হক ভাসানী সোহরাওয়ার্দী মুজিব - রামেন্দ্র চৌধুরী

   অভিমুখ 

 স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের (১৯৭১ খ্রি.) প্রসঙ্গে প্রথম এবং প্রধানতম নামটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রাসঙ্গিক পূর্বাপর রাজনীতির আলােচনায় অনিবার্যভাবেই উঠে আসে আরাে তিনটি নাম : শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। তাঁদের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং মত-পথ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা বিতর্ক থাকলেও ইতিহাসের স্বীকৃত সত্য হচ্ছে, এঁরাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক চালচিত্রের চারপ্রধান। কখনাে এককভাবে, কখনাে একত্রে, এমনকি কখনাে পারস্পরিক মতভেদবৈপরিত্বের ভেতর দিয়েও, প্রধানত তাঁরাই বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট নির্মাণ এবং প্রভাবিত করেছিলেন। নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে, অতীতের মতই আগামীতেও বহুকাল এঁরা প্রবল প্রাসঙ্গিক থাকবেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে। প্রাজ্ঞজন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর একটা তর্কাতীত পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করা যেতে পারে শুরুতেই : “ইতিহাস একদিকে যেমন সত্যবাদী, আবার অন্যদিকে তার রয়েছে এক ধরণের হেঁয়ালিপনা। খ্যাতিমানের খ্যাতির পাশাপাশি রয়েছে অখ্যাতি। যিনি বীর, তিনিই আবার অবরেণ্য দুর্জন। যে যেভাবে দ্যাখে। সবাই একজন প্রকৃত বীরকে বীরের সম্মান দেবে না, দেয়নি।  ইতিহাসবিদেরাও সবাই সবক্ষেত্রে একমত হতে পারে না। দলীয়-সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের বাইরে সবাই নন, যদিও ইতিহাস তাই দাবি করে”(১(১)/৬৫)। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এক আলােচনায়। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের উল্লেখ করে বলেছিলেন : হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হকের মত অভিজ্ঞ নেতারাও। অনেক অবদান রেখেছেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত তরুণ হয়েও একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না” অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমান একটি মহাকাব্যের নায়ক ছিলেন। এই মহাকাব্য জাতীয়তাবাদের । সকলকে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন, ছাপিয়ে উঠেছেন। কেন পারলেন? অন্যরা কেন পারলেন? প্রধান কারণ সাহস। শেখ মুজিবের মত সাহস আর কারাে মধ্যে দেখা যায়নি। ফাঁসির মঞ্চ থেকে তিনি একাধিকবার ফিরে এসেছেন, আপােষ না করে। শেখ মুজিবের সাহস ব্যক্তিগত স্বার্থের পুষ্টিসাধনে নিয়ােজিত হয়নি। তিনি তাঁর দলের লােক ছিলেন, শ্রেণীরও ছিলেন। কিন্তু পার হয়ে গিয়েছিলেন ওই দুই সীমান্ত, পরিণত হয়েছিলেন জনগণের নেতায়। সাহস মওলানা ভাসানীরও ছিল। ভাসানী পাকিস্তানি শাসকদের দেখেছেন, ওই শাসকদের পেছনে সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থনটাও দেখতে পেয়েছেন। দেখেছেন সামন্তবাদকেও। শেখ মুজিবের দেখাটা ছিল সেই তুলনায় সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। স্বাধীনতা ছাড়া অন্য সবকিছুই যে অসম্ভব, এটা তিনি বুঝে নিয়েছিলেন লক্ষ্য নির্দিষ্ট ও প্রত্যক্ষ ছিল বলেই তার জন্য সাফল্য এল, মওলানার সাফল্যটা কোনাে কেন্দ্রীভূত ও দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ নিল না” (১(২)/৭৮০-৭৮১)। হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিব প্রমুখ চারজনই রাজনীতির মানুষ, আর তাই, সংজ্ঞা-নির্ধারিত জীবনী নয় বরং রাজনীতির আয়নায় প্রতিফলিত তাঁদের জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে চাই। ভারত-ভাগের(১৯৪৭) আগে, বাংলার চারটি ভিন্ন স্থানে, এবং ততােধিক উল্লেখ্য, চারটি ভিন্ন আর্থ-সামাজিক পরিবেশে জন্ম হয়েছিল চারজনের। সাধারণ পর্যালােচনাতেই এ-সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণ-কর্মকে আজীবন প্রভাবিত করেছে শৈশব অভিজ্ঞতার পারিবারিক এবং আর্থ-সামাজিক পরিবেশ। এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের পরীক্ষালব্ধ সত্য হচ্ছে, “Any living being is a product of heredity and environment । বিরল ব্যতিক্রম থাকতেই পারে, কিন্তু ব্যতিক্রমটা সাধারণ নিয়ম নয়। তদানীন্তন বাংলার আর্থ-সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার দিকে, সংক্ষেপে হলেও নজর ফেরালে বাংলাদেশের রাজনীতির চার-প্রধানের জীবন ও কর্মের উপলব্ধি সহজ হতে পারে। গােলাম মুরশিদ লিখেছেন : “দুই বাংলায়  ১৮৮০ সালের দিকে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের ছাড়িয়ে যায়। মুসলমানরা বেশির ভাগ বাস করতেন পূর্ব বাংলায়; আর হিন্দুদের বেশির ভাগ পশ্চিম বাংলায় । শ্রেণী হিসেবেও বাঙালিদের পরিষ্কার দু টি ভাগ ছিলাে। আগে সমাজের উপর তলায় বাস করতেন উচ্চবর্ণের হিন্দুরা আর সামান্য কিছু উর্দু-ভাষী মুসলমান। বাকি শতকরা ৯০ জনেরও বেশি ছিলেন গ্রামের মুসলমান আর নিচু জাতের হিন্দু।  চাষী, জেলে, কামার, কুমাের, লেখাপড়া শেখার প্রয়ােজন তারা বােধ করেননি” (২/১১)। “উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানের সংখ্যা ছিল মুসলমানদের শতকরা দু’ভাগের চেয়েও কম। তারা বেশির ভাগই এসেছিলেন বাংলার বাইরে থেকে। তাদের অনেকেই তাই নিজেদেরকে বাঙালি বলে শনাক্ত করতেন না। সমাজে মস্ত পরিবর্তন এসেছিলাে ইংরেজ আমলে। রাজধানী আসে কলকাতায়। এ জায়গায় যারা বাস করতেন, তারা বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু। মুসলমানও ছিলেন, কিন্তু তাঁরা ছিলেন আধাবাঙালি, কথাবার্তা বলতেন উর্দুতে” (২/১২-১৩)। সারা বাংলায় স্বদেশী আন্দোলনের প্রবল জোয়ার ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি করতে পারেনি। রবীন্দ্র-বয়ানে তার কারণ-সন্ধান করেছেন আবদুশ শাকুর : “এ দেশের কোন সফল কীর্তি আমরা আশা করতে পারি? আদুরে ছেলের মত আমরা আব্দারের ঠোঁট ফুলিয়ে ভাঙবার কাজেই আছি। স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। যে নূতন চেতনা আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল তারপরে একটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা যেমনই ঘটল, অমনই শুরু হল স্বার্থের সংঘাত । অপঘাত ঘটতে বিলম্ব হল না। সেই মহৎ আদর্শকে আমরা আর ফিরে পাইনি। স্বার্থের পাঁকেই গড়াগড়ি দিয়ে মাতামাতি করেছি”(৩/২২৬)। সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন :“ধর্ম ও কৃষ্টির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম দুইটা স্বতন্ত্র সমাজ আগে হইতেই ছিল। অর্থনীতিতে মুসলমানদের অধঃপতনে জীবনের সকল স্তরে হিন্দু ও মুসলমান দুইটা পৃথক জাতি (এভাবে ‘জাতি  গঠিত হয় কিনা, তা এখানে আলােচ্য নয় -র.চ.) হইয়া গেল। পরিস্থিতিটা এমন হৃদয় বিদারক ছিল যে কংগ্রেসের নিষ্ঠাবান কর্মী হইয়াও আমি কংগ্রেস সহকর্মীদের সামনে জনসভায় কঠোর ভাষায় এই পার্থক্যের কথা  বলিতাম : বাংলার জমিদার হিন্দু প্রজা মুসলমান; বাংলার মহাজন হিন্দু খাতক মুসলমান; উকিল হিন্দু মক্কেল মুসলমান;..ইত্যাদি ইত্যাদি। যতই বলিতাম ততই উত্তেজিত হইতাম”(৪/১৬১-১৬২)। এমন পরিস্থিতিকেই যথার্থ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক : “পলিটিকস্ অব বেঙ্গল ইজ ইন রিয়েলিটি ইকনমিকস্ অব বেঙ্গল। বাংলার অর্থনীতিই বাংলার আসল রাজনীতি”। অর্থনীতি ও রাজনীতির আন্ত-সম্পর্কের বিষয়টি দেশ-কাল নির্বিশেষেই অনস্বীকার্য বটে। বামপন্থী রাজনীতিক-লেখক অজয় রায় বলছেন, “মধ্যযুগে ভারতবর্ষের যে অঞ্চল বঙ্গ হিসেবে খ্যাত ছিল তার মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ অঙ্গীভূত ছিল । তবে ভাষার ঐক্য যে এই অঞ্চলের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগােষ্ঠীকে পুরােপুরিভাবে ঐক্যবদ্ধ করে সংহত এক জাতিসত্তায় পরিণত করতে পারেনি তা তাে পরবর্তী কালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান দাবির সপক্ষে বাংলার মুসলিম জনগণের বিপুল সমর্থন থেকে প্রমাণিত। সেদিন এই ঘটনার পিছনে এখানে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির অভাব, ব্রিটিশ সরকারের বিভেদ নীতি। প্রভৃতি কাজ করেছে, এটা সত্য, তবে তার সাথে এটাও সত্য যে, এ দেশের মানুষ ধর্ম ও অন্যান্য বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে তখনাে সংহত জাতিগঠনের পর্যায়ে পৌঁছুতে পারেনি” (৫/৭)। সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক অনুপম সেনের পর্যবেক্ষণ : ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা বাংলাদেশ দখল করার পর, “পারস্পরিক  বিদ্বেষের ফলে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম একশ’ বছরে বাংলার মুসলমানেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হয়। মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের হিন্দু মধ্য-শ্রেণীর একাংশ বিভিন্ন রাজকার্যে নিয়ােজিত হওয়ার লক্ষ্যে ফারসি ভাষার চর্চায় বিপুলভাবে মনােনিবেশ করেছিল।  ফারসির বদলে যখন (১৮৩৭) ইংরেজিকে রাষ্ট্রপরিচালনার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল তখন তারা ইংরেজি চর্চায় মনােনিবেশ করে। কিন্তু মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর পক্ষে ব্যাপারটা অত নির্দ্বন্দ্ব ছিল না।  স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড় আন্দোলনের (১৮৫৭-পরবর্তী) মাধ্যমে মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানানাের পরেই কেবলমাত্র কিছু কিছু মুসলমান ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করে।  মুসলিম মধ্য শ্রেণীর বিকাশ হিন্দু মধ্য শ্রেণীর বিকাশের তুলনায় প্রায় অর্ধশতাব্দী পিছিয়ে পড়ে। এই অসম বিকাশের কারণেই এই উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সুষম বিকাশ হয়নি”(6/vi)। হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক বিভেদ-বিভাজনের কথা বলি অসম বিকাশের কথা কিংবা সামাজিক সাম্প্রদায়িকতার কথা, বিচার্য এমন প্রেক্ষাপটেই। আন্তরিক উপলব্ধির প্রয়ােজনে, এসব কথা স্মরণে রেখেই বারবার ফিরে তাকাতে হবে হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিবের দিকে। 

  চার প্রধানের উৎস সন্ধান : জন্ম, পারিবারিক পরিচয়, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ এবং কর্মজীবনের শুরু। 

  এক নিঃশ্বাসে যখন হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিব বলা হয়, তখন তাঁদের পর্যায়ক্রমিক প্রবীণতার দিকটিও জানা হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) ছিলেন প্রবীণতম আর বঙ্গবন্ধু মুজিব (১৯২০-১৯৭৫) কনিষ্ঠতম। শেরে বাংলা বিভিন্ন উপলক্ষেই মুজিবকে  নাতি  বলে উল্লেখ করেছেন আর ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬ খ্রি.) ‘পুত্রসম’ বিবেচনা করতেন মুজিবকে। সােহরাওয়ার্দীর (১৮৯২-১৯৬৩) বিবেচনায় ‘One of my star organisers’ ছিলেন মুজিব। তারা তিনজনই ছিলেন মুজিবের নেতা এবং রাজনৈতিক গুরু। প্রসঙ্গতই উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে গুরু-শিষ্যে মতান্তর হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণেই, কিন্তু কেউ কখনাে মুজিবকে সরাসরি পরিত্যাগ করেননি। অপরদিকে মুজিব তাঁর নেতা বা গুরুদের সাথে বিভিন্ন সময়ে প্রবল মতভিন্নতার কারণে আপত্তি-অভিমান প্রকাশ করলেও অভিযােগ-বিরােধিতা করেননি কখনাে, সতত সম্মান প্রদর্শন করেছেন যথােচিতভাবেই । লেখক, সংস্কৃতিজন মফিদুল হক উল্লেখ করেছেন, কোলকাতায় ছাত্রজীবনে (১৯৪২- ৪৭) “ফজলুল হকের সান্নিধ্যে এলেও শেখ মুজিব অধিকতর আকৃষ্ট হয়েছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দ্বারা। ফজলুল হকের রাজনীতির তখন এক অস্থির পর্ব চলছে। কৃষক-প্রজা পার্টি গঠন করে বাংলার প্রজাকুলের মধ্যে আলােড়ন তুললেও ফজলুল হক রাজনীতিতে স্থিরপ্রত্যয়ী ছিলেন না। পক্ষান্তরে সােহরাওয়ার্দী বৈপ্লবিক না হলেও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছিলেন স্থিতধী এবং  মুসলিম অভিজাতগােষ্ঠী তথা নবাব পরিবারের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিরােধী। শেখ মুজিবকে বিশেষ স্নেহ দিয়েই বরণ করেছিলেন সােহরাওয়ার্দী এবং তাঁর কাছেই শুরু হয় মুজিবের রাজনীতির পাঠ”(১(৩)/১৫১৮-১৫১৯)। ব্রিটিশভারতে কোলকাতা-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার ধারাবাহিকতায় হক সােহরাওয়ার্দীর পরে আসে ভাসানী-মুজিবের নাম। ব্রিটিশ-ভারতে রাজনীতিতে যুক্ত হলেও ভাসানী-মুজিব গুরুত্ব অর্জন করেছিলেন দেশ-বিভাগের পরে ঢাকা-কেন্দ্রিক রাজনীতিতে। আলােচ্য চার-প্রধানের প্রবীণতম আবুল কাসেম ফজলুল হকের জন্ম বরিশাল। (বর্তমান ঝালকাটি) জেলার সাতুরিয়া গ্রামে। তাঁর পৈতৃক নিবাস বরিশাল জেলার চাখার গ্রামে। শেরে বাংলার পিতা মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ছিলেন বরিশাল জেলার একজন খ্যাতনামা উকিল। মেধাবী ছাত্র ফজলুল হক বরিশাল জেলা স্কুল এবং কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে লেখাপড়ার পর ১৮৯৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৯৭ সালে ডিস্টিংশনসহ বি.এল. পাস করে স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়ের সহকারী হিসেবে কলিকাতা হাইকোর্টে আইনব্যবসা শুরু করেন। তারপর কিছুকাল কলেজে অধ্যাপনা এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করে ১৯১১ সালে আবার হাইকোর্টের আইন ব্যবসায়ে ফিরে আসেন” (৭(৪)/২)। “ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর হতে মৃত্যু পর্যন্ত ফজলুল হক সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। কিন্তু মত ও পথ, লক্ষ্যাদর্শ সম্পর্কে তার কখনও কোন সুস্পষ্ট ধারণা অথবা আস্থা ছিল বলে মনে হয় না। একাধিকবার তিনি ক্ষমতা ও সুনামের সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছেন; কিন্তু কোনােটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবু পল্লীবাংলার মানুষ তাকে ভালােবেসেছে, মনে করেছে, তিনি এক বটবৃক্ষ যার ছায়া তাদের জন্য বরাভয়। ফজলুল হক পল্লীবাংলার দুঃখী মানুষের আপদে বিপদে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেনও। ফজলুল হক সাহেবকে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম সমাজের নির্মাতা বললে অত্যুক্তি হয় না। 

 …সুনির্দিষ্ট মতাদর্শের অভাব এবং সুবিধাবাদী রাজনীতি সত্ত্বেও ফজলুল হক সাহেব বাঙালির ইতিহাসে একজন স্মরণীয় ব্যক্তি”(৮/১৯১-১৯২)। কৃষক-দরদী নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম “সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। অল্প বয়সে পিতামাতার মৃত্যু হলে এক চাচার আশ্রয়ে থেকে মাদ্রাসায় পড়াশােনা করেন। মাদ্রাসা-শিক্ষার শেষে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারির এক প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যােগ দেন। এখানে কৃষকদের ওপর জমিদার-মহাজনদের শােষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। এজন্য তাঁকে কাগমারি ত্যাগ করতে হয়। তিনি আসামের জলেশ্বর চলে যান। সেখানে সুফী সাধক শাহ নাসিরউদ্দিন বােগদাদীর ইসলাম প্রচার মিশনে তিন বছর কাজ করেন। তারপর বােগদাদীর উৎসাহে উত্তর ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন” (৭(৪)/২৪০-২৪১)। উল্লেখ্য যে, “আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসানচরে 

  বাঙালি কৃষকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করার সময় সেখানকার কৃষকসমাজ তাঁকে ‘ভাসানীর মওলানা  বলে ডাকতে শুরু করলে তিনি ‘ভাসানী’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেন। মওলানা ভাসানী ‘মজলুম জননেতা পরিচয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন।। শহীদ সােহরাওয়ার্দী “১৮৯২ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর কলিকাতা মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা স্যার জেহাদুর রহিম জাহিদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন কলিকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি। তিনি কলিকাতা মাদ্রাসা-ই-আলীয়া, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনা করেন। ১৯২০ সালে দেশে ফিরে তিনি কলিকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন” (৭(৫)/৩৪০) । ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলছেন, “সােহরাওয়ার্দী বাঙালি নন, যদিও একসময় আলাদা বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেছিলেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তাঁকে গুরু মানতেন, সেজন্যই হয়তাে অনেকের ধারণা তিনি বাঙালি” (১(১)/২৯২)। পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে তাঁর যতটা গ্রহণযােগ্যতা ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে আদৌ ততটা ছিল না। 

 বৈরুতের হােটেলে মৃত্যুর পরে, স্বজন-পরিজনের সম্মতিতেই তাকে ঢাকায় সমাহিত করা হয়। সুতরাং জন্মসূত্রে যা-ই হােক, বাংলা এবং বাঙালির রাজনীতিবিদ হিসেবেই সােহরাওয়ার্দী স্মরণীয়। তিনি গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ পরিচয়ে উল্লিখিত হয়ে থাকেন। “বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০সালের ১৭ই মার্চ ফরিদপুর (বর্তমান গােপালগঞ্জ) জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সাহেরা খাতুন। তিনি গােপালগঞ্জ থেকে স্কুলের পড়াশােনা সমাপ্ত করে কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৪৭ সালে বি.এ.  পাস করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন”(৭(৫)/২০৪)। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার আন্দোলনে (১৯৪৯) জড়িয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটেছিল। পারিবারিক পরিচয় প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেই উল্লেখ করেছেন : “টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশের নাম কিছুটা এতদঞ্চলে পরিচিত। শেখ পরিবারকে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার বলা যেতে পারে । শেখ বােরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গােড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল, তার প্রমাণস্বরূপ মােগল আমলের ছােট ছােট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরেই জন্মগ্রহণ করি । শেখদের আভিজাত্যটাই থাকল, অর্থ ও সম্পদ শেষ হয়ে গেল” (৯/১-৫)। 

 বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন, “রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ক্ষণজন্মা পুরুষ। তাই বলে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্ষমতার অধিকারী হয়ে জন্মান না। বংশ, বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিত্তের ওপর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকখানি নির্ভর করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে এসবের কোনােটারই বিশেষ ভূমিকা ছিল না । শেখ মুজিবকে কর্মী হিসেবে অন্যদের প্রশংসা কুড়াতে হয়েছে। কর্মী থেকে আঞ্চলিক নেতা এবং আঞ্চলিক বা গােষ্ঠী নেতা থেকে সারা দেশের নেতা হতে শেখ মুজিবকে নিরলস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হয়েছে”(১(১)/৮৯)। সােহরাওয়ার্দীর জন্ম কোলকাতা মহানগরের সমৃদ্ধ চাকরিজীবী পরিবারে। সােহরাওয়ার্দীর পিতৃপরিবারে দৃশ্যমান স্বাচ্ছল্য থাকলেও স্থায়ী সম্পদ-ভিত্তি ছিল না। বাকি তিনজনেরই জন্ম পূর্ব বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে। অর্থনৈতিকভাবে ফজলুল হক ছিলেন উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবেরের সন্তান। ভাসানী এসেছিলেন বিত্তহীন পরিবার থেকে। শেখ মুজিবের জন্ম নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। পারিবারিক আর্থিক অবস্থান এবং স্থানীয় পরিবেশের সুস্পষ্ট ভিন্নতাই তাঁদের রাজনৈতিক জীবনেও ভিন্নতার সূচনা করেছিল। হক-সােহরাওয়ার্দীর রাজনীতির শুরু ‘ওপরতলা’য় নেতার পরিচয়ে, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের (প্রাদেশিক পরিষদ) নির্বাচিত সদস্য হিসেবে। অপরদিকে ভাসানী-মুজিব রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী হিসেবে। কর্মজীবনে হক-সােহরাওয়ার্দী ছিলেন আইনজীবী এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত রাজনীতির পাশাপাশি সেই পেশা-পরিচয় গুরুত্বের সাথেই অব্যাহত রেখেছিলেন। ভাসানী-মুজিবের কার্যত কোনাে পেশা-পরিচয় ছিল না। তারা দু জনেই ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। বলা চলে, জন্মসূত্রে যে পারিবারিক পরিবেশ পেয়েছিলেন, সেটিই হক-সােহরাওয়ার্দীর কর্মজীবনের গতিমুখ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ভাসানী টাঙ্গাইলের কাগমারিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও জমিদার-মহাজনদের বিরূপতার কারণে তিনি চাকরি ছেড়ে স্থানান্তরে | (আসামে) চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুজিবের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণই প্রতিকূলে, তিনি আইনের ছাত্র হিসেবে পরিকল্পিত শিক্ষাজীবন সমাপ্তই করতে পারেননি। ছাত্রজীবনজুড়েই মুজিব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করার পর থেকেই তিনি সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধু পরিচয়ে উল্লিখিত শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জাতিরজনক এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে (বিবিসি জরিপ, ২০০৪) স্বীকৃত-সম্মানিত। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব-আদর্শের বিরােধী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে বঙ্গবন্ধু মুজিবকে স্ত্রী-পুত্রপরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ঘটনাক্রমে তখন বিদেশে থাকায় বেঁচে রয়েছেন কেবল তাঁর দু কন্যা   শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। 

  হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিব : রাজনৈতিক জীবনের সূচনার কথা। 

  হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিব, চারজনেরই রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল ‘ব্রিটিশ-ভারত’এর অবিভক্ত বাংলায়। অতঃপর পাকিস্তানের রাজনীতিতে চারজনই অনস্বীকার্য গুরুত্বের অধিকারী হয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে, পাকিস্তান। আমলের মতই নানা সংশয়-প্রশ্নের জন্ম দিলেও, এ কথা সত্য যে, রাজনীতির প্রায় সকল দৃশ্যপটেই মৃত্যুর (১৯৭৬) পূর্ব পর্যন্তই মওলানা ভাসানীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষ উপস্থিতি ছিল অবধারিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আততায়ীদের হাতে নিহত (১৯৭৫) হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং রাজনীতির প্রধানতম পুরুষ। এখানেই বলে রাখা যেতে পারে, রাজনৈতিক ঘটনাক্রম এবং বাস্তবতার কারণেই বর্তমান আলােচনার সুবৃহৎ অংশ জুড়ে থাকবে বঙ্গবন্ধু মুজিবের কথা। 

  শেরে বাংলা ফজলুল হক রাজনৈতিক জীবনের সূচনাতেই বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত (১৯১৩) হয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দী রাজনীতিতে যােগ দিয়েছিলেন মওলানা মুহম্মদ আলী এবং মওলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের আহ্বানে। তিনি “খিলাফত আন্দোলন ও স্বরাজ আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯২১ সালে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন”(৮(৫)/৩৪০)। তাঁরা উভয়েই নিজ নিজ পছন্দ এবং পরিবেশ-প্রয়ােজনমত দল পরিবর্তন করেছেন, তবে অনস্বীকার্য যে, তাঁদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল পরিবর্তনের বিষয়টি যতটা ব্যক্তিগত অবস্থান-মর্যাদা রক্ষার লক্ষ্যে ছিল, আদর্শের প্রশ্ন ততটা জড়িত ছিল না। তাঁরা। উভয়েই আজীবন পাশ্চাত্যধারার গণতন্ত্রে আস্থাশীল ছিলেন। শেরে বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন হয়তাে নানা পর্বেই সংশয়-বিতর্কের কারণ হয়েছে কিন্তু তিনি কখনাে সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন যােগাননি। কিন্তু সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন এদিক থেকেও সম্পূর্ণরূপে কলঙ্কদাগ-মুক্ত নয়। 

 আর্থ-সামাজিক অবস্থানগত পার্থক্যের কারণেই ভাসানী-মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের সূচনাতে ছিল লক্ষণীয় ভিন্নতা। প্রকৃতপক্ষেই ভাসানী-মুজিব কারাে সমর্থনসহযােগিতায় নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উপলব্ধি আর প্রেরণা থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী প্রথম জীবনে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। সেখানে সাধারণ কৃষকদের ওপর জমিদার এবং মহাজনদের শােষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু করায় তাকে কাগমারি ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। তখন তিনি আসাম প্রদেশে চলে যান। পরবর্তী সময়ে (১৯০২) আসামেই মাত্র ২২ বছর বয়সে সন্ত্রাসবাদী (স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চরমপন্থী অংশ কর্তৃক পরিচালিত) আন্দোলনে যােগদানের মধ্য দিয়ে ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়” (৭(৪)/২৪১)। বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন রাজনীতির দর্শক-সারি থেকে : “চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুরে (১৯৩৭) ফিরে এলাম, কোন কাজ নেই। শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকালে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গােপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত, মাদারীপুরে সুভাষ বােসের দলই শক্তিশালী ছিল । আমাকে রােজ সভায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের সম্পর্কে আমার মনেও বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এ দেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম” (৯/৯)। বঙ্গবন্ধু আরাে উল্লেখ করেছেন : “শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সােহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তারা গােপালগঞ্জে (১৯৩৮) আসবেন। মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলােড়নের সৃষ্টি হল। আমার বয়স একটু বেশি, তাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ল আমার উপর । আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করলাম দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে। পরে দেখা গেল, হিন্দু ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সরে পড়তে লাগল । এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম সে আমাকে বলল, কংগ্রেস থেকে নিষেধ করেছে আমাদের যােগদান করতে। যাতে বিরূপ সম্বর্ধনা হয় তারও চেষ্টা করা হবে। আমি এখবর শুনে আশ্চর্য হলাম। কারণ, আমার কাছে তখন হিন্দু-মুসলমান বলে কোন জিনিস ছিলনা। আমাদের নেতারা বললেন, হক সাহেব (কৃষক-প্রজা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা) মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন বলে হিন্দুরা ক্ষেপে গিয়েছে। এটা আমার মনে বেশ একটা রেখাপাত করল। হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন, সভা হল। শান্তিপূর্ণভাবে সকল কিছু হয়ে গেল । শহীদ সাহেব গেলেন মিশন স্কুল দেখতে । তাঁকে সম্বর্ধনা দিলাম। তিনি (ফেরার পথে) ভাঙা ভাঙা বাংলায় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছিলেন, আর আমি উত্তর দিচ্ছিলাম। আমাকে ডেকে নিলেন খুব কাছে, আদর করলেন এবং বললেন, “তােমাদের এখানে মুসলিম লীগ করা হয় নাই’? বললাম, কোনাে প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই। তিনি নােটবুক বের করে আমার নাম ও ঠিকানা লিখে নিলেন। কিছুদিন পরে আমি একটা চিঠি পেলাম, তাতে তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এবং লিখেছেন কলকাতা গেলে যেন তার সঙ্গে দেখা করি। আমিও তার চিঠির উত্তর দিলাম । এইভাবে মাঝে মাঝে চিঠিও দিতাম” (৯/১০-১১)। হক-সােহরাওয়ার্দীর গােপালগঞ্জ পরিভ্রমণের পরে শহরে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান আড়াআড়ি একদিন মারামারিতে রূপ নেয়। “দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়। আমরা দরজা ভেঙ্গে মালেককে (মুজিবের বন্ধু, একটি হিন্দু বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল) কেড়ে নিয়ে চলে আসি। হিন্দু নেতারা রাতে বসে হিন্দু অফিসারদের সাথে পরামর্শ করে একটা মামলা দায়ের করল। খন্দকার শামসুল হক মােক্তার সাহেব হুকুমের আসামি। আমি খুন করার চেষ্টা করেছি, লুটপাট দাঙ্গাহাঙ্গামা লাগিয়ে দিয়েছি। আমাদের জেল হাজতে পাঠানাের হুকুম হল। এসডিও হিন্দু, জামিন দিল না । সাত দিন পরে আমি প্রথম জামিন পেলাম। আমার জীবনে প্রথম জেল”(৯/১২-১৩)। আজ ভাবতেও বিস্ময় জাগে, একটা চরম সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে আক্রান্ত-ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাজনৈতিক জীবনের। সূচনা হলেও মুজিব পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছিলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির উজ্জ্বল উদাহরণ, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং প্রতিষ্ঠাতা। প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেন একটি লেখায় বলেছিলেন : “ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা থেকে ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তার যে ঐতিহাসিক রূপান্তর তার প্রধান সূত্রধর ও মধ্য-শিরােমণি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান”(১০/১০)। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আস্থাশীল ছিলেন ভাসানী-মুজিব উভয়েই। কিন্তু ফারাকও ছিল। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বর্ণনায় : “মওলানার একটা। সীমাবদ্ধতা ছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি যে সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতেন, তাকে তিনি ভাবতেই পারতেন না ধর্মকে বাদ দিয়ে। পরিচ্ছন্ন সমাজতন্ত্র নয়, তার লক্ষ্য ছিল ইসলামি সমাজতন্ত্র যার দরুন সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়ােজিত হয়েও তিনি (ভাসানী) সামন্তবাদের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন, এমনটা বলা যাবে না। মওলানার সমাজতন্ত্রের তুলনায় (শেখ মুজিবের) বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল অধিকতর ধর্মনিরপেক্ষ। ছিল তা ভাষাভিত্তিক, যে-ভাষা কোনাে সম্প্রদায়ের সম্পত্তি নয়, সব বাঙালির মানসিক ও ব্যবহারিক সম্পদ বটে। এবং ওই জাতীয়তাবাদ প্রত্যাখ্যান করেছিল ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকে বেশ প্রবলভাবে” (১(২)/৭৮১)। 

  আবু জাফর শামসুদ্দীন লিখেছেন, “সােহরাওয়ার্দী সাহেবের ব্যক্তিগত সাহস, ব্যক্তিত্ব, একই সঙ্গে অর্থের প্রতি আসক্তি ও অবহেলা, অর্থ সঞ্চয়ে অবিশ্বাস, অনুসারীদেরকে পুত্রবৎ প্রতিপালন, পরিশ্রম করার অসাধারণ ক্ষমতা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সােহরাওয়ার্দী তেমন বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হলেও তার মধ্যে একটা যুদ্ধংদেহি মনােভাব ছিল । মনে হয়, সােহরাওয়ার্দী ছিলেন নিঃসঙ্গ মানুষ। বহু লােকের সঙ্গে তিনি মিশতেন, বহু রকমের রাজনীতি করেছেন   প্রথমে ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহকারী হিসেবে তাঁর জীবনারম্ভ, জীবন শেষ হলাে আওয়ামী লীগে   কিন্তু তাঁর কোনাে পরমাত্মীয়। বন্ধু ছিল না। তিনি সর্বদা লােক পরিবৃত থাকতেন কিন্তু তবু তিনি ছিলেন তাঁদের থেকে আলাদা। আচার-আচরণ জীবনযাপন প্রণালীতে তিনি ছিলেন পুরােপুরি পশ্চিমী, রাজনীতি করতেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিরক্ষর জনসাধারণের। ব্যক্তিগত জীবনে তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্রও ছিল না” (৮/৩৮০-৩৮১)। সাহিত্যিক-সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, “হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে আমি কাছে এবং দূরে থেকে বহুবার দেখেছি। যতবার দেখেছি, ততবারই মনে হয়েছে, তিনি গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়ক। ভুল করে এযুগের বাংলাদেশে (অবিভক্ত বাংলা) জন্মেছেন। আপােষের রাজনীতির পরিণাম কী মর্মান্তিক হতে পারে, শহীদ সােরাওয়ার্দীর জীবন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ” (১১/১৩১)। সােহরাওয়ার্দী ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক হলেও তাঁর নানাবিধ রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত কন্ট্রাডিকশন’এর কারণেই সম্ভবত তিনি কোনাে মহলেরই নিঃসংশয় আস্থাভাজন হতে পারেননি। ১৯৪৭ খ্রি. ভারত-ভাগের প্রাক্কালে “বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রেখে স্বাধীন ও সার্বভৌম এক নতুন রাষ্ট্রগঠনের চেষ্টা করেছিলেন তিন নেতা   শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাশিম (তদানীন্তন বাংলার মুসলিম লীগের অসাম্প্রদায়িক চিন্তাবিদ) এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। প্রথম দু’জনের আন্তরিকতা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন তােলেননি ঐতিহাসিক ও রাজনীতির গবেষকেরা। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী প্রসঙ্গে অনেকেই সন্দেহ পােষণ করেছেন। কারাে কাছেই তাঁর বিশ্বাসযােগ্যতা ছিল না। 

 না তাঁর নিজের দল মুসলিম লীগের সহকর্মীদের কাছে না বাঙালি হিন্দুদের কাছে। মাউন্টব্যাটেন ও বরােজও তাকে সন্দেহ করতেন”(১২/৯)। উল্লেখ্য যে, “যুক্ত বাংলা গঠনের আন্দোলনে তিনি (সােহরাওয়ার্দী) শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেননি। দিল্লিতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় (মতান্তরে কনভেনশন’, ১৯৪৬) জিন্নাহর প্রতি আপসমূলক নীতি গ্রহণ করে বাংলা-ভাগের প্রস্তাবে সমর্থন করেন। যে কারণে শহীদ সাহেবের এই আপস   অর্থাৎ বাংলাদেশে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ও সভাপতির পদ   এ দু’টিই রক্ষা করা, তার কোনটিই 

  শেষ পর্যন্ত হল না। বাংলাদেশ (অবিভক্ত বাংলা প্রদেশ) ভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিন্নাহর ইঙ্গিতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্টির নেতৃত্ব থেকে শহীদ সাহেব অপসারিত হলেন। নতুন নেতা নির্বাচিত হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর পদ গেল প্রতিক্রিয়াশীল খাজা নাজিমুদ্দিন ও তার গ্রুপের দখলে” (১১/১৩১)। “১৯৪৬- ৪৭-এ শেখ মুজিব ছিলেন মুসলিম লীগের পতাকাবহনকারী তরুণ ছাত্রনেতা। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক গুরু। সােহরাওয়ার্দী অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের ধারণাকে কখনাে রাষ্ট্রপরিচালনায় স্বাগত জানাননি। মাঝে মাঝে এর পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছেন, তা ক্ষমতার আসনকে ধরে রাখতে। রাজনৈতিক গুরুর প্রভাবকে সম্পূর্ণ অতিক্রম করেছিলেন শেখ মুজিব উত্তরকালে । কি ভাবে শেখ মুজিবের মুসলিম লীগের আদর্শ থেকে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উত্তরণ ঘটেছিল” (১২/১৪) তার বর্ণনা এখানে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়। তবে, অনেক পর্যবেক্ষক এবং রাজনীতি বিশ্লেষকেরই অভিমত হচ্ছে, সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক স্ববিরােধিতা এবং আপষকামিতার পথ-পরিণাম থেকেই স্থির-লক্ষ্য রাজনীতির শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ব্যক্তিগত অসাম্প্রদায়িকতা আর রাজনৈতিক অসাম্প্রদায়িকতা আদৌ সমার্থক নয়, তবে অনস্বীকার্য যে, ব্যক্তিজীবনে অসাম্প্রদায়িক না হলে কিছুতেই রাজনৈতিক অসাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থাশীল হওয়া অসম্ভব। “শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন। মুসলিম লীগের বিপরীতে শ্যামাপ্রসাদ বাংলায় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে এসেছিলেন। .ব্যক্তি শ্যামাপ্রসাদ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন সে ব্যাপারে কোনাে দ্বিমত নেই। কিন্তু রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদকে আমরা অস্বীকার করি কি করে?”(১২/৯)। অপরদিকে স্মরণ করা যেতে পারে এ. কে ফজলুল হকের কথাও। তিনি একবার মুসলিম লীগের সাথে (১৯৩৭ খ্রি.) আরেকবার হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদের সাথে (১৯৪১ খ্রি.) কোয়ালিশন করে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেও কখনাে কোনাে মহল থেকেই তাঁকে সাম্প্রদায়িকতাবাদী বলে অভিযােগ করা হয়নি। 

  চার প্রধানের রাজনৈতিক জীবনের আদি পর্ব : ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলায় 

  পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিবের জন্ম এবং রাজনৈতিক জীবনের সূচনাও ব্রিটিশ-ভারতের অবিভক্ত বাংলায়। ঐ পর্বে এ. কে. ফজলুল হক বাংলা এবং সর্বভারতীয় পর্যায়েও বিপুল বৈচিত্র্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকার অধিকারী হয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দী সর্বভারতীয় পর্যায়ে পরিচিতি অর্জন করলেও তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মােটামুটি বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মওলানা ভাসানী আসাম প্রদেশে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। অপরদিকে শেখ মুজিব তখন ছিলেন কোলকাতা-ভিত্তিক মুসলিম লীগের সক্রিয় ছাত্রকর্মী। এ. কে. ফজলুল হক “১৯১৩ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৫সালে তিনি কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সূচনা করেন। ১৯১৮ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি এবং ১৯১৯ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯২৩ সালে মুসলমানদের পক্ষ থেকে তিনি স্বরাজ্য পার্টির নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট  নামক চুক্তিটি সম্পাদন করেন” (৭(৪)/২)। সােহরাওয়ার্দীও এ চুক্তি সম্পাদনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। সারা ভারতেই, বিশেষত বাংলায় “হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তিনি (সােহরাওয়ার্দী) দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহযােগিতায় ‘বেঙ্গল প্যাক্ট নামে হিন্দু-মুসলিম চুক্তি সম্পাদনের পক্ষে কাজ করেন” (৭(৫)/৩৪০)। আলােচনার প্রাসঙ্গিকতায় ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’এর মূল প্রতিপাদ্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “স্যার আব্দুর রহিম, মৌলবী আব্দুল করিম, মৌলবী মুজিবুর রহমান, মওলানা আকরম খাঁ ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রভৃতি মুসলিম নেতৃবৃন্দ এবং মিঃ জে. এম. সেনগুপ্ত, মি. শরৎচন্দ্র 

   বসু, মি. জে. এম. দাশগুপ্ত ও ডা. বিধান চন্দ্র রায় প্রভৃতি হিন্দু নেতার সহযােগিতায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন (১৯২৩, এপ্রিল) ঐতিহাসিক ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামক হিন্দু-মুসলিম চুক্তিনামা রচনা করেন। তিনি স্বরাজ্য পার্টি ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিকে দিয়া ঐ প্যাক্ট মনযুর করাইলেন”(৪/৪৯)। প্যাক্টের শর্ত হিসেবে স্বীকার করা হয়েছিল যে, “সরকারি চাকরিতে মুসলমানরা জনসংখ্যানুপাতে চাকরি পাইবে এবং যতদিন ঐ সংখ্যানুপাতে (তৎকালে ৫৪%) না পৌঁছিবে ততদিন নতুন নিয়ােগের শতকরা ৮০টি মুসলমানদেরে দেওয়া হইবে। সরকারি চাকরি ছাড়াও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে, যথা কলিকাতা কর্পোরেশন, সমস্ত মিউনিসিপ্যালিটি এবং ডিস্ট্রিক্ট ও লােকাল বাের্ডসমূহে মুসলমানরা ঐ হারে চাকরি পাইবে”(প্রাগুক্ত)। প্যাক্ট-বিরােধী হিন্দু নেতাদের বক্তব্য ছিল, “দেশবন্ধু বাংলাদেশ মুসলমানের কাছে বেচিয়া দিযাছেন। তারা আশা করছিলেন, প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রকাশ্য অধিবেশনে এটি অনুমােদিত হবে না। কিন্তু দেশবন্ধু সিরাজগঞ্জে মওলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে (১৯২৪) সফলতার সাথেই চুক্তিটি অনুমােদন করাতে পেরেছিলেন। ‘বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পর্কে সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রাজ্ঞজন এবং কংগ্রেসী রাজনীতিবিদ মৌলানা আবুল কালাম আযাদের একটি পর্যবেক্ষণমূলক মন্তব্য উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য একান্তই গুরুত্বপূর্ণ : “His (Chittaranjan Das) attitude made a great impression on the Muslims of Bengal and outside. I am convinced that if he had not died a premature death, he would have created a new atmosphere in the country. It is a matter for regret that after he died, some of his followers assailed his position and his declaration was repudiated. The result was that the Muslims of Bengal moved away from the Congress and the first seed of partition was sown” (১৩/২৪)। ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ সম্পাদনের পরেই কোলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে (১৯২৪) দেশবন্ধু “নিজে মেয়র নির্বাচিত হইয়াছেন। জনপ্রিয় তরুণ মুসলিম নেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ডিপুটি মেয়র করিয়াছেন”(৪/৫০)। এ তথ্যটি ‘বেঙ্গল প্যাক্ট প্রণয়নের ব্যাপারে দেশবন্ধুর সাথে সােহরাওয়ার্দীর সংযােগ-সহযােগিতার বিষয়টি সপ্রমাণ করে। সােহরাওয়ার্দীই ছিলেন “কলিকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মুসলমান ডেপুটি মেয়র” (৭(৫)/৩৪০)। প্রসঙ্গতই উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে “১৯৩৫ সালে ফজলুল হক কলিকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন”(৭(৪)/৩)। দেশবন্ধুর মৃত্যুর (১৯২৫) পরে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বাতিল হয়ে গেলে “সােহরাওয়ার্দী কংগ্রেস ও স্বরাজ্য দলের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং ১৯৩৬ সালে মুসলিম লীগে যােগ দেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে তিনি কলিকাতার দু’টি আসনে নির্বাচিত হন” (৭(৫)/৩৪০)। পরবর্তী সময়ে, ১৯৪০ সালে সুভাষ বসুর উদ্যোগে-প্রস্তাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন মুসলিম লীগ নেতা আব্দুর রহমান সিদ্দিকী। নেতাজী সুভাষ বসু আরাে বিধান করেছিলেন যে, “পর্যায়ক্রমে প্রতি তিন বছরে মুসলিম মেয়র হইবেন”(৪/১৯৪)। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৩৭ সালে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের অল্পকাল পূর্বে ফজলুল হক সাহেব তাঁর সহযােগী সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিশেষ লক্ষ্যে নতুন রাজনৈতিক দল কৃষক প্রজা পার্টি গঠন করেন” (৫/১৫৮)। কৃষক-প্রজা পার্টির লক্ষ্য ছিল মুসলিম আসনে সংখ্যাধিক্য অর্জন। বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে মােট আসনসংখ্যা ছিল ২৫০টি, যার মধ্যে ১২২টি ছিল সংরক্ষিত মুসলিম আসন। বর্ণহিন্দুদের আসন ছিল ৬৪, তফশিলী হিন্দু ৩৫, ইউরােপিয়ান ২৫ এবং অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান ৪টি আসন। স্বাভাবিকভাবেই প্রাদেশিক সরকার গঠনের জন্য কমপক্ষে ১২৬টি আসন পাওয়ার দরকার ছিল। ঐ সময় বাংলার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন নাজিমউদ্দিন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক-প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লীগের তীব্র ভােটযুদ্ধে পটুয়াখালি আসনে শেরে বাংলার কাছে নাজিমুদ্দিন শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, “ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয় গভর্নরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য স্যার নাজিমুদ্দিন ‘মােহাম্মদী’র মওলানা আকরম খাঁ এবং ইস্পাহানি-ভ্রাতাগণসহ বাংলার প্রায় সকল মুসলিম জমিদার তালুকদার নওয়াব নাইট খান বাহাদুর এবং কলকাতার অবাঙালি মুসলিম ব্যবসায়ী সমাজ। ওরা (জিন্নাহর উদ্যোগে-পরামর্শে) গঠন করেন ‘ইউনাইটেড মুসলিম প্রগ্রেসিভ পার্টি (কার্যত বেনামী মুসলিম লীগ)। শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঐ দলেই ছিলেন। মুসলিম লীগ কাগজে-কলমে ছিল । বাংলার প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম শ্ৰেণী মুসলিম লীগের নামে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সাহস পায়নি। ওরা সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ সৃষ্টি করে বাজিমাৎ করতে চেয়েছিল, মি. জিন্নাহ আড়াল থেকে ইউনাইটেড মুসলিম প্রগ্রেসিভ পার্টিকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিচ্ছিলেন। এ দলের টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। মুখপত্ররূপে ছিল দৈনিক  স্টার অব ইন্ডিয়া এবং সাপ্তাহিক ‘মােহাম্মদী  প্রভৃতি পত্রিকা” (৮/১৫৮-১৫৯)। তথাপি ১৯৩৭-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি : “নাজিমুদ্দিন সাহেব পটুয়াখালী থেকে পরাজিত হয়ে ফিরে আসলেন। তার রাজনীতি থেকে সরে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। শহীদ সাহেব হক সাহেবকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললেন, 

 আমি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে কলকাতা থেকে বাই-ইলেকশনে পাস করিয়ে নেব। যদি হক সাহেব পারেন, তাঁর প্রতিনিধি দিয়ে মােকাবিলা করতে পারেন। হক সাহেবও লােক দাঁড় করিয়েছিলেন নাজিমুদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে। নাজিমুদ্দিন সাহেবই শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেন, শহীদ সাহেবের দয়ায়। সেই নাজিমুদ্দিন সাহেব শহীদ সাহেবকে অপমানই করলেন”(৯/৪২)। প্রসঙ্গতই উল্লেখ করা দরকার, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক-প্রজা পার্টি ৫৯টি, কংগ্রেস ৫৪টি, মুসলিম লীগ ৩৯টি আসন লাভ করেছিল, অর্থাৎ কারাে পক্ষেই এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব ছিল না। প্রয়ােজন পড়েছিল ‘কোয়ালিশন’ সরকার গঠনের। কিন্ত কংগ্রেসের সহযােগিতা না পেয়ে শেরে বাংলা বাধ্য হয়েই মুসলিম লীগ, তফশিলী এবং অপরাপর ছােটো ছােটো দলের সহযােগিতায় বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন (১এপ্রিল, ১৯৩৭) করেছিলেন। সােহরাওয়ার্দী কোলকাতায় বিজিত দু’টি আসনের একটি নাজিমউদ্দিনের অনুকূলে ছেড়ে দেয়াতে উভয়েই সেই কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। 

