতে হবে। বিশেষ করে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে কোনাে আলাপ চলবে না। বােস্টনে তার সহযােগী খুব নির্দিষ্ট, শুধু তৈয়ব মাহতাব আর ড. মাহবুব আলম। তৈয়ব মাহতাব বহুদিন ধরে বােস্টনের অধিবাসী। ১৯৫৮
৭৯
সালে তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যােগ দেন। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর পরই চাকরি ছেড়ে দেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় লাহােরে, যেখানে তিনি সম্ভবত ফোরমান ক্রিশ্চিয়ান কলেজে একজন তুখােড় ছাত্র ছিলেন। পরে ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে পদায়িত থাকাকালে তার সঙ্গে আমার যােগাযােগ হয়। সেখানে কাজ নিয়েও তার মনে খেদ ছিল যে তাতে কোনাে চ্যালেঞ্জ নেই।
তিনি পরবর্তীকালে ক্যালিফোর্নিয়ায় সানডিয়াগােতে ছােটখাটো ব্যবসা করেন। মাহবুবের কথা আগে বলেছি। ফিরােজ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করবে তার শিক্ষক অধ্যাপক রবার্ট রাইনের সৌজন্যে। ড. রাইন পেন্টাগনের জন্য মাঝেমধ্যে কাজ করেন। তাঁদের উদ্বৃত্ত মালের গুদাম থেকে পানির দরে তিনি প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি জোগাড় করবেন। সেগুলােকে দুরস্ত করে বাক্সবন্দী করে ফিরােজ আমার হাতে সঁপে দেবে। ওয়াশিংটনে এসব যন্ত্রপাতি আমাকে গ্রহণ করতে হবে এবং এগুলােকে কূটনৈতিক চ্যানেলে পার করতে হবে। সাধারণত এসব মালপত্র রপ্তানি করতে সরকারি নিকাশপত্র লাগে। কিন্তু এগুলােকে সাইক্লোন-সংকেত যন্ত্রপাতি হিসেবে বিনা নিকাশপত্রে মুজিবনগরে পাঠাতে হবে। সে ব্যবস্থা সম্ভব শুধু ভারতীয় সরবরাহ মিশনের সহায়তায় এবং আমাকে সে জন্য সব ব্যবস্থা করতে হবে। ফিরােজের তৃতীয় প্রস্তাব ছিল যে এগুলাের জন্য কিছু পয়সা লাগবে, যা সে চাদা হিসেবে মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠিত বাঙালির কাছ থেকে আদায় করবে। তার জন্য সে একটি ফর্দও বানিয়েছে। আমাকে এ ব্যাপারে তিনটি কাজ করতে হবে। সে শিকাগাের বিখ্যাত বাস্তুকলাবিদ ফজলুর রহমান খানের সঙ্গে যােগাযােগ করবে। তবে আমাকে এ মর্মে তাঁকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে এতে কোনাে জালিয়াতি নেই।
ফজলুর রহমান খান ফরিদপুরের প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আবদুর রহমান খানের পুত্র এবং স্কিডমাের, ওয়িংস ও মেরিল কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার ছিলেন। উঁচু দালান নির্মাণের কৌশল আবিষ্কার করে তিনি বিশ্ববিখ্যাত হন এবং ছয় বছর আমেরিকায় বছরের সেরা বাস্তুকলাবিদ হিসেবে স্বীকৃতি পান। অতি অল্প বয়সে ১৯৮২ সালে এই প্রতিভাবান প্রকৌশলী ইহধাম ত্যাগ করেন। ফজলুর রহমান খান শুধু ফিরােজের উদ্যোগেই সাহায্য করেননি, তিনি ১৯৭১ সালে বাঙালি ও আমেরিকানদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করতে মূল্যবান অবদান রাখেন। জুন মাসে তিনি আমেরিকায় বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগ স্থাপন করেন এবং যুদ্ধবিজয়ের পর বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। নিউ মেক্সিকো না অ্যারিজোনায় আরেকজন বাঙালি ইরতেজা হােসেনের সঙ্গে যােগাযােগ করা হয় আমার দ্বিতীয় কাজ। ইরতেজা হােসেন আমাদের উদ্যোগের ব্যাপারে কোনাে উৎসাহ প্রকাশ করলেন না। আমার তৃতীয় কাজ হয় গােপনীয়তা ভেঙে বাঙালি সমিতিগুলাের দু-একটির কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ।
৮০
লস অ্যাঞ্জেলেসের শামসুদ্দোহা এবং মিড ওয়েস্টের ফজলে বারী মালিকের কাছে চেয়ে আমি এ দুই সমিতি থেকে কিছু সাহায্য আদায় করতে সক্ষম হই। ফিরােজ অবশ্য বােস্টনের ডা. রেজাউর রহমান, মানিটোবা সমিতি, নিউ ইংল্যান্ড সমিতি ও নিউইয়র্ক সমিতি থেকে সাহায্য সংগ্রহ করে। ফিরােজের পরিকল্পনার চতুর্থ ও শেষ বিষয় ছিল মুজিবনগরে এই যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। তৈয়ব মাহতাব সারা জুন মাস ডা. লিওনার্ড কাটজের ল্যাবরেটরিতে এগুলাের ব্যবহার শেখেন এবং জুলাইয়ে মুজিবনগরে হাজির হন। সেখানে তিনিই হন প্রশিক্ষক। পরবর্তী সময়ে আগস্টে ওহাইওর অধ্যাপক আমিনুল ইসলামও ফিরােজের চাপে নিজে কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে মুজিবনগরে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দেন। অধ্যাপক ইসলাম ঢাকায় আমার সমসাময়িক ছাত্র ছিলেন এবং বহুদিন ধরে আমেরিকায় ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি কংগ্রেসে তদবির করার জন্য। কয়েকবার ওয়াশিংটনে আসেন। ওহাইওর ডেটনে তিনি বাংলাদেশ লিগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার সভাপতি ছিলেন।
ফিরােজ ১০০টি ওয়াকিটকি, ৮টি শর্টওয়েভ রেডিও ট্রান্সমিটার ও রিসিভার এবং প্রয়ােজনীয় ব্যাটারি জোগাড় করে। আমি হিসাব করে দেখেছি যে এগুলাের দাম ছিল লাখখানেক ডলার, তবে ফিরােজ এর জন্য মাত্র ২০ হাজার ডলারের মতাে ব্যয় করে। এগুলােকে ২৫টি বাক্সে বন্দী করে ফিরােজ বিমানে আমার । কাছে ওয়াশিংটনে পাঠায় তিন দিনে (১১, ১৩ ও ১৮ জুন)। আমরা তিনজন—হারুন, রাজ্জাক খান (তার সম্বন্ধে পরে বলেছি) এবং আমি একটি। মার্সিডিস, একটি বুইক ও একটি ভক্সওয়াগনে করে এগুলােকে ভারতীয় সরবরাহ মিশনে রাতের অন্ধকারে পৌছে দিই। এই মিশনের ভারপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ—সাপ্লাই মিনিস্টার সুশীতল ব্যানার্জির সৌজন্যে এই চার টন যন্ত্রপাতি মুজিবনগরে পৌছায়। জুলাইয়ের ২ তারিখেই বােধ হয় তৈয়ব মাহতাব। মুজিবনগরে প্রশিক্ষণ দিতে হাজির হন। এ কাজ করে আমাদের খুব তৃপ্তি হয়। এতে আমার মনে হলাে যেন আমরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলাম। অনেক ভেবেচিন্তেও কিন্তু আর কোনাে যন্ত্রপাতি আমরা মুজিবনগরে পাঠাতে সক্ষম হইনি । নিউইয়র্ক থেকে একসময় একটি শক্তিশালী রেডিও ট্রান্সমিটার পাঠায়। নানা জায়গা থেকে কাপড়, তাঁবু ইত্যাদি পাঠানাে হয়। জেনারেল ওসমানী একবার অনেক সমরাস্ত্রের একটি ফর্দ পাঠান কিন্তু সেগুলাে কখনাে সংগ্রহ করা যায়নি, পাঠানাে তাে দূরের কথা। অনেক অস্ত্র ব্যবসায়ী অনেক প্রস্তাব নিয়ে এসেছে কিন্তু কিছুই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
৮১
পঞ্চম অধ্যায়
মনােযাতনার এক মাস : মে ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম মাস কী রকম এক ব্যস্ততা, উত্তেজনা ও ক্ষোভের মধ্যে পেরিয়ে গেল। অনিশ্চয়তা থাকলেও তা নিয়ে হাহুতাশ করার সুযােগ ছিল না। আশঙ্কার প্রথম ইঙ্গিত জ্যাকের (লন্ডনবাসী জাকারিয়া খান চৌধুরী) সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে মিলল। একটি সংগঠিত ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীকে বর্শা-বল্লমলাঠিসোটা নিয়ে প্রতিহত করা যে কত দুরূহ, তা প্রমাণ হতে মাসখানেক অতিবাহিত হয়ে গেল। এপ্রিল মাসের শেষে আস্তে আস্তে সারা বাংলাদেশের শহরাঞ্চল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাতে চলে গেল। রংপুর আর নােয়াখালীতে প্রায় শেষ হলাে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম রাউন্ড। শুধু কয়েকটি সীমান্ত এলাকা ছাড়া সারা বাংলাদেশ প্রায় পাকিস্তানিদের কর্তৃত্বে চলে গেল । রূঢ় বাস্তব আমাদের মাসখানেকের একধরনের ‘ট্রান্স’-এ যবনিকা টানল। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমেও বাংলাদেশের খবর বেশ কমে এল। মার্চ থেকেই অন্তত মার্কিন মহাদেশে সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর যত খবর বেরােত, সংগ্রহের কাজ আমি শুরু করি।
এখন যখন এই সংগ্রহের আলমারি খুলি, তখন অতি সহজে যা ধরা পড়ে, তা হলাে যে মে মাসের সংগ্রহ সবচেয়ে ক্ষীণকায়। ২১ এপ্রিল ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল পত্রিকায় সাংবাদিক পিটার কান মেহেরপুর থেকে খবর পাঠালেন, বহু বছর ধরে যদিও এ রকম একটি যুদ্ধের আশঙ্কা তারা বিবেচনা করেছেন, বাঙালিরা আশ্চর্যজনকভাবে এ যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলেন। তাঁর প্রতিবেদনের শিরােনাম ছিল একটি টিমটিমে আন্দোলন’ (A Flickering Cause)। তিনি প্রশ্ন করেন যে বাংলাদেশে বােধ হয় অত্যন্ত বেশিসংখ্যক প্যাট্রিক হেনরি রয়েছেন। প্যাট্রিক হেনরি ছিলেন মার্কিন স্বাধীনতা আন্দোলনে ভার্জিনিয়ার সুপ্রসিদ্ধ আইনবিদ ও জননেতা। প্যাট্রিক হেনরি ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের স্ট্যাম্প
৮২
আইনের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন করে নাম করেন এবং ১৭৭৬ সালে মার্কিন স্বাধীনতা ঘােষণার একজন প্রধান হােতা ছিলেন। পিটার কান আরও লেখেন যে বাকপটু বাঙালি রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা অথবা পেশাজীবী—সবাই আমরণ যুদ্ধের কথা বলেন, কিন্তু বস্তুতপক্ষে তারা তা করেন না। তাই তিনি এক হিসেবে সিদ্ধান্তই দিয়ে দেন যে বাঙালিরা একটি অতি দুর্বল স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করে কিন্তু ইতিহাসে এটি বােধ হয় সবচেয়ে স্বল্প সময়ের বৈপ্লবিক যুদ্ধ। আমাদের ক্ষোভ শুধু বাড়তেই থাকে। এত বড় হত্যাযজ্ঞের পর কী করে আমরা ব্যর্থ হতে পারি!
প্রবাসী পাকিস্তানিদের ব্যবহারেও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এত দিন তারা তাদের সামরিক বাহিনীর বর্বরতা নিয়ে কাঁচুমাচু করত, আমাদের সরাসরি আক্রমণ করতে ইতস্তত করত। এখন সে ভাব চলে গেল—অনেক হয়েছে, এখন ব্যস! পাকিস্তানি বন্ধুমহল এখন আর সহানুভূতি প্রদর্শনে এগিয়ে আসে না, বরং বিশ্বাসঘাতক, জাতির শত্রু ও দেশদ্রোহীদের চিহ্নিত করতে ব্যস্ত থাকে। পাকিস্তানে সামরিক জান্তা এতই নিশ্চিত হয় যে তারা ৬ মে বিদেশি। সাংবাদিকদের সরেজমিনে বাংলাদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আহ্বান করে বসল । একই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যােগাযােগও পুনঃস্থাপন করা। হলাে। আমার আব্বা ২৫ মার্চে আমাকে একখানি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সেটা এসে। পৌছাল ১৭ মে। তারপর দেশ-বিদেশ থেকে পাঠানাে চিঠি আসতে শুরু করল। পাকিস্তানি বর্বরতার লােমহর্ষক সব কাহিনি বিবৃত করে। যুদ্ধকালে মানুষের দুর্গতি ও দুর্দশার হৃদয়বিদারক কাহিনি পৌছাতে লাগল। আমি এ রকম দুটো ব্যক্তিগত চিঠি পাই। আমার বােন ডা. শাহলা খাতুন ছুটি নিয়ে গিয়েছিল সিলেটে তার দুটি সদ্য পিতৃহারা বাচ্চাকে নিয়ে। তারা কেমন করে বাড়িভরা মানুষজনসহ কামান আর বােমাবর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পেল; কী কষ্ট করে শহর থেকে পালিয়ে গ্রামে আশ্রয় নিল; আমার বয়স্ক মা-বাবা কেমন করে হেঁটে পালাতে শুরু করলেন ইত্যাদি। মাসখানেক সবাই মিলে গ্রামে থাকলেন। তারপর বাড়ি এসে। পেলেন অর্ধবিধ্বস্ত ও লুণ্ঠিত সংসার। তাঁর সন্তানগুলাে কী কষ্টে বেঁচে আছে, আমার আব্বা কীভাবে শারীরিক ও মানসিক যাতনায় আছেন, এসব কাহিনির সঙ্গে প্রকাশ পেল আর্থিক সংকটের কথাও।
বাঙালিরা আমাদের বাড়িতে ক্যাম্প করে প্রথমে যুদ্ধ করেছে। তারপর পাকিস্তান বিমানবাহিনী বাড়ির চাল উড়িয়ে দিয়েছে, দেয়াল বিধ্বস্ত করেছে। সবশেষে মানুষ খানিকটা লুট করেছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ, রােজগারের রাস্তা নেই অথচ খরচের বহর বেড়ে গেছে। যুদ্ধের এই স্বাভাবিক প্রতিফল আমি সরাসরি টের পাইনি, শুধু চিঠিতেই উপলব্ধি করলাম । পরবর্তীকালে এ রকম আরেক চিঠি লিখেছিলেন বিচারপতি মাহমুদুর রহমান
৮৩
চৌধুরী তাঁর ভাই নুরুল আমিন চৌধুরীর কাছে। সেই চিঠি অন্য একজন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত থেকে ডাকে দেন বলে খানিকটা আগেই এসে পৌঁছায়। নুরুল আমিন চৌধুরী আমাদের কাছে তাঁর ডাকনাম হুমায়ুন নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন নিউইয়র্কের অধিবাসী। মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তাদের পিতা আবদুল গফুর সাহেব ছিলেন আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ গুরুজন। তিনি আমার আব্বার ছেলেবেলায় তার শিক্ষক ছিলেন এবং প্রায় আট বছর তার অভিভাবক ছিলেন। পুরাে পরিবারই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
হুমায়ুন টেলিফোনে আমাকে চিঠির কাহিনি শােনালেন এবং পরে চিঠির কপি পাঠিয়ে দিলেন। তাতেও পালানাের কাহিনি, আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানাে, বয়স্ক লােকদের কষ্টের কথা, বাচ্চাদের দুর্দশা আর অবুঝ আকুতি এবং সবশেষে অর্থনৈতিক দুরবস্থার বিবরণ । এ ধরনের খবরে অসাধারণ কিছু ছিল না, প্রতিটি পরিবারেই তখন এ রকম দুর্দশা দেখা দিয়েছে। দুই মাস পর পাকিস্তানের প্রচারবিদ হামিদুল হক চৌধুরীর একটি মন্তব্য এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, এমন কোনাে পরিবার নেই, যারা দুর্দশায় নিপতিত হয়নি। খুব কম পরিবারই সামরিক অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে এবং নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু প্রায় সব পরিবারেই হয়েছে। অবশ্য তবু তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তির অবতারণা করেন এবং বাংলাদেশের বিরােধিতায় অটুট থাকেন (হামিদুল হক চৌধুরীর বিষয়ে পরে বিস্তৃত আলােচনা করব)।
এপ্রিল মাসে দুটো দুঃসংবাদ পেলাম। একটি ভুল প্রমাণিত হলাে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম প্রচার করল যে আমার আব্বা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। খবরে সঠিকভাবেই তার পেশা ও পরিচিতি দিয়েছে। উকিল এবং একসময় মুসলিম লীগের নেতা। সিলেট পাকিস্তানে যােগ দেয় গণভােটের মাধ্যমে, শুধু সংসদ সদস্যদের সিদ্ধান্তে নয় । এই গণভােট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই। এই গণভােটের সময় মুসলিম লীগ নেতা হিসেবে আমার আব্বার ছিল বিরাট অবদান। মুসলিম লীগ গণভােট বাের্ডের তিনি ছিলেন সচিব এবং সভাপতি ছিলেন আবদুল মতিন চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে তিনি সিলেটের তরফ থেকে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত সীমান্ত কমিশনের শুনানিতে হাজিরা দেন। বিভাগােত্তরকালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় ১৯৫২ সালে তিনি মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে অন্য কোনাে রাজনৈতিক দলে আর যােগ দেননি। আমি খবরটি যথাসময়ে পাইনি বা দেখিনি। একদিন হঠাৎ অন্য একজনের মুখে শুনতে পাই। একই সময়ে মাহমুদ আলীর (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের ফেডারেল মন্ত্রী) বরাতে
৮৪
রাষ্ট্রদূত হিলালির কাছে খবর আসে যে সংবাদটি সঠিক নয় এবং আমার ভাই সুজন (আবু সালেহ আবদুল মুইজ) সিলেটে গিয়ে ঠিক খবর নিয়ে এসেছে যে। আমার আব্বা জীবিত আছেন।
পরে জানা গেল, হাফিজ নামের অন্য একজন উকিল সত্যি সত্যিই নিহত হন। পরে আমার মা-বাবার এপ্রিল মাসের অডিসির কাহিনিও জানলাম। আরও জানলাম যে তাঁরা যে গ্রামে (ফুলবাড়ীতে) আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানে আমার আরেক ভাই আবুল কালাম আবদুল মােমেনকে (পরবর্তীকালে বােস্টনে শিক্ষক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০০৯ সালের সরকারের আমলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের আট বছরব্যাপী স্থায়ী প্রতিনিধি) পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে এবং শেষ মুহূর্তে কোনাে সদয় কর্মকর্তার হুকুমে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়। মােমেনকে অবশ্য সরকারি চাকরির ব্যাপারে কালাে ফর্দ বা নিষিদ্ধের লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আরও জানলাম যে আমার এক মামা সৈয়দ শাহ জামালকে (তখন তিনি উচ্চশিক্ষারত এবং জামায়াতের রাজনীতি করেন) সেনাবাহিনী ২৫ তারিখেই ধরে নিয়ে যায়। আর কোনাে দিন ফেরত দেয়নি। প্রথম আঘাতে জামায়াতের লােকজনও এই বর্বর বাহিনীর হাতে রেহাই পায়নি।
এপ্রিল মাসে আরেকটি দুঃসংবাদ এল ইসলামাবাদ থেকে। বন্ধুবর ফারুক আহমদ চৌধুরী (পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্রসচিব ও লেখক) খবর পাঠালেন। যে দুর্ঘটনা তাঁদের পরিবারকে দ্বিতীয়বারের মতাে আঘাত করেছে। তাঁর ছােট বােন নাসিমের স্বামী কর্নেল সৈয়দ আবদুল হাই যশাের সেনাছাউনিতে নিহত হয়েছেন (নাসিম এখন লন্ডনে বসবাস করে)। বার্তাটি সংক্ষিপ্ত, তবে বুঝতে অসুবিধা হলাে না যে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শিকার। খবরটি ফারুকের অন্য ভগ্নিপতি ফখরুদ্দীন আহমদকে পৌছে দিতে হবে। ফখরুদ্দীন তখন ম্যাসাচুসেটসের উইলিয়ামস কলেজে উচ্চশিক্ষারত। ড. ফখরুদ্দীন পরবর্তীকালে ওয়াশিংটনে বিশ্ব ব্যাংকে চাকরি করেন। আগে সিভিল সার্ভিসে ছিলেন এবং বহিঃসম্পদ বিভাগে (বর্তমানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) আমার একজন সুযােগ্য সহযােগী ছিলেন। ড. ফখরুদ্দীন ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন এবং তাঁরই দৃঢ়তার ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ফখরুদ্দীনের কাছে তিন-চার মাসের ব্যবধানে আমাকে দ্বিতীয়বার দুঃসংবাদ দিতে হলাে। সম্ভবত জানুয়ারির শেষে ফারুকই ইসলামাবাদ থেকে খবর পাঠান যে তাঁর সর্বকনিষ্ঠ বােন নীনা এবং তার স্বামী ফখরুদ্দীনকে জানাতে হবে যে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর পিতা গিয়াসুদ্দিন আহমদ (ঢাকার জনপ্রিয় কমিশনার হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ এবং রাজস্ব বাের্ডের সদস্য হিসেবে অবসর নেন) ইন্তেকাল
৮৫
করেছেন; তাঁর ভাই ইনাম আহমদ চৌধুরী (তখন যশােরে জেলা প্রশাসক, পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ও একসময় ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট) আহত হয়েছেন। ইনাম আহমদ চৌধুরী বর্তমানে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং তিনি মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ফারুক আরও বলেন যে তাঁর বােন, যে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে বাপের খুব আহ্লাদী ছিল, তাকে ঢাকায় পাঠানাের ব্যবস্থা করতে হবে। নীনারা ওয়াশিংটনে এল, যে কদিন আমাদের সঙ্গে ছিল, শুধুই কেঁদে সারা হলাে আর তার দুরন্ত ছেলে নাভিদ তাতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল । নীনা নাভিদকে নিয়ে সেই যে ঢাকায় গিয়েছিল, ফিরল বােধ হয় মে মাসে। সে যখন ফিরল, তখন সে খুব গম্ভীর এবং প্রায় নির্বাক এবং তার দুরন্ত ছেলেটিও কেমন শান্ত হয়ে গেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা এবং বাংলাদেশ তাদের মধ্যে নিয়ে। আসে দারুণ পরিবর্তন। নাভিদ কালে এক চমৎকার যুবক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৮৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। নাভিদের মৃত্যু ফখরুদ্দীন দম্পতির সুখী জীবনে এক গভীর কালাে মেঘের ছায়া ফেলে এবং তাঁদের হাসি মিলিয়ে দেয়। বিধাতার ইচ্ছা অনুধাবন করা বড় কঠিন।
ভারত-পাকিস্তান প্রতিবেশী দেশ। হাজার হাজার বছর ধরে একই রাজত্বের অংশ। তাদের ইতিহাস ও উত্তরাধিকার একই। দিল্লির লালকেল্লা আর লাহোের দুর্গ একই ছাঁচে গড়া। উপমহাদেশীয় রান্না প্রায় একই রকমের, অবশ্য বৈচিত্র্য অনেক। মহেঞ্জোদারাে-তক্ষশীলা-নালন্দা-হরপ্পার ঐতিহ্য সবাই দাবি করে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের শেষ অধ্যায়ে দেশ শুধু ভাগই হলাে না, বরং দেশের দুই প্রধান ধর্মাবলম্বী হিন্দু আর মুসলমান হয়ে গেল পরম শত্রু। ধারণা ছিল যে ক্ষমতার ভাগাভাগি এই মনােমালিন্যের অবসান ঘটাবে। কিন্তু তা আর হলাে না। হায়দরাবাদ, জুনাগড় আর কাশ্মীর নিয়ে শুরুতেই লাগল বিরােধ আর তার সুরাহা বাস্তবে এখনাে হয়নি। ধর্মোন্মাদনা বড় জটিল এবং সব সময়ই ধর্মের চেয়ে অন্য স্বার্থ এই জটিলতা বাড়ায়। খ্রিষ্টানমুসলমানে ক্রুসেড চলে প্রায় হাজার বছর । ক্যাথলিক আর প্রটেস্টান্টদের ঝগড়া ৬০০ বছর ধরে, এই সেদিন পর্যন্ত চলেছে আয়ারল্যান্ডে। তবে উপমহাদেশে ধর্মোন্মাদনার সঙ্গে পরাশক্তির শত্রুতার যৌথ ফসল হচ্ছে একধরনের চিরস্থায়ী মনােমালিন্য। যদি পরাশক্তির প্রতিযােগিতা ভারত ও পাকিস্তানকে দুই শিবিরে না ঠেলত, তাদের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযােগিতা না শুরু করত, তবে নিশ্চয় তারা সহাবস্থানের রাস্তা খুঁজে পেত। এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে শীতল যুদ্ধের মানসিকতা বানচাল করে দিল । যার ফলে ভারত
৮৬
পাকিস্তানের সম্পর্ক এমন তিক্ত হলাে যে বিদেশে কূটনৈতিক মহলেও এ দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে মেলামেশা ছিল ন্যূনতম ।
সরকারি কার্যোপলক্ষে ঢাকায় ষাটের দশকের শুরুতে কতিপয় ভারতীয় কূটনীতিবিদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে থাকাকালীন কালেভদ্রে যদি কোনাে ভারতীয় কূটনীতিবিদের সঙ্গে দেখা হয়ে থাকে, তা স্মরণ নেই। ওয়াশিংটনেও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত রইল। আমরা অন্যান্য দেশের কূটনীতিবিদের সঙ্গে ওঠাবসা করি কিন্তু ভারতীয়দের সঙ্গে নয়। বছরের পর বছর এই অভ্যাস বজায় রাখলে স্বভাবতই একে অন্যকে চিরশত্রু ভাবতে থাকে এবং শত্রুতার কারণ আর খুঁজতে বা বিশ্লেষণ করতে চায় না।
ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাসে তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত ঝা। তিনি ১৯৩৬ সালের আইসিএস কর্মকর্তা ছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে সচিব ছিলেন। অত্যন্ত দক্ষ কর্মকর্তা। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরও ছিলেন। শেষ বয়সে তিনি কাশ্মীরের প্রদেশপাল হন, ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টাও। তিনি উত্তর ভারতের লােক, তবে সুন্দর বাংলা বলতেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন জোড়াসাঁকোর। ঠাকুর পরিবারের একজন। ব্রিটিশ কমনওয়েলথ কূটনীতিবিদদের স্ত্রীদের একটি সক্রিয় সমিতি ছিল ওয়াশিংটনে, সেখানে আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয় শ্রীমতী ঝার। সেই সুযােগে কূটনৈতিক পার্টিতে কালেভদ্রে রাষ্ট্রদূত ঝার সঙ্গে কথা হয়েছে। মিশনের দ্বিতীয় ব্যক্তি মহারাজ কৃষ্ণন রাসগােত্রা। পরবর্তী সময়ে লন্ডনে। হাইকমিশনার এবং পররাষ্ট্রসচিব। তাঁর সঙ্গে দেড় বছরে কোনাে দিন দেখাও হয়নি। সরবরাহ মিশনের কর্তা সুশীতল ব্যানার্জি, ১৯৪৮ সালের আইএএস, অত্যন্ত ঝানু কর্মকর্তা। আমরা জানতাম যে খাদ্যশস্য, সার ইত্যাদি সংগ্রহে তিনি খুব পারদর্শী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কাশ্মীরে মুখ্য সচিব এবং সবশেষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব হন। কম বয়সে তিনি পরলােকগমন করেন। তিনি উত্তর প্রদেশের বাঙালি এবং তাঁর স্ত্রী রানু ব্যানার্জি ছিলেন অনবদ্য মেজবান ও রাধুনে (এবং অত্যন্ত সুন্দরী)। তাঁর সঙ্গেও কখনাে দেখা হয়নি।
বিশ্ব ব্যাংকে ভারতের নির্বাহী পরিচালক হয়ে আসেন ড. সমর রঞ্জন সেন । তিনি মুন্সিগঞ্জের মানুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। তার মা শ্ৰীমতী আশালতা সেন কবি ছিলেন এবং পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। গেন্ডারিয়া মহিলা। সমিতিতে তিনি খুবই সক্রিয় ছিলেন এবং তাঁর বাড়ি তিনি ওখানকার একটি মহিলা বিদ্যালয়কে দান করে যান। ড. সেন বিভাগােত্তরকালে ভারতে গিয়ে। ইউনিয়ন সরকারের চাকরি নেন এবং সেচ ও পরিকল্পনাসচিব হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশের তরফ থেকে বিশ্ব ব্যাংকে প্রথম নির্বাহী পরিচালকের।
৮৭
দায়িত্ব পালন করেন (আমি হই তাঁর প্রথম বাংলাদেশি বিকল্প পরিচালক)। ওয়াশিংটনে তার সঙ্গেও যােগাযােগ আমরা সযত্নে পরিহার করতাম।
এপ্রিলের শুরুতে হারুন ও আমি ঠিক করলাম যে এবার বেড়া অতিক্রম করতে হবে, ভারতীয়দের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে হবে। একদিন আমরা রাতে গিয়ে ড. সেনের বাড়িতে হাজির হলাম। তিনি ছিলেন ভারতীয় মিশনের সঙ্গে আমাদের যােগসূত্র । হারুনের কলকাতায় যাওয়া যখন ঠিক হলাে, তিনি তখন ভারতে তাঁর জন্য অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেন এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন যুগ্ম সচিব এ কে রায়ের কাছে একটি চিরকুট লিখে দেন। ভারতীয়দের সঙ্গে যােগাযােগ না থাকার কারণে প্রথম যেদিন ড. সেনের বাড়ি গেলাম, তখন কেমন জানি অস্বস্তি লাগে। কিছুদিন পর তেমনই যখন ভারতীয় সরবরাহ মিশনে গেলাম, তখনাে খুঁতখুঁতে ভাব বজায় ছিল। তবে আগস্টে যখন প্রথম রাষ্ট্রদূত ঝার দপ্তরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন সেই ভাব আর ছিল না। ড. সেন ঢাকায় এনায়েত করিমের শিক্ষক ছিলেন, সেই সূত্রে তিনি আমাদের সবার গুরুজনে পরিণত হন। তিনিই আমাদের সঙ্গে সুশীতল ব্যানার্জির যােগাযােগ করিয়ে দেন। টেলিকমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি মুজিবনগরে পাঠানাের জন্য মে মাসের শেষে আমরা তার কাছে ধরনা দিই এবং তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আমাদের বাধিত করেন।
একটি কাকতালীয় বিষয় ছিল সমর রঞ্জন সেন নামের মানুষের সঙ্গে ১৯৭১ সালে আমাদের যােগাযােগ। ওয়াশিংটনে ড. সেন ছিলেন আমাদের বন্ধু । নিউইয়র্কে সে সময় ভারতীয় স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন সমর রঞ্জন সেন। তিনি ছিলেন মাহমুদ আলীর একধরনের অভিভাবক এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কে এলে তিনি তাঁর খুব খাতিরযত্ন করেন। পরবর্তী সময়ে এই নামের আরেক ব্যক্তি ছিলেন বাংলাদেশে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রদূত এবং তিনি সেখানে সন্ত্রাসের শিকার হয়ে খানিকটা আহত হন, সময়টা ছিল পঁচাত্তরের নভেম্বর।
মে মাসে দুজন আগন্তুক সংবাদমাধ্যমে খানিকটা আলােড়ন সৃষ্টি করেন। পাকিস্তানের সুনাম প্রতিষ্ঠার জন্য আসেন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মির্জা মােজাফফর আহমদ। তিনি ৯ মে আসেন এবং তাঁর ছিল ব্যস্ত সময়সূচি । প্রায় একই সময় আসেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি অধ্যাপক রেহমান সােবহান এবং তিনি রাতারাতি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এম এম আহমদের সঙ্গে আসেন আমার বন্ধু এবং একসময়ের সহকর্মী সারতাজ আজিজ। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের মন্ত্রিসভায় একজন সিনিয়র মন্ত্রী। আমরা পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে ১৯৬৪-৬৬ সালে সহকর্মী ছিলাম। একই সময়ে আসেন আরেক পাকিস্তানি বন্ধু
৮৮
তারেক সিদ্দিকী। তারেক পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে সহকর্মী ছিলেন এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানে অনেক দিন চাকরি করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তারেক পাকিস্তানে ফিরে যান ১৯৭১ সালে এবং বাংলাদেশ মুক্ত হলে পাকিস্তানে বন্দী বাঙালি সরকারি কর্মচারীদের নানাভাবে সাহায্য করেন। তিনি সরকারি চাকরি অনেক দিন হলাে ছেড়ে দিয়েছেন, তবে তাঁর সঙ্গে আমার যােগাযােগ সেই উত্তাল ‘৭১-এ খতম হয়ে যায়। এম এম। আহমদ ১০ তারিখে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে দেখা করেন। সেক্রেটারি রজার্স, বিশ্ব ব্যাংকে ম্যাকনামারা এবং কারগিল, মুদ্রা তহবিলে সােয়াইটজার—সবার। কাছে তিনি তদবির করেন। কংগ্রেসে সিনেটর সাইমিংটনের এক চা-চক্রে তিনি মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য দেন। প্রেস ব্রিফিং, দেখাসাক্ষাৎ এসবও অনেক হয়।
তিনি একটি সংবাদ সম্মেলনেরও চিন্তা করেন কিন্তু সেটা আর শেষ পর্যন্ত করা হলাে না। পাকিস্তানের ভাবমূর্তি সুশ্রী করবার তার প্রচেষ্টা যে খুব ফলপ্রসূ হয়েছে, তা মনে হলাে না। তিনি অনেক উপদেশ এবং মৃদু ভর্ৎসনার সম্মুখীন। হন। তাঁকে বলা হয় যে অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য তাদের আরও সচেষ্ট হতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার জন্য তাঁকে বলা হয়। অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের প্রকল্প গ্রহণের জন্য তাঁকে পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থ সাহায্য বা ঋণ মওকুফের বিষয়ে সরেজমিনে তদন্তের জন্য বিশ্ব ব্যাংক পাকিস্তানে মিশন পাঠাতে চায়। এম এম আহমদ নিউইয়র্কে গিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গেও যােগাযােগ করেন। ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি মােটামুটিভাবে জাতিসংঘ ত্রাণ উদ্যোগে সায় দেন এবং বিশ্ব ব্যাংক ও মুদ্রা তহবিলের যৌথ মিশনকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান। তিনি সম্ভবত সপ্তাহখানেক পরই ফেরত যান। জেনারেল ইয়াহিয়া ২২ মে জাতিসংঘকে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণকাজে নিয়ােজিত হতে আহ্বান জানান এবং ব্যাংক মিশন ৩১ মে ঢাকার পথে ওয়াশিংটন ছাড়ে।
এম এম আহমদের কর্মঠ ও ভালাে কর্মকর্তা হিসেবে সুনাম ছিল। তিনি পাকিস্তানের অর্থসচিব ছিলেন এবং আমি পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে যাওয়ার। প্রাক্কালে তিনি সেখানে ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন (১৯৬৬ সাল)। তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি কাদিয়ানি মতবাদে বিশ্বাস করতেন বলে তাঁকে আশির দশকে পাকিস্তান ছাড়তে হয় এবং তখন তিনি ওয়াশিংটনে আশ্রয় নেন। জীবনের বাকি দিনগুলাে তিনি সেখানেই পার করেন। ১০ তারিখ রাতে তিনি আমাকে একান্ত আলােচনায় আহ্বান করেন, রাষ্ট্রদূত হিলালি বােধ হয় তাঁকে এই পরামর্শ দেন। আমিও তার সঙ্গে খােলামেলা আলাপ করতে চেয়েছিলাম। তিনি
৮৯
ঢাকায় সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন, তিনি সব সময়ই বুদ্ধিদীপ্ত, তাঁর কাছে হয়তাে একটি ভালাে বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে, আর ব্যক্তিগতভাবে তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন না । রাষ্ট্রদূতের বাসায় তাঁর সঙ্গে আমার একান্ত বৈঠক হলাে, তাঁর সহযােগীরা এবং রাষ্ট্রদূত আমাদের রেখে অন্যত্র চলে গেলেন।
প্রথমেই এম এম আহমেদ বললেন, ‘অনেকেরই ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি খুব গভীর । তােমার উত্তেজনা ও ক্ষোভ সংগত। তবে অবস্থা এত খারাপ না, যতটা বিশ্ব সংবাদমাধ্যম বলতে শুরু করেছে। আমরা একটি মিশন বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলাম, তাতে তােমারই বন্ধুবান্ধব ছিলেন। তাঁদের প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির কথা আছে, তবে তা শুধরে নেওয়া যাবে। তােমার বিদেশে খারাপ লাগলে তুমি যেকোনাে সময় দেশে ফিরতে পারাে। পূর্ব পাকিস্তানে বা কেন্দ্রীয় সরকারে তােমার পদোন্নতি হয়েই আছে, যেকোনােখানে যােগ দিতে পারাে। আমি তাঁকে সংলাপে ব্যর্থতার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। তার জবাব হলাে যে তাঁকে সংলাপে ডাকা হয়েছিল আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক প্রস্তাব পরীক্ষা করার জন্য। তাঁর আপত্তি ছিল দুই মুদ্রাব্যবস্থায়। তিনি মনে করেন যে বৈদেশিক মুদ্রা ও সাহায্যের হিসাব আলাদা করা যায়, তবে তার জন্য যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি সময়ের দরকার। তার প্রস্তাব ছিল, বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে আলােচনা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ভিন্নভাবে না করে একসঙ্গে করা উচিত। ফেডারেল সরকারের কিছু বিষয়ে তিনি অধিকতর ক্ষমতা চান, যেমন প্রতিরক্ষা, শিল্প ও কেন্দ্রীয় কর্মকমিশন সংশ্লিষ্ট কতিপয় বিষয়ে। আর রাজস্ব আদায় প্রদেশ করলেও কেন্দ্রীয় একটি রাজস্ব বাের্ড থাকতে হবে। তিনি এ-ও বললেন যে তাঁর ধারণা ছিল তার মতামত আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছে। তিনি ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ করে বােঝেন যে ভুট্টো অর্থনৈতিক ক্ষমতা বণ্টনে মােটেই আগ্রহী নন এবং তার সমস্ত মনােযােগ নিবদ্ধ ছিল রাজনৈতিক সমঝােতায়। তার এই বক্তব্য রেহমান সােবহানকে জানালে রেহমান মােটামুটি সায় দেন।
এম এম আহমদকে আমি আরও জিজ্ঞাসা করলাম, বাঙালিরা যে মনে করে সংলাপ শুধুই ধোকাবাজি ছিল, সে সম্বন্ধে তিনি কি কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন? তার জবাব ছিল যে তার কাজ শেষ হয়ে গেলে তিনি ঢাকা পরিত্যাগ করেন এবং আলােচনার গতি সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল না, বরং সমঝােতা হয়ে যাচ্ছে বলেই তার তখন মনে হয়। তিনি যে কথাটি খুব জোর দিয়ে বললেন তা হলাে, জেনারেল ইয়াহিয়া বিষয়টির সুরাহা করতে বদ্ধপরিকর। এবং ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তিনি আলােচনা শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে তিনি একটি নামই উল্লেখ করেন আর তা হলাে মােহাম্মদ জহিরুদ্দীন, যার নাম ইতিমধ্যে পাকিস্তানি খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা।
৯০
হয় । আমার শেষ প্রশ্ন ছিল ইয়াহিয়ার সমাধান নিয়ে, তিনি কী দিয়ে বাঙালিদের সন্তুষ্ট করবেন—ছয় দফার তাে বিকল্প নেই। এম এম আহমদের জবাব ছিল যে এক রকমের ছয় দফা তাে গৃহীত হয়েছিল, তবে কনফেডারেশনের ধারণা নিয়ে ছিল আপত্তি । তিনি কিন্তু একটি বিষয়ে অত্যন্ত সত্যবাদী ছিলেন। তিনি বলেন যে। ইয়াহিয়া সম্ভবত একা আর কোনাে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না এবং তার জান্তা নমনীয় হবে কি না, সে সম্বন্ধে তিনি ওয়াকিবহাল নন।
এম এম আহমদ এক ফাঁকে খবর দিলেন যে ড. নূরুল ইসলাম আমেরিকায় আছেন। এখানে পৌছে তিনি খবর পাঠিয়েছেন, তাঁর ছুটি আগেই মঞ্জুর করা ছিল, তিনি শুধু আগেভাগেই ছুটি উপভােগ করতে শুরু করেছেন। ড. ইসলাম তখন ঢাকায় পাকিস্তান অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন আর আহমদ ছিলেন তার সভাপতি । আমার সঙ্গে যােগাযােগ হয়নি শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন, আমার মনে হলাে তিনি আমাকে বিশ্বাস করলেন না। দুদিন পর ড. ইসলামের সঙ্গে ওয়াশিংটনে আমার দেখা হয়। তিনি ইয়েলে আগেই পৌছেছিলেন, ১২ মে ওয়াশিংটনে আসেন। | আহমদের সফরসঙ্গী সারতাজ আজিজের সঙ্গে একদিন মধ্যাহ্নভােজে দীর্ঘ আচ্ছা হলাে। সারতাজ আজিজ পাকিস্তানে আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন, ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আমরা পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে একসঙ্গে কাজ করেছি। এ ছাড়া ‘৬৯ ও ‘৭১ সালে তিনি কিছুদিন ওয়াশিংটনে ছিলেন এবং সেখানেও আমরা ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তারেক সিদ্দিকীও আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চাকরি করতেন ও বাংলা ভাষা রপ্ত করেছিলেন। প্রদেশের বৈষম্য নিয়ে তিনি সােচ্চার ছিলেন। সারতাজের কথাবার্তা ছিল অন্য জগতের—খুবই জ্ঞানজাগতিক বা একাডেমিক। তিনি বাংলাদেশের সব সুযােগ বিবেচনা করে অভিমত দিলেন যে ওই মুহূর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। এত দিন পর যখন পশ্চিম থেকে পূর্বে সম্পদ প্রতিপ্রবাহ শুরু হয়েছে, তখন বাংলাদেশের এই সুযােগ কোনােমতেই ছাড়া উচিত হবে না। হত্যাযজ্ঞ তাঁর মতে তেমন হয়নি এবং দুই দিকেই খুনােখুনি ঘটেছে। সেনাবাহিনী বাঙালি মেরেছে, বাঙালিরা বিহারি মেরেছে। এটি একটি গভীর ক্ষত, কিন্তু একে সারিয়ে নিতে হবে।