  শেরে বাংলার মন্ত্রিসভায় নাজিমউদ্দিন হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর সােহরাওয়ার্দী বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী। পরবর্তী সময়ে নাজিমুদ্দিন চরম অপমান-শত্রুতা করেছেন শেরে বাংলার প্রতিও। “১৯৩৭এ ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে কংগ্রেসের কোয়ালিশন সরকার গঠন করে বাংলার শাসনক্ষমতায় শরিক হওয়া উচিত ছিল। তা না করে সেসময় অসাম্প্রদায়িক ফজলুল হককে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। ক্ষমতার প্রতি দুর্বলতা ছিল ফজলুল হকের। কংগ্রেসকে কোনােভাবেই সাথে না পেয়ে বাধ্য হয়ে তিনি মুসলিম লীগের সাথে মিলে কোয়ালিশন গঠন করেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। মুসলিম লীগ এই সুযােগই খুঁজছিল। ফজলুল হকের হাত ধরেই তাদের বাংলার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠান। এর পরের ইতিহাস ১৯৪৭ র বাংলা বিভাগ পর্যন্ত মুসলিম লীগ বাংলার শাসনক্ষমতা নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়েছিল” (১২/২৬-২৭)। “ফজলুল হক সাহেবের ‘কৃষক-প্রজা পার্টি’ নামে হলেও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ছিল। তাছাড়া এ দলের পক্ষে একটি চৌদ্দ-দফা কর্মসূচিও প্রচারিত হয়। ঐ কর্মসূচিতে বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ, অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, বাংলাদেশের জন্য স্বায়তুশাসন প্রভৃতি প্রতিশ্রুতি ছিল। কৃষক-প্রজা। পার্টির আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পল্লীর সাধারণ মুসলিম সমাজের সমর্থন লাভ করে। নিম্নবেতনের চাকরিজীবী এবং মুসলিম ছাত্র সমাজের সমর্থনও ছিল। ফজলুল হক সাহেবের দলের প্রতি। হক সাহেব জিতলেন। তাঁর দলও মুসলিম আসনে সংখ্যাধিক্য লাভ করল। ইউনাইটেড মুসলিম প্রগ্রেসিভ পার্টি রাতারাতি নাম পরিবর্তন করে মুসলিম লীগ হয়ে গেল। ফজলুল হক সাহেব নিজেই (কয়েক মাস পরে) মুসলিম লীগে যােগ দিলেন; হলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি” (৮/১৫৯-১৬০)। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে ফজলুল হক “যােগ দেন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লক্ষৌ অধিবেশনে। তিনি পেয়ে যান বাংলার মুসলিম লীগের সভাপতির পদ” (১২/৩০)। উক্ত সম্মেলনে “ফজলুল হকের অনলবর্ষী ও বীরত্বব্যঞ্জক বক্তৃতায় আকৃষ্ট হয়ে লক্ষৌবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে ‘শের-এ-বাংলা বা শেরে বাংলা উপাধিতে ভূষিত করে” (৭(৪)/৩)। “১৯৪০-এ শেরে বাংলা ফজলুল হকই উত্থাপন করেছিলেন মুসলিম লীগের বিখ্যাত লাহাের প্রস্তাব। এত করেও ফজলুল হক মুসলিম লীগে লীন হয়ে যেতে পারলেন না। মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগের সহকর্মীদের সাথে তাঁর বনিবনা হচ্ছিল না। দলের ‘Sole spokesman জিন্নাহও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ফজলুল হককে। মতভেদ চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে ফজলুল হক মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন ১৯৪১-এ (১২/৩০)। মুসলিম লীগ সমর্থন প্রত্যাহার করায় তাঁর মন্ত্রিসভারও পতন হয় । মন্ত্রিসভার পতনের পর “ক্ষমতার প্রতি দুর্দমনীয় আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যায় নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদ (হিন্দু মহাসভার নেতা) এবং কংগ্রেসের একাংশকে নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। বাংলার প্রধানমন্ত্রী রূপে দ্বিতীয়বার শপথ নেন ১২ ডিসেম্বর, ১৯৪১-এ। মন্ত্রিসভায় যােগ দেওয়ার কথা ছিল শরৎচন্দ্র বসুর, কিন্তু বাংলার ছােটলাট (গভর্নর) স্যার জন হারবার্ট (মন্ত্রিসভার) শপথ গ্রহণের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ভারত-রক্ষা আইনে শরৎ বসুকে গ্রেফতার করেন, ব্রিটিশরাজ চাননি শরৎ বসুর সাথে ফজলুল হকের কোনাে রাজনৈতিক মিলন । শরৎ বসুর অনুপস্থিতিতে মন্ত্রিসভায় (অর্থ দপ্তরসহ) দ্বিতীয় স্থান পান শ্যামাপ্রসাদ। শ্যামাপ্রসাদকে মন্ত্রিসভায় নেওয়ার ব্যাপারে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির সহকর্মীদের আপত্তি ছিল” (১২/৩০-৩১)। এ আপত্তি একান্ত সঙ্গত ছিল বলেই মানতে হয়। “শ্যামা-হক মন্ত্রিসভাকে শান্তিতে থাকতে দেননি গভর্নর হারবার্ট। মুসলিম লীগের সাথে ষড়যন্ত্র করেই ২৮মার্চ ১৯৪৩-এ তিনি বাধ্য করেন ফজলুল হককে পদত্যাগ করতে।  শেরে বাংলা এর পরে আর কখনাে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে তার যােগ্য অবস্থান নিতে পারেননি। বলা যায় তাকে চলে যেতে হয়েছিল রাজনীতির অন্তরালে ।  ২৪ এপ্রিল, ১৯৪৩ খাজা নাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় স্থানে থাকেন সােহরাওয়ার্দী, তাঁকে দেওয়া হয় বেসামরিক সরবরাহ (খাদ্য) দপ্তরের ভার। ১৯৪৫’র ২৮ মার্চ এক অনাস্থা ভােটে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে । ১৯৪৬’র ফেব্রুয়ারিতে  অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুসলিম লীগ নির্ধারিত মুসলিম আসনে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। 

 হিন্দু আসনে জয়ী হয় কংগ্রেস। কৃষক-প্রজা পার্টি পায় ৫টি আসন,  ফজলুল হকেরই ছিল ২টি আসন। ১৯৪৬’র নির্বাচন মুসলিম লীগকে বাংলার মুসলমানদের পক্ষে কথা বলার সময় ও একক ক্ষমতা প্রদান করে। ২৪ এপ্রিল মুসলিম লীগের নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেয় শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে” (১২/৩২-৩৩)। মন্ত্রিসভায় বগুড়ার মােহাম্মদ আলী যােগ দেন অর্থমন্ত্রী হিসেবে। আবু জাফর শামসুদ্দিনের মন্তব্য, বাংলা ছাড়া ভারতের অন্য সবকটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে মুসলিম লীগের অবস্থা ছিল শােচনীয়। মুসলিম লীগের এই দুরবস্থার সময়ে মি. জিন্নাহর পাশে এসে দাঁড়ান কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা এ. কে. ফজলুল হক । স্বপ্রতিষ্ঠিত কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফজলুল হক সাহেব মুসলিম লীগে যােগ দেন । হন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট; নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। বাংলার দুর্ভাগ্যের সূচনা সেদিন থেকে। তিনি মি. জিন্নাহর মাকড়সা রাজনীতির জালে নিজেকে জড়িয়ে না ফেললে তখন দ্বিতীয় এমন কোনাে বাঙালি মুসলমান নেতা ছিলেন না যিনি মুসলিম লীগকে বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। মি. জিন্নাহ ইসলাম ধর্মকে তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ সিদ্ধির হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করেছিলেন । অসংখ্য মুসলিম নেতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিদে স্বাধীনতা সগ্রামে যােগ দিয়ে জেল খেটেছেন। মি. জিন্নাহ এবং মিঃ এ. কে, ফজলুল দু জনই কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ দুই করেছেন। কিন্তু  জেলে যাওয়ার মত হঠকারিতার রাজনীতি করেননি। ফজলুল হক সাহেবের গণ-সংযােগ এবং গণ-বক্তৃতার ক্ষমতাকে (Mass demagogy) কাজে লাগিয়ে দেয়াটা, জিন্নাহর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম বড় সাফল্য। ফজলুল হক সাহেবকে দিয়ে ১৯৪০ সালে লাহােরে তথাকথিত পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করানাে হয়। চারিদিকে বাহবা ধ্বনি উঠল । প্রশংসা ও স্তুতির মধ্যগগনে তিনি ভারসাম্য হারান। সাম্প্রদায়িকতা তুঙ্গে তােলার জন্যে যা কিছু করা আবশ্যক ছিল, মুসলিম লীগ ফজলুল হক সাহেবকে দিয়ে সে কাজগুলাে করিয়ে নেয়। এরপর প্রয়ােজন হলাে ফজলুল হক সাহেবকে বর্জন করার । ফজলুল হককে মুসলিম লীগ হতে বহিষ্কার (১৯৪২) করা হলাে” (৮/১৮৫-১৮৭)। তখনকার সময়ে পল্লী-বাংলার রাজনীতিতে শেরে বাংলার অনন্য গুরুত্ব এবং সাধারণ মানুষের মনে তার অবস্থান-সম্মানের দিকটি চমৎকারভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর লেখায়। “একদিনের কথা মনে আছে, আব্বা বললেন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মা ও আমাকে বলেছিলেন,  বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলিও । শেরে বাংলা মিছামিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালােবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলােচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লােক দাড়িয়ে বললেন, যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাইনা। জিন্নাহ কে? তার নামও শুনি নাই । আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব । শুধু এটুকুই না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালাে পতাকা দেখাতে গিয়েছি জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি”(৯/২২)। আলােচনার প্রাসঙ্গিকতায় এখানে কিছুটা দীর্ঘ উদ্ধৃতি উপস্থাপন করছি কামরুদ্দীন আহমদের বাংলার মধ্যবিত্তের বিকাশ’ বইটির ১ম খণ্ড থেকে, যাতে শেরে বাংলা, সােহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবকেও রাজনৈতিক আদর্শ-বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অবস্থানের নিরিখে উপলব্ধি করা যেতে পারে । “ফজলুল হক কোন সংগঠনকেই সহ্য করতে পারতেন না   কৃষক-প্রজা পার্টিকে ১৯৩৮সনে কবর দিতে যেমন ইতস্তত করেননি তেমনি করেননি মুসলিম লীগকে দূরে ফেলে দিতে -১৯৪২ সালে (মতান্তরে ১৯৪১)। বাংলার রাজনীতিতে ইতিমধ্যে যে পরিবর্তন এসেছিল সেটি তিনি বুঝতে পারেননি।  তিনি নিজেকে ‘ইনস্টিটিউশন’ বলে মনে করতেন। এ দুর্বলতাই তাঁর পতনের মূল কারণ হয়েছিল। এ ব্যাপারে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পথ ছিল ভিন্ন। রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেই তিনি বুঝলেন যে কলকাতার উপর সম্পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করতে পারলেও বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য তা যথেষ্ট নয়। পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারলে তাকে সারা জীবন মন্ত্রিসভার একজন সাধারণ সদস্য হয়েই থাকতে হবে। অসুবিধা তার ছিল অনেক। প্রথমত পূর্ব বাংলায় তাঁর কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না, দ্বিতীয়ত, তাঁর বাংলা ভাষা জানা ছিল না।  প্রথমে দৃষ্টি পড়ল ফজলুল হকের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার (অতি দূর সম্পর্কের) বন্ধন ঝালাই করা।  ঐ আত্মীয়তার সূত্রেই প্রথম সােহরাওয়ার্দী সাহেব পূর্ব বাংলায় ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রী হিসেবে ঘুরতেন। বাংলায় বক্তৃতা অভ্যাস করার জন্য ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লিখে তাই সভায় বলতেন বা পড়তেন। বছর দুয়েক তিনি ঐভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং ইংরেজি জানা লােকদের সঙ্গে যােগাযােগ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন”। “এ পথে যখন খুব বেশি দূর এগােনাে গেল না, তখন শহীদ সাহেব খুঁজে বেড়াতে লাগলেন কলকাতার ছাত্রদের মধ্যে এমন একজন যুবক যাকে তিনি গ্রহণ করতে পারবেন নিজের বলে এবং যার মধ্যে রাজনীতির নেশা আছে, যে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে তাঁর সম্পূর্ণ পৃষ্ঠপােষকতা পেলে । ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত অনেককে তিনি পরীক্ষা করেছেন কিন্তু তিনি যেমনটি চেয়েছিলে তেমনটি পাননি । ১৯৪৩ সালে আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থীতে ভাগ হ’ল ।  শহীদ সাহেব বুর্জোয়া কিন্তু তিনি শিল্পপতিও নন জমিদারীর মালিকও নন।  কলকাতার সাধারণ মানুষের সঙ্গেই ছিল তাঁর উঠা-বসা ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর  অনেক লােক সংসদে প্রবেশ করলেন যারা তাঁদের জেলার অভিজাতদের প্রতি ঘৃণা পােষণ করতেন। তাঁরা শহীদ সাহেবকে জননেতা হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ ছিলেন না। এমনি পরিস্থিতিতে শহীদ সাহেবকে প্রতিক্রিয়াশীল দলের মধ্যে ধরা হ’ল না। ফলে আবুল হাশিমের আন্দোলনের পূর্ণ সুযােগ সংসদীয় রাজনীতিতে শহীদ সাহেবই গ্রহণ করেছিলেন। “যখন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল সভা ডাকা (১৯৪৪) হ’ল তখন সােহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দিন ও মওলানা আক্রাম খান একত্রে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, আবুল হাশিম সাম্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত সুতরাং মুসলিম লীগের সম্পাদক পদে তাঁকে রাখা যায় না। আবুল হাশিমের অনুরাগীদের মধ্যে একটা ভয়ানক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ল। নির্বাচনের পূর্বের দিন সন্ধ্যার দিকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সম্মুখে ফজলুল কাদেরের (চৌধুরী) নেতৃেত্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন আরম্ভ হ ল   বক্তৃতা করল প্রথম নুরুদ্দীন তারপর (শেখ) মুজিবুর রহমান।  মুজিবের বক্তৃতা জোরালাে হয়েছিল এবং যুক্তিপূর্ণও, ফলে সােহরাওয়ার্দী সাহেব কাউন্সিলের ওপর সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দিতে রাজি হলেন। সে মুহূর্তেই শহীদ সাহেব বেছে নিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে । এতদিনে যেন শহীদ সাহেব সন্ধান পেলেন তিনি যাকে খুঁজছিলেন তাকে” (১৪(১)১১৩-১১৬)। 

  ২২-২৪ মার্চ, ১৯৪০ সালে লাহােরের মিন্টো পার্কে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগের পক্ষে যে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, সেটিই ‘লাহাের প্রস্তাব  হিসেবে উল্লিখিত হয় এবং তাকে পরের দিন থেকেই সংবাদপত্রে  পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত করে তােলা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, প্রস্তাবটিতে ‘পাকিস্তান  শব্দটিও ছিল না, ছিল না একক রাষ্ট্রের কথাও। প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো : “No constitutional plan would be workable or acceptable to the Muslims unless geographical contiguous units are demarkated into regions which should be so constituted with such territorial readjustments as may be necessary. That the areas in which the Muslims are numerically in majority as in the North-Western and Eastern zones of India should be grouped to constitute independent states in which the constituent units shall be autonomous and soverign” 

 শেরে বাংলার ‘লাহাের প্রস্তাব’ (১৯৪০ খ্রি.) ভারতীয় ইতিহাসে বহুল আলােচিত। তবে কমই আলােচিত হয় যে, কূট-কৌশলী জিন্নাহ সেই লাহাের প্রস্তাবটি অবিকৃত রাখেননি। দিল্লিতে ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ‘কনভেনশন’এ ‘লাহাের প্রস্তাব’এর মূল লক্ষ্য-ভিত্তিটাকেই বদলে ফেলা হয়েছিল। দিল্লি কনভেনশন’এর অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “জিন্নাহ সাহেব বক্তৃতা করলেন,  মনে হচ্ছিল সকলের মনেই একই কথা, পাকিস্তান কায়েম করতে হবে । সাবজেক্ট কমিটির  প্রস্তাব লেখা হল, সেই প্রস্তাবে লাহাের প্রস্তাব থেকে আপাতদৃষ্টিতে ছােট কিন্তু মৌলিক একটা রদবদল করা হল। একমাত্র হাশিম সাহেব আর সামান্য কয়েকজন যেখানে পূর্বে  স্টেটস্  লেখা ছিল, সেখানে ‘স্টেট লেখা হয়, তার প্রতিবাদ করলেন, তবু তা পাস হয়ে গেল । ১৯৪০ সালে লাহােরে যে প্রস্তাব কাউন্সিল পাস করে, সে প্রস্তাব আইনসভার সদস্যদের কনভেনশন পরিবর্তন করতে পারে কি না এবং সেটি পরিবর্তন করার অধিকার আছে কি না, এটা চিন্তাবিদরা ভেবে দেখবেন। কাউন্সিলই মুসলিম লীগের সুপ্রিম ক্ষমতার মালিক” (৯/৫২)। জিন্নাহর ইচ্ছায় বাংলার এবং তখন সারা ভারতে একমাত্র মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর উত্থাপিত ‘কনভেনশন প্রস্তাব’এর মূল কথা ছিল : “The Muslims are convinced that with a view to saving Muslim India from the domination of the Hindus and in order to afford them full scope to develop themselves .it is necessary to constitute a soverign, independent state comprising Bengal and Assam in the North-East zone and in Punjab, NW Frontier Province, Sind and Baluchistan in the North-West Zone.” সােহরাওয়ার্দীর কনভেনশন প্রস্তাব’এ পাকিস্তান নামক একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যটি আরাে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছিল, “The Zones comprising Bengal and Assam in the North-East and in Punjab, NW Frontier Province, Sind and Baluchistan in the North-West of India, namely Pakistan Zones, where the Muslims are in a dominant majority, be constituted into one soverign independent state and an unequivocal undertaking be given to implement the establishment of Pakistan ”(৯/৫৩-৫৪)। মুসলিম লীগের ১৯৪০ খ্রি. লাহাের প্রস্তাব’এর কথা বলা হােক কিংবা ১৯৪৬ খ্রি. ‘দিল্লি কনভেনশন’এর প্রস্তাব, দু’টিই জিন্নাহর অভিপ্রায়ে-নির্দেশে উপস্থাপিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে জিন্নাহ তাঁর কুশলী চালে, হক-সােহরাওয়ার্দীকে পরস্পর বিপরীত অবস্থানে ঠেলে দিয়ে দুর্বল করে দিতে পেরেছিলেন। লাহাের প্রস্তাব উপস্থাপনের পরে জিন্নাহ-নাজিমুদ্দিন অক্ষের অভিপ্রায় অনুসারে শেরে বাংলাকে মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। এবার ‘দিল্লি কনভেনশন’এর প্রস্তাব উপস্থাপনের পরে এল সােহরাওয়ার্দীর পালা। ইতিহাস সাক্ষী, বিলম্ব হয়নি এক্ষেত্রেও। “প্রতিভা, জ্ঞান, বিদ্যা-বুদ্ধি, বাগ্মিতা ও জনপ্রিয়তায় ফজলুল হকের কাছে জিন্নাহ কিছুই ছিলেন না”, আবদুল গাফফার চৌধুরীর এমন বক্তব্যকে যদি নিতান্তই বাঙালি-প্রীতির লক্ষণ বলা হয়, পরবর্তী তথ্যটিকে কী বলা হবে? “ঐতিহাসিক লাহাের সম্মেলনে জিন্নাহ যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন ফজলুল হক এসে সভামণ্ডপে পৌঁছেন। হাজার জনতা উঠে দাঁড়িয়ে জিন্নাহর বক্তৃতা উপেক্ষা করে ‘শেরে বাংলা জিন্দাবাদ  স্লোগান দিতে শুরু করে। শেরে বাংলার উপস্থিতিতে আর বক্তৃতা দেওয়া সম্ভব নয় দেখে জিন্নাহ বলে ওঠেন ‘শের যখন এসে গেছেন তখন আমার পথ ছেড়ে দেওয়াই ভালাে। বলে বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখে তিনি বসে পড়েন। সম্ভবত তখনই জিন্নাহ এবং অবাঙালি উর্দুভাষী মুসলিম লীগ নেতারা বুঝেছিলেন যে, সর্বভারতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বাঙালি ফজলুল হক তাদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ”(১১/১৫৮)। এই ফজলুল হকই রাজনীতির ঘুরপাকে জড়িয়ে পরবর্তী সময়ে জিন্নাহর কাছে চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়ে পুনরায় মুসলিম লীগের সদস্য হয়েছিলেন কিন্তু তাঁকে আবারও দলটি ছাড়তে হয়েছিল, সে-কথা যথাস্থানে আলােচনায় আসবে। ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতনের (১৯৪৩) জন্য মুসলিম লীগ তথা জিন্নাহর বিরােধিতা এবং কূট-কৌশল অবশ্যই বহুলাংশে দায়ী ছিল। “এ হচ্ছে ঘটনার একদিক। অপরদিকে ব্রিটিশ সরকারও যুদ্ধকালে (২য় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) ফজলুল হককে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছিল না। জাপানিদের ভয়ে বাংলাদেশে ‘পােড়ামাটি নীতি’ (ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পিত) অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না ফজলুল হক। এই পােড়ামাটি নীতিই ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্য প্রধানত দায়ী। ব্রিটিশ সরকার ফজলুল হক মন্ত্রিসভাকে বিতাড়িত করতে চাইছিল” (৮/১৮৭)। এমন সব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিরােধিতার কারণে “ফজলুল হক সাহেবের প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অবসান হলাে বটে কিন্তু অন্য দিক থেকে তাঁর জন্য এটা শাপে বর হলাে। তেতাল্লিশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং সে সময়ের ব্যাপক দুর্নীতির দায়-দায়িত্ব থেকে ফজলুল হক সাহেব নিস্কৃতি পেলেন” (৮/১৯৬)। ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলার সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য জমিদারি 

 উচ্ছেদ, মহাজনী আইন, ঋণ-সালিশী বাের্ড, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি সুদূরপ্রসারী আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ-প্রবর্তন করার জন্যই বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। যুক্তবাংলার শিক্ষামন্ত্রী হিসেবেও তিনি বিপুল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। এসময় কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বাংলার মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে পরবর্তীকালে কলিকাতা লেডি ব্রাবাের্ন কলেজ, ঢাকার বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট (বর্তমান শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়), চাখার কলেজ, ইডেন গার্লস কলেজ ছাত্রীনিবাস (এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লা মুসলিম হল) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া তিনি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহে মুসলমান ছাত্রদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন এবং মুসলিম এডুকেশন্যাল ফান্ডও গঠন করেন” (১৩(৪)/২-৩)। শেরে বাংলা যতবার মন্ত্রী হয়েছেন, ততবারই শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাতে রেখে শিক্ষা বিস্তার এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে যথাসম্ভব কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ১৯৩৭-১৯৪৭ পর্যন্ত দশ বছর বাংলার তিনজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং শহীদ সােহরাওয়ার্দী। ২৯ মার্চ, ১৯৪৩-এ ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতনের পরে বাংলায় খাজা নাজিমুদ্দিনেরর মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন বেসামরিক সরবরাহ তথা খাদ্যমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী। “১৯৪৩ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ধ্বংসকারী দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল । এই দুর্ভিক্ষের দায়িত্ব ও অপরাধ গিয়ে বর্তে নাযিম মন্ত্রিসভার ঘাড়ে। এই দুর্ভিক্ষে অনুমান পঞ্চাশ লক্ষ লােক মারা গিয়াছে”। তদানীন্তন ‘প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “ঐ আকালের জন্য  উভয় মন্ত্রিসভাই (হক-মন্ত্রিসভা এবং পরবর্তী নাজিমুদ্দিন-মন্ত্রিসভা) অংশত দায়ী ছিলেন। আসলে আকালের কারণ ঘটাইয়াছিলেন ভারত-সরকার। পঞ্চাশ সালের ঐ নজিরবিহীন আকালে মুসলিম বাংলা কিছু-কিছু মানব-সেবীর সন্ধান পাইয়াছিল। এঁদের মধ্যে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নাম সকলের আগে নিতে হয়। অত অভাবের মধ্যেও ধৈর্য ও সাহসে বুক বাধিয়া গ্রুয়েল কিচেন ও লঙ্গরখানা খুলিয়া আর্ত ও ক্ষুধার্তের সেবা করিয়াছিলেন, আহার-নিদ্রা ভুলিয়া দিনরাত চড়কির মত ঘুরিয়া বেড়াইতেন(৪/২৩৪-২৩৭)। অথচ সেই দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমদই তাঁর “ফুড কনফারেন্স’ পুস্তকে স্যার নাজিমুদ্দিনকে ‘মহিষে বাংলা ; শহীদ সাহেবকে  কুত্তায়ে বাংলা  ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগ কাগজ ‘আজাদ’ও শহীদ সাহেবের পক্ষে ওকালতি করার জন্য ব্যস্ততা দেখায়নি ঘরােয়া দলাদলির কারণে।  মুসলিম লীগের অনেকেই মানুষের দুর্দশার জন্য শহীদ সাহেবকেই দায়ী (escape goat) করতে সচেষ্ট ছিলেন। পরিষদ সদস্য আবুল হাশিম সাহেবও বেসরকারি সরবরাহ মন্ত্রীর বেশ কড়া সমালােচনা করেন”(১৪(২)/২০-২১)। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে ।  এমন দিন নাই রাস্তায় লােক মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। আমরা কয়েকজন ছাত্র শহীদ সাহেবের কাছে যেয়ে বললাম, কিছুতেই জনসাধারণকে বাঁচাতে পারবেন না, মিছামিছি বদনাম নেবেন। তিনি বললেন, দেখি চেষ্টা করে কিছু করা যায় কিনা, কিছু লােক তাে বাঁচাতে চেষ্টা করব । তিনি রাতারাতি বিরাট সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট গড়ে তুললেন। কন্ট্রোল’ (রেশন ব্যবস্থা) দোকান খােলার ব্যবস্থা করলেন। গ্রামে গ্রামে লঙ্গরখানা খােলার হুকুম দিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারকে ভয়াবহ অবস্থার কথা জানালেন চাল, আটা ও গম বজরায় করে আনতে শুরু করলেন”(৯/১৭-১৮)। “শহীদ সাহেবের প্রথম কাজ হ’ল কলকাতা শহরে রেশনের ব্যবস্থা করা। এ সম্বন্ধে কারাে কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরােধ করে দু’জন দক্ষ লােক নিয়ে কলকাতার জন্য রেশনের একটি পরিকল্পনা তৈরি হ’ল তারপর ঢাকা, চিটাগাং-এর পরিকল্পনা। রেশন ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বিপদ সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা। যেখানে সব জিনিসের অভাব সেখানে এ সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখা খুবই শক্ত। ঐ সময় আমি দেখেছি শহীদ সাহেবকে দিনে আঠার ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে। তাঁর যেন জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য   মানুষকে বাঁচাতে হবে (১৪(২)/২০)। 

  উপরোল্লিখিত কয়েকটি সূত্রে সােহরাওয়ার্দীর সপ্রশংস উল্লেখ করা হলেও আরাে বিভিন্ন সূত্রেই তার বিরূপ সমালােচনাও করা হয়েছে। নােবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন প্রমাণ করেছেন যে, “১৯৪৩ খ্রি. দুর্ভিক্ষ খাদ্যঘাটতির জন্য হয়নি। 

 পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার এবং একশ্রেণীর ব্যবসায়ী মানুষের মুখ (থেকে খাদ্য ছিনিয়ে তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তরের জন্য দায়ী ছিল অবশ্যই ব্রিটিশরাজ এবং সেই সাথে  . শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতি এবং ইতিহাসের গবেষকরাও দায়ী করেন নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভাকে  বিশেষ উল্লেখ করেন বেসামরিক সরবরাহ (খাদ্য) দপ্তরের মন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী এবং বাংলার মুসলিম লীগের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইস্পাহানির নাম”(১২/৩৩-৩৪)। জহুর হােসেন চৌধুরীর মন্তব্য : “একটি লােককেও অনাহারে মরতে দেব না, প্রয়ােজন হলে প্রত্যেকটি বাড়ির তক্তপােশের নিচে সার্চ করে মজুদকৃত চাউল বার করব’   সে সময় খাদ্যমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর এ ঘােষণা নির্মম পরিহাস হিসেবে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। বস্তুত মজুদদার ও কালােবাজারীদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। একটি উল্লেখযােগ্য মামলা দায়ের করা হয়নি । চালের কালােবাজারী ও মজুদদারির ব্যাপারে সে যুগে দুই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান যুক্তভাবে সর্বাপেক্ষা কুখ্যাতি অর্জন করে তাদের একটি ছিল মাড়ােয়ারী আর একটি পশ্চিমা মুসলমান। এই মুসলমান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নিখিল বঙ্গ ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কর্ণধারদের অন্যতম ছিলেন”(১৫/১২)। একই সূত্রে বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলগুলি মুসলিম প্রধান ছিল, যে লক্ষ লক্ষ কৃষক মারা গিয়েছিল, তাদের “শতকরা সত্তরজনই মুসলমান”। ২৪ এপ্রিল ১৯৪৬ থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তানের জন্ম বা দেশভাগের আগে পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতাসীন ছিলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। এসময়ের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য এবং কলঙ্কজনক ঘটনা ছিল ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ মুসলিম লীগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস । এ ঘটনাটির জন্যও সােহরাওয়ার্দী সম্যকরূপেই নন্দিত এবং নিন্দিত হয়েছিলেন। বােম্বাইতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কার্যকরী অধিবেশনেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল যে, পরবর্তী ১৬ আগস্ট ভারতজুড়ে মুসলমানদের ‘Direct Action Day. ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস  পালন করা হবে। মৌলানা আজাদের বর্ণনায় সেই দিনটির বাস্তবতা ঃ “16 August was a black day in the history of India. Mob violence unprecendented in the history of India plunged the great city of Calcutta into an orgy of bloodshed, murder and terror. Hundredas of lives were lost. Thousands were injured .. Processions were brought by the League which began to loot and commit acts of arson. Soon the whole city was in the grip of goondas of both the communities” (১৩/১৬৯)। জিন্নাহ বুঝতে পারছিলেন, ব্রিটিশদের চলে যাবার সময় এসেছে, তারা ভারতের শাসন-ক্ষমতা হস্তান্তর করতেও আগ্রহী। অথচ ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পাকিস্তান। সৃষ্টি করে দিচ্ছে না। এমন হতাশার চাপ কাটানােই ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’এর প্রধান লক্ষ্য। তাহলে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’এর সংগ্রাম  তাে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আদৌ তা হয়নি। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ অথবা অঘােষিত ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’   যা-ই বলা হােক না কেন, একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটতে চলেছে, এ কথাটা কিন্তু ভারত সরকার বা বড়লাট ওয়াভেলের অজানা ছিল না। কিন্তু সংঘাত আটকানাের জন্য সরকার কার্যকর কিছু করেনি বরং করেছিল উল্টোটাই, দাঙ্গদমনে পুলিশ-মিলিটারিকে সরকারি নির্দেশেই কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। ১৬ই আগস্ট জিন্নাহর ঘােষিত প্রত্যক্ষ  সংগ্রাম দিবস’সহ তিনচারদিনব্যাপী কোলকাতায় সংগঠিত একান্ত অযৌক্তিক এবং চরম অমানবিক বর্ণনা এড়িয়ে যাওয়াই ভালাে। কারণ, মানুষ হিসেবে মানুষের, হিন্দু-মুসলমান যেপরিচয়েই হােক না কেন, পাশবিক বর্বরতা মানবিক চিত্তকে আহত এবং কলুষিত করে। এ কথাও অজানা নয় যে, এমন ঘটনায় বিধ্বস্ত-বিপন্ন হয় সাধারণ মানুষ, 

 আর অসাধারণ-মানুষ’, যারা কলকাঠি নাড়েন, তারা ভালই থাকেন, ফায়দাও হয় তাদেরই। তবে ইতিহাসের মােড়-ফেরানাে ঘটনাটির পেছনের রাজনীতির কথা কিছুটা হলেও আলােচনা করা প্রয়ােজন। 

  সেদিন মুসলিম লীগ রাজনীতির দাবার বোড়ে হয়েছিল বাংলা, বাংলার ভােট এবং রক্তের মূল্যেই কেনা হয়েছিল পাকিস্তান। বাঙালি রাজনীতিবিদ এবং তখন কোলকাতায় কর্মরত সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদের প্রণিধানযােগ্য মন্তব্যে : “১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট কলিকাতায় কেয়ামত নামিয়া আসিল।  প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমার নিজের বিবেচনায় এর প্রাথমিক দায়িত্ব মুসলিম লীগ নেতৃত্বের । কায়েদে-আযম ১৬ই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম-দিবস ঘােষণা করিয়া দিলেন । কিন্তু কোনও কার্যক্রম ঘােষণা করিলেন না। তবে এ কথা তিনি বলিয়াছিলেন : আজ হইতে মুসলিম লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ ত্যাগ করিল। আমরা ধরিয়া নিলাম সভা-সমিতিতে হুমকি দিয়া উত্তেজনাপূর্ণ প্রস্তাবাদি পাস হইবে। আমার অনেক হিন্দু বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়া বুঝিলাম হিন্দুরাও তাই ধরিয়া নিয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী শহীদ সাহেবের নির্দেশে বাংলা সরকার ১৬ই আগস্ট সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করিলেন । মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা হইলেই লীগের পার্টি-প্রােগ্রামকে সরকারি ছুটির দিন গণ্য করা হইবে, এটা কোনও যুক্তির কথা নয়। কংগ্রেস মন্ত্রিসভারা তা করেনও নাই” (৪/২৫১-২৫৩)। জিন্নাহর প্রত্যক্ষ অগ্রামের ডাকের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার মুসলিম লীগ নেতা, প্রাক্তন ধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন “কলিকাতা মুসলিম ইনিস্টিটিউটের এক সভায় ঘােষণা করিলেন :  আমাদের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ইংরাজের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দুর বিরুদ্ধে। হিন্দুরা সন্ত্রস্ত এবং শেষ পর্যন্ত এগ্রেসিভ হইয়া উঠিল” (৪/২৫১)। শুধু খাজা নাজিমুদ্দিনই নন, আরাে কিছু প্রােপাগান্ডার তথ্য মেলে। জিন্নাহ বলেছিলেন, “আমি নীতি-নৈতিকতার কথা বলতে রাজি নই। এখন আমরা পিস্তল পেয়ে গিয়েছি এবং তাকে ব্যবহার করার অবস্থায় রয়েছি”(৮/৩৬)। লীগপন্থী মর্নিং নিউজ’ লিখেছিল, “কোন নাগরিক অথবা সেনার দ্বারা কোন ব্রিটিশ পুরুষ বা নারীকে উৎপীড়ন করা কেবল বােম্বাইতে গৃহীত প্রস্তাবের বিরােধিতা করা নয়, উপরন্তু তা হল ইসলাম গর্মের তত্ত্ব ও বক্তব্যের পরিপন্থী। হিন্দুদের মত ব্রিটিশরাও ছিল মুসলমানদের কাছে বিধর্মী। কিন্তু স্পষ্টতই বলা হয়েছিল যে ব্রিটিশদের উৎপীড়ন করা ইসলাম ধর্মবিরােধী। এর পরিণামে যা হওয়ার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনে তাই হয়েছিল” (১৬/৮৬)। উল্লেখ্য যে, তখন স্বরাষ্টমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর হাতেই। ৫ আগস্ট স্টেটসম্যান  পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে সােহরাওয়ার্দী লিখেছিলেন : “আজ মুসলমানদের কাছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনাে উদ্দেশ্যই প্রিয় অথবা মহান নয়”। আর ১৬ আগস্ট কোলকাতা ময়দানের জনসভায় সােহরাওয়ার্দী বলেছিলেন “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মাত্র ২৪ ঘণ্টা সময় পাওয়া গেছে” (১২/৪১)। মৌলানা আজাদ লিখেছেন, কোলকাতা থেকে দিল্লি যাবার জন্য অনেক কষ্টে দমদম বিমানবন্দরে পৌঁছানাে সম্ভব হয়েছিল। বিমানবন্দরের কাছে বিরাট একদল মিলিটারিকে অবস্থানরত দেখে আজাদ জিজ্ঞেস করেছিলেন, “Why they were not helping in resorting order, they replied that their orders were to stand ready but not to take action. Throughout Calcutta, the military and the police were standing by but remained inactive while innocent men and women were being killed চ (১৩/১৬৯)। কোলকাতা শহরে চারদিনব্যাপী মারাত্মক সাম্প্রদায়িক সংঘাতে হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না, তবে বড়লাট ওয়াভেল বলেছিলেন, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের দাঙ্গায় কোলকাতায় যত মানুষ মারা পড়েছিল, পলাশীর যুদ্ধেও তত মানুষ মারা যায়নি। স্মরণ করা যেতে পারে, “১৯৪৬-এ কলকাতায় মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২৬ শতাংশ, হিন্দু জনসংখ্যা ৬৬ শতাংশ। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রথম দিন পার হতেই হিন্দুরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিলেন শিখরা” (১২/৪৭)। “কলিকাতায় স্বভাবতই হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের জান-মালের ক্ষতি হইয়াছিল অনেক বেশি। এই খবর অতিরঞ্জিত আকারে পূর্ব বাংলায় পৌঁছিলে নােয়াখালি জেলায় হিন্দুরা নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়। তারই প্রতিক্রিয়ায় বিহারের হিন্দুরা তথাকার মুসলমানদিগকে অধিকতর নৃশংসতার সাথে পাইকারিভাবে হত্যা করে। দেশভাগের আগে পর্যন্ত বাংলা-বিহারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই নৃশংস অমানুষিকতার সর্বাপেক্ষা লজ্জাকর নিদর্শন। অনেক অতি-সাম্প্রদায়িক মুসলমান আজও সগর্বে বলিয়া থাকে কলিকাতা দাঙ্গাই পাকিস্তান আনিয়াছিল। এ কথা নিতান্ত মিথ্যা নয়। এই দাঙ্গার পরে ইংরাজ-হিন্দু-মুসলিম তিনপক্ষই বুঝিতে পারেন, দেশ বিভাগ ছাড়া উপায়ন্তর নাই” (৪/২৫৪-২৫৫)। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের আহ্বান ছিল সারা ভারতেই, কিন্তু অন্য কোথাও নয়, কোলকাতাতেই অমন নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল কেন? অনেকে বলেন, বাংলায় মুসলিম লীগ শাসন বলবৎ ছিল। অনেকেই আবার ভিন্নমত পােষণ করেন, “পাকিস্তান গঠন সম্পর্কে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর মনােভাব কেমন, তা নিয়ে জিন্নার মনে সংশয় ছিল। সােহরাওয়ার্দী চেষ্টা করেও জিন্নার কাছের মানুষ হয়ে যেতে পারেননি। সেজন্য বাংলার মুসলমানদের ওপর তার প্রভাব কত তা দেখাবার সুযােগ সােহরাওয়ার্দী খুঁজছিলেন। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান তাঁর কাছে সেই সুযােগ এনে দেয়। সেনাবাহিনীকে দূরে সরিয়ে রেখে এবং পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে তিনি দেখাতে পেরেছিলেন যে তাঁর ডাকে মুসলমানদের একটি অংশ পাকিস্তানের দাবি নিয়ে কী বর্বরােচিত ঘটনা সংঘটিত করতে পারে” (১৬/৮৭)। 

 অসংখ্য মানুষ মারা পড়েছিল কোলকাতার দাঙ্গায়, এ কথা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি সত্য, মনুষ্যত্বের সবটুকু মেরে ফেলা সম্ভব হয়নি, কখনাে সম্ভব হয় না। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “সামগ্রিক উন্মত্ততার মধ্যেও দু’একটা সাহসিক মানবিকতার দৃষ্টান্ত মহত্ত্বের উজ্জ্বলতায় ঝলমল করিতেছে। হিন্দুএলাকায় উন্মত্ত জনতা বেষ্টিত মুসলমান পরিবারকে রক্ষার জন্য হিন্দু নারী-পুরুষের বীরত্ব এবং মুসলিম এলাকায় ঐ অবস্থায় পতিত হিন্দু পরিবার রক্ষায় মুসলিম নারীপুরুষের বীরত্ব ইতিহাসে সােনার হরফে লেখা থাকার যােগ্য” (৪/২৫২)। এ বক্তব্য। থেকে আমরা অবশ্যই লক্ষ্য করবাে যে, হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়ের জন্য কেউ মনুষ্যত্ব হারায় না, মনুষ্যত্ব হরাবার কারণটা মানুষের ধর্ম-পরিচয়ে নয়, খুঁজতে হবে অন্যত্র । কোলকাতায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের চরম অমানবিকতার মাঝেও ‘সাহসী মানবিকতা এবং মহত্ত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেও সামনে চলে আসে সােহরাওয়ারদির নাম। হতে পারে, ইতােমধ্যে যা বলা হয়েছে এবং অতঃপর যা বলা হবে, তার মাঝেই নির্দেশিত হয় তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের দ্বিমুখিতা। ওপরের কথাগুলি যদি সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক চারিত্র্য-লক্ষণ হয়, তাহলে পরের কথাগুলি অবশ্যই তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের অনুষঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আবু জাফর শামসুদ্দীন লিখেছেন : “ডাইরেক্ট অ্যাকশনে নামার পর যখন গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং শুরু হলাে তখনও একমাত্র শহীদ সােহরাওয়ার্দীই জীবন বিপন্ন করে মারমুখী হিন্দু মহল্লায় যাচ্ছিলেন। অন্য মুসলিম লীগ নেতাদের নাম তখন শােনা যায়নি”(৮/২৩০)। প্রসঙ্গতই মুজিব লিখেছেনঃ “সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে ধরতে পারছি না। ফোন করলেই খবর পাই লালবাজার আছেন। লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার । শহীদ সাহেব রাতদিন পরিশ্রম করেছেন, শান্তি রক্ষা করবার জন্য” (৯/৬৫-৬৬)। অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক মুজিবকে চিনবার জন্যই এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইসলামিয়া কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক, পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ভবতােষ দত্তের আট দশক  নামক স্মৃতিকথা থেকে বিবরণটি উদ্ধৃত করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : “ছাত্ররা আমাদের অত্যন্ত সমাদরে গ্রহণ করেছিলেন। প্রায় সব ছাত্রই অবশ্য লীগ-পন্থী। পাকিস্তান-কামী। মুসলমান শিক্ষকেরাও তাই। বাংলাভাষীদের (ছাত্র) সংখ্যা ছিল বেশি। এই বাংলাভাষী দলের নেতা ছিল একটি কৃশকায় ছেলে   নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্ররা যে আমাদের জন্য কতটা করতে পারত তার প্রমাণ পেলাম ১৯৪৬-এর রক্তাক্ত দাঙ্গার সময়। বালিগঞ্জ থেকে ইসলামিয়া কলেজের রাস্তায় পদে পদে বিপদ। এই রাস্তা আমাদের ছাত্ররা পার করে দিত। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি ইসলামিয়া কলেজের সেইসব মুসলমান ছাত্রদের যারা আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে বিপজ্জনক এলাকাটা পার করে দিতেন। এই-সব ছাত্রদের একজনের নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান”(১(১)/২৪১) । 

 উপরের উদ্ধৃতি থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় একজন হিন্দু শিক্ষকের চোখে মানবিক মুজিবের কথা জানা গেল। এবার সেই মুজিবের চোখে একজন হিন্দুশিক্ষককে দেখা যাক। “ইসলামিয়া কলেজে গরীব ছেলেদের সাহায্য করবার জন্য একটা ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশােনার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। আমি (মুজিব) আর্টসের ছাত্র ছিলাম, তবু নারায়ণ বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি যদিও জানতেন, আমি প্রায় সকল সময়ই  পাকিস্তান, পাকিস্তান’ করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সকলেই এই কাজের ভার দিত কেন? কারণ, তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এই রকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে কমই পড়েছে” (৯/৩৭-৩৮)। কোলকাতায় ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’এর অমানবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্তিমিত হয়ে আসার সময়, “পহেলা সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ সালে শেরে বাংলা জিন্নাহকে এক চিঠি লেখেন তাঁর অতীতের দোষত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়ে   এবং অদ্ভুত ব্যাপার জিন্নাহও এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করলেন এবং তাকে আবার মুসলিম লীগের সদস্য হবার অধিকার দিলেন। ফজলুল হক মনে করেছেন, এমনি বিপদের দিনে মুসলমানদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত, হয়ত জিন্নাহও তাই ভেবে এবার আর তার সঙ্গে অপমানসূচক ব্যবহার করেননি। অন্যদিকে কেউ কেউ ভাবলেন এটা খাজা। সাহেবদের চাল। আবুল হাশিমকে শেষ আঘাত হানবার কৌশল মাত্র” (১৪(২)/৭৭)। কয়েক বছর পরে (১৯৫৩) ফজলুল হক আবার মুসলিম লীগে যােগ দিয়েছিলেন এবং আবারও তাকে মুসলিম লীগ ছেড়ে যেতে হয়েছিল। ১৯৪৭-এ বাংলা-ভাগ (ভারত-ভাগের সাথেই) এবং কোলকাতাসহ পশ্চিম বাংলা ভারতের ভাগে পড়ার বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে যাওয়াতে মুসলিম লীগে সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের রাজনৈতিক অবস্থান বােধগম্য কারণেই নাজুক হয়ে পড়েছিল। তখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্পাদক লিয়াকত আলী খান। স্বভাবতই জনপ্রিয় মুসলিম লীগ নেতা এবং অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী, কোলকাতাবাসী সােহরাওয়ার্দীকে আরাে হীনবল করে দিতে চাইলেন। আর তাই, লিয়াকত আলী পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের নেতৃত্ব নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। আবুল মনসুর আহমদ এটাকে মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘নৈতিক মরাল ও এথিক্যাল অপরাধ  বলে বর্ণনা করেছেন। লিয়াকত আলীর পরিকল্পনা এবং পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগে নবাগত সিলেট জেলা মুসলিম লীগারদের সমর্থনে। “Nazimuddin was elected as the leader of the pariamentary party and became the Chief Minister-designate of East Bengal. Suhrawardy decided to stay on in Calcutta for the time being and joined Gandhi in his peace mission to restore communal harmony there. Abul Hashim also decided to remain in India” (১৭/৩০-৩১)। “নাজিমুদ্দিন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়েই দলবলসহ ঢাকা চলে গেলেন। একবারও চিন্তা করলেন না, পশ্চিম বাংলার হতভাগা মুসলমানদের কথা । নাজিমুদ্দিন সাহেব মুসলিম লীগ বা অন্য কারাের সাথে পরামর্শ না করেই ঘােষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার উপর আর কোনাে দাবি রইল না। নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়। কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লােক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয় । সােহরাওয়ার্দী নেতা হলে তাদের অসুবিধা হত তাই তারা পিছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইল”(৯/৭৮-৭৯)। তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন, আবুল হাশিম, সােহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসুর নতুন রাষ্ট্র হিসেবে যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা জানাজানি হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লীগের কর্ণধারদের মধ্যে এক আশঙ্কা জেগে উঠে। তারা ধরে নেয় যে, বাংলা অবিভক্ত থাকলে আবার আবুল হাশিম ও সােহরাওয়ার্দীর রাজত্ব কায়েম হবে। এদিকে শরৎ বাবুর  ইচ্ছা শহীদ সাহেবকে একটু পেছনে রেখে আবুল হাশিম সাহেবকে সম্মুখে রাখা   কারণ, শহীদ সাহেবের প্রতি হিন্দুদের চরম বিরূপ মনােভাব ছিল” (১৪(২)/৮৪)। জিন্নাহ ও অবাঙালি লীগ কোটারির দুশ্চিন্তা ছিল, “সােহরাওয়ার্দী যদি নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের লীগ নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রী হন, তাহলে তিনি তার শক্তির ও নেতৃত্বের ভিত্তি খুঁজবেন বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এবং তাদের তিনি সমর্থন ও শক্তি যােগাবেন। তাহলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামােতেও অবাঙালি পুঁজি ও নেতৃত্ব বাঙালি পুঁজি ও নেতৃত্বের হাতে মার খাবে। সুতরাং তাদের জন্য সবচাইতে নিরাপদ হচ্ছে অবাঙালি ও উর্দুভাষী নাজিমুদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা মুখ্যমন্ত্রী বানানাে । ফলে দেশভাগের সময় সােহরাওয়ার্দী বাংলাদেশে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ও পার্লামেন্টারি দলের নেতৃত্ব হারালেন । পূর্ব বাংলায় কিছুদিনের জন্য গণতান্ত্রিক কণ্ঠ, বিরােধী কণ্ঠ একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়” (১১/১৫৯-১৬০)। জহুর হােসেন চৌধুরীর মন্তব্য : “বাঙালি মুসলমান লীগে যােগদান করলেও এর নেতৃত্বের কোন অংশ তারা পায়নি। উর্দুভাষী হওয়া ও বাংলাদেশে চিফ মিনিস্টার হওয়া সত্ত্বেও জনাব সােহরাওয়ার্দীকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়” (১৫/১৮)। অতঃপর তাঁকে অপসারণ করা হয়েছিল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতৃত্ব এবং পার্লামেন্টারি পার্টির নেতৃত্ব থেকেও। 