তিনি আরও বললেন যে বাংলাদেশের যাবার জায়গা নেই। ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার ফলে আমেরিকা আর বাংলাদেশে জড়াতে চাইবে না। তিনি ভারতকে আমলেই আনতে চাইলেন না, বরং বললেন যে ভারত যুক্তিবাদী হলে তাে দেশ বিভাগই হতাে না। হিন্দু-ভারতকে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগণ কখনাে গ্রহণ করবে না। আর শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দু এবং মুষ্টিমেয় কট্টর আওয়ামী লীগারের
৯১
জন্য ভারতও খুব আগ্রহী হবে না। এই লাইনে কথা বলা তখন সব পাকিস্তানির সহজাত অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। তারেক সিদ্দিকী ওয়াশিংটনে পৌছেই আমাকে। বাড়িতে টেলিফোন করে সমবেদনা জানান এবং পরিবার-পরিজনের ‘খায়রিয়ত জানতে চান। তারপরই বললেন যে আমাদের কথা বলতে হবে, দেশের বিরাট সমস্যা নিয়ে একাধিক মস্তিষ্ক খাটাতে হবে। তাঁর সঙ্গে আলােচনায় তার সহানুভূতি প্রকাশ পায় কিন্তু তাঁরও শেষ সিদ্ধান্ত ছিল ঠিক সারতাজের মতােই। ভারতের ছত্রচ্ছায়ায় বাংলাদেশ হবে না এবং হলেও তা গৃহীত হবে না। তারেকের বুদ্ধিজীবী হিসেবে সুনাম ছিল। সুতরাং তার সঙ্গে আলােচনায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটেনি।
সারতাজের সঙ্গে আলােচনা কিন্তু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সারতাজ শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, “আমরা ঘাস খেয়ে হলেও তােমাদের ভারতের সহায়তায় স্বাধীন। হওয়া ঠেকাব। এই পর্যায়ে আমাদের আলােচনায় ইতি ঘটে। তারেকের ব্যবহারে দোষ নেওয়ার কিছু ছিল না কিন্তু অনেক দিন পর একটি ঘটনা শুনে মনে কষ্ট পাই। সিনেটর চার্চের সহকারী টমাস ডাইন একদিন বললেন যে এখনাে কিছু বাঙালি পাকিস্তানের সমর্থক। এই কথাবার্তা সম্ভবত হয় আগস্টের শেষে বা সেপ্টেম্বরের প্রথমে। আমি খুব জোরে আপত্তি করলাম। তখন তিনি বললেন যে পাকিস্তান দূতাবাসের আকরম জাকির সঙ্গে একজন বাঙালি সিনেটরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। নাম খুঁজে পাওয়া গেল তারেক সিদ্দিকীর, বােধ হয় দেশে প্রত্যাবর্তনের আগে তিনি ওয়াশিংটনে এসেছিলেন। আমি টমকে জানালাম যে উনি বাঙালি নন, তবে বাংলাদেশকে ভালাে জানেন। আকরম জাকি খুব চালাক লােক ছিলেন। তিনি পরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরে সাধারণ সচিব হন। তিনি হয়তাে বলে থাকবেন যে বাংলাদেশে তেমন কিছু ঘটেনি এবং বাঙালিরা ভারতকে পছন্দ করে না এবং হয়তাে বলেছেন যে আমার সতীর্থ তাে ওই দেশ চেনেন, তারও অভিমত এ রকম। এ ধরনের আলাপ হয়ে থাকতে পারে বলে টমেরও সন্দেহ হয়।
রেহমান সােবহান কোন তারিখে ওয়াশিংটনে পৌছান, কোনােমতেই তা মনে করতে পারছি না। আর কোথাও তা লেখাও নেই । তবে নানা হিসাব করে দেখেছি যে তিনি ৮ অক্টোবরে ওয়াশিংটনে আসেন। তার ওয়াশিংটনে আসার খবর আগেই পেয়েছি; সম্ভবত তসনু ভাইয়ের কাছে। লন্ডনে তসন্দুক আহমদ বহুদিন থেকেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানবিশেষ। আমাদের ছেলেবেলার নেতা, পথপ্রদর্শক ও চিন্তানায়ক তসনু ভাই। তাঁর ছােট ভাই শফাত আহমদ চৌধুরী (ডেল্টা লাইফ-খ্যাত) এবং হেদায়েত আহমদ (অবসরপ্রাপ্ত সচিব) আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তারা দুজনই ইতিমধ্যে পরলােকগত হয়েছেন। তসনু ভাই সেই চল্লিশের দশকেই ছিলেন প্রগতিশীল ছাত্রনেতা এবং বামপন্থী। ১৯৫২
৯২
সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি দেশ ত্যাগ করেন আর লন্ডনেই থেকে যান। ষাটের দশকে তিনি লন্ডনে ‘গেঞ্জেস’ নামে একটি সুন্দর রেস্তোরা প্রতিষ্ঠা করেন। এই গেঞ্জেস ১৯৭১ সালে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বাঙালিদের একটি আড্ডাস্থল, বিশেষ করে র্যাডিক্যাল গােষ্ঠীর মিলনকেন্দ্র।
পরবর্তীকালে তসনু ভাই ব্রিটেনের রানি কর্তৃক অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ খেতাবে ভূষিত হন। রেহমান ওয়াশিংটনে হারুন রশীদের বাড়িতে থাকবেন, আমি তাঁকে নিয়ে আসতে গেলাম বিমানবন্দরে। এতটুকু খেয়াল আছে যে তিনি আর এম এম আহমদ প্রায় একই সময়ে এসে পৌছান। প্রথম দিনেই তিনি আমার বাড়িতে দূতাবাসের সব বাঙালির সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। তিনি যেমন এখানকার অবস্থা সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী ছিলেন, আমরাও তেমনি বাংলাদেশের ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলি তাঁর কাছ থেকে জানতে উদগ্রীব ছিলাম । মাসখানেক তিনি আমেরিকায় ছিলেন। তাঁর প্রধান আখড়া ছিল ওয়াশিংটন এলাকায় হারুনুর রশীদের বাড়ি। তবে বােস্টন, শিকাগাে ও নিউইয়র্কেও ছিল তার যাতায়াত। ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ লিগও তাঁকে লুফে নেয়। মিশনের দুজন কর্মচারী রাজ্জাক ও ফজলুল বারী হয় তাঁর সব সময়ের সহচর। রাজ্জাক ১৭ মে দূতাবাস থেকে বরখাস্ত হবার পর রেহমানের সার্বক্ষণিক সহকারীর ভূমিকা গ্রহণ করে।
সংবাদমাধ্যমে রেহমান সহজেই গৃহীত হন। তারা এই প্রথম মুজিবনগর সরকারের একজন প্রতিনিধিকে পেল। পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস সে যুগে ওয়াশিংটনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রচার করত, যার নাম। ছিল ওয়াশিংটন নিউজ কনফারেন্স। সেখানে বিভিন্ন সাংবাদিক সংবাদ পড়তেন। এবং বিশেষ বিশেষ সংবাদ নিয়ে আলােচনা করতেন। এসব সংবাদের জন্য আবার অতিথিদের ডেকে আনা হতাে অথবা সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করা হতাে। একজন সাংবাদিক ওয়ারেন উনা রেহমানকে এই প্রােগ্রামে হাজির করালেন। রেহমানের সংবাদ পরিবেশনা ছিল দৃঢ়বিশ্বাসে দীপ্ত এবং ব্যাখ্যায় পরিস্ফুট । রেহমান তার মাসখানেকের অবস্থিতিতে সম্ভবত চারটি টেলিভিশন সংবাদ পর্যালােচনায় অংশগ্রহণ করেন। ১২ মে রেহমান একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। এবং এতে বেশ লােকসমাগম হয়। পাকিস্তানি দুজন সাংবাদিককে পাকিস্তান। সরকার তখন ওয়াশিংটনে পাঠায়, ডন-এর নাসিম আহমদ এবং ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর-এর কুতুবুদ্দিন আজিজ। তারা কিছুদিনের জন্য দূতাবাসের জনসংযােগ কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। অবশ্য প্রকাশ্যে তারা স্বাধীন সাংবাদিক হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিতেন। তাঁরা রেহমানের সংবাদ সম্মেলনে বাধা সৃষ্টির জন্য হাজির হন কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে খানিকক্ষণ থেকে বিদায় নেন।
৯৩
স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে তারা সব সময় যেতেন এবং খুব তত্ত্বকথা শােনাতেন। বলা যায়, একধরনের উঁচু মার্গে অবস্থান নেবার চেষ্টা করতেন তাঁরা। রাজ্জাক একদিন তাদের খুব অপদস্থ করেন। তাঁর উপস্থিতি নিয়ে বােধ হয় নাসিম প্রশ্ন তােলেন। রাজ্জাক কম গেলেন না, তিনি বললেন যে নাসিম তাে ওই আসরে সাংবাদিক হিসেবে ভুয়া পরিচয়ে হাজির হয়েছেন, তিনি পাকিস্তান দূতাবাসের বেতনভুক্ত কর্মচারী। সুতরাং তারই বরং এই আসরে হাজিরা দেবার অধিকার নেই। নাসিম কিছুদিন পর পাকিস্তানে ফেরত যান, তবে কুতুবুদ্দিন বহুদিন পর্যন্ত জনসংযােগ কর্মকর্তা এবং কংগ্রেসে লবিস্ট হিসেবে ওয়াশিংটনে থেকে যান। তাঁরা দুজন পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে তথ্য দপ্তরে উচ্চ পদে আসীন হন।
এম এম আহমদ কংগ্রেসে সিনেটর সাইমিংটন কর্তৃক আপ্যায়িত হন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর ফুলব্রাইটকে এম এম আহমদের সঙ্গে বৈঠক করতে অনুরােধ করেন। কিন্তু ফুলব্রাইট তাতে রাজি না হওয়ায় সাইমিংটন তার জন্য চায়ের ব্যবস্থা করেন। সাইমিংটন পাকিস্তানের কোনাে শক্ত সমর্থক ছিলেন না, তবে শত্রুও ছিলেন না। তিনি বাংলাদেশ সমস্যার ওপর সিনেটে পাঁচবার বক্তব্য দেন। প্রথমে ২৪ জুন, তারপর ১৫, ২৩ ও ৩০ জুলাই এবং সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বরে । তাঁর সব কটি বক্তৃতাতেই ছিল মার্কিন নির্বাহী বিভাগের বিরুদ্ধে অভিযােগ—তাদের মিথ্যাচার, পক্ষপাতিত্ব ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা। তিনি বলেন যে নিক্সন সরকার বন্ধুকে কী করে ধ্বংস করতে হয় এবং বন্ধুত্বের জায়গায় নিজেদের মিথ্যাচার ও গােপনীয়তার আবরণ সৃষ্টি করতে হয়, সে কৌশলে অত্যন্ত দক্ষ। টমাস ডাইন, জেরি টিংকার, মাইক গার্টনার—আমাদের এসব বন্ধু ঠিক করলেন যে এর প্রত্যুত্তরের জন্য সিনেটরদের সঙ্গে রেহমানের আলাপের ব্যবস্থা করতে হবে। বিষয়টি যাতে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ও ডেমােক্রেটিক কংগ্রেসের দ্বন্দ্বে রূপ না নেয় তার জন্য স্থির হলাে যে সিনেটর স্যাক্সবি (রিপাবলিকান) রেহমানের জন্য মধ্যাহ্নভােজের ব্যবস্থা করবেন।
রেহমান ভালাে বক্তা এবং বিষয়টি ছিল তার নখদর্পণে, তাই তাঁর বক্তব্য সবাইকে প্রভাবিত করে। রেহমানের কথা শুনতে হাজির হন সিনেটর ফুলব্রাইট এবং রিপাবলিকান দলের নেতা সিনেটর হিউ স্কট। সংবাদমাধ্যমে রেহমানের প্রচারণা ইতিমধ্যে তাঁকে করে তােলে আকর্ষণীয়। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বস্তরে আলাপ-আলােচনার সুযােগ হলাে অতি সহজে, বিশেষ প্রকল্প বিভাগ, পাকিস্তান ডেস্ক, পিটার কারগিল—সবাই রেহমানের কথা শুনলেন। খােদ ম্যাকনামারাও দেখা করলেন। রেহমান কিন্তু মার্কিন নির্বাহী বিভাগে তদবির করার বিশেষ
৯৪
সুযােগ পেলেন না। তাঁর পক্ষে পররাষ্ট্র দপ্তর, এইড কর্তৃপক্ষ বা হােয়াইট হাউসে পৌছা খুব কষ্টকর হলাে। স্টেট ডিপার্টমেন্টে শুধু ক্রেইগ ব্যাক্সটারের সঙ্গে কথা হলাে। এইডে অবশ্য ডেপুটি প্রশাসক মরিস উইলিয়ামস তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন। হােয়াইট হাউসে পৌছার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলাে। অন্যান্য সূত্রেও হােয়াইট হাউসে যােগাযােগের সব প্রচেষ্টা সারা একাত্তরে ফলপ্রসূ হয়নি। রেহমান হার্ভার্ডের মাধ্যমেও কিসিঞ্জারের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করে ব্যর্থ। হলেন। বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের পর প্যাট নিক্সন একটি ত্রাণ তহবিল গঠন করেন। এই তহবিলের কো-চেয়ার ছিলেন একজন আইনবিদ, যার পুরাে নাম এখন মনে পড়ছে না। তবে মিস্টার সাউয়ারের সঙ্গে আমার বেশ পরিচয় ছিল।
প্যাট নিক্সনের তহবিলের ব্যাপারে আমাকে যােগাযােগ রাখতে হতাে। তহবিলের জন্য চিঠিপত্র লেখা, হিসাব রাখা—এসব কাজে আমাদের মহিলারা স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতেন। আইনবিদ সাউয়ারের কাছে রেহমানকে নিয়ে একদিন বিকেলে হাজির হলাম। সেখানে আমাদের দালানে ঢুকবার জন্য একটি রেজিস্টারে নাম লিখতে হয়। আমি আমার নামেই মােলাকাত ঠিক করেছি, সেই নামই লিখে দিলাম। রেহমান তার নাম লিখলেন ‘মােহনলাল। তিনি বললেন যে ছদ্মনামের একটি কালচার মুজিবনগরে চালু হয়েছে এবং আমি যে তা রপ্ত করিনি, তাতে আমার অসুবিধা হতে পারে। মার্কিন মুলুকে এ রকম- অসুবিধা আমি কখনাে চিন্তা করিনি এবং বাস্তবে তা কখনাে হয়নি। জুলাই কি সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক আনিসুর রহমানও ওয়াশিংটনে আসেন এবং কংগ্রেসে তদবির করেন। তিনিও সব সময় ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। তার আবার বাতিক ছিল যে তিনি সব সময় ‘আ’ এবং ‘র’ অক্ষরের নাম নিতেন, যেমন আবদুর রাজ্জাক, অনিল রায় ইত্যাদি। রেহমান দ্বিতীয়বার যখন ওয়াশিংটনে আসেন, তখন আর ছদ্মনাম ব্যবহার করেননি। সাউয়ার আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক অনুমানের খেলা খেললেন। কিন্তু নিক্সনের কাছে এ ব্যাপারে কোনাে তদবিরের সুযােগ বের করতে পারলেন না। আমাদের ফজলে বারীও একবার নিক্সনের কাছে পৌছাবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনাে ফল হলাে না।
কিসিঞ্জারের সহকারী হ্যারল্ড সন্ডার্স এনায়েত করিমের পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনিও বাংলাদেশের ব্যাপারে কিসিঞ্জারের সঙ্গে কোনাে রকমের ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। সে সময় হােয়াইট হাউস এ ব্যাপারে কানে দেয় তালা আর চোখে দেয় তুলা।
আমি অনবরত প্রতিবেদন ও প্রচারপত্র তৈরি করেই চলেছি। ২ মে অ্যান্টনি মাসকারেনহাসের বরাতে বিহারি হত্যা নিয়ে একটি বড় কাহিনি বিশ্ব
৯৫
সংবাদমাধ্যমে বেরােল। হারুনের সঙ্গে মিলে আমি লিখলাম কে কাকে খুন করছে। রেহমান এসে এতে এক নতুন মাত্রা যােগ করলেন। তিনিও দু-একটি সাপ্তাহিকীতে লিখলেন। আরও সব প্রতিবেদন বানালেন, যেমন অবস্থান এবং বিকল্প নীতি’। তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ১৭ এপ্রিলের একটি মূল্যবান বক্তৃতার খসড়া এনে তার বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। ১২ মে রাতে ড. নূরুল ইসলাম এলেন ওয়াশিংটনে। রেহমান, হারুন আর আমি গেলাম রজার স্মিথ। হােটেলে। সেদিন আমাদের একটি লম্বা এবং খােলামেলা আড্ডা হলাে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা দুটি ভিন্ন বিশ্লেষণ শুনলাম।
রেহমানের অভিমত ছিল যে অতিসত্বর বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি দখলদারেরা বিদায় নেবে। বাঙালি যুবসম্প্রদায়কে দেখে এবং তাদের ত্যাগ ও যুদ্ধস্পৃহা বিশ্লেষণ করে তার ধারণা হয় যে এরা দেশকে স্বাধীন করেই ছাড়বে। ভারত সরকার তাদের দরাজ হাতে সাহায্য না করলে নিজেই বিপদে পড়বে এবং কোনােমতেই আমাদের পিছু টেনে রাখতে পারবে না। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে বছর ঘুরতে না ঘুরতে দেশ মুক্ত হবে। ড. ইসলাম এতটা আশাবাদী ছিলেন না। তাঁর প্রাথমিক অভিমত ছিল যে মুজিবনগর সরকার ক্রমে তিব্বতের দালাই লামা বনে যাবে। পাকিস্তানিরা বিতাড়িত হবে, তবে সে অনেক দিনের ব্যাপার। তারা দুজনই একমত ছিলেন যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব হবে অন্য রকমের, অন্য মাত্রার। নেতারা হবেন যৌবনদীপ্ত, বিপ্লবী, প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী। ড. ইসলাম হাস্যোচ্ছলে আমাকে উপদেশ দিলেন আমার যেকোনাে আন্তর্জাতিক বা মার্কিন সংস্থায় চাকরির জন্য চেষ্টা করা উচিত। মজার ব্যাপার হলাে যে দুই মাস পর একই রকম ব্যক্তিগত উপদেশ আমাকে আবার দেন পাকিস্তানি মাহমুদ আলী। সময়ের ব্যবধানে মে মাসে আমি ছিলাম পাকিস্তান দূতাবাসের ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী কূটনীতিবিদ এবং জুলাইয়ে পাকিস্তান পরিত্যাগী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত লবিস্ট।
রেহমান ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কের বাঙালি কূটনীতিবিদদের নিয়ে একটি বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের পরিকল্পনা রচনায় ব্রতী হন। প্রাথমিক হিসাবে ঠিক হলাে যে মাসিক ১৫-২০ হাজার ডলারে একটি মিশন স্থাপন করা যায়। সেখানে সব বাঙালি কূটনীতিবিদ যােগ দেবেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন বাঙালি সমিতিও খুব আগ্রহী ছিল। কিন্তু অর্থের নিয়মিত ব্যবস্থা করাটা তত সহজ ছিল না। নিউইয়র্কে মিশনের জন্য মাহমুদ আলীর দুই হাজার ডলার আদায়ের প্রতিশ্রুতি কোনাে সময়ই পালন করা যায়নি। শিকাগাের ফজলুর রহমান খানও এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা নিয়ে সফল হননি। দু-একজনের জন্য দূতাবাস ছেড়ে কোনাে রকমে জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা করা কঠিন ছিল না, কিন্তু সবাইকে নিয়ে ১০-১৫ জনের মিশন স্থাপন করা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার ।
৯৬
১১ মে কংগ্রেসে বাংলাদেশের ওপর গালাগার শুনানি হলাে। নিউজার্সির প্রতিনিধি ডেমােক্র্যাট কর্নেলিয়াস গালাগার ছিলেন হাউসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা সাব-কমিটির চেয়ারম্যান। তিনিই কংগ্রেসে বাংলাদেশের ওপর প্রথম শুনানির ব্যবস্থা করেন। (এ বিষয়ে বিস্তৃত আলােচনা দ্রষ্টব্য)। এতে প্রথম দিন সাক্ষ্য দেন সিনেটর কেনেডি। দ্বিতীয় অধিবেশন হয় ২৫ মে এবং তাতে সাক্ষ্য দেন অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যান ও অধ্যাপক গিডন গটলিয়েব। আবদুর রাজ্জাক খান এই শুনানিতে হাজির হন। তিনি ওই দিনের জন্য দূতাবাস থেকে ছুটি নেন এবং দর্শক গ্যালারিতে উপস্থিত হন। দূতাবাস তাঁকে এর জন্য শাস্তি দিল । ১৭ তারিখে তাকে বরখাস্ত করা হলাে। আমরা দূতাবাসের বাঙালি কর্মচারীরা একসময় একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমাদের কাউকে যদি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ অন্যায়ভাবে শাস্তি দেয়, তাহলে আমরা সবাই একযােগে তার প্রতিবাদ করব আর সেটি হবে আমাদের আনুগত্য পরিবর্তনের সময়।