  “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যার অবদান ছিল সবচাইতে বেশি তিনি শহীদ সােহরাওয়ার্দী । ১৯৪৬ সালের নির্বাচনটি ছিল পাকিস্তান ইস্যুতে গণভােট। বঙ্গ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কর্ণধার শহীদ সােহরাওয়ার্দী নির্বাচনে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন, ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১১৩টিতে বিজয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন,  জিন্নাহর প্রতারণা এখানেই শুরু; তাই পুণরায় মুসলিম লীগের কাউন্সিল ডাকেন (দিল্লিতে) ১৯৪৬ সালের ৯ ও ১০ এপ্রিল এবং সােহরাওয়ার্দীকে দিয়ে লাহাের প্রস্তাবের ‘States’ শব্দটির পরিবর্তে ‘State  সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন ও গ্রহণ করে এক পাকিস্তানের পটভূমি সৃষ্টি করেন। ইতিপূর্বে ৩ এপ্রিল (১৯৪৬) শহীদ সােহরাওয়ার্দী বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করে নেতা নির্বাচিত (হন) এবং ২৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভা গঠন করেন। জিন্নাহর ষড়যন্ত্রে ৫/৮/৪৭ তারিখে সােহরাওয়ার্দীকে ৭৫:৩৯ ভােটে পরাজিত করে নেতা নির্বাচিত হন খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট শহীদ সােহরাওয়ার্দী পূর্ববঙ্গের ক্ষমতা খাজা নাজিমুদ্দিন এবং ইতিপূর্বে ডা. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘােষের কাছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা হস্তান্তর করেন” (সরদার সিরাজুল ইসলাম :‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন’; দৈনিক জনকণ্ঠ, ৬-০২- ১৩ খ্রি.)। তৎকালে বাংলার মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিত্বের সংঘাত প্রসঙ্গে কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন, পূর্ববাংলার মুসলিম লীগ পার্টির ‘পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচনের বিষয়টিও “পাকিস্তান হবার আগেই ঠিক হয়ে যাবে। শহীদ সাহেব (বাংলার প্রধানমন্ত্রী) আমাদের বললেন যে, তিনি ঐ গুজবে বিশ্বাস করেন না। তবু আমরা হাশিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘লিডার’ নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত হয় তবে আমাদের করণীয় কি? তিনি বললেন, “আমাদের কিছু করার নেই । আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখব। আমার মনে হয়, আবুল হাশিম সাহেবের ঐ সিদ্ধান্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও তােফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) মেনে নেননি   আর সেদিন থেকেই তাঁদের সঙ্গে আবুল হাশিম সাহেবের সকল সম্পর্ক  শেষ পর্যন্ত তিক্ততায় পৌঁছেছিল। শহীদ সাহেব অনেক ভােটের ব্যবধানে ( নাজিমুদ্দিনের কাছে) হেরে গেলেন। শহীদ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি হিন্দুস্তানেই থেকে যাবেন। সেজন্য তিনি পশ্চিমবাংলার মুসলিম লীগ দলের নেতা নির্বাচিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পরিষদে বিরােধী দলের আসনে বসার ব্যবস্থা করলেন” (১৪(২)/৮৮)। বঙ্গবন্ধুর কথা :“আমাদের পক্ষে কলকাতা থাকা সম্ভবপর না, কারণ অনেককে গ্রেফতার করেছে। শহীদ সাহেবের কাছে বিদায় নিতে গেলাম। তাঁকে রেখে চলে আসতে আমার মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার মন বলছিল, কতদিন মহাত্মাজী শহীদ সাহেবকে রক্ষা করতে পারবেন? কয়েকবার তার উপর আক্রমণ হয়েছে। শহীদ সাহেবকে বললাম, চলুন স্যার পাকিস্তানে, এখানে থেকে কি করবেন?’ বললেন ‘যেতে তাে হবেই, তবে এখানে এই হতভাগা মুসলমানদের জন্য কিছু একটা না করে যাই কি করে? সমস্ত নেতা চলে গেছে, আমি চলে গেলে এদের আর উপায় নাই। তােমরা একটা কাজ কর, দেশে গিয়ে, সাম্প্রদায়িক গােলমাল যাতে না হয়, তার চেষ্টা কর। চেষ্টা কর, যাতে হিন্দুরা চলে না আসে। ওরা এদিকে এলেই গােলমাল করবে, তাতে মুসলমানরা বাধ্য হয়ে পূর্ব বাংলায় ছুটবে। যদি পশ্চিম বাংলা, বিহার ও আসামের মুসলমান একবার পূর্ব বাংলার দিকে রওনা হয়, তবে পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব বাংলা রক্ষা করা কষ্টকর হবে। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (পূর্ব বাংলায়) হতে দিও না”(৯/৮২)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হক-ভাসানী-মুজিব ফিরে এলেন তাঁদের জন্মভূমি পূর্ববঙ্গে, সােহরাওয়ার্দী কিছুকালের জন্য পশ্চিমবঙ্গে রয়ে গেলেন। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সােহরাওয়ার্দীকে অপসারণের পর, তাঁকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের অনুরােধ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী এবং গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ স্বয়ং লিয়াকত আলীকে সােহরাওয়ার্দী জানিয়েছিলেন, “ভারতীয় মুসলমানদের একটা হিল্লা না করিয়া তিনি ভারত ছাড়িতে পারেন না”(৪/২৬৮)। কামরুদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেছেন : ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ স্বল্পকালীন ঢাকা সফর শেষে “শহীদ সাহেব কলকাতা ফিরে যাবার কিছুদিন পরেই জিন্নাহ সাহেব তাঁকে পাকিস্তানের পুনর্বাসন ময়ী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যােগদিতে অনুরােধ করেন। শহীদ সাহেব জিন্নাহ সাহেবকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি যে কাজের ভার নিয়েছেন (কোলকাতার মুসলমানদের শান্তি ও পুনর্বাসন) তা ছেড়ে তখন তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে পারেন না।” (১৮/১১১)। সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ দু টি বিষয়ে নিজের সুস্পষ্ট অভিমত সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃতির মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন সােহরাওয়ার্দী। বিষয় দু’টি ছিল : “এক, পাকিস্তান হাসিল হওয়ার পর পাকিস্তানের জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নাম আর মুসলিম লীগ থাকা উচিত নয়। দুই, পাকিস্তানের হিন্দুদের রাজনৈতিক আনুগত্য বিচারে উদার বাস্তব দৃষ্টি অবলম্বন করা উচিত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে উভয় রাষ্ট্রেই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকার করিতে গেলেই জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক হইতেই হইবে। ভারতের যেমন ন্যাশনাল কংগ্রেস আছে, পাকিস্তানেরও তেমনি ন্যাশন্যাল লীগ করিতে হইবে। কথাটা যুক্তিসঙ্গত এবং কায়েদে-আযমের মতও তাই; এই ধারণায় আরাে অনেক মুসলিম নেতা শহীদ সাহেবের এই মত সমর্থন করেন”(৪/২৭৩)। কিন্তু এসব কারণেই তিনি পাকিস্তান সরকার তথা মুসলিম লীগের কায়েমি স্বার্থবাদী নেতৃবৃন্দের চরম বিরাগভাজন হয়েছিলেন। 

 অতঃপর আলােচ্য অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে ভাসানী-মুজিব প্রসঙ্গ। মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই ১৯০২ সালে ইংরেজ-বিরােধী স্বদেশী আন্দোলনের সন্ত্রাসবাদী ধারায় যুক্ত হওয়াতে দশ মাস কারাবন্দি ছিলেন। দেশবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভাসানী ১৯১৯-এ কংগ্রেস দলে যােগ দিয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জে (১৯২৪)অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক কংগ্রেসের যে অধিবেশনে দেশবন্ধুর ‘বেঙ্গল প্যাক্ট অনুমােদিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী সেখানে কৃষক-প্রজাদের ওপর জমিদার-মহাজনের নির্যাতনের প্রাণস্পর্শী বিবরণ উপস্থাপন করেছিলেন। ফলে আবার তাকে (বাংলা) দেশ ছেড়ে আসামে পাড়ি জমাতে হয়। আসামের ধুবড়ি জেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে বসবাসরত বাঙালি কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে তিনি এক বিশাল সম্মেলনের আয়ােজন করেন। পরে তাঁর কর্মস্থল হয় আসামের ঘাগমারি অঞ্চল। সেখানে তিনি বাঙালি কৃষকদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, স্কুল, মাদ্রাসা ইত্যাদি স্থাপন করেন। ১৯৩৫ সালে আসামের স্থানীয় লােকরা আসাম থেকে বাঙালিদের বহিষ্কার করার জন্য বাঙালখেদা’ আন্দোলনের ডাক দিলে তিনি এর বিরুদ্ধে পাল্টা আন্দোলন গড়ে তােলেন”(৭(৪)/২৪১)। উল্লেখ্য যে, “১৯৩০ সালের পূর্ব পর্যন্ত আসামে বহিরাগতদের (প্রধানত ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে আগত মুসলমান কৃষক) বসবাস একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ রাখার জন্য সরকার কর্তৃক টেনে দেওয়া ভৌগােলিক সীমারেখাই ইতিহাসে ‘লাইন প্রথা  নামে পরিচিত। পূর্ববঙ্গের ভূমিহীন ও জমিদার-মহাজনদের দ্বারা লাঞ্ছিত নিপীড়িত বহু মানুষ আসামের দুর্গম অরণ্যভূমি পরিষ্কার করে আবাদ শুরু করলে সরকার প্রথম দিকে তাদের স্বাগত জানায় এবং উৎসাহিত করে। অল্পদিনের মধ্যে তারা কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে শুরু করে। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলাে বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে এবং সরকার লাইন প্রথা প্রবর্তন করে (গােপীনাথ বড়দলৈ-এর কংগ্রেসী সরকার পুলিশ ও হাতি নিয়ােগ করে উদ্বাস্তু কৃষকদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে উৎখাত করে দিচ্ছিল) ..মওলানা ভাসানী আসামে পূর্ববঙ্গের হতভাগ্য কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ‘লাইন প্রথা’ ও ‘বাঙাল খেদা’ আন্দোলনের তীব্র বিরােধিতা করে নতুনভাবে আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। এই আন্দোলনের চাপে ১৯৪০ সালের শেষভাগে আসামের অ্যাডভােকেট জেনারেল লাইন প্রথার কার্যকারিতা স্থগিত করতে বাধ্য হন। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এলাকা থেকে লাইন প্রথা প্রত্যাহার করা হয়  .লাইন প্রথা-বিরােধী আন্দোলনের সাফল্য আসামে পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিল (৭(৫)/৯০-৯১)। তবে স্মরণ করা যেতে পারে যে, সিলেট জেলা তখন আসাম প্রদেশের অন্তর্গত ছিল, ১৯৪৭ জুন মাসে সিলেট জেলার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে ‘রেফারেন্ডাম’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত দশ বছর আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি থাকা সত্ত্বেও “মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রেফারেন্ডামে কোন সাহায্যই করেননি” (১৪(২)/১৪১)। জহুর হােসেন চৌধুরী লিখেছেন :“মওলানা ভাসানীকে আমি প্রথম দেখি ১৯৪৫-৪৬ সালে কলকাতায় ‘লাইন প্রথা বিরােধী আন্দোলনের নেতা হিসেবে মওলানা ভাসানী তখন খ্যাতির উচ্চতম শিখরে। প্রথম দর্শনেই মওলানা ভাসানীকে আমার অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতৃবর্গের চেয়ে ভিন্ন ধরনের বলে মনে হলাে। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও, কংগ্রেসী মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে যথেষ্ট তীব্র কথাবার্তা বললেও একবারও তাকে ‘হিন্দু  শব্দটি উচ্চারণ করতে শুনলাম না। তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য - তিনি কেবল যে মুখে চাষী-জনতার সুখ-দুঃখের কথা বলছেন তা নয়, তাদের সঙ্গে একাত্মবােধ করার সাধনায়ও সিদ্ধিলাভ করেছেন । দেশবিভাগের পরে  মওলানা সাহেবের সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়। আসাম থেকে সদ্য-আগত। বড়দলৈর জেল থেকে বেরােবার পর তিনি দেশে এসেছেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের মারফতে স্বদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার জন্য। কিন্তু মওলানাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য তদানীন্তন  মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।   একটি প্রচারপত্রও দেখলাম যে, সর্দার প্যাটোই মওলানা সাহেবকে পাঠিয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানকে ধ্বংস করে। ভারতের সঙ্গে জুড়ে দেয়ার জন্য। শহীদ সাহেবের ভাগ্যেও একই লাঞ্ছনা জুটল।  রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত জনতা পাকিস্তান আন্দোলনের এ দুই পরীক্ষিত অগ্রনায়ক সম্বন্ধে ক্ষমতাসীনদের অপপ্রচারে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করে নাই”(১৫/৩৯-৪০)। মওলানা ভাসানী ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক জীবন মিলিয়ে যথার্থই ‘ক্যারিশমেটিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। একদিকে তিনি সমাজতন্ত্রী-বামপন্থী, অপরদিকে ‘পীরালী’ প্রথা-আচরণে অভ্যস্থ ছিলেন। ভাসানীর আদর্শে আস্থাশীল আবু জাফর শামসুদ্দিনের লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি : “খুব সম্ভব ১৯৪৫ সালের। শেষদিকে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ঐ সম্মেলন (বাহাদুরাবাদ ঘাটে) আহ্বান করেছিলেন। আসাম মন্ত্রিসভার বাঙ্গাল-খেদা নীতি ছিল আলােচ্য বিষয় । তিনি (ভাসানী) ছিলেন ময়মনসিংহ, রংপুর এবং আসামের ধুবড়ি জেলা। এবং ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলের পীর। গিয়ে দেখি কম করেও লক্ষাধিক। লােক । গরু-খাসি-বকরি বে-এন্তেহা জবাই হচ্ছে। ভাত গােশত ডাল রান্না চলছে। সবাই ফ্রি আহার করছেন। বলাবলি হতে শুনেছি, জিনেরা মওলানা ভাসানীর। তাঁবে। খাওয়া-খাদ্য ওরাই যােগায়। চেয়ে দেখলাম, জিন্নাত নয় মওলানা ভাসানীর মুরিদরাই যার যেমন আওকাত কিছু না কিছু নিয়ে আসছে, চাল ডাল গরু, খাসি সমানে আসছে; মাতবর শ্রেণীর মুরিদগণ সেগুলি জমা নিচ্ছেন এবং প্রয়ােজন মতাে খরচ করছেন” (৮/২২০-২২১)। 

  আরেকদিন একটি সভা থেকে মওলানা ভাসানীর ফেরার পথে, “কিছু দূর অন্তর অন্তর লােকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে তেলের শিশি, পানির ঘটি, মাটির ঢেলা প্রভৃতি। গাড়ি থামিয়ে মওলানা ভাসানী ফু দিচ্ছেন আর ওরা দু চারটা করে পয়সা পীরের হাতে দিচ্ছে। মওলানা পকেটে পুরছেন এবং পথিমধ্যে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন। পথিমধ্যে প্রাপ্ত একটি পয়সাও মওলানা নিয়ে আসেননি”(৮/২২৬)। দেশের নিরক্ষর জনসাধারণের মধ্যে মওলানা ভাসানীর জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গে আবু জাফর শামসুদ্দিন এ কথাও লিখেছেন যে, “শুধু পীর-মুরিদী এই জনপ্রিয়তার কারণ ছিল না। তিনি জনসাধারণের একজন রূপে তাদের পরম আত্মীয়রূপে মিশতে পারতেন। তাঁর মার্কিনের লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি তালের আঁশের টুপি অথবা সাদা টুপি ছিল সাধারণের সঙ্গে আত্মীয়তার প্রতীক” (৮/২২১)। দেশ-বিভাগের পরে তিনি টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে বসবাস শুরু করেন এবং মত-পথ পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে আমৃত্যু (১৭ নভেম্বর, ১৯৭৬) রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। 

 স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৩০-এ মওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যােগ দিয়েছিলেন, ১৯৩৬-এ সােহরাওয়ার্দী, ১৯৩৭-এ ফজলুল হক আর শেখ মুজিব যােগ দিয়েছিলেন ১৯৩৯-এ। শেখ মুজিব নিজেই জানিয়েছেন, “১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই বেড়াতে । শহীদ সাহেবকে বললাম, গােপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব । খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যােগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল। একজন মােক্তার সাহেব সেক্রেটারি হলেন, অবশ্য আমিই কাজ করতাম। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি একটা গঠন করা হল। আমাকে তার সেক্রেটারি করা হল। আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম” (৯/১৩-১৪)। তবে এ কথা সবারই জানা, সরাসরি মুসলিম লীগে যােগ না দিলেও কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র জীবনের শুরু (১৯৪২) থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন সােহরাওয়ার্দীর অনুসারী সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। দুর্ভিক্ষ (১৯৪৩) পরবর্তী মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আবু জাফর শামসুদ্দীন লিখেছেন : “তখন নেতৃত্ব নিয়ে লড়াই চলছে। বামপথ ও ডানপথের নামে । একপক্ষে ছিলেন মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ ( ঢাকায় ‘আজাদ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা; জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গীয়), খাজা নাজিমুদ্দীন ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া) প্রমুখ । অপরপক্ষে বৈপ্লবিক ইসলাম এবং রাব্বানিয়াত তত্ত্ব নিয়ে মাঠে অবতীর্ণ হন বর্ধমানের জমিদার আলীগড়ের এম.এ আবুল হাশেম (হাশিম) সাহেব । সােহরাওয়ার্দী সাহেবও এ উপদলে ছিলেন। সােহরাওয়ার্দীআবুল হাশেম উপদলের প্রধান প্রধান ছাত্রকর্মীদের মধ্যে ছিলেন ফরিদপুরের শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকার শামসুদ্দীন আহমদ, টাঙ্গাইলের শামসুল হক প্রমুখ”(৮/১৯৫-১৯৬)। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে একটা নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেন এবং নতুনভাবে যুক্তিতর্ক দিয়ে বােঝাতে চেষ্টা করতেন যে, পাকিস্তান দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু-মুসলমানদের মিলানাের জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সুখে বসবাস করতে পারে তারই জন্য। তিনি আমাদের কিছুসংখ্যক কর্মীকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে রাতে আলােচনা সভা করতেন মুসলিম লীগ অফিসে। হাশিম সাহেব আমাদের বললেন, একটা লাইব্রেরি করতে হবে, তােমাদের লেখাপড়া করতে হবে। শুধু হিন্দুদের গালাগালি করলে পাকিস্তান আসবে না। আমি ছিলাম শহীদ সাহেবের ভক্ত। হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের ভক্ত ছিলেন বলে আমিও তাকে (হাশিম সাহেবকে) শ্রদ্ধা করতাম, হাশিম সাহেব বলতেন, মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে। গ্রাম থেকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে”(৯/২৪)। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রজীবনেই (১৯৪২-৪৭) সােহরাওয়ার্দীর অনুসারী তরুণ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সকলেরই প্রশংসা-মনােযােগ আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে বেকার হােস্টেল এবং ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। হােস্টেল বা কলেজ সংসদ নির্বাচনে তার মনােনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনাে প্রার্থী দাঁড়াতাে না। কোনাে সময় বিভিন্ন ছাত্র-গ্রুপের মতান্তর-বিভেদ ঘটলে সকল পক্ষই তাঁকে মেনে নিত । তিনি ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে গােপালগঞ্জের মুসলিম। লীগের সংগঠক-সমন্বয়কের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেছেন। সবিশেষ উল্লেখযােগ্য যে, দেশভাগের আগে সিলেটের পাকিস্তানে যােগদানের প্রশ্নে যে ‘রেফারেন্ডাম  (জুন, ১৯৪৭) হয়েছিল, সেখানে সােহরাওয়ার্দী পাঁচ শত স্বেচ্ছাসবক পাঠিয়েছিলেন। মুজিব লিখেছেন : “মওলানা তর্কবাগীশ, মানিক ভাই ( তােফাজ্জল হােসেন, পরবর্তী সময়ে ইত্তেফাকের সম্পাদক), ফজলুল হক ও আমি পাঁচশত কর্মী নিয়ে একদিন সিলেটে পৌঁছি। আমাদের জন্য সিলেটের গণভােট কমিটির শুধু কোন এলাকায় কাজ করতে হবে,  সেখানে পৌঁছে দিতে হয়েছে। যাবতীয় খরচপত্রের ব্যবস্থা শহীদ সাহেব করে দিয়েছিলেন” (৯/৭৫-৭৬)। এ তথ্য থেকে লক্ষণীয় যে, শেখ মুজিব তখনই কর্মী পর্যায় থেকে নেতৃত্বে উঠে আসছেন। 

  হক-ভাসানী-মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : 

 সােহরাওয়ার্দীর পাকিস্তানে আগমন 

 দেশভাগের পরে হক-ভাসানী-মুজিবের পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসাটা ছিল যথার্থই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। অপরদিকে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর জন্ম এবং পৈতৃক নিবাস ছিল পশ্চিম বাংলার কলকাতায়। মুসলিম লীগের রাজনীতি এবং পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত থাকলেও তাঁকে আসতে হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের আরােপিত অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে, প্রায় দু বছর পরে। সবার আগে পূর্ব বাংলায় (ঢাকায়) এসেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন : “আমি ভাবতাম, পাকিস্তান কায়েম হয়েছে, আর চিন্তা কি? এখন ঢাকায় যেয়ে ল’ ক্লাসে ভর্তি হয়ে কিছুদিন মন দিয়ে লেখাপড়া করা যাবে। চেষ্টা করব, সমস্ত লীগ কর্মীদের নিয়ে যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা না হয়। সেপ্টেম্বর (১৯৪৭) মাসে ঢাকা এলাম। পূর্বে দু একবার এসেছি বেড়াতে। পথঘাট ভাল করে চিনি না। ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে উঠব ঠিক করলাম । শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের কর্মীদের সভা ডেকেছেন আমাকে পূর্বেই খবর দিয়েছেন। তাই কয়েকদিন পূর্বেই এসে হাজির হতে হল। শামসুল হক সাহেব বললেন, ‘জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় কনফারেন্স করব? সরকার নাকি এটাকে ভাল চোখে দেখছে না। আমাদের কনফারেন্স যাতে না হয়, সেই চেষ্টা করছে এবং গােলমাল করে কনফারেন্স ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমি বললাম, এত তাড়াতাড়ি এরা আমাদের ভুলে গেল হক সাহেব । হক (শামসুল) সাহেব হেসে দিয়ে বললেন, এই তাে দুনিয়া” (৯/৮২-৮৩)। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ-বিরােধী রাজনীতির কথা হােক কিংবা অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূচনা, সর্বার্থেই ১৫০ নং মােগলটুলী হয়ে উঠেছিল তার আদি ঠিকানা এবং শেখ মুজিব তখন থেকেই কথায়-কাজে হয়ে উঠছিলেন পূর্ব বাংলার প্রথম সক্রিয় প্রতিবাদী রাজনীতিবিদ। 

 শেখ মুজিবের পরেই কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন: “পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকাতে সমগ্র রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও রাষ্ট্র-নেতারাও চলিয়া আসিয়াছেন। হক সাহেব তখনও কলিকাতায় পড়িয়া আছেন। পাকিস্তান-প্রস্তাবের প্রস্তাবক হইয়াও তিনি শেষ পর্যায়ে জিন্নাহ সাহেবের সাথে ঝগড়া করিয়া মুসলিম লীগ হইতে বাহির হইয়া যান। জিন্নাহ সাহেব বলেন, ফজলুল হকের কপালে ওয়াটারলু (চরম পরাজয় ও রাজনৈতিক মৃত্যু) ঘটিয়াছে। যারা ফজলুল হককে জানিত, তারা এটাও জানিত যে, শেরে-বাংলার মৃত্যু (রাজনৈতিক) ঘটে নাই” (৪/২৮৩)। তবে উল্লেখ্য যে, ঢাকায় ফিরেও শেরে বাংলা রাজনীতিতে যােগ দেননি, এমনকি প্রবল মাতৃভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি রাজনীতির সাথে প্রায় সংযােগ-সম্পর্কহীনই ছিলেন। ঢাকায় এসে ফজলুল হক প্রথমে খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পরে নুরুল আমিন প্রমুখ। দু’জন মুসলিম লীগার মুখ্যমন্ত্রীর আমলেই প্রাদেশিক সরকারের অ্যাডভােকেট জেনারেল পদে নিয়ােজিত ছিলেন। তিনি ঢাকায় আওয়ামী লীগ গঠনের কর্মী সম্মেলনে (২৩ জুন, ১৯৪৯)কিছু সময় উপস্থিত থাকলেও দলে যােগ দেননি। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : “১৯৫৩সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি অ্যাডভােকেট জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করে মুসলিম লীগে (পুনরায়) যােগদান করেন। মুসলিম লীগের মধ্যে তখন কোন্দল শুরু হয়েছিল ভীষণভাবে। মােহন মিয়া সাহেব নুরুল আমিন সাহেবের বিরুদ্ধে গ্রুপ সৃষ্টি করেন এবং হক সাহেবকে মুসলিম লীগের সভাপতি করতে চেষ্টা করে পরাজিত হন। ফলে মােহন মিয়া ও তার দলবল (হক। সাহেবসহ) লীগ থেকে বিতারিত হন। এরপর আমি তাঁকে (ফজলুল হক) আওয়ামী লীগে যােগদান করতে অনুরােধ করলাম। চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় তিনি যােগদানও করলেন। সেখানে ঘােষণা করলেন, যারা চুরি করবেন, তারা মুসলিম লীগে থাকুন, আর যারা ভাল কাজ করতে চান, তারা আওয়ামী লীগে যােগদান করুন। আমাকে ধরে জনসভায় বললেন, ‘মুজিব যা বলে তা আপনারা শুনুন। আমি বেশি বক্তৃতা করতে পারব না, বুড়া মানুষ। এ বক্তৃতা খবরের কাগজেও উঠেছিল” (৯/২৪৪)। পূর্ব বাংলা বা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে তৃতীয় নামটি মওলানা ভাসানীর। তখন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং অন্যতম মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী নির্বাচিত পরিষদ সদস্য ছিলেন না। ১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইনে অনির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের ছয় মাসের অধিক মন্ত্রী থাকার বিধান ছিল না। তাই প্রথম টাঙ্গাইল দক্ষিণ নির্বাচনী এলাকায় আসন খালি হওয়ায় তিনি (নাজিমুদ্দিন) সেখানে প্রার্থী হলেন। ঐ সময় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কিছুদিনের জন্য কাগমারী এসেছিলেন, সবাই ধরে তাকে প্রার্থী করে দিলেন। 

  নাজিমুদ্দিন সাহেব ভয় পেয়ে সেখান থেকে তাঁর (নিজের) নাম প্রত্যাহার করলেন   ফলে মওলানা সাহেব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিষদে নির্বাচিত হলেন। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে তার কোন আকর্ষণ না থাকায় তিনি আসামে চলে যান। ওখানে যাবার কিছুদিন পরেই আসাম সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজবন্দি করে রাখে” (১৪(২)/১১০)। বঙ্গবন্ধুর বিবরণ কিছুটা ভিন্ন : “টাঙ্গাইলে দুইটা আইনসভার আসন খালি হয়েছিল। আমাদের ইচ্ছা ছিল, নাজিমুদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে লােক দেওয়া যায় কিনা? তাঁর শরণাপন্ন হলাম। কিন্তু মওলানা সাহেব এক সিট নিজে এবং এক সিট নাজিমুদ্দিন সাহেবকে দিয়ে নির্বাচন করে এমএলএ হলেন। পরে নির্বাচনী হিসাব দাখিল না করার জন্য মওলানা সাহেবের নির্বাচন বেআইনি ঘােষণা হয়েছিল”(৯/১০১)। আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আসাম কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে পূর্ব বাংলায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিব। পূর্ব বাংলায় ফিরে মওলানা ভাসানী পুনরায় বসবাস শুরু করেছিলেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। আরাে কিছুদিন পরে ঢাকার রােজ গার্ডেনের যে কর্মিসভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ  গঠন করা হয়েছিল, তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন মওলানা ভাসানী। উল্লেখ্য যে, কয়েক মাস আগে কর্মিসভার আহ্বায়ক কমিটি গঠনের সময় মওলানা ভাসানীকে ‘আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি’ পরিচয়ে আহ্বায়ক মনােনীত করা হয়েছিল। সম্পাদক মনােনীত হয়েছিলেন ইয়ার মুহম্মদ খান। প্রসঙ্গত এখানেই উল্লেখ করা যেতে পারে যে, একদিকে তিনি দ্রুতই পূর্ব বাংলায় সরকার-বিরােধী রাজনীতির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এ কথাও যে, সারা জীবন রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও মওলানা ভাসানী প্রথাসিদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কখনাে আকর্ষণ বােধ করেননি। বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে “মওলানা ভাসানীর কোন শৃঙ্খলাবােধ না থাকায় তিনি অনেক সময় ইচ্ছামত  কাজ পরিচালনা করতেন এবং তার ফলে অনেক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিতাে” (১৮/১৮)। অতঃপর সােহরাওয়ার্দীর পাকিস্তানে আগমনের প্রসঙ্গ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরবর্তী দু’বৎসরাধিক কাল কোলকাতায় মহাত্মা গান্ধীর সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় নিয়ােজিত থেকে “যখন ঢাকা রওনা হলেন, তখন অর্ধপথে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন, তাঁর পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। পাকিস্তান গণপরিষদে তার সদস্য পদটিও (জিন্নাহর মৃত্যুর পরে) বাতিল করে দেওয়া হয়” (১১/১৩১)। উল্লেখ্য যে, তিনি তখনও পশ্চিমবঙ্গ (প্রাদেশিক) পরিষদে সদস্যপদ বজায় রেখে সেখানে মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের চেষ্টা করছিলেন। দৃশ্যত একারণেই “সােহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানে অবৈধ ঘােষিত ব্যক্তি । এ সময় তিনি একবার পাকিস্তানে প্রবেশের চেষ্টা করলে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাট থেকে পুলিশ তাঁকে একখানি ১ম শ্রেণীর রিটার্ন টিকিট ধরিয়ে দিয়ে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। সােহরাওয়ার্দীকে কলকাতায় ফেলে রাখার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান সে সময়ে ন্যক্কারজনকভাবে উক্তি করেছিলেন Surhrawardi ?  the mad dog let loose by India  – সােহরাওয়ার্দী ভারতের প্রভাবাধীন একটি পাগলা কুকুর” (১৯/৫৬)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসার ব্যাপারে, সম্ভবত স্মৃতি-নির্ভরতার কারণেই বিভিন্ন সূত্রে তথ্য-ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। উপরােদ্ধৃত দু’টি তথ্যেও ভিন্নতা লক্ষণীয়। অপরদিকে কামরুদ্দীন আহমদ উল্লেখ করেছেন, “১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকায় আগমন করেন এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের অতিথি হন। তাঁর সঙ্গে দু দেশের বাস্তুহারাদের সমস্যা সম্পর্কে সম্বন্ধে আলােচনা করেন। তিনি নাজিমুদ্দিন সাহেবকে বলেন যে, সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করে শান্তি ফিরিয়ে আনতে না পারলে অবস্থা আরাে সংকটাপন্ন হয়ে দাঁড়াবে” (১৪(২)/১১১)। 

  তবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লিখিত বিভিন্ন তথ্য থেকে এমন ধারণাই হয় যে, ১৯৪৮-  ৪৯ সময়কালে সােহরাওয়াদী একাধিকবার ঢাকায় এসেছিলেন। এবার পর্যায়ক্রমে সেই তথ্যগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে। 

  ঠিক দিন-তারিখের উল্লেখ নেই, তবে প্রসঙ্গ-বিবেচনায় ধারণা করা চলে ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন পারিবারিক প্রয়ােজনে “এই সময় আমি কিছুদিনের জন্য কলকাতায় যাই। আমাকে দেখে (সােহরাওয়ার্দী সাহেব) খুব খুশি হলেন এবং বললেন ‘আমি শীঘ্রই পূর্ব বাংলায় যাব এবং কয়েকটা সভা করব, যাতে হিন্দুরা (ভারতে) না আসে। শহীদ সাহেব ঢাকা হয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে পরামর্শ করে বরিশালে সভা করতে যাবেন ঠিক হল। শহীদ সাহেব ঢাকায় এসে নাজিমুদ্দিন সাহেবের কাছেই থাকতেন। আমরা স্টিমারে বরিশাল রওয়ানা করলাম। কলকাতা থেকে প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষও (পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী) এসেছেন”(৯/৮৫-৮৬)। সােহরাওয়ার্দীর দ্বিতীয়বার পূর্ব বাংলায় আসার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর লেখায় জানা যায় : “দিনটা আমার ঠিক মনে নাই। তবে ঘটনাটা মনে আছে, ১৯৪৮ সালের ভিতর হবে। সােহরাওয়ার্দী সাহেব ঢাকায় এসেছিলেন এবং সলিমূল্লাহ মুসলিম হলে এক ছাত্রসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। শহীদ সাহেবের বক্তৃতা এত ভাল হয়েছিল যে, যারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করতেন তারাও তাঁর ভক্ত হয়ে পড়লেন। শহীদ সাহেব পরে আবার (অর্থাৎ তৃতীয় বার) যখন ঢাকায় আসলেন, তখন কতগুলি সভার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, যাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকে। প্রথম সভার জায়গা ঠিক হল টাঙ্গাইল। স্টিমারে মানিকগঞ্জ যেতে হবে, পথে আরাে একটি সভা হবে। শহীদ সাহেব প্লেন থেকে ঢাকায় নেমে সন্ধ্যায় বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়বে । আমিও সাথে যাব। আমরা শহীদ সাহেবকে নিয়ে জাহাজে উঠলাম। জাহাজ ছয়টায় ছাড়বার কথা, ছাড়ছে না। রাত আটটায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিআইজি পুলিশ শহীদ সাহেবের হাতে একটা কাগজ দিলেন, তাতে লেখা, “তিনি ঢাকা ত্যাগ করতে পারবেন না। তবে যদি কোলকাতা ফিরে যান, সরকারের আপত্তি নাই। তিনি ঢাকায় যে কোনাে জায়গায় থাকতে পারেন তাতেও আপত্তি নাই। শহীদ সাহেব জাহাজ ছেড়ে নেমে আসলেন, আমিও তার মালপত্র নিয়ে সাথে সাথে নেমে আসলাম। দুইদিন পরে শহীদ সাহেবকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে জাহাজে (কোলকাতাগামী) তুলে দিলাম” (৯/১০৮)। সম্ভবত এ ঘটনাটিকেই নানাসূত্রে এই বলে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি একবার পাকিস্তানে প্রবেশের (৩জুন, ১৯৪৮) চেষ্টা করলে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাট থেকে পুলিশ তাঁকে একখানি ১ম শ্রেণীর রিটার্ন টিকিট ধরিয়ে দিয়ে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল”। এখানে একটি কৌতূহলােদ্দীপক প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি যাতে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিবিদ সােহরাওয়ার্দী এবং ‘মুখােশ-ঢাকা’ পুলিশ-আমলা জাকির হােসেনের চারিত্র্য-পরিচয় অনেকটাই স্পষ্ট হতে পারে। সেদিন সােহরাওয়ার্দী যখন স্টিমার থেকে নেমে আসছিলেন, জাকির হােসেন বলেছিলেন ‘আপনি আজ রাতে আমার বাসায় অতিথি হলে সুখী হব । শহীদ সাহেব উত্তরে বললেন, “Thanks.If I am not under arrest I would prefer to remain with my host . জাকির হােসেন বললেন, না, আপনি যেখানে খুশি রাত কাটাতে পারেন। শহীদ সাহেব বললেন,  Tell your Nazimuddin that Suhrwardy is not yet dead. এই জাকির হােসেনকে (পূর্বে কনডেমৃড় হওয়া সত্বেও) তিনি একদিন ঢাকার পুলিশ সুপার করেছিলেন। দেশ বিভক্ত হওয়ার সময়ও তাঁকেই আইজি হিসেবে নিযুক্ত তিনি করেছেন কলকাতা মুসলিম লীগ কর্মীদের মতের বিরুদ্ধে” (১৪(২)/১২২-১২৩)। জাকির হােসেনের সাক্ষাৎ পরবর্তী আলােচনাতেও পাওয়া যাবে। জুন, ১৯৪৮ সােহরাওয়ার্দী বিমানে ঢাকায় এসেছিলেন। তখনকার একটি তথ্যের উল্লেখ করেছেন আবু জাফর শামসুদ্দীন: “ঠিক তারিখটা মনে নেই। পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সােহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর পুনর্বাসন যে কোনাে উপায়ে ঠেকিয়ে রাখাটাই ছিল তৎকালীন মুসলিম লীগারদের একমাত্র রাজনীতি। আমি, জহুর (হােসেন চৌধুরী) এবং আরাে কে কে যেন জনসন রােডে আমার দোকানে বসে গল্প-গুজব করছি। এমন সময় দেখি সমুখে দুটো খালি ট্রাকে রাস্তার গরিব কুলিমজুর এবং বেকার যুবকদের তােলা হচ্ছে। ট্রাক বােঝাই হতেই চোঙ্গায় আল্লাহু আকবর পাকিস্তান জিন্দাবাদ, সােহরাওয়ার্দী মুরদাবাদ ধ্বনি তুলল দু ট্রাকের দু’নেতা। অন্যেরা যােগ দিল, তারপর ট্রাক দুটো তেজগা বিমানবন্দরের দিকে ছুটল। পরে জানতে পেরেছিলাম, প্রতি ব্যক্তিকে ১০টাকা করে পারিশ্রমিক দিয়ে ট্রাক বােঝাই করা হয়েছিল” (৮/২৫৮-২৫৯)। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ইউসুফ আলী চৌধুরী। সােহরাওয়ার্দীর আরেকবার (সম্ভবত তৃতীয় বার) পূর্ব বাংলায় আসার কথা বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন এভাবে, “শহীদ সাহেবও এই সময় ঢাকা আসলেন এবং মাদারীপুর, গােপালগঞ্জ ও আরও কয়েক জায়গায় সভা করলেন, তাতে ফল খুব ভাল হল। হিন্দুদের দেশত্যাগ করার যে একটা হিড়িক পড়েছিল তা অনেকটা বন্ধ হল এবং পশ্চিম বাংলা ও বিহার থেকেও মুসলমানরা অনেক কম আসতে লাগল । এই সমস্ত সভায় এত বেশি জনসমাগম হত এবং শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করার জন্য এত লােক উপস্থিত হত যে নাজিমুদ্দিন সাহেবের সরকার ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। এবার শহীদ সাহেব (ঢাকায়) নবাবজাদা নসরুল্লাহ সাহেবের বাড়িতে উঠেছিলেন। শহীদ সাহেবকে বিদায় দিলাম গােপালগঞ্জ থেকে। সবুর সাহেব খুলনায় শহীদ সাহেবকে অভ্যর্থনা করলেন। কারণ, সবুর সাহেব তখনও শহীদ সাহেবের কথা ভুলতে পারেন নাই । তাঁকে সমর্থন করতেন এবং আমাদেরও সাহায্য শরতেন”। প্রসঙ্গতই বঙ্গবন্ধু আরাে উল্লেখ করেছেন, “এইবার যখন শহীদ সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে এলেন, আমরা দেখলাম সরকার ভাল চোখে দেখছে না। দু একজন (সরকারি কর্মকর্তা) গােপনে বলেই ফেলেছিল, “উপরের হুকুম, যাতে তারা সহযােগিতা না করে। গােয়েন্দা বিভাগের তৎপরতাও বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিল”(৯/১০২-১০৩)। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, শহীদ সােহরাওয়ার্দীর তৃতীয়বার পূর্ব বাংলায় আসাটা কখন হয়েছিল? লক্ষণীয় যে, এসময় পূর্ব বাংলায় বক্তৃতা-সফরে সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গী ছিলেন শেখ মুজিব। উল্লেখ করা যেতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে জড়িত হয়ে উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান ধর্মঘট করার কারণে শেখ মুজিবকে ১৯এপ্রিল, ১৯৪৯ খ্রি. গ্রেফতার করে নিরাপত্তা আইনে বন্দী রাখা হয়, তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার (২৩ জুন,  ১৯৪৯) পর ২৯ জুন তারিখে । সুতরাং অবধারিত যে, পূর্ব বাংলায় সােহরাওয়ার্দীর তৃতীয় সফরটি ১৯৪৯-এর জুলাই মাসের আগে ঘটেনি। যদিও কামরুদ্দিন আহমদ বলেছেন, “এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি শহীদ সাহেব ঢাকা এলেন তার শান্তি মিশনে”। কোনাে কোনাে তথ্য-সূত্রে জানা যায়, পাকিস্তান হবার পর সেবার ঢাকাতেই খাজা নসরুল্লাহর দিলকুশার বাসায় মওলানা ভাসানী এবং সােহরাওয়ার্দীর প্রথম সাক্ষাৎ-আলােচনা হয়েছিল। 

 “Suhrwardy, had finally ended his residence in India in 1949 to settle in West Pakistan and was more interested in national, rather than provincial politics” (১৭/৪৬)। তখন সােহরাওয়ার্দী কোলকাতা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে ফিরে আইন-পেশা শুরু করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে লাহাের-করাচিভিত্তিক, মুসলিম লীগ-বিরােধী রাজনীতি শুরু করার জন্য নিজস্ব সংগঠন গড়ে নাম দিয়েছিলেন ‘জিন্নাহ মুসলিম লীগ’ । কিন্ত “শহীদ সাহেবের পশ্চিম পাকিস্তানে কোনাে রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। সুতরাং সেখানে তিনি একটি সংগঠন ড্রইংরুমে বসে তৈরি করে সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাবের ‘উপরের চক্র থেকে কিছু লােক জোগাড় করতে সচেষ্ট হন। সিন্ধুতে   নইলে অন্তত করাচিতে কোন সংগঠন করা যায় কি না তার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু ..সম্ভব হয়নি। মওলানা ভাসানী সাহেব তাকে ঢাকায় তার কর্মস্থল করতে বললেন। কারণ তাঁর মতে শহীদ সাহেব করাচিতে পাত্তা পাবেন না, মাঝখান থেকে পূর্ব বাংলাও হারাবেন। শহীদ সাহেবের (পঃ পাকিস্তানে বসবাসের) সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল তার উচ্চাভিলাষ। পূর্ববঙ্গে কর্মস্থল করলে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া কখনাে সম্ভব হবে না ” (১৪(২)/১৩১১৩২)। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তিনি স্থায়ী বসবাসের ঠিকানা পশ্চিম পাকিস্তানে রেখেই পূর্ব বাংলায় গঠিত ভাসানী-মুজিবের ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’এ যােগ দিয়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন, আমৃত্যু (১৯৬৩) বেশ দীর্ঘকাল। বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন : “১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন এবং খাজা নাজিমুদ্দিনকে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন জনাব নুরুল আমিন সাহেব। এই সময়ও কিছু সংখ্যক এমএলএ শহীদ সাহেবকে পূর্ব বাংলায় এসে প্রধানমন্ত্রী হতে অনুরােধ করেছিলেন। তিনি রাজি হন নাই। গণপরিষদে একটা নতুন আইন পাস করে শহীদ সাহেবকে গণপরিষদ থেকে বের করে দেওয়া হল” (৯/১০৯)। এখানে পাকিস্তান গণ-পরিষদে গৃহীত সেই নতুন আইনটির কথা উল্লেখ করা দরকার। নতুন আইনে বলা হলাে যে, “পাকিস্তানে যেসব সদস্যদের বাড়ি নেই বা সরকারের নিকট থেকে বাড়ি ‘এলটমেন্ট’ নেননি, তাদের গণ-পরিষদের সদস্য থাকতে দেয়া হবে না। শহীদ সাহেব ‘বিলের বিরােধিতা করলেন। বললেন, কেবল তাঁকেই বের করার জন্য ঐ ‘বিল আনা হয়েছে। তার বা তাঁর পিতা বা পিতামহের কোন বাড়ি কোথায়ও নেই, কি ভারতে কি পাকিস্তানে, তাই বলে সেটি একটা অপরাধ হতে পারে না” (১৪(২)/১২৫)। তথাপি এ আইনেই শহীদ সােহরাওয়ার্দীর গণ-পরিষদ সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছিল। 

 পাকিস্তানি শাসনের শুরু : পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদী আন্দোলনের সূচনা 

 বঙ্গবন্ধুর একটি অনস্বীকার্য উক্তি উদ্ধৃত করেই প্রসঙ্গটি শুরু করা যেতে পারে : “পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়েছিল” (৯/৭৫)। ইতিহাস সাক্ষী, পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানিরাই নন, তাঁদের তল্পিবাহক এবং সহায়ক হিসেবে সকল পর্যায়েই যুক্ত ছিলেন কতিপয় বাঙালি রাজনীতিবিদ এবং আমলা-প্রশাসকও। শেখ হাসিনার প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ : “পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পূর্ব পাকিস্তান নামক অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠী বৈষম্য ও উপেক্ষায় বঞ্চিত হচ্ছিল অনবরত। বাংলাদেশ অর্থাৎ তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তান মূলত ছিল পাকিস্তানের একটা কলােনি। অত্যন্ত অবহেলিত একটা প্রদেশ, যা কিনা বারাে শ  মাইল দূরে অবস্থিত।  বড় বিচিত্র আমাদের এই ভূখণ্ড! এখানে একদিকে যেমন রয়েছে। আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত মানুষ, আবার অপরদিকে রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতায় কলঙ্কিত মােনাফেক” (১(১)/২৩-২৪)। ১৯৪৭-১৯৭১ কালপর্ব-জুড়ে হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী-মুজিব প্রমুখ চারজন মহান। রাজনীতিবিদের বহুমুখী সচেতন উদ্যোগ-অবদানেই পূর্ব বাংলায় চলেছে নিরবচ্ছিন্ন প্রতিবাদী সংগ্রাম। দেশভাগের পরবর্তী সময়ে পূর্ব বাংলার রাজনীতির চার-প্রধানের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম কোলকাতা ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন এবং কালক্রমে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন এপার বাংলার রাজনীতির প্রধানতম পুরুষ। সুতরাং চার-প্রধানের কনিষ্ঠতম মুজিবের কথা দিয়েই এ পর্যায়ের আলােচনা শুরু করতে হবে এবং অতঃপর ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে সমধিক পরিমাণেই আসবে তাঁর কথা, এ-সত্যও অনস্বীকার্য । ‘স্থির লক্ষ্যের রাজনীতিবিদ শেখ মুজিব’ নিবন্ধে স্বদেশ রায় লিখেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন বিকশিত হবার অনুকূল পরিবেশ পায় পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই । ঢাকা-কেন্দ্রিক পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে পূর্ব বাংলার নেতা ছিলেন শেরে বাংলা আর কোলকাতা-কেন্দ্রিক বাংলার মুসলিম নেতা ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুকাল আগে থেকে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক শেরে বাংলা অনেকটা পরাজিত হন। তিনি রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কোলকাতা-কেন্দ্রিক যে মুসলমানদের নেতা সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তান সৃষ্টির আগে তিনিও মুসলিম লীগের কট্টর রাজনীতির কাছে অনেকখানি পরাজিত হয়েছিলেন। জিন্নাহ-লিয়াকত আলীরা পূর্ব বাংলার রাজনীতি তুলে দেন নবাব পরিবারের হাতে। খাজা নাজিমুদ্দিন হন পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের নেতা” (১(৩)/১৫২৩-২৪) এবং মুখ্যমন্ত্রী। বিশিষ্ট সংস্কৃতি-জন এবং সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক ‘হৃদয়টা ছিল তাঁর আকাশের মত  শিরােনামের নিবন্ধে লিখেছেন : “সােহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে হেরে গিয়ে এলেন না এ দেশে, ভারতের মুসলমানদের (ও গান্ধীজীর) সেবা করবার জন্য রয়ে গেলেন ভারতে। মুজিব কি কেবল তারই কারণে প্রতিবাদী রাজনীতি গ্রহণ করলেন? তা হলে মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেবেন কেন? সােহরাওয়ার্দী মুগ্ধতার ব্যাপারটা ছিল মুজিবের অনেক দিন । কিন্তু এটাই তার জীবনের প্রধান নিয়ামক ছিল না। 

  শহীদ সাহেব ও অন্যান্য অনেক মুসলমান নেতাদের মত তিনি পদলালসায় রাজনীতি করতেন না। রাজনীতি তিনি করতেন, তাঁর বুদ্ধিতে যতদূর কুলায়। অধিকাংশের (তথা কৃষকের) মঙ্গলের স্বার্থে, তাঁর অভ্রান্ত কিবলা ছিল সর্বমানবের, তার আশপাশের সর্বগরিবের কল্যাণ। এবং সেখানে পৌঁছবার তাঁর অবলম্বন ছিল এই লাঞ্ছিত নিপীড়িতদের মতামত। সকলেই জানে, তিনি জাতির পালস্ কতটাই না পড়তে পারতেন” (১(৩)/১৫৩৪)। “জনগণের নাড়িনক্ষত্রের খবর তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) ছিল অসাধারণ   শেরে বাংলা বা সােহরাওয়ার্দী কোনমতেই তার সমকক্ষ ছিলেন না। অনেক আদর্শ বা ধারণা তিনি (শেখ মুজিব) আবিষ্কার করেননি, কিন্তু একটি আদর্শকে জনগণের আদর্শে রূপান্তরিত করতে তিনি ছিলেন সার্থক শিল্পী। জনহিতে নিবেদিত এমন নেতা আমি আর দেখিনি”। বাংলাদেশ ও শ্রেষ্ঠতম বাঙালি  নিবন্ধে আবুল মাল আবদুল মুহিত আরাে লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ শিল্প-সাহিত্য ও রুচির বিকাশে দিশারী। দেশবন্ধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ। জাতীয়তাবােধ জাগরণে বিপিন পাল চিরবিদ্রোহী। সমাজ বিনির্মাণে রাজা রামমােহন রায় সংস্কারের অগ্রদূত। বাংলা ভূখণ্ডের একীভূত অবস্থান রচনায় গােপাল, ইলিয়াস শাহ ও শায়েস্তা খানরা মহান স্রাট। ধর্মপ্রচারে হযরত শাহ-জালাল বা অতীশ দীপঙ্কর অথবা শ্রীচৈতন্য নতুন দিগন্ত উন্মােচিত করেছেন। একান্তভাবে বাংলার শাশ্বত উত্তরাধিকারের বাহক, একজন 

  সাধারণ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান এদের সবার উপর বাঙালি জাতিকে উপহার দেন একটি জাতিরাষ্ট্র   ৫৭ হাজার বর্গমাইলে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ” (১(২)/৬২৪)। 

 পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার জাতীয় জীবনে সর্বাধিক প্রভাবক রাজনৈতিক ঘটনাটি ছিল বাঙালির ভাষা আন্দোলন, অনস্বীকার্যভাবেই যা’ বাঙালির স্বায়ত্তশাসন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ নির্মাণ করেছিল। ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বিস্তার ছিল ১৯৪৮- ৫২খ্রি. সময়কালে। এ সময়কালের মধ্যেই ১৯৪৯ খ্রি. সংঘটিত হয়েছিল ভিন্ন দু’টি ঘটনা, একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘট আর দ্বিতীয়টি আওয়ামী মুসলিম লীগ’এর প্রতিষ্ঠা। নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা এবং বাংলার ভাষা-আন্দোলন সর্বতােভাবেই ছিল জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন, জাতীয় গুরুত্বের ঘটনা না হলেও, পরােক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল মুজিবের ব্যক্তি-জীবন। আপাতত এ ঘটনাটির কথাই উল্লেখ করা যেতে পারে, অতঃপর পৃথক শিরােনামে আলােচনা করা যাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা এবং ভাষা আন্দোলনের কথা। 

 এমন ধারণাই সঠিক বলে মনে হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনের অংশভাগী হওয়ার পরিণাম-প্রতিক্রিয়াই শেখ মুজিবের প্রতিবাদী রাজনৈতিক সত্তাকে ব্যতিক্রমী জীবনের পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অন্যথায় তিনিও হয়তাে আরাে অনেকের মতই আইনজীবী-রাজনীতিকের প্রথাসিদ্ধ জীবনে জড়িয়ে পড়তেন। কিন্তু ইতিহাসের দাবি ছিল সম্পূর্ণ অন্য রকম। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বলিখিত বিবরণটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে। 

 “১৫০নম্বর মুগলটুলীতে যেয়ে শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভােগী কর্মচারীরা ধর্মঘট (মার্চ, ১৯৪৯) শুরু করেছে এবং ছাত্ররা তার সমর্থনে ধর্মঘট করছে। কর্মচারীরা বহুদিন পর্যন্ত তাদের দাবি পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন করছে একথা আমার জানা ছিল। এরা আমার কাছেও এসেছিল। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রথমে সংঘবদ্ধ হােন, তারপর দাবিদাওয়া পেশ করেন, তা না হলে কর্তৃপক্ষ মানবে না। তারা একটা ইউনিয়ন করেছিল, একজন ছাত্র তাদের সভাপতি হয়েছিল।  কর্তৃপক্ষ এদের দাবি মানতে অস্বীকার করেছে। তবু এত তাড়াতাড়ি ধর্মঘটে যাওয়া উচিত হয় নাই” (৯/১১২)। মুজিব কয়েকজন ছাত্রনেতাসহ ভাইস-চ্যান্সেলারের সাথে আলােচনা করে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, ভিসি আশ্বাসও দিয়েছিলেন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সমস্যাটি সমাধান হয়নি। শেখ মুজিবের মন্তব্য: “একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ও 

  ৫৭ 

  শিক্ষাবিদ সরকারের চাপে কথার মারপ্যাঁচ করতে পারে এটা আমার ভাবতেও কষ্ট হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করে ছাত্রদেরকে হল ছাড়তে নির্দেশ দেয়া হলাে এবং ধর্মঘটকারী কর্মচারীদেরকে বরখাস্ত করা হলাে। এমন পরিস্থিতিতে কর্মচারীরা বন্ড দিয়ে একে একে কাজে যােগদান করায় ধর্মঘট শেষ হয়ে গেল। কিন্তু মুজিবসহ সাতাশ জন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদের জন্য (সর্বোচ্চ চার বছর) বহিষ্কার করা হলাে। বহিষ্কৃতদের মধ্যে একজন ছাত্রীও ছিলেন। শাস্তির আদেশে বলা হয়েছিল ১৭ এপ্রিলের মধ্যে দবিরুল ইসলাম প্রমুখ (চার বছরের জন্য বহিষ্কৃত, এক্ষেত্রে মুজিব অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না) চারজন ছাড়া “আর সকলে বন্ড ও জরিমানা দিলে লেখাপড়া করতে পারবে”। ১৬ এপ্রিলের মধ্যেই ছাত্রলীগের কনভেনরসহ অনেক প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বন্ড-জরিমানা দিয়েছিলেন। কিন্তু মুজিব মুচলেকা দিতে রাজি নন। তিনি ছাত্রলীগের সভা ডেকে কর্তৃপক্ষের শাস্তি-ঘােষণার প্রতিবাদে ছাত্র-ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিলেন। দু দিন ধর্মঘটের পরে, ১৮ এপ্রিল শােভাযাত্রা করে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে গিয়ে মুজিব ঘােষণা করেছিলেন, “আমরা এখানেই থাকব, যে পর্যন্ত শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার করা না হয়। একশ’ জন করে ছাত্র রাতদিন ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে বসে থাকবে। একদল যায় আর একদল থাকে। শুধু আমি জায়গা ত্যাগ করতে পারছিলাম না। কারণ, শুনলাম, তিনি পুলিশ ডাকবেন”(৯/১১৭)। এখান থেকেই ১৯ এপ্রিল তারিখ বিকেলে শেখ মুজিবসহ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২৩ জুন ১৯৪৯, আওয়ামী মুসলিম লীগ  গঠিত হওয়ার কয়েকদিন পরে, ২৯ জুন শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার এখানেই ইতি ঘটেছিল। 

 কর্তৃপক্ষের শাস্তির আদেশ শেখ মুজিবের না-মানা প্রসঙ্গে কামরুদ্দিন আহমদ লিখেছেন : “তার ঐ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বাস্তব ও সময়ােপযােগী হয়েছিল। তিনি তখন জননেতা হবার পথে   তার আর ছাত্র থাকা শােভা পাচ্ছিল না। নিজে থেকে পড়াশােনা ছেড়ে না দিয়ে একটা ইস্যুর উপর পড়াশােনা ছেড়ে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছিল এবং রাজনৈতিক দিক থেকেও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল” (১৪(২)/১২৮-১২৯)। মুজিবের মনেও তখন ছাত্র-যুব রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ কমে গিয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার আগে, কারাবন্দি মুজিবের মতামতের জন্য যােগাযােগ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নিজের কথা, “আমি খবর দিয়েছিলাম, আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা কোটারি করে ফেলেছে’। আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না 

  ৫৮ 

  রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠন গঠন হলে তাতে যােগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ, বিরােধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে” (৯/১২০)। 

 যে জন্য উপরােক্ত দীর্ঘ বিবরণটি উপস্থাপন করা হলাে, মুজিবের ব্যক্তিগত জীবন এবং বাংলাদেশের রাজনীতির জন্যও একান্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই কথাটিও জানা যাক তাঁর লেখা থেকেই : “আব্বা খুবই দুঃখ পেয়েছেন। আমি আইন পড়ব না শুনে বললেন,  যদি ঢাকায় না পড়তে চাও, তবে বিলাত যাও। সেখান থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি নিয়ে এস। যদি দরকার হয়, আমি জমি বিক্রি করে তােমাকে টাকা দিব। আমি বললাম, এখন বিলাত গিয়ে কি হবে, অর্থ-উপার্জন আমি করতে পারব না। আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে। এর একটা পরিবর্তন করা দরকার। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর হবে না কেন? দুর্নীতি বেড়ে গেছে, খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে বন্ধ করে রাখা হচ্ছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মুসলিম লীগ নেতারা মানবে না। পূর্ব পাকিস্তানের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে না। সবকিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে। আব্বাকে সকল কিছুই বললাম। বললাম,  যদি কিছু করতে না পারি, বাড়ি চলে আসব। তবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলতে পারে না। আমাকে আর কিছুই বললেন না”(৯/১২৫-১২৬)। দেখা যাচ্ছে, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে এবং সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেই শেখ মুজিব হয়েছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ এবং এবিষয়ে তাঁর পিতারও নীরব সমর্থন ছিল। 

  ৫৯ 

  আওয়ামী  মুসলিম  লীগ : 

 পূর্ব বাংলার প্রথম প্রতিবাদী রাজনৈতিক সংগঠন 

  টাঙ্গাইলের শামসুল হক আগে থেকেই ছিলেন ১৫০ মােগলটুলিতে অবস্থিত মুসলিম লীগের যুবলীগ কার্যালয়ে, শেখ মুজিবও ঢাকায় এসে (সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭) এখানেই উঠেছিলেন। এসময় তাদের উদ্যোগেই গঠিত হয়েছিল ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ। শামসুল হক নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রথম আহ্বায়ক, শেখ মুজিবুর রহমান ও আতাউর রহমান যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারি ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’এর পাশাপাশি শেখ মুজিব (৪জানুয়ারি, ১৯৪৮) গঠন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, কমিটির আহ্বায়ক হয়েছিলেন নঈমুদ্দিন আহমদ। ১৪-সদস্য নিয়ে গঠিত সাংগঠনিক কমিটিতে শেখ মুজিবুর রহমানসহ তরুণ প্রগতিশীল ছাত্র-কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন”(১(২)/৯২৫)। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। “এক মাসের ভিতর আমি (মুজিব) প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি (ছাত্রলীগের) করতে সক্ষম হলাম।  সরকার প্রকাশ্যে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে সাহায্য করত। আর আমাদের (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) বিরুদ্ধে গােয়েন্দা লাগিয়ে দিত (৯/৮৯)। 

 কোনাে কোনাে পর্যবেক্ষক বলেছেন, ১৫০ নং মােগলটুলিতে সমবেত সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের অনুসারীরা মুসলিম লীগ দখল করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এমন মন্তব্য সঠিক নাকি এঁরা মুসলিম লীগের গণ-ভিত্তিক সম্প্রসারণ ঘটাতে চেয়েছিলেন, সংক্ষেপে হলেও সে তথ্য-সত্য অন্বেষণ করা পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্যই অপরিহার্য বটে। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন : “পাকিস্তান হাসিলের সঙ্গে-সঙ্গেই মুসলিম লীগের দরজা জনগণের মুখের উপর বন্ধ করিয়া দেওয়া শুধু রাজনৈতিক অপরাধ ছিল না, নৈতিক মর্যাল ও এথিক্যাল অপরাধও ছিল। তবু নেতারা কোটারি-স্বার্থ রক্ষার জন্য মুসলিম লীগকে পকেটস্থ করিলেন। 

  ৬০ 

    মুসলিম লীগ কর্মীদের পক্ষে জনাব আতাউর রহমান খাঁ ও বেগম আনােয়ারা খাতুন প্রথমে মওলানা আকরম খাঁ ও পরে চৌধুরী খালিকুযযামানের কাছে দরবার করিয়াও রশিদ বই (পার্টি সদস্য অন্তর্ভুক্তির) পান নাই। তারা বলিয়াছিলেন, এখন তাঁরা আর লীগের বেশি মেম্বর করিতে চান না। এখন শুধু গঠনমূলক কাজ। দরকার। হৈ হৈ করিলে তাতে কাজের বিঘ্ন সৃষ্টি হইবে। অগত্যা মুসলিম লীগ। কর্মীরা প্রথমে নারায়ণগঞ্জে ও পরে টাংগাইলে কর্মী-সম্মিলনী করিয়া মুসলিম লীগের দরজা খুলিয়া দিবার দাবি করেন”(৪/৩০৯-৩১১)। কিন্তু নেতারা কর্ণপাত করেননি, সুতরাং নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য নতুন সংগঠন গঠন করা ছাড়া, কোনাে বিকল্প ছিল না। 

 ঢাকার ১৫০, মােগলটুলিতে “মুসলিম লীগের আবুল হাসেম (হাশিম) ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী জোটের তরুণ কর্মী ও ছাত্রবৃন্দ অন্যান্য স্থান থেকে ঢাকায় সমবেত হয়ে  শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করেন। এই কর্মী শিবিরের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে গঠিত অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন আসাম মুসলিম লীগের নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মুহম্মদ খান। ১৯৪৯ সালের ২৩শে ও ২৪শে জুন টিকাটুলির কাজী বশিরের বাসভবন। রােজ গার্ডেন’এ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিন  শতাধিক কর্মী এতে যােগদান করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন   সামসুল হক, খয়রাত হােসেন, আনােয়ারা খাতুন, আলী আহম্মদ খান, শওকত আলী, আতাউর রহমান খান, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, কুষ্টিয়ার শামসুদ্দিন আহমদ, আলী আমজাদ খান, ইয়ার মােহাম্মদ খান প্রমুখ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভােকেট জেনারেল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক কিছুক্ষণের জন্য সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ২৩শে জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ’ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। মাওলানা ভাসানী সভাপতি, সামসুল হক সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান(তখন কারারুদ্ধ) যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরাসহ নবগঠিত দলটির ৪০ সদস্য বিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়” (২১/২৪)। বহু প্রতিবাদী ইতিহাসের সাক্ষী ১৫০ নং মােগলটুলিতেই বিশাল সাইনবাের্ড লাগিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। 

 অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, পাকিস্তানের প্রতি মােহভঙ্গের কারণে নেতাকর্মীরা “যখন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন (২৩ জুন, ১৯৪৯) করেন, তখন করারুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এ থেকে অনুমান করা যায়, ১৯৪৯ সালেই তিনি কী রকম মর্যাদা লাভ করেছিলেন। মুক্তিলাভ করে (২৯ জুন) শেখ মুজিব সর্বক্ষণ ব্যয় করেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজে। তবে 

  ৬১ 

  কারাগারে যাওয়া তার পক্ষে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবু নিজের বিশ্বাস ও কর্তব্যবােধ থেকে তিনি এতটুকু সরে আসেননি এবং নিজের পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কেও উদ্বিগ্ন হননি”(১(১)/২৪৩)। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত অনুরােধ সত্ত্বেও, শেরে বাংলার আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগ দেননি। সােহরাওয়ার্দীও দলটিতে যুক্ত হয়েছিলেন কিছুদিন পরে। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হলেও ভাসানী একসময় দলটি ছেড়ে গিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন সম্মিলিত বিরােধী শক্তির প্রতীকী পুরুষ। সােহরাওয়ার্দী সাহেবের রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তিভূমি ছিল পূর্ববঙ্গ। এ বিষয়টা বুঝতে পারার পর তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগ দেন”(৮/২৬৫)। 

 বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কয়েকদিন পরেই আমার মুক্তির (২৯ জুন, ১৯৪৯ খ্রি.) আদেশ এল। জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে। আমার আব্বাও আমাকে দেখার জন্য বাড়ি থেকে এসেছেন। আমি আব্বাকে সালাম করে ভাসানী সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকেও সালাম করলাম। সাথে সাথে আওয়ামী মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ, ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠল। জেলগেটে এই প্রথম আওয়ামী লীগ জিন্দাবাদ’ হল। শামসুল হক সাহেবকে কাছে পেয়ে তাকে অভিনন্দন জানালাম এবং বললাম, ‘হক সাহেব, আপনার জয়, আজ জনগণের জয় । হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন,  চল, এবার শুরু করা যাক” (৯/১২১)। প্রকৃতপক্ষে মুজিবের কারামুক্তির পরেই দলটির সাংগঠনিক বিকাশের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল। 

 কামরুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের বৎসরাধিককাল আগে থেকেই ১৫০নং মােগলটুলির ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’এর “কি কর্মী কি ছাত্র তারা, শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হল। এদিকে শামসুল হক সাহেবও ভাল সংগঠক শামসুল হক ও শেখ মুজিব স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্রিয়তায় বিশ্বাস করত না। তাদের মতে সবকিছুই সংগঠন করতে হয়” (১৪/১০৭)। এখানে প্রসঙ্গতই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ সম্মেলনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে : “রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রথম প্রয়ােজন সঠিক নেতৃত্বের। সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছে। নেতৃত্বের সাথে প্রয়ােজন আদর্শের। যাকে অপর কথায় বলা যায় ম্যানিফেস্টো। নেতৃত্ব ও আদর্শের পরে প্রয়ােজন নিঃসাৰ্থ কর্মীর। নিঃস্বার্থ কর্মী ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান বড় হতে পারে না, কোন সংগ্রাম সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে। এর পরে প্রয়ােজন সংগঠনের। সংগঠন ছাড়া কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের 

  ৬২ 

  কাজ সফল হতে পারে না। আওয়ামী লীগের ১৯৪৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নেতৃত্ব ছিল, আদর্শ ছিল, নিঃসাৰ্থ কর্মী ছিল এবং সংগঠন ছিল। এই ভিত্তির উপরই সংগ্রামে এগিয়ে গিয়ে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টি করতে পেরেছে”। 

 আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী সাংগঠনিক উদ্যোগ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন, “আওয়ামী লীগের প্রথম ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয় ১৫০নম্বর মােগলটুলিতে। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেব তাতে যােগদান করেছিলেন। একটা গঠনতন্ত্র সাব-কমিটি ও একটা কর্মপন্থা সাব-কমিটি করা হল। আমরা কাজ করা শুরু করলাম” (৯/১২১)। শেখ মুজিবের কারামুক্তির আগেই ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে দলটি প্রথম জনসভা আয়ােজন করেছিল, বক্তা ছিলেন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক। কিন্তু সভাটি মুসলিম লীগ ভাড়াটিয়া গুণ্ডা লাগিয়ে মারপিট করে এবং প্যান্ডেল ভেঙ্গে পণ্ড করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে পরবর্তী জনসভার আয়ােজন করা হয়েছিল গােপালগঞ্জে। কিন্তু সেটিও সুষ্ঠুভাবে হতে পারেনি, অতঃপর সেই সভার বর্ণনাটি উদ্ধৃত করছি বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকেই, যাতে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের আচরণ এবং বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্রুত বিকাশমান জনপ্রিয়তার দিকগুলি উপলব্ধি করা যায় সহজেই। 

 “সভায় হাজার হাজার জনসমাগম হয়েছিল। হঠাৎ সকালবেলা ১৪৪ধারা জারি করা হয়। আমরা সভা মসজিদ প্রাঙ্গণে করব ঠিক করলাম। তাতে যদি ১৪৪ধারা ভাঙতে হয়, হবে। আমরা যখন সভা শুরু করলাম, তখন এসডিও মসজিদে ঢুকে মসজিদের ভিতরে ১৪৪ধারা জারি করলেন। আমরা মানতে আপত্তি করলাম, পুলিশ মসজিদে ঢুকলে মারপিট শুরু হল। দুই পক্ষেই কিছু আহত হল। আমি ও সালাম সাহেব (সভাপতি, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগ) সভাস্থান ত্যাগ করতে অস্বীকার করলাম। আমাদের গ্রেফতার করা হল। জনসাধারণও মসজিদ ঘিরে রাখল। মহকুমা পুলিশ অফিসার কাছে এসে অনুরােধ করলেন, ‘গােলমাল হলে অনেক লােক মারা যাবে। এদের বলে দেন রাস্তা ছেড়ে দিতে। আমরা আপনাদের কোর্টে নিয়ে যাব এবং এখনই জামিন দিয়ে দেব। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, জনসাধারণের হাতেও অনেক লাঠি ও নৌকার বৈঠা আছে। সালাম সাহেব ও গােপালগঞ্জ মহকুমার নেতাদের সাথে আলাপ-আলােচনা করে আমি বক্তৃতা করলাম, যা বলার ছিল সবই বললাম এবং রাস্তা ছেড়ে দিতে অনুরােধ করলাম। জনসাধারণ শেষ পর্যন্ত আমাদের রাস্তা দিল। আমাদের সাথেই জিন্দাবাদ দিতে দিতে কোর্টে এল। রাত আট ঘটিকার সময় আমাদের জামিন দিয়ে ছেড়ে দেয়া হল। তারপর জনগণ চলে গেল। এটা আমাদের আওয়ামী লীগের মফস্বলে প্রথম সভা”(৯/১২৩)। 

  কম্যুনিস্ট নেতা খােকা রায় লিখেছেন, ১৯৫১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে আওয়ামী মুসলিম লীগ’এর রাজনৈতিক মূল্যায়ন করে বলা হয়েছিল :“১৯৪৯ সনে একটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচি নিয়ে সরকার বিরােধী দল হিসাবে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল। তখন আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি সাম্প্রদায়িক চরিত্রও (দলের নাম এবং কেবল মুসলিম সদস্য গ্রহণ) ছিল। কিন্তু ঐ দলের কর্মসূচিতে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাজবন্দিদের মুক্তি, প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভােটে নির্বাচন, বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা প্রভৃতি গণতান্ত্রিক দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। কর্মসূচিতে কোন সাম্প্রদায়িক দাবি ছিল না।  কাজকর্মের মধ্যেও কোন সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। কর্মতৎপরতা পরিচালিত হচ্ছিল মুসলিম লীগ সরকারের গণ-বিরােধী নীতিসমূহের বিরুদ্ধে। তদুপরি, ১৯৪৮সন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভিতর যে জাতীয় অধিকার বােধ জেগে উঠছিল, আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিল তার প্রধান ধারক ও বাহক” (২০/১০৭-১০৮)। 

 এস এ করিম তাঁর ‘শেখ মুজিব : ট্রিয়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি’ নামক বইতে উল্লেখ করেছেন, “The party s middle name  Muslim  was dropped in 1955, but from the outset it behaved as a non-communal organisation,   The newspapers in Dhaka were not in sympathy with the reformist ideas of the new party,..Fortunately, this void was soon filled  The newspaper “Ittefaq  was established soon afterwards in August, with Manik Mian as its editor” (17/47)। শহীদ সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক কোলকাতায় প্রকাশিত ‘ইত্তেহাদ’ (১৯৪৬ খ্রি.) পত্রিকায় কাজ করার অভিজ্ঞতায় তােফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া, মানিক মিয়া এবং শেখ মুজিবের মধ্যেও প্রীতি-সৌহার্দের সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক চিন্তার বিশেষ সামঞ্জস্য ছিপ। “Mujib sometimes tended to act too hastily; Manik Mian, the older man (by some ten years), was generally calm and thoughtful. By seeking counsel with Manik Mian, Mujib felt assured that he (Mujib) was taking considered, rather than impulsive, action” (প্রাগুক্ত)। ইত্তেফাক’ প্রথমে (১৯৪৯ খ্রি.) সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল, পরে দৈনিক পত্রিকায় (১৯৫৪ খ্রি.) রূপান্তরিত হয়। উল্লেখ্য যে, ‘ইত্তেফাক প্রকাশের প্রাথমিক মূলধন কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছিলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। প্রথম দিকে পত্রিকাটির প্রকাশক হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম লেখা হতাে। 

  আজ এত বছর পরেও পেছন ফিরে তাকালে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক লক্ষ্য নিয়ে মুসলিম লীগ-বিরােধী যে দলটি সেদিন গঠিত হয়েছিল, তার নামে ‘মুসলিম  শব্দটি যুক্ত করা হয়েছিল কেন? এবিষয়ে পরিষ্কার একটি ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন খােকা রায়, “পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপক জনসাধারণের ওপর তখনও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব বিদ্যমান ছিল” (২০/১০৭)। সুতরাং সাধারণ জনগণের মন-মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া হঠাৎ করেই সুস্পষ্ট অসাম্প্রদায়িক নাম-পরিচয়ের দল গঠন করে, পাকিস্তান অর্জনকারী দল মুসলিম লীগের বিরােধিতা করলে, জনসমর্থন পাওয়া যথার্থই দুরুহ। হয়ে পড়তাে, এ সত্য অনস্বীকার্য। অর্থাৎ নামকরণে এবং কর্মপন্থায় আওয়ামী মুসলিম লীগের পথটাই তখন সঠিক ছিল। স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং আন্দোলন-সংগ্রামের সকল পর্যায়েই বঙ্গবন্ধু জনগণের ‘পালস্ বুঝে জনগণকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন বলেই জনগণও সর্বদাই তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে। 

 স্মরণ করা যেতে পারে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট লীগ  গঠনের সময়ই শেখ মুজিবের সহযােগী অলি আহাদ এবং তােয়াহা প্রমুখ নতুন সংগঠনের নাম থেকে।  মুসলিম  শব্দটি বাদ দিতে চেয়েছিলেন। “But Mujib argued that if the word Muslim  was deleted, it would give the Government an excuse to misrepresent their aims; he was not opposed to the idea as such, but he believed that it should be considered at the appropriate time, not now” (১৭/৩৮)। ১৯৫৪ খ্রি. নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অভাবিত বিজয়ের পরে ১৯৫৫ খ্রি.  আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নাম থেকে মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে কাউন্সিল অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত বক্তব্যটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা যাচ্ছে : “এ কথা অনস্বীকার্য যে, যে সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম (রাখা) হয়, তখনকার বাস্তব প্রয়ােজন অনুযায়ী আমাদের সংগঠনকে একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আজ অবসান ঘটেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানবাসীর নিজস্ব রাজনৈতিক জোট হিসেবে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দান করার মহান দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে। আমরা দ্বিধাহীনচিত্তে এ কথা ঘােষণা করিতে পারি যে, দেশের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের এবং সকল ভাষাভাষী মানুষকে একটি গণ প্রতিষ্ঠানে সমবেত করা প্রয়ােজন। বস্তুত আওয়ামী লীগ দলকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হবাে”(২১/২৮-২৯)। এ তাে শুধুই দলীয় নাম পরিবর্তনের বক্তব্য নয়, দলটির মৌলিক আদর্শ এবং মূলগত লক্ষ্যেরও সুস্পষ্ট উচ্চারণ। 

  প্রসঙ্গত অবশ্যই উল্লেখ্য যে, “আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের কাজেও সােহরাওয়ার্দী-নেতৃত্ব ছিল দ্বিধান্বিত। কিন্তু দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন শেখ মুজিব এবং মওলানা ভাসানী। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি কতটা জনপ্রিয় হবে সে সম্পর্কেও শহীদ সােহরাওয়ার্দী দ্বিধান্বিত ছিলেন। কিন্তু দ্বিধামুক্ত ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি সঙ্গে পেলেন মওলানা ভাসানীকে। শহীদ সাহেবের দ্বিধার সুযােগ নিয়ে আওয়ামী লীগের একটা গ্রুপ আব্দুস সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখার জন্য চক্রান্ত শুরু করলেন। এদের সঙ্গে হাত মেলালেন খােন্দকার মােশতাক আহমেদ। কিন্তু আওয়ামী লীগে ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল নীতির দল ভারী হল। শহীদ সাহেবও সংগঠনটিকে অসাম্প্রদায়িক করার পক্ষে মত দিলেন” (১১/১২৯)। ‘আওয়ামী লীগ’ নব-নামকরণের অব্যবহিত পরেই, ১৯৫৫তে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের পণপরিষদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দলটি মােট ২২টি আসন লাভ করেছিল। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ’ নামকরণের পরেও দলটির গ্রহণযােগ্যতা এবং ভােট পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনই অসুবিধা হয়নি। 

 ১৯৫৬, আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে যুক্তনির্বাচনের দাবি উপস্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর আগ্রহে বিলটি ১১ অক্টোবর পরিষদে উত্থাপিত হয়। ১২ অক্টোবর ১৯৫৬, পাকিস্তানে ‘যুক্ত নির্বাচন বিলটি অনুমােদিত হয়েছিল। ৩ এপ্রিল, ১৯৫৭ তারিখে আওয়ামী লীগের উত্থাপিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে অনুমােদিত হয়েছিল। বিলটির সমর্থনে প্রাদেশিক পরিষদে প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন, “স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি। এই দাবির ভিত্তিতেই আমরা গত নির্বাচনে(যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। শাসনতন্ত্র রচনার সময় আওয়ামী লীগের ১২জন সদস্য স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করেছিল। গত ৯ বছরের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে বুঝা যাবে আমরা কেন স্বায়ত্ত শাসন চাই। এ আমাদের বাঁচা-মরার দাবি” (২১/২৯)। এখানেই সময়ের সরণীতে কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া দরকার। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে দলটির সংঘটিত সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা ছিল, খাদ্য সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১১ অক্টোবর ১৯৪৯, ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে বিশাল জনসভা শেষে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মিছিল। উল্লেখ্য যে, তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় ‘গভর্নর হাউস’এ অবস্থান করছিলেন। গভর্নর হাউস’এর দিকে যাবার পথে মিছিলটি নবাবপুর রেল ক্রসিং’এ পুলিশী বাধার মুখে পড়ে। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় : “মওলানা সাহেব রাস্তার উপরেই নামাজে 

  দাঁড়িয়ে পড়লেন। শামসুল হক সাহেবও সাথে দাঁড়ালেন। এর মধ্যেই পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছেড়ে দিল। আর জনসাধারণও ইট ছুড়তে শুরু করল। পুলিশ লাঠিচার্জ করতে করতে এগিয়ে আসছে। একদল কর্মী মওলানা সাহেবকে কোলে করে নিয়ে এক হােটেলের ভিতর রাখল। কয়েকজন কর্মী ভীষণভাবে আহত হল এবং গ্রেফতার হল। শামসুল হক সাহেবকেও গ্রেফতার করল। আমার উপরও অনেক আঘাত পড়ল। একসময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে নর্দমায় পড়ে গেলাম। আমাকে কয়েকজন লােক ধরে রিকশায় উঠিয়ে মােগলটুলি নিয়ে আসল। আমার পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। ডাক্তার এল, ক্ষতস্থান পরিষ্কার করল। ইনজেকশন দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল”(৯/১৩২)। 

 প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী এ-সময় ঢাকার জনসভায় বললেন, ‘যাে আওয়ামী লীগ করেগা, উসকো শির হাম কুচাল দে গা’, সুতরাং বলাই বাহুল্য যে, মুজিবকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ যথেষ্টই তৎপর হয়ে উঠেছিল। শেষ রাতে মুজিবের খুঁজে পুলিশ ১৫০, মােগলটুলিতে হানা দিলেও তিনি আহত-অসুস্থ অবস্থায় পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পরবর্তী দু’দিনের আশ্রয়স্থল ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাড়িতেও আইবি পুলিশ এলে মুজিব পালিয়েছিলেন, কারণ, তাঁর প্রতি গ্রেফতার না হবার নির্দেশ ছিল মওলানা ভাসানীর। পলাতক অবস্থাতেই তিনি ঢাকায় মওলানা ভাসানী এবং ঢাকা থেকে লাহােরে গিয়ে সােহরাওয়ার্দীর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।  অসমাপ্ত আত্মজীবনী র বর্ণনায় গােপন রাজনীতি আর পলাতক জীবন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা চিন্তার পরিচয় মেলে এবং জানা যায় তৎকালে ভাসানীর চিন্তায় সােহরাওয়ার্দীর প্রতি আস্থার কথাও। 

  তখন মওলানা ভাসানী ইয়ার মােহাম্মদ খানের বাড়িতে থাকতেন। তাঁর সাথে আমার দেখা করা দরকার; কারণ তাকে এখনও গ্রেফতার করা হয় নাই। তাঁকে 

 জিজ্ঞাসা করা দরকার, তিনি কেন আমাকে গ্রেফতার হতে নিষেধ করেছেন। আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। গােপন রাজনীতি পছন্দ করি না, মওলানা সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি ব্যাপার, কেন পালিয়ে বেড়াব’? মাওলানা সাহেব আমাকে বললেন,  তুমি লাহাের যাও, কারণ সােহরাওয়ার্দী সাহেব লাহোরে আছেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সারা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারলে ভাল হয়। সােহরাওয়ার্দী সাহেব ছাড়া আর কেউ এর নেতৃত্ব দিতে পারবেন না” (৯/ ১৩৪-১৩৫)। ভাসানীর পরামর্শে মুজিব নাম-পরিচয় গােপন করে লাহােরে গিয়ে সােহরাওয়ার্দী এবং মুসলিম লীগবিরোধী কয়েকজন নেতার সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। 

 শেখ মুজিবের তখনকার মনের অবস্থা তাঁরই বর্ণনায় : “প্রায় একমাস হয়ে গেল, আর কতদিন আমি এখানে থাকব? ঢাকায় মওলানা সাহেব, হক সাহেব এবং 

  সহকর্মীরা জেলে আছেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে বললাম। তিনি বললেন, ‘ঢাকায় পৌঁছার সাথে সাথেই তারা তােমাকে গ্রেফতার করবে। লাহােরে গ্রেফতার নাও করতে পারে। আমি বললাম, এখানে গ্রেফতার করেও আমাকে ঢাকায় পাঠাতে পারে। আর জেলে যদি যেতেই হবে, আমার সহকর্মীদের সাথে থাকব” (৯/১৪২)। যাবার পথে গিয়েছিলেন ঢাকা-লাহাের বিমানে এবার নাম-ঠিকানা গােপন করে ফিরলেন বিমানে লাহাের-দিল্লি, ট্রেনে দিল্লি-কোলকাতা-খুলনা এবং নৌপথে টুঙ্গিপাড়া হয়ে ঢাকায়। কিন্তু লাহাের বিমানবন্দরেই বুঝতে পেরেছিলেন, গােয়েন্দারা তাঁর পরিচয় জেনে গেছে। তবে সেখানে গ্রেফতার করেনি। ঢাকায় ফেরার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ১৫০, মােগলটুলির আবাস-আশ্রয় থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হয়েছে। আমার তিনবার জেলে আসতে হল, এইবার নিয়ে” (৯/১৬৮)। 

  ঐতিহাসিক ভাষা-আন্দোলন : 

 বাঙালির অনিবার্য গন্তব্যের যাত্রা-শুরু 

  “বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত যখন পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন সে বিশ্বাস করে যে, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে হিন্দুই তাকে দাবিয়ে রেখেছে। পাকিস্তান অর্জিত হলেই তার আত্মবিকাশের সব দরজা খুলে যাবে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে যখন ঢাকা পৌঁছাই তখন দেখি সকলে আত্মহারা। অবশ্য হিন্দু মধ্যবিত্ত তখন স্রোতের ন্যায় সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। কদিন পরেই দেখি দেয়ালে আঁটা পােস্টার   রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ।  ১৯৪৮ সালের মার্চ  ঢাকা সফরে এসে জিন্নাহ সাহেব ঘােষণা করলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”(১৫/৪৭), পর্যবেক্ষণটি প্রখ্যাত সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীর। পরবর্তী মন্তব্যটিও তারই : “এরপর চার বছর ধরে নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায় পূর্ব বাংলার মানুষ দেখল তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ প্রসারিত হওয়ার পরিবর্তে সংকুচিতই হচ্ছে।   শাসনতন্ত্রের মুলনীতি কমিটির রিপাের্ট প্রকাশিত হওয়ার পর ঢাকা আরমানিটোলা ময়দানে বিরাট জনসভায় রিপাের্টকে অগ্রহণযােগ্য ঘােষণা করে পূর্ব বাংলার জন্য সার্বিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়। বাংলাকে অবিলম্বে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও এই আন্দোলনের সময়ে অনুষ্ঠিত প্রতিটি জনসভায় উত্থাপিত হয়” (১৫/৪৮-৪৯)। 

 উল্লেখ্য যে, মূল লাহাের প্রস্তাব’ (১৯৪০) পরিবর্তন করে জিন্নাহর উদ্যোগে “১৯৪৬ খ্রি. মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দুইটি অঞ্চল নিয়ে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয় চূড়ান্ত হলে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও তমদুন মজলিস বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে গণসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে তমদুন মজলিসের উদ্যোগে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে 

  সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে যােগ দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইন পরিষদে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা দেয়া হয়। শেখ মুজিব তার প্রতিবাদে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন” (১(২)/১০৮৯)। “২৮ ফেব্রুয়ারি ৪৮, তমদুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের সভায় ভাষার দাবিতে ১১মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান সম্বলিত এক বিবৃতিতে সই করেন শেখ মুজিব, নইমুদ্দিন আহম্মদ, আব্দুর রহমান চৌধুরী” ( ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, সরদার সিরাজুল ইসলাম, জনকণ্ঠ, ২০-২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২)। 

 “১৯৪৮ সালের ২মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের পক্ষ থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনের দিন অর্থাৎ ১১মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহ্বান করা হয়। একপর্যায়ে পুলিশ শেখ মুজিবসহ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে”(১(২)/১০৯৪)। বিচারপতি কে. এম. সােবহান লিখেছেন, “১৯৪৮-এর ১১মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করবার দাবির জন্য প্রথম যে-সব ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন, বঙ্গবন্ধু তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন”(১(১)/১০৯)। স্বদেশ রায়ের মন্তব্য, “এই গ্রেফতারের ভিতর দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের এবং পূর্ব বাংলার তরুণ নেতাদের অন্যতম নেতায় পরিণত হন। ভাষা আন্দোলনের এই পর্ব যাদের দূরদৃষ্টি ছিল। তারা বুঝতে পারে যে, পূর্ব বাংলার রাজনীতি একটি নতুন পথে যাচ্ছে। সে পথ আর যা-ই হােক কোন ধর্মীয় অন্ধকারের ভিতর থাকবে না। এ সময়ে উদার। রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তােলার মত উদার জাতীয় নেতার অভাব দেখা দেয় পূর্ব বাংলায়। কারণ, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তখনও ভারতে, শেরে বাংলা নিশ্রুপ। তাছাড়া শেরে বাংলার একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল সব সময়ই। শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ নেন আসাম থেকে মওলানা ভাসানীকে পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসার জন্য। .একদিকে যেমন জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠন কোন জাতীয় প্রবীণ নেতার মাধ্যমে গড়ে তােলার চেষ্টা করেছেন শেখ মুজিব, তেমনি তিনি কিন্তু ১৯৪৮-এর পর থেকে একদিনের জন্যও কোন আন্দোলন থেকে দূরে থাকেননি” (১(৩)/১৫২৫-২৬)। 

 মুজিবের প্রত্যক্ষ সংগ্রামী মানসিকতার একটি পরিচয় উল্লেখ করেছেন এস, এ. করিম, ১১মার্চ, ১৯৪৮ সচিবালয় ঘেরাওয়ের সময় মুজিবের অন্যতম সহযােগী কামরুদ্দিন আহমদ পরামর্শ দিয়েছিলেন, মুজিবের উচিত সামনে না গিয়ে কোথাও আড়ালে থাকা, তাতে তিনি সাংগঠনিক দক্ষতায় আন্দোলন এগিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু মুজিবের তাৎক্ষণিক জবাব ছিল, “Unless he- Mujib was in the forefront of the struggle, his followers might lose heart and not perform to the best of their abilities” (১৭/৩৯)। কামরুদ্দিন আহমদ নিজেও লিখেছেন, “পরদিন 

  নেতৃস্থানীয় শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ অনেক কর্মীও গ্রেফতার হয় বহু ছাত্র ও কর্মী আহত হয়। আন্দোলন চলতে থাকে। আমার এখনাে ধারণা, নেতারা প্রথম দিন গ্রেফতার না হয়ে পরিচালনার দায়িত্ব নিলে   আন্দোলন আরাে জোরদার হত” (১৪(২)/১১৭)। 

 ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করেও মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন স্বস্তিতে ছিলেন না, কারণ গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ কয়েকদিন পরেই ঢাকায় আসছেন। নাজিমুদ্দিন তখন ছাত্রদের দাবি মানার শর্তে একটি চুক্তি করে ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। জেলের ভেতর থেকেই এই চুক্তিনামা অনুমােদন করেছিলেন শেখ মুজিব। তাঁর। অনুমােদন আনার জন্য, সরকারি অনুমতিক্রমে জেলের ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ। তিনিই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে চুক্তিটিতে স্বাক্ষর। করেছিলেন, সরকার পক্ষে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। একটি বিশেষ তথ্য মেলে বিচারপতি সােবহানের লেখায়, “চুক্তিনামার শর্ত অনুযায়ী ছাত্রনেতাদের মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বার হতে অস্বীকার করেন, যতক্ষণ না সমস্ত রাজবন্দীদের জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন বাধ্য। হয়েছিলেন সে শর্ত মেনে নিতে। সে সময় দুই কমিউনিস্ট নেতা রণেশ দাশগুপ্ত ও রণী রায় রাজবন্দী হিসাবে আটক ছিলেন জেলে”(১(১)/১০৯)। 

 ভাগা আন্দোলন সংক্রান্ত গবেষক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন, “আটচল্লিশ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সঙ্গেই ছাত্রনেতা শেখ মুজিবকে প্রথম দেখি সচিবালয়ের প্রবেশ পথে পিকেটিং রত অবস্থায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের পুকুর পাড়ে (এখন নেই) একটি ছাত্রসভায় প্রথম বক্তৃতা করতে শুনি। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের দাবি মেনে চুক্তিপত্রে সই দিয়েছেন, বন্দি ছাত্রনেতারা মুক্তি পেয়েছেন, তারপরেও শেখ মুজিব ছাত্রসভা ডেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রাদেশিক আইন পরিষদ ভবনের (জগন্নাথ হল পুরাতন মিলনায়তন) দিকে চলে গেলেন। সেই সভায় তিনি নাজিমুদ্দিনের চুক্তিভঙ্গের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। শেখ মুজিব পরিষদ ভবনে বিক্ষোভের মাধ্যমে। দ্বিতীয়বারের মতাে গ্রেফতার হয়ে এটা যথার্থভাবে প্রমাণ করেছিলেন যে খাজা। নাজিমুদ্দিন চুক্তিভঙ্গকারী” (১(৩)১৩৪৮)। 

 ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে নাজিমুদ্দিন সরকারের স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় মুজিব জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। “ছাত্র-যুবকদের আন্দোলন নতুন মাত্রা পেল যখন ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় এক জনসভায় (রেসকোর্স মাঠে) ভাষণদান কালে জিন্নাহ ঘােষণা করলেন, ‘Let me make it very clear to you that the State Language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালাে। 

  পূর্ব বাংলা   অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি শিকড় নিলাে মুসলিম পাকিস্তানে” (১(২)/৯১২)। তিনদিন পরে কার্জন হলে প্রদত্ত ‘কনভােকেশন ভাষণ’এ জিন্নাহ বলেছিলেন, “My dear students, for the sake of Islam I have decided that Urdu alone would be the state language of Pakistan.”- তখন ছাত্রসমাজের প্রথম সারিতে উপবিষ্ট আইনের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান এবং বরিশালের মেধাবী ছাত্র ফজলুল করিম একই সঙ্গে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। No, No, Bangla, we want Bengali shall be the state language of Pakistan.  (১৯/৫৫)। সম্ভবত তিনদিন আগের রেসকোর্সের বক্তৃতায় ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের কথা মনে রেখেই কার্জন হলের বক্তৃতায় উর্দুই রাষ্ট্রভাষা করা হবে বলতে গিয়ে জিন্নাহ ইসলাম রক্ষার অনুষঙ্গটি যুক্ত করেছিলেন। কমিউনিস্ট নেতা খােকা রায় লিখেছেন, “No, No  বলে ঐ প্রতিবাদ যে খুব বড় ছিল তা নয়। কিন্তু মিঃ জিন্নাহর জনপ্রিয়তা ছিল তখন তুঙ্গে। তার বক্তৃতার মাঝখানে ঐ প্রতিবাদ- সেটি তখন খুব অল্পসংখ্যক ছাত্রের কণ্ঠ হতে ধ্বনিত হলেও, তা থেকে বােঝা যাচ্ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের মাতৃভাষার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগােষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারী ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতি মেনে নিতে রাজি ছিল না” (২০/৭৬)। 

 গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর ঢাকা সফর এবং উর্দু, কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা    এমন ঘােষণার পর “রাষ্ট্রভাষার দাবি রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল সেই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ। করে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ২৪জনকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় ব্যক্তিগত মুচলেকা প্রদানের মাধ্যমে অনেকেই নিজেদের ছাড়িয়ে নেন, কিন্তু শেখ মুজিব ছিলেন আদর্শ ও নীতিতে অটল। তাই ভাষা আন্দোলনের চরম মুহূর্তেও (২১ফেব্রু, ৫২) তিনি জেলখানা থেকে ছাড়া পাননি” (১(১)২৮২-২৮৩)। 

 ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকায় ছাত্র-জনতা নিহত হওয়ার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে আইন পরিষদের অধিবেশনে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে যখন মওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মনােরঞ্জন ধর, গােবিন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অধিবেশন বয়কটের প্রস্তাব এনে ছাত্র-হত্যার বিচার দাবি করছিলেন, তখন বাঙালি-সন্তান মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন নির্লিপ্তভাবে। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন, “It s a fantastic story  উচ্ছৃঙ্খলতা দমনের জন্য পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে। এর জন্য কারাে মৃত্যু হলে আমরা কি করতে পারি? আপনারা জানেন, এর পেছনে কম্যুনিস্ট এবং হিন্দুদের উস্কানি রয়েছে। আমরা এদের নির্মূল করবাে ইনশাল্লাহ্ .”(১৯/৬০)। প্রসঙ্গতই সবিশেষ উল্লেখ্য যে, সেদিন একমাত্র আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে। পদত্যাগ করে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি তখন ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। 

  স্মরণ করা যেতে পারে, “১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচীর ‘কনস্টিটুয়ান্ট অসেম্বলি’তে সর্বপ্রথম শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কংগ্রেস নেতা, কুমিল্লা) দাবি জানান যে, উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও সরকারি কাজে ব্যবহার করতে হবে।  পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসেবে বাংলা তার যােগ্য মর্যাদা পাবার দাবি অবশ্যই জানাবে’ (১৯/৫৫)। এটিই ছিল বাংলা ভাষার মর্যাদার বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের নিকট উত্থাপিত প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু মুজিব গভীর দুঃখের সাথেই বলেছিলেন, “ had a single Bengali Muslim Legislator echoed the sentiments of Dutta, the rulling circle of Pakistan would have had second thought about the wisdom of imposing “One Nation, One Language  Policy in a country as diverse as Pakistan” (১৭/৩৯) 

 মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন প্রকৃতপক্ষে চুক্তি-রক্ষার জন্য ছাত্রনেতাদের সাথে চুক্তি করেননি, তার একমাত্র প্রযােজন ছিল গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর আসন্ন সফরটি নিরাপদ করা। সেটিও জিন্নাহর অতি-উৎসাহ এবং অগণতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে সম্ভব হয়নি। অতঃপর নাজিমুদ্দিনই হঠকারী এক ঘােষণায় আন্দোলনকে তুঙ্গস্পর্শী করে তুলেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরে এসে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা দিলে বাংলা ভাষার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে শেখ মুজিবুর রহমান জেলখানাতে বসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”(১(২)/১০৯০)। তবে ৭ ফেব্রুয়ারির পরে মওলানা ভাসানী তার গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হককেও কমিটির সদস্য করা হলে তিনি আপত্তি প্রকাশ করেছিলেন। 

 খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার পরই শহরে যেন আগুন জ্বলে উঠল। মওলানা আব্দুল হামিদ খান সাহেব ঢাকা মােক্তার লাইব্রেরিতে মুসলিম লীগ ছাড়া সকল পার্টিকে, সকল সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানকে, সকল ট্রেড ইউনিয়নকে ডেকে পাঠালেন। ১৯৫২সন ১৯৪৮সন নয়। এবার আর হিন্দু কে, কম্যুনিস্ট কে, কংগ্রেস কে এ নিয়ে কথা উঠল না। এবারে সকল বাঙালি যেন এক হয়ে দাঁড়াল।  প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে  প্রতিনিধি নিয়ে বৈঠক বসবে ১৫০নং মােগলটুলি অফিসে ৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে। সে সভায় কমিটি অব অ্যাকশন’এর কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হবে বলে ঘােষণা করেন। মওলানা সাহেব।  ৭ তারিখে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, কে জি মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ছােট একটি কমিটি (সর্বদলীয়) গঠন করা হয়। প্রস্তাব গ্রহণ করা হল যে, ২১শে ফেব্রুয়ারি সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হবে।  শেখ 

 মুজিবুর রহমান সাহেব (তখন নিরাপত্তা বন্দি) তাঁর নিজস্ব সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং ফলে দীর্ঘদিন কারাজীবন যাপন করছিলেন তাই ১৯৫২সনের ভাষা আন্দোলনে তাকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে পাইনি। তবে তার পরােক্ষ প্রভাব আমরা অনুভব করেছি” (১৪(২)/১৫৬-১৫৭)। এখানে আলােচনার প্রাসঙ্গিকতায় শ্রদ্ধেয় তিনজন ভাষা-সৈনিকের লিখিত কিছু বর্ণনা উদ্ধৃত করছি। 

 ভাষা-সৈনিক গাজীউল হক লিখেছেন, “১৯৫২সালের ভাষা আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠছে তখন শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় নিশ্ৰুপ ছিলেন না। পরামর্শ দিয়েছেন এবং কারাগারে বন্দি থেকেও আন্দোলনের শরিক হয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টন ময়দানে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘােষণা দিলে ৩০ জানুয়ারি (মতান্তরে ৩১শে) সন্ধ্যায় শামছুল হকের উদ্যোগে ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে আহুত সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু তখন চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ৩ ফেব্রুয়ারী শামছুল হক, আব্দুস সামাদ। আজাদ ও ডা. গােলাম মাওলার মাধ্যমে মুজিব ভাই সংবাদ পাঠালেন যে, ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল ডেকে মিছিল করে ব্যবস্থাপক পরিষদ ভবন ঘেরাও করা যায় কিনা বিবেচনা করে দেখতে। ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিল শেষে বেলতলায় ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল ঘােষণা হলাে”(১(৩)/১৬৪৯)। 

 ভাষা-সৈনিক এবং ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্মৃতিচারণ : “বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন। ধরে জেলে আবদ্ধ ছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তাই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।   বঙ্গবন্ধু সে সময় ছাত্র নেতাদের গভীর রাতে আলাপ আলােচনার জন্য ডাকতেন এবং তাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক বিষয় এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে। আলােচনা করতেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধুই আমাদেরকে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে প্রথম দিনেই পরিষদ ভবন ঘেরাও করার কথা বলেছিলেন। তিনি আরাে বলেছিলেন যে, একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি আমরণ অনশন করবেন। এ কথা আজ অনেকেই রাজনৈতিক কারণে মানতে চান না, কিন্তু আমি এসব সত্য বলেই জানি”(১(৩)১৬৪৯-৫০)। 

 ভাষা আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সময়ে বঙ্গবন্ধুর সহযােগী অলি আহাদ লিখেছেন, “প্রহরী পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযােগ গ্রহণ করে আমরা তার সহিত হাসপাতালে কয়েক-দফা দেখা করি। এর পরে সরকার তাঁকে ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে সরিয়ে নেয়”(১(৩)/১৬৫০)। উল্লেখ্য যে, ফরিদপুর জেলেই শেখ মুজিব ও তাঁর সহবন্দি মহিউদ্দিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন। 

  একটানা ১১দিন অনশনের পর সেখান থেকে চরম ভগ্নস্বাস্থ্য অবস্থায় মুজিব ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ মুক্তিলাভ করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ গােপালগঞ্জে এবং টুঙ্গিপাড়ায় কাটিয়ে তিনি ঢাকায় ফিরেছিলেন। 

 পরবর্তী উদ্ধৃতি বঙ্গবন্ধুর কারাবন্দি (১৯৬৬- ৬৯) অবস্থায় লিখিত  অসমাপ্ত আত্মজীবনী  থেকে, “আমি হাসপাতালে আছি (জানুয়ারি ১৯৫২ খ্রি., ‘নিরাপত্তা বন্দী’ হিসাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে)। সন্ধ্যায় মােহাম্মদ তােয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচসাতজন এসেছে। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকে, কারণ জানে আমি ভাগব না। আমি বললাম সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তােয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আরও বললাম, “খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে। কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তােমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস । পরের দিন রাতে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২ খ্রি.) রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি আরও বালাম, ‘আমিও আমার মুক্তি দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। মহিউদ্দিন জেলে আছে। আমার কাছে থাকে। যদি সে অনশন করতে রাজি হয় তার নামটাও আমার নামের সাথে দিয়ে দেবে” (৯/১৯৬-১৯৭)। 

 “সরকার আমাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিলেন, ভালভাবে চিকিৎসা না করে। মহিউদ্দিনও রাজি হল অনশন ধর্মঘট করতে। আমরা দুইজন সরকারের কাছে পহেলা ফেব্রুয়ারি দরখাস্ত পাঠালাম যদি ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমাদের মুক্তি দেওয়া না হয় তাহা হলে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করতে শুরু করব। যখন জেল কর্তৃপক্ষ অনুরােধ করল অনশন ধর্মঘট না করতে তখন আমি বলেছিলাম, কোন অন্যায় করি নাই। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব। হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে। কারণ, ঐ দিনই পূর্ব বাংলার আইনসভা বসবে। ১৯৪৮সালে ছাত্ররাই এককভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল। এবার আমার বিশ্বাস ছিল, জনগণ এগিয়ে আসবে। মাতৃভাষার অপমান কোনাে জাতি সহ্য করতে পারে না” (প্রাগুক্ত)। 

 “জেলের ভেতর আমরা দুইজনে প্রস্তুত হচ্ছিলাম অনশন ধর্মঘট করার জন্য। ১৫ 

  ফেব্রুয়ারি তারিখে সকালবেলা আমাকে জেল গেটে নিয়ে যাওয়া হল মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে কর্তৃপক্ষ বললেন, আপনাদের অন্য জেলে পাঠানাের হুকুম হয়েছে। ফরিদপুর জেলে। আমরা (ফরিদপুর) জেলগেটে এসে দেখি জায়গাও ঠিক করে রেখেছেন, রাজবন্দিদের সাথে নয়, অন্য জায়গায়। আমরা তাড়াতাড়ি ঔষধ খেলাম পেট পরিষ্কার করার জন্য। তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলাম। মহিউদ্দিন ভুগছে পুরিসি রােগে, আর আমি ভুগছি নানা রােগে। চারদিন পরে আমাদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। এদের কথা হল, ‘মরতে দেব না। পাঁচ-ছয় দিন পর বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমরা কাগজি লেবুর রস দিয়ে লবণ-পানি খেতাম। কারণ এর মধ্যে কোনাে ফুড-ভ্যালাে নেই। প্যালপিটিশন হয় নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। ভাবলাম আর বেশি দিন নাই”(৯/২০১-২০৩)। 

 “২১শে ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গােলমাল হয়েছে। কয়েকজন লােক গুলি খেয়ে মারা গেছে। মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। পরের দিন নয়দশটার সময় বিরাট শােভাযাত্রা বের হয়েছে, বড় রাস্তার কাছে জেল। শােভাযাত্রীদের স্লোগান পরিষ্কার শুনতে পেতাম হর্ন দিয়ে একজন বক্তৃতা করছে। কি হয়েছে ঢাকায় কিছু কিছু বুঝতে পারলাম। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। ২৭তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। খােদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি। ডেপুটি জেলার এসে আমার কাছে বসলেন এবং বললেন,   আপনার মুক্তির অর্ডার এসে গেছে পরের দিন আব্বা আমাকে নিতে আসলেন। অনেক লোেক জেলগেটে হাজির। আমাকে স্ট্রেচারে করে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হল এবং গেটের বাইরে রেখে দিল, যদি কিছু হয়, বাইরে গিয়ে হােক, এই তাদের ধারণা (৯/২০৩-২০৬)। 

 চরম অসুস্থ অবস্থায় মুক্তিপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধু প্রায় মাস দেড়েক পরিবারের সাথে বাড়িতে কাটিয়ে ঢাকায় ফিরেছিলেন। ১৯৫২সালের ২৭ এপ্রিল আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদের কনফারেন্সে সমবেত প্রায় পাঁচশত প্রতিনিধির উদ্দেশে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিব বলেছিলেন, “দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা ভাষা-সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত। আপনারা সংঘবদ্ধ হােন, মুসলিম লীগের মুখােশ খুলে ফেলুন। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই, ভাষা চাই। মুসলিম লীগ সরকার আর মর্নিং নিউজ, গােষ্ঠী ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়” (১(৩)/১৬৫০-৫১)। এস. এ. করিম 

  লিখেছেন, “One of the outcomes of the conference was the decision  .to observe the Martyrs  Day annually on 21 February. When it was observed for the first time after independence in 1972, Mujib described it as the fountainhead of Bangalee nationalism” (১৭/৫৩)। 

 ১৯৫৫সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রদত্ত অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “অন্য কোন ভাষা জানি কি না জানি তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমরা এখানে বাংলাতেই কথা বলতে চাই। যদি আমরা এটা উপলব্ধি করি যে, আমরা বাংলা ভাষায় ভাব বিনিময়ে সক্ষম, তা হলে সকল সময়ই বাংলায় কথা বলবাে, এমনকি ইংরেজিতেও যদি আমাদের সমান দক্ষতা থেকে থাকে। যদি আমাদের অনুমতি না দেয়া হয় তবে আমরা হাউজ পরিত্যাগ করবাে। বাংলাকে অবশ্যই হাউজ কর্তৃক গ্রহণ করে নিতে হবে”(১(৩)/১৬৫১)। প্রসঙ্গতই স্মরণীয়, বাংলাদেশের সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই জাতিসংঘে (১৯৭২) প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন এবং ভাষার প্রতি ভালােবাসার দিকটিও প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। তবে তারও অনেক আগে, অক্টোবর, ১৯৫২ পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে শেখ মুজিব গণচীনে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলির শান্তি সন্মেলনে ৩৭টি দেশের কয়েক শত প্রতিনিধির সমাবেশে বাংলাতেই ভাষণ দিয়েছিলেন। অনস্বীকার্য যে, সেদিন মাতৃভাষার প্রতি তাঁর ভালােবাসাটাই যথেষ্ট ছিল না, প্রয়ােজন ছিল যথার্থ সাহসেরও। শান্তি সম্মেলনে তাঁর বাংলা ভাষণটি ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন আতাউর রহমান খান। উল্লেখ্য যে, উক্ত সম্মেলনে ৩০ সদস্যের পাকিস্তান প্রতিনিধিদলে পাঁচজন মাত্র ছিলেন পূর্ব বাংলার। 

 ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে সােহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলার অবস্থান-দৃষ্টিভিঙ্গ সম্পর্কে ভিন্ন দু’টি ঐতিহাসিক তথ্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। করাচিতে বাস করায় সােহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত ঘটনাবলী থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২, পুলিশের গুলিবর্ষণে ছাত্রজনতার কয়েকজনের মৃত্যুর পর “He issued a statement condemning the police excesses, adding at the same time that Urdu, in his opinion, should be the state language. His statement was so out of tune with the sentiments of the people in East Bengal Mujib flew to Karachi to apprise Suhrawardy about the situation Suhrawardy then issued another statement expressing his full support for Bengali as a state language”(১৭/৫৩)। সােহরাওয়ার্দী তার প্রথম বিবৃতিটি প্রসঙ্গে পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। “২০ নভেম্বর  ৫২ ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে বিরাট জনসভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি 

  জানানাে হয়। এই সভায় সােহরাওয়ার্দী রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলেন, বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে এ মত আমি বহু পূর্বে ঘােষণা করেছি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করা হচ্ছিল তখন আমার বক্তৃতা বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছিল, যে রেডিও পাকিস্তান আমার কোন কথা ইতিপূর্বে প্রচার করেনি, সেই রেডিও থেকে বিবৃতি বিকৃত করে ৩ দিন ধরে প্রচার করা হয়। আমি ঘােষণা করছি যে, বাংলা এবং উর্দু দুটোই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে এবং ভাবের আদান প্রদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানে উর্দু শিক্ষা করা উচিত” (প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ভাষা আন্দোলন ; সরদার সিরাজুল ইসলাম, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৫-০২-২০১৩)। 

 “১৫ মে, ১৯৫২ থেকে দেশময় বাংলা ভাষার পক্ষে স্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়। শহীদ সােহরাওয়ার্দী এই অভিযানের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করেন ৭জুন ‘৫২” (জনকণ্ঠ, প্রাগুক্ত)। ঢাকায় বাংলা ভাষার সমর্থক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের নাম-তালিকাসহ একটি প্রচার-পত্র প্রকাশ করা হয়। তাতে সােহরাওয়ার্দী এবং ফজলুল হক উভয়ের নামই ছিল। “Huq, however, blamed his unnamed opponents for trying to create a rift between himself and Nurul Amin and publicly dissociated himself from the langage movement,  .he did not want to jeopardize his lucrative position as Advocate General” (১৭/৫৩)। অবশ্য এর কিছুদিন পরেই নুরুল আমিনের লাইন ছেড়ে শেরে বাংলা তাঁর নতুন দল কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) গঠন করেছিলেন। 

 “১৯৫৩সালের শহীদ দিবসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, মওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, ওসমান আলী, অলি আহাদসহ সকল রাজবন্দি একদিনের জন্য অনশন করেন এবং খােরাকির টাকা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কাছে প্রেরণ করতে অনুরােধ করেন। মওলানা ভাসানী ১৮এপ্রিল। থেকে আমরণ অনশন শুরু করলে ২১ এপ্রিল মুক্তিলাভ করেন। ২৫ এপ্রিল  ৫৩ সারাদেশে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ওইদিন পল্টন ময়দানে জিল্লুর রহমানের (তদানীন্তন ফজলুল হক হলের ভিপি এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিরাট সভায় মওলানা ভাসানী বক্তব্য রাখেন। আন্দোলনের তীব্রতায় পরদিন ২৬ এপ্রিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করা হয়। ১৯৫৪সালের ..পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচন ( যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন নামে পরিচিত) ছিল ১২ মার্চ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা (করার) দাবিটি ইতােমধ্যে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় (নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো) স্থান পেয়েছে এবং ১৯৫৪ সালের শহীদ দিবসে গােটা পূর্ব বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবশেষে জনগণ ভাষার প্রশ্নে 

  চূড়ান্ত রায় দেন মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করে”(প্রাগুক্ত, জনকণ্ঠ)। 

 ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬ পাকিস্তান কন্সটিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’তে খসড়া সংবিধানের ওপর আলােচনাকালে “শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, যেহেতু বাংলা দেশের ৫৬% লােকের ভাষা, তাই উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করতে হবে। এটা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি। উল্লেখ করেন যে, বাংলা ও উর্দুকে সমভাবে সমৃদ্ধ করে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রদান করাটা সমভাবে কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের গুরুদায়িত্ব। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে আরাে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সবাই চায় যে আজ থেকেই উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হােক” (১(৩)/১৫৯৪)। পরবর্তী ১৬ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘কনস্টিটুয়ান্ট অ্যাসেম্বলি’তে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে আবার আলােচনা করতে গিয়ে মুজিব বলেছিলেন, “বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হয়েছেন এবং প্রায় ১৫০০জন জেল খেটেছেন”। 

  কটিটুয়ান্ট অ্যাসেম্বলি’তে গৃহীত (১৯৫৬) অন্তর্বর্তী সংবিধানে বাংলাকে উর্দুর সাথে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও পূর্ব বাংলায় গভর্নরের *ন, জরি অবস্থা এবং ১৯৫৮ খ্রি. পাকিস্তানে আয়ুবের সামরিক শাসনে বাংলা ভাষা ও সাটি পিছিয়ে পড়েছিল। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ খ্রি. ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। আমরা ক্ষমতা হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশােধন করা হবে” (সূত্র: ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু , স,সিরাজুল ইসলাম, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০-২১ ফেব্রুয়ারি,২০১২)। বাংলা ভাষা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার প্রকৃত সুযােগ আসে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সাথেসাথেই। অতঃপর শাসনতন্ত্র তৈরি হয় বাংলায়। “বঙ্গবন্ধুর কাছে ইংরেজিতে লেখা কোন ফাইল পাঠাতে কেউ সাহস করত না”। 

 “১৯৫৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির সময় প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কেএসপি’র আবু হােসেন সরকার। যেখানে ১৯৫২সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম গুলিবর্ষণের ফলে বরকত শহীদ হন সেখানে মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার, মওলানা ভাসানী ও বরকতের মাতা যৌথভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এইদিন ঢাকায় দু’টি জনসভা হয়। আরমানিটোলা ময়দানে সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী পল্টনের সভায় সভাপতিত্ব করেন আবু হােসেন সরকার । আরমানিটোলা ময়দানে সমাবেশ শেষে এক বিরাট মিছিল শহর প্রদক্ষিণ 

  করে। ১৯৫৬সালের সংবিধান নির্বাচিত গণপরিষদে গৃহীত হয়। স্বায়ত্তশাসন ও ভাষার প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে ২১জানুয়ারি ১৯৫৬ সংবিধান যেদিন গৃহীত হয় সেদিন প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা(সহ) গণপরিষদ ত্যাগ করেছিলেন” (প্রাগুক্ত, জনকণ্ঠ, ১৬-০২- ১৩)। 

 বঙ্গবন্ধুর কথা দিয়েই বাংলার ভাষা-আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র চিন্তা  প্রসঙ্গটি ইতি টানতে চাই, যাতে সহজেই উপলব্ধি করা যাবে, বাংলা আর বাঙালি সম্পর্কিত নিজের চেতনাকে কী গভীর বাস্তবতাবােধ থেকে একটি জাতিরাষ্ট্রে রূপ দিয়েছিলেন। ১৯৭২সালে ঢাকায় সৈয়দ মুজতবা আলী বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনাদের জাতীয়তার ভিত্তি কি কেবল ভূগােল আর ভাষা? বঙ্গবন্ধু মৃদু হেসে বলেছিলেন, না, কেবল ভূগােল আর ভাষা হলেতাে আপনাদের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও বিহার-ওড়িশ্যার অংশবিশেষ দাবি করতাম। আমাদের বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তি বাংলার সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের হাজার বছরের মিলিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তাতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও উপজাতীয় সভ্যতার যেমন ছাপ আছে, তেমনি আছে মুসলমান সভ্যতা-সংস্কৃতির মিশ্রণ। বর্তমানের ভারত একটি পলিটিক্যাল ইউনিয়ন। আর আমরা একটি কালচারাল নেশন। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আমাদের পরিচয় বাঙালি। বহুকাল আমাদের একটি নেশন স্টেট ছিল না। সেটি এখন পেয়েছি। সেটি যদি তার সেকুলার সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে আমরা টিকিয়ে রাখতে পারি, তাহলে বাঙালি জাতি বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি বিশ্বে একটি আধুনিক জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাবেই” (১(১)/১২৯-১৩০)। 

  ৮০ 

  ১৯৫৪’র ‘যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন  : 

 মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বাঙালির ব্যালট-বিস্ফোরণ 

  ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ’ নিবন্ধে ব্যারিস্টার এম, আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন, “১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে যৌথ নেতৃত্বে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। যেমনটি বিজয় হয়েছিল (পরবর্তী সময়ের) ১৯০এর নির্বাচনে। সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক ছত্রছায়ায় গড়া পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী জনগণের এ বিজয়কে মেনে নেয়নি ১৯৫৪ সালে, তেমনি মেনে নেয়নি ১৯৭১-এ” (১(১)/২০২)। প্রকৃতপক্ষেই জনমত বা গণকল্যাণের ভিওিতে নয়, পাকিস্তান শাসিত হতাে সেনা-আমলাচক্রের মর্জি-মাফিক। 

 যুক্তফ্রন্ট গঠন সম্পর্কে বিরল আলােচিত একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য উল্লেখ করেছেন কামরুদ্দীন আহমদ : “১৯৫৩ সনের নভেম্বর মাসে বামপন্থী ছাত্ররা এবং যুবসম্প্রদায়  (আসন্ন) নির্বাচনের পূর্বে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি  যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করার জন্যে আন্দোলন চালালেন। ফজলুল হক সাহেব ও মওলানা ভাসানী  একটি ‘যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে রাজি হলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ‘যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিরােধিতা করছিলেন। শহীদ সাহেব ঢাকায় এলেন এবং তিনিও যুক্তফ্রন্টের বিরােধিতা করলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বামপন্থীরা ও হামিদুল হক, মােহন মিঞা, আব্দুস সালাম খান কিছু কৃষক-প্রজা ও মুসলিম লীগের নেতারা যুক্তফ্রন্ট গঠনের উপর জোর দিলেন   শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেব ও শেখ মুজিবুর রহমান রাজি হলেন এবং হক সাহেব ও মওলানা সাহেব ‘যুক্তফ্রন্ট’ চুক্তিটি সই করেন” (১৪(২)/১৮৩-১৮৪)। তৎকালীন পরিস্থিতিতে যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিষয়ে অনীহার কারণটাও বঙ্গবন্ধুর কথাতেই জানা যায়, “আমি মওলানা সাহেবকে বললাম,  আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয় লাভ করবে, ভয়ের কোন কারণ নাই। আর যদি সংখ্যাগুরু না হতে পারি, আইনসভায় আওয়ামী লীগই বিরােধী দল হয়ে কাজ 

  ৮১ 

  করবে। রাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, জগাখিচুড়ি হবে না। আদর্শহীন লােক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে” (৯/২৪৯)। এতকাল পরেও মানতেই হয়, সেদিনের তরুণ নেতা শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ধারণাই অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রতিপন্ন হয়েছিল। 

 সাংবাদিক-সাহিত্যক এবং রাজনীতি পর্যবেক্ষক আবু জাফর শামসুদ্দিন লিখেছেন, “ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টি (প্রকৃতপক্ষে কৃষক শ্রমিক পার্টি   কেএসপি) ছিল একটি নামসর্বস্ব দল। কিন্তু সেদিনের পূর্ব বাংলায় ব্যক্তি ফজলুল হক ছিলেন এক প্রচণ্ড শক্তি। যুক্তফ্রন্টে মওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম দলকে না টানলেও চলতাে। ওরা ফজলুল হক সাহেবের কৃষক প্রজা দলের সঙ্গে আঁতাত করে যুক্তফ্রন্টে প্রবেশ করে। এ দলটিকে যুক্তফ্রন্টে গ্রহণ করা ছিল একটি মারাত্মক রাজনৈতিক ভুল। ফলাফল শুভ হয়নি। আওয়ামী লীগ দলে যারা ছিলেন না, যারা রাজনীতি করতেন সমাজে নামধাম কামাবার জন্য তারাই প্রধানত কৃষক প্রজা দলের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হন। গণতন্ত্রী দল ছিল প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের মুক্তফ্রন্ট । অবশ্য এ দলেও কিছু কিছু সুযােগ-সুবিধাবাদী ছিলেন। নেজামে ইসলাম দল মুসলিম লীগের বেনামিতে যুক্তফ্রন্টে প্রবেশ করেছিল ” (৮/২৬৬-২৬৭)। 

 বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “প্রত্যেকটা নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিল, যারা ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নিজ নিজ এলাকায় কাজ করেছে। হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক দলের প্রার্থীর অভাব থাকায় বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা থেকে যারাই ইলেকশন করতে আশা করে তারাই কৃষক শ্রমিক দলে নাম লিখিয়ে দরখাস্ত করেছিল। এমন প্রমাণও আছে, প্রথমে মুসলিম লীগে দরখাস্ত করেছে, নমিনেশন পেয়ে কৃষক শ্রমিক দলে নাম লিখিয়ে নমিনেশন পেয়েছে। নেজামে ইসলাম দল কয়েকজন মওলানা সাহেবের নাম নিয়ে এসেছে, তারা দরখাস্তও করে নাই। তাদের সব কয়জনকে নমিনেশন দিতে হবে। এই দল একুশ দফায় দস্তখতও করে নাই। তবে এই দলের প্রতিনিধি একটা লিস্ট দাখিল করলেন, যাদের নমিনেশন দেওয়া যাবে না। কারণ তারা সকলেই নাকি কমিউনিস্ট। এরা কিছু আওয়ামী লীগের জেলখাটা সদস্য আর কিছু গণতান্ত্রিক দলের সদস্য। এদের দাবি এমন। পর্যায়ে চলে গেল যে, নিঃস্বার্থ কর্মী ও নেতাদের নমিনেশন না দিয়ে যারা মাত্র চারপাঁচ মাস পূর্বেও মুসলিম লীগ করেছে অথবা জীবনে রাজনীতি করে নাই, তাদেরই নমিনেশন দিতে হবে। মাঝে মাঝে হক সাহেবের কাছ থেকে ছােট্ট ছােট্ট চিঠিও এসে হাজির হয়। তাঁর চিঠিকে সম্মান না করে পারা যায় না”(৯/২৫৩)। প্রকৃতপক্ষে ফজলুল হক পূর্বাপর কখনাে রাজনৈতিক দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অপরদিকে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময়ই প্রতিপন্ন হয়েছিল যে, ভিন্ন 

  ৮২ 

  মতাদর্শের নেতাকর্মীদের নিয়ে, আপন লক্ষ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিরল দক্ষতা ছিল মুজিবের। 

 যুক্তফ্রন্ট ২১-দফা ‘ম্যানিফেস্টো’র ভিত্তিতে নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল। প্রসঙ্গতই উল্লেখ করা অপরিহার্য যে, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছ দফা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা এবং সবিশেষ উল্লেখ্য যে, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা আর ১৯৭২সালে প্রণীত সংবিধানেও ২১দফার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ২১-দফা প্রণয়নের মূল দায়িত্ব পালন করেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আবুল মনসুর আহমদ সাহেব বিচক্ষণ লােক সন্দেহ নাই। তিনি তাড়াতাড়ি কফিলুদ্দিন চৌধুরীর সাহায্যে একুশ দফা প্রােগ্রামে দস্তখত করিয়ে নিলেন হক সাহেবকে দিয়ে। তাতে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা, রাজবন্দিদের মুক্তি এবং আরও কতকগুলি মূল দাবি মেনে নেওয়া হল” (৯/২৫১)। তদানীন্তন রাজনৈতিক মতপথের নানা দিক অবহিত হওয়ার জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠনের পশ্চাদপটের আরাে কিছু কথা একটু বিস্তারিতভাবেই উল্লেখ করা দরকার। 

 “নির্বাচনী প্রচার অভিযানে যুক্তফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ   প্রধানত শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, সােহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি এলাকায় ব্যাপক গণসংযােগ করেন। আর এই নির্বাচনী প্রচারণার ফলে শেখ মুজিব বিশাল জনগােষ্ঠীর সাথে আরাে নিবিড় এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তাঁর সাংগঠনিক শক্তি ও দক্ষতার ব্যাপক বিকাশ ঘটে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অবিশ্বাস্য সাফল্য পাকিস্তানি শাসকদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। মুসলিম লীগ সম্পূর্ণ ধরাশায়ী হয় এবং তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে” (১(১)/১৩৫)। উল্লেখ্য যে, তখনাে ধর্ম-ভিত্তিক পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। “যুক্তফ্রন্ট শুধু মুসলিম আসনেই কনটেস্ট করিয়াছিল। ২৩৭টি মুসলিম সিটের মধ্যে ২২৮টিই দখল করিয়াছিল। এই ২২৮টির মধ্যে আওয়ামী (মুসলিম) লীগ ১৪৩, কৃষক-শ্রমিক ৪৮, নিজামে ইসলাম ২২, গণতন্ত্রী ১৩ ও খিলাফতে-রববানী ২ জন পাইয়াছিল। নিজামে ইসলাম কার্যত হক সাহেবের পৃষ্ঠপােষিত দল বলিয়া হক সাহেবের নিজস্ব মেম্বর ছিলেন ৭০জন”(৪/৩৩১)। মুসলমান-অমুসলমান এবং মহিলা আসন মিলিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে তখন মােট আসনসংখ্যা ছিল ৩০৯টি। ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের প্রাপ্ত মােট ২২৮টি আসন বাদে ৯টি মাত্র আসন পেয়েছিল মুসলিম লীগ। উন্মুক্ত সাধারণ আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের সহযােগী কংগ্রেস এবং তফশিলী ফেডারেশন ৪২টি এবং কম্যুনিস্ট পার্টি ৪টি আসন পেয়েছিল। বাদ-বাকি ২৬টি আসন পেয়েছিলেন নির্দল প্রার্থী এবং সংরক্ষিত আসনের মহিলারা। 

  ৮৩ 

  রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন এবং যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সাফল্যের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পথটি রচিত হয়েছিল এবং এ পথ ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ। কিন্তু কী হতে পারতাে, এ দুটি সাফল্য অর্জিত না হলে? খ্যাতিমান সম্পাদক আবেদ খান ‘শেখ মুজিবই বাংলাদেশের ঠিকানা’ নিবন্ধে লিখেছেন, “সাতচল্লিশের (ভারত-ভাগ) অব্যবহিত পরে পাকিস্তানকে অস্বীকার করা কিংবা জিন্নাহ অথবা মুসলিম লীগ সম্পর্কিত সামান্যতম শব্দ উচ্চারণ করাও ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। সে সময় থেকেই পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠি শেখ মুজিবকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করেছিল। উনিশ শ’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যদি সফল না হত এবং চুয়ান্নর নির্বাচনে যদি মুসলিম লীগের ভরাডুবি না হত, তাহলে বােধ হয় আওয়ামী লীগ। নিষিদ্ধ হত এবং শেরে বাংলা, ভাসানী বা সােহরাওয়ার্দী এবং অবশ্যই শেখ মুজিব, তাজউদ্দিনের জন্য অপেক্ষা করতাে অন্ধ কারাপ্রকোষ্ঠ কিংবা ফাঁসির দড়ি। লক্ষ্য করার ব্যাপার, পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠির রােষানল থেকে শেরে বাংলা, সােহরাওয়ার্দী, ভাসানী কোনও না কোন সময় রক্ষা পেয়েছিলেন, কিন্তু শেখ মুজিবের জন্য নিস্কৃতি ছিল না। কিন্তু এতকিছুর পরেও শেখ মুজিব ক্রমশঃ উজ্জ্বলতর হয়েছেন” (১(২)/৮০২-৮০৩)। 

 নির্বাচনের (৮-১২মার্চ, ১৯৫৪) বিপুল বিজয় সত্বেও যুক্তফ্রন্ট সরকার সফলতা কিংবা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারেনি, এর পেছনে মুসলিম লীগ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবল ষড়যন্ত্র যেমন ছিল, তেমনি দায়ি ছিল যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ বিবাদ-দুর্বলতাও। এখানে প্রসঙ্গতই যুক্তফ্রন্ট গঠনের আগে জগা-খিচুরী রাজনীতি’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর উক্তিটি স্মরণীয়, “আদর্শহীন লােক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে”। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ের প্রেক্ষাপটে ভােটার-জনগণের আশা ও আস্থার মর্যাদা নেতারা দিতে পারিলেন না। লিডার নির্বাচনের দিন হইতেই, বরঞ্চ আগে হইতেই, আমাদের মধ্যে ফাটল দেখা দেয়। এই ফাটল রােধ করার চেষ্টা একমাত্র শহীদ সাহেব ছাড়া আর কেউ করেন নাই। কৃষক শ্রমিক পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে, আরও নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে হক সাহেব ও শহীদ সাহেবের মধ্যে, মনের অমিল আগে হইতেই ছিল। কারণ এই দুই মহান নেতার নিচে উভয় দলের আরও অনেক নেতা ছিলেন। 

 আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাকর্মীরা যুক্তফ্রন্টের সংসদীয়-নেতা নির্বাচনের আগেই কিছু শর্ত আরােপের প্রস্তাব করলে সােহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, হক সাহেবের ওপর “কোনও শর্ত আরােপ করা চলে না। করিলে এটা হইবে হদ্দ বেইমানি। প্রস্তাবকরা অবশ্যই বলিলেন : তারা সত্যসত্যই হক সাহেবকে ছাড়া অন্য কাউকে লিডার 

  ৮৪ 

  নির্বাচন করিতে চান না। শুধু চাপ দিয়া একটা সর্বদলীয় উঁচুস্তরের মন্ত্রিসভা গঠন করিতে চান। বিনাশর্তে হক সাহেবকে স্বাধীনভাবে ছাড়িয়া দিলে লিডার নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তিনি পার্শ্ব-চরদের দ্বারা বিপথে পরিচালিত হইবেন। তাঁদের যুক্তি শহীদ সাহেবের মনঃপুত হইল না। তিনি আশ্বাস দিলেন, অতীতে যাই হইয়া থাকুক, জীবন-সন্ধ্যায় হক সাহেব আর ভুল করিবেন না। তরুণদের অসন্তোষের মধ্যে সভা ভঙ্গ হইল (৪/৩৩১-৩৩২)। 

 বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিক বর্ণনাটি ভিন্নতর : “নির্বাচনে জয়লাভ করার সাথে সাথে আমাদের কানে আসতে লাগল, জনাব মােহাম্মদ আলী বগুড়া হক সাহেবের সাথে। যােগাযােগ করতে চেষ্টা করছেন পুরানাে মুসলিম লীগারদের মারফতে   যারা কিছুদিন পূর্বে হক সাহেবের দলে যােগদান করে এমএলএ হয়েছেন কৃষক শ্রমিক দলের নামে। সকালবেলা (২ এপ্রিল, ৫৪) আওয়ামী লীগ সদস্যদের সভা (দলীয় কার্যালয়ে) আর বিকালে বার লাইব্রেরি হলে সমস্ত দল মিলে যুক্তফ্রন্ট এমএলএদের সভা। আওয়ামী লীগের সভায় শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব উপস্থিত ছিলেন। সভায় (সকালের) রংপুরের আওয়ামী লীগ নেতা খয়রাত হােসেন সাহেব প্রস্তাবের মাধ্যমে বললেন, “জনাব একে ফজলুল হক সাহেবকে নেতা নির্বাচন করার পূর্বে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তার সাথে পরামর্শ করে মন্ত্রীদের লিস্ট ফয়সালা করা উচিত। একবার তাঁকে যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি দলের নেতা করলে তাঁর দলবলের মধ্যে এমন পাকা খেলােয়াড় আছে, যারা চক্রান্তের খেলা শুরু করতে। পারে। আর একজন ডেপুটি লিডার আমাদের দল থেকে করা উচিত, কারণ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যুক্তফ্রন্টের মধ্যে। শহীদ সাহেব বললেন, তিনি নিশ্চয়ই আমাদের দুইজনের সাথে পরামর্শ করবেন মন্ত্রীদের নাম ঠিক করার পূর্বে। বৃদ্ধ মানুষ এখন তাকে আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না। ভাসানী সাহেবও শহীদ সাহেবকে সমর্থন করলেন। আমি জনাব খয়রাত হােসেন সাহেবের সাথে একমত ছিলাম। কিন্তু জোর করলাম না। যুক্তফ্রন্ট এমএলএদের সভা হল। শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেব তাতে উপস্থিত ছিলেন। হক সাহেবকে সর্বসম্মতিক্রমে নেতা করা হল” (৯/২৫৯)। 

 আবুল মনসুর আহমদ আরাে লিখেছেন, “আওয়ামী লীগের তরুণ এমএলএ’রা যা আশঙ্কা করিয়াছিলেন তাই হইল। মন্ত্রিসভা গঠন লইয়া হক সাহেবের সাথে শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের মতান্তর হইল। সে মতভেদও মাত্র দুই দলের দুইজন তরুণের মন্ত্রিত্ব লইয়া। তার একজন হক সাহেবের প্রিয়পাত্র, অপরজন শহীদ সাহেবের। হক সাহেব তার লােকটির নাম প্রস্তাব করায় শহীদ সাহেবও তাঁর লােকটির নাম করেন। নইলে শহীদ সাহেবের লােকটিকে মন্ত্রী করার ইচ্ছা শহীদ সাহেবের নিজেরই ছিল না। বস্তুত ঐ দিনই সকালের দিকে কিছু সংখ্যক আওয়ামী 

  ৮৫ 

  লীগ-কর্মী ঐ লােককে মন্ত্রী করার দাবি করাতে শহীদ সাহেব কর্মীদের ত ধমকাইয়া দেনই, উপরন্তু তাঁর প্রিয়পাত্রটিকেও ধমকাইয়া দেন। যা হােক শহীদ সাহেব তাঁকে এই বলিয়া সান্ত্বনা দিয়া বিদায় করেন যে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি করা তিনি আগে হইতেই ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন” (৪/৩৩৩-৩৩৪)। ১৯৫৪ র কথা ১৯৭০-এ লিখতে গিয়েও আবুল মনসুর আহমদ শহীদ সাহেবের প্রিয়পাত্র এবং হক সাহেবের প্রিয়পাত্র পরিচয়ের যে-দুটি নাম আড়ালে রেখেছেন, নানা তথ্য-সূত্রে নাম দু’টি অজানা থাকেনি। শহীদ সাহেবের প্রিয়পাত্র শেখ মুজিবুর রহমান এবং হক সাহেবের প্রিয়পাত্র তাঁরই ভাগিনেয়, সৈয়দ আজিজুল হক, নান্না মিয়া। 

 উল্লেখ্য যে, নির্বাচনের ফলাফল ঘােষণার পরেই মুজিব ইত্তেফাক-সম্পাদক মাণিক মিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মাণিক মিয়া লিখেছেন, “He (Mujib) informed me that in Faridpur Mohan Mian and Abdus Salam had been reported as saying that on no account would Mujib be allowed to become a minister and that they would ensure his exclusion .Mujib said that he was not interested in becoming a minister but now it had become a matter of prestige with him. He requested me to have a word with Shaheed Suhrawardy. When I told Suhrawardy about this, he was astounded” (১৭/৫৭-৫৮)। 

 সােহরাওয়ার্দীর সাথে প্রায় একই সময়ে সাক্ষাৎ-আলােচনার একটি বর্ণনা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু নিজেই, “আমি যখন নির্বাচনের পরে ফিরে আসি, শহীদ সাহেব আমাকে একাকী ডেকে বললেন, তুমি মন্ত্রিত্ব নেবা কি না? আমি বললাম, আমি মন্ত্রিত্ব চাই না। পার্টির অনেক কাজ আছে, বহু প্রার্থী আছে, দেখে শুনে তাদের করে দেন। শহীদ সাহেব আর কিছুই আমাকে বলেন নাই” (৮/২৫৯)। মাণিক মিয়া এবং বঙ্গবন্ধুর লিখিত দুটি ভিন্ন বিবরণ থেকে অন্ততপক্ষে একটি সত্য উপলব্ধি করা যায় যে, মন্ত্রিত্ব চাওয়া-পাওয়া নিয়ে মুজিব-সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে মত-ভিন্নতার কিংবা সােহরাওয়ার্দীর ‘প্রিয়পাত্রটিকে ধমকাইয়া দেবার মতও কিছু ঘটেনি। অথচ ‘রাজনৈতিক ইতিহাস  নামে এমন অনেক কথাই ‘বাজার-চালু হয়ে যায়। প্রসঙ্গতই স্মরণীয় যে, পরবর্তী সময়েও প্রায় একই রকম অভিযােগ একই সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, সে-কথা যথাস্থানে আলােচ্য। 

 শেরে বাংলার ওপর নেজামে ইসলামীর প্রভাব এবং দলটির ওপর তাঁর অতিনির্ভরতার কারণে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় যেমন, তেমনি মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ও সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছিল। যুক্তফ্রন্টের মূল সাংগঠনিক শক্তি ছিল আওয়ামী (মুসলিম) লীগ এবং নির্বাচনেও তাদের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল কে.এস.পি-নেজামে ইসলামীর 

  সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। শেখ মুজিব ছিলেন তখন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রভাবশালী সংগঠক। কিন্তু “ফজলুল হকের কৃষক প্রজা (শ্রমিক) দল এবং নেজামে ইসলাম দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে নারাজ হয়” (৮/২৭৩)। শেরে বাংলা নিজেও আওয়ামী লীগকে, বিশেষত শেখ মুজিবকে মন্ত্রিসভায় নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁর মূল পার্শ্বচর নেজামে ইসলাম ধুয়া তুলেছিল শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অনেকেই ক্যুনিস্ট, সুতরাং মন্ত্রিসভায় নেয়া চলবে না। এবিষয়ে নির্বাচন বিজয়ী কেএসপি-প্রার্থী হিসেবে মােহন মিয়া প্রমুখেরও যথেষ্ট উদ্যোগ ছিল। শেখ মুজিব ক্যুনিস্ট   একথা পাকিস্তানি শাসকদের ওপর মহলে ভালােভাবেই ছড়ানাে হয়েছিল। অপরদিকে সােহরাওয়ার্দী-ভাসানী প্রমুখ আওয়ামী নেতৃত্ব যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলেছিলেন, কারা মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবে, সেটি স্থির করবে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ থেকে মন্ত্রীপদে মনােনীত ব্যক্তিবর্গকে একসাথেই মন্ত্রিসভায় নিতে হবে। কিন্তু এ.কে ফজলুল হক ৩ এপ্রিল, ১৯৫৪ তারিখে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়েই একক উদ্যোগে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। 

 তখন প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক কেএসপি’র আবু হােসেন সরকার ও সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া এবং নেজামে ইসলামের আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। মাত্র তিনজনকে মন্ত্রী করেছিলেন। মাণিক মিয়ার মন্তব্য, “The general public  saw the list of three cabinet ministers did not include any Awami Leaguer, they lost their enthusiasm about the electoral victory At last a compromise was reached on 15 May and Awami League joined the government.” (১৭/৫৮)। আবু জাফর শামসুদ্দিন লিখেছেন, “দেড় মাস পরে  চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ১৫ই মে তারিখে আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান এবং আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করা হয়। প্রশ্ন জাগতেই পারে, কেন ফজলুল হক তার মন্ত্রিসভার বিলম্বিত সম্প্রসারণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন? 

 নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের সাথেসাথেই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে উঠেছিল। ২৩ মার্চ চন্দ্রঘােনা কাগজ কলে বাঙালি ও উর্দুভাষীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা লাগিয়ে এরই একটা রিহার্সাল’ তারা সম্পন্ন করেছিল। ষড়যন্ত্রকারীরা শেরে বাংলার বিপুল জনপ্রিয়তাকে খর্ব করতে চেয়েছিল। আর প্রধান লক্ষ্য ছিল কেএসপি’র সাথে আওয়ামী লীগের বিভেদ-বৈরিতা বাড়িয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে জনগণের কাছে অগ্রহণযােগ্য করে তােলা। এমন পরিস্থিতিতেই পূর্ব বাংলার গভর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামান চন্দ্রঘােনা কাগজ কলের দাঙ্গার দোহাই দিয়ে শেরে বাংলাকে ২রা এপ্রিলের মধ্যে মন্ত্রিসভা গঠনের তাগাদা দিলেন। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে মাত্র তিনজন মন্ত্রী নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক মন্ত্রিসভা শপথ নিলেন ৩ এপ্রিল। 

  “ভগ্নস্বাস্থ্য লইয়া শহীদ সাহেব করাচি গেলেন। একই বিমানে প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব তার মন্ত্রী ও অনেক কৃষক-শ্রমিক মেম্বর লইয়া কেন্দ্রীয় সরকারের আমন্ত্রণে করাচি গেলেন। মওলানা ভাসানী ক্ষুণমনে মফস্সলের বাড়িতে গিয়া বসিলেন। যুক্তফ্রন্টে বড় রকমের ফাটল ধরিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে যাতে এই ফাটল বৃদ্ধির কোনও কাজ না হয়, সেজন্য আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকিয়া। আমরা সর্ব অবস্থায় হক মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করিবার প্রস্তাব গ্রহণ করিলাম” (৪/৩৩৪-৩৩৫)। 

 করাচি থেকে ঢাকায় ফিরবার পথে কলকাতায় ৪মে, ১৯৫৪ শেরে বাংলা বলেছিলেন, “Politicians have partitioned the territories, but the common mass should ensure, that everybody live peacefully. Language proved to be the most unifying factor in history and the people of two Bengals, bound together in common language, should forget political divisions and feel themselves to be one” (৮/২৭৪)। ৫ মে তারিখে এটি প্রকাশিত হয়। ঢাকার মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। মুসলিম লীগ মহল তােলপাড় লাগিয়ে ফজলুল হককে কোণঠাসা করে ফেলে। পূর্ব বাংলা কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগাররা একবারও ভাবলেন না যে, শেরে বাংলা ছিলেন পাকিস্তানের প্রস্তাবক, তিনি ১৯৪৬-৪৭ খ্রি. সময়কালে ‘যুক্ত বাংলার দাবিতে কোনােভাবেই যুক্ত ছিলেন না। এমনকি ভাষা আন্দোলন থেকেও তিনি দূরে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সুযােগ বুঝে মােহাম্মদ আলী বগুড়া এবং তার দলবলেরা হক সাহেবের বিরুদ্ধে তাই নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। এই বিপদের মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেতা বা কর্মীরা হক সাহেব ও তার দলবলের বিরুদ্ধাচরণ করলেন না। তারা জানিয়ে দিলেন যে, তারা হক মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করবেন। হক সাহেব এই অবস্থায় আওয়ামী লীগারদের সাথে আলােচনা করে পুরা মন্ত্রিসভা গঠন করতে আগ্রহ প্রকাশ করতে লাগলেন” (৯/২৬২)। 

 “১০ই মে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে (ঢাকায়) এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় শেরে বাংলাও উপস্থিত ছিলেন এবং ঘােষণা করেন মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করে আওয়ামী লীগকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে” (২১/২৮)। পরবর্তী প্রসঙ্গ-কথা বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকে : “মওলানা সাহেব ও আমি টাঙ্গাইলে এক কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতা করছিলাম। এই সময় টাঙ্গাইলের এসডিও জানালেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে ঢাকায় যেতে অনুরােধ করে রেডিওগ্রাম পাঠিয়েছেন। মওলানা সাহেব বললেন, ‘দরকার হলে তােমাকে মন্ত্রিসভায় যােগদান করতে হবে। তবে শহীদ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে নিও বােধহয় হক সাহেবের দল কোনাে মুশকিলে পড়েছে, তাই ডাক পড়েছে” (৯/২৬২)। বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে টেলিফোনে আলােচনা করলে 

  সােহরাওয়ার্দী সম্মতি দিয়েছিলেন। সেদিনই মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু, আতাউর রহমান খানসহ কয়েকজন নেতা এবং মাহবুব মাের্শেদ জিপে টাঙ্গাইল গিয়ে মওলানা ভাসানীরও সম্মতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন শেরে বাংলা মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত (১৫ মে,  ৫৪ খ্রি.) করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। 

 পাকিস্তান সরকারের সহযােগিতায় তখন এগিয়ে এসেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিলড্ৰেথ। “নির্বাচনের পরে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ 

 সরকারের পদত্যাগের যে জোর দাবি উঠেছিল, সে সম্পর্কে হিলড্রেথ প্রকাশ্য বিবৃতিতে বলেছিলেন যে, পূর্ব বঙ্গের নির্বাচন ছিল নেহাৎ একটা প্রাদেশিক ব্যাপার। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের পদত্যাগের কোন প্রশ্নই ছিল না। ঐ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের জনগণ পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধেও কোন রায় দেয় নাই । হিলড্রেথের ঐ বিবৃতি ছিল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীদের নগ্ন হস্তক্ষেপ” (২০/১৩৫)। উল্লেখ্য যে, যুক্তফ্রন্ট সংসদীয় দলের প্রথম সভাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ইতােপূর্বে গঠিত গণপরিষদ থেকে পূর্ববঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু হক সাহেবকে করাচিতে পূর্ব বাংলার সদস্যরা যখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “তারা পদত্যাগ করবেন কিনা, তিনি উত্তরে বলেছিলেন, তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন নাই, আর তাদের করতে হবে কেন?” (৯/২৬১)। এতকাল পরেও মনে হয়, সেদিন গণপরিষদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে, গণ-পরিষদের অবর্তমানে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের টিকে থাকা সম্ভব হতাে না এবং সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডগুলি অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়তাে। 

 “On 15 May, as the United Front Ministry was expended to include the Awami League and other Front members, pre-planned riots between Bengali and non-Bengali workers broke out at the Adamjee Jute Mills Bengalis who had voted for the Front suffered most of the casualties.” (১৭/৫৮)। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমরা যখন শপথ নিচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে দাঙ্গা শুরু হওয়ার কারণ কি? বুঝতে বাকি রইল না, এ এক অশুভ লক্ষণ ! হক সাহেব আমাদের নিয়ে সােজা রওনা করলেন আদমজী জুট মিলে।  দাঙ্গা। তখন অল্প অল্প চলছিল। রাস্তায় বস্তিতে মরা মানুষের লাশ পড়ে আছে। অনেকগুলি লােক চিৎকার করছে, সাহায্য করার কেউই নাই। ইপিআর পাহারা দিতেছে, বাঙালি ও অবাঙালিদের আলাদা আলাদা করে দিয়েছে। কিছু সংখ্যক লােক পাওয়া গেল, তাদের সাহায্যে আহত লােকগুলিকে এক জায়গায় করে পানি দিতে শুরু করলাম। মােহন মিয়া ও আমি সকাল এগারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিনশতের মত আহত লােককে হাসপাতালে পাঠাতে পেরেছিলাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালি জনসাধারণ জমা হচ্ছিল তাদের শান্ত করলাম। যদি তারা সঠিক 

  খবর পেত তাহা হলে আমার কথা শুনত কিনা সন্দেহ ছিল। পাঁচশতের উপর লাশ আমি স্বচক্ষে দেখলাম। আরও শ খানেক পুকুরের মধ্যে আছে, ” (৯/২৬৩-২৬৪)। 

 বঙ্গবন্ধু আরাে লিখেছেন, আদমজী মিল থেকে সােজা চিফ মিনিস্টারের বাড়িতে যেয়ে শুনতে পারলাম তিনি আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আমি তার কাছে গেলে তিনি আমাকে খুব আদর করলেন। আমাকে বললেন, ক্যাবিনেট মিটিং এখনই শুরু হবে, তুমি যেও না । রাত সাড়ে দশটায় ক্যাবিনেট মিটিং বসল। এরপর আলােচনা শুরু হল সে কথা আমার পক্ষে বলা উচিত না, কারণ ক্যাবিনেট মিটিংয়ের খবর বাইরে বলা উচিত না। মিটিং শেষ হবার পর যখন বাইরে এলাম, তখন রাত প্রায় একটা। অনেক অবাঙালি নেতা দাঁড়িয়ে আছেন। বললেন এখনই ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বের হতে। খবর রটে গেছে যে বাঙালিদের (আদমজীতে) অবাঙালিরা হত্য করেছে। যেকোনাে সময় অবাঙালিদের ওপর আক্রমণ হতে পারে। কয়েকজনকে নিয়ে আমি বেড়িয়ে পড়লাম। রাস্তার মােড়ে মােড়ে ভিড় জমে আছে বক্তৃতা করে সকলকে বুঝাতে লাগলাম এবং অনেকটা শান্ত করতে সক্ষম হলাম। এই দাঙ্গা যে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এবং দুনিয়াকে নতুন সরকারের অক্ষমতা দেখাবার জন্য বিরাট এক ষড়যন্ত্রের অংশ সে সম্বন্ধে আমার মনে কোনাে সন্দেহ নাই। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ও পশ্চিমা শিল্পপতিদের যােগসাজশে যুক্তফ্রন্টকে ভাঙতে চেষ্টা করছিল, আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভায় যােগদান করায় তা সফল হল না। এ সুযােগ (কেন্দ্রীয় সরকার) সৃষ্টি করতে পারত না, যদি প্রথম দিনই যুক্তফ্রন্ট পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা গঠন করে শাসন ব্যবস্থাকে কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করত” (৯/২৬৫-২৬৬)। 

 আদমজী-দাঙ্গার দু’সপ্তাহ পরে এবং ‘পাক-মার্কিন অস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরের দশ দিনের মাথায় “১৯৫৪ সালের ২৯শে মে তারিখে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল (গােলাম মােহম্মদ) যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করেন। প্রদেশে জারি হয় ৯২-ক’ ধারা। সাম্রাজ্যবাদের দালাল ইসকান্দর মীর্জা বাংলাদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন। বাংলাদেশে পদার্পণ করেই তিনি নেতাদের গুলি করে হত্যা করার সংকল্প প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, যেখানে পারাে ভাগাে,  Go while going is good’। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে সন্তুষ্ট করার জন্যই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়েছিল। গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অসংখ্য কর্মী ও নেতাকে। বিরানব্বই-ক ধারা প্রবর্তনের পর কিছুদিন বাংলার রাজনীতি স্তব্ধ হয়ে যায়। বাঙালিকে সন্তুষ্ট করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে” তড়িঘড়ি ফিরিয়ে এনে প্রধানমন্ত্রী বানানাে হয়। 

  প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ইংরেজি ভাষায় দেয়া বক্তৃতায় বলেছিলেন, “Fazlul Huq is a traitor” এই দম্ভপূর্ণ উক্তি শুনে যতটা না বিস্মিত হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি হয়েছিলাম ক্ষুব্ধ। ফজলুল হক বয়সে তাঁর পিতৃতুল্য। দু’জনের বিদ্যাবুদ্ধির কোনাে তুলনা হয় না। সেই লােকের এই দম্ভ” (৮/২৭৪-২৭৬)। 

 পাকিস্তানের সেনা-আমলা-রাজনীতিক ষড়যন্ত্রকারীদের দিক থেকে চন্দ্রঘােনা এবং আদমজীতে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা ঘটানাের প্রয়ােজনও ছিল। তারা জানতাে, আওয়ামী লীগসহ যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতায় রেখে অনেক চক্রান্তই বাস্তবায়িত করা যাবে না। ১৯মে তারিখে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে করাচিতে ডেকে পাঠালাে কেন্দ্রীয় সরকার। একই দিনে করাচিতে স্বাক্ষরিত হলাে ‘পাক-ইউএস আর্মস্ প্যাক্ট’ (পাক-মার্কিন অস্ত্র চুক্তি)। অতঃপর ২৩শে মে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় পাকিস্তান থেকে প্রেরিত জন. পি. কালাহান নামক এক সাংবাদিকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলা হয় যে, ফজলুল হক, তার প্রদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছেন। শেরে বাংলা অবশ্য ঐ রিপাের্টটিকে ‘Perversion of truth   সত্যের বিকৃতি  বলে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু কালাহানের রিপাের্টটিরই প্রয়ােজন ছিল পাকিস্তানি চক্রান্তকারীদের, এটার সত্য-মিথ্যা বিচারের প্রয়ােজন ছিল না। “পূর্ব-বাংলার প্রধানমন্ত্রীর আনুগত্য যাচাই করা হইল একজন বিদেশী রিপাের্টারের উক্তির দ্বারা। হক সাহেব ও তাঁর সহকর্মী মন্ত্রীরা করাচি হইতে ঢাকায় ফিরিবার আগেই খুব বিশ্রী ও অভদ্রভাবে ৯২-ক ধারা (গভর্নরের শাসনসহ) জারি করা হইয়াছিল। অন্যতম মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকারী মন্ত্রী-ভবন হইতে গেরেফতার করা হইল। আমাদের বাড়ি হইতে সরকারি গাড়ি, টেলিফোন, পিয়ন চাপরাশী গার্ড সবই তুলিয়া নেওয়া হইল। পরদিন যুক্তফ্রন্ট পার্টির এক সভা ডাকা হইল। একজন অফিসার আসিয়া আমাদিগকে জানাইলেন : যুক্তফ্রন্ট আফিস তালাবদ্ধ করা হইয়াছে। এখানে কোনও সভা করিতে দেওয়া হইবে না”(৪/৩৩৬-৩৩৮)। 

 ১৯ মে, ১৯৫৪ খ্রি. মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকে করাচি যাবার সময় শেখ মুজিবসহ বেশ ক জন মন্ত্রীকেও সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “মােহম্মদ আলী বেয়াদবের মত হক সাহেবের সাথে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করছিল। এমন সময় মুহম্মদ আলী আমাকে বললেন, কি মুজিবর রহমান, তােমার বিরুদ্ধে বিরাট ফাইল আছে আমার কাছে। এই কথা বলে, ইয়াংকিদের মত ভাব করে পিছন থেকে ফাইল এনে টেবিলে রাখলেন। আমি বললাম, ফাইল তাে থাকবেই, আপনাদের বদৌলতে আমাকে তাে অনেক জেল খাটতে হয়েছে। আপনার বিরুদ্ধেও একটা ফাইল প্রাদেশিক সরকারের কাছে আছে। তিনি বললেন, ‘এর অর্থ’। আমি বললাম,  যখন খাজা নাজিমুদ্দিন 

  সাহেব ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে আপনাকে মন্ত্রী করেন নাই। আমরা যখন ১৯৪৮সালে প্রথম ভাষা আন্দোলন করি, তখন আপনি গােপনে দুইশত টাকা চান্দা দিয়েছিলেন, মনে আছে আপনার? পুরানা কথা অনেকেই ভুলে যায়’। হক সাহেবের সাথে যে সে বেয়াদবের মত কথা বলেছিল, সে সম্বন্ধেও দু এক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলাম”(৯/২৬৭-২৬৮)। 

 মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক করাচিতে ২৮ মে, ১৯৫৪, প্রাদেশিক মন্ত্রীদেরকে নিয়ে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। গভর্নর জেনারেল “যে কামরায় শুয়ে দেশ শাসন করতেন, আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। তিনি খুবই অসুস্থ,হাত-পা সকল সময়ই কাঁপে। তিনি হক সাহেবের সাথে আলাপ করলেন। আমার নাম ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, উপস্থিত আছি কিনা !  আমি আদাব করলাম। তিনি আমাকে কাছে নিয়ে বসালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লােকে বলে, আপনি কমিউনিস্ট, এ কথা সত্য কি না? আমি তাকে বললাম, “যদি শহীদ সাহেব কমিউনিস্ট হন, তাহলে আমিও কমিউনিস্ট । তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, আপনি এখনও যুবক, দেশের কাজ করতে পারবেন। আমি আপনাকে দোয়া করছি। আপনাকে দেখে আমি খুশি হলাম। তিনি পরিষ্কার বলতে পারেন না। আল্লাহ সমস্ত বুদ্ধি আর মাথাটা ঠিক রেখে দিয়েছেন” (৯/২৬৮-২৬৯)। 

 গােলাম মােহম্মদের ষড়যন্ত্র আগেই শুরু হয়েছিল। করাচিতে পরের দিনই শেখ মুজিব এবং আতাউর রহমান জেনেছিলেন, মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব বাংলায় জরুরি আইনে গভর্নর শাসন জারি করা হবে। পূর্ব বাংলার বাঙালি আইজি দোহাও তখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী হিসেবে করাচিতেই ছিলেন। শেখ মুজিবের পর্যবেক্ষণ, আইজি দোহা কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন। 

  পূর্ব বাংলার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বরখাস্ত : 

 ‘৯২-ক ধারা  জারি, যুক্তফ্রন্টে ভাঙ্গন 

  ২৯মে, ১৯৫৪ তারিখে রাতে করাচি থেকে দিল্লি-কলকাতা হয়ে ৩০ তারিখ দুপুরে হক সাহেব ঢাকায় ফিরলেন আর সেদিনই বিকাল চারটায় যুক্তফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করে পূর্ব বাংলায় জারি করা হলাে (৯২-ক ধারা) গভর্নরের শাসন। কেন্দ্রীয় ডিফেন্স সেক্রেটারি ইস্কান্দর মির্জা জরুরি ক্ষমতার অধিকারী নতুন গভর্নর এবং এন. এম খান চিফ সেক্রেটারি হিসেবে, হক-মুজিবের আগেই মিলিটারি বিমানে ঢাকায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। “Mirza lost no time ..Under Public Safety Act, which allowed preventive detention and arrest of people without trial, more than 1600 people were rounded up within the first twenty four hours. Most of them belonged to the Awami Muslim League  Among those arrested were Mujib and forty other legislators. Fazlul Huq was interned in his home. Section 144 .was imposed throughout the province. Pro-Awami League Ittefaq was subjected to pre-censorship” (১৭/৬০)। 

 করাচি থেকে বিমানে ঢাকায় ফেরার সময়ের একটি কৌতুহলােদ্দীপক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু, “কলকাতা পৌঁছাবার কিছু সময় পূর্বে জনাব দোহা (আই.জি) হক সাহেবকে যেয়ে বললেন, স্যার আমার মনে হয় আপনার আজ কলকাতা থাকা উচিত। কি হয় বলা যায় না,..রাতেই ইস্কান্দর মির্জা এবং এন. এম. খান ঢাকায় মিলিটারি প্লেনে রওয়ানা হয়ে গেছেন। যদি কোনাে কিছু না হয়, তবে আগামী কাল প্লেন পাঠিয়ে আপনাদের নেওয়ার বন্দোবস্ত করব । আমার কাছে দোহা সাহেব এসে ঐ একই কথা বললেন। আমি বলে দিলাম, কেন কলকাতায় নামব? কলকাতা আজ আলাদা দেশ। যা হয় ঢাকায়ই হবে । নান্না মিয়াও একই জবাব দিলেন। আমার বুঝতে বাকি থাকল না পাকিস্তানি শাসকচক্র দুনিয়াকে দেখাতে চায়, হক সাহেব দুই বাংলাকে এক করতে চান, তিনি পাকিস্তানের দুশমন, 

  রাষ্ট্রদ্রোহী। আর আমরা তাঁর এই রাষ্ট্রদ্রোহী কাজের সাথী। কলকাতা এয়ারপাের্টে আবার দোহা সাহেব এসে বললেন, ‘টেলিফোন করে খবর পেলাম, সমস্ত ঢাকা এয়ারপাের্ট মিলিটারি ঘিরে রেখেছে। চিন্তা করে দেখেন, কি করবেন?  বললাম, আমাদের তাতে কি, আমরা ঢাকায়ই যাব। ভাবলাম, দোহা। সাহেব পুলিশে চাকরি করেন, তাই নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেন। আমরা রাজনীতি করি, তাই এই সামান্য চালাকিটাও বুঝতে পারি না! ঢাকায় এসে দেখলাম, বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য অপেক্ষা করছে” (৯/২৬৯২৭০)। 

 আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, আবু হােসেন সরকারের সরকারি বাড়িতে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীবর্গ এবং প্রায় দেড় শত এমএলএ র এক ‘ইনফরমাল’ সভায় (৬জুন, ১৯৬৫৪ খ্রি.)“কেন্দ্রীয় সরকারের এই অনিয়মতান্ত্রিক ৯২-ক ধারা প্রবর্তনের নিন্দা করিয়া, পার্টি লিডারকে নজরবন্দি ও অন্যতম মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে গেরেফতার করার তীব্র প্রতিবাদ করিয়া সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হইল। অতঃপর সমবেতভাবে কারাবরণ করার কর্ম-পন্থায় অধিকাংশের সমর্থন দেখা গেল। এখানেও পুলিশের হামলা হইল। আমরা বেশ কয়েকজন তখন হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিয়া সমস্ত অবস্থা ও আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানাইলাম এবং আইন অমান্যে আমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করিতে অনুরােধ করিলাম। হক সাহেব আমাদিগকে এলাকায় গিয়া জনগণকে বিপ্লবী বেআইনি ধবংসাত্মক কাজে নিয়ােগ করিবার .পরামর্শ দিলেন।..বুঝিয়া আসিলাম শেরে বাংলা বেশ একটু ভয় পাইয়াছেন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একটা আপস করিবার জন্য চেষ্টা তলেতলে করিতেছেন। হক সাহেব ও যুক্তফ্রন্টের এই দুর্বলতার পূর্ণ সুযােগ কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করিলেন (৪/৩৩৮-৩৪০)। 

 আরাে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য, বঙ্গবন্ধুর লেখা থেকে : ৩০মে তারিখে ঢাকায় পৌঁছানাের কিছু পরেই “আমি তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে আতাউর রহমানের বাড়িতে এসে তাঁকে নিয়ে হক সাহেবের বাড়িতে গেলাম এবং তাঁকে অনুরােধ করলাম ক্যাবিনেট মিটিং ডাকতে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই অন্যায় আদেশ আমাদের মানা উচিত হবে না। তিনি বললেন, কি হবে বুঝতে পারছি না, অন্যদের সাথে পরামর্শ কর। মনে হল সকলেই ভয় পেয়ে গেছেন। আতাউর রহমান সাহেব রাজি ছিলেন, যদি সকলে একমত হতে পারতাম। মন্ত্রীদের পাওয়া গেল না, হক সাহেব দোতলায় বসে রইলেন। আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দরকারি কাগজপত্র সরিয়ে বের হওয়ার সাথে সাথে অন্য পথ দিয়ে পুলিশ অফিসে এসে পাহারা দিতে আরম্ভ করল। বাড়িতে ফোন করে জানলাম সেখানেও গিয়েছিল। বিদায় (নান্না মিয়ার বাড়ি থেকে) নেওয়ার সময় অনেককে বললাম, আপনারা এই অন্যায় আদেশ মাথা 

  পেতে নেবেন না। দেশবাসী প্রস্তুত আছে, শুধু নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদের। জেলে অনেকের যেতে হবে, তবে প্রতিবাদ করে জেল খাটা উচিত” (৯/২৭০২৭১)। 

 “পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন জারি করার দিন প্রধানমন্ত্রী জনাব মােহাম্মদ আলী (বগুড়া) যে বক্তৃতা রেডিও মারফত করেন, তাতে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ এবং আমাকে ‘দাঙ্গাকারী’ বলে আক্রমণ করেন। আমাদের নেতারা যারা বাইরে রইলেন, তাঁরা এর প্রতিবাদ করারও দরকার মনে করলেন না। দেশবাসী ৬ই জুনের (যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি পার্টির সভা) দিকে চেয়েছিল, যদি নেতারা সাহস করে প্রােগ্রাম দিত তবে দেশবাসী তা পালন করত। অনেক কর্মীই চেষ্টা করে গ্রেফতার হয়েছিল। যদি সেইদিন নেতারা জনগণকে আহ্বান করত তবে এতবড় আন্দোলন হত যে কোনদিন আর ষড়যন্ত্রকারীরা সাহস করত না বাংলাদেশের উপর অত্যাচার করতে। একমাত্র আতাউর রহমান খান কয়েকদিন পরে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন। দেড় ডজন মন্ত্রীর মধ্যে আমিই একমাত্র কারাগারে বন্দি। যদি ৬ই জুন সরকারের অন্যায় হুকুম অমান্য করে (হক সাহেব ছাড়া) অন্য মন্ত্রীরা গ্রেফতার হতেন তা হলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন শুরু হয়ে যেত। দুঃখের বিষয়, একটা লােকও প্রতিবাদ করল না। ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারল যে, যতই হৈচৈ বাঙালিরা করুক যতই জনসমর্থন থাকুক এদের দাবিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। পুলিশের বন্দুক ও লাঠি দেখলে এরা পালিয়ে গর্তে লুকাবে” (৯/২৭৩)। 

 পাকিস্তানের প্রাসাদ চক্রান্তের তখন প্রধান কৃৎ-কুশলীরা ছিলেন গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহম্মদ, প্রধানমন্ত্রী মােহম্মদ আলী বগুড়া, চৌধুরী মােহম্মদ আলী, সেনাপ্রধান আয়ুব খান এবং পূর্ব-বাংলার গভর্নর ইস্কান্দর মির্জা প্রমুখ। তারা রাজনীতির ক্ষেত্রে সরাসরি মিথ্যা বলেছেন, কথা দিয়ে কথা রাখেননি, আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে। বরখেলাফ করেছেন, এমনকি কোরান-ছুঁয়ে শপথ করেও প্রয়ােজনমত ভুলে গেছেন। গণ-পরিষদ বাতিল করে দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট তমিজুদ্দিন খান এবিষয়ে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে লাহাের ‘চিফ কোর্ট’এ একটি আপিল-মামলা করেছিলেন। ষড়যন্ত্রকারীদের ভয় ছিল, আপিলের রায় সরকারের বিপক্ষে গেলে, স্থগিদ’ আইন পরিষদ পুনর্বহাল হবে এবং আবার যুক্তফ্রন্ট তথা আওয়ামী লীগেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রসঙ্গতই বলা দরকার যে, তদানীন্তন বাঙালি রাজনীতির তিন-প্রধান হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী বিভিন্ন সময়ে, কখনাে ষড়যন্ত্রী পাওয়ার-ক্লিক’ দ্বারা চরম অপমানিত হয়েছেন, আবার কখনাে তাদের ষড়যন্ত্রের জালে ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় জড়িয়ে পড়েছেন। বঙ্গবন্ধু মুজিবের দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য-বলিষ্ঠতা এবং রাজনৈতিক একাকীতু  উপলব্ধি 

  করার জন্যই ১৯৫৪ পরবর্তী ষড়যন্ত্রমূলক পাক-রাজনীতির বস্তুনিষ্ঠ আলােচনা করা দরকার, সংক্ষেপে হলেও। 

 ১৯৫৪ সালের ৩০ মে সন্ধ্যায় পূর্ব বাংলার মন্ত্রী শেখ মুজিবকে ঢাকায় তাঁর সরকারি বাসা থেকে গ্রেফতার করে দাঙ্গা বাঁধানাে, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি বেশ কয়েকটি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ধারাগুলি খুব যুৎসই বা মজবুত নয় এবং আদলত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে যেতে পারেন, এমন আশঙ্কায়, দু’তিন দিন পরেই তাঁকে নিরাপত্তা বন্দী’ ঘােষণা করা হয়। তখন নিরাপত্তা আইনে, যেকোনাে ব্যক্তিকে বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল বন্দি করে রাখার ‘আইনগত সুযােগ ছিল। এ-যাত্রায় মুজিব বন্দি ছিলেন ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিক পর্যন্ত। মুজিবের বন্দিত্বকালেই ‘মুক্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ’   বিশেষত, হক সাহেব এবং সােহরাওয়ার্দী প্রমুখ এমন কিছু কাজ করেছিলেন, যাতে মুজিবের পক্ষে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ হওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না। 

 “Fearful of being charged of treason unless he apologized, Fazlul Huq issued a statement on 30 May ending with these lines :  I sincerely regret having made utterances which reflected on my loyality to Pakistan. On account of my old age, I am retiring from public life” (39/40) দেখা যাচ্ছে, পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করে হক সাহেবকে গৃহবন্দি করার দিনই তিনি অমন ‘মুচলেকা দিয়েছিলেন এবং রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে আলােচনাও করেননি। আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ হক সাহেবের সাথে প্রতিবাদ সংগঠনের জন্য আলােচনা করতে গেলেও তিনি তাঁর আবেদনের কথা গােপন রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “গৃহবন্দী হক সাহেবকে দিয়ে তাঁর সমর্থকেরা এক বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাতে তিনি অন্যায় স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করলেন। তিনি যুক্তফ্রন্টের নেতা, তার এই কথায় আমাদের সকলের মাথা নত হয়ে পড়ল। তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তাঁর মনে দুর্বলতা আসতে পারে। যারা বাইরে ছিলেন তাঁরা কি করলেন! স্থির করলাম এই কৃষক শ্রমিক দলের সাথে আর রাজনীতি করা যায় না। খবর পেতে লাগলাম যে, কৃষক শ্রমিক দলের কয়েকজন নামকরা নেতা। গােপনে মােহাম্মদ আলীর (পাক প্রধানমন্ত্রী) সাথে আলােচনা চালিয়েছেন কিভাবে আবার মন্ত্রিত্ব পেতে পারেন। দরকার হলে আওয়ামী লীগের সাথে কোনাে সম্পর্ক তাঁরা রাখবেন না”(৯/২৭৭-২৭৮)। 

 অচল-অসুস্থ অবস্থাতেও গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহম্মদের ষড়যন্ত্র-পরিকল্পনা অব্যাহত ছিল। তিনি ভাবলেন, ফজলুল হক রাজনীতি থেকে বিদায় নিলে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ প্রবল হয়ে উঠবে, পাকিস্তানের শক্তি-কাঠামাে তাতে অধিকতর হুমকিতে পড়তে পারে। সুতরাং ফজলুল হকের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় 

  একটা অবস্থান-সমর্থনের ভিত্তি রাখা দরকার, সেই সাথে দরকার আওয়ামী লীগকে যুক্তফ্রন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফজলুল হকের মাধ্যমেই সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা। গােলাম মােহম্মদেরা এটাও জানতেন যে, শেরে বাংলার সবটুকু রাজনৈতিক শক্তিই পূর্ব বাংলায় আর সােহরাওয়ার্দী হচ্ছেন একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় সমভাবেই প্রভাবশালী। সুতরাং কাউকেই হারানাে চলবে না। তাই, পূর্ব বাংলার রাজনীতির বিভেদ-ষড়যন্ত্রের | খেলায় যখন যাকে প্রয়ােজন কাজে লাগাবার পরিকল্পনাগুলি গােলাম মােহম্মদ যথেষ্ট ভেবেচিন্তেই শুরু করেছিলেন। 

 ‘ভারত শাসন আইন,১৯৩৫  তখনাে পাকিস্তানের শাসন-ভিত্তি। তাতেই উল্লেখ ছিল, ‘গভর্নর জেনারেল প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য পরিচালনা করবেন। সেই ‘সাংবিধানিক আতঙ্ক’ দূর করতেই ২৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ গভর্নর জেনারেল সারা পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করে গণ-পরিষদ ভেঙ্গে দিলেন। অতঃপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী বগুড়া এবং সেনাপ্রধান আয়ুব খানকে দ্রুত করাচিতে ফিরিয়ে এনে নতুন ছক সাজিয়ে ‘Ministry of Talents - ‘প্রতিভাধরদের মন্ত্রিসভা গঠন করে বলা হলাে, দল-পরিচয় নয়, মন্ত্রীদের দক্ষতা-প্রতিভাই বিবেচ্য বিষয়। গভর্নর জেনারেল অতঃপর চৌধুরী মুহম্মদ আলীকে অপসারণ করে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসালেন মােহম্মদ আলী বগুড়াকে, দেশরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল আয়ুব খান, পূর্ব বাংলার গভর্নরের পদ ছেড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন ইস্কান্দর মির্জা। গােলাম মােহম্মদের অনুরােধে’ জুরিখে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে, সাংবিধানিক সংকট মােকাবিলার দায়িত্ব নিয়ে ২১ ডিসেম্বর, ১৯৫৪ আইনমন্ত্রী হলেন সােহরাওয়ার্দী। 

 গােলাম মােহম্মদ এবং জুরিখে চিকিৎসাধীন সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে সমঝােতার দূত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান খান। অপরদিকে মন্ত্রিসভা গঠনের আগেই মােহম্মদ আলী নভেম্বর মাসে ঢাকা সফরে এসে শেরে বাংলার সাথে আপােষ রফা করে রেখেছিলেন। মােহম্মদ আলী এবং ফজলুল হকের সমঝােতার শর্ত ছিল, “Huq would be rehabilitated politically provided he co-operated with the power structure in West Pakistan and their Bengali henchman Mohammad Ali Bogra. In fact, Bogra had secretly made a deal with Fazlul Huq to make his nominee Chief Minister of East Bengal in exchange for Huq s promise to challenge Suhrawardy s credentials to represent the people of East Bengal” (১৭/৬২)। 

 বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, কারাবন্দি অবস্থায় “খবরের কাগজে দেখলাম, করাচিতে 

  আতাউর রহমান সাহেব গােলাম মােহম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আতাউর রহমান সাহেব জুরিখ থেকে ফিরে আসলেন। এমএলএ’রা ও কর্মীরা জেলে। আওয়ামী লীগের সভাপতি (মওলানা ভাসানী) বিলাতে, জেনারেল সেক্রেটারি কারাগারে বন্দি। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা ঝুলছে। এই অবস্থায় কি করে গােলাম মােহম্মদকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেবার বন্দোবস্ত করার জন্য একটা ফুলের মালা নিয়ে আতাউর রহমান সাহেব, আরেকটা মালা নিয়ে হক সাহেব তেজগা এয়ারপাের্টে দাঁড়িয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত গােলাম মােহম্মদ সাহেবের গলায় দুইজনই মালা দিলেন। আওয়ামী লীগ একটা সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান সেই প্রতিষ্ঠানের নেতারা কি করে এই অগণতান্ত্রিক ভদ্রলােককে অভ্যর্থনা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমি ও আমার সহবন্দিরা খুবই মর্মপীড়ায় ভুগছিলাম। শহীদ সাহেব ভুল করলেন, লাহাের ও ঢাকায় না যেয়ে, দেশের অবস্থা না বুঝে মন্ত্রিত্বে যােগদান করে। ঢাকায় এসে যদি যুক্তফ্রন্ট পার্টির সভা ডাকতেন এবং সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে কিছু করতেন তাহলে কারও কিছু বলার থাকত না। আমি নিজে কিছুতেই তার আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না” (৯/ ২৮১-২৮৩)। 

 এস. এ. করিম জানিয়েছেন, জুরিখ থেকে করাচি ফেরার পর, “Following faceto-face talks with Ghulam Mohammed, Suhrawardy accepted the offer only after Ghulam Mohammed swore on the Holy Koran that promises made to him would be kept. Still Suhrawardy wanted to go to Dhaka for consultations with his colleagues before joining the Cabinet. Ghulam Mohammed requested him not to do so because it could complicate matters” (১৭/৬২)। ২১ ডিসেম্বর সােহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী হিসেবে ‘মিনিস্ট্রি অব ট্যালেন্ট’এ যােগ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ গােলাম মােহম্মদের কথা মেনেই সােহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান হিসেবে ঢাকায় এসে দলীয় এবং ফ্রন্টভুক্ত নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনার দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছিলেন। 

 ১৯৫৪’র ২৪ডিসেম্বর (মতান্তরে ২৫) কারামুক্তি পেয়ে মুজিব সােহরাওয়ার্দীর সাথে। সাক্ষাৎ-আলােচনার জন্য ১ বা ২ জানুয়ারি করাচি পৌঁছেছিলেন। এবার করাচিতে মুজিব-সােহরাওয়ার্দী সাক্ষাৎকার খুব প্রীতিকর হয়নি। করাচিতে পৌঁছানাের রাতে তিনি নেতার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাননি, মুজিবের দুশ্চিন্তা ছিল: “দেখা হলে কি। অবস্থা হয়, বলা যায় না ! আমি তার সাথে বেয়াদবি করে বসতে পারি”। পরের দিন সকালে শহীদ সাহেব “আমাকে দেখে বললেন, “গত রাতে এসেছ শুনলাম, রাতেই দেখা করা উচিত ছিল। আমি বললাম, ক্লান্ত ছিলাম, আর এসেই বা কি করব, আপনি তাে এখন মােহম্মদ আলী সাহেবের আইনমন্ত্রী। তিনি বললেন, ‘রাগ করেছ, বােধ হয়। বললাম, “রাগ করব কেন স্যার, ভাবছি সারা জীবন আপনাকে 

  নেতা মেনে ভুলই করেছি কি না?  তিনি বললেন,  বুঝেছি, আর বলতে হবে না, কাল,এস, অনেক কথা আছে” (৯/২৮৬)। 

 পরের দিন সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিত্ব গ্রহণের ইতিবৃত্ত শােনালেন ‘প্রিয়-শিষ্য’ মুজিবকে। কিন্তু মুজিব বললেন, “পূর্ব বাংলায় যেয়ে সকলের সাথে পরামর্শ করে অন্য কাউকেও তাে মন্ত্রিত্ব দিতে পারতেন। আমার মনে হয় আপনাকে ট্র্যাপ করেছে। ফল খুব ভাল হবে না, যে জনপ্রিয়তা আপনি অর্জন করেছিলেন, তা শেষ করতে চলেছেন। তিনি আমাকে বােঝাতে চেষ্টা করলেন  ‘কিছু না করতে পারলে ছেড়ে দেব,, তাতে কি আসে যায় ! আমি বললাম, এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আপনার যােগদান করা উচিত হয় নাই, আপনি বুঝতে পারবেন। তিনি আমাকে পূর্ব বাংলায় কখন যাবেন তার প্রােগ্রাম করতে বললেন। আমি বললাম, ভাসানী সাহেব দেশে না এলে এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি না দিয়ে আপনার ঢাকায় যাওয়া উচিত হবে না। তিনি রাগ করে বললেন, তার অর্থ তুমি আমাকে পূর্ব বাংলায় যেতে নিষেধ করছ । আমি বললাম, কিছুটা তাই। আমি থাকতে থাকতে দেখলাম, আবু হােসেন সরকার সাহেবকে হক সাহেবের নমিনি হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে (স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ৪ জানু, ১৯৫৫) গ্রহণ করা হয়েছে। শহীদ সাহেব কিছুই জানেন না। এবার তিনি কিছুটা বুঝতে পারলেন যে খেলা শুরু হয়েছে” (প্রাগুক্ত)। 

 আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “১৯৫৪সালের ১১ই ডিসেম্বর সুহরাওয়ার্দী সাহেব বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। তিনি ইতিপূর্বেই করাচিতে ঐ তারিখে কেন্দ্রীয় আওয়ামী 

 লীগের একটি বৈঠক আহ্বান করিয়াছিলেন। যথাসময়ে আওয়ামী লীগের বর্ধিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসিল। শহীদ সাহেব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করিয়া মূল্যবান বক্তৃতা করিলেন। তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিবেন কিনা, সে সম্বন্ধে মেম্বরদের পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। উভয় পাকিস্তান হইতে যাঁরা বক্তৃতা করিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই বলিলেন, শহীদ সাহেব একমাত্র প্রধানমন্ত্রী রূপেই মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিবেন, অন্যথায় নয়। তাছাড়া এ কথাও কেউ কেউ বলিলেন যে, মৌঃ তমিয়ুদ্দিন সাহেবের রিট দরখাস্ত তখনও সিন্ধুর চিফ কোর্টে বিচারাধীন রহিয়াছে। কাজেই অনিশ্চিত পরিবেশে শহীদ সাহেবে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হইবে না। এইভাবে শহীদ সাহেব আওয়ামী নেতাদের মতামত জ্ঞাত হইয়া গভর্নর জেনারেলের সাথে দেখা করিতে গেলেন” (৪/৩৪৪-৩৪৫)। 

 পরের দিন সােহরাওয়ার্দী জানালেন: “বড়লাটের মতে শহীদ সাহেবকে সাধারণ মন্ত্রী হিসেবেই মােহম্মদ আলী-কেবিনেটে ঢুকিতে হইবে। তারপর অল্পদিন মধ্যেই শহীদ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী করিয়া মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হইবে। শহীদ সাহেব আমাদিগকে বুঝাইতে চাহিলেন যে, প্রধানমন্ত্রীত্বটা বড় কথা নয়, বড় কথা শাসনতন্ত্র রচনা। কিন্তু মেম্বররা শহীদ সাহেবের সহিত একমত হইলেন না। তখন 

  তিনি প্রস্তাব দিলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের.৪জন করিয়া নেতৃস্থানীয় আওয়ামী-নেতা লইয়া তিনি গােপন পরামর্শ করিবেন। আমরা তাতেই রাজিীহইলাম” (৪/৩৪৫-৩৪৬)। বৈঠকটি একটানা বেশ কয়েকদিন চলেছিল এবং সেটি অসমাপ্ত রেখেই আবুল মনসুর আহমদকে ময়মনসিংহে ফিরতে হয়েছিল। তখন সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি নিজস্ব ৮-দফা মতামত লিখে দিয়েছিলেন, ৪নং ক্রমিকে ছিল, “যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার নির্বাচনী ওয়াদার ১৯নং দফা অনুসারে ৩ বিষয়ের কেন্দ্রীয় সরকারের বিধান শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে বড়লাট ও মন্ত্রিসভার সঙ্গে এখনই বােঝাপড়া করিতে হইবে”। আর ৮নং ছিল, “মন্ত্রিসভায় প্রবেশের আগেই শহীদ সাহেবকে একবার পূর্ব-বাংলা সফর করিতে এবং যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সাথে আলােচনা করিতে হইবে”(৪/৩৪৭)। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী কেনাে পরামর্শই মানেননি। ততােধিক বিস্ময়কর ছিল, মন্ত্রিসভায় সােহরাওয়ার্দীর প্রবেশের পর শেখ মুজিব যখন করাচিতে দেখা করে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, তখন সােহরাওয়ার্দী এসব কথা মুজিবকে জানাননি। 

 আগেই বলা হয়েছে, সােহরাওয়ার্দীকে না জানিয়েই আবু হােসেন সরকারকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নেয়া হয়েছিল। “Mujib, however, was so angry at this deliberate insult of his leader that he left Karachi on 5 January .On arrival in Dhaka, Mujib accused Fazlul Huq of challenging the leadership of Suhrawardy. He proposed to the Awami Leaguers that Fazlul Huq should be removed from his position of leader of the Parliamentary Party of the United Front” (১৭/৬৩)। শেখ মুজিব করাচিতেই জেনেছিলেন, হক সাহেব নিজেই এক সাংবাদিকের কাছে বলেছেন, তিনিই যুক্তফ্রন্টের নেতা, সােহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের কেউ নন। অথচ এ কথা কারােই অজানা ছিল না যে, যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগই ছিল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ, অন্য সকলে মিলেও তার সমান নয়। 

 শেখ মুজিব করাচিতেই আরাে জেনেছিলেন যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের। নিকট থেকে “কৃষক-শ্রমিক দলের নেতারা কথা পেয়েছেন, পূর্ব বাংলায় সরকার তাদেরই দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ দল থেকে কিছু লােক তাঁরা পাবেন, এ আশ্বাসও তারা পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু আরাে লিখেছেন, “যদিও শহীদ সাহেবের সাথে। তাঁর মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার ব্যাপার নিয়ে একমত হতে পারি নাই, তবু অন্য কেউ তাঁকে অপমান করুক এটা সহ্য করা আমার পক্ষে কষ্টকর ছিল। আমি শহীদ সাহেবকে বললাম, যখন হক সাহেব প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন, আপনি যুক্তফ্রন্টের কেউ নন, তখন বাধ্য হয়ে প্রমাণ করতে হবে, আপনিও যুক্তফ্রন্টের কেউ। আমরা অনাস্থা দিব হক সাহেবের বিরুদ্ধে। শহীদ সাহেব বললেন, যতদিন আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টে আছে ততদিন তাে সত্যই আমি কেউ নই। হক সাহেব যুক্তফ্রন্টের 

  নেতা, (সকল দলের) পক্ষে কথা বলতে পারেন” (৯/২৮৭)। অর্থাৎ সােহরাওয়ার্দী পরােক্ষভাবে হলেও মুজিবকে যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার পরামর্শ দিয়েছিলেন। 

 ঢাকায় ফিরেই যুক্তফ্রন্ট ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডেকে, হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার উদ্যোগ গ্রহণ করলেন শেখ মুজিব। প্রথমেই আলােচনা আতাউর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ এবং মানিক মিয়া প্রমুখের সাথে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, তিনজনই প্রথমে একটু অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। অনাস্থা সম্বন্ধে কোনাে আপত্তি নাই, তবে পারা যাবে কিনা আমি বললাম, না পারার কোনাে কারণ নাই। নীতি বলেও তাে একটা কথা আছে। আমি ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করলাম। ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সকলেই একমত, কেবল সালাম সাহেব ও হাশিমউদ্দিন সাহেব একমত হতে পারলেন না। তবে এ কথা জানালেন যে, তাঁরা ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই মানতে বাধ্য। হক সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে কে অনাস্থা প্রস্তাব প্রথমে পেশ করবে,  অনেকেই আপত্তি করতে লাগলেন, আমার নিজেরও লজ্জা করতে লাগল। তাকে তাে আমি সম্মান ও ভক্তি করি। কিন্তু এখন কয়েকজন নেতা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তাঁকে তাঁদের কাছ থেকে শত চেষ্টা করেও বের করতে পারলাম না। ঠিক হল, আমিই প্রস্তাব আনব আর জনাব আব্দুল গণি নার এট ল’ সমর্থন করবেন” (৯/২৮৭-২৮৮)। 

 আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, “আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি মুজিবুর রহমান সাহেব হক সাহেবের বিরুদ্ধে এক অনাস্থা প্রস্তাব আনিলেন। বলিলেন : ‘এ অনাস্থা প্রস্তাব আওয়ামী লীগের তরফ হইতে নয়, যুক্তফ্রন্টের তরফ হইতে।   ইত্তেফাক’ সম্পাদক মানিক মিয়া সাহেব ও আমি এই অনাস্থা প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করিলাম। ১৯৫৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি যুক্তফ্রন্টের এই ঐতিহাসিক (ওয়ার্কিং কমিটির) বৈঠক বসিল” (৪/৩৫০-৩৫১)। আওয়ামী মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যদের সর্বাত্মক সমর্থন না পেলেও মুজিব আশাবাদী ছিলেন, দলের বাইরে কেএসপি এবং নেজামে ইসলামের কিছু সদস্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল বিপরীত। 

 “As many as thirty five members of the Awami League, led by Abdus Salam Khan of Faridpur, did not vote in support of the motion; worse still, some of them, enticed by various inducements deserted the party to join the KSP. Mujib did not despair. To him the defection of a few self-seeking opportunists would not amount to any tangible loss for Awami League. Quite the contrary, he argued, the party would emerge out of this seemingly disheartening experience as a more determined, ideologically cohesive body (১৭/৬৩) 

 অনাস্থা প্রস্তাবের ব্যর্থতার অল্প দিনের মধ্যেই আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট থেকে 

  বেরিয়ে এসেছিল। হক-সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে বিভেদ-বিরােধ সৃষ্টির ব্যাপারে গােলাম মােহম্মদ-মির্জা-মােহম্মদ আলীরা সফল হলেন। আবু জাফর শামসুদ্দিনের প্রণিধানযােগ্য মন্তব্য, “ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বড় নােংরা জিনিস। কুকুরের মত উদগীর্ণ খাদ্যও পুনরায় গিলতে হয়। বাংলায় আওয়ামী লীগকে একঘরে করার প্রয়ােজন ছিল। তাই ‘ট্রেটর’ ফজলুল হককে কিছুকাল পরেই পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করার প্রয়ােজন হলাে। এ সময়ে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির আবর্তের মধ্যে পথ হারালেন পূর্ব বঙ্গের অনেক নেতা। প্রাদেশিক আইন পরিষদে কৃষক-প্রজা পার্টির (কৃষক-শ্রমিক পার্টি) নেতা আবু হােসেন সরকার নিজামে ইসলামীর সহযােগিতায় মন্ত্রিসভা গঠন করেন” (৮/২৭৬)। “যুক্তফ্রন্ট ভাংগিয়া গেল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের বড় শরিক আওয়ামী লীগ কোনাে সুবিধা উপভােগ করিতে পারিল না। বরঞ্চ ছােট শরিক কেএসপি দৃশ্যত এবং স্পষ্টত সব সুবিধা লুটিতে লাগিল। শহীদ সাহেব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকার দরুন আওয়ামী লীগের কোনও সুবিধা ত হইলই না, বরঞ্চ প্রতিপদে বেকায়দা হইতে লাগিল” (৪/৩৫২)। 

 আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গভর্নর জেনারেল কর্তৃক গণ-পরিষদ ভেঙ্গে দেবার প্রতিবাদে গণ-পরিষদের প্রেসিডেন্ট তমিজউদ্দিন খান লাহাের চিফ কোর্টে ৯ নভেম্বর, ১৯৫৪ একটি মামলা করেছিলেন। ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৫ চিফ কোর্টের প্রদত্ত রায়ে গভর্নর জেনারেলের কাজটি আইনবহির্ভূত এবং অবৈধ ঘােষিত হয়েছিল। তখন আইনমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে উচ্চতর আদালতে আপিল করায় গভর্নর জেনারেলের সিদ্ধান্তটিই বৈধতা পেয়েছিল। অতঃপর গভর্নর জেনারেল জরুরি অবস্থা জারি করে নিজেকেই সংবিধান প্রণয়নের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী ঘােষণা করলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট অন্য এক মামলার রায়ে গভর্নর জেনারেলের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণকেও বেআইনি বলে ঘােষণা করলেন। তখন আইনের পথে চলা ছাড়া গভর্নর জেনারেলের আর কোনাে উপায় রইলাে না। ২৮ মে, ১৯৫৫ গভর্নর জেনারেল ঘােষণা করলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্যারিটি  মেনে ৪০জন। করে নির্বাচিত সদস্য নিয়ে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণ-পরিষদ গঠন করা হবে। 

 জুন ১৯৫৫, পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের ভােটে শেখ মুজিব গণ-পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। “Mujib was now a member of both the East Bengal Assembly and the Constituent Assembly he was quick to learn the rules and conventions of the parliamentary system. His long association with Suhrawardy was no doubt of great help to him in his new role” (১৭/৬৬)। পৃথক নির্বাচন বিধান অনুসারে গণ-পরিষদে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসন ছিল ৩১টি, তার মধ্যে যুক্তফ্রন্টের বিজয় হয়েছিল ১৬ আসনে, যুক্তফ্রন্ট ছেড়ে বেরিয়ে-আসা আওয়ামী মুসলিম লীগ পেয়েছিল ১২টি আসন আর 

  ১০২ 

  একটি করে আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন মুসলিম লীগ, কম্যুনিস্ট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বাকি নয়টি অ-মুসলিম আসনে কংগ্রেস পেয়েছিল পাঁচটি এবং তফশিলী ফেডারেশন চারটি। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়েছিল ২৬টি আসনে। সব মিলিয়ে মােট ৮০টি আসনের ২৭টি পেয়েছিল মুসলিম লীগ, অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও, মুসলিম লীগই গণ-পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। গণ-পরিষদ নির্বাচনের দল-ভিত্তিক ফলাফলে মুসলিম লীগকেএসপি’র মধ্যে ঐক্য-বােঝাপড়া দৃশ্যতই বেড়ে গিয়েছিল। পূর্ব বাংলায় কেএসপি-দলীয় আবু হােসেন সরকার প্রধানমন্ত্রী, অথচ ফজলুল হক স্বায়ত্তশাসনসহ যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা দাবিগুলি এড়িয়ে চলছিলেন। অপরদিকে পূর্ব ও পশ্চিম। পাকিস্তানের জনগণ এবং নেতৃবৃন্দের সমঝােতার লক্ষ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ‘প্যারিটি’ প্রবর্তনের উদ্যোগটি আইনমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীই শুরু করেছিলেন। 

 এমন পরিস্থিতিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আলােচনার জন্য গণ-পরিষদের প্রথম বৈঠক ৭-১৪ জুলাই ১৯৫৫, পশ্চিম পাকিস্তানের মারি শৈল-শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার আগে অনানুষ্ঠানিক আলােচনাতেই ‘প্যারিটি’র প্রশ্নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতভেদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তবে মারিতে প্রথম দু’দিনের আনুষ্ঠানিক আলােচনার পর শাসনতন্ত্রের পাঁচ-দফাভিত্তিক সমঝােতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সমঝােতামূলক দফাগুলি ছিল : ১. পশ্চিম পাকিস্তানে ‘এক ইউনিট’, ২. ‘পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন’, ৩. সকল ব্যাপারে দুই অঞ্চলের মধ্যে সংখ্যা-সাম্য’ (প্যারিটি ), ৪. ‘যুক্ত নির্বাচন এবং ৫. বাংলা-উর্দু রাষ্ট্রভাষা  (৪/৩৬৪)। 