সেদিন বিকেলে আমরা অধ্যাপক আবু রুশদের বাড়িতে সম্মিলিত হলাম। সেখানে প্রথম আমাদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিল। কারও মত ছিল যে রাজ্জাক আক্রান্ত হওয়ায় আমাদের পূর্বেকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবারই দূতাবাস পরিত্যাগ করা উচিত। ভিন্নমত হলাে যে রাজ্জাক স্থানীয় কর্মচারী, পুরােপুরি কূটনীতিবিদ নন। সুতরাং কূটনীতিবিদদের ওপর আক্রমণ এখনাে হয়নি এবং আমাদের কোনাে পদক্ষেপ নেবার সময় আসেনি। এই যুক্তির বিপদ ছিল যে এটি বাঙালি মহলে সমাদৃত হবে না এবং বৈষম্যমূলক বলে গণ্য হবে। যা-ই হােক, সিদ্ধান্ত হলাে যে সম্মিলিতভাবে আমরা কোনাে প্রতিবাদ করব না, তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি প্রতিবাদ করে কোনাে পদক্ষেপ নেন, তাতে কোনাে আপত্তি থাকবে না। এককথায় এবার আমাদের ঐক্যে ভাঙন এল। এই সিদ্ধান্ত কিন্তু কাউকেই শান্তিতে থাকতে দিল না এবং এ নিয়ে কদিন ধরে কানাঘুষা চলল। দূতাবাসের কয়েকজন নিম্নপদস্থ কর্মচারী কিন্তু খুব ক্ষুন্ন হলেন। তাঁদের তিনজন ফজলুল বারী, মুহিদ চৌধুরী ও মােশতাক আহমদ আমার কাছে এলেন বুদ্ধি নিতে। তারা চাকরির তােয়াক্কা করেন না, কিন্তু প্রতিবাদ তাদের করতেই হবে। অবশেষে তাঁদের নিয়ে একটি প্রতিবাদলিপি তৈরি করলাম এবং ১৯ মে তাঁরা সেটি রাষ্ট্রদূতের কাছে দিলেন। ২৬ মে প্রথমে ফজলুল বারী বরখাস্ত হলেন। তার কদিন পর ৯ জুন মুহিদ বরখাস্ত হলেন। মােশতাককে বরখাস্তের সুযােগ আর হলাে না। ৪ আগস্ট তিনি নিজেই বিদায় নিলেন। হিউবার্ট মিচেল বলে একজন উকিল বারী ও মুহিদকে রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে এবং জীবিকার রাস্তা খুঁজে পেতে খুব সাহায্য করেন।
৯৭
কিছুদিন পর আমার বাড়িতে দূতাবাসের কর্মচারীদের আরেকটি সভা বসল। সেদিন আমি আমার সহকর্মীদের জানালাম যে আমি মাস শেষে দূতাবাস পরিত্যাগ করছি এবং আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিচ্ছি। কিন্তু তার আগে হারুন রশীদের প্লেনের ভাড়ার চাঁদাটা আদায় করতে হবে। সবার প্রশ্ন হলাে দুটি, প্রথমত আমার চলবে কী করে, আমি কি কোনাে ব্যবস্থা নিয়েছি? দ্বিতীয়ত, আমার এই পদক্ষেপে আন্দোলনের কী লাভ হবে, আমি কী করব? আমি কোনাে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা ঠিক করিনি, তবে দু-চারটি বক্তৃতা দেবার প্রােগ্রাম করেছিলাম আর বিশ্বাস ছিল যে কিছু একটা জুটিয়ে নিতে পারব। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর ছিল সহজ। কারণ, ইতিমধ্যে একটি মিশন বা কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা শুধু বাঙালিদের মধ্যে নয়, মার্কিন শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যেও আলােচিত হচ্ছিল।
মে মাসে বাংলাদেশের খবর তত আশাব্যঞ্জক ছিল না। ওয়াশিংটনে কর্মচারীদের বরখাস্তের ঘটনাটি মনঃকষ্টের কারণ ছিল। পাকিস্তানিরা বেশ মাথা। উঁচু করে কথা বলছিল । রাষ্ট্রদূত কতগুলাে প্রচারপত্র ও পুস্তিকা বিতরণ করে বেড়াচ্ছিলেন। এর মধ্যে পাকিস্তান একটি সংবাদ বিজ্ঞাপন বের করল। তাতে ‘আমরা মৃত বলে ঘােষিত হয়েছিলাম’–এই শিরােনামে ঢাকার কয়েকজন। শিক্ষক জানান যে ঢাকায় হত্যাযজ্ঞ হয়নি এবং তারা বেঁচে আছেন। এম এম আহমদ পাকিস্তানের জন্য শক্ত তদবির করে গেলেন। লাভের খাতায় ছিল রেহমানের সফল সফর, আনার দুটি বিক্ষোভ, গালাগার শুনানি এবং কেস মন্ডেইল প্রস্তাব পাস।
মে মাসের শুরুতে দুজন বাঙালি এসে সামরিক বর্বরতার বিস্তৃত কাহিনি শােনালেন। প্রথমে এলেন জিল্লুর রহমান খান এবং তাঁর স্ত্রী, পরে এলেন মাসুদা আলম (শরফুল আলমের স্ত্রী দেশে বেড়াতে গিয়েছিলেন, প্রত্যাবর্তন করলেন ১০ মে)। জিল্লুর রহমান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন, লালমাটিয়ায় থাকতেন। তাঁর স্ত্রী মার্কিন, তাই ৬ এপ্রিল তিনি মার্কিন নাগরিকদের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অপসারিত হন। জিল্লুর কিছুদিনের মধ্যে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওসকস ক্যাম্পাসে অধ্যাপক হন। প্রসিদ্ধ ফজলুর রহমান খানের তিনি কনিষ্ঠ ভ্রাতা । মাসুদা ঢাকা থেকে পালিয়ে টাঙ্গাইল এলাকায় ঘুরে বেড়ান। করটিয়ায় শত্রুপক্ষের গােলাগুলিতে তাঁর কয়েকজন আত্মীয় নিহত হন এবং তিনিও বুলেটবিদ্ধ হন। তিনি সামরিক বর্বরতার লােমহর্ষক বিবরণ দিলেন। তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করলেন যে বাংলাদেশে এসব বর্বর দখলকারীর দিন খুবই নির্দিষ্ট । জিল্লুর মার্কিন শিক্ষক মহলে একটি লিখিত বিবৃতি দেন, যেখানে তিনি সামরিক বাহিনীর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আক্রোশের বিশদ বিবরণ দেন। তিনি দেশব্যাপী প্রতিরােধেরও একটি চিত্র আঁকেন।
৯৮
তাঁর এই বক্তব্য পণ্ডিত মহলকে খুবই বিচলিত করে এবং এর ওপর ভিত্তি করে তারা কড়া বক্তৃতা ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করেন। জিল্লুর আমাদের বাড়িতে কয়েক দিন ছিলেন। তাঁর স্ত্রী সামরিক আক্রমণের অনেক বিবরণ দেন। একদিন এফ আর খান এলেন আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে এবং জিল্লুরকে দেখতে। এই স্বনামধন্য ব্যক্তির সঙ্গে সেদিন আমার প্রথম মােলাকাত। তিনি ওয়াশিংটনে একটি বাংলাদেশ মিশনের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। জিল্লুরের জন্য কী করতে পারেন, তা আলােচনা করলেন। বাংলাদেশ সমিতিগুলাের জন্য একটি সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা বললেন এবং ফিরােজের প্রকল্পের বিষয়ে খোজ নিলেন। তিনি ১২ ১৪ মে আমার বাড়িতে আসেন।
এদিকে আরেকটি সুখবর হলাে কর্নেলিয়া রােডির উদ্যোগ। কর্নেলিয়া কংগ্রেসের লবিতে ঘােরাফেরা করছিলেন। সিআরএলের আরও লােকজন এখানে-সেখানে তদবির করছিলেন। ওয়াশিংটনের বাঙালি সমিতির উদ্যোগে জোর আসে রেহমানের আগমনে ও তৎপরতায়। আমি প্রায় রােজই ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ১৪ মে ডানহাম প্রস্তাবের খসড়া দপ্তরে দপ্তরে বিতরিত হলাে। কর্নেলিয়ার আলাপ-আলােচনার ওপর ভিত্তি করে এবং আমার একটি প্রতিবেদনের সাহায্য নিয়ে নিউইয়র্কের এক অত্যুৎসাহী যুবক ডেল ডানহাম (বােধ হয় সিআরএল গােষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং ফরিদা বুইর বন্ধু) প্রস্তাবটি রচনা। করেন। এই প্রস্তাবে পাকিস্তানে সব রকম মার্কিন সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয়। কথা হলাে যে জন রােডি এলে পরে ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টের সংশােধনী নিয়ে সিনেটরদের কজন আলােচনায় বসবেন। রােডির আসার তারিখ ছিল ২২ মে।
পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত মাস শেষে খুব তৎপরতা দেখাতে লাগলেন। তিনি অনেক প্রচারপত্র বিলি করলেন। জনপ্রতিনিধিদের অনবরত তারবার্তা পাঠিয়ে আর চিঠি লিখে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন। বাঙালি কর্মচারীদের বিশ্বাস করা যায় না বলে তিনি দূতাবাসে দুজন পাকিস্তানি কর্মকর্তা আমদানি করলেন। আকরম জাকি ছিলেন কানাডায় কাউন্সেলর, তাঁকে নিয়ে এলেন। জহিরুদ্দীন ফারুকী ছিলেন এনায়েত করিমের পূর্বসূরি, মিশনের উপপ্রধান। তিনি সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রদূত হয়ে বদলি হয়েছিলেন। তাঁকে আবার নিয়ে আসা হলাে। কুতুবুদ্দিন আজিজ আর নাসিম আহমদও দূতাবাসের কর্মচারী হিসেবে কাজ করছিলেন। তারা কংগ্রেসে খুব ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করলেন, সংবাদমাধ্যমে জোর তদবির চালালেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের মিশন পাঠানাের তােড়জোড় চলছে। ২৭ মে মাইকেল উইহেন ও ভানডার হাইডেন আমাকে মধ্যাহ্নভােজে ডাকলেন। তাঁদের পাকিস্তানি মিশন নিয়ে হবে আমাদের আলােচনা। কোথায় গেলে, কার সঙ্গে
৯৯
আলাপ করলে সঠিক খবর পাওয়া যাবে, কী কী বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া দরকার (যেমন চা-বাগান, পাটের পরিবহন, বিদ্যুৎ স্টেশনের নিরাপত্তা, যানবাহনের অবস্থা, গৃহায়ণ ও ধ্বংসলীলা)। অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে আমার অভিমতও তারা শুনলেন। কী ধরনের সাহায্য দিলে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হবে অথবা কীভাবে তাদের কাছে সাহায্য পৌছানাে যাবে, এমন ধরনের খােলামেলা আলােচনায় প্রায় দপ্তরের সময় শেষ হয়ে এল। উইহেন মােটামুটিভাবে দলনেতার কাজ করবেন, তবে শেষের দিকে খােদ পিটার। কারগিল যাবেন এবং তিনিই হবেন লৌকিক দলাধিপতি। আমার কোনাে ব্যক্তিগত খবর থাকলে তা-ও তারা পৌছে দেবার অঙ্গীকার করেন। তবে তারা। তখনাে নিশ্চিত ছিলেন না যে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও খুলনা ছাড়া আর কোনাে জায়গায় তারা যেতে পারবেন কি না।
সারা দেশ শান্ত—পাকিস্তানিদের এই দাবির ব্যাপারে তাঁরা মােটেই আস্থাশীল ছিলেন না। যােগাযােগের ব্যবস্থা সম্বন্ধেও তাঁদের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। আমার সৌভাগ্য যে আমার সরকারি মধ্যাহ্নভােজ ছিল এত বিশদ ও দীর্ঘ। সেদিন অপরাহ্রে রাষ্ট্রদূত দূতাবাসে এক সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন, যার অন্যতম। উদ্দেশ্য ছিল জেনারেল ইয়াহিয়ার ২৪ তারিখের বক্তব্যের ব্যাখ্যা ও প্রচার। আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল দুরভিসন্ধিমূলক। এ এইচ মাহমুদ আলীর আনুগত্য। পরিবর্তন, রাজ্জাকের বরখাস্ত, বাঙালি কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ—এগুলাে। নিয়ে স্থানীয় পত্রিকাগুলাে কয়েক দিন অনেক মন্তব্য করে এবং ধারণা দেয় যে দূতাবাসেই একধরনের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। হিলালি এই প্রচার বন্ধ করতে দৃঢ়মনস্ক ছিলেন। তার সংবাদ সম্মেলনে তিনি এক পাশে বসালেন এনায়েত করিমকে আর। অন্য পাশে শামসুল কিবরিয়াকে। আমাকেও খুঁজেছিলেন, তবে আমার সৌভাগ্য যে আমি কার্যোপলক্ষে দপ্তরে ছিলাম না। সংবাদ সম্মেলনে দূতাবাসে বাঙালিপাকিস্তানি মন-কষাকষি নিয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন। হিলালি এর জবাবে তার দুপাশে বসা বাঙালিদের দেখিয়ে ঘােষণা করেন যে সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার আর বাংলাদেশেও এ রকম সম্পর্ক বিরাজ করছে। শুধু গুটিকয়েক দুষ্কৃতকারী ভারতীয় উসকানিতে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তিনি শরণার্থীদের দেশত্যাগের বিষয়ে তাঁর কর্তাদের কথারই পুনরাবৃত্তি করলেন যে, ও তেমন কিছু নয়, শুধু ভারতীয় প্রচারণা। এই সংবাদ সম্মেলনের খবর কাগজে বেরােল, তবে বাঙালি-পাকিস্তানি সম্পর্কের বিষয়ে কেউই কোনাে মন্তব্য করলেন না। দুই মাস পর অবশ্য হিলালির সে মধুর সম্পর্কের দাবিটি নিতান্তই অসার প্রমাণিত হলাে। ৪ আগস্ট হিলালির দূতাবাসে কোনাে বাঙালি, এমনকি একজন পিয়নও অবশিষ্ট থাকল না।
এদিকে মে মাসের শেষ, সম্ভবত ২৪ তারিখের দিকে বিচারপতি আবু সাঈদ
১০০
চৌধুরী নিউইয়র্কে আগমন করলেন। এ এইচ মাহমুদ আলী সেখানে তাঁর দেখাশােনা করেন, এস এ করিমও তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ রাখেন। বাংলাদেশ লিগ তাঁকে নিয়ে অনেক হইচই করল। নিউইয়র্ক টাইমস-এ ৩০ তারিখ একটি সুন্দর প্রতিবেদন ছাপলেন কেথলিন টেল্টস। পাকিস্তানিরা তাকে মানবাধিকার কমিশন। থেকে বিতাড়নের তােড়জোড় চালাচ্ছে আর তিনিও ধীরস্থিরভাবে পাকিস্তানের গণহত্যার প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। ২৯ মে হারুন আর আমি গেলাম নিউইয়র্কে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে। এবার আমাদের বাসে করে যেতে হলাে। কারণ, প্লেনের ভাড়া অনেক বেশি। ওখানে এফ আর খান ও রেহমানও গেছেন তাঁর সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্য। সবাই চান, ওয়াশিংটনে একটি মিশন স্থাপন করা হােক। বিচারপতির সঙ্গে একান্ত আলাপে আমি জানালাম যে জুনের ১৫ তারিখ আমি দূতাবাস ছাড়ব এবং মিশনের ভার নেব। পাকিস্তানের চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত আমার চূড়ান্ত এবং আমার সহযােগীরা তা জানেন।
বিচারপতি আমাকে দুটো উপদেশ দিলেন—প্রথমত, আমার পদত্যাগ করা উচিত নয়, সরকারটি অবৈধ, সুতরাং আমি তাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেব এবং যথাসময়ে আমার অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করব। তিনি বললেন যে তিনি তখনাে বাংলাদেশের বিচারপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। শুধু সাময়িকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। দখলদারদের উচ্ছেদ করে নিজের জায়গায় আবার ফিরে যাবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বললেন যে এই সিদ্ধান্ত নিতান্তই ব্যক্তিগত এবং প্রত্যেকেরই উচিত নিজের বিচার-বিবেচনা ধীরেসুস্থে প্রয়ােগ করা। তবে তার বিশ্বাস আমি কোনাে দিনই আমার সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ পাব না, অনুশােচনা করব না বা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগব না। আমার ব্যক্তিগত অঙ্গীকার কিন্তু আমি যথাসময়ে রাখতে পারিনি এবং এর জন্য বিচারপতির ক্ষোভ এফ আর খান আমার কাছে প্রকাশ করেন। পরে একসময় তা ব্যাখ্যা করার সুযােগ আমার হয়। তখন তিনি বলেন যে যথাসময়ে তা আমি তাকে জানালে ভালাে হতাে। আমি ১৫ তারিখের পরিবর্তে ৩০ তারিখে দূতাবাস ছাড়ি। ৭ জুন জানলাম যে পাকিস্তান সরকার দয়াপরবশ হয়ে জুনের শেষে আমার পদটি বিলুপ্ত করে দেবে। তাই আমি আরও ১৫ দিন পাকিস্তানের ভাত সাবাড় করতে স্থির করি। তারা অবশ্য আরও দয়া প্রদর্শন করে আমাকে পিন্ডিতে শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে নিযুক্তি দেয়। তবে পিন্ডি থেকে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি ডেভিড গর্ডন বার্তা পাঠালেন যে আমি যেন পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনে বিলম্ব করি, অবশ্য বার্তাটি ছিল একান্ত ব্যক্তিগত ।
১০১
<p style="text-align: justify;"> ষষ্ঠ অধ্যায়
মুক্তিযুদ্ধ দৃঢ়করণের সময় : জুন-জুলাই ১৯৭১
যাতনার মাসের পর আসে দৃঢ়করণের সময়। জুন-জুলাই ছিল আমেরিকায়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দৃঢ়করণের সময় । জুন মাসে কংগ্রেসে পাকিস্তানকে সব। রকম সাহায্য বন্ধের জন্য সংশােধনী প্রস্তাব পেশ হলাে। বাংলাদেশের সমর্থনে দুটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, ফিলাডেলফিয়ায় ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার আত্মপ্রকাশ করল । নিউইয়র্কে বাঙালি সমিতিগুলাের বড় কনভেনশন হলাে। শিকাগােতে বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগও গঠিত হলাে। পাকিস্তান এইড কনসাের্টিয়ামের সভায় পাকিস্তানকে কোনাে সাহায্য বা ঋণ রেয়াতি দেওয়া বন্ধ হলাে। পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য প্রদানে মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অস্বস্তিকর সংবাদ প্রকাশিত হলাে জুনের শেষে। আর জুলাইয়ের প্রথমে বেরােল পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্বন্ধে বিশ্ব ব্যাংকের মারাত্মক এক প্রতিবেদন।।
তখন মার্কিন কংগ্রেস ছিল বস্তুতই জনপ্রতিনিধিদের কর্মস্থল । এত সহজে কোনাে আইন পরিষদে প্রবেশ করা এবং সরাসরি প্রতিনিধির কাছে নিজের দাবি বা দুঃখ বলা অন্য কোনাে আইন পরিষদে সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা। নিরাপত্তার বেড়া অথবা অন্য রকম লৌকিকতার সীমানা পেরিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টে যাওয়া, ভারতীয় লােকসভায় পৌছা অথবা আমাদের জাতীয় পরিষদে হাজিরা দেওয়া অনেক দুরূহ। মার্কিন কংগ্রেসে এখন নাকি কিছু নিরাপত্তার কড়াকড়ি হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও ওকলাহােমার বােমা হামলার পর কড়াকড়ি নাকি বেড়েছে। কিন্তু ১৯৯০ সালেও আমি ইচ্ছেমতাে সিনেটর অথবা কংগ্রেসম্যানদের দপ্তরে হাজির হয়েছি আর তাঁদের সঙ্গে দেখা না হলেও তাঁদের সহকারীদের কাছে আমার বক্তব্য বলেছি। জনপ্রতিনিধিদের দুয়ার জনগণের জন্য সব সময় উন্মুক্ত আর বিশেষ করে তাদের জন্য যারা তার নির্বাচনী এলাকার
১০২
লােক । আর একটি রীতি হলাে কোনাে রকম চিঠি, বার্তা বা টেলিফোন এলে তার জবাব তাঁরা দেবেনই দেবেন। জনপ্রতিনিধিরা নানা বিষয়ে, বিশেষ করে মানুষের অভিযােগ নিয়ে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য ও ব্যাখ্যা চান, বিশ্লেষণ চেয়ে পাঠান। নির্বাহী বিভাগ এসব অনুসন্ধানের জবাব দিতে বাধ্য এবং দেরি করলে বা ভুল খবর দিলে বিপদে পড়ে।
কংগ্রেসের দুই পরিষদেই অসংখ্য কমিটি রয়েছে। দেশের প্রতিটি বিষয়—পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, বিচারব্যবস্থা, শরণার্থী সমস্যা, ইন্ডিয়ান বিষয়, পরিবেশ, বাজেট নিয়েই কমিটি ও সাব-কমিটি রয়েছে। সমস্ত আইন নিয়ে তারা মাথা ঘামায় এবং নির্বাহী বিভাগের কার্যকলাপ নিয়ে অনুসন্ধান চালায় বা তথ্য সংগ্রহ করে। নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি হয় এসব কমিটিতে । কমিটির চেয়ারম্যান হন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের একজন প্রতিনিধি এবং এর সদস্যরা সব দল থেকেই আনুপাতিক হারে নির্বাচিত হন। কে কোন কমিটিতে যাবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেয় দলাধিপতিদের গােষ্ঠী এবং তাতে প্রতিনিধি হিসেবে জ্যেষ্ঠতা একটি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। এভাবে প্রতিনিধিরা সাধারণত বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে যান এবং সেই ক্ষেত্রেই অবস্থান করতে ভালােবাসেন । যেমন সিনেটর কেনেডি ছিলেন তিনটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, যথা : শরণার্থী, প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য। সিনেটর ফুলব্রাইট ছিলেন পররাষ্ট্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। প্রতিনিধিদের কাজকর্মে দক্ষতার পেছনে রয়েছে তাদের স্টাফরা। তাঁরা দুই ধরনের স্টাফ ব্যবহার করেন। একটি হলাে অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সাধারণত পড়াশােনায় ভালাে, জনসংযােগে পারদর্শী এবং খুব চলতাফেরতা। অন্যটি হলাে অনভিজ্ঞ কিন্তু খুব সপ্রতিভ ও মেধাবী সাময়িক স্টাফ, যাদের একধরনের শিক্ষানবিশ বলা চলে। তাদের মধ্যে অনেকেই কালে নিয়মিত স্টাফ হিসেবে যােগ দেন। প্রত্যেক প্রতিনিধির নিজস্ব স্টাফ থাকে আর তাঁদের নিয়েই হলাে তাঁর দপ্তর। এই দপ্তরে যত কাজ হয়, পরিষদের মেঝেতে বা গ্যালারিতে তার তুলনায় অতি সামান্যই হয়। সেখানে হয় বক্তৃতা, যার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দপ্তরে এবং ভােট প্রদান, যার জন্য সব তদবির হয় দপ্তরে।
মাত্র একটি সুরম্য প্রাসাদে হলাে পরিষদের দুই কক্ষ। কিন্তু দপ্তরগুলাে ছড়িয়ে আছে আরও পাঁচটি প্রাসাদে। ১০০ জন সিনেটর এবং ৪৩৫ জন প্রতিনিধির দপ্তর এই বিরাট কমপ্লেক্সে । তারা সারা বছর এখানে কাজ করেন, গ্রীষ্মে কদিন ছুটি আর আছে ছােট ছােট বিরতি। তারা সবাই নিয়মিত বেতন পান, মন্ত্রীদের চেয়ে। সামান্য কম তাদের বেতন। প্রতিনিধিদের নিজস্ব স্টাফ ছাড়াও কমিটিগুলাের স্টাফও রয়েছে। যখন চেয়ারম্যানের পরিবর্তন হয়, বিশেষ করে একদল থেকে আরেক দলে, তখন স্টাফেরও পরিবর্তন হয় কিছুটা।
১০৩
সাধারণত প্রতিনিধিরা যত গুণী, তাঁদের স্টাফও তত মেধাবী ও সপ্রতিভ। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলাে সিনেটর ও প্রতিনিধিদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য। সিনেটররা প্রায়ই অনেক বেশি শিক্ষিত এবং তাদের চিন্তার পরিধি অনেক বিস্তৃত। ১৯৭১ সালে কয়েকজন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানকে আমার ঘনিষ্ঠভাবে চেনার সুযােগ হয়। সিনেটর স্যাক্সবি, হ্যারিস, কেইস ও মন্ডেইলের কথা আগেই বলেছি। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি তাঁর পরিবারের নামেই সমধিক পরিচিত। অতি অল্প বয়সে তাঁর ভাই প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির শূন্য আসনে তিনি সিনেটর নির্বাচিত হন ১৯৬২ সালে। তবে সিনেটে বস্তুতই কঠিন শ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি নিজস্ব উচ্চাসন প্রতিষ্ঠা করেন। জনস্বাস্থ্য, প্রবাসন ও শরণার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মানবাধিকার—এসব বিষয়ে তাঁর বিশেষ অবস্থান ও বক্তব্য সর্বত্র সমাদৃত। একসময় অত্যধিক মদ্যপান ও মেয়েমানুষে আসক্তি নিয়ে তার বদনাম ছিল । কিন্তু সিনেটের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলিতে তাঁর ভূমিকা তার শত্রুরাও অস্বীকার করতে পারত না। ১৯৮০ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে স্বদলীয় প্রেসিডেন্ট কার্টারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন, তবে তারপর আর কোনাে প্রচেষ্টা চালাননি। ১৯৮৮ সালে সিনেটে তাঁর রজতজয়ন্তী উদ্যাপিত হয়। সেই উপলক্ষে বােস্টনে এক বিশেষ উৎসবের আয়ােজন হয়, সেখানে এক নৈশভােজে তাঁর গুণমুগ্ধ খ্যাতনামা এবং অনেক অচেনা মানুষ তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে। এই অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হবার এবং হাজিরা দেবার সুযােগ আমার হয়েছিল ।
সিনেটর কেনেডি একজন সুবক্তা। ১৯৭২ সালে ডেমােক্রেটিক কনভেনশনে। তিনি দলীয় প্রার্থী সিনেটর ম্যাকগভার্নকে পরিচয় করিয়ে দেন। এমন সুন্দর বক্তৃতা, যেমন বক্তব্যে, তেমন পরিবেশনায়, আমি খুব কম শুনেছি। আমাদের দেশে সুন্দর বক্তৃতা দেবার একটি রেওয়াজ ছিল এবং অনেক বক্তা এ ব্যাপারে কঠোর অনুশীলন করতেন। আমাদের ছাত্রবেলায় এ ধরনের সুন্দর বক্তৃতা দিতেন শেরেবাংলা ফজলুল হক, উপাচার্য ওয়াল্টার জেনকিনস, অধ্যাপক খালেদ বিন সাইদ, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মুরশেদ। সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ ছিলেন বাংলাদেশের আরেক বন্ধু । আইডাহাে আলু উৎপাদনে প্রসিদ্ধ, সিনেটর এ রাজ্যের প্রতিনিধি ছিলেন এবং তাঁর মনােগ্রামে সম্ভবত আলুর ছবি পরিস্ফুটিত হতাে। চার্চকে অনেকে বলতেন সিনেটের কুলীন সদস্য—ব্রাহ্মণ । তিনি ভারতের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। রক্ষণশীল একটি রাজ্যের তিনি ছিলেন অতি প্রগতিশীল প্রতিনিধি। মুক্তচিন্তা, পরিচ্ছন্ন রাজনীতি এবং যুক্তিবাদী অবস্থান ছিল তার শক্তির উৎস। তিনি একসময় একটি বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান হন। এই কমিটির কাজ ছিল আমেরিকার সমুদয় বিশেষ ও জরুরি আইনের হিসাব নেওয়া এবং তাদের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে এর জঙ্গল সাফ করা ।
১০৪
একদিন তিনি বললেন যে এমন সব জরুরি আইনের তথ্য তিনি পেয়েছেন, যা গৃহযুদ্ধের সময় (১৮৬১-৬৫) বা প্রথম মহাযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৮) সাময়িকভাবে জারি করা হয়েছিল কিন্তু তখনাে বহাল রয়ে গেছে। মানবাধিকারের রক্ষাকবচ হলাে সতর্কতা এবং নিজের অধিকার সম্বন্ধে সদা সজাগ থাকা। জরুরি আইন মূলতই মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং তা এস্টাবলিশমেন্টের পছন্দ। সুতরাং সজাগ না থাকলে এগুলাে বহাল থাকে এবং ক্রমে নিয়মিত জীবনের অঙ্গ হয়ে যায়। মার্কিন মুলুকে যেখানে গণতন্ত্র শক্তিশালী, সরকারি বিধিনিষেধ তত কঠোর নয়, জনগণ শিক্ষিত ও স্বাতন্ত্রবাদী এবং সুশীল সমাজের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান কাজ করে, সেখানে জরুরি আইনের বাড়াবাড়ির যে চিত্র সিনেটর চার্চ আবিষ্কার করেন, তা ছিল বস্তুতই ভাবনার বিষয়। সিনেটর ফুলব্রাইট অবসর নিলে তার জায়গায় সিনেটর চার্চ সিনেট পররাষ্ট্র কমিটির চেয়ারম্যান হন। তবে ১৯৮৫ সালে তিনি ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেন।
সিনেটর চার্চের সহযােগী ছিলেন তরুণ টমাস ডাইন। টমাস ডাইন অল্প বয়সে ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত চেস্টার বাউলসের স্টাফ ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সিনেটর কেনেডির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অভিযানের স্টাফ হন এবং তারও পরে মার্কিন বিভিন্ন ইহুদি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হন। এরপর তিনি হন ক্লিনটন প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা, ইউএসএইডের সহকারী প্রশাসকদের একজন। টম ও তার স্ত্রী জোন ছিলেন বাংলাদেশ সংগ্রামের নিবেদিত মুক্তিযােদ্ধা। আরও দুজন সিনেটর ছিলেন আমার খুব শ্রদ্ধেয়, জর্জ ম্যাকগভার্ন ও চার্লস পার্সি। দক্ষিণ ডাকোটার সিনেটর জর্জ ম্যাকগভার্ন ছিলেন একজন। নীতিমান জননেতা। একজন ধর্মপ্রচারকের ছেলে, তার মধ্যে ছিল পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। তার সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনবরত কথা বলা যেত এবং তাঁকে মনে হতাে শিশুর মতাে সরল এক ব্যক্তি।
তিনি ১৯৭২ সালে ডেমােক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন লাভ করেন, তবে নিক্সনের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। ইলিনয় রাজ্যের সিনেটর চার্লস পার্সি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী একজন রাজনীতিবিদ। অল্প বয়সে তিনি ব্যবসায় যশ লাভ ও আর্থিক উন্নতির শিখরে পৌছান, সম্ভবত ইলেকট্রনিকসের হিউলেট পাকার্ভ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী পরিচালক হন। তিনি রিপাবলিকান পার্টির প্রগতিশীল গােষ্ঠীতে অবস্থান নেন। একসময় প্রেসিডেন্ট পদের জন্যও বিবেচিত হন। তাঁর। সহকারী স্কট কোহেন আমাদের বন্ধু ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনিও বােধ হয় প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ ছাড়া আরও ডজনখানেক সিনেটর এবং তাঁদের সহকারী আমাদের শুভানুধ্যায়ী ও বন্ধুর ভূমিকা গ্রহণ করেন। আমি নিজে তত কংগ্রেসম্যান চিনতাম না। শুধু কর্নেলিয়াস গালাগারের
১০৫
সঙ্গে খুব সখ্য গড়ে ওঠে এবং ১৯৭৪ সালে তাঁর নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বে আমি তার অভিযানের একজন প্রধান সদস্য ছিলাম। গালাগার নানা মােকদ্দমায় জড়িয়ে পড়লে আর নির্বাচন করতে পারেননি এবং কিছুদিন বােধ হয় কারাবাসও করেন। তাঁর সহকারী চার্লস উইটার ছিলেন আমাদের ফজলে বারীর বন্ধু এবং বাংলাদেশ সংগ্রামের নিবেদিত একজন মুক্তিযােদ্ধা। চার্লস তােতলা ছিলেন কিন্তু তাঁর অনন্ত কর্মক্ষমতা ও চৌকশ বুদ্ধি তাঁর এই দুর্বলতাকে সহজেই ঢেকে রাখত। বছরের শেষের দিকে কংগ্রেসম্যান জেমস কোরমান (ক্যালিফোর্নিয়া ডেমােক্র্যাট), পল ম্যাকলেস্কি (ক্যালিফোর্নিয়া রিপাবলিকান) এবং হেনরি হেলস্টোস্কির (নিউজার্সি ডেমােক্র্যাট) সঙ্গে আমার বেশ পরিচয় হয়। জিম কোরমান ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন। পল ম্যাকলােস্কি ও হেনরি হেলস্টোস্কি বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন স্বীকৃতিদানের পক্ষে ডিসেম্বরেই দাবি তােলেন। ম্যাকলােস্কি পরে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতেও প্রয়াস পান।
কংগ্রেসের কমিটিগুলাে খুবই ক্ষমতাশালী। নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা ছাড়াও যেকোনাে আইন প্রণয়নে তাদের ক্ষমতা অসীম। প্রেসিডেন্ট বাজেট বিল প্রণয়ন করেন কিন্তু কংগ্রেসের কমিটি (সিনেটে ও হাউসে) যেভাবে বাজেট কাটছাট করে, পরিবর্তন বা সংশােধন করে, সেটাই শেষ পর্যন্ত পরিষদে বিবেচিত হয়। দুই পরিষদের অভিমত ভিন্ন হলে আবার দুই কমিটি কনফারেন্সে বসে তার সমাধান করে। যেকোনাে বিষয় বিবেচনা উপলক্ষে এসব কমিটি শুনানির ব্যবস্থা করে। শুনানিতে নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা সাক্ষ্য দেন এবং কমিটি অন্য বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য শােনে। সদস্যরা মন্তব্য করেন, নির্বাহী বিভাগের কাছ থেকে তথ্য আদায় করেন, তারপর তাদের প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পরিষদে বিবেচনার জন্য পাঠান। সাধারণত এসব শুনানি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, তবে মাঝেমধ্যে গােপন অধিবেশন হয়। এক্সিকিউটিভ অধিবেশনের আলােচনা গােপনীয় থাকে। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে অনেক শুনানি হয়। সিনেট পররাষ্ট্র কমিটি, শরণার্থী সাব-কমিটি, হাউস পররাষ্ট্র কমিটি (এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সাব-কমিটি) এসব শুনানির আয়ােজন করে। প্রথম শুনানি হয়। হাউস সাব-কমিটিতে, যার চেয়ারম্যান ছিলেন কর্নেলিয়াস গালাগার এবং সর্বশেষ শুনানি হয় সিনেট পররাষ্ট্র কমিটিতে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে।
১১ মে গালাগার সাব-কমিটির শুনানি শুরু হয়। প্রথম দিন তাতে বক্তব্য দেন। চেয়ারম্যান গালাগার ও সিনেটর কেনেডি। বাংলাদেশের অবস্থা এবং বিশেষ করে শরণার্থী ও ত্রাণসমস্যার ওপর ছিল এই শুনানি। শুনানিতে অনেকের মধ্যে দূতাবাসের কর্মচারী আবদুর রাজ্জাক খান উপস্থিত ছিলেন। রাজ্জাক পঞ্চাশের দশকের শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লন্ডনে যান ব্যারিস্টার হবার
১০৬
উদ্দেশ্যে। পরে তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান এবং পড়াশােনা ছেড়ে দিয়ে দূতাবাসে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার চাকরি নেন। তাঁর সঙ্গে আমেরিকার পাকিস্তানি ছাত্রগােষ্ঠীর যােগাযােগ ছিল ঘনিষ্ঠ। ১১ মে রাজ্জাক দূতাবাস থেকে ছুটি নিয়ে গালাগার শুনানিতে যান। কিন্তু পাকিস্তান তখন একেবারে মারমুখাে । তাই রাজ্জাককে দূতাবাস ১৭ তারিখে বরখাস্ত করে। রাজ্জাক বাংলাদেশ লিগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চাকরিমুক্ত হয়ে তিনি সিআরএল গ্রুপের উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন, রেহমানের সহকারী হিসেবে কাজ করেন, বাংলাদেশ ইনফরমেশন। সেন্টারের প্রতিষ্ঠাকালে তিনি এতে কাজ করেন।
আগস্ট মাসে বাংলাদেশ মিশন স্থাপিত হলে তিনি সেখানে যােগ দেন এবং বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরে পরে আত্তীকৃত হন । কিছুদিন নিউইয়র্কে স্থায়ী মিশনে কাজ করার পর তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যােগ দেন। অবশেষে সেখান থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে নিউইয়র্কে স্কার্সডেলে বসবাস করছেন। তাঁর স্ত্রী জাকিয়া আমেরিকায় পড়াশােনাকালে কলেজ-রানি হিসেবে নাম করেন। তিনি মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করে অবসরে গেছেন। কখনো কখনাে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ পরিবেশন বা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। গালাগার শুনানির দ্বিতীয় অধিবেশন হয় ২৫ মে এবং সেখানে সাক্ষ্য দেন নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক গিডন গটলিয়েব এবং হার্ভার্ডের অধ্যাপক রবার্ট ডর্ফম্যান। গালাগার জুনের শুরুতে ভারতে যান এবং বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ঘুরে বেড়ান। তিনি শরণার্থীদের দেশত্যাগ ও দুর্দশার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসেন। ১০ জুন তিনি কংগ্রেসে এ বিষয়ে বিস্তৃত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আমার ১২ বছর পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির অভিজ্ঞতায় এমন দুরবস্থা আমি আর কখনাে দেখিনি । পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার সমাধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একার ক্ষমতায় নেই। তবে এটি পাকিস্তানের একার কোনাে অভ্যন্তরীণ বিষয়ও নয়। এটি উপমহাদেশের শান্তি বিপর্যস্ত করেছে। সেখানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। মানুষের মানবিক অনুভূতির প্রতি শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এবং মানবজাতির সামনে একটি ভয়ংকর ও দুরূহ নৈতিক প্রশ্ন তুলে ধরেছে।
জুন মাসের শুরুতেই ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স আইনের সংশােধনী নিয়ে আলােচনা শুরু হলাে। টমাস ডাইন আর মাইক গার্টনার সিআরএল গােষ্ঠীর সঙ্গে বসে কৌশল নির্ধারণে ব্রতী হলেন। জেরি টিংকার, ডেল ডিহান ও আর্ট কুল তাতে যােগ দিলেন। আর্থার কুল, যাকে আর্ট কুল বলে ডাকা হতাে, ছিলেন সিনেট পররাষ্ট্র কমিটির ডাইরেক্টর এবং সিনেটর ফুলব্রাইটের উপদেষ্টা।
১০৭
সিনেটে চার্চ ও স্যাক্সবি হবেন এই সংশােধনীর উদ্যোক্তা। জন রােডি ও কর্নেলিয়া দুজনের কাছেই তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলেছেন। হাউসেও একটি সংশােধনীর প্রয়ােজন। ফজলে বারী গালাগারের দপ্তরে আগেই তদবির করে গেছেন। গালাগার ভারত থেকে ফিরে এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে রাজি হলেন। তবে তাঁর সহযােগীদের মধ্যে আরও উদ্যোক্তা বের করতে হবে। বাংলাদেশ লিগ ও তাদের সমর্থক এবং সিআরএল গােষ্ঠী এই উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি পরিষদে জোরেশােরে লবি করতে শুরু করল। অবশেষে সিনেট পররাষ্ট্র কমিটি এ বিষয়ে শুনানির ব্যবস্থা করল এবং স্যাক্সবি-চার্চ সংশােধনী পেশ হলাে ১০ জুন। ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্টের ওপর কমিটি শুনানি গ্রহণ করে ১০, ১১ ও ১৪ জুন। জন রােডি এই শুনানিতে সাক্ষ্য দেন এবং সংশােধনীতে বলা হয় যে পাকিস্তানে সব রকমের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত রাখা হবে। তা পুনরারম্ভের শর্ত হবে, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছে এবং ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা ফিরে আসতে এবং তাদের জমিজমা ও সম্পত্তি ফিরে পেতে সক্ষম হচ্ছে। অবশ্য ত্রাণকাজের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানে প্রদত্ত সাহায্য বহাল থাকবে।
১৭ জুন হাউসে কর্নেলিয়াস গালাগার অনুরূপ আরেকটি সংশােধনী উত্থাপন করলেন। অবশ্য এটি একটু নমনীয় ছিল, এতে সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে তত কড়াকড়ি ছিল না। অর্থাৎ সামরিক ঋণের খাতে বিক্রয় বা সরবরাহ এবং সার্ভিস প্রদান স্থগিত রাখা হয়নি। এই সংশােধনী পাস করবার জন্য শুরু হলাে তদবির এবং এর জন্য লবি করা হলাে পরবর্তী পাঁচ মাসে বাঙালি ও তাদের মার্কিন সমর্থকদের প্রধান কর্তব্য। এ কাজেই ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারের সৃষ্টি হয় এবং এ কাজেই আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশ মিশন বিশেষভাবে ব্যস্ত থাকে। এই সংশােধনী নিয়ে আমরা নানা ব্রিফিং নােট, প্রতিবেদন, যুক্তিজাল ইত্যাদি প্রস্তুত করি। সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের এবং তাদের সহকারীদের সম্বন্ধে অভিমত লিপিবদ্ধ করে কার্ড বানাই। তাঁদের কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, তার জন্য কৌশল রচনা করি। এ কাজে প্রধান উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার এবং সিনেটে আমাদের বন্ধুস্থানীয় কতিপয় সিনেটরের সহকারীরা। সিআরএল গােষ্ঠীর কথা তৃতীয় অধ্যায়ে কিছুটা আলােচনা করেছি। কর্নেলিয়া রােডি ওয়াশিংটনে আসার। পর রীতিমতাে একটি লবিস্ট এজেন্সি সংগঠনের চিন্তাভাবনা চলে। বােস্টন থেকে আনা টেইলর ও ডেভিড ন্যালিন এবং শিকাগাে থেকে রন ইন্ডেন ওয়াশিংটনে। এসে এই উদ্যোগে শামিল হন। বাংলাদেশ লিগের বিবেচনায়ও এ রকম একটি
১০৮
সংগঠনের গুরুত্ব প্রাধান্য পায়। এ বিষয়ে নেতৃত্ব দেন উইলিয়াম গ্রিনাে। ১১ জুন এই উদ্যোগ একটি নির্দিষ্ট সংগঠনের রূপ নেয়।