 উক্ত চুক্তিনামায় “প্রধানমন্ত্রী মােহম্মদ আলী, নবাব গুরমানী (পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর) ও জনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দীর দস্তখত হওয়ার পর হক সাহেব দস্তখত করিতে অস্বীকার করিয়াছেন। হক সাহেব শহীদ সাহেবকে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি মনে করেন না। কাজেই তার সাথে তিনি পূর্ব বাংলার পক্ষে দস্তখত করতে রাজি নন। হক সাহেব শহীদ সাহেবকে অপদস্থ করিবার মতলবেই এ কথা বলিয়াছেন, এতে আমাদের কোনও সন্দেহ রহিল না” (৪/৩৬৫)। সােহরাওয়ার্দী তখন। বিচক্ষণভাবেই পরিস্থিতি সামাল দিয়ে পূর্ব বাংলার পক্ষে আতাউর রহমান ও আবুল। মনসুর আহমদকে দিয়ে চুক্তিটি স্বাক্ষর করিয়েছিলেন এবং অতঃপর স্বাক্ষর। করেছিলেন ফজলুল হক। চক্রান্তের রাজনীতিতে জড়িয়ে শেরে বাংলা ফজলুল হক পূর্ব বাংলার প্রতনিধিত্বকারী হিসেবে সােহরাওয়ার্দীকে অস্বীকার করেছিলেন, অথচ অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ইস্কান্দর মির্জাকে ‘রাজকীয় বংশােদ্ভূত বাঙালি  বলে ঘােষণা করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, সিরাজউদদৌলার আত্মীয় এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের সরাসরি উত্তরপুরুষ ছিলেন ইস্কান্দর মির্জা। 

  ১০৩ 

  ‘মারী চুক্তিটি অবশ্য শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। কারণ, গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা চূড়ান্ত পর্যায়ে আলােচনার জন্য ঐ চুক্তির‘ট্র কপি হিসেবে যা উপস্থাপন করেছিলেন, তাতে প্রকৃতপক্ষে অনেক কিছুই তিনি বদলে ফেলেছিলেন। যাহােক, ‘মারী চুক্তির পরিবর্তনের কথা বর্তমান আলােচনায় তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। তবে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে, ইস্কান্দর মির্জার গভর্নর জেনারেল হওয়ার প্রসঙ্গটি। ১৯৫৫সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকেই ষড়যন্ত্রীরা গােলাম মােহম্মদকে তাঁর স্বাস্থ্যগত অক্ষমতার কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। গভর্নর জেনারেল হলেন ইস্কান্দর মির্জা নিজে। আর নিজের ছেড়ে আসা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বসালেন ফজলুল হককে। ফজলুল হকের পছন্দে ক মাস আগে নিয়ােজিত কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কেএসপি’র আবু হােসেন সরকারকে বানানাে হলাে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। এখানে পূর্বোল্লিখিত মির্জা-হক ‘গােপন-সমঝােতার বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। এ পরিবর্তনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল সােহরাওয়ার্দীর, কিন্তু ডিফেন্স মিনিস্টার আইয়ুব খানের আপত্তির কারণে মন্ত্রিসভাতেই তিনি স্থান পেলেন না। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরে এলেন চৌধুরী মােহম্মদ আলী। কেএসপিকংগ্রেস-তফশিলীদের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় নতুন মন্ত্রিসভা ১০ আগস্ট, ১৯৫৫ শপথ গ্রহণ করেছিল। 

 তখন পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি, অপশাসন এবং খাদ্যাভাবের কারণে যথার্থই নাজুক হয়ে পড়ছিল। “Abu Hossain Sarker as Chief Minister of East Pakistan  did not have a majority in the legislature and he refused to call it into session. To shore up his position, Fazlul Huq was sent as Governor in March (1956) and the two of them,  did their best to prolong the life of the Sarker Ministry. In order to buy the support of the legislators, Sarker restored to the practice of issuing permits for them to get rice from government godowns cheaply, which could then be sold in the open market at an exorbitant price. This officially sanctioned profiteering by legislators supporting the Sarker Ministry made the already grave food situation worse” (১৭/৭২-৭৩)। 

 খাদ্য-পরিস্থিতি দ্রুতই অসহনীয় হয়ে ওঠায় আবু হােসেন মন্ত্রিসভার জনপ্রিয়তা। বলতে কিছুই বাকি থাকলাে না। সরকারের দুঃশাসন এবং খাদ্য-সঙ্কটের প্রতিবাদে ভাসানী অনশন শুরু করলেন। মুজিব ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল করলেন। মুজিবের দাবি ছিল দু’টি : চরম খাদ্য-সঙ্কটাপন্ন জেলাগুলিকে দুর্ভিক্ষ-এলাকা বলে ঘােষণা করতে হবে আর প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। জরুরি ত্রাণ-সহায়তা প্রেরণের আহ্বান জানাতে হবে। মুজিব এবং তার সহযােগীরা 

  ১০৪ 

  জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের পাশে এসে দাঁড়ালেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার পর, সােহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলায় এসে বিভিন্ন এলাকায় জরুরি পরিদর্শন করে সঙ্কটজনক খাদ্য-পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে গভর্নর জেনারেল মির্জাকে চিঠি লিখলেন : “Unconstitutional conduct on the part of the rulers breeds unconstitutional reaction on the part of the people”। সােহরাওয়ার্দী প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে হুঁশিয়ারি জানালেন, গণ-বিরােধী কেএসপিসরকারের পতনের জন্য শিগগিরই আইন-অমান্য আন্দোলন শুরু করা হবে। 

 আবু জাফর শামসুদ্দিন তখনকার পরিস্থিতির কয়েকদিনের বিবরণে লিখেছেন : “আজ ৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬। ভুখ মিছিল এলাে নদীর ওপারের এবং মাতুয়াইল অঞ্চলের কাছারিতে হাজার হাজার লােক জমায়েত হলাে। পুলিশ কাছারির বারান্দায় মিছিলকারীদের ওপর লাঠি চালাল। কয়েকজন আহত হলাে। সংবাদ পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান, মহিউদ্দিন এমএলএ, ইয়ার মােহম্মদ খান এমএলএ, আতাউর রহমান খান এমএলএ, আবুল মনসুর আহমদ এবং আমিও ঘটনাস্থলে গেলাম। মিছিলকারীরা ধ্বনি তুলছে : চাউল চাই, রেশনিং ব্যবস্থা চাই। ৪ঠা সেপ্টেম্বর গতকাল সন্ধ্যায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারা জারি করেছে ভুখ মিছিলের ভয়ে। বেলা সাড়ে এগারােটা খবর এলাে পুলিশ মিছিলকারীদের ওপর গুলি ছুড়েছে। কাজী ইদরিসকে নিয়ে ঘটনাস্থলে চকবাজারে গেলাম। তিনজনকে খুন করেছে পুলিশ। একজনের লাশ পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে স্থানীয় জনসাধারণ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান আসতেই জনতা সেই লাশ নিয়ে মিছিল করল। ১৫ হাজারের মিছিল। শেখ মুজিব, ইয়ার মুহম্মদ খান লাশসহ মিছিলের পুরােভাগে। মিছিল সদরঘাটে পৌঁছতেই আবার গুলি চললাে   নিহত হলাে একজন এবং কয়েকজন আহত। মানুষ তবু দমে না, মিছিল তবু চলে। ৫সেপ্টেম্বর গতকাল জনতার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রতিজ্ঞার ভাব দেখেছি   করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। সােয়ারিঘাটে একটি সাধারণ লােক, পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যে ঘেরাও লােকদের দিকে গুলি চলার পর সে বলছিল, ভাত চান, তবে যান না এগিয়ে এমনিতে মরতে হবে তার চেয়ে গুলি খেয়ে মরাে। সে নিজেও যাচ্ছিল। সারাদিন তুমুল বিক্ষোভ মিছিল চললাে। বিকেলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে বিরাট জনসভা হলাে। শেখ মুজিবও বক্তৃতা করলেন। ৬-৯-৫৬ আবু হােসেন সরকার পদত্যাগ করেছেন”(৮/২৭৬-২৭৮)। 

  ১০৫ 

  পূর্ববঙ্গ ও কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সরকার : 

 পূর্ববঙ্গের খাদ্য-সঙ্কটের সফল মােকাবিলা 

  খাদ্য-সঙ্কট সম্পর্কে সােহরাওয়ার্দীর চিঠি এবং প্রকাশ্য বিবৃতি গভর্নর জেনারেল মির্জাকে যথেষ্টই দুর্ভাবনায় ফেলেছিল। ঢাকার সেনা-সদরের মাধ্যমেও তিনি নাজুক পরিস্থিতির খবর পাচ্ছিলেন, বিষয়টা আর এড়িয়ে চলা সম্ভব ছিল না। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে ইস্কান্দর মীর্জা পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনার জন্য ফজলুল হক, আবু হােসেন সরকার এবং সােহরাওয়ার্দীকে করাচিতে ডেকে পাঠালেন। এ আলােচনাতেই স্পষ্ট হলাে গভর্নর “Fazlul Huq had no option but to ask the Awami League to form a government. He invited Ataur Rahman Khan to do so immediately” (১৭/৭৩)। 

 পূর্ব বাংলায় সঙ্কটাপন্ন খাদ্য পরিস্থিতিতে সরকার গঠনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের ভিতরে দুটি ভিন্ন মত ছিল। একপক্ষের মত ছিল, দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষাবস্থায় সরকার গঠন করা হবে আত্মহত্যার শামিল, কারণ এমন কোনাে নিশ্চয়তা নেই যে, আওয়ামী লীগ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারবে। অপরদিকে শেখ মুজিবসহ অন্যরা চাইছিলেন, অবশ্যই দুঃসময়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সঙ্কটাপন্ন জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে, অনুকূলভাবে সরকার পরিচালনার সক্ষমতা আছে আওয়ামী লীগের। এঁদের সাহসী সিদ্ধান্তক্রমেই ৫সেপ্টেম্বর গভর্নর ফজলুল হকের সাথে সাক্ষাতের পরদিন, ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬ আতাউর রহমান খানের প্রধানমন্ত্রীত্বে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। নবগঠিত আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ (আওয়ামী মুসলিম লীগ) মাহমুদ আলী (গণতন্ত্রী পার্টি) এবং কফিলউদ্দিন চৌধুরী (কেএসপি’র বিদ্রোহী সদস্য) প্রমুখ। সুতরাং এটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে প্রকারান্তরে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাই ছিল। 

 তখন পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ ছিল সরকারি দল’ আর কেন্দ্রে বিরােধী দল। 

  ১০৬ 

  তবে এক সপ্তাহ পরেই শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্য আবুল মনসুর আহমদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যােগ দিয়েছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পরদিনই গভর্নর জেনারেল মির্জার কৌশলে প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহম্মদ আলী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তখন সােহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানালে তিনি সম্মত হয়েছিলেন। ইস্কান্দর মির্জার পরােক্ষ উদ্যোগে-সমর্থনে গঠিত রিপাবলিকান পার্টির সহায়তায় ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫, সােহরাওয়ার্দী কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ এটাকে দেখেছেন সােহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিত্বের প্রতি লােভ’ হিসেবে আবার কেউবা বলেছেন, ‘অস্বাভাবিক ঝুঁকি নেয়া। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্ভাব্য সকল ষড়যন্ত্রপ্রতিক্রিয়ার বিষয়েই সােহরাওয়ার্দী সচেতন ছিলেন এবং পাকিস্তানের গণতন্ত্রবিরােধী শক্তির প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কাও তাঁর অজানা ছিল না। তবু পূর্ব বাংলার খাদ্য সঙ্কটের দ্রুত সমাধান এবং যথাশীঘ্র দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যেই, নানা দিক থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও সােহরাওয়ার্দী এ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। 

 পূর্ব বাংলা সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, পল্লী-উন্নয়ন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব অক্লান্ত উদ্যোগে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে দেশজুড়ে দলীয় নেতাকর্মীদেরকে রিলিফ কাজে সক্রিয় করে তুলেছিলেন। বার্মা থেকে দ্রুত চাল আমদানি এবং সকল দুর্গত এলাকাতে লঙ্গরখানা পরিচালনা করায় খাদ্য-পরিস্থিতির লক্ষণীয় উন্নতি ঘটছিল। অনস্বীকার্য যে, যুক্তফ্রন্টের ভেতরে কেএসপি-আওয়ামী লীগ মতবিরােধ, যুক্তফ্রন্ট থেকে আওয়ামী লীগের বেরিয়ে যাওয়া, আওয়ামী-দলীয় বেশ ক’জন এমএলএ দলত্যাগ করে কেএসপি’র পক্ষাবলম্বন এবং দেশজুড়ে নানামুখী রাজনৈতিক টানাপড়েনের ফলে ইতােপূর্বে আওয়ামী লীগ ব্যাপক প্রতিকূলতার মুখে পড়েছিল। কিন্তু দেশের সঙ্কটের সময় সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার গঠন করে “The Awami League government faced the food crisis with great determination. Ataur Rahman, the Chief Minister, directed his ministers to treat the food emergency as a top priority . The Awami League had passed its first test in administration with flying colours” (১৭/৭৫)। ফলে হারানাে জনপ্রিয়তার পুনরুদ্ধার সম্ভব হওয়াতে পরবর্তী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাতটি আসনের উপ-নির্বাচনে ছ টিতেই জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। 

 পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের তিনদিনের মাথায়, সােহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলায় এসে বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই করে খাদ্য-সঙ্কট মােকাবিলার জন্য তিন কোটি টাকার বিশেষ তহবিল মঞ্জুর করায় প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে সঙ্কট 

  ১০৭ 

  মােকাবিলা করা অনেকটাই সহজ হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর আরেকটি উল্লেখযােগ্য প্রশংসনীয় কাজ সম্পর্কে খােকা রায় লিখেছেন, “তিনি সংবিধান সংশােধন করে পৃথক নির্বাচন প্রথার বদলে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যুক্ত নির্বাচন প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন” (২০/১৬১)। পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগ (সংখ্যাগরিষ্ঠ কোয়ালিশন) সরকার অতি দ্রুত সকল রাজবন্দির মুক্তির ব্যবস্থা করেছিল। আর কেন্দ্রের আওয়ামী লীগ (সংখ্যালঘু কোয়ালিশন) সরকার পূর্ব বাংলায় সাম্প্রদায়িক পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে যুক্ত-নির্বাচন প্রবর্তন করেছিল। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উল্লেখযােগ্য উন্নতি ঘটেছিল। 

 প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমন্বিত উদ্যোগে পূর্ব বাংলার চরম খাদ্য-সঙ্কটের দ্রুত নিরসন হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিরুদ্ধ-পক্ষীয় কেউই আওয়ামী লীগ সরকারের অদক্ষতা কিংবা অসততার কোনাে অভিযােগ আনতে পারেনি। কিন্তু অভিযােগ এনেছিলেন স্বয়ং আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী। প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের পরেই সােহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলার খাদ্য পরিস্থিতি সরজমিনে যাচাই করতে এসেছিলেন, সঙ্গে এনেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আমজাদ আলী এবং কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর সম্বর্ধনা-সভায় সভাপতি ভাসানী প্রকাশ্যেই অশােভন অভিযােগের তীর ছুঁড়েছিলেন : “the people had expected the Prime Minister to bring a planeload of foodgrain – he has brought instead a plane load of women If he did not perform his job properly, he would be dragged down by the ear from his seat of power” (১৭/৭৫)। এখানেই শেষ নয়, প্রাদেশিক সরকারের প্রতিও তাঁর অভিযােগ ছিল, এখনাে জুয়া-খেলা, ঘােড়দৌর বন্ধ হয়নি, পতিতালয়গুলি কিভাবে বাধাহীন চালু রয়েছে? সােহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতির জন্যও তীব্র সমালােচনা করেছিলেন, যেক্ষেত্রে ভাসানীর কোনাে অভিজ্ঞতাই ছিল না। উল্লেখ্য যে, সে-সময় ভাসানীকে ঘিরে রাখতেন, “young leftist leaders with intellectual pretensions” (প্রাগুক্ত)। 

 “প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাঁরই উপস্থিতিতে মওলানা ভাসানীর এমন বিরূপ সমালােচনায় খুবই ব্ৰিত এবং মর্মাহত হন। ঐ সভায় বসেই জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন যে, আমি পদত্যাগ করবাে। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকেই ভাসানী ও সােহরাওয়ার্দীর বিরােধ দানা বেঁধে উঠে। সে সময় এই দুই নেতার বিরােধের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একজন মাত্র নেতা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন যাতে সােহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীকে এক সঙ্গে রাখা যায়। যাতে করে এই দুই প্রতিভাবান ব্যক্তিকে পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত বঞ্চিত জনতার মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। সােহরাওয়ার্দী যে মুহূর্তে পদত্যাগের কথা উচ্চারণ 

  ১০৮ 

  করলেন, সেই মুহূর্তেই শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, স্যার আপনাকে আমরা ছাড়ব না, ছাড়তে পারি না” (১৯/৯৪)। সােহরাওয়ার্দী-ভাসানীর মনান্তরের “সুযােগ গ্রহণ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শ্ৰেণী। প্রধানমন্ত্রী থাকতে হলে মওলানা ভাসানী এবং তাঁর পক্ষীয় লােকদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। অপরদিকে মওলানা ভাসানীর কাছে বিভিন্ন সূত্র মারফত বার্তা পাঠানাে হয় যে, সােহরাওয়ার্দীর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করা হলে মওলানা ভাসানীর জনহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য বিপুল অর্থ সাহায্য করা হবে” (৮/২৮৩)। শেখ মুজিব কেমন জটিল পরিস্থিতির মাঝেও আপন অবস্থান এবং লক্ষ্য অবিচল রেখেছিলেন, তার উপলব্ধির জন্যই এসকল পার্শ্ব-প্রসঙ্গগুলি মনে রাখা দরকার। 

 শেখ মুজিব তখন প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় গণপরিষদের সদস্য। ‘এক ইউনিট’ ব্যবস্থার মূল প্রস্তাবক ছিলেন মুহম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী। কিন্তু ১৯৫৫ র ১০ আগস্ট গঠিত চৌধুরী মুহম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় তার স্থান হয়নি, অর্থাৎ গণ-পরিষদে আওয়ামী লীগ তখন বিরােধী দলে ছিল। ১৯৫৫ খ্রি. ২৫ আগস্ট গণ-পরিষদে প্রদত্ত প্রথম ভাষণেই মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট  প্রবর্তনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলে দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন : “Sir, they want to place the word “East Pakistan  instead of ‘East Bengal  The word Bengal has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted whether they accept it .the question of One Unit .can come into the constitution. Why do you want it to be taken up just now? What about the state language, Bengali? What about joint electorate? What about autonomy? The people of East Bengal will be prepared to consider One Unit with all these things. So I appeal allow the people to give their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebiscite. Let the people of the frontier say that they want One Unit Similarly in Sind  If you will force it upon us we will have to adopt unconstitutional means. You must proceed constitutionally” (১৭/৬৮)। 

 পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক আইন সভায় পয়লা অক্টোবর ১৯৫৬, ‘যুক্ত নির্বাচনী বিল’এর সমর্থনে প্রদত্ত নীতি নির্ধারণী’ ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন “the opposition move to press for separate electorates on the basis of the two nation theory, would drive the minorities to a position from where they could justifiably demand a separate homeland within Pakistan. He also 

  ১০৯ 

  regretted that the post of the head of the state in Pakistan researved for Muslims only .such a communal provision in the constitution might have repercussions in India, where parties like Hindu Mahasabha might ..demand reservation of the post of President of India for Hindus only. Such a movement would not be a happy one for the forty millions of Indian Muslims” (১৯/৯৩)। মূলত তার বক্তৃতার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে যুক্ত নির্বাচন বিলটি “গৃহীত হওয়ার মাধ্যমেই রাজনীতি থেকে পাকিস্তানের জন্মলগ্নের প্রােথিত মৌল ভাবধারা কিছুটা হলেও অন্তর্হিত হয়ে নতুন এক ভাবধারা প্রবর্তিত হয়”(প্রাগুক্ত)। উল্লেখ্য যে, প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় ১১ অক্টোবর যুক্ত-নির্বাচন বিল জাতীয় পরিষদে উত্থাপিত হয় এবং ১২ অক্টোবর তা গৃহীত হয়েছিল। 

 চৌধুরী মুহম্মদ আলীর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়, ১৯৫৬’র ফেব্রুয়ারি মাসে শাসনতন্ত্র বিল গণ-পরিষদে উত্থাপন করে ২৩ মার্চ সদস্যদের ভােটে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’এর প্রথম শাসনতন্ত্র ‘পাস করা হলাে। শাসনতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট প্রবর্তন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি না মানা এবং যুক্ত-নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন না করা ইত্যাদি বিবিধ কারণে অসন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ সেদিন গণ-পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেছিল। শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের দিনই গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দর মির্জা পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। “Fazlul Huq, who had cooperated with the power brokers in Pakistan was duly rewarded with the post of Governor of East Bengal .A big celebration was held in the Governor s house but the Awami League boycotted it” (১৭/৭০-৭১)। পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদে ৩ এপ্রিল, ১৯৫৭ স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন, “স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি। এই দাবির ভিত্তিতে আমরা গত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। গত ৯ বছরের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে বুঝা যাবে আমরা কেন স্বায়ত্তশাসন চাই। এই দাবি কেবল রাজনৈতিক নয়, এ আমাদের বাঁচা-মরার দাবি”(২১/২৯)। সেদিনই ব্যবস্থাপক পরিষদে স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি গৃহীত হয়েছিল। 

 আতাউর রহমানের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় মােটামুটি দেড় বছর দায়িত্ব পালনের পর, দলীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব সাংগঠনিক কার্যক্রমে পূর্ণ-সময় নিয়ােজিত থাকার প্রয়ােজন বােধ করে স্বেচ্ছায় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু মুজিবের সিদ্ধান্তকে মুখ্যমন্ত্রী এবং দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান পছন্দ করেননি। আবুল মনসুর আহমদের পর্যবেক্ষণ : পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ 

  ১১০ 

  সরকারের বিবিধ সাফল্য এবং “সর্বাঙ্গীন সদাচারের মধ্যে চাঁদের কলঙ্কের মতই ছিল আতাউর রহমান-মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত বিরােধ। এই বিরােধের সবটুকুই ব্যক্তিগত ছিল না, অনেকখানিই ছিল নীতিগত। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয় নষ্ট করিয়া দেওয়ার জন্য অনেকেই দায়ী ছিলেন। কিন্তু সবার চেয়ে বেশি ও আশু দায়ী ছিল মুজিবুর রহমানের একগুঁয়েমি। যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গিয়া দেওয়ার মূলেও ছিল মুজিবুর রহমানের কার্যকলাপ। মুজিবুর রহমানের নিজের কথা ছিল পাঁচমিশালী আদর্শহীন ম্যারেজ-অব-কনভিনিয়েন্স’ যুক্তফ্রন্ট ভাংগিয়া আওয়ামী লীগকে প্রকৃত গণ-প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাঁচাইয়া তিনি ভালই করিয়াছেন। পক্ষান্তরে অনেকের মত, আমার নিজেরও, যুক্তফ্রন্ট ভাংগিয়া তিনি পূর্ব-বাংলার বিপুল ক্ষতি করিয়াছেন। যুক্তফ্রন্ট ভাংগা যদি দোষের হইয়া থাকে তবে সে দোষের জন্য মুজিবুর রহমানই প্রধান দায়ী। যদি প্রশংসার কাজ হইয়া থাকে তবে সমস্ত প্রশংসা মুজিবুর রহমানের। তবু এর বিচারের জন্য ইতিহাসের রায়ের অপেক্ষা করিতে হইবে” (৪/৫৪৩-৫৪৪)। ইতিহাসের রায় অবশ্যই মুজিবের পক্ষে গেছে, বঙ্গবন্ধু মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। 

 উল্লেখ্য যে, ১৯৫৪ খ্রি. যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন পর্যায়েই বিরূপ সমালােচনার মুখে পড়েছেন। কারণ, তখন তিনি দ্রুতই অনেককে পেরিয়ে রাজনীতির মূল-মঞ্চে উঠে আসছিলেন এবং তার পরিচয় দাঁড়িয়েছিল একাধারেই সংগঠক এবং নীতি-নির্ধারকের। এস. এ. করিমের প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ : “Mujib s prestige within the Awami League improved considerably because of his decision to quit the Cabinet in late May (1957) in order to continue to function as the General Secretary of the party . Chief Minister Ataur Rahman Khan was apparently not pleased with this decision of Mujib, which boosted his profile as the only Awami Leaguer in the Cabinet to to put the interest of the party above all other considerations” (১৭/৮০-৮১)। 

 এক বছর পরেই, ১৯৫৮ র আওয়ামী লীগ সম্মেলনেই আতাউর-মুজিব বিরােধটা প্রকাশ্য আলােচনায় উঠে এসেছিল। সাধারণ সম্পাদক মুজিব বলেছিলেন, প্রাদেশিক সরকার দল এবং জনগণের প্রত্যাশা মিটাতে পারছে না। ক্ষমতাসীন সরকার অতিমাত্রায় আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, মফস্বল এলাকার পার্টিকর্মীরা হতাশ হচ্ছে। আগামী নির্বাচনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হবে। অপরদিকে আতাউর রহমান বলেছিলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে সরকার চালাতে অসুবিধা ঘটছে। দলের প্রতি মুজিব অতিসংবেদনশীল হয়ে পড়েছেন। “Mujib resented the remarks and tendered his 

  resignation as the AL General Secretary. But he was persuaded by the party leaders to withdraw his letter of resignation” (১৭/৮৬-৮৭) 

 সােহরাওয়ার্দী বিশ্বাস করতেন, “So long as there was an ongoing confrontation with India over Kashmir, Pakistan could not efford the luxury of following a non-aligned course internationally” (১৭/৭৬)। কিন্তু নীতিগতভাবে আওয়ামী লীগ ছিল জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির প্রতি আস্থাশীল। আবু জাফর শামসুদ্দিনের একটি মন্তব্য লক্ষণীয়, “আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে সকল প্রকার সামরিক জোটের বিরােধী ছিল। ১৯৫৩, ১৯৫৫ এবং ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সভায় সামরিক জোটভুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে যথারীতি প্রস্তাব গৃহীত হয়” (৮/২৮১)। মনে রাখা দরকার, সােহরাওয়ার্দীর কোনােরকম ক্ষমতা অর্জনের পূর্বেই পাকিস্তান বিভিন্ন যুদ্ধজোটের শরিক হয়েছিল। “দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সামরিক জোটে (সিয়াটো) পাকিস্তান যােগ দিয়েছিল ১৯৫৪ সনের ৮ সেপ্টেম্বর, বাগদাদ চুক্তিতে সই করেছিল ১৯৫৫সনের ২৩ সেপ্টেম্বর। ঐ যুদ্ধজোটে পাকিস্তানের যােগদান কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল। মুসলিম লীগ শাসকগােষ্ঠী বরাবরই সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা ছিল। পাকিস্তান প্রথম। থেকেই ধনবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সহিত বন্ধুত্বের নীতি এবং ভারতের বিরুদ্ধে ‘শক্তিশালী মিত্র’ লাভের জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে দহরম-মহরম শুরু করে” (২০/১৩৮)। তথাপি সােহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর সমালােচনা কখনাে থামেনি। 

 আবু জাফর শামসুদ্দিন লিখেছেন, “পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীরূপে শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহেব প্রথম ঢাকায় আসেন ১৯৫৬সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে। পল্টন মাঠে। এক বিরাট জনসভার আয়ােজন করা হয়। সভাপতি মওলানা ভাসানী। প্রধান বক্তা শহীদ সােহরাওয়ার্দী। সভাপতির বক্তৃতায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেট পূরণ না করলে সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভাকে লাথি মেরে বিতারিত। করা হবে। সােহরাওয়ার্দী সাহেব তখন একই মঞ্চে পাশাপাশি বসা। অশালীন উক্তি আমার ভালাে লাগেনি। দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কাবােধ করেছিলাম। সােহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের আনুগত্য ছিল সন্দেহাতীত। দলে শেখ মুজিবুর রহমানের রিক্রুটদের সংখ্যাধিক্য হয়তাে ছিল। কিন্তু মওলানা ভাসানীর প্রতি অনুগত কর্মীদের সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। শেষােক্তদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী লােকজনও ছিলেন” (৫/২৮২)। প্রকাশ্য জনসভায় স্ব-দলীয় প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করে মওলানা ভাসানী কোন মহৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিলেন কিংবা পেরেছিলেন, এটা যথার্থই। রাজনৈতিক গবেষণার বিষয় হতে পারে। 

  কাগমারী আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি সম্মেলন : 

 ন্যাপের জন্ম এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির দ্বৈরথ 

  ১৯৫৬সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী স্থির করেন যে, ফেব্রুয়ারি মাসে কাগমারীতে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন আহ্বান করবেন। তার আগেই তিনি নির্ধারণ করেছিলেন, আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ১৯৫৭ র ফেব্রুয়ারি মাসের ৭-৮ তারিখে, টাঙ্গাইলের সন্তোষের কাছে অবস্থিত কাগমারী গ্রামে। তদনুসারে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পরেই ৮ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি সারা রাতব্যাপী সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রায় যােগাযােগ-বিচ্ছিন্ন একটি গ্রামে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী সাহিত্যিক-শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীদের অংশগ্রহণের ফলে আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি সকলের সপ্রশংস মনােযােগ আকর্ষণ করেছিল। তবে অনস্বীকার্য যে, কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন পূর্ব বাংলার বিকাশমান জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক শিবিরে অনিবার্য বিভাজনের সূচনা করেছিল। 

 মওলানা ভাসানীর একান্ত নিজস্ব চিন্তাতেই কাগমারীতে সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। আবু জাফর শামসুদ্দিন তাঁর ‘আত্ম-স্মৃতি  (১ম খণ্ড) গ্রন্থে কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনের প্রায় অনুপুঙ্খ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। “১৯৫৬ সালের শেষের দিকে কোনাে একদিন আমরা কিছু লােক ইয়ার মােহাম্মদ খানের বাড়িতে  মওলানা সাহেব একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন করার প্রস্তাব দিলেন। তিনি নিজেই আমাকে আহ্বায়ক করে একটি প্রস্তুতি কমিটি করে দেন। কমিটিতে অন্য সদস্যরা ছিলেন (১) কাজী মােহাম্মদ ইদরিস (২) খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস (৩) খায়রুল কবির (৪) ফকীর শাহাবুদ্দিন আহমদ (৫) ইয়ার। মােহাম্মদ খান এবং (৬) সদরি ইস্পাহানি। শেষােক্ত দু’জনকে করা হয় যুগ্ম। ট্রেজারার। আমরা মওলানা সাহেবকে কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্যে অনুরােধ। জানালে তিনি রাজি হন। মওলানা সাহেব সম্মেলনকে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পরিণত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন” (৮/২৮৭-২৮৮)। 

  পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানী সর্বতভাবেই সুপরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদরকে এমনকি দলীয় অফিসটিকেও দূরে রেখেই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। “বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে যখন প্রবল মতবিরােধ চলছে, তখন উভয় পক্ষ চরম মীমাংসার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। ইতিপূর্বেই সােহরাওয়ার্দী সাহেব প্রদত্ত টাকায়  তােফাজ্জল হােসেনের সম্পাদনায় দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাক মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে। এসময় মুসলিম লীগার অ্যাডভােকেট তােফাজ্জল আলীর ছােট ভাই ইসকান্দর আলী ঢাকা হতে দৈনিক ইত্তেহাদ’ পুনরায় প্রকাশ শুরু করেন। কাজী মােহাম্মদ ইদরিস সম্পাদক নিযুক্ত হন।  ইত্তেহাদ’ মওলানা ভাসানীকে সমর্থন করতাে” (৮/২৮৩-২৮৪)। ইত্তেহাদ’ অফিসেই সাংস্কৃতিক সম্মেলনের প্রাথমিক অস্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। 

 “সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইল হতে কাগমারী পর্যন্ত অনেকগুলাে সংবর্ধনা তােরণ নির্মিত হয়। মওলানা মােহম্মদ আলী তােরণ, মহাত্মা গান্ধী সুভাষ বসু , চিত্তরঞ্জন দাশ , মওলানা শওকত আলী , সূর্যসেন , সিরাজদ্দৌলা , ক্ষুদিরাম , বিধান রায় .নামের তােরণগুলাের কথা এখনাে মনে পড়ে। মওলানা। আজাদ তােরণও সম্ভবত তৈরি হয়েছিল” (৮/২৯২)। তবে “Visitors coming to Kagmari could not have failed to notice that the first ceremonial gate was named after President Iskander Mirza who, as Governor of East Bengal in 1954, had publicly threatened to shoot Bhasani,  The man in charge of the Finance Committee was Sadri Ispahani, an industrialist friend of Iskander Mirza As an extremely crafty political operator, he (Mirza) could resort to any device to cause an internecine strife within the Awami League  Iskader Mirza s ultimate target was Suhrawardy” (১৭/৭৮)। 

 কাগমারী সম্মেলনের বিপুল ব্যয়ের বিভিন্ন উৎস সম্পর্কে আবু জাফর শামসুদ্দিন উল্লেখ করেছেন:“তিন দিনব্যাপী সম্মেলনে যােগদানকারী সকলের জন্যে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা মওলানা সাহেব নিজেই করেছিলেন। তাঁর মুরিদান এবং ভক্তগণ গরু খাসি চাল ডাল মরিচ মসলা নিয়ে এসেছিলেন। ইয়ার মােহাম্মদের কাছে। শুনেছি, সােহরাওয়ার্দী সাহেবের কেন্দ্রীয় সরকার কাগমারী সম্মেলনের জন্যে নাকি ৫০,০০০ টাকা দিয়েছিলেন। আতাউর রহমান তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। টাকাটা নাকি তাঁর কাছে এসেছিল। প্রস্তুতি কমিটির কাছে সে টাকা আসেনি। যুগ্ম ট্রেজারার সদরি ইস্পাহানি এবং ইয়ার মােহাম্মদ খান সে টাকা পেয়েছিলেন কিনা অথবা সে টাকা প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা নিজেরাই সম্মেলনের জন্য ব্যয় করেছিলেন 

  ১১৪ 

  নাকি মওলানা সাহেবকে দেওয়া হয়েছিল কিছুই অবগত ছিলাম না। সদরি। ইস্পাহানি ৫০০০ টাকা ব্যক্তিগত চাঁদা দিয়েছিলেন খায়রুল কবির পরে আমাকে জানিয়েছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট ইসকান্দর মির্জা নাকি সম্মেলনের জন্য মওলানা সাহেবকে আলাদাভাবে ২৫০০০ টাকা পাঠিয়েছিলেন। আমার ধারণা, টাকাটা সদরি ইস্পাহানির মারফত এসে থাকবে। আমার কাছে যে দশ হাজার টাকা মওলানা সাহেব জমা রেখেছিলেন, সেটিও নাকি সদরি ইস্পাহানি দিয়েছিলেন” (৮/২৯২-২৯৩)। 

 উদ্যোগে-সফলতায় যথার্থই বিরাট কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে অব্যবহিত পূর্বগামী আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনের ওপর একটা প্রবল মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, এ-সত্য অনস্বীকার্য। অধিকতর বাড়তি চাপ সৃষ্টির জন্যই মাত্র একমাস আগে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে “the left-wing elements both inside and outside the Awami League had organized a youth festival at Rangpur to rally support for a movement against the  imperialist pacts . But if Bhashani and his leftist adhearents had hoped that they would carry the day at the Kagmari conference, they were bitterly disappointed by the outcome” (১৭/৭৭)। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের “ভাড়াটে লােকজন আওয়ামী লীগ কাউন্সিলারদের ভিতর সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার প্রতিক্রিয়াশীল বিদেশনীতির পক্ষে নানাভাবে প্রচার চালিয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোটে পাকিস্তানের যােগদানকে যুক্তিসঙ্গত বলে জাহির করার জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন ইনফরমেশন সার্ভিস সােভিয়েত-বিরােধী কুৎসাপূর্ণ কয়েকটি চলচ্চিত্র কাগমারীতে প্রকাশ্যে প্রদর্শনের আয়ােজনও করেছিল” (২০/১৬২)। অর্থাৎ দৃশ্যতই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রবল বাম-ডান চাপের মধ্যেই আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 

 কাগমারীতে ৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় প্রায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পরের দিন কাউন্সিল সভার প্ল্যানারি সেসন’এ বিতর্কিত বৈদেশিক চুক্তিগুলির বিষয় আলােচনায় তােলা হবে না। অথচ কাউন্সিল-সভার উদ্বোধনী অধিবেশনেই “Bhashani denounced the pacts and warned that if the central government failed to ensure autonomy to the eastern wing East Pakistan would be obliged to say Assalamu Alaikum .” “good-bye  to Pakistan. Rhetoric aside, Bhashani took no steps to raise formally the issue of Pakistan s membership of the military pacts (১৭/৭৭)। প্রদেশে এবং কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সরকারের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা সম্পর্কে ভাসানী অবহিত ছিলেন বলেই হয়তাে আওয়ামী লীগের মূল-ধারা থেকে 

  ১১৫ 

  বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সরাসরি ঝুঁকি তিনি নিতে চাননি। স্মরণযােগ্য যে, কাগমারীতে (১৯৫৭) পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ‘আস্ সালামু আলায়কুম’ বললেও ১৯৬৩ সালে। সেনা-শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত জনগণকে তিনিই বলেছিলেন, “ডােন্ট ডিস্টার্ব আয়ুব’। 

 খােকা রায় লিখেছেন, কাউন্সিল বৈঠকে “মওলানা ভাসানী বিদেশ নীতি সম্পর্কে কোন প্রস্তাব বা বক্তব্য পেশ করেন নাই। বৈঠকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের বিদেশ নীতির পক্ষে বা বিপক্ষে কোন সিদ্ধান্ত হয় নাই”(২০/১৬৩)। তবে কাউন্সিল বৈঠকে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়েই প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর প্রতি নির্দেশ করে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সমবেত প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনারা যারা দলের মেরুদণ্ড, গরিবের রক্ত জল করে যারা দল গড়েছেন, তারা বড় না এই ভদ্রলােকটি বড়? আপনারা শহীদকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তাই শহীদ আজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আপনারা পেছন থেকে সরে গেলে এ ভদ্রলােককেও সরে যেতে হবে। তাই আপনাদের নির্দেশ, পার্টির সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে মানতেই হবে”(১৯/৯৫)। অর্থাৎ বিদেশ-নীতি সংক্রান্ত কোনাে প্রস্তাব না তুললেও দলীয় নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্বের বিষয়টাকে ভাসানী প্রকটভাবেই সামনে এনেছিলেন। 

 কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে পাকিস্তান, ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশেরই জ্ঞানী-গুণী-সংস্কৃতিজনেরা এসেছিলেন। অথচ সম্মেলনের পরেই, করাচির ‘ডন’ এবং ঢাকার ‘আজাদ  পত্রিকায় “মওলানা ভাসানী এবং সম্মেলনের বিরুদ্ধে দ্বিখণ্ডিত বাংলাকে যুক্ত বাংলা করার অভিযােগ উত্থাপিত হলাে সােহরাওয়ার্দী সাহেব করাচি ফিরে ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে এক সুদীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযােগ খণ্ডন করলেন। দৈনিক ‘ইত্তেহাদ  পত্রিকায় ১৯৫৭সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি পূর্ণ বিবৃতিটি ছাপা হয়” (৮/২৯৬)। সােহরাওয়ার্দীর মূল কথাটি ছিল “মওলানা ভাসানী কখনই পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার হুমকি প্রদান করেন নাই”। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, বারবার স্থূলভাবেই রাজনৈতিক কটাক্ষ-অপমানের শিকার হলেও সােহরাওয়ার্দী কখনাে ভাসানীর প্রতি রাজনৈতিক দায়িত্ব এবং সৌজন্য-শােভনতা এড়িয়ে যাননি। 

 কাগমারী সম্মেলনের আহ্বায়ক আবু জাফর শামসুদ্দিন অনেক বছর পরে একটি তাৎপর্যবহ মন্তব্য করেছিলেন, “সম্মেলন শেষ হওয়ার পর বিষয়টা নিয়ে ভেবেছি। নানা সূত্র থেকে অনেক তথ্য কানে এসেছে। সম্মেলন পরবর্তী ঘটনাবলীও দেখেছি। আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ভাসানী সােহরাওয়ার্দী উভয় গ্রুপের মধ্যে শত্রুপক্ষের এজেন্ট ছিল। ওরা ডবল এজেন্টের কাজ করেছিল। অবশ্য কিছু কিছু সৎ অতি-উৎসাহী কর্মীও ছিলেন। যারা কোন সময় কতটা অগ্রসর হওয়া উচিত তদ্বিষয়ে সজাগ ছিলেন না” (৮/২৯৭)। কাগমারী সম্মেলনের ব্যর্থতা’ ভাসানীকে 

  ১১৬ 

  যথার্থই ত্যক্ত-বিরক্ত করেছিল, উপলব্ধি করেই মুজিব ভেবেছিলেন, ভাসানী এমন কিছু করে বা বলে ফেলতে পারেন, যাতে পরিণামে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনকি আসন্ন ২১শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিও বিঘ্নিত হতে পারে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুজিব ১৬ ফেব্রুয়ারি ভাসানীর সাথে সাক্ষাৎ করতে তাঁর সন্তোষের বাড়িতে গিয়ে, হুজুর সম্বােধন করে বিস্তারিত আলােচনা করেন। কিন্তু বিশেষ সুফল মেলেনি। 

 শহীদ দিবসের (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৮) পরেই অলি আহাদ তৎপর হয়ে ভাসানীকে বুঝাতে পেরেছিকেন যে, “It was Mujib s control of the party apparatus as General Secretary that was largely to blame for the rout of the Bhashani camp at Kagmari. Once Mujib was removed from his position as General Secretary, the Bhashani faction would be able to regain the initiative and fight with renewed strength for their objectives” (১৭/৭৯)। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের বিধান ছিল, এক সাথে দলের নির্বাহী কমিটি এবং মন্ত্রিসভার সদস্য থাকা যাবে না। কিন্তু আতাউর রহমান এবং শেখ মুজিবসহ অনেকেই উভয় পদে নিয়ােজিত ছিলেন। অলি আহাদ নিঃসংশয় ছিলেন, এবিষয়ে প্রশ্ন তুললে মুজিব সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়েই মন্ত্রিত্ব করবেন। সেই পদটি তখন সহজেই অলি আহাদ পেয়ে যাবেন। ভাসানীকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে অলি আহাদ ৬-১৭মার্চ,১৯৫৭, দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলীয় সভা করে ফিরে এসেই জানলেন যে, ভাসানী ইতােমধ্যে দলীয় সভাপতি হিসেবে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

 কাগমারী সম্মেলনের পরে “আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার প্রতিও মওলানা সাহেব বিরূপ হইয়া উঠেন। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তিনি প্রকাশ্যভাবে বলিতেন যে, আতাউর রহমান মন্ত্রিসভা ২১-দফার খেলাফ কাজ করিতেছেন। কথাটা সত্য ছিল না। মওলানা সাহেব স্বভাবতই সরকার-বিরােধী মনােভাবের লােক বলিয়া মাত্রাছাড়াভাবে তিনি নিজের দলের সরকারের নিন্দা করিতেন। তাতে আতাউর রহমান সাহেব ত অসন্তুষ্ট হইতেনই শহীদ সাহেবও হইতেন। এই বিরােধে ইন্ধন যােগাইবার লােকেরও অভাব ছিল না” (৪/৪৮৭-৪৮৮)। 

 আওয়ামী লীগে চূড়ান্ত বিভেদ-ভাঙ্গন সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট মির্জা কোনাে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছাড়াই মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু “শহীদ সাহেবকে দিয়া মওলানাকে আক্রমণ করাইতে পারিলেন না। কাজেই তিনি (মির্জা) মওলানাকে দিয়া শহীদ সাহেবকে আক্রমণ করাইবার আয়ােজন করিলেন। হঠাৎ মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে ইস্তফা দিলেন। মওলানা সাহেবের ঘনিষ্ঠ বলিয়া পরিচিত দুইজন আওয়ামী-নেতা একজন পূর্ব-পাকিস্তানি শিল্পপতিসহ ইতােমধ্যে #সিডেন্টের (সভাপতি, মওলানা ভাসানী) সাথে দেখা করিয়া গিয়াছেন। মওলানা 

  ১১৭ 

  সাহব মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াই ফেলিয়াছিলেন যে, হয় তিনি সােহরাওয়ার্দী-হীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব করিবেন, নয় ত তিনি আলাদা পার্টি করিবেন। এটা আমি বুঝিতে পারি হাসপাতালে তাঁর (ভাসানী) সাথে আলাপ করিয়া” (৪/৪৯০-৪৯১)। 

 মওলানা ভাসানী “পদত্যাগের ঘােষণাটি করিয়াছিলেন নজিরবিহীন গােপনীয়তার সাথে। আতাউর রহমান-মুজিবুর রহমান কাউকে না দেখাইয়া বামপন্থী খবরের কাগজে ( সংবাদ’ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীর কাছে) পৌঁছাইয়া দিবার ওয়াদা করাইয়া তিনি উহা মি. অলি আহাদের হাতে দেন। মি. অলি আহাদ সরল বিশ্বস্ততার সাথে অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেন। একাজে তিনি মওলানা সাহেবের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য দেখাইয়া থাকিলেও প্রাতিষ্ঠানিক আনুগত্য ভঙ্গ করিয়াছেন,.. মওলানা সাহব তখন হাসপাতালে। আমিও। প্রধানত আমারই প্রস্তাবে মওলানা সাহেবকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিতে অনুরােধ করিয়া (ওয়ার্কিং ও পার্লামেন্টারি কমিটির যৌথ বৈঠকে) সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কখনাে আমি ও মুজিবুর রহমান একত্রে, কখনাে আমি একা মওলানা সাহেবকে ইস্তফা প্রত্যাহারের অনুরােধ-উপরােধ করি। কিন্তু মওলানা অটল। যা হয় কাউন্সিল মিটিংএ হইবে, এই তাঁর শেষ কথা” (৪/৪৯১-৪৯২)। 

 “কাউন্সিল মিটিং-এ তিনি (ভাসানী) জয়লাভ করিবেন, এটা তিনি আশা করিলেও নিশ্চিত ছিলেন না। সেজন্য আগেই তিনি মিয়া ইফতিখারুদ্দিন ও জি এম সৈয়দ প্রভৃতি পশ্চিম পাকিস্তানি বামপন্থী নেতৃবৃন্দ ও শহীদ সাহেব কর্তৃক বিতাড়িত সাবেক আওয়ামী লীগ (নিখিল পাকিস্তান) সেক্রেটারি মি. মাহমুদুল হক ওসমানীর সাথে গােপন পরামর্শ করিতে থাকেন। একদিন হাসপাতালে ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম, ইতােমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা মওলানা সাহেবের সাথে পরামর্শ করিয়া গিয়াছেন। এটা চলে পর-পর কয়দিন” (৪/৪৯২)। “At this special conference, held in Dhaka in mid-June (13-14h) 1957, both Suhrwardy and Bhashani spoke at length about their ideas on foreign policy. The conference approved Suhrwardy s foreign policy by an overwhelming majority.This did not satisfy Bhashani and he insisted upon another vote. This time Surhwardy won by a much greater margin of votes : 800 to 35”(17/80) 

 তারপরেও “কাউন্সিল মওলানাকে ইস্তফা প্রত্যাহারের অনুরােধ করেন। মওলানা তদুত্তরে ন্যাপ গঠন করেন। ন্যাপ গঠনে প্রেসিডেন্ট মির্জার হাত ছিল, এতে আমার কোনও সন্দেহ নাই” (৪/৪৯২)। ভাসানী অনুগত অলি আহাদও পরবর্তী সময়ে মন্তব্য করেছেন, “Around that time he was so full of rage against Suhrwardy that it blotted out all reason and he succumbed to an amorous 