গ্রিনাে ও রােডি দম্পতি ওই তারিখে একটি নিউজ লেটার প্রচার করেন। এই চিঠিটি ডা. গ্রিনের বাড়ির ঠিকানা ১২০৩ পপলার হিল রােড, বাল্টিমাের থেকে প্রচারিত হয়। এতে বলা হয় যে কংগ্রেসে বাংলাদেশ সমস্যা যথেষ্ট সহানুভূতি উদ্রেক করতে সক্ষম হয়েছে এবং তার জন্য সংবাদ সরবরাহ ও তদবির অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু হােয়াইট হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে কোনােমতেই কূলকিনারা মিলছে না। এতে সংবাদ সরবরাহ ও তদবির বজায় রাখার জন্য অর্থসাহায্য চাওয়া হয় এবং বলা হয় যে ওয়াশিংটনে এ জন্য অচিরেই একটি কেন্দ্রীয় দপ্তর স্থাপন করা হবে। সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানরা যখন বাংলাদেশ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন, তখন সহজেই বােঝা যায় যে বাংলাদেশ ও তার সমস্যা সম্বন্ধে কংগ্রেস ও অন্যান্য মহলকে আরও ওয়াকিবহাল করতে হবে এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাবলির খবরাখবর সরবরাহ করতে হবে। এক হিসাবে খবরই সত্যিকার ক্ষমতা। তাই এর বিস্তারই হয় সিআরএল গােষ্ঠীর লক্ষ্য। এই চিঠিতে কংগ্রেসে সংশােধনী উদ্যোগের কথা বলা হয় এবং এ বিষয়ে প্রতিনিধিদের সঙ্গে তদবির করার জন্য তাঁদের একটি ফর্দও সরবরাহ করা হয়। কিছুদিনের মধ্যে ওয়াশিংটনে যে একটি শক্তিশালী লবিং প্রচেষ্টা পরিচালনা করা হয়, এভাবেই হলাে তার সূচনা।
পরবর্তী নিউজলেটার প্রচারিত হলাে ২৩ জুন এবং ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার খবর এতে দেওয়া হলাে। একই সঙ্গে সূচনালগ্ন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত এই উদ্যোগের জন্য প্রাপ্ত চাঁদা ও ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হয়। মােট প্রাপ্তি ছিল ১০৫২ ডলার আর ব্যয় ছিল ৮৩৩ ডলার ১০ সেন্ট। ২৪ জুলাই সেন্টারের তরফ থেকে প্রথম নিউজলেটার প্রচারিত হলাে। এটা প্রচার করেন ৪১৮ সিওয়ার্ড স্কয়ার (অ্যাপার্টমেন্ট ৪), ওয়াশিংটনে প্রতিষ্ঠিত সেন্টারের তরফ থেকে আনা টেইলর, উইলিয়াম গ্রিনাে, ডেভিড ন্যালিন ও মহসিন সিদ্দিক। এতে বলা হয় যে সেন্টারটি হবে একটি ক্লিয়ারিং হাউস এবং সমুদয় লবিং কাজের সমন্বয়কেন্দ্র। এটি হবে সব বাংলাদেশ সমিতি ও সমর্থক গােষ্ঠীর সম্মিলিত কেন্দ্রীয় দপ্তর। স্বেচ্ছাসেবীদের সেন্টারের জন্য কাজ করতে আহ্বান জানানাে হয়। প্রথম স্বেচ্ছাসেবী দলে ছিলেন আনা টেইলর (সার্বক্ষণিক), ডেভিড ন্যালিন (খণ্ডকালীন) এবং অনিয়মিতভাবে ডা. গ্রিনাে, মহসিন সিদ্দিক, মুহাম্মদ ইউনূস ও ফরহাদ ফয়সল। বাংলাদেশের খবর, কংগ্রেসে উদ্যোগ, বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকাণ্ড—সবকিছু নিয়ে এই নিউজলেটার প্রস্তুত করা হয়। পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই
১০৯
চিঠিতে বিভিন্ন মার্কিন সমুদ্রবন্দর থেকে যেসব জাহাজ সমরাস্ত্র নিয়ে যেতে পারে, তার একটি নির্ঘণ্ট প্রকাশ করা হয় এবং এগুলােকে পিকেট করার আহ্বান। জানানাে হয়।
একই সময়ে ফিলাডেলফিয়ায় বাঙালি এবং তাঁদের মার্কিন বন্ধুরা মিলে ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গল নামে একটি সংগঠন স্থাপন করেন। তাঁদেরও উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সম্বন্ধে প্রচার, বাংলাদেশের জন্য জনসমর্থন আদায় এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য প্রদান। এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন নিউজার্সির মজহারুল হক ও ফরিদা হক, অধ্যাপক চার্লস কান, ক্লাউস ক্রিপেনডর্ফ এবং সুলতানা আলম, মােনায়েম চৌধুরী ও রওশন আরা চৌধুরী । মজহারুল হক (টুনু হক নামে সমধিক পরিচিত) বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দুই ক্লাস ওপরে পড়তেন, ফরিদা দুই ক্লাস নিচে। তাঁরা সেই পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি আমেরিকায় পাড়ি জমান। এখন ওয়াশিংটনের শহরতলিতে থাকেন। প্রাক-বাংলাদেশ যুগে যত মধ্য ও উচ্চবিত্ত বাঙালি আমেরিকায় গেছেন, নিউজার্সিতে হক দম্পতির বাড়ি হয়েছে তাদের একটি আড্ডাখানা। তিনি ১৯৭১ সালে বৃহত্তর ডেলাওয়ার উপত্যকার বাংলাদেশ লিগের সভাপতি হন। চার্লস কান ছিলেন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক। তিনি হন ফ্রেন্ডস অব ইস্ট বেঙ্গলের সভাপতি। ক্লাউস ক্রিপেনডর্ফ ছিলেন আরেকজন অধ্যাপক এবং তখন তাঁর স্ত্রী ছিলেন। সুলতানা আলম। ক্লাউস বােধ হয় এখনাে ফিলাডেলফিয়ায় আছেন। মােনায়েম চৌধুরী ছিলেন পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা, তখন পেনসিলভানিয়ায় উচ্চশিক্ষায় রত । তিনিও এখন পেনসিলভানিয়ার অধিবাসী। বােধ হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এ ছাড়া আরও বাঙালি অনেকেই ছিলেন, গােটা তিরিশেক পরিবার।
মার্কিন মহলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছাড়া একটি বড় সমর্থক গােষ্ঠী ছিল কোয়েকার ধর্মীয় গােষ্ঠী, যাদের নেতা ছিলেন উইলিয়াম টেইলর। তাঁরা এপ্রিলেই সংগঠিত হতে থাকেন, যদিও সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ২৪ জুন। তারা নিউইয়র্কে ও ওয়াশিংটনের সব উদ্যোগে অংশ নিতেন, নিজেরা নিউজলেটার প্রকাশ করতেন, আলােচনা সভা ডাকতেন। তাঁদের অন্যতম অবদান ছিল পাকিস্তানে সমরাস্ত্র জাহাজীকরণের প্রতিবাদ এবং এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। মার্কিন লংশােরম্যানরা কোনাে জাহাজে পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র ওঠাবেন না বলে একটি সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল ফিলাডেলফিয়ার জোর তদবির; তাঁদের হয়ে সুলতানা মায়ামিতে লংশােরম্যানদের বার্ষিক সম্মেলনে হাজির হয়ে বক্তব্য দেন। ১২ জুন তাঁরা নিউইয়র্কের বিক্ষোভে যােগ দেন। ওখানে ভারতের সর্বোদ নেতা জয় প্রকাশ
১১০
নারায়ণ বক্তব্য দেন। ১১ জুলাই তাঁরা বাল্টিমােরে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মার লােডিং বন্ধ রাখেন এবং ২৯ জুলাই ফিলাডেলফিয়ায় অহিংস ফ্লোটিলা অভিযান চালান। ছােট ছােট ডিঙির শােভাযাত্রা পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র লােডিং বন্ধ করে দেয়। আগেই বলেছি যে সিউয়ার সিটি বিক্ষোভে তারা বিশেষ অবদান রাখেন। এ দুটি সংগঠন সারা বছর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। অবশ্য এরা ছাড়াও অনেক শহরে আরও অনেক সমর্থক গােষ্ঠী নানা রকম অবদান রাখে। ফিলাডেলফিয়ায় প্রায়ই তহবিল আদায় বা প্রচারসভার জন্য নানা রকম অনুষ্ঠান আয়ােজিত হতাে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এদের দুটি উদ্যোগে হাজির ছিলাম। একটি ছিল তহবিল আদায়ের জন্য ১৭ সেপ্টেম্বরের নৈশভােজ এবং অন্যটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ ও ৯ অক্টোবরের শিক্ষাসভা।
মার্কিন সরকার শুরু থেকেই পাকিস্তানের প্রতি নমনীয় ভাব গ্রহণ করে। এ রকম বর্বরতা ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য নিন্দা তাে দূরের কথা, কোনাে রকমের উদ্বেগ প্রকাশেও সরকারের কুণ্ঠা ছিল। এর বিরুদ্ধে শুধু কংগ্রেস ও সংবাদমাধ্যমই সােচ্চার ছিল না, সরকারি কর্মচারীরাও ছিলেন ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী। তৃতীয় অধ্যায়ে ঢাকার কনসাল জেনারেল ও তার সহকর্মীদের ভিন্নমতের বার্তার কথা বলেছি। তবে মার্কিন সমরাস্ত্র ব্যবহার নিয়ে সাধারণ উদ্বেগের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সরকার ঘােষণা করে, কোনাে সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে না এবং হবেও না। এ ঘােষণা স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ১৫ এপ্রিল দেওয়া হয় ।
১৯৬৫ সালের সমরাস্ত্র সরবরাহের নিষেধাজ্ঞার পর ১৯৭০ সালে একবারের জন্য রেয়াতের কথা প্রথম অধ্যায়ে আছে। এ বিষয়ে কংগ্রেস খুব সক্রিয় থাকে এবং তাই নির্বাহী বিভাগের তরফ থেকে বারবার বলা হয় যে বস্তুতপক্ষে ২৫ মার্চের পর সব সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে, যদিও সরবরাহের সামগ্রী ছিল যৎসামান্য। কিন্তু এই ঘােষণা বা অঙ্গীকার ছিল মিথ্যা এবং এ বিষয়ে হােয়াইট হাউস ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের মধ্যে নীতিগত মতৈক্য ছিল না। স্টেট ও ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট বােধ হয় সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখতেই চেয়েছিল কিন্তু নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির ভাবনা ছিল অন্য রকম। প্রথমত, যেসব চুক্তি ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, তার অধীনে সরবরাহ বন্ধ রাখার কোনাে ইচ্ছা তাদের ছিল না। দ্বিতীয়ত, কোনাে উপায়ে লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করা ছিল। তাদের উদ্দেশ্য। তৃতীয়ত, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অস্ত্র পাচার করার কথাও নিক্সন। বিবেচনা করতে নির্দেশ দেন। এসব তথ্য অবশ্য অনেক পরে জানা যায়, বিশেষ করে যুদ্ধ শেষে এন্ডারসনের প্রতিবেদন থেকে।
জুন মাসে সৌভাগ্যবশত এই মিথ্যা ভাষণের প্রমাণ আমাদের হস্তগত হয় । দূতাবাসে কর্মরত সােলায়মানের মাধ্যমে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র সরবরাহের বিল অব
১১১
লােডিংয়ের খসড়া বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারে পৌছে যায়। সাজেদা সােলায়মান এই খসড়া জোগাড় করেন এবং এনায়েত রহিম এটি ডা. গ্রিনাে ও টমাস ডাইনের কাছে পৌছে দেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর টেড শুলজ এই তথ্য পেলেন ডা. গ্রিনাের কাছে। তারপর তিনি অনেক অনুসন্ধান করে ২২ জুন তাঁর প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তারপরও তিনি ২৫ ও ২৯ তারিখে আরও দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ২২ জুন প্রথম খবর পাওয়া গেল যে পদ্ম জাহাজ সমরাস্ত্র নিয়ে গত রাতে পাকিস্তানের পথে রওনা হয়েছে এবং সুন্দরবন জাহাজ আরও সমরাস্ত্র নিয়ে ৮ মে নিউইয়র্ক ছেড়েছে। পদ্মার ছবিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ২৫ মের খবরে জানা গেল যে এ ছাড়া আরেকটি জাহাজ কাউখালীও নিষেধাজ্ঞা ঘােষণার পর ২ এপ্রিলে নিউইয়র্ক ছাড়ে। ২৯ এপ্রিল জানা গেল যে আরও সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হবে। শুধু নতুন কোনাে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না, তবে আগে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার অধীনে সরবরাহ আটকানাে হবে না এবং তা সহজসাধ্যও নয়। সমরাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে মিথ্যা ভাষণ শুধু সংবাদমাধ্যমে নয়, কূটনৈতিক মহলে এবং বিশেষ করে কংগ্রেসে প্রচণ্ড উত্মা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
সিনেটর কেনেডি তার শরণার্থী সাব-কমিটির শুনানির ব্যবস্থা করেন ২৮ জুন। এতে সাক্ষ্য দেন নির্বাহী বিভাগের অনেক কর্মকর্তা, স্টেট, এইড ও ডিফেন্সের কর্মকর্তারা। যদিও শরণার্থীদের নিয়ে, তাদের অবস্থা, ক্যাম্পে দুর্দশা, বাংলাদেশের বিভীষিকা থেকে পলায়ন এবং ত্রাণকাজের ব্যবস্থা ও অর্থায়ন নিয়েই ছিল মূল আলােচনা; সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে অব্যাহত মার্কিন সমরাস্ত্র সরবরাহ। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ক্রিস ভান হােলেন স্বীকার করলেন যে তারা যখন নিষেধাজ্ঞার কথা ঘােষণা করেন, তখন সম্পাদিত চুক্তির অধীনে সরবরাহ সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন না। তিনি আরও বলেন যে আরও কিছু সমরাস্ত্র (যদিও যৎসামান্য) সম্ভবত জাহাজজাত হবে, তবে নতুন কোনাে নিকাশপত্র বা লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না বা পুরােনাে লাইসেন্স নবায়িত হচ্ছে না। সমরাস্ত্র সরবরাহ অক্টোবরের ৮ তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কিসিঞ্জার এ ব্যাপারে ডিসেম্বরে কৈফিয়ত দিয়ে বলেন যে সমরাস্ত্র সরবরাহ অত্যন্ত গৌণ বিষয় ছিল এবং ৩৫ মিলিয়ন ডলারের সরবরাহ বন্ধ করা হয় শুধু, চার-পাঁচ মিলিয়ন ডলারের সরবরাহ অব্যাহত থাকে। কিসিঞ্জারের কূটনীতিতে নৈতিকতার কোনাে স্থান নেই বলে বিষয়টি তার কাছে অত্যন্ত গৌণ বলে মনে হয়। একটি ঘাতক গােষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ করা, তা যতই সামান্য হােক না কেন, কী রকম জঘন্য কাজ, সেই বােধটিই নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির নির্মম কূটনীতিতে ছিল না।
সিনেটর কেনেডি তাঁর সাব-কমিটির দ্বিতীয় শুনানির ব্যবস্থা করেন জুলাই মাসের ২২ তারিখে। এবার শরণার্থী শিবিরগুলােতে ব্যাধি ও ক্ষুধা এবং
১১২
বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ছিল প্রধান আলােচ্য বিষয়। এতে সাক্ষ্য দেন। স্টেটের আন্ডারসেক্রেটারি জন আরউইন এবং শরণার্থীবিষয়ক সমন্বয়কারী ফ্যাঙ্ক কেলগ। এই শুনানি শেষে পাকিস্তান দূতাবাসের কাউন্সেলর আকরম জাকির সঙ্গে আমার সামান্য বচসা হয়। আকরম জাকি আমার অনেক দিনের পরিচিত। ১৯৫৩ সালে ছাত্রাবস্থায় তিনি বাংলাদেশে আসেন একটি ছাত্র শুভেচ্ছা মিশনের সদস্য হিসেবে। সিলেটে তিনি আমার আব্বার সঙ্গে পরিচিত হন এবং ঢাকায় তারা সবাই সলিমুল্লাহ হলে আমার আমন্ত্রণে অতিথি ছিলেন। আমি তখন হল। ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে তাঁদের দেখাশােনা করি। ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যােগ দেন। ১৯৫৮ সালে বিলেত থেকে দেশে ফেরার পথে আমি ব্রাসেলসে বিশ্ব শিল্পমেলা দেখতে যাই এবং বেশ কয়েক দিন ওখানে থাকতে বাধ্য হই। তখন ওখানে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন বগুড়ার সাত আনি বাড়ির হাবিবুর রহমান, যার ডাকনাম ছিল ভুলু মিয়া এবং আকরম জাকি ছিলেন তৃতীয় সচিব। আমি ব্রাসেলসে থাকতে প্রায়ই আকরম জাকির ওখানে আড্ডা জমাতাম এবং তখনই তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তী সময়ে করাচিতে যখন চাকরি করতাম, তখন আবার তার সঙ্গে যােগাযােগ হয়। আমরা তখন সিন্দ জাতীয় পরিষদ ভবনে কাজ করতাম—আকরম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আর আমি পরিকল্পনা কমিশনে।
বাঙালিদের বিশ্বাস করা যায় না বলে তাঁকে আনা হয় সাময়িকভাবে রাষ্ট্রদূতকে সাহায্য করতে। এবার তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ তেমন ছিল না, তবে তাঁর স্ত্রী দুএকবার যােগাযােগ করেন। শুনানি শেষে আকরম আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিযুক্ত করেন। আমি প্রত্যুত্তরে সহাস্যে বললাম যে আমার দেশপ্রেম অত্যন্ত খাটি আর তিনি একজন জালিমের ভূমিকা নিয়েছেন। আমি বেশ রূঢ়ভাবেই তাকে বললাম, তােমরা আমাদের দেশ থেকে বিদায় নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। শরণার্থী সাব-কমিটির স্টাফরা তখন আমাদের কাছে ভিড় করতে শুরু করেছে। আকরমকে তাঁর সহকারী কুতুবুদ্দিন আজিজ টেনে নিয়ে বিদায় হলেন। আকরমের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে দেখা ম্যানিলায়, সম্ভবত ১৯৭৫ সালে। তখন তিনি ওখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং আমি এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক। দুই দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের সম্পর্ক ছিল স্বাভাবিক সৌজন্যমূলক।
সমরাস্ত্র সরবরাহের বিস্তৃত বিবরণ যতই বেরােতে থাকল, কংগ্রেসে ধৈর্যচ্যুতির ব্যাপারটা ততই প্রকট হয়ে দেখা দিল। ১ জুলাই দুজন
১১৩
ম্যাসাচুসেটসের প্রতিনিধি ব্র্যাডফোর্ড মাের্স—যৌথভাবে সামরিক সাহায্য, বিক্রয় বা সরবরাহ বন্ধের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করেন। সিনেট প্রস্তাব নম্বর ১২৪ এবং হাউস প্রস্তাব নম্বর ৭৬৫। কিন্তু এসব কোনাে কিছুতেই সামরিক বর্বরতার প্রতি আমেরিকার সমর্থন শিথিল হলাে না। ডিসেম্বরের যুদ্ধের সময় দেখা গেল যে মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ ইজারায় পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে। ইলিনয়ের সিনেটর আদলাই স্টিভেনসন (তৃতীয়) ১৪ ডিসেম্বর এই তথ্য ফাঁস করেন। কিসিঞ্জারের জবানিতে জানা যায় যে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সমরাস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য উদ্যোগ ছিল আণবিক অস্ত্রসজ্জিত জাহাজ এন্টারপ্রাইজের বঙ্গোপসাগরে যাত্রা। মন্টানার সিনেটর ইগলটন এ খবর প্রকাশ করেন ১৫ ডিসেম্বর। সত্যি সত্যিই ক্ষমতামদমত্ত এক জনবিচ্ছিন্ন জুটি তখন আমাদের তৃতীয় মহাযুদ্ধের মুখে। ঠেলে দিতে মােটেই দ্বিধান্বিত ছিল না।
টেড শুলজের খবর ছিল সামরিক বিষয়ে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের বিপদ দেখা দেয়। ২১ জুন প্যারিসে ছিল পাকিস্তান দাতাগােষ্ঠীর বৈঠক। এ জন্য পাকিস্তানে একটি ব্যাংক ফান্ড মিশন যায় মে মাসের শেষ দিনে এবং প্রায় ১২ দিন সেখানে থেকে সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। এই মিশনের নেতা ছিলেন খােদ পিটার কারগিল আর এর সদস্য ছিলেন মােট ১০ জন—দুজন ফান্ডের, দুজন ব্যাংকের ইসলামাবাদ দপ্তরের, দুজন ঢাকা দপ্তরের আর চারজন ওয়াশিংটন থেকে। তাদের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় জুলাই মাসে, তবে প্যারিসে কারগিল একটি মৌখিক বিবরণ দেন। প্রতিবেদনের মূল কথা ছিল বাংলাদেশে ভীতির রাজত্ব এবং অস্বাভাবিক অবস্থা। দাতাগােষ্ঠীর সভায় ঠিক হয় যে অবস্থা স্বাভাবিক না হলে কোনাে রকম অর্থনৈতিক সাহায্য কাজে আসবে না এবং পাকিস্তানও কোনাে রকমের সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে পারবে না। সুতরাং ওই পর্যায়ে সাহায্যের বিষয়টি বিবেচনা করা সমীচীন হবে না এবং ঋণ রেয়াতির ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। শুধু মার্কিন সরকার ছাড়া কেউই পাকিস্তানের অনুরোধ বিবেচনা করতে রাজি ছিলনা। ২৬ তারিখে ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকার বার্নার্ড নসিটার খবর দিলেন যে কারগিলের বিবৃতি ছিল মারাত্মক, একেবারে বিধ্বংসী এবং আমেরিকাও শেষ পর্যন্ত সাহায্য স্থগিত রাখার ব্যাপারে রাজি হয়। ওয়াশিংটন পােস্ট সামরিক সরবরাহের খবরটি দিতে পারেনি। এবার তার খেসারত দিল তারা অর্থনৈতিক অঙ্গনের বিস্তৃত তথ্য সরবরাহ করে। তবে ২৩ তারিখে ওয়াশিংটন পােস্ট খুব সুন্দর একটি সম্পাদকীয় লিখেছিল যখন নিষেধাজ্ঞা একটি নিষেধাজ্ঞা নয়’ (When an Embargo is not an Embargo) শিরােনামে।
১১৪
মার্কিন সরকার কিন্তু নসিটারের বক্তব্য মানল না। শরণার্থী সাব-কমিটির শুনানিতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বক্তব্য হলাে যে অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত রাখা। তারা সমর্থন করে না এবং মার্কিন সাহায্য অব্যাহত থাকবে। বাস্তবে অবশ্য ১৯৭১ সালে কোনাে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি এবং ত্রাণকাজের জন্য যে সাহায্য দেওয়া হয়, তারও অতি নির্দিষ্ট ভাগ খরচ করা হয় । তবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বক্তব্য সর্বসাধারণের কাছে মােটেই গ্রহণযােগ্য ছিল না। ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজতার ওপর সম্পাদকীয় লিখল : ‘আরও বাঙালি হত্যায় সাহায্য (Helping to kill more Bengalis)। বার্নার্ড নসিটার ৮ জুলাই আবার খবর দিলেন যে বিশ্ব ব্যাংক পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর যে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে, তাতে তারা পাকিস্তানকে কঠোরভাবে সমালােচনা করেছে, যে কারণে প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারা ওই সাহায্য বিতরণ স্থগিত রেখেছেন।
আগেই বলেছি যে ব্যাংক মিশন বাংলাদেশে যাবার প্রাক্কালে মাইক উইহেন ও হেনরিক ভানডার হাইডেনের সঙ্গে আমার লম্বা আলােচনা হয়। তারা ফিরে এলে মাইক খবর দিলেন এবং তাঁর সঙ্গে এবং ম্যানফ্রেড ব্লোবেলের সঙ্গে পৃথকভাবে আমার আবার আলােচনা হলাে। ম্যানফ্রেড ব্লোবেল ছিলেন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। ব্লোবেল জানালেন যে দেশটির অবস্থা খুবই অনিশ্চিত এবং অর্থনীতি একান্তই অচল। এমতাবস্থায় পাকিস্তান কোনাে রকম অর্থনৈতিক সাহায্যের ব্যবহারই করতে পারবে না। তাদের ঋণ রেয়াতির আবেদন যৌক্তিক, কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে না এলে প্রয়ােজনীয় সংস্কারে হাত দেওয়া যাবে না। তাই ঋণের বােঝা লাঘব করলেও পাকিস্তানের ঋণ পরিশােধের ক্ষমতা বাড়বে না। সুতরাং এই মুহূর্তে দেশটিকে ঋণ রেয়াত দেওয়া যাবে না। ব্লোবেলের কথাবার্তায় সােজা ও পরিষ্কার বক্তব্য বেরিয়ে এল। ব্লোবেল। মােটামুটিভাবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে ভালাে ধারণা পােষণ করতেন। তাই তাঁর বক্তব্যে হতাশা এবং একধরনের ক্ষোভ সহজেই ধরা পড়ল ।
মাইক জার্মান হলেও অনেকটা হৃদয়তাড়িত মানুষ। মাইক আমার বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের কুশলবার্তা নিয়ে আসেন। মাইক বললেন যে তিনি মাহবুবুজ্জামানের সঙ্গে সিলেটে গিয়েছিলেন। মাহবুবুজ্জামান তখন চা বাের্ডের সভাপতি ছিলেন এবং বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসর নেন। পরে তিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সিলেটে তাঁরা এক রাত ছিলেন সার্কিট হাউসে। সেখানে নৈশভােজে জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় সেনাপতিদের সঙ্গে তাদের মােলাকাত হয়। মাইক বললেন যে সেনাধ্যক্ষরা তাদের মানুষ নিধনের কাহিনি নিয়ে গল্প করছিল আর তার ধারণা হলাে যে বিষয়টি তাদের জন্য ছিল একটি খেলা, যেন তারা পাখি শিকারে বেরিয়েছে। মাহবুবুজ্জামান নাকি তাদের
১১৫
ব্যবহার অপছন্দ করেন এবং তাদের দলাধিপতির কাছে অভিযােগ করেন। কৃষিসচিব সালাহউদ্দিন মিশনকে তাদের গর্বাধ্য বক্তব্য তুলে ধরেন, সভা শেষে নিরিবিলিতে তাঁকে বলেন যে সরকারি বক্তব্য ও বাস্তবের মধ্যে কোনাে সম্পর্ক নেই। সালাহউদ্দিন বাংলাদেশে সচিব হন এবং পরে বিশ্ব খাদ্য সংস্থার উপপরিচালক হিসেবে অবসর নেন। সালাহউদ্দিন ২০১৬ সালে ওয়াশিংটনে ইন্তেকাল করেন।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন যে পাকিস্তানের কড়া সমালােচনা করবে, তাতে কোনাে সন্দেহ ছিল না। তবে নসিটারের খবরের পর সেই প্রতিবেদন জোগাড়ের হিড়িক পড়ে গেল। আমি দুটি প্রতিবেদনের খসড়া পেয়ে গেলাম হারুনের কাছে। একটি ছিল ভানডার হাইডেনের মাঠপর্যায়ের প্রতিবেদন। এটি ছিল অভ্যন্তরীণ একটি খসড়া । তিনি খুলনা, চালনা, যশাের আর কুষ্টিয়া গিয়েছিলেন এবং এসব জায়গায় কী দেখলেন, তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। এই প্রতিবেদনটির তারিখ ছিল ২৩ জুন। অন্যটি ছিল কারগিল প্রতিবেদনের প্রাথমিক খসড়া। এটিকে খানিকটা সংশােধন করে কিছু কড়া মন্তব্য নমনীয় করে ১৫ জুলাই বিতরণ করা হয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেদন দুটি নিউইয়র্ক টাইমস-এর কাছে পৌছে দিই। ১৩ জুলাই টেড শুলজ আবার একটি মারাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন এবং তাতে কারগিল ও ভানডার হাইডেন প্রতিবেদন থেকে কিয়দংশ উদ্ধৃত করেন। এ দুটি প্রতিবেদন একই সঙ্গে আমি মুজিবনগরেও পাঠিয়ে দিই।
কিছুদিন পর খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকে অনুসন্ধান চালানাে হয়। গ্রেগরি ভােটা এ বিষয়ে আমাকে কিছু প্রশ্ন করেন। আমি পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে দিলেও বিশ্ব ব্যাংকে আমার যাতায়াত ছিল অবারিত। আমার মনে হলাে, বিল ম্যাকুলককে দোষী সাব্যস্ত করার জন্যই এই অনুসন্ধান পরিচালিত হয়। বিল সম্বন্ধে আগেই বলেছি যে তিনি খুব স্বাধীনচেতা লােক ছিলেন এবং উত্তেজিত হওয়া তার স্বভাবেই ছিল। সৌভাগ্যবশত এই প্রতিবেদন দুটো আমাকে বিলের কাছে চাইতে হয়নি। তাঁর কাছে চাইলে তিনি যেভাবেই হােক না কেন, তা আমাকে সরবরাহ করতেন। পাকিস্তান ডেস্কের সব কাগজপত্রই বিশেষ প্রকল্প বিভাগে বিতরণ করা হতাে। সেখান থেকে যে এগুলাে প্রকাশিত হতে পারে, অনুসন্ধানে সেদিকে মােটেই খেয়াল করা হয়নি। অনেকের ধারণা ছিল যে কারগিল এই প্রতিবেদনের প্রচার স্থগিত হলে বিরক্ত হন এবং নসিটারের সব তথ্য তাঁর কাছ থেকেই প্রচারিত হয়। এত বড় প্রতিষ্ঠানে যেখানে গােপনীয়তার কালচার তেমন শক্ত নয়, সেখানে এ ধরনের তথ্য ফাঁসের বিষয় মােটেও অস্বাভাবিক নয়। পাকিস্তানের নালিশের কারণেই অনুসন্ধানটি পরিচালিত হয়। তবে তাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
১১৬
বিশ্ব ব্যাংক মিশন ১৯টি জেলার ১২টিতে ভ্রমণ করে এবং বাংলাদেশের অবস্থার ৪টি বিশেষত্ব চিহ্নিত করে। প্রথমত, সারা দেশে ধ্বংসলীলার প্রধান হােতা ছিল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। দ্বিতীয়ত, যােগাযােগ ও যানবাহনব্যবস্থা পুরােপুরি ব্যাহত। তৃতীয়ত, দেশ থেকে যানবাহন সব উধাও হয়ে গেছে। কিছু গেছে। বিদেশে, প্রচুর ধ্বংস হয়েছে আর বাকি চলে গেছে যুদ্ধসজ্জায় এবং সবশেষে দেশব্যাপী ভীতি ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ, যার প্রধান কারণ হচ্ছে সামরিক বর্বরতা ও নিষ্পেষণ । এর ফলে অর্থনীতি হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অচল এবং অদূর ভবিষ্যতে তার চাঙা হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা ছিল না। ভানডার হাইডেনের প্রতিবেদনটি ছিল মারাত্মক। খুলনা প্লাটিনাম চটকল এলাকা সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য ছিল যে এটি দেখে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি এলাকার কথা তার মনে হয়। কুষ্টিয়া যেন ছিল মহাযুদ্ধের বােমায় বিধ্বস্ত একটি এলাকা। সেখানকার অবস্থা ও অল্প কিছু বিহ্বল লােকজনকে দেখে মনে হয় আণবিক বােমাবর্ষণের পরবর্তী সকাল। কুষ্টিয়া যেন ছিল পাকিস্তানিদের ‘মাইলাই। ভিয়েতনামের মাইলাইতে মার্কিন সেনাবাহিনী উন্মাদের মতাে গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চালায় এবং তার জন্য সেনাবাহিনীর একজন। অধিনায়কের কোর্ট মার্শাল হয়। হাইডেন বিভিন্ন জায়গায় যান এবং সবখানেই দেখেন যে লােকজন সব পালিয়েছে এবং সরকারি কর্মচারীদের অনেকেই খুন হয়েছেন। এ দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটির পক্ষেও পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান অসম্ভব হয়ে পড়ল।
কনসাের্টিয়ামের সভায় সাহায্য না মিললে পাকিস্তান সরকার কিছু বাঙালি দালালকে ওয়াশিংটনে পাঠাল বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে দেনদরবার করতে এবং মার্কিন মুলুকে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালাতে। ৩ জুলাই এলেন সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন ও বিচারপতি নুরুল ইসলাম। সাজ্জাদ তখন রাজশাহী থেকে এসে ঢাকায়। উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছেন আর নুরুল ইসলাম হয়েছেন রেডক্রসের সভাপতি। সাজ্জাদ তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বাংলাদেশের শত্রুতা করেছেন, যদিও কিছুদিন সৌদি আরবের হাওয়া খেয়ে পরবর্তী সময়ে এ দেশেরই অন্ন-বস্ত্র সাবাড় করেছেন। নুরুল ইসলাম কিছুদিন জেল খেটে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপােষকতায় এ দেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পুনর্বাসিত হন। তারপর জেনারেল এরশাদের সৌজন্যে আইনমন্ত্রী এবং উপরাষ্ট্রপতি পদও অলংকৃত করেন। পরে দুষ্কর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে এসে পুনর্বাসনের নতুন উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁদের ব্যবহার ছিল পাকিস্তানি ক্রীতদাসের উপযুক্ত এবং তাই সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। এ ছাড়া আরও কয়েকজন অপরিচিত দালাল এসেছিলেন, যাদের উপস্থিতি আমরা মােটেই টের পাইনি। এ রকম দুজনার নাম আমার মনে আছে, একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক
১১৭
মােহর আলী এবং আরেকজন শিক্ষক কাজী দীন মােহাম্মদ। ৫ জুলাই কিন্তু দুজন ভারী ওজনের দালাল এসে পৌছালেন ওয়াশিংটনে। মাহমুদ আলী ও হামিদুল হক চৌধুরী। মাহমুদ আলী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দ্বিতীয়বার আমেরিকায় আসেন। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে।
পাকিস্তান কনসাের্টিয়ামের জন্ম হয় ১৯৬০ সালে । ১৯৫৮ সালে ভারত তার দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বৈদেশিক মুদ্রাসংকটের সম্মুখীন হয়। পাঁচসালা পরিকল্পনার দুই বছর শেষে দেখা গেল যে প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব ব্যাংকের উদ্যোগে তখন ভারতের দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য একটি উদ্ধারকার্য শুরু হয়। এই উদ্ধারকার্যে বিশ্ব ব্যাংকের নেতৃত্বে অংশ নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পশ্চিম জার্মানি, জাপান ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। ১৯৫৮ সালের ২৭ আগস্ট এসব দাতা ভারতকে এক বছরের জন্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের ব্যবস্থা করে । পরবর্তী বছরের ১৭ মার্চ এই দাতাগােষ্ঠী আরও ২৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। ইতিমধ্যে দাতাগােষ্ঠীর মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসে নতুন উদ্যোগের সূচনা হয়। সিনেটর শারমান কুপার ও সিনেটর জন কেনেডি, পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি, ভারতের জন্য একটি নিয়মিত দাতাগােষ্ঠী গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। হাউসে কংগ্রেসম্যান চেস্টার বাউলস এ রকম আরেকটি প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। সিনেটর কেনেডি মার্কিন সরকারকে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য সাহায্য সংস্থা। গঠনে পরামর্শ দেন এবং বিশ্ব ব্যাংককে এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে বলেন। বিশ্ব। ব্যাংকের সভাপতি ইউজিন ব্ল্যাক ‘তিনজন বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে ভারত ও পাকিস্তানে অবস্থা বিশ্লেষণে পাঠান। তারা তিনজন ছিলেন আমেরিকার এলান স্পাউল, ব্রিটেনের স্যার অলিভার ফ্রাঙ্কস এবং জার্মানির হারমার্ন অ্যাবস। তারাই ভারত ও পাকিস্তানের জন্য সাহায্য কনসাের্টিয়াম গঠনের পরামর্শ দেন।
১৯৬০ সালে তাই দুটি কনসাের্টিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল এসব দেশের উন্নয়ন উদ্যোগে বুদ্ধি দান এবং অর্থসংস্থান। ১৯৬২ সালে প্যারিসের ওইসিডি তুর্কির জন্য একটি দাতাগােষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯৬৩ সালে বিশ্ব ব্যাংক নাইজেরিয়া, কলম্বিয়া, সুদান ও তিউনিসিয়ার জন্য দাতাগােষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে, তবে এগুলাের নাম হয় কনসালটেটিভ গ্রুপ, কনসাের্টিয়াম নয় । ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জন্য যে দাতাগােষ্ঠী স্থাপিত হয়, তার নাম হয় এইড গ্রুপ। সে সময় এ ধরনের ২০টি দাতাগােষ্ঠী ছিল এবং ১৮টিতেই বিশ্ব ব্যাংক নেতৃত্ব দিত। তুরস্কের জন্য ছিল ওইসিডি ক্লাব আর ইন্দোনেশিয়ার জন্য নেদারল্যান্ডস ক্লাব (এখন এই দুই ক্লাবেও বিশ্ব ব্যাংক নেতৃত্ব দেয়)। কোনাে
১১৮
কোনাে দাতাগােষ্ঠী বছরে অন্তত একবার সভা করে। যেমন ভারত, পাকিস্তান বা বাংলাদেশ এইড গ্রুপ। আবার কোনােটি কালেভদ্রে বসে, যেমন সুদান বা নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে। এগুলাের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অর্থসংস্থান; তবে বর্তমানে বােধ হয় নীতিবিষয়ক সংলাপ মুখ্য বিষয় হয়েছে। বর্তমানে এই সব দাতাগােষ্ঠি তেমন নেই এবং তাদের সভাসমিতিও অনেক সীমিত। বহুদিন বাৎসরিক সভা করতাে, কখনাে বছরে একাধিক সভাও করতাে।
এসব দাতাগােষ্ঠী প্রতিষ্ঠার পেছনে দুই রকমের প্রভাব কাজ করেছে। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে নিশ্চয়ই আদর্শবাদ ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী । দাতাগােষ্ঠী গঠনের প্রস্তাব প্রথমে দেন লেডি জ্যাকসন (বারবারা ওয়ার্ড)। তিনি মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন। বারবারা ওয়ার্ড বস্তুতই মানুষের মঙ্গল কামনা করতেন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনহিতে নিবেদিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল তাঁর আদর্শ ও অঙ্গীকার। অন্যদিকে তখন ছিল শীতল যুদ্ধের প্রতিযােগিতা। ভারতে মিশ্র অর্থনীতির সাফল্যকে পুঁজিবাদী দুনিয়া অত্যন্ত গুরুত্ব দিত। কারণ, তখন সমাজতন্ত্রের বিকল্প ছিল তাদের লক্ষ্য। মার্কিন কংগ্রেসের উদ্যোগ এবং বিশ্ব ব্যাংকের নেতৃত্ব যেমন একদিকে ছিল মানুষের মঙ্গলে নিবেদিত, তেমনি আরেক দিকে ছিল কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে মােকাবিলা করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞাপ্রসূত।
১৯৫৮ সালে সিনেটর মনােরােনি এক প্রস্তাবে আইডিএ-র সূচনা করলেন। ভারতের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা গেল যে উন্নয়নের জন্য সহজ শর্তে সাহায্য দরকার, শুধু বিশ্ব ব্যাংকের ঋণে তা সম্ভব নয়। জাতিসংঘে তখন ধনী দেশের অনুদান থেকে একটি উন্নয়ন তহবিল গঠনের জন্য দাবি উঠেছে। ভি কে আর ভি রাও তার জন্য শক্ত অর্থনৈতিক ও মানবিক যুক্তি হাজির করেছেন। সিনেটর মনােরােনি প্রস্তাব করে বসলেন যে এ রকম একটি তহবিল স্থাপনে আমেরিকা উদ্যোগী হােক। এর থেকেই ১৯৬০ সালে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি (আইডিএ) বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠল। এতে দাতাগােষ্ঠী প্রতি তিন বছরের জন্য অনুদান দেয় এবং সে তহবিল গরিব দেশের উন্নয়নে নিয়ােজিত হয়। বাংলাদেশ এই তহবিল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত মােট ৭০০০ মিলিয়ন ডলার পায় ।
মাহমুদ আলী আমাদের ছাত্র বয়সের আদর্শ নেতা, প্রগতিশীল, ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ একবার সিদ্ধান্ত নেয় যে দলের নেতৃত্বে কোনাে ব্যবস্থাপক বা আইনসভার সদস্য থাকতে পারবেন না। তাই প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক দেওয়ান আবদুল বাসেতকে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর তার পদ ছাড়তে হলাে। সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ
১১৯
সম্পাদক বানান। পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগে মাহমুদ আলী বিশেষ স্থান পেলেন না । তবে তিনি সিলেটের সব প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং ছাত্রদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী হাজেরা মাহমুদও ছিলেন ছাত্রদের অত্যন্ত প্রিয়। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে এবং ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় শান্তি আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৫১ সালে মুসলিম লীগ ছেড়ে তিনি হন যুবলীগের প্রাদেশিক সভাপতি। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের পক্ষে আইন পরিষদের সদস্য হন এবং পরবর্তী সময়ে ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যােগ দেন। কৃষক-শ্রমিক দলের আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় তিনি প্রাদেশিক মন্ত্রী হন। কিন্তু তার পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল তাঁর যৌবনের আদর্শদীপ্ত নেতৃত্বের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তিনি তখন সুবিধাবাদ ও পাকিস্তান কায়েমি স্বার্থবাদের অন্যতম হােতা। ১৯৬৯-এর গােলটেবিল বৈঠকে তাঁর ভূমিকা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূল। তিনি সে সময় প্রচণ্ডভাবে শেখ। মুজিবের বিরােধিতায় লিপ্ত হন এবং ১৯৭১ সালে জেনারেল ইয়াহিয়ার ক্রীতদাসে পরিণত হন।
আমার আব্বার মৃত্যুসংবাদ ঘােষিত হলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সে বিষয়ে অনুসন্ধান করেন এবং আমাকে সঠিক খবর জানাতে উদ্যোগ নেন। পারিবারিকভাবে তাই আমাদের মধ্যে একটি ভালাে সম্পর্ক ছিল। তিনি ওয়াশিংটনে এসে রাষ্ট্রদূত হিলালির বাড়িতে আস্তানা গাড়েন। আমি তখন দূতাবাস ছেড়ে দিয়েছি। তিনি আমাকে টেলিফোন করেন এবং তার সঙ্গে দেখা। করতে বলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হই, তবে পাকিস্তান দূতাবাস বা রাষ্ট্রদূতের বাড়িতে যেতে আপত্তি জানাই। তখন তিনি বললেন যে বিশ্ব ব্যাংকের পাকিস্তানি সহসভাপতি মােহাম্মদ শােয়েবের দপ্তরে কি আমি তার সঙ্গে দেখা করতে পারি? মােহাম্মদ শােয়েব পাকিস্তানি, তবে আন্তর্জাতিক আমলা। তিনি যখন পাকিস্তানে অর্থমন্ত্রী, তখন আমি সরাসরি তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। এবং তাঁর দক্ষতা অবলােকন করেছি। তার সঙ্গে ওয়াশিংটনেও ভালাে যােগাযােগ ছিল। তাঁর দপ্তরে আমি পৌছালে তিনি আমাদের দুজনকে রেখে অন্যত্র চলে গেলেন।
মাহমুদ আলী প্রথমেই ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতি উষ্ম প্রকাশ করে বললেন, ‘তিলকে তাল করা তাদের স্বভাব। তােমার আব্বার মৃত্যুসংবাদ তাদেরই এক তেলেসমাতি। আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম যে একজন হাফিজ নামের উকিল তাে মারা গেছেন, তা তাে আর অস্বীকার করা যায় না। তার জবাব ছিল যে তেমন কিছু হয়নি, কিছু গােলযােগে সামান্য কজন মারা গেছেন এবং তাদেরও অনেকে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছেন। সিলেটে যারা পাকিস্তানি বর্বরতার
১২০
শিকার হন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দিন আহমদ—হাসপাতালের সুপরিনটেনডেন্ট। তিনি সার্জন, আহত লােকজনকে ছেড়ে পালাতে রাজি ছিলেন না। তাই পাকিস্তানি দস্যুরা যখন শহর দখল করল, তখন তিনি হাসপাতালেই কর্মরত ছিলেন। জল্লাদরা তাঁকে পেয়েই হত্যা করে এবং কয়েক দিন পর্যন্ত তাঁকে দাফন করতে দেয়নি। তাঁর স্ত্রী সিলেট মহিলা। কলেজের প্রিন্সিপাল হােসনে আরা মাহমুদ আলীর একরকমের ভাগনি। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে তার ভাগনি-জামাইকে কেন হত্যা করা হলাে? তাঁর জবাব হলাে, ডাক্তার তাে ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। এ রকম ডাহা মিথ্যা তিনি সজ্ঞানে বললেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলােচনায় মেজাজ ঠিক রাখা বেশ কষ্টকর ছিল। তাঁর বক্তব্যের মােদ্দাকথাটা ছিল, “তােমাদের মুজিব একজন বিদেশি এজেন্ট, দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। আমরা ভারতের হাত থেকে। পাকিস্তানকে বাঁচানাের চেষ্টা করছি। তাঁর কথায় ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছিল বড়ই প্রকট। মাহমুদ আলী আমার স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন এবং সবশেষে উপদেশ দিলেন, কোনাে আন্তর্জাতিক বা বিদেশি সংস্থায় কি তুমি কাজ করতে পারাে না?’ একই উপদেশ দুই মাস আগে দেন ড. নূরুল ইসলাম।
প্রায় দেড়-দুই বছর আগে হাজেরা মাহমুদ ইন্তেকাল করেছেন। মাহমুদ আলী। তারপরই নিঃসঙ্গ ও হৃদরােগী। ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে এপ্রিলে ইসলামাবাদে। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় কয়েক মিনিটের জন্য। পাকিস্তান সরকার তখনাে তাঁকে লালনপালন করছে। তিনি ফেডারেল মন্ত্রীর মর্যাদায় আছেন এবং কনসেপ্ট নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। যৌবনে মাহমুদ আলীর সাপ্তাহিক নওবেলাল ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনের মুখপত্র। ১৯৯৬ সালে কনসেপ্ট ছিল। ঠিক তার উল্টো, মান্ধাতার আমলের সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারার বাহক। এই চিন্তাধারায় বাংলাদেশ তখনাে পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভাের এবং সেই আদর্শে পরিচালিত। তার প্রমাণস্বরূপ তাদের পকেটে আছে জুলফিকার আলী ভুট্টোর একসময়ের ক্রীতদাস সদ্যপ্রয়াত বামপন্থী আবদুল হক, মােহাম্মদ নুরুল্লা নামের এক দেশদ্রোহী কুলাঙ্গার এবং পাকিস্তান সেনা গােয়েন্দা সংস্থার কিছু। এজেন্ট। কনসেপ্ট-এর জগৎটিই কল্পলােক অথচ মাহমুদ আলীর কাছে সেটিই ধ্রুব সত্য ছিল।
হামিদুল হক চৌধুরী এসে উঠলেন পাকিস্তান দূতাবাসের সন্নিকটে এমবেসি রাে হােটেলে। নাফিসা তখন ওয়াশিংটন ছেড়ে জেনেভায় চলে গেছেন, তাই হক চৌধুরী এবার হােটেলে। তাঁর ডাকে একদিন অপরাহ্ েতাঁর হােটেলে গেলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার যে বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্বন্ধে তিনি সত্যভাষণ করলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে যে রকম আগাগােড়া মিথ্যাভাষণ আর বানােয়াট কাহিনি
১২১
রয়েছে, তাতে তাঁর ওই সময়ের সে সত্যভাষণকে অত্যাশ্চর্য বলে মনে হয়। তিনি বললেন যে এমন কোনাে পরিবার বাংলাদেশে নেই, যাদের কেউ না কেউ সামরিক বাহিনীর হাতে, না হয় বিহারিদের হাতে মারা যায়নি। তিনি তার নিজের কিছু আত্মীয়স্বজনের উল্লেখ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে যােগ দিলেন যে ইপিআর ও বাঙালিরাও অনেক পাকিস্তানি নিধন করেছে, যদিও তুলনায় তা যৎসামান্য। তাঁর কথা ছিল, হাজার বছরে উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বা সখ্য হলাে না এবং এর কোনাে ভবিষ্যৎ নেই। ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলবে, মুসলিম তহজিব-তমদুন নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তাই পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝােতা না করে বাংলাদেশের উপায় নেই।
তিনি স্বীকার করলেন যে আগামী কয়েক বছর, হয়তাে এক দশক, বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে থাকতে হবে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি যথাসময়ে নিজেকে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে তিনি টিপ্পনী কাটলেন যে বাঙালির এই দুরবস্থার জন্য সবটা দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের এবং তাদের অদূরদর্শী নেতৃত্বের। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনাে দোষ তিনি দেখতে পান না, তবে ভুট্টো সম্বন্ধে তার যথেষ্ট সংশয় আছে। আগেও বলেছি, জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাঁর কেমন যেন একটি বিশেষ সম্পর্ক ছিল। আলােচনার একপর্যায়ে হক চৌধুরী উত্তপ্ত হয়ে বললেন, তােমার বাংলাদেশ চুলােয় যাবে আর সেখানে আমাকে কখনাে পাবে না। আমরা ভদ্রভাবে এ বিষয়ে আলাপ করার জন্য ১৯৭২-পরবর্তী কোনাে সময়ে জেনেভায় মিলিত হব বলে ঠিক করলাম । ১৯৭২-এর মধ্যে বাংলাদেশ মুক্ত হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস ছিল এবং তার জন্য একটি যুক্তিসম্মত অবস্থানও আমি তত দিনে রচনা করে ফেলেছি। ১৯৭২ সালে ঢাকায় ইস্টার্ন প্রগ্রেসিভ শু ইন্ডাস্ট্রির নুরুল ইসলাম আমাকে জানান যে হক চৌধুরী আমাদের আলােচনার যে বিবরণ তাঁকে দেন, সেটি মােটামুটিভাবে আমার স্মৃতিরই অনুকূল।
হক চৌধুরীর সঙ্গে জেনেভার বৈঠকের সুযােগ আমার আর হয়নি। তবে ১৯৭৭ সালে তিনি যখন তােমার বাংলাদেশে হিজরত করেন, তখন নুরুল ইসলামের মাধ্যমে আমাকে আগাম সংবাদ দেন এবং জানান যে তিনিই ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। অবশ্য বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বােধ হয় আর সেই ভুল স্বীকার করতে তেমন প্রস্তুত ছিলেন না। আমি যখন ওয়াশিংটনে তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, তখন হন্তদন্ত হয়ে রাষ্ট্রদূত হিলালির এক বরকন্দাজ তাঁর দরবারে হাজির হন। তিনি কোনাে একটি চিঠিতে হক চৌধুরীর দস্তখতের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তিনি তাঁকে জানান যে ওই রকম আরেকটি চিঠিতে মাহমুদ আলী ইতিমধ্যে দস্তখত করেছেন আর হিলালি সে চিঠির খসড়া দেখে
১২২
দিয়েছেন। হক চৌধুরী সেই বরকন্দাজকে চিঠির খসড়াটি রেখে চলে যেতে বললেন এবং আরও বললেন যে চিঠিটি যখন তাঁর কাছ থেকে যাবে, তখন। বিষয়টি তিনি আরেকটু বিবেচনা করে দেখবেন । বরকন্দাজ হয়তাে আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, তবে হক চৌধুরী তাঁকে সরাসরি বিদায় নিতে বললেন। বরকন্দাজ ছিলেন একজন ব্যক্তিগত সহকারী এবং হামিদুল হক মন্তব্য করলেন। যে ওদের এই মুরব্বিয়ানা এবং সবজান্তা ভাবই সব অনর্থের মূল।
হামিদুল হক চিঠিটি আমাকে পড়তে দিলেন। এটি ছিল ম্যাকনামারার কাছে একখানা চিঠির খসড়া। সেদিনই তিনি ম্যাকনামারার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, আর এই চিঠিতে তাঁর বক্তব্য লিখে জানাচ্ছিলেন। তার কথা ছিল যে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া পূর্ব পাকিস্তানেরই মঙ্গলের জন্য এবং ওখানে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে গেলে এই সাহায্যের প্রয়ােজন। তিনি আমাকে শুধালেন যে এমন কোনাে শর্ত কি বেঁধে দেওয়া যায়, যাতে সমুদয় সাহায্য শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই খরচ করা হবে? আমার কাছে ব্যাপারটি কৌতুকের বিষয় বলে মনে হলাে। হামিদুল হক বুদ্ধিমান ব্যক্তি, অর্থনৈতিক বা আর্থিক বিষয়ে বেশ চালাক। আমার ছাত্রজীবনে তার আধুনিক চিন্তাধারা আমাকে অভিভূত করে এবং আমার মনে হয়েছে যে তার লােভের কারণও তাঁর দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস। প্রথম যখন তাঁকে দেখি, তখন আমি সদ্য কলেজে ঢুকেছি আর তিনি পূর্ব বাংলার অর্থমন্ত্রী। অনেক রাজনীতিবিদকে চিনি, মন্ত্রীও দেখেছি। কিন্তু এই দেখলাম একজন চতুর লােক, অন্য ধরনের রাজনীতিবিদ। তার মুখে প্রশ্নটা শুনে আমার হাসির উদ্রেক হলাে। পাকিস্তানের সাহায্যের প্রয়ােজন ছিল মনস্তাত্ত্বিক কারণে, সামরিক জান্তার আত্মবিশ্বাসের জন্য এবং আন্তর্জাতিক সমাজে তাদের গ্রহণযােগ্যতার জন্য। আর্থিক সমস্যাটি ছিল নিতান্তই গৌণ। আমি শুধু তাঁকে বললাম, আপনার কাজ আপনি করুন, আমার প্রচেষ্টা হবে সব সাহায্য বন্ধ করা। হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরবর্তী সাক্ষাৎ হয় ১৯৭৭ সালে এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে । সেদিন তার স্নেহময়ী স্ত্রী ইন্তেকাল করেন।
জুন-জুলাইতে আমেরিকার বিভিন্ন বাঙালি সমিতিও সংহত হতে থাকে। শিকাগাে ও নিউইয়র্ক এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নেয়। শিকাগােতে এফ আর খান মে মাসেই বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি নিয়মিত পাক্ষিক সংবাদপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা নেন। ১৭ মে শুরু করে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মােট ১৭টি বাংলাদেশ নিউজলেটার প্রকাশিত হয়। এতে থাকত আমেরিকায় বাঙালিদের উদ্যোগের খবর, বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডের খবর এবং দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র থেকে নেওয়া মন্তব্য। প্রথম দু-একটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন শামসুল বারী, তিনি ডিফেন্স লিগের সম্পাদক ছিলেন। তারপর সব কটি
১২৩
নিউজলেটার সম্পাদনা করেন ভেন্ডারবিল্ট থেকে মুহাম্মদ ইউনূস। ৬ জুন এফ আর খান শিকাগােয় সব বাঙালি সমিতির প্রতিনিধিদের আহ্বান করেন। উদ্দেশ্য ছিল একটি সমন্বয় পরিষদ গঠন করা। এ বিষয়ে খানিকটা দ্বিমত ছিল। অনেক সমিতি ইতিমধ্যে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লিগকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল। তাদের ধারণা হলাে যে নতুন করে আবার সমন্বয় পরিষদ গঠনের প্রয়ােজন নেই। সব সমিতিই একযােগে কাজ করতে পারে। যেমন শিকাগাে লিগের মাধ্যমে ওয়াশিংটন ইনফরমেশন সেন্টারকে সাহায্য দেওয়া যেতে পারে। পশ্চিম উপকূলে লস অ্যাঞ্জেলেসের সমিতি সমন্বয়ের কাজ করতে পারে। নিউইয়র্কের সঙ্গে কিছু সমিতি একযােগে নানা উদ্যোগ নিতে পারে। যা হােক, ৬ জুনের সভায় অনেক সমিতি থেকে প্রতিনিধি হাজির হলেন। ওয়াশিংটন বাংলাদেশ লিগ নিউইয়র্কের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল, কিন্তু তারাও প্রতিনিধি পাঠাল আর আমি হলাম তাদের প্রতিনিধি । নিউইয়র্ক লিগ এ এইচ মাহমুদ আলীকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাল। মধ্য, পশ্চিম ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য থেকে প্রতিনিধিরা এলেন শিকাগােতে।
এই সভায় চাঁদা আদায় ও প্রচারের ওপর খুব জোর দেওয়া হয়। চাঁদা আদায়ের জন্য ট্যাক্স রেয়াতির বিষয়ও বিবেচনা করা হয় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সমর্থন হবে প্রথমত চাঁদা দিয়ে এবং দ্বিতীয়ত স্বেচ্ছাসেবক ও লবিস্ট পাঠিয়ে। আরেকটি বিষয় নিয়েও অনেক আলােচনা হয়। সেটি ছিল বাংলাদেশ মিশন প্রতিষ্ঠা এবং দূতাবাসের কর্মচারীদের আনুগত্য পরিবর্তন। মিশন প্রতিষ্ঠার খরচ আছে এবং সব বক্তা দুটো মিশন চান। একটি নিউইয়র্কে এবং আরেকটি ওয়াশিংটনে। আমি সেখানে তিক্ত কথা বললাম। নিউইয়র্কের মিশন মাহমুদ আলী মে মাস থেকে চালাচ্ছিলেন এবং শত অঙ্গীকারের পরও তাঁকে খরচ চালানাের জন্য এক সেন্টও তখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে দুই মিশনের ধারণা ছিল অবাস্তব। একটি মিশনের খরচ জোগানাের প্রস্তাব আমি দিলাম ।
একটি বিষয়ে আমার মন বেশ খারাপ হয়ে গেল। বিভিন্ন সমিতি প্রতিষ্ঠার হিসাব যখন নেওয়া হচ্ছিল, তখন দেখা গেল যে অনেক উদ্যোক্তা সমিতির সঙ্গে নিজেদের নাম যােগ করতে রাজি নন। তাঁদের আত্মীয়স্বজন দেশে ভােগান্তির শিকার হতে পারেন, এই ভয়ে তারা চিহ্নিত হতে চান না। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার কিন্তু যার এ রকম শঙ্কা রয়েছে, তার পক্ষে অন্য ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে আনুগত্য প্রকাশের জন্য চাপ দেওয়ার কোনাে অধিকার আছে কি না, আমি সেই প্রশ্নটি তুলে ধরলাম। শামসুল বারী এ বিষয়ে দোটানা
১২৪
মনােভাবের নিন্দা করলেন। জাতি হিসেবে জীবন-মরণের সমস্যা যখন এত প্রবল, তখন এ ধরনের গা বাঁচানাের মনােভাব কতটা সংগত। এ প্রসঙ্গে একটি কাহিনি এ সময় বহুল প্রচার লাভ করে। এতে কৌতুক ও রূঢ় বাস্তবতা দুটোই প্রকাশ পায়। কোনাে এক ব্যক্তিকে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে আহ্বান। জানালে তিনি নাকি বলেন যে তাঁর পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তাঁকে লাে-প্রােফাইল বজায় রাখতে হবে। কারণ, দেশে তার পিতা একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। দূতাবাসের কর্মচারীদের অবস্থান সম্বন্ধে আমি একটি সমাধান প্রস্তাব করলাম। যাঁরা দূতাবাসে কাজ করে যাবেন, তাঁদের ঔপনিবেশিক সরকারের অনুগত ভৃত্য হিসেবে বিবেচনা করে দেশের শত্রু মনে করলেই হলাে। সারা দেশ যদি হয় বিদ্রোহী, এদের দখলদারদের প্রতি আনুগত্যে কিছু যাবে-আসবে না। আমার মনে হয়েছিল যে দূতাবাসের কর্মচারীরা আন্দোলনে যােগ দিলে উত্তম কিন্তু তাঁদের যদি অসুবিধা থাকে, তার জন্য মুষড়ে পড়ার বা তা নিয়ে অনবরত সময়ক্ষেপণের প্রয়ােজন নেই।
রাতে ওয়াশিংটনে ফিরলে পরে আতাউর রহমান চৌধুরী খবর দিলেন যে আমাকে পিন্ডিতে বদলি করা হয়েছে। তিনি টিপ্পনী কাটলেন যে পাকিস্তানিরা জেনে গেছে আমি অচিরেই দূতাবাস পরিত্যাগ করছি। কয়েক দিনের মধ্যেই কথাটির যথার্থতা প্রমাণিত হয়ে গেল। আমার উকিল বার্নি আমার হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করছিলেন। তার পরামর্শে আমি স্টেট ডিপার্টমেন্টে বন্ধুস্থানীয় কারাের কাছ থেকে এ ব্যাপারে খবর চাই । তিনি তখন বললেন যে পাকিস্তানিরা বােধ হয় আমার মতলব জানে। প্রচার অ্যাটাশে কুতুব নাকি কথাচ্ছলে তার কাছে জানতে চেয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদানের নীতিটি কী? তাঁর প্রশ্ন ছিল, কোনাে বন্ধুদেশের নাগরিক যদি সেই দেশের বিরােধিতা করে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়, তাকে কি তখন সেই সুযােগ দিতে হবে?’ একই সঙ্গে উদাহরণ হিসেবে তিনি আমার কথাটি তােলেন।
আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে যে কিছুদিন আগে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়ে একটি খবর সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ফলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ও আইন দপ্তর সম্মিলিতভাবে এ ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ নীতি গ্রহণ করে। এস্তোনিয়ার অথবা লিথুয়ানিয়ার একজন নাবিক জাহাজ ত্যাগ করে রাজনৈতিক আশ্রয় চায়। কিন্তু কোস্টগার্ড তাঁকে জাহাজত্যাগী (deserter) হিসেবে জাহাজের ক্যাপ্টেনের হাতে সােপর্দ করে এবং নাবিকটি বােধ হয়