  ১১৮ 

  embrace with Iskander Mirza. And because of this he did not hesitate to take one disastrous step after another. This is how the split in the Awami League was brought about” (১৭/৭৮-৭৯)। বিভক্ত দলটির মূল-ধারা রইলাে আওয়ামী লীগ নামেই আর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বিচ্ছিন্ন অংশটি সংগঠিত হলাে ‘ন্যাপ’ (National Awami Party) নামে। ইতিহাসের ধারাপথ বেয়ে আওয়ামী লীগ এখনাে এ দেশের মূলধারার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি আর ক্রমাগত বিভক্তি-বিচ্ছিন্নতায় ‘ন্যাপ’ কার্যত হারিয়েই গেছে। আওয়ামী লীগের ভিতরে “মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ছিলেন সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যাদর্শে বিশ্বাসী কিছু যুবকর্মী। অবশ্য ভণ্ড সমাজতন্ত্রীদেরও অনেকে স্থান করে নিয়েছিলেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন ব্রিটিশ-টাইপ পুঁজিবাদী পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।  আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির উদ্ভবের মধ্যে ছদ্মবেশী মােনাফেকদেরও বড় রকমের ভূমিকা ছিল। মত ও পথের মেরুকরণ ১৯৪৮সালেই শুরু হয়” (৮/২৯৭-২৯৮)। বামপন্থী রাজনীতির দোহাই দিয়ে গঠিত ‘ন্যাপ’ (জুন, ১৯৫৭) এক বছর পরেই ডানপন্থীদের সাথে মিলে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটায়। প্রকৃতপক্ষে এটাই ছিল আওয়ামী লীগ ভাঙ্গনের পরােক্ষ কুশলী আর প্রত্যক্ষ কুশিলবদের প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্য। 

 “১৯৫৮সনের জুন মাসে কে.এস.পি. নেতা আবু হােসেন সরকার পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে এক অনাস্থা প্রস্তাবের নােটিশ দিয়েছিলেন। সেই সময় ঢাকাতে মওলানা ভাসানী, খান আব্দুল গফফার খান, জি.এম. সৈয়দ প্রমুখদের উপস্থিতিতে ন্যাপের বৈঠক হতে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ভােট দেওয়ার জন্য আইন সভার ন্যাপ সদস্যদের প্রতি এক নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। কেএসপি, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ জোট এবং তার সাথে আইনসভার ন্যাপ সদস্যদের ভােটে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়েছিল। ইস্কান্দর মির্জার চক্রান্তে (পূর্ব বাংলায়) আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটেছিল। ১৯৫৮ সালের ১৯শে জুন পূর্ব পাকিস্তানে আবার গণ-বিরােধী আবু হােসেন সরকার মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় বসেছিল” (২০/১৬৮)। উল্লেখ্য যে অনাস্থা প্রস্তাবের ভােটাভুটিতে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার পক্ষে ছিল ১২৪টি ভােট আর বিপক্ষে ১৩৬টি, অর্থাৎ ১২টি ভােটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটেছিল। 

 গােপনে পরিচালিত ক্যুনিস্ট পার্টি তখনই উপলব্ধি করেছিল যে, আওয়ামীরাজনীতির কিছু নেতিবাচকতা থাকা সত্ত্বেও ইতিবাচক অবদান অনস্বীকার্য। “আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী শাসন-প্রতিষ্ঠা ও নির্বাচন বানচাল করার জন্য (উদ্যোগী) প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জার চক্রান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে, ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রসার করেছিল এবং সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের পক্ষে 

  ১১৯ 

  দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল। আওয়ামী লীগ বস্তুনিষ্ঠভাবে জনস্বার্থের অনুকূল ছিল। কমুনিস্ট পার্টি তখন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা কায়েম থাকা একান্ত প্রয়ােজন বলে মনে করেছিল। তাই মন্ত্রিসভার পতনের পরেই কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের সাথে এক বৈঠকে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সে সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর ২১জুন তারিখে প্রাদেশিক আইনসভায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আবু হােসেন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে এক অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে প্রাদেশিক আইনসভার ২১/২২জন কমুনিস্ট সদস্যদের ভােটেই আবু হােসেন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে পাল্লাটা ভারী হয়ে গিয়েছিল। আবার আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা কায়েম হয়েছিল”(২০/১৬৯-১৭০)। অর্থাৎ মাত্র দু দিনের মাথায় কেএসপি-ন্যাপমুসলিম লীগ-নেজামে ইসলামীর ষড়যন্ত্রের উদ্যোগটা বুমেরাং হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, এবার শেরে বাংলাকেও রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছিল। কেএসপি’র উদ্যোগে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটার সঙ্গেসঙ্গেই ক্ষুব্ধ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নুনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের চাপ প্রয়ােগ করায়, নুন পূর্ব বাংলার গভর্নর পদ থেকে ফজলুল হককে সরিয়ে হামিদ আলীকে গভর্নর বানিয়েছিলেন। 

 আওয়ামী লীগ-ন্যাপ বিভাজন সম্পর্কে কেউ বলেন, এটা ছিল ভিন্নমুখী রাজনৈতিক আদর্শের সংঘাত, আর কেউ এজন্য দায়ী করেন মুজিবকেই। যদিও “Mujib had always kept his line of communication open with Maulana Bhashani, for whom he had considerable respect.  Mujib felt that Bhashani s heart was in the right place, on the side of the oppressed peasantry and workers, and if he occasionally slipped into a wrong track, it was mostly due to the counsel from his young advisers. Mujib called them ‘Theoriticians  Mujib s initiative paid off. In mid-September not only Bhashani, on be half of NAP, but Mahmud Ali of the leftist Ganatantri Dal, announced that they were in accord with the Awami League on all basic issues” (১৭/৮৮)। 

  ১২০ 

  পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে-গােলযােগে নিহত ডেপুটি স্পিকার : 

 পাকিস্তানে সেনা-শাসনের উদ্যোগ-পর্ব 

  পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের হট্টগােল-গােলযােগে আহত (২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮)। ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর মৃত্যুর ঘটনাটিকেই পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির প্রধান অজুহাত হিসেবে কাজে লাগানাে হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ তখন পূর্ব বাংলায় ক্ষমতাসীন দল। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ-বিরােধী উদ্যোগে ঘটনাটি যারা সংঘটিত করেছিলেন, তাঁরাই একে আওয়ামী লীগ এবং মুজিব-বিরােধী অপপ্রচারের অজুহাত হিসেবে কাজে লাগিয়েছিলেন। 

 “১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছিল। আইনসভার সে অধিবেশনকে বানচাল করার জন্য ইস্কান্দর মির্জার। সমর্থনপুষ্ট কে.এস.পি ও মুসলিম লীগ দল আইনসভার ভিতরেই মারপিট ও হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দিয়েছিল। ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী গুরুতররূপে আহত। হয়েছিলেন। তিনি হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন। ইস্কান্দরী চক্রান্তে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা আবার জটিল আকার ধারণ করেছিল” (২০/১৭১)। পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা এবং কেন্দ্রীয় জোট সরকার থেকে আওয়ামী লীগ দলভুক্ত মন্ত্রীদের পদত্যাগের বিষয় দু’টিকে কাজে লাগিয়েই পাকিস্তানে প্রথম সামরিক শাসন-১৯৫৮  জারি করা হয়েছিল। এ দু’টি। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ বর্তমান আলােচনায় অপ্রাসঙ্গিক। তবে, হক-ভাসানীসােহরাওয়ার্দী-মুজিব’ সংশ্লিষ্ট ইতিহাসের তথ্য এবং সেনা-আমলা-চক্র প্রভাবিত ষড়যন্ত্রের রাজনীতি উপলব্ধির জন্যই সংক্ষেপে কিছু উল্লেখ করা যেতে পারে। আলােচ্য ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ইস্কান্দর মির্জা আর সহযােগী ছিলেন বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে রাজনীতির ভেতরের এবং বাইরের অনেকেই। 

 ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৫৮ স্পিকার আব্দুল হাকিম স্বাভাবিকভাবেই পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই “সভাকক্ষে তুমুল হৈ চৈ 

  ১২১ 

  শুরু হলাে। প্রবল উত্তেজনাকর মুহূর্তে দেওয়ান মাহাবুব আলী (ন্যাপ) অকস্মাৎ স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তুললেন। একদল ক্রুদ্ধ সদস্য স্পিকারের আসনের দিকে ধাবিত হলেন। তারা বললেন,  তাঁকে এই মুহূর্তে চলে যেতে হবে। আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান এবং ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীসহ। অনেক সদস্য স্পিকারকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন।  বিশৃঙ্খল অবস্থা আয়ত্তে আনতে না পেরে স্পিকার .সভাকক্ষ ছেড়ে চলে গেলেন।  ডেপুটি স্পিকার (শাহেদ আলী)  অধিবেশন মুলতবি ঘােষণা করলেন।  ২৩শে সেপ্টেম্বর পার্লামেন্ট হাউসে রাইফেলস্ ও পুলিশের কড়া প্রহরা বসানাে হয়। বেলা তিনটায় অধিবেশন শুরু হলে ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলী আসন গ্রহণ করেন। সরকারি দল আওয়ামী লীগ তাকে স্বাগত জানায়। বিরােধী দলের সদস্যরা কেএসপি’র প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার উত্তেজিতভাবে চিৎকার করে এ সময় বলেন, আপনি যদি এই মুহূর্তে বেরিয়ে না যান তবে আমরা আপনাকে খুন করে ফেলব। আপনার বিবি ও বাচ্চারা এবং আপনার সারা পরিবার ধংস হয়ে যাবে। কিন্তু শাহেদ আলী বিচলিত হলেন না। পরিষদে হাঙ্গামা বেঁধে গেল। হঠাৎ সবেগে নিক্ষিপ্ত কোন বস্তু তাঁকে আঘাত করলাে। তার ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হলাে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে স্পিকারের আসনে লুটিয়ে পড়লেন”(১৯/১০১-১০২)। 

 ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন : ২৩ সেপ্টেম্বর “ডেপুটি স্পিকারের সভাপতিত্বে হাউস শুরু হইল। মানে অপজিশন দলের হট্টগােল শুরু হইল। শুধু মৌখিক নয়, কায়িক।  অপজিশনের কেউ কেউ মঞ্চের দিকে ছুটিলেন। তাঁদেরে বাধা দিতে আমাদের পক্ষেরও স্বাস্থ্যবান শক্তিশালী দু-চারজন আগ বাড়িলেন। বসিয়া-বসিয়া এই মারাত্মক খেলা দেখিতে লাগিলাম। আমার হাতে রিভলভার থাকিলে আমি নিজের আসনে বসিয়া আক্রমণকারীদেরে গুলি করিয়া মারিতে পারিতাম। দেহরক্ষীরা চেয়ারের উপর চেয়ার খাড়া করিয়া ডেপুটি স্পিকারের সামনে প্রাচীর খাড়া করিয়া ফেলিয়াছিলেন। সে প্রাচীরটা ভেদ করিয়া হামলাকারীদের পাটকেল ডেপুটি স্পিকারের মাথায়-নাকে-মুখে লাগিতেছিল। পরের দিন (মতান্তরে, তিন দিন পরে) হাসপাতালে তিনি মারা যান। এই হত্যাকাণ্ডের আদালতী বিচার হয় নাই। আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করিতে গিয়া শাহেদ আলী নিহত হইল অপজিশনের ঢিল-পাটকেলে। অথচ পূর্ব বাংলার দুশমনরা তখনও বলিলেন এবং আজও বলেন ও আওয়ামী লীগই শাহেদ আলীকে হত্যা করিয়াছে। কোন্ পাপে এই মিথ্যা তহমত! (৪/৫৫৬-৫৫৮)। 

  ১২২ 

  ডেপুটি স্পিকার নিহত হওয়ার পরবর্তী দু’সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিস্থিতিও জটিল হয়ে উঠেছিল। “সেই সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার আসনবন্টন (‘পাের্টফোলিও ) নিয়ে ফিরােজ খান নুনের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের মতবিরােধ হয়েছিল। ১৯৫৮ সালের ২রা অক্টোবর আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরা ফিরােজ খান নুনের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ঐ অবস্থার সুযােগ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জা ‘দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বিশৃঙ্খলা প্রতিরােধের অজুহাত দেখিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর (প্রকৃতপক্ষে ৮ই অক্টোবর) দেশে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন” (২০/১৭৩)। পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ খ্রি.। তবে মির্জা এবং সহযােগীরা ঠিকই বুঝতে পারছিলেন, জাতীয় নির্বাচনে, বিশেষত পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের প্রবল প্রধান্য কমানাে যাবে না বরং বৃদ্ধি পেতে পারে। সুতরাং তাদের দিক থেকে নির্বাচন বন্ধ করাই জরুরি ছিল। পূর্ব বাংলায় ডেপুটি স্পিকারের হত্যাকাণ্ডের পর দরকার হলাে কেন্দ্রেও একটা অজুহাত তৈরি করা। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জা “সরল-সােজা আয়েশী প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ নুনকে দিয়া বলাইলেন, আওয়ামীদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ঢুকিতে হইবে। দায়িত্ব বহন করিতে হইবে”। আবুল মনসুর আহমদ আরাে লিখেছেন, “এসব কথায় আওয়ামী লীগনেতাদের কান না দেওয়া উচিত ছিল।  আওয়ামী লীগ মন্ত্রিত্বে অংশ না নিয়াই নুন-মন্ত্রিসভার সমর্থন দিবে এই চুক্তি হইয়াছিল। এই ত্যাগের বদলা, যুক্ত-নির্বাচন প্রথায় আগামী সনের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হইয়াছে। আতাউর রহমান, মানিক মিয়া ও আমি বিরােধিতা করিলাম। যতদূর জানি লিডারও (সােহরাওয়ার্দী) এসময় মন্ত্রিত্বে যাওয়ার বিরােধী ছিলেন। মুজিবুর রহমানও আমার সাথে একমত ছিলেন। কিন্তু কেন জানি না,..মুজিবুর রহমান আমাদের কাউকে না জানাইয়া কয়েকজন হবু মন্ত্রী লইয়া হঠাৎ করাচি চলিয়া গেলেন। মন্ত্রিত্বের শপথ নিলেন। ভাল পাের্টফলিও পাওয়া গেল না বলিয়া চার-পাঁচ দিন পরে পদত্যাগ করিলেন। সেই রাত্রেই মার্শাল ল। প্ল্যানটা ছিল সুস্পষ্ট” (৪/৫৫৯-৫৬০)। 

 সম্পূর্ণ ভিন্ন বিবরণ মেলে এস.এ. করিমের লেখায় : “Chief Minister Ataur Rahman was also of the view that Awami League should also be there Suhrawardy was in quandary. But with elections only a few months away he thought it would be better for some Awami Leaguers to join the Noon Cabinet to prop it up against Mirza s manifest desire to bring it down. So, Suhrawardy directed Mujib to come to Karachi 

  ১২৩ 

  urgently to discuss Awami League participation in the Noon Ministry and election matters. Mujib arrived in Karachi with six Awami League aspirants  Chief Minister Ataur Rahman Khan and Manik Mian joined them the next day” (১৭/৯২)। দু টি উদ্ধৃতির তথ্য-সত্যের প্রকট ফারাক নজর এড়াবার নয়। তবে এবিষয়ে বিতর্কে না গিয়েও বলা চলে, ইস্কান্দর মির্জা কুশলী পরিকল্পনায় পূর্ব বাংলায় এবং কেন্দ্রে গণতান্ত্রিক শাসন অবসানের ‘অজুহাত সৃষ্টি করেছিলেন। পূর্ব বাংলায় ডেপুটি স্পিকার নিহত হওয়ার দু’সপ্তাহ পরেই ৭ অক্টোবর, ১৯৫৮ খ্রি. অর্থাৎ নুন-মন্ত্রিসভা থেকে আওয়ামী লীগ সদস্যদের পদত্যাগের দিনই রাত সােয়া দু টায় (৮ অক্টোবর) পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। 

  ১২৪ 

  পাকিস্তানে সামরিক স্বৈরশাসন : 

 দমন-পীড়নের প্রধান টার্গেট’ মুজিব 

  “১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জা  পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র বাতিল ঘােষণা করে দেশে মার্শাল ল জারি করেছেন।  এজন্যই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। এর শেষ কোথায়। ঢাকার জনসাধারণের মধ্যে কোনাে চাঞ্চল্য দেখলাম না। নেতারাও কেউ এর সঙ্গে যুক্ত আছেন কিনা কে জানে, শহীদ সােহরাওয়ার্দী, কাইয়ুম খান, ফিরােজ খান নুন সব কোথায়। মুজিব ! কি কোনাে কথা নেই-ত তাদের মুখে। মওলানা ভাসানী সম্ভবত হাসপাতালে চিকিৎসারত। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া ১২ই অক্টোবর তারিখের সম্পাদকীয় নিবন্ধে সামরিক শাসন সমর্থন করেছিলেন। আতাউর রহমান খান করাচিতে ইস্কান্দার মির্জার সাথে দেখা করেছেন কাল (১২ অক্টোবর, ১৯৫৮), কেন, কি কথা হলাে?” (৮/৩২৯-৩৩২)। 

 সাত অক্টোবর রাতে করাচি থেকে যাত্রা করে ৮ অক্টোবর সকালে ঢাকায় নেমেই শেখ মুজিব সামরিক শাসন জারির কথা জেনেছিলেন। স্বভাবতই তিনি আশঙ্কা করলেন, তাকে আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারাগারে যেতে হবে। তাই তিনি পিতামাতার সাথে সাক্ষাতের জন্য অবিলম্বে গােপালগঞ্জে রওনা হয়ে যান। ১২ অক্টোবর তারিখে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবকে গােপালগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ এবং আব্দুল খালেককে আলাদা আলাদাভাবে নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দি রাখা হয়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আব্দুল হামিদ চৌধুরী, কোরবান আলী এবং নুরুদ্দিন আহমদও এসময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন” (১৯/১০৫)। সামরিক আইন প্রশাসক (এবং প্রধানমন্ত্রীও) আয়ুব খান ঢাকায় এসে ২২ অক্টোবর। বিকালে স্টেডিয়াম মাঠে জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। আইয়ুব খান প্রেস কনফারেন্সও করেন। মওলানা ভাসানী সম্বন্ধে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে 

  ১২৫ 

  গিয়ে আয়ুব খান বলেন, যদি তিনি কোন অপরাধ করে থাকেন তবে প্রাদেশিক সরকার তার বিচার করবে। ব্যাপার কি ! ভাসানী সম্বন্ধে কি তার ধারণা তাহলে ভালাে? ..আশ্চর্যের বিষয়, ২৭শে অক্টোবর তারিখে রাত্রে এক জায়গায় কয়েকজন নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগারের সঙ্গে দেখা হয়। ১৯৭০-৭১ সালেও তাদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগার ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তাদের গৌরবজনক ভূমিকা ছিল। সেদিন রাতে তারা মার্শাল ল’র জন্যে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতৃত্বকেই দায়ী করেছিলেন। হয়তাে সেটি ছিল আত্মসমালােচনা (৮/৩৩৪-৩৩৫)। 

 যুক্তফন্ট মন্ত্রিত্বকালীন সময়ের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযােগ এনে মুজিবের বিরুদ্ধে এসময় ৮টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর মধ্যে সাতটি মামলায় তিনি নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছিলেন। কিন্তু স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সংক্রান্ত একটি মামলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত তাকে দু বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার শাস্তি প্রদান (সেপ্টেম্বর, ১৯৬০) করে। এ-সংক্রান্ত আপিল মামলায় হাইকোর্টে শেখ মুজিবের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। জুন, ১৯৬১ মামলাটিতে জেলা-কোর্টের রায় খারিজ হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, এর আগেই সাতটি মামলায় নিরপরাধ প্রমাণিত হয়ে ডিসেম্বর, ১৯৫৮ মুজিব কারামুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে গােয়েন্দা এবং পুলিশের নিবিড় নজরদারিতে রেখে ঢাকার বাইরে যাবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হয়েছিল। 

 “Mujib could have secured his release earlier had he agreed to sign a bond renouncing political activity as a number of detainees had done, but politics was in his blood and he had no intention of giving it up” (১৭/৯৭)। সেনা-শাসনের শুরুতেই শেখ মুজিব ছাড়াও মামলা হয়েছিল অনেক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধেও। আবুল মনসুর আহমদের ক্ষুব্ধ মন্তব্য : “আমরা আসামিরা সবাই আওয়ামী লীগার। আওয়ামী লীগাররাই দুর্নীতিবাজ এটা দেখানােই এই সব কেসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। শেষ পর্যন্ত আদালতের বিচারে কারাে বিরুদ্ধেই কোনাে মামলা টিকে নাই। কথায় বলে, ভালরূপ কাদা ছুড়িতে পারিলে, কাদা গেলেও দাগ থাকে” (৪/৫৭২)। এক্ষত্রে পাকিস্তানি সেনা-আমলা চক্র সাময়িক সফলতাও পেয়েছিল। সেনা-শাসন জারি করে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা প্রধান সেনাপতি আয়ুব খানকে বানিয়েছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রধানমন্ত্রীও। এই আয়ুব খানই মাত্র ২০দিনের মাথায় ২৭ অক্টোবর মধ্য রাতে তিনজন জেনারেলকে পাঠিয়ে অস্ত্রের মুখে ইস্কান্দার মির্জাকে পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। এক্ষেত্রে আইয়ুবের মূল সহায়ক ছিলেন আজম খান এবং পরামর্শদাতা ইয়াহিয়া খান। ২৭ 

  ১২৬ 

  অক্টোবর প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খান নিজেকেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘােষণা করে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করেছিলেন। মির্জার মন্ত্রিসভার সকল সদস্যকে বহাল রেখেই তিনজন নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে আইয়ুবের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। তবে আইয়ুবের মন্ত্রিসভায় কোনাে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। 

 আইয়ুব খান পূর্ব বাংলায় একে একে গভর্নর বানিয়েছিলেন জেনারেল আজম খান(জুন, ১৯৬০), অতঃপর পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা গােলাম ফারুক (মে, ১৯৬২) এবং সবশেষে (অক্টোবর, ১৯৬২) ময়মনসিংহের উকিল আব্দুল মােনায়েম খানকে। “Monem Khan s principal characteristick was his unabashed servility toward Ayub Khan  In spite of black marks on his records, or perhaps because of them, he was considered a suitable Governor for East Pakistan” (১৭/১০৫)। পূর্ব বাংলায় তদানীন্তন সময়টা মূলত ‘আইয়ুব-মােনায়েম আমল’ পরিচয়েই কুখ্যাত হয়ে আছে। গভর্নর মােনায়েম খান চরম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন শেখ মুজিবকে “In him (Mujib) Monem Khan saw his principal political antagonist in East Pakistan. Mujib could not be tempted by inducements of office or material rewards to give up his opposition to the Ayub rgime (১৭/১০৬)। মােনায়েম ভেবেছিলেন, প্রচণ্ড ভয় দেখিয়েই মুজিবকে সামলাতে হবে। ১৯৬০-দশকের মধ্যভাগ থেকে শেখ মুজিব সামরিক শাসন-বিরােধী কর্মকাণ্ড জোরদার করায় মােনায়েমও তাঁকে সম্ভাব্য সকল প্রকার অত্যাচার-অপমানের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিলেন। 

  ১২৭ 

  সহযােগী শক্তির সন্ধান শেখ মুজিব : 

 নতুন রাজনৈতিক চিন্তা  স্বাধীন বাংলাদেশ  

  ১৯৬১ সালের জুন মাসে কারামুক্তির পর থেকেই শেখ মুজিব পাঞ্জাব-প্রভাবিত পাকিস্তান এবং সেনা-শাসক আইয়ুবের গণতন্ত্রের কথাবার্তা সম্পর্কে আস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকেন। “He felt that the situation cried out for a radical approach. For the first time in his life he began to entertain seriously the thought of secession from Pakistan and the establishment of an independent government in East Pakistan  So he needed like-minded allies outside his party to advance toward his objective. He decided to sound out the Communists to find out whether they were inclined to his way of thinking” (17/97)। এক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তার সমর্থন-সহায়তার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টির কথাই ভেবেছিলেন। কিন্তু কেন? 

 শেখ মুজিব জানতেন, বিভাগ-পূর্বকালে কম্যুনিস্ট পার্টিই ছিল একমাত্র সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল, যারা মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে সবার আগেই তাদের মােহভঙ্গ ঘটেছিল। ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তানের শুরুতেও সরকারি রােষের কারণে ‘আন্ডার গ্রাউন্ড দল পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকায়, দল হিসেবে ছােটোবড় যা-ই হােক না কেন, জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষত, পল্লী-অঞ্চলে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রসারিত গণ-ভিত্তি ছিল। শেখ মুজিব রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই শহর-গ্রামের ব্যাপক জনগােষ্ঠীর সাথে সংযােগ প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষায় অভ্যস্ত ছিলেন বলে কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক ভিত্তি, এবং তৎপরতার বিষয়গুলি ভালােভাবেই অবহিত ছিলেন। ভাষাআন্দোলনে ‘গােপন ক্যুনিস্ট পার্টির প্রভূত অবদান ছিল। আওয়ামী লীগ  নামে সংগঠিত ধর্ম-নিরপেক্ষ দল হিসেবে সকলের জন্যই সদস্য পদ উন্মুক্ত করে দেবার পর থেকে নানাভাবেই আওয়ামী লীগ এবং ক্যুনিস্ট পার্টির যােগাযােগও বৃদ্ধি পেয়েছিল। সর্বশেষ, কেএসপি-ন্যাপ সদস্যদের সম্মিলিত অনাস্থা ভােটে আওয়ামী 

  ১২৮ 

  লীগ মন্ত্রিসভার পতনের (১৯৫৭) পরে সংসদে আওয়ামী লীগের পক্ষে কম্যুনিস্ট সদস্যদের ভােট দেবার সিদ্ধান্ত নেয়াতে দু’দিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা পুনর্বহাল হয়েছিল। 

 অপরদিকে, কম্যুনিস্ট পার্টির পর্যবেক্ষণ ছিল : “সামরিক শাসনাধীনে ব্যক্তিস্বাধীনতা পদদলিত হয়ে যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের ভিতর স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে। বিক্ষোভ জমে উঠেছিল। সামরিক শাসন জারির পর সাধারণ মানুষের মনে যে মােহ দেখা গিয়েছিল, সে মােহ ক্রমে ক্রমে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। ক্যুনিস্ট পার্টি এটাও উপলব্ধি করেছিল যে, বাস্তব অবস্থা আন্দোলনের অনুকূল হলেও পার্টির একার প্রচেষ্টায় তখন কোন আন্দোলন গড়ে তােলা সম্ভব ছিল না। আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টিসহ পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের ঐক্য, অন্তত আওয়ামী লীগ ও ক্যুনিস্ট পার্টির ভিতর ঐক্য বা সমঝােতা একান্ত প্রয়ােজন ছিল” (২০/১৮১)। সব মিলিয়ে কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতি শেখ মুজিবের আগ্রহ এবং পার্টির দিক থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা-মনােযােগ ইত্যাদি কারণেই উভয়পক্ষের যােগাযােগ প্রতিষ্ঠার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই চার-পাঁচটি গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 

 ১৯৬১ সালের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত “সে সব বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও মানিক মিয়া। কম্যুনিস্ট পার্টির পক্ষে উপস্থিত ছিলাম মণি সিংহ ও আমি। প্রতিক্রিয়াশীল আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন গড়ে তােলা একান্ত দরকার আমরা প্রথম বৈঠকেই একমত হয়েছিলাম। আন্দোলনের দাবি কি হবে, এবং আন্দোলন কিভাবে শুরু হবে, সে সম্পর্কে পরবর্তী ৩/৪টি বৈঠকে আলােচনার সময় শেখ মুজিবুর রহমান বারবার বলছিলেন যে, পাঞ্জাবের ‘বিগ বিজনেস’ যে ভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল তাতে ‘ওদের সাথে আমাদের থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; তখন আমরা শেখ মুজিবকে বুঝিয়েছিলাম যে, কমুনিস্ট পার্টি নীতিগতভাবে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি সমর্থন। করে, কিন্তু সে দাবি নিয়ে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পরিস্থিতি তখনও ছিল না। মুজিব আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘ভাই এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। কিন্তু আমার কথাটা থাকলাে। বঙ্গবন্ধু ১৯৬১ সাল থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিলেন” (২০/১৮২-১৮৩)। 

 পরবর্তী সময়ের সংবাদ’-সম্পাদক বজলুর রহমান উক্ত ‘সিরিজ’ সংলাপের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় লিখেছেন, “শেখ মুজিব তখনাে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের মুখ্য সংগঠক, বলতে গেলে প্রাণপুরুষ। শহীদ সােহরাওয়ার্দী তখনাে 

  ১২৯ 

  আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা। শেখ মুজিব তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, মানতেন; তার কথা ছিল তখনাে আওয়ামী রাজনীতির শেষ কথা। তবু তরুণ প্রজন্মের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ছিল লক্ষণীয়। সােহরাওয়ার্দী সাহেব তখনাে ছিলেন সারা পাকিস্তানভিত্তিক আন্দোলনের মারফত ‘গণতান্ত্রিক পাকিস্তানের চিন্তায় মােহাবিষ্ট। শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু তখনই বুঝে নিয়েছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই এবং সে লক্ষ্যকে সামনে রেখেই রাজনীতির ধারা ঠিক করতে হবে। তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া ছিলেন দুয়ের মাঝামাঝি। সােহরাওয়ার্দী সাহেবের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও আনুগত্য ছিল নিঃশর্ত ও প্রশ্নহীন; কিন্তু গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য বাঙালির সংগ্রামকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার পথেই যেতে হবে, এ কথা শেখ মুজিবের মত তিনিও মনে করতেন” (১(৩)/১২৭৪- ১২৭৫)। 

 কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে আলােচনায় শেখ মুজিব আস্থার সাথেই উপলব্ধি করেছিলেন, নতুন রাজনৈতিক চিন্তায় তিনি নিঃসঙ্গ নন এবং আন্দোলন শুরু করলে একটি নির্ভরযােগ্য রাজনৈতিক শক্তির সহযােগিতা নিশ্চিতই পাওয়া যাবে। উভয় পক্ষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে “১৯৬২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের ছাত্রদের ভিতর থেকে আন্দোলন শুরু করার জন্য চেষ্টা করার সিদ্ধান্তও হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির ভিতর ঐ সমঝােতার কথা সারা প্রদেশে ঐ দুটি দলের কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল” (২০/১৮৩)। “There were at this time two main student bodies at loggerheads with each other : the Students League which supported the Awami League and the Students Union, a left-wing organization. Both sides agreed to do their best to end the bickering between them to ensure the successful agitation  (১৭/১০০)। ২১ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২ থেকে ছাত্র আন্দোলনের জন্য সক্রিয় ঐক্যের ভিত্তিতে প্রস্তুতি শুরু করা হলেও জানুয়ারি মাসেই সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করায় সমগ্র পরিস্থিতি পাল্টে যায়। 

  ১৩০ 

  সােহরাওয়ার্দী গ্রেফতার : 

 পূর্ব বাংলায় প্রবল ছাত্র-গণঅন্দোলন 

  আইয়ুবের ‘মৌলিক-গণতন্ত্রী সংবিধান’ জারির সময় যতই এগিয়ে আসছিল, সােহরাওয়ার্দী ততই ১৯৫৬ খ্রি. সংবিধান পুনর্বহালের মাধ্যমে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রবর্তনের লক্ষ্যে জোরেশােরে প্রস্তুতি শুরু করছিলেন। তাঁর জানা ছিল, আইয়ুববিরােধী বিক্ষোভের সম্ভাবনা পূর্ব বাংলাতেই বেশি, কারণ, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এখানকার জনগণই সমধিক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনের বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই এবং পথ-পদ্ধতি নির্ধারণের জন্যই সােহরাওয়ার্দী ১৯৬২ র। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ঢাকায় এসেছিলেন। ২৪ জানুয়ারি তারিখে আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়া, হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, আবু হােসেন সরকার প্রমুখ বিভিন্ন দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সােহরাওয়ার্দী এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। “They agreed to submerge their political differences and work for a common goal : the restoration of 1956 constitution. They all agreed to intensify their opposition to the Ayub Constitution expected to be promulgated soon” (১৭/১০৩)। ঢাকা থেকে করাচিতে ফেরার পরই, সােহরাওয়ার্দীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে ২৯ জানুয়ারি (মতান্তরে ৩০ জানুয়ারি) গ্রেফতার করা হয়। তিন-চারদিন পরেই ২ জানুয়ারি ঢাকাতে গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ। নেতৃবৃন্দকে। আওয়ামী লীগ-কম্যুনিস্ট পার্টির পূর্বোল্লিখিত গােপন সংলাপসমঝােতায় ছাত্র আন্দোলন শুরুর নির্ধারিত তারিখ ছিল ১৯৬২ র ২১ফেব্রুয়ারি কিন্তু সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের খবরে সেটি শুরু হয়ে গিয়েছিল ৩১ জানুয়ারি তারিখেই, সেদিনই ঢাকায় এসেছিলেন আইয়ুব খান। 

 “বিশ্ববিদ্যালয়ে কতকটা আপনা-আপনি ধর্মঘট হয়ে গেল। জগন্নাথ কলেজ, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদিতে ষােলআনা ধর্মঘট হয়েছে। ভাল লক্ষণ নয় বলে মনে 

  ১৩১ 

  হয়। আইয়ুব খাঁর মুখমণ্ডলে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট দেখেছি তাকে অভ্যর্থনা বা দর্শন করার জন্যেও পূর্বের মত লােকজন কোথাও জমায়েত হয়নি”(৮/৩৫৯)। প্রেস সেন্সরশিপ থাকায় ধর্মঘটের কোনাে খবর ১ ফেব্রুয়ারির পত্রিকায় প্রকাশ করা যায়নি। ছাত্রেরা সেদিন ঢাকায় পত্রিকা পুড়িয়েছিল। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছিল যে, পাকিস্তান সপ্তাহ উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ‘ডি-লিট ডিগ্রি গ্রহণের জন্য আইয়ুবের রাজশাহী যাওয়ার পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচিও। বাতিল করতে হয়েছিল। আইয়ুবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কাছে প্রশ্নোত্তর বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছাত্রদের প্রশ্নগুলি পত্রিকায় প্রকাশের নিশ্চয়তা দিতে না পারায় বক্তৃতা না করেই চরম অপমানিত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। ৮ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান করাচি ফিরে গেলেন। 

 আনুষ্ঠানিকভাবে আইয়ুব প্রণীত শাসনতন্ত্র জারি করা হয় ১ মার্চ, ১৯৬২। শাসনতন্ত্র জারির আগে থেকেই করাচিতে বন্দি ছিলেন সােহরাওয়ার্দী আর পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এমন পরিস্থিতিতেই ১৬ই এপ্রিল থেকে ছাত্ররা তিনদিনের ছাত্র-ধর্মঘট ঘােষণা দিয়ে প্রথমবারের মত স্লোগান তুলেছিল আইয়ুবের রক্ত চাই । ১৭ই এপ্রিল থেকে কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিল। “২১শে এপ্রিলের সংবাদপত্রে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিটি জেলখানা হতে প্রেরণ করা হয়েছিল। এটি ছিল তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সরকারি অভিযােগের জবাব। সরকারি অভিযােগ যে কত দুর্বল ও হাস্যকর তার প্রমাণ জবাবে ছিল। পূর্বে যারা পাকিস্তানের বন্ধু ছিল শহীদ সােহরাওয়ার্দী নাকি সে-সব রাষ্ট্রকে শক্ত করে তুলেছেন”(৮/৩৬৪)। 

 ২৭ এপ্রিল, ১৯৬২ ঢাকায় শেরে বাংলা ফজলুল হকের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে শােকাহত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জেলের ভিতরেই, কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সপ্তাহাধিক কাল কালাে-ব্যাজ ধারণ করেছিলেন। “আমাদের সাথে অন্যান্য ওয়ার্ডের রাজবন্দিরা সাধারণ বন্দিরাও কালাে ব্যাজ পরিলেন” (৪/৫৭৮)। ২৮এপ্রিল পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত শেরে বাংলার জানাজায় “দুই লাখের বেশি লােক সমবেত হয়েছিলেন। গভর্নর আজম খান জানাজাতে শামিল হয়েছিলেন। এত বড় জনসমুদ্র আমার জীবনে আমি আর কখনও দেখিনি। তিনি বাংলার লােকের আসল চরিত্র জানতেন এবং সকল প্রকার স্ববিরােধিতা সত্ত্বেও ফজলুল হকের সত্যিকার রূপটিও সম্ভবত বাংলার লােক জানতাে   এবং ভালােবাসতাে”(৮/৩৬৪-৩৬৫)। 

 “আইয়ুব খানের সংবিধান ঘােষিত (১ মার্চ, ১৯৬২) হওয়ার পরে এপ্রিল মাসে বুনিয়াদী: গণতন্ত্রীদের ভােটে জাতীয় পরিষদ ও মে মাসে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের 

  ১৩২ 

  প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের এক প্রহসন করা হয়েছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তি ঐসব নির্বাচন বয়কট করেছিল। ১৯৬২ সালের ৮ই জুন রাওয়ালপিন্ডিতে তথাকথিত জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল। সেই দিন থেকেই দেশ থেকে সামরিক আইন উঠে গিয়েছিল”(২০/১৮৫১৮৬)। পূর্ব পাকিস্তানের ৯জন নেতা আইয়ুবের জারিকৃত সংবিধানকে “অগ্রহণযােগ্য আখ্যায়িত করে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এই বিবৃতিতে সার্বজনীন। ভােটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠনের দাবি জানানাে হয়। কারামুক্তির পর শহীদ সােহরাওয়ার্দী ৯ নেতার বিবৃতির সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেন”(২১/৩১-৩২)। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুসারে নয় নেতা’র মধ্যে মওলানা ভাসানী, মওলানা তর্কবাগীশ, আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান, মাহমুদ আলী, নুরুল আমিন এবং আবু হােসেন সরকার প্রমুখের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৯৬২ সালের ৮ই জুলাই তারিখে প্রায় সাড়ে তিন বছর (সামরিক শাসন জারির) পরে পুরানা পল্টন মাঠে পুনরায় এক বিরাট জনসভা হয়। পরদিন সংবাদপত্রের রিপাের্টে জনসংখ্যার পরিমাণ দু’লাখ বলা হয়। এ জনসভার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল, একই রঙ্গমঞ্চে .মুসলিম লীগের নুরুল আমিন সভাপতি, বক্তা আবু হােসেন সরকার (কেএসপি), আতাউর রহমান, মুজিবুর রহমান (আওয়ামী লীগ), মাহমুদ আলী (ন্যাপ) প্রমুখ। সকলেরই দাবি বর্তমানConstitution বদলাও, রাজবন্দিদের ছাড়াে   ইত্যাদি” (৮/৩৬৬-৩৬৭)। 

 ছাত্রসমাজের স্বার্থবিরােধী দু’টি সরকারি উদ্যোগ সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্র আন্দোলনকে তুঙ্গস্পর্শী করে তুলেছিল। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ আগে থেকেই সেনা-শাসকের নিয়ােজিত ‘বিচারপতি হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন’এর রিপাের্টটির তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছিল, কিন্তু সরকার অর্ডিন্যান্স দ্বারা রিপাের্টটি দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং প্রায় একই সময়ে আরেকটি সরকারি হুকুমে ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। সােহরাওয়ার্দী এক বিবৃতিতে প্রস্তাব করেছিলেন, সমগ্র বিষয়টি জাতীয় সংসদে আলােচনা করা হােক। কিন্তু তাঁর নরম কথা’য় সরকার কর্ণপাত করেনি। উল্লেখ্য যে, ছ মাসের অধিক কারাবন্দি রাখার পর, পূর্ব বাংলার “ছাত্রজনতার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৬২ সালের ১৯শে আগস্ট শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। ৮ই সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা আগমন করেন। বিমানবন্দরে লাখ লাখ লােকের সমাগম হয়” (২১/৩২)। 

 ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২ “ঢাকাতে সেনাবাহিনী মােতায়েন সত্ত্বেও ছাত্রজনতার বিশাল শােভাযাত্রায় টঙ্গী, তেজগাঁ ও ডেমরা অঞ্চলের বহু শ্রমিক যােগদান 

  ১৩৩ 

  করেছিলেন। টঙ্গীতে এক শ্রমিক মিছিলের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণে সুন্দর আলী নামে একজন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন।  ৬২ সালের ঐ ছাত্র আন্দোলন সামরিক শাসন সম্পর্কে জনগণের ভয়ভীতি ভেঙ্গে দিয়ে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনের দরজা খুলে দিয়েছিল। ইহাই ছিল  ৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের বিশেষ তাৎপর্য” (২১/১৮৪-১৮৫)। বাষট্টির শিক্ষা কমিশন বিরােধী “হরতাল চলাকালীন পুলিশের গুলিতে তিনজন ছাত্র শহীদ হন। ২৯শে সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে এক জনসভায় তৎকালীন সময়ে বাঙালি জাতির কণ্ঠস্বর  বলে অভিহিত আওয়ামী লীগের কর্ণধার শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন”(১৯/১১৫)। 

 “শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশব্যাপী ঝটিকা সফরের মাধ্যমে সামরিক শাসন বিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলেন। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট(National Democratic Front-NDF) গঠিত হয়” (৮/৩২)। আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনের প্লাটফর্ম হিসেবে ‘এনডিএফ’ গঠনের পর সােহরাওয়ার্দী করাচি ফিরে গেলেন। কিছুদিন আগের কারাবন্দিত্ব তাঁর দারুণ স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়েছিল। ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি পরপর দু বার হৃদরােগে আক্রান্ত হলেন। এ সময়েই আইয়ুব খান মুসলিম লীগের একাংশের সহযােগিতায় নিজস্ব কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠনের ব্যবস্থা পাকা করে, সকল রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবনের সুযােগ সৃষ্টি করলেন। আইয়ুব খানের ‘রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবন’এর ঘােষণায় বাস্তব পরিস্থিতি সােহরাওয়ার্দীর জন্য যথার্থই ব্রিতকর হয়ে পড়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবনে তিনি বাধা দিতে পারছিলেন না, আবার পূর্ব পাকিস্তানে এনডিএফ ভেঙ্গে যাক বা দুর্বল হয়ে পড়ক, এটাও মানতে পারছিলেন না। অপরদিকে, শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাকর্মীরা দলের পুনরুজ্জীবনে একান্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তখন সােহরাওয়ার্দীর স্বাস্থ্যের মারাত্মক অবনতি ঘটায় চিকিৎসার জন্য বৈরুত হয়ে লন্ডনে চলে গেলেন। তার অনুপস্থিতিতে নানা মত-পথের নেতাদের ‘এনডিএফ’ ক্রমশই উদ্যমহীন এবং দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সংগঠনটিকে সুসংগঠিত করার মত ব্যক্তিত্ব এবং রাজনৈতিক দক্ষতা নুরুল আমিনের ছিল না। অপরদিকে মওলানা ভাসানী এনডিএফ’এর অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও সংগঠনটিকে জোরদার করার বদলে প্রকাশ্যেই নাথিং ডুয়িং ফ্রন্ট’ বলে পরিহাস করতেন। ততদিনে তার সাথে আইয়ুবের ‘চীন-কেন্দ্রিক যােগাযােগ শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারে সােহরাওয়ার্দীর সাথে আলােচনার জন্য। 

  ১৩৪ 

  ১৯৬৩’র আগস্ট মাসে শেখ মুজিব লন্ডনে গেলেন। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী বললেন, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের এনডিএফ-নেতৃবৃন্দকে কথা দিয়েছেন, তাঁদের সাথে আলােচনা না করে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত করা হবে না। সুতরাং মুজিবকে ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসতে হলাে। কিছুদিন পরেই, দল পুনর্গঠনে একান্ত আগ্রহী নেতাকর্মীরা শেখ মুজিবকে অনুরােধ করেছিলেন, তিনি যেন আবার লন্ডনে গিয়ে নেতার সম্মতি অর্জনের চেষ্টা করেন। তবে তার আগেই, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৩ বৈরুতের হােটেলে রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৪ খ্রি. জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তার পাকিস্তানে ফেরা নির্ধারিত ছিল। “The timing and circumstances of Suhrawardy s death left no doubt in Mujib s mind that his leader s death was not natural. Who would benefit from his death? Only Ayub Khan. Mujib was therefore convinced that it was another case of political murder  engineered by the Ayub regime.” (১৭/১১৫)। 

  ১৩৫ 

  আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন : 

 অভ্যন্তরীণ মতভেদ সত্ত্বেও বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত 

  শেরে বাংলা ফজলুল হকের মৃত্যু এপ্রিল ১৯৬২, আর সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয় ১৯৬৩’র ডিসেম্বরে। “সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই দুই প্রবীণ নেতার মৃত্যুতে (পূর্ব বাংলার) রাজনৈতিক অঙ্গনে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিব হয়ত-বা কিছুটা নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব অনুভব করেন। উপলব্ধি করেন যে, বাঙালির স্বার্থরক্ষা এবং অধিকার আদায়ের কঠিন সংগ্রামে এখন থেকে তাঁকেই আরাে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে এবং তিনিই হবেন পশ্চিমা শাসকদের প্রধান শত্রু   মূল টার্গেট। দলকে সুসংগঠিত করতে হবে আগামী দিনের কঠিন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য” (১(১)/১৩৭) “He (Mujib) had to overcome the objections of old-time senior leaders of the party who argued that Suhrawardy s wishes (about NDF) should not be disregarded so soon But Mujib had his support among the young party workers, Like Mujib, they wanted the struggle for the rights of Bengalis in various spheres to be continued simultaneously with the campaign for the restoration of democracy” (১৭/১১৭)। 

 বাংলার রাজনীতির চালচিত্রে অতঃপর সার্বক্ষণিক এবং প্রধানতম ভূমিকা বঙ্গবন্ধু মুজিবের। মওলানা ভাসানী তখনাে সক্রিয় রাজনীতিবিদ, কিন্তু তাঁর কর্মকাণ্ডে অব্যাহত ধারাবাহিকতা ছিল না। মওলানা কখনাে রাজনীতির ময়দানে সােচ্চারসংগ্রামী কখনােবা নীরব-নিষ্ক্রিয় দূরবাসী। সাধারণভাবে জনমনে ভাসানীর প্রতি যতটা বিপুল সম্মান-শ্রদ্ধা ছিল, রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি কখনাে ততটা সুস্থির-সক্রিয় ছিলেন না। রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং করণীয় নির্ধারণ সম্পর্কে প্রবল বৈপরীত্ব এবং দোদুল্যমানতা ছিল তাঁর। সুতরাং ঐতিহাসিক অনিবার্যতার কারণেই আমাদের চলমান আলােচনার পরবর্তী সময়-খণ্ডের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে মুজিব প্রায় আক্ষরিক অর্থেই স্থির-লক্ষ্য এবং উজ্জ্বলতম একক ব্যক্তিত্ব, সেখানে ভাসানী যেন ঘটনাপ্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন এক অনিশ্চিত-অস্থির রাজনৈতিক চরিত্র। 

  ১৩৬ 

  ১৯৬৪সালে রাজনৈতিক আন্দোলন, বিশেষত গণতন্ত্রের আন্দোলনকে ব্যর্থ করার লক্ষ্যে আইয়ুব-মােনায়েম চক্র পেশাদার অবাঙালি খুনিদের দিয়ে পূর্ব বাংলায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করলে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করেন। ১৬ই জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও শীর্ষক দাঙ্গা-বিরােধী প্রচারপত্র বিলি করা হয়। এই অভিযােগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদকে গ্রেফতার করলেও পরে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। উক্ত প্রচারপত্রের মূল বক্তব্য ছিল : “পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনের উপর এই পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমি পূর্ব বাংলার সকল মানুষকে আহ্বান জানাইতেছি। প্রতি মহল্লায় দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করুন। খাদেম শেখ মুজিবুর রহমান”(১৯/১১৮)। দৈনিক ইত্তেফাক প্রথম পৃষ্ঠায় বিশাল হরফে লিখেছিল : “দিকে দিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস”। সরকারি চক্রান্তের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে “ঢাকার সমস্ত জাতীয় দৈনিক বাঙালি রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরােনামে একযােগে যে সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল, তার ফলে বাঙালি জনগণের ভিতর দাঙ্গার বিরুদ্ধে এক মনােভাব জেগে উঠেছিল। ফলে দাঙ্গা ছড়াতে পারেনি” (২১/১৮৭)। 

 পূর্ব বাংলায় দাঙ্গা প্রশমনের পর, ২৫ জানুয়ারি, ১৯৬৪ মওলানা তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ সভায় আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সম্পাদকবৃন্দ এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সভায় মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